পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাটির মসজিদ
আন্দালিব আয়ান | ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০
পশ্চিম আফ্রিকার কৃষিনির্ভর অনুন্নত একটি দেশ মালি। খরা, মহামারি আর অনাহারের দেশ হিসেবে পরিচিত মালি বিশেষ একটি স্থাপনার জন্যও বিখ্যাত। হাজার বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি একটি মসজিদ। সম্পূর্ণ কাদামাটি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ মালির জেনি নামে একটি এলাকায় অবস্থিত। ফলে এটি সারা বিশ্বে ‘গ্রেট মস্ক অব জেনি’ নামেই অধিক পরিচিত। লিখেছেন আন্দালিব আয়ান
নির্মাণ ইতিহাস
সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে নির্মিত জেনির গ্রেট মসজিদ কবে, কীভাবে নির্মিত হয়েছিল তা কেউ না জানলেও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। এসব মতের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, ১২০০ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদ সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো দলিলটি হলো আব্দুল আল-সাদি রচিত ‘তারিক আল-সুদান’ বা ‘সুদানের ইতিহাস’ গ্রন্থটি। ১৬৫৫ সালের আগে এই বইটি রচনা করা হয়। তবে, মসজিদ সম্পর্কে ‘তারিক আল-সুদান’-এর বর্ণনাটি সম্ভবত লোক কথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এই বর্ণনা অনুযায়ী, জেনির ২৬তম শাসক কোনবোরোর হাতে এই মসজিদের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়। তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম ছিলেন। নিজের বাসস্থানটিকেই তিনি মসজিদে রূপ দিয়েছিলেন এবং মসজিদের পূর্বদিকে কাছাকাছি এলাকায় নিজের জন্য আরেকটি প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। তবে, সেই প্রাসাদ মসজিদের চেয়েও ছোট ছিল।
জেনির সাধারণ মানুষ তখন ব্যাপক উৎসাহে গ্রহণ করে নেন তাদের প্রথম মুসলমান শাসককে। তখন নতুন রাজা চিন্তা করেন তার প্রজাদের প্রার্থনার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান দরকার। যেখানে সৃষ্টিকর্তার জন্য স্থান নেই সেখানে তিনি কী করে প্রাসাদে বাস করবেন? তিনি ঠিক করলেন তার প্রাসাদ ভেঙে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডেকে আনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মসজিদ তৈরিতে গতানুগতিক কাদামাটি এবং গ্রামের সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করা হবে।
মসজিদের দেয়াল অনেক উঁচু হবে বলে সেখানে তালগাছের কাঠ দিয়ে নকশা করা হলো যা স্থানীয়ভাবে টরল নামে পরিচিত। মাটির দেয়াল যাতে সহজে ধসে না পড়ে সে জন্যই এই কাঠ ব্যবহার করা হতো। রাজা কোনবোরোর উত্তরসূরিরা মসজিদের আরও ব্যাপক সংস্কার করেন। তারা এই মসজিদের সঙ্গে আরও দুটি মিনার নির্মাণ করেন এবং মসজিদের চারপাশে উঁচু দেয়াল তোলেন।
ঐতিহাসিক উত্থান-পতন
১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ সম্পর্কে কোনো প্রকার লিখিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সেবার ফরাসি পর্যটক রেনে কাইলি মালি ভ্রমণের সময় জেনিতে গিয়ে মসজিদটি খুঁজে বের করেন। জার্নাল অব দ্য ভয়েজ টু টিম্বাকটু অ্যান্ড জেনিতে রেনে কাইলি লিখেন, ‘জেনিতে মাটি দিয়ে নির্মিত এক মসজিদ রয়েছে। খুব বেশি উঁচু না হলেও বিশাল আকারের দুটি টাওয়ার রয়েছে এই মসজিদে। অনেক বড় আয়তন নিয়ে মসজিদটি বানানো হয়েছে। মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার চড়–ই পাখির বসবাস। তারা সেখানে বাসা বানিয়ে থাকে।
রেনে কাইলিই ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে নিজের চোখে দেখেছিলেন। তিনি তার প্রবন্ধে এও উল্লেখ করেন মসজিদের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত কাদামাটির প্রলেপ দেওয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি ধারণা করেন, অনেক বছর অবহেলায় পড়ে থেকে মসজিদটির স্থায়িত্ব কমে এসেছিল।
রেনে কাইলির ভ্রমণের ১০ বছর আগে ফালানি নেতা সেকু আমাডুর নেতৃত্বে এক জিহাদের মধ্য দিয়ে জেনি শহর দখল করে নেওয়া হয়। খুব সম্ভবত সেকু আমাদু ওই মসজিদটিকে অস্বীকার করেছিলেন এবং অবহেলার দরুন এর করুণ দশার সৃষ্টি হয়। আর এমন পরিস্থিতিতেই মসজিদ এলাকায় ভ্রমণ করেন রেনে কাইলি। কথিও আছে সেকু আমাদু ওই শহরের আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে, তার নেতৃত্বেই ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে মাটির মসজিদের পূর্বদিকে যে প্রাসাদটি ছিল সেখানে দ্বিতীয় আরেকটি মসজিদ নির্মিত হয়। এই মসজিদ আগের মসজিদের তুলনায় অনেক বড় ছিল। তবে, এই মসজিদের ভবনগুলো তুলনামূলক নিচু ছিল এবং এতে টাওয়ার কিংবা সাজসজ্জা কম ছিল। ১৮৯৩ সালে লুইস আর্কিনার্ডের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী জেনি অঞ্চল দখল করে নেয়। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবোইস জেনিতে ভ্রমণ করেন এবং আসল মসজিদটির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বর্ণনা করেন। পরিত্যক্ত মসজিদটির ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। এটিকে তখন একটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ১৮৯৭ সালে ডুবোইস-এর লেখা ‘টম্বোকটো লা মিস্ট্রিজ’ বইয়ে এ সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করেছিলেন এবং নিজের হাতে আঁকা একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। মসজিদটি ধ্বংস ও পরিত্যক্ত হওয়ার আগে এটি দেখতে কেমন ছিল, তা কল্পনা শক্তির ওপর নির্ভর করে এঁকেছিলেন ডুবোইস।
সেখানে আরও দেখানো হয় আকার ও আকৃতিতে দ্বিতীয় মসজিদের স্থাপনা প্রথম মসজিদের চাইতে অনেক বড়। পাশাপাশি দ্বিতীয়বার নির্মিত মসজিদটিতে স্তম্ভের ব্যবহার করা হয়েছিল।
বর্তমান রূপ
১৯০৬ সালে ফরাসি প্রশাসন আসল মসজিদটিকে আবারও নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেকু আমাদু যে মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন সেটিকে একটি স্কুলে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করা হয়। মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দেন ইসমাইলা ট্রাওরি নামে এক রাজমিস্ত্রি সর্দার। এই নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল জেনির সাধারণ মানুষও। সে সময়ের কিছু ছবি দেখে ধারণা করা হয়, আসল মসজিদের সীমানা দেয়ালগুলো আগের মতো করে নির্মাণ করা হলেও ভেতরের স্তম্ভ নির্মাণে আগের রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল কি-না তা এখনো অস্পষ্ট।
নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে কিবলা ওয়ালের ওপর স্থাপিত তিনটি টাওয়ার প্রতিসম ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। মসজিদের পুনর্নির্মাণে ফরাসি ভ‚মিকা নিয়ে অনেক বিতর্কও রয়েছে। কারও কারও মতে, ফরাসিদের কোনো ভ‚মিকা ছাড়াই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।
ফেলিক্স ডুবোইস দ্বিতীয়বারের মতো জেনি সফর করেন ১৯১০ সালে। নতুন মসজিদ দেখে তিনি কিছুটা মর্মাহত হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, মসজিদটি নির্মাণ করতে গিয়ে ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসন এর কিছুটা বিকৃতি ঘটিয়েছে। কারণ ডুবোইসের মনে হচ্ছিল নতুন মসজিদটিতে একটু চার্চের আদল রয়েছে এবং এটি অনেকটা বারোক স্থাপত্যের মন্দিরের মতো দেখাচ্ছে। তবে, তার এই মতামতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন আমেরিকার স্থাপত্য ইতিহাসবিদ জিন লুইস বারগেনাস। তার মতে, নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে ফরাসি প্রভাব নেই বললেই চলে। এছাড়া এর ভেতরে যেসব নকশা করা হয়েছে তার সবগুলোর উৎস আফ্রিকান।
তবে, ১৯৩১ সালে ফরাসি জাতিতত্ত¡বিদ মিশেল ল্যারিস মালি সফরকালে মসজিদটি পরিদর্শন করে বলেছিলেন, এটি ইউরোপীয়দের কাজ। তিনি এও বলেন, নতুন মসজিদের নকশা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অনেক অসন্তোষ ছিল। তাই তারা এটিকে পরিষ্কার করে রাখতে অনীহা দেখাত। পরে জেলের ভয় দেখিয়ে তাদের এই কাজে বাধ্য করা হতো।
মসজিদের পূর্বদিকের দেয়ালের সামনের চত্বরে দুটি সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে বড় সমাধিটি আলমানি ইসমাইলা নামে অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে বাস করা এক গুরুত্বপূর্ণ ইমামের। ফরাসি ঔপনিবেশিকতার শুরুর দিকে মসজিদের পূর্বপ্রান্তে একটি পুকুর ছিল। পরে এটিকে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্তমানে এই স্থানটিতে সাপ্তাহিক বাজার বসে।
স্থাপত্য ও নকশা
বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে যে মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায় তার মাঝে বেশ পরিকল্পিত স্থাপত্যশৈলীর ছাপ দেখা যায়। মসজিদটির চারপাশ উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মসজিদটির মাঝখানের চ‚ড়াটি একটি উঁচু স্তম্ভের মতো দেখা যায়। এর দেয়ালে এবং ছাদে অনেকগুলো ছিদ্র রাখা হয়েছে যেন গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট আলো-বাতাস পাওয়া যায়। এর বাইরের অংশের ৩টি উঁচু মিনার মসজিদটিকে অসম্ভব সুন্দর ছন্দময় দৃশ্য উপহার দেয়। এতে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বর্তমানে মসজিদটির সঙ্গে একটি শৌচাগার সংযুক্ত রয়েছে। আরও আছে নারীদের জন্য নামাজের আলাদা স্থান।
মসজিদে এখন আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে লাউড স্পিকার সিস্টেম। ১৯৯০-এর দশকে মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্ধনের জন্য বহির্বিশ্বে বেশ প্রশংসা কুড়ায় দরিদ্র দেশ মালি।
মসজিদের দেয়ালগুলো ইটের মতো এক ধরনের মাটির টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো রোদে শুকানো। এর ওপর মাটির আবরণ দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ভবনের দেয়ালগুলোতে তালগাছের পাতার কাÐ দিয়ে বিশেষ নকশা করা হয়েছে। প্রতি বছর মসজিদের নির্মাণকাজে এই কাÐগুলো বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। কারণ এগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই শ্রমিকরা কাজ করে। ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মসজিদের ভিত্তিভ‚মিটি দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুই দিকেই ৭৫ মিটার করে। সমতল থেকে এই ভ‚মি প্রায় ১০ ফুট উঁচু। ওই অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলা বানি নদী প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হলে যেন মসজিদের কোনো ক্ষতি না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। উত্তর দিক দিয়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদের ভেতরে যেখানে নামাজ পড়া হয় সেই অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২৬ মিটার।
স্থানীয়দের উৎসব
মসজিদটিকে ঘিরে জেনি অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক’ প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য গ্রামের মানুষ সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। উৎসবে স্থানীয় সব মানুষই আনন্দের সঙ্গে অংশ নেয়। তখন রাজমিস্ত্রির সংগঠন গ্রামের লোকদের একত্রিত করে নাইজার এবং বানি নদী থেকে মাটি আহরণ করা শুরু করে। সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটি সংগ্রহের কাজে। এদিকে, গান বাজনার দল গান গেয়ে সকলকে বিনোদন দিতে থাকে। আর গৃহস্থ মেয়েদের কাজ হলো মাটির মিশ্রণ তৈরিতে পানি সরবরাহ করা। এভাবে কাদামাটির মিশ্রণ তৈরি করার পর মসজিদের দেয়াল জুড়ে প্রলেপ লাগানোর কাজ শুরু হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী মাটির মসজিদকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করে। উৎসবের সময়ে বাইরের কিছু পর্যটক সবসময় চেয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব খাটাতে। আবার অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী মসজিদটিকে কংক্রিটের মসজিদ করে দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে। কিন্তু জেনি সম্প্রদায়বাসী তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী। তারা কোনোপ্রকার প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করে এখনো সমুন্নত রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম মাটির মসজিদটিকে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদ এবং মসজিদের চারপাশের গ্রামটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ
মধ্যযুগে আফ্রিকার এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক পথ এবং এর বিস্তৃত সংস্কৃতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে জেনিতে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে, যাদের অধিকাংশই মুসলমান। অনেক কাল আগে থেকেই এ অঞ্চলটি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মসজিদটি। অসংখ্য শিক্ষার্থী কুরআন শেখার জন্য এই মসজিদে ভিড় করত। এখনো এই মসজিদে নিয়মিত কুরআন পাঠদান করা হয়।
কাদামাটির এ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ মোটেও সহজসাধ্য নয়। জেনি গ্রামে রাজমিস্ত্রিদের সংগঠনটি পুরো গ্রামের মাটির ঘরবাড়ি তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন। এই সংগঠনই মূলত মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে কর্মরত থাকে। কিন্তু খুব বড় আকৃতির স্থাপনা হওয়ায় প্রায় সময় কিছু না কিছু মেরামত হতেই হয়। উপযুক্ত লোক এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এই কাজ দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে জেনিবাসীর জন্য। স্বাভাবিকভাবে এর সঙ্গে খরচের ব্যাপারটিও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামবাসীর অদম্য ভালোবাসা এবং ধর্মীয় অনুভব মসজিদটিকে এখনো বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে।
১৯৯৬ সালে এই মসজিদের ভেতরে বিশ্বখ্যাত ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের একটি ফটোশ্যুট করা হয় মসজিদের ভেতরে। মসজিদের ভেতরে স্বল্পবসনা নারী মডেলের উপস্থিতির জন্য সে-সময় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল স্থানীয়দের মধ্যে। তার পর থেকেই এই মসজিদে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের আলোচিত সিনেমা ‘সাহারা’তেও মসজিদটিকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে।
শেয়ার করুন
আন্দালিব আয়ান | ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০

পশ্চিম আফ্রিকার কৃষিনির্ভর অনুন্নত একটি দেশ মালি। খরা, মহামারি আর অনাহারের দেশ হিসেবে পরিচিত মালি বিশেষ একটি স্থাপনার জন্যও বিখ্যাত। হাজার বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি একটি মসজিদ। সম্পূর্ণ কাদামাটি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ মালির জেনি নামে একটি এলাকায় অবস্থিত। ফলে এটি সারা বিশ্বে ‘গ্রেট মস্ক অব জেনি’ নামেই অধিক পরিচিত। লিখেছেন আন্দালিব আয়ান
নির্মাণ ইতিহাস
সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে নির্মিত জেনির গ্রেট মসজিদ কবে, কীভাবে নির্মিত হয়েছিল তা কেউ না জানলেও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। এসব মতের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, ১২০০ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদ সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো দলিলটি হলো আব্দুল আল-সাদি রচিত ‘তারিক আল-সুদান’ বা ‘সুদানের ইতিহাস’ গ্রন্থটি। ১৬৫৫ সালের আগে এই বইটি রচনা করা হয়। তবে, মসজিদ সম্পর্কে ‘তারিক আল-সুদান’-এর বর্ণনাটি সম্ভবত লোক কথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এই বর্ণনা অনুযায়ী, জেনির ২৬তম শাসক কোনবোরোর হাতে এই মসজিদের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়। তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম ছিলেন। নিজের বাসস্থানটিকেই তিনি মসজিদে রূপ দিয়েছিলেন এবং মসজিদের পূর্বদিকে কাছাকাছি এলাকায় নিজের জন্য আরেকটি প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। তবে, সেই প্রাসাদ মসজিদের চেয়েও ছোট ছিল।
জেনির সাধারণ মানুষ তখন ব্যাপক উৎসাহে গ্রহণ করে নেন তাদের প্রথম মুসলমান শাসককে। তখন নতুন রাজা চিন্তা করেন তার প্রজাদের প্রার্থনার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান দরকার। যেখানে সৃষ্টিকর্তার জন্য স্থান নেই সেখানে তিনি কী করে প্রাসাদে বাস করবেন? তিনি ঠিক করলেন তার প্রাসাদ ভেঙে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডেকে আনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মসজিদ তৈরিতে গতানুগতিক কাদামাটি এবং গ্রামের সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করা হবে।
মসজিদের দেয়াল অনেক উঁচু হবে বলে সেখানে তালগাছের কাঠ দিয়ে নকশা করা হলো যা স্থানীয়ভাবে টরল নামে পরিচিত। মাটির দেয়াল যাতে সহজে ধসে না পড়ে সে জন্যই এই কাঠ ব্যবহার করা হতো। রাজা কোনবোরোর উত্তরসূরিরা মসজিদের আরও ব্যাপক সংস্কার করেন। তারা এই মসজিদের সঙ্গে আরও দুটি মিনার নির্মাণ করেন এবং মসজিদের চারপাশে উঁচু দেয়াল তোলেন।
ঐতিহাসিক উত্থান-পতন
১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ সম্পর্কে কোনো প্রকার লিখিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সেবার ফরাসি পর্যটক রেনে কাইলি মালি ভ্রমণের সময় জেনিতে গিয়ে মসজিদটি খুঁজে বের করেন। জার্নাল অব দ্য ভয়েজ টু টিম্বাকটু অ্যান্ড জেনিতে রেনে কাইলি লিখেন, ‘জেনিতে মাটি দিয়ে নির্মিত এক মসজিদ রয়েছে। খুব বেশি উঁচু না হলেও বিশাল আকারের দুটি টাওয়ার রয়েছে এই মসজিদে। অনেক বড় আয়তন নিয়ে মসজিদটি বানানো হয়েছে। মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার চড়–ই পাখির বসবাস। তারা সেখানে বাসা বানিয়ে থাকে।
রেনে কাইলিই ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে নিজের চোখে দেখেছিলেন। তিনি তার প্রবন্ধে এও উল্লেখ করেন মসজিদের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত কাদামাটির প্রলেপ দেওয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি ধারণা করেন, অনেক বছর অবহেলায় পড়ে থেকে মসজিদটির স্থায়িত্ব কমে এসেছিল।
রেনে কাইলির ভ্রমণের ১০ বছর আগে ফালানি নেতা সেকু আমাডুর নেতৃত্বে এক জিহাদের মধ্য দিয়ে জেনি শহর দখল করে নেওয়া হয়। খুব সম্ভবত সেকু আমাদু ওই মসজিদটিকে অস্বীকার করেছিলেন এবং অবহেলার দরুন এর করুণ দশার সৃষ্টি হয়। আর এমন পরিস্থিতিতেই মসজিদ এলাকায় ভ্রমণ করেন রেনে কাইলি। কথিও আছে সেকু আমাদু ওই শহরের আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে, তার নেতৃত্বেই ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে মাটির মসজিদের পূর্বদিকে যে প্রাসাদটি ছিল সেখানে দ্বিতীয় আরেকটি মসজিদ নির্মিত হয়। এই মসজিদ আগের মসজিদের তুলনায় অনেক বড় ছিল। তবে, এই মসজিদের ভবনগুলো তুলনামূলক নিচু ছিল এবং এতে টাওয়ার কিংবা সাজসজ্জা কম ছিল। ১৮৯৩ সালে লুইস আর্কিনার্ডের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী জেনি অঞ্চল দখল করে নেয়। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবোইস জেনিতে ভ্রমণ করেন এবং আসল মসজিদটির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বর্ণনা করেন। পরিত্যক্ত মসজিদটির ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। এটিকে তখন একটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ১৮৯৭ সালে ডুবোইস-এর লেখা ‘টম্বোকটো লা মিস্ট্রিজ’ বইয়ে এ সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করেছিলেন এবং নিজের হাতে আঁকা একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। মসজিদটি ধ্বংস ও পরিত্যক্ত হওয়ার আগে এটি দেখতে কেমন ছিল, তা কল্পনা শক্তির ওপর নির্ভর করে এঁকেছিলেন ডুবোইস।
সেখানে আরও দেখানো হয় আকার ও আকৃতিতে দ্বিতীয় মসজিদের স্থাপনা প্রথম মসজিদের চাইতে অনেক বড়। পাশাপাশি দ্বিতীয়বার নির্মিত মসজিদটিতে স্তম্ভের ব্যবহার করা হয়েছিল।
বর্তমান রূপ
১৯০৬ সালে ফরাসি প্রশাসন আসল মসজিদটিকে আবারও নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেকু আমাদু যে মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন সেটিকে একটি স্কুলে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করা হয়। মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দেন ইসমাইলা ট্রাওরি নামে এক রাজমিস্ত্রি সর্দার। এই নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল জেনির সাধারণ মানুষও। সে সময়ের কিছু ছবি দেখে ধারণা করা হয়, আসল মসজিদের সীমানা দেয়ালগুলো আগের মতো করে নির্মাণ করা হলেও ভেতরের স্তম্ভ নির্মাণে আগের রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল কি-না তা এখনো অস্পষ্ট।
নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে কিবলা ওয়ালের ওপর স্থাপিত তিনটি টাওয়ার প্রতিসম ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। মসজিদের পুনর্নির্মাণে ফরাসি ভ‚মিকা নিয়ে অনেক বিতর্কও রয়েছে। কারও কারও মতে, ফরাসিদের কোনো ভ‚মিকা ছাড়াই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।
ফেলিক্স ডুবোইস দ্বিতীয়বারের মতো জেনি সফর করেন ১৯১০ সালে। নতুন মসজিদ দেখে তিনি কিছুটা মর্মাহত হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, মসজিদটি নির্মাণ করতে গিয়ে ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসন এর কিছুটা বিকৃতি ঘটিয়েছে। কারণ ডুবোইসের মনে হচ্ছিল নতুন মসজিদটিতে একটু চার্চের আদল রয়েছে এবং এটি অনেকটা বারোক স্থাপত্যের মন্দিরের মতো দেখাচ্ছে। তবে, তার এই মতামতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন আমেরিকার স্থাপত্য ইতিহাসবিদ জিন লুইস বারগেনাস। তার মতে, নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে ফরাসি প্রভাব নেই বললেই চলে। এছাড়া এর ভেতরে যেসব নকশা করা হয়েছে তার সবগুলোর উৎস আফ্রিকান।
তবে, ১৯৩১ সালে ফরাসি জাতিতত্ত¡বিদ মিশেল ল্যারিস মালি সফরকালে মসজিদটি পরিদর্শন করে বলেছিলেন, এটি ইউরোপীয়দের কাজ। তিনি এও বলেন, নতুন মসজিদের নকশা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অনেক অসন্তোষ ছিল। তাই তারা এটিকে পরিষ্কার করে রাখতে অনীহা দেখাত। পরে জেলের ভয় দেখিয়ে তাদের এই কাজে বাধ্য করা হতো।
মসজিদের পূর্বদিকের দেয়ালের সামনের চত্বরে দুটি সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে বড় সমাধিটি আলমানি ইসমাইলা নামে অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে বাস করা এক গুরুত্বপূর্ণ ইমামের। ফরাসি ঔপনিবেশিকতার শুরুর দিকে মসজিদের পূর্বপ্রান্তে একটি পুকুর ছিল। পরে এটিকে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্তমানে এই স্থানটিতে সাপ্তাহিক বাজার বসে।
স্থাপত্য ও নকশা
বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে যে মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায় তার মাঝে বেশ পরিকল্পিত স্থাপত্যশৈলীর ছাপ দেখা যায়। মসজিদটির চারপাশ উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মসজিদটির মাঝখানের চ‚ড়াটি একটি উঁচু স্তম্ভের মতো দেখা যায়। এর দেয়ালে এবং ছাদে অনেকগুলো ছিদ্র রাখা হয়েছে যেন গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট আলো-বাতাস পাওয়া যায়। এর বাইরের অংশের ৩টি উঁচু মিনার মসজিদটিকে অসম্ভব সুন্দর ছন্দময় দৃশ্য উপহার দেয়। এতে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বর্তমানে মসজিদটির সঙ্গে একটি শৌচাগার সংযুক্ত রয়েছে। আরও আছে নারীদের জন্য নামাজের আলাদা স্থান।
মসজিদে এখন আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে লাউড স্পিকার সিস্টেম। ১৯৯০-এর দশকে মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্ধনের জন্য বহির্বিশ্বে বেশ প্রশংসা কুড়ায় দরিদ্র দেশ মালি।
মসজিদের দেয়ালগুলো ইটের মতো এক ধরনের মাটির টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো রোদে শুকানো। এর ওপর মাটির আবরণ দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ভবনের দেয়ালগুলোতে তালগাছের পাতার কাÐ দিয়ে বিশেষ নকশা করা হয়েছে। প্রতি বছর মসজিদের নির্মাণকাজে এই কাÐগুলো বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। কারণ এগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই শ্রমিকরা কাজ করে। ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মসজিদের ভিত্তিভ‚মিটি দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুই দিকেই ৭৫ মিটার করে। সমতল থেকে এই ভ‚মি প্রায় ১০ ফুট উঁচু। ওই অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলা বানি নদী প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হলে যেন মসজিদের কোনো ক্ষতি না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। উত্তর দিক দিয়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদের ভেতরে যেখানে নামাজ পড়া হয় সেই অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২৬ মিটার।
স্থানীয়দের উৎসব
মসজিদটিকে ঘিরে জেনি অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক’ প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য গ্রামের মানুষ সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। উৎসবে স্থানীয় সব মানুষই আনন্দের সঙ্গে অংশ নেয়। তখন রাজমিস্ত্রির সংগঠন গ্রামের লোকদের একত্রিত করে নাইজার এবং বানি নদী থেকে মাটি আহরণ করা শুরু করে। সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটি সংগ্রহের কাজে। এদিকে, গান বাজনার দল গান গেয়ে সকলকে বিনোদন দিতে থাকে। আর গৃহস্থ মেয়েদের কাজ হলো মাটির মিশ্রণ তৈরিতে পানি সরবরাহ করা। এভাবে কাদামাটির মিশ্রণ তৈরি করার পর মসজিদের দেয়াল জুড়ে প্রলেপ লাগানোর কাজ শুরু হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী মাটির মসজিদকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করে। উৎসবের সময়ে বাইরের কিছু পর্যটক সবসময় চেয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব খাটাতে। আবার অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী মসজিদটিকে কংক্রিটের মসজিদ করে দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে। কিন্তু জেনি সম্প্রদায়বাসী তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী। তারা কোনোপ্রকার প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করে এখনো সমুন্নত রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম মাটির মসজিদটিকে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদ এবং মসজিদের চারপাশের গ্রামটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ
মধ্যযুগে আফ্রিকার এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক পথ এবং এর বিস্তৃত সংস্কৃতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে জেনিতে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে, যাদের অধিকাংশই মুসলমান। অনেক কাল আগে থেকেই এ অঞ্চলটি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মসজিদটি। অসংখ্য শিক্ষার্থী কুরআন শেখার জন্য এই মসজিদে ভিড় করত। এখনো এই মসজিদে নিয়মিত কুরআন পাঠদান করা হয়।
কাদামাটির এ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ মোটেও সহজসাধ্য নয়। জেনি গ্রামে রাজমিস্ত্রিদের সংগঠনটি পুরো গ্রামের মাটির ঘরবাড়ি তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন। এই সংগঠনই মূলত মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে কর্মরত থাকে। কিন্তু খুব বড় আকৃতির স্থাপনা হওয়ায় প্রায় সময় কিছু না কিছু মেরামত হতেই হয়। উপযুক্ত লোক এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এই কাজ দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে জেনিবাসীর জন্য। স্বাভাবিকভাবে এর সঙ্গে খরচের ব্যাপারটিও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামবাসীর অদম্য ভালোবাসা এবং ধর্মীয় অনুভব মসজিদটিকে এখনো বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে।
১৯৯৬ সালে এই মসজিদের ভেতরে বিশ্বখ্যাত ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের একটি ফটোশ্যুট করা হয় মসজিদের ভেতরে। মসজিদের ভেতরে স্বল্পবসনা নারী মডেলের উপস্থিতির জন্য সে-সময় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল স্থানীয়দের মধ্যে। তার পর থেকেই এই মসজিদে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের আলোচিত সিনেমা ‘সাহারা’তেও মসজিদটিকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে।