পাগলাটে এক বিলিয়নিয়ার
লায়লা আরজুমান্দ | ২০ জুন, ২০১৯ ০০:০০
রিচার্ড ব্রানসনকে বলা হয় ব্রিটিশ ব্যবসার মোগল। দুনিয়াজুড়ে তার পরিচিতি হলো ‘দ্য রেবেল বিলিয়নিয়ার’ নামে। তার মালিকানায় আছে চার শতাধিক কোম্পানি। কী নেই তার ব্যবসায়! কোমল পানীয় থেকে শুরু করে আকাশে ডানা মেলা উড়োজাহাজ; মহাকাশে ভ্রমণ সবই আছে তার ব্যবসার মধ্যে। অথচ তিনি স্কুলের গন্ডিই পেরোতে পারেননি। তার ব্যবসার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে আনন্দ ও মজা। রোমাঞ্চপ্রিয় এই মানুষটি কাইটবোর্ডে করে যেমন পাড়ি দিয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল তেমনি গ্যাস বেলুনে ভ্রমণ করে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। তার জীবনের নানা গল্প নিয়ে লিখেছেন লায়লা আরজুমান্দ
প্রেমের কারণে স্কুলছাড়া
ছেলেটা পড়াশুনায় ছিল অমনোযোগী, তার ওপর প্রেম করত স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে। একদিন ধরাও পড়ে গেল। ব্যস আর যায় কোথায়! রাগী মাস্টার মশাই তাকে দিলেন স্কুল থেকে বহিষ্কার করে। তাছাড়া পড়াশুনা করতে ভালো লাগত না তাই সেই ঘটনার পর আর স্কুলের পথে পা মাড়াননি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে শেষ করেন শিক্ষাজীবন।
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো বহিষ্কারের পর লিখেছিলেন সুইসাইড নোটও। তবে মজার ব্যাপার হলো...যতদিনে সুইসাইড নোটটা পাওয়া গেছে, ততদিনে তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছেন সেই সুইসাইড নোটের কথা। হেডমাস্টার আবার বলেছিলেন এই দস্যি ছেলে হয় জেলে যাবে না হয় কোটিপতি হবে। কিন্তু সেই ভবিষদ্বাণী যে দুটোই ফলে যাবে কিশোর রিচার্ড ব্রানসনের ভাগ্যে, এই ব্যাপারটা হয়তো অজানাই ছিল সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের।
দ্য স্টুডেন্টস
স্কুল ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনি ১৬ বছর বয়সে ‘স্টুডেন্ট’ নামে একটা ম্যাগাজিন বের করেছিলেন। যেটা স্কুলের ছাত্র ও তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করবে। পত্রিকাতে মিক জ্যাগার আর আরডি লাইংসহ ষাটের দশকের বহু জনপ্রিয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন তিনি। ‘দ্য স্টুডেন্ট’ পত্রিকায় জনপ্রিয় রেকর্ড আর বিজ্ঞাপনের প্রচার ব্রানসনকে রাতারাতি সাফল্য এনে দেয়। তবে সাফল্য পেলেও তিনি সেখান থেকে তেমন আয় করতে পারেননি। মাত্র ২০ বছর বয়সে স্টুডেন্ট ম্যাগাজিনের ইতি টেনে শুরু করলেন মিউজিকের রেকর্ড মেইলের মাধ্যমে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা। নাম দেন ভার্জিন মেইল। তাদের কাজ ছিল মূলত কম দামে মিউজিকের রেকর্ড কুরিয়ার করা। ১৯৭১ সালে একবার তিনি ভয়াবহ বিপদে পড়েন। পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের কর্মবিরতির কারণে তারা গ্রাহকদের কাছে অর্ডার পৌঁছাতে পারছিলেন না। ততদিনে ব্যবসাও বড় হয়ে আসছিল। এই ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য তিনি ‘ভার্জিন রেকর্ড স্টোর’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই স্টোরই পরবর্তী সময়ে ভার্জিন মেগাস্টোরে রূপ নেয়। রেকর্ড স্টুডিওকে তিনি বিরক্তকর কাজের জায়গা থেকে বানিয়েছেন আর্টিস্টদের থাকার জায়গা, তৈরি করেছেন স্পেস যাতে ক্রিয়েটিভিটি বিকাশে সহায়ক হয়। রেকর্ড স্টোরকে এত বড় বানিয়েছেন যাতে লোকজন রেকর্ড কিনতে এসে হারিয়ে যায়।
কর ফাঁকি দিয়ে জেলে
বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। অর্থাৎ অধিক চালাকিতে বিপদের সম্ভাবনা। তবে শুধু সম্ভাবনা নয় বিপদ কিন্তু হয়েছেও। একদিন ব্রানসন ভার্জিন মেইলের একটা বড় অর্ডার পেলেন বেলজিয়াম থেকে। ইউকে থেকে রেকর্ড নিয়ে ব্রানসন নিজেই রওনা হলেন। তখনকার ইউকে ট্যাক্স আইন অনুসারে, ব্রানসন রেকর্ডগুলো কিনেছিলেন অনেক কম দামে। পথিমধ্যে ফ্রেঞ্চ অথরিটি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চাইল কিন্তু সেটা তার কাছে ছিল না। তাই তিনি মালপত্র সমেত আবার ফিরে এলেন ইউকে। ব্রানসন ভাবলেন, রেকর্ডগুলো যে আবার ইউকে ফিরে এসেছে এটা তো আর কেউ জানে না। তাই এগুলো ইউকেতেই বিক্রি করে ফেললে লাভ হবে বেশি। যদিও এটা অপরাধ কিন্তু চতুর ব্রানসন বেছে নিলেন সেই পথ।
ব্রানসন রপ্তানির কথা বলে ট্যাক্স আইন অনুসারে রেকর্ড কিনতে লাগলেন অনেক কমদামে। আর ইউকেতেই বিক্রি করতে লাগলেন বেশি দামে। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া রেকর্ডের পাহাড় জমতে থাকল তার গোডাউনে। একদিন একটা ফোন এলো, এক ব্যক্তি বললেন পরদিন ব্রানসনের ফ্যাক্টরিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হানা দেবে। এক্সপোর্টের রেকর্ডগুলোতে ‘E’ মার্ক করা থাকে যা শুধু ‘UV’ লাইটেই বোঝা যায়। ব্রানসন ও তার পার্টনার সদ্য কেনা ‘UV’ লাইটসহ হাজির হলেন ফ্যাক্টরিতে। সারা রাত ধরে ‘E’ মার্ক করা রেকর্ড আলাদা করলেন তারপর ভোরের আগেই অক্সফোর্ডের আরেকটি শপে তিনি সেগুলো সরিয়ে ফেললেন। কাস্টমস অফিসাররা কিছুই পেলেন না। কিন্তু একই সঙ্গে অক্সফোর্ডের সেই শপেও হানা দিয়েছে কাস্টমস। ব্রানসনকে করা হলো গ্রেপ্তার আর জরিমানা হলো ৬০,০০০ পাউন্ড। যা কিনা অবৈধভাবে তিনি যা আয় করেছেন তার থেকেও প্রায় ৩ গুণ বেশি। ব্রানসন শিক্ষা নিলেন জীবনেও আর এমন কাজ করবেন না যাতে তাকে অপদস্থ হতে হয়। ১৯৮০ সালের দিকে ব্রানসনের রেকর্ড ব্যবসা ও মেগাশপের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৯৮১ সালের দিকে তিনি চালু করেন ‘ভার্জিন বুকস’ ও ‘ভার্জিন ভিডিও’। মাত্র দুই বছরের মধ্যে এটা এত জনপ্রিয় হয়ে যায় যে তিনি আরও ৫০টি কোম্পানি খুলে বসেন। আর আয় করে ফেলেন ১৭ মিলিয়ন ডলার। ১৯৮২ সালে তিনি ভার্জিন আটলান্টিক এয়ারওয়েজ ও ভার্জিন রেকর্ডস মিউজিক লেভেল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি একের পর এক নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। যেখানেই হাত দিয়েছেন ফলেছে সোনা। বিশ্বজুড়ে তার কোম্পানিতে কাজ করে প্রায় ৮০ হাজার লোক। ফোর্বসের বিলিয়নিয়ারের তালিকা অনুযায়ী রিচার্ড ব্রানসন হলেন যুক্তরাজ্যের চতুর্থ ধনী নাগরিক। তার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিমানবন্দরে অর্ধ উলঙ্গ
তিনি পাবলিসিটি পছন্দ করেন। তাই তিনি মাঝে মাঝে এমন কাজ করে বসেন যা ঠিক সেলিব্রেটিদের সঙ্গে যায় না। ২০১৩ সালে এডেনবরা বিমানবন্দর থেকে ভার্জিনের একটি বিমান যাচ্ছিল হিথ্রো বিমানবন্দরে। সেখানে তিনি হাজির হয়েছিলেন শার্ট পরে, তার ওপর ছিল একটি কোট আর প্যান্টের বদলে তিনি পড়েছিলেন একটি স্কার্ট। হঠাৎ করে তিনি সেখানে স্কার্ট তুলে নিচের অংশ উন্মুক্ত করে দেন। বলেন, আজ বাতাস খুব সুন্দর বইছে বেশ আরামদায়ক। আর আমি স্কার্ট পরার উপকারিতা উপভোগ করছি। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার লোক। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না তার। সে কাজই করবেন যা তার করার ইচ্ছা।
বিমানবালা রিচার্ড!
একবার তিনি বাজি ধরেছিলেন এয়ার এশিয়ার সিইও টনি ফার্নান্দেজের সঙ্গে। বাজি ছিল গাড়ির রেস নিয়ে। শর্ত ছিল যে হারবে সে অন্যের বিমানে বিমানবালার কাজ করবে। বাজিতে হেরে গেলেন রিচার্ড। ভাবছেন তিনি লজ্জা পাবেন? মোটেও না। ২০১০ সালে পার্থ থেকে কুয়ালালামপুরের একটি ফ্লাইটে তিনি হয়ে যান বিমানবালা। তাদের মতো পোশাক পরে, হাই হিল পায়ে গলিয়ে, সেজেগুজে, ঠোঁট রাঙিয়ে, চোখে আইলাইনার-মাশকারা লাগিয়ে যাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন অন্যদের সঙ্গে। পরিবেশন করেছেন খাবার ও পানীয়। সেই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন টনি ফার্নান্দেজ নিজেও। খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে মজা করে পুরো জুসের গ্লাসই ঢেলে দিয়েছেন টনির গায়ের ওপর। পাগল না হলে এই কাজ কেউ করে! তবে তাতে কিন্তু টনি রাগ করেননি। হেসে এক বন্ধুর গায়ে ঢলে পড়েছেন আরেক জন। তবে অনেকেই বলছেন এটা তার বিজনেসের একটা স্টান ছিল। ১৯৮৪ সালে চালু হওয়া ভার্জিন আটলান্টিকের ৫১ শতাংশের মালিক রিচার্ড।
নারীসঙ্গ
নারীসঙ্গ তার খুবই পছন্দ। তিনি যেখানেই যান না কেন একঝাঁক নারী তাকে ঘিরে থাকবেই। তার নিজস্ব যে দ্বীপ রয়েছে সেখানেও তাকে ঘিরে থাকে সুন্দরী ললনারা। সাগরে যখন স্পিডবোট চালান পেছনে গলা জড়িয়ে থাকা চাই কোনো নারীর। কিংবা কাইট সার্ফিংয়ের সময় পিঠে ঝুলে থাকে নগ্ন মডেল। তার কথা হচ্ছে সুস্থ থাকতে চাই নারীসঙ্গ, চাই যৌন আনন্দ। তার রঙিন যৌন জীবনের কথা সবার জানা। কেবল একজন দুজন তো নয়। নানা সময়ে তাকে ঘিরে থাকে নতুন নতুন নারীরা। সবার সামনেই তাকে চুম্বন করতে দেখা যায়। জড়িয়ে ধরতে দেখা যায়। তবে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগও নানা সময়ে উঠেছে। তাকে ঘিরে নানা সময়ে নানা ধরনের গল্প ঘুরে বেড়ায়। সুইমিং পুলে গেলেও দেখা যায় তাকে ঘিরে রয়েছে নারীরা।
হট এয়ার বেলুন ও বিশ্ব রেকর্ড

রোমাঞ্চকর চরিত্রের অধিকারী রিচার্ড ব্রানসন। রোমাঞ্চপ্রিয় এই মানুষটি মেতেছেন নানা ধরনের রোমাঞ্চকর অভিযানে। কখনো তিনি নিজেই পাল তোলা নৌকা করে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়েছেন। কখনো হট এয়ার বেলুন দিয়ে তিনি করেছেন বিশ্ব রেকর্ড। এ বেলুনে চেপে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়েছিলেন এই বেলুনে চড়ে। তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার। ১৯৯১ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে এই বেলুনে চেপে মোট ৭ হাজার ৬৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। ২০১৪ সালে তিনি নতুন রেকর্ড করেন। সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে কাইটবোর্ডে চড়ে পাড়ি দিয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল।
বিলাসবহুল জীবনযাপন
বিলিয়নিয়ার হলে অনেকেই খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতে পছন্দ করে, যেমন ওয়ারেন বাফেট। আবার অনেকেই রয়েছে যারা কিনা খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। মন যা চায় তাই তাদের করা চাই। তেমনই এক মানুষ হলেন রিচার্ড ব্রানসন। মন চাইল তো কিনে ফেললেন বিশাল এক দ্বীপ। মাত্র কয়েকদিন থাকবেন তাতে কি! শখ বলে কথা।

শখ মেটাতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৭৮ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপ নেকার আইল্যান্ড কিনে ফেলেন তিনি। সেখানে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল একটি বাড়িও। নাম নেকার ভিলা। সেখানে তিনি ছুটি কাটাতেই যান সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে।
দ্বীপটা সাজানো হয়েছে বিলাসবহুল আর বিনোদনপূর্ণ উপাদান দিয়ে। বর্তমানে কেউ যদি সেই দ্বীপে থাকতে চায় তাহলে তাকে খরচ করতে হবে ৪২ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই দ্বীপটি হয়ে উঠেছে সেলিব্রেটিদের অবকাশ যাপনের প্রাণকেন্দ্র। হলিউড অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট, জিমি ফেলন, ডেভিড বেকহাম, এডি মারফি, রবার্ট ডি নিরো, গিন ডেভিস, কেট মসের মতো জনপ্রিয় তারকারা এখানে আসেন ছুটি কাটাকে। গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ২০০৭ সালে এই দ্বীপে জমকালো আয়োজন করে বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে।
কোকা-কোলার সঙ্গে প্রতিযোগিতা
তার সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার লিস্টটাও কিন্তু কম বড় নয়। তার প্রথম ব্যর্থ উদ্যোগ ছিল ভার্জিন মেইল। এর জন্য জেলে গেলেও একে কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলেতে নারাজ তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে ব্রানসন বলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল ‘ভার্জিন কোলা’। কোকা-কোলার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তিনি এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোকা-কোলার কাছে হেরে যায় ভার্জিন কোলা। ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলেন। এ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ব্রানসন বলেন, ভার্জিন কোলাকে কোকা-কোলার বিকল্প হিসেবে বাজারে চালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটি তার থেকে যথেষ্ট আলাদা ছিল না।
এর বাইরেও ছিল তার ব্যর্থ উদ্যোগ যেমন- Virgin brides, Virgin Clothes, Virgin Vodka ইত্যাদি। তবে এসব ব্যর্থতাকে কখনোই তিনি প্রশ্রয় দেননি। বিপুল কর্মোদ্যম দিয়েই জয় করেছেন ব্যর্থতাকে। আর তাই ব্যবসার দুনিয়ায় সফল বলে আজ তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
এয়ারলাইনস ব্যবসা
এয়ারলাইনস ব্যবসায় আসার পেছনে একটি মজার গল্প রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে একবার তার স্ত্রীসহ পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে পৌঁছে ব্রানসন দেখলেন ফ্লাইট বাতিল। যাত্রীরা এদিক সেদিক ঘুরছে কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি দু’হাজার পাউন্ডে একটি বিমান ভাড়া করলেন এবং হিসাব করে দেখলেন ৩৯ পাউন্ড করে প্রত্যেক যাত্রীর ভাগে পড়ে। মজা করে নিজের কোম্পানি ভার্জিনের নাম অনুকরণে ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজ’ নাম দিয়ে একটি ব্লাকবোর্ডে লিখে দিলেন ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজে পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। জনপ্রতি ভাড়া ৩৯ পাউন্ড’। আর এভাবেই তার মাথায় ভার্জিন এয়ারওয়েজের ধারণাটি আসে।
পরবর্তী সময়ে পুরোপুরি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ভার্জিন আটলান্টিক, ভার্জিন আমেরিকা, ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া ভার্জিন ব্লু, ভার্জিন এক্সপ্রেস, ভার্জিন নাইজেরিয়াসহ বিশ্বব্যাপী তার বিমান ওড়ে আকাশে! এমনকি তিনি মহাশূন্যে বাণিজ্যিকভাবে ভ্রমণের জন্য তৈরি করেছেন ‘ভার্জিন গ্যালাকটিক’।
‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’
নিজের উত্থানের গল্প নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’ নামের আত্মজীবনীমূলক বই। বইটি বেশ আনন্দদায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক। তার জীবনের শুরু থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত নানা ঘটনা তিনি তার বইয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি কাজ করতে ভালোবাসেন আনন্দ ও মজার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ করি। এটাই আমার স্বভাব। আমাকে আজকেই এটা করতে হবে এমন কোনো কিছু আমি করি না বা আমার মধ্যে এমন অনুভূতিও আসেনি কখনো।’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূলত রিচার্ড ব্রানসনের প্রাত্যহিক নোটবুক থেকে লেখাগুলোকে একত্রিত করে, লুজিং মাই ভার্জিনিটি বইটির রূপ দেওয়া হয়েছে।
পরিবারই সব
ব্যারিস্টার এডওয়ার্ড জেমস ব্রানসন ও ইভা হান্থলি ব্রানসনের প্রথম সন্তান রিচার্ড ব্রানসন। ১৯৫০ সালের ১৮ জুলাই যুক্তরাজ্যের ব্ল্যাকআর্থে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন যৌথ পরিবার। তাই তার নিজের পরিবারের সঙ্গে বন্ধনটাও ছিল মজবুত। ছোটবেলায় তার ছিল ডাইলেক্সিয়া রোগ। যার জন্য তার পড়তে ও লিখতে অসুবিধা হতো। এই পুরো সময়ে তার বাবা-মা তার পাশে ছিলেন। কখনো কোনো কিছুর জন্য জোরাজুরি করেননি। এই রোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি যখন মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি ম্যাগাজিন বের করতে আগ্রহী হলেন তখনো পাশে ছিলেন তার বাবা-মা। তারা শিখিয়েছেন কখনো কারও সমালোচনা না করতে। ছোটবেলায় তারাই তার ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার মা বলেছিলেন, আমি এক সময় কোটিপতি হব। আর হব ইংল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। মা মনে হয় আগেই সব বুঝতে পেরেছিলেন। আমার কাছে আমার পরিবারই আমার দুনিয়া। দিন শেষে ফিরে তো সেই পরিবারের কাছেই যেতে হয়।
মাত্র বাইশ বছর বছরে ক্রিস্টিনকে বিয়ে করেন রিচার্ড। কিন্তু ১৯৭৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন জোয়ান টেম্পালমেনকে।
শেয়ার করুন
লায়লা আরজুমান্দ | ২০ জুন, ২০১৯ ০০:০০

রিচার্ড ব্রানসনকে বলা হয় ব্রিটিশ ব্যবসার মোগল। দুনিয়াজুড়ে তার পরিচিতি হলো ‘দ্য রেবেল বিলিয়নিয়ার’ নামে। তার মালিকানায় আছে চার শতাধিক কোম্পানি। কী নেই তার ব্যবসায়! কোমল পানীয় থেকে শুরু করে আকাশে ডানা মেলা উড়োজাহাজ; মহাকাশে ভ্রমণ সবই আছে তার ব্যবসার মধ্যে। অথচ তিনি স্কুলের গন্ডিই পেরোতে পারেননি। তার ব্যবসার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে আনন্দ ও মজা। রোমাঞ্চপ্রিয় এই মানুষটি কাইটবোর্ডে করে যেমন পাড়ি দিয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল তেমনি গ্যাস বেলুনে ভ্রমণ করে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। তার জীবনের নানা গল্প নিয়ে লিখেছেন লায়লা আরজুমান্দ
প্রেমের কারণে স্কুলছাড়া
ছেলেটা পড়াশুনায় ছিল অমনোযোগী, তার ওপর প্রেম করত স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে। একদিন ধরাও পড়ে গেল। ব্যস আর যায় কোথায়! রাগী মাস্টার মশাই তাকে দিলেন স্কুল থেকে বহিষ্কার করে। তাছাড়া পড়াশুনা করতে ভালো লাগত না তাই সেই ঘটনার পর আর স্কুলের পথে পা মাড়াননি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে শেষ করেন শিক্ষাজীবন।
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো বহিষ্কারের পর লিখেছিলেন সুইসাইড নোটও। তবে মজার ব্যাপার হলো...যতদিনে সুইসাইড নোটটা পাওয়া গেছে, ততদিনে তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছেন সেই সুইসাইড নোটের কথা। হেডমাস্টার আবার বলেছিলেন এই দস্যি ছেলে হয় জেলে যাবে না হয় কোটিপতি হবে। কিন্তু সেই ভবিষদ্বাণী যে দুটোই ফলে যাবে কিশোর রিচার্ড ব্রানসনের ভাগ্যে, এই ব্যাপারটা হয়তো অজানাই ছিল সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের।
দ্য স্টুডেন্টস
স্কুল ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনি ১৬ বছর বয়সে ‘স্টুডেন্ট’ নামে একটা ম্যাগাজিন বের করেছিলেন। যেটা স্কুলের ছাত্র ও তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করবে। পত্রিকাতে মিক জ্যাগার আর আরডি লাইংসহ ষাটের দশকের বহু জনপ্রিয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন তিনি। ‘দ্য স্টুডেন্ট’ পত্রিকায় জনপ্রিয় রেকর্ড আর বিজ্ঞাপনের প্রচার ব্রানসনকে রাতারাতি সাফল্য এনে দেয়। তবে সাফল্য পেলেও তিনি সেখান থেকে তেমন আয় করতে পারেননি। মাত্র ২০ বছর বয়সে স্টুডেন্ট ম্যাগাজিনের ইতি টেনে শুরু করলেন মিউজিকের রেকর্ড মেইলের মাধ্যমে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা। নাম দেন ভার্জিন মেইল। তাদের কাজ ছিল মূলত কম দামে মিউজিকের রেকর্ড কুরিয়ার করা। ১৯৭১ সালে একবার তিনি ভয়াবহ বিপদে পড়েন। পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের কর্মবিরতির কারণে তারা গ্রাহকদের কাছে অর্ডার পৌঁছাতে পারছিলেন না। ততদিনে ব্যবসাও বড় হয়ে আসছিল। এই ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য তিনি ‘ভার্জিন রেকর্ড স্টোর’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই স্টোরই পরবর্তী সময়ে ভার্জিন মেগাস্টোরে রূপ নেয়। রেকর্ড স্টুডিওকে তিনি বিরক্তকর কাজের জায়গা থেকে বানিয়েছেন আর্টিস্টদের থাকার জায়গা, তৈরি করেছেন স্পেস যাতে ক্রিয়েটিভিটি বিকাশে সহায়ক হয়। রেকর্ড স্টোরকে এত বড় বানিয়েছেন যাতে লোকজন রেকর্ড কিনতে এসে হারিয়ে যায়।
কর ফাঁকি দিয়ে জেলে
বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। অর্থাৎ অধিক চালাকিতে বিপদের সম্ভাবনা। তবে শুধু সম্ভাবনা নয় বিপদ কিন্তু হয়েছেও। একদিন ব্রানসন ভার্জিন মেইলের একটা বড় অর্ডার পেলেন বেলজিয়াম থেকে। ইউকে থেকে রেকর্ড নিয়ে ব্রানসন নিজেই রওনা হলেন। তখনকার ইউকে ট্যাক্স আইন অনুসারে, ব্রানসন রেকর্ডগুলো কিনেছিলেন অনেক কম দামে। পথিমধ্যে ফ্রেঞ্চ অথরিটি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চাইল কিন্তু সেটা তার কাছে ছিল না। তাই তিনি মালপত্র সমেত আবার ফিরে এলেন ইউকে। ব্রানসন ভাবলেন, রেকর্ডগুলো যে আবার ইউকে ফিরে এসেছে এটা তো আর কেউ জানে না। তাই এগুলো ইউকেতেই বিক্রি করে ফেললে লাভ হবে বেশি। যদিও এটা অপরাধ কিন্তু চতুর ব্রানসন বেছে নিলেন সেই পথ।
ব্রানসন রপ্তানির কথা বলে ট্যাক্স আইন অনুসারে রেকর্ড কিনতে লাগলেন অনেক কমদামে। আর ইউকেতেই বিক্রি করতে লাগলেন বেশি দামে। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া রেকর্ডের পাহাড় জমতে থাকল তার গোডাউনে। একদিন একটা ফোন এলো, এক ব্যক্তি বললেন পরদিন ব্রানসনের ফ্যাক্টরিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হানা দেবে। এক্সপোর্টের রেকর্ডগুলোতে ‘E’ মার্ক করা থাকে যা শুধু ‘UV’ লাইটেই বোঝা যায়। ব্রানসন ও তার পার্টনার সদ্য কেনা ‘UV’ লাইটসহ হাজির হলেন ফ্যাক্টরিতে। সারা রাত ধরে ‘E’ মার্ক করা রেকর্ড আলাদা করলেন তারপর ভোরের আগেই অক্সফোর্ডের আরেকটি শপে তিনি সেগুলো সরিয়ে ফেললেন। কাস্টমস অফিসাররা কিছুই পেলেন না। কিন্তু একই সঙ্গে অক্সফোর্ডের সেই শপেও হানা দিয়েছে কাস্টমস। ব্রানসনকে করা হলো গ্রেপ্তার আর জরিমানা হলো ৬০,০০০ পাউন্ড। যা কিনা অবৈধভাবে তিনি যা আয় করেছেন তার থেকেও প্রায় ৩ গুণ বেশি। ব্রানসন শিক্ষা নিলেন জীবনেও আর এমন কাজ করবেন না যাতে তাকে অপদস্থ হতে হয়। ১৯৮০ সালের দিকে ব্রানসনের রেকর্ড ব্যবসা ও মেগাশপের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৯৮১ সালের দিকে তিনি চালু করেন ‘ভার্জিন বুকস’ ও ‘ভার্জিন ভিডিও’। মাত্র দুই বছরের মধ্যে এটা এত জনপ্রিয় হয়ে যায় যে তিনি আরও ৫০টি কোম্পানি খুলে বসেন। আর আয় করে ফেলেন ১৭ মিলিয়ন ডলার। ১৯৮২ সালে তিনি ভার্জিন আটলান্টিক এয়ারওয়েজ ও ভার্জিন রেকর্ডস মিউজিক লেভেল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি একের পর এক নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। যেখানেই হাত দিয়েছেন ফলেছে সোনা। বিশ্বজুড়ে তার কোম্পানিতে কাজ করে প্রায় ৮০ হাজার লোক। ফোর্বসের বিলিয়নিয়ারের তালিকা অনুযায়ী রিচার্ড ব্রানসন হলেন যুক্তরাজ্যের চতুর্থ ধনী নাগরিক। তার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিমানবন্দরে অর্ধ উলঙ্গ
তিনি পাবলিসিটি পছন্দ করেন। তাই তিনি মাঝে মাঝে এমন কাজ করে বসেন যা ঠিক সেলিব্রেটিদের সঙ্গে যায় না। ২০১৩ সালে এডেনবরা বিমানবন্দর থেকে ভার্জিনের একটি বিমান যাচ্ছিল হিথ্রো বিমানবন্দরে। সেখানে তিনি হাজির হয়েছিলেন শার্ট পরে, তার ওপর ছিল একটি কোট আর প্যান্টের বদলে তিনি পড়েছিলেন একটি স্কার্ট। হঠাৎ করে তিনি সেখানে স্কার্ট তুলে নিচের অংশ উন্মুক্ত করে দেন। বলেন, আজ বাতাস খুব সুন্দর বইছে বেশ আরামদায়ক। আর আমি স্কার্ট পরার উপকারিতা উপভোগ করছি। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার লোক। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না তার। সে কাজই করবেন যা তার করার ইচ্ছা।
বিমানবালা রিচার্ড!
একবার তিনি বাজি ধরেছিলেন এয়ার এশিয়ার সিইও টনি ফার্নান্দেজের সঙ্গে। বাজি ছিল গাড়ির রেস নিয়ে। শর্ত ছিল যে হারবে সে অন্যের বিমানে বিমানবালার কাজ করবে। বাজিতে হেরে গেলেন রিচার্ড। ভাবছেন তিনি লজ্জা পাবেন? মোটেও না। ২০১০ সালে পার্থ থেকে কুয়ালালামপুরের একটি ফ্লাইটে তিনি হয়ে যান বিমানবালা। তাদের মতো পোশাক পরে, হাই হিল পায়ে গলিয়ে, সেজেগুজে, ঠোঁট রাঙিয়ে, চোখে আইলাইনার-মাশকারা লাগিয়ে যাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন অন্যদের সঙ্গে। পরিবেশন করেছেন খাবার ও পানীয়। সেই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন টনি ফার্নান্দেজ নিজেও। খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে মজা করে পুরো জুসের গ্লাসই ঢেলে দিয়েছেন টনির গায়ের ওপর। পাগল না হলে এই কাজ কেউ করে! তবে তাতে কিন্তু টনি রাগ করেননি। হেসে এক বন্ধুর গায়ে ঢলে পড়েছেন আরেক জন। তবে অনেকেই বলছেন এটা তার বিজনেসের একটা স্টান ছিল। ১৯৮৪ সালে চালু হওয়া ভার্জিন আটলান্টিকের ৫১ শতাংশের মালিক রিচার্ড।
নারীসঙ্গ
নারীসঙ্গ তার খুবই পছন্দ। তিনি যেখানেই যান না কেন একঝাঁক নারী তাকে ঘিরে থাকবেই। তার নিজস্ব যে দ্বীপ রয়েছে সেখানেও তাকে ঘিরে থাকে সুন্দরী ললনারা। সাগরে যখন স্পিডবোট চালান পেছনে গলা জড়িয়ে থাকা চাই কোনো নারীর। কিংবা কাইট সার্ফিংয়ের সময় পিঠে ঝুলে থাকে নগ্ন মডেল। তার কথা হচ্ছে সুস্থ থাকতে চাই নারীসঙ্গ, চাই যৌন আনন্দ। তার রঙিন যৌন জীবনের কথা সবার জানা। কেবল একজন দুজন তো নয়। নানা সময়ে তাকে ঘিরে থাকে নতুন নতুন নারীরা। সবার সামনেই তাকে চুম্বন করতে দেখা যায়। জড়িয়ে ধরতে দেখা যায়। তবে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগও নানা সময়ে উঠেছে। তাকে ঘিরে নানা সময়ে নানা ধরনের গল্প ঘুরে বেড়ায়। সুইমিং পুলে গেলেও দেখা যায় তাকে ঘিরে রয়েছে নারীরা।
হট এয়ার বেলুন ও বিশ্ব রেকর্ড
রোমাঞ্চকর চরিত্রের অধিকারী রিচার্ড ব্রানসন। রোমাঞ্চপ্রিয় এই মানুষটি মেতেছেন নানা ধরনের রোমাঞ্চকর অভিযানে। কখনো তিনি নিজেই পাল তোলা নৌকা করে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়েছেন। কখনো হট এয়ার বেলুন দিয়ে তিনি করেছেন বিশ্ব রেকর্ড। এ বেলুনে চেপে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়েছিলেন এই বেলুনে চড়ে। তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার। ১৯৯১ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে এই বেলুনে চেপে মোট ৭ হাজার ৬৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। ২০১৪ সালে তিনি নতুন রেকর্ড করেন। সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে কাইটবোর্ডে চড়ে পাড়ি দিয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল।
বিলাসবহুল জীবনযাপন
বিলিয়নিয়ার হলে অনেকেই খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতে পছন্দ করে, যেমন ওয়ারেন বাফেট। আবার অনেকেই রয়েছে যারা কিনা খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। মন যা চায় তাই তাদের করা চাই। তেমনই এক মানুষ হলেন রিচার্ড ব্রানসন। মন চাইল তো কিনে ফেললেন বিশাল এক দ্বীপ। মাত্র কয়েকদিন থাকবেন তাতে কি! শখ বলে কথা।
শখ মেটাতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৭৮ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপ নেকার আইল্যান্ড কিনে ফেলেন তিনি। সেখানে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল একটি বাড়িও। নাম নেকার ভিলা। সেখানে তিনি ছুটি কাটাতেই যান সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে।
দ্বীপটা সাজানো হয়েছে বিলাসবহুল আর বিনোদনপূর্ণ উপাদান দিয়ে। বর্তমানে কেউ যদি সেই দ্বীপে থাকতে চায় তাহলে তাকে খরচ করতে হবে ৪২ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই দ্বীপটি হয়ে উঠেছে সেলিব্রেটিদের অবকাশ যাপনের প্রাণকেন্দ্র। হলিউড অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট, জিমি ফেলন, ডেভিড বেকহাম, এডি মারফি, রবার্ট ডি নিরো, গিন ডেভিস, কেট মসের মতো জনপ্রিয় তারকারা এখানে আসেন ছুটি কাটাকে। গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ২০০৭ সালে এই দ্বীপে জমকালো আয়োজন করে বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে।
কোকা-কোলার সঙ্গে প্রতিযোগিতা
তার সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার লিস্টটাও কিন্তু কম বড় নয়। তার প্রথম ব্যর্থ উদ্যোগ ছিল ভার্জিন মেইল। এর জন্য জেলে গেলেও একে কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলেতে নারাজ তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে ব্রানসন বলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল ‘ভার্জিন কোলা’। কোকা-কোলার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তিনি এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোকা-কোলার কাছে হেরে যায় ভার্জিন কোলা। ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলেন। এ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ব্রানসন বলেন, ভার্জিন কোলাকে কোকা-কোলার বিকল্প হিসেবে বাজারে চালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটি তার থেকে যথেষ্ট আলাদা ছিল না।
এর বাইরেও ছিল তার ব্যর্থ উদ্যোগ যেমন- Virgin brides, Virgin Clothes, Virgin Vodka ইত্যাদি। তবে এসব ব্যর্থতাকে কখনোই তিনি প্রশ্রয় দেননি। বিপুল কর্মোদ্যম দিয়েই জয় করেছেন ব্যর্থতাকে। আর তাই ব্যবসার দুনিয়ায় সফল বলে আজ তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
এয়ারলাইনস ব্যবসা
এয়ারলাইনস ব্যবসায় আসার পেছনে একটি মজার গল্প রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে একবার তার স্ত্রীসহ পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে পৌঁছে ব্রানসন দেখলেন ফ্লাইট বাতিল। যাত্রীরা এদিক সেদিক ঘুরছে কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি দু’হাজার পাউন্ডে একটি বিমান ভাড়া করলেন এবং হিসাব করে দেখলেন ৩৯ পাউন্ড করে প্রত্যেক যাত্রীর ভাগে পড়ে। মজা করে নিজের কোম্পানি ভার্জিনের নাম অনুকরণে ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজ’ নাম দিয়ে একটি ব্লাকবোর্ডে লিখে দিলেন ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজে পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। জনপ্রতি ভাড়া ৩৯ পাউন্ড’। আর এভাবেই তার মাথায় ভার্জিন এয়ারওয়েজের ধারণাটি আসে।
পরবর্তী সময়ে পুরোপুরি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ভার্জিন আটলান্টিক, ভার্জিন আমেরিকা, ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া ভার্জিন ব্লু, ভার্জিন এক্সপ্রেস, ভার্জিন নাইজেরিয়াসহ বিশ্বব্যাপী তার বিমান ওড়ে আকাশে! এমনকি তিনি মহাশূন্যে বাণিজ্যিকভাবে ভ্রমণের জন্য তৈরি করেছেন ‘ভার্জিন গ্যালাকটিক’।
‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’
নিজের উত্থানের গল্প নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’ নামের আত্মজীবনীমূলক বই। বইটি বেশ আনন্দদায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক। তার জীবনের শুরু থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত নানা ঘটনা তিনি তার বইয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি কাজ করতে ভালোবাসেন আনন্দ ও মজার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ করি। এটাই আমার স্বভাব। আমাকে আজকেই এটা করতে হবে এমন কোনো কিছু আমি করি না বা আমার মধ্যে এমন অনুভূতিও আসেনি কখনো।’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূলত রিচার্ড ব্রানসনের প্রাত্যহিক নোটবুক থেকে লেখাগুলোকে একত্রিত করে, লুজিং মাই ভার্জিনিটি বইটির রূপ দেওয়া হয়েছে।
পরিবারই সব
ব্যারিস্টার এডওয়ার্ড জেমস ব্রানসন ও ইভা হান্থলি ব্রানসনের প্রথম সন্তান রিচার্ড ব্রানসন। ১৯৫০ সালের ১৮ জুলাই যুক্তরাজ্যের ব্ল্যাকআর্থে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন যৌথ পরিবার। তাই তার নিজের পরিবারের সঙ্গে বন্ধনটাও ছিল মজবুত। ছোটবেলায় তার ছিল ডাইলেক্সিয়া রোগ। যার জন্য তার পড়তে ও লিখতে অসুবিধা হতো। এই পুরো সময়ে তার বাবা-মা তার পাশে ছিলেন। কখনো কোনো কিছুর জন্য জোরাজুরি করেননি। এই রোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি যখন মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি ম্যাগাজিন বের করতে আগ্রহী হলেন তখনো পাশে ছিলেন তার বাবা-মা। তারা শিখিয়েছেন কখনো কারও সমালোচনা না করতে। ছোটবেলায় তারাই তার ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার মা বলেছিলেন, আমি এক সময় কোটিপতি হব। আর হব ইংল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। মা মনে হয় আগেই সব বুঝতে পেরেছিলেন। আমার কাছে আমার পরিবারই আমার দুনিয়া। দিন শেষে ফিরে তো সেই পরিবারের কাছেই যেতে হয়।
মাত্র বাইশ বছর বছরে ক্রিস্টিনকে বিয়ে করেন রিচার্ড। কিন্তু ১৯৭৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন জোয়ান টেম্পালমেনকে।