আজারবাইজান : যে মাটিতে আগুন জ্বলে
আরফাতুন নাবিলা | ২১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
আর্মেনিয়া, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যবর্তী একটি দেশ আজারবাইজান। দেশটির বিভিন্ন এলাকার মাটিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলার ঘটনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে আগুন জ্বলছে এই অঞ্চলে। বৃষ্টি, বাতাস, বরফেও এই আগুন নেভেনি কখনো। হাজার বছর ধরে জ্বলতে থাকা এই অগ্নিভূমি নিয়ে লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
পাহাড়ের গায়ে আগুন
পাহাড়ের গায়ে আগুন জ্বলছে এমন একটি দৃশ্য নিঃসন্দেহে সব দর্শকের জন্যই আগ্রহের একটি বিষয়। দিনের বেলা আগুনের এই রূপ ভালো করে বোঝা না গেলেও রাতে কিংবা শীতের সময় প্রকৃতির এই রহস্য দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। রাতের বেলায় ঘন অন্ধকারের মধ্যে যখন শুধু পাহাড়ের গায়ে আগুন জ্বলতে থাকে তখনই এর আসল রূপ চোখে পড়ে। আর শীতের সময় শ্বেতশুভ্র তুষার যখন মাটি না ছুঁয়েই ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে মিশে যায়, সেই দৃশ্যও মন ছুঁয়ে যায় দর্শনার্থীদের।
আজারবাইজানের অ্যাবশেরন উপদ্বীপে নিরন্তর জ্বলে চলা প্রাচীন পাহাড়ি একটি জায়গার নাম ইয়ানার ড্যাগ। বহুকাল আগে থেকেই এই জায়গাকে ‘অগ্নি পর্বত’ বলা হয়। পর্বতের চেয়ে পাহাড় বললেই সম্ভবত বেশি মানানসই হবে। পাহাড়ের গায়ের ১০ মিটার উচ্চতায় সব সময় জ্বলতে থাকা আগুন সত্যিই বিস্ময়কর। ঐতিহাসিক লেখক মার্কো পোলোও আজারবাইজানের বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
অনেকেই দাবি করেন, ইয়ানার ডাগে এমন একটি স্থান রয়েছে যেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলছে ১৯৫০ সাল থেকে। এই আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, পাহাড়ি এলাকা বলে ওই স্থানে অনেক রাখালই মেষ চড়াতে আসতেন। তাদের মাঝেই কোনো একজন রাখাল না বুঝে অল্প জ্বলতে থাকা আগুনের মাঝে একটি ম্যাচের টুকরো ফেলে দেন। আর তারপর থেকেই এই আগুনের পরিমাণ বেড়ে যায়। মুষলধারে বৃষ্টি, তুষার ঝড় কিংবা বাতাস কোনো কিছুই নেভাতে পারেনি এই আগুন। সারা দিন ধরে আগুন জ্বলার কারণে আশপাশের এলাকাটির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে।
আজারবাইজানকে ‘অগ্নিভূমি’ বলার কারণ
আজারবাইজানের প্রাচীন পার্সিয়ান নাম ‘অতুরপাতাকান’-এর অর্থ ‘যে ভূমিতে আগুন জমা আছে’। বর্তমানে ‘আজার’-এর পার্সিয়ান অর্থ দাঁড়ায় ‘আগুন’। প্রাচীন গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, দেবতার কাছ থেকে আগুন চুরি করে ককেশাস পর্বতে নিয়ে রেখেছিলেন
প্রমিথিউস। আর সে কারণে জিউস তাকে বেঁধে রাখেন। পৌরাণিক সেই গল্প থেকেই মূলত আজারবাইজান নামটি এসেছে।
প্রায় চার হাজার বছর ধরে দেশটির বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলছে। মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলসমৃদ্ধ দেশটির অনেক স্থানেই এই ধরনের আগুনের দেখা মেলে।
এক সময় দেশটিতে এই ধরনের জ্বলন্ত আগুনের ঘটনা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে এটি বেশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে আগুনের ঘটনা বেশ কমে এসেছে। এখনো টিকে থাকা এই ধরনের আগুনগুলোরই একটি হলো ‘ইয়ানার ড্যাগ’। চিত্তাকর্ষক এই অগ্নিকুণ্ডটি তাই অনেক পর্যটককেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। স্থানীয় এমনকি বহু বিদেশি পর্যটক আসে এটি দেখতে। প্রতি বছর এখানে গড়ে প্রায় ২৫ হাজার পর্যটক ভ্রমণে আসে। আজারবাইজান ভ্রমণে পর্যটকদের কাছে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে উত্তর দিকে অবস্থিত এই জায়গাটি। পুরো এলাকায় শুধু একটি ক্যাফে ছাড়া তেমন কিছু নেই। চাইলে পাবলিক বাসে করেও সেখানে যাওয়া যায়। পাবলিক বাসে না চড়তে চাইলে মেট্রোরেলও আছে ইয়ানার ডাগে যাওয়ার জন্য।
আগুন জ্বলার কারণ কী?
আজারবাইজানে তেল এবং ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি বড় আধার রয়েছে। রোমানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও তারা আজারবাইজানের এই উপদ্বীপ থেকে তেল উত্তোলন করেছিল। বাইজেন্টাইনদের মতে, পঞ্চম শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ অবধি আজারবাইজানের ইয়ানার ডাগ জ্বলছে।
গ্যাস স্টোভে গ্যাসের মাধ্যমে আগুন কীভাবে জ্বলে আমরা জানি। গ্যাস স্টোভের মাঝে গ্যাস সংরক্ষিত থাকে। যখন নব ঘুরানো হয় তখন গ্যাস বাতাসের সংস্পর্শে আসে। তাতে আগুন দিলেই জ্বলে ওঠে। আগুনের জ্বালানি মূলত এই গ্যাসই। যতক্ষণ এই জ্বালানি বেরুতে থাকবে ততক্ষণ আগুনও জ্বলতে থাকবে। গ্যাসের কারণে আজারবাইজানের পাহাড় আর অগ্নি মন্দিরের সার্বক্ষণিক আগুন জ্বলতে থাকার রহস্যটাও ঠিক এমনই।
প্রাচীন বিশ্বাস অগ্নিপূজা
ইতিহাসের যে সময়টাতে প্রাচীন জরোস্ট্রিয়ান (অগ্নিপূজক) ধর্মের উপস্থিতি ছিল সে সময় থেকেই আজারবাইজানের আগুনের কথা জানা যায়। শুরুর দিকে এই ধরনের আগুনের খোঁজ পাওয়া যায় ইরানে। পরে খ্রিস্টপূর্বের প্রথম শতকে আজারবাইজানে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
অগ্নিপূজারীরা বিশ্বাস করত, আগুন হচ্ছে মানুষ এবং অপার্থিব পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করার একটি মাধ্যম। শুধু তাই নয়, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি এবং জ্ঞান অর্জন করারও মাধ্যম এটি। এই আগুন শুদ্ধ, জীবন বাঁচিয়ে রাখে এবং পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইতিহাস অনুযায়ী, অগ্নিপূজারীদের জন্য ইয়ানার ডাগ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হলেও বর্তমানে দর্শনার্থীরা এখানে পূজার জন্য আসেন না। তারা আসেন শুধু প্রাচীন এই জায়গাটা ঘুরে দেখতে।
আতিশগহ অগ্নি মন্দির
আজারবাইজানের অগ্নিপূজার ইতিহাস অনেক দর্শনার্থী খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চান। ইতিহাসপ্রেমীরা তাই এখানে চলে আসেন। সেই অগ্নি ইতিহাস জানতে বাকুতে আছে ‘আতিশগহ অগ্নি মন্দির’। বাকু থেকে পশ্চিম দিকে সুরাখানি শহরে গেলেই এই মন্দিরের দেখা মেলে। পার্সিয়ান শিলালিপির ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই মন্দিরে হিন্দু, শিখ আর অগ্নিপূজকরা উপাসনা করতেন। মন্দির অর্থাৎ পেন্টাগল (পঞ্চকোণী) কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হয়েছিল ১৭ থেকে ১৮ শতকের দিকে। বাকুর ভারতীয় বাসিন্দারা এটি নির্মাণ করেন। প্রাচীনকাল থেকেই তারা ভাবতেন, জায়গাটিতে তাদের ভগবান থাকেন। দশম শতক বা তারও আগে থেকে আগুনের পূজা হয়ে আসছিল। আতিশগহ নামটি এসেছে পার্সিয়ান শব্দ ‘আগুনের ঘর’ থেকে। এই কমপ্লেক্সের একটি বেদীতে প্রাকৃতিক গ্যাসযুক্ত একটি গম্বুজের ওপর আগুন জ্বালানো আছে। ১৯৬৯ সাল থেকে এই জায়গাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে আগুন জ্বলত। কিন্তু বর্তমানে এই আগুন জ্বলে বাকুর প্রধান গ্যাস সরবরাহ করার জায়গা থেকে। আর এটি শুধু দর্শনার্থীদের জন্য। মন্দিরে অগ্নিপূজকদের নিয়ম মানা হলেও ইতিহাস মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় হিসেবেই এটির ব্যবহার ছিল।
ভ্রমণকারীদের কথা মাথায় রেখে মন্দিরটির গঠন করা হয়েছিল সরাইখানার মতো করে। চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা আর মাঝেখানে মন্দির। দেয়ালঘেরা জায়গায় মোট ২৪টি কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহার করা হয় পথিকদের জন্য। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাদের যাত্রাপথে বিরতি নিতে হয়। তারা এখানে এসে বিশ্রাম নেন। কেউ কেউ রাতেও থাকেন। তাদের দেওয়া অনুদান এই জায়গার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়। আরও আসেন ভারী মালা পরিহিত স্থানীয় সাধু-সন্ন্যাসীরা। ১৯ শতকের শেষের দিকে মন্দিরটি থেকে পূজা করার বিষয়টি উঠে যায়। সে সময়ই তেল বিষয়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয় জোরালোভাবে।
বলা যায়, ধনীরা তখন আরও বেশি ধনী হওয়ার পথ খুঁজে পান। কমপ্লেক্সটিকে ১৯৭৫ সালে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কোর বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী জায়গা হিসেবে এই কমপ্লেক্সের নাম উঠে আসে। প্রতি বছর এখানে প্রায় ২৫ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।
রঙিন আজারবাইজান
আকাশ থেকে নিচের দিকে তাকালে যদি দেখতে পান আকাশ ছোঁয়া একটি ভবনে লাল, নীল, কমলা এক কথায় রঙিন আলো শোভা পাচ্ছে তখন বুঝবেন আপনি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে পৌঁছে গেছেন। শহরটির অনেক মানুষের কাছে উঁচু দালানের দেখা পাওয়া মানেই বাড়ি ফিরে আসা। সুউচ্চ এই ভবনটির নাম ‘ফ্লেম টাওয়ার’। শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই এই ভবনটি দেখা যায়। আর রাত হলে যেন মনে হয় শহরে প্রাণ ফিরে এসেছে।
আজারবাইজানকে বলা হয় ‘এ ল্যান্ড অব ম্যাজিক কালার্স’। এর অর্থ ‘জাদুর রঙের দেশ’। এই সেøাগানটি দেয় দেশটির পর্যটন বিভাগ। বিশ্ববাসীর কাছে রঙিন এই শহরটি বেশ সুপরিচিত। আজারবাইজান এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এটি কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত রাষ্ট্র। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া। এছাড়াও ছিটমহল নাখশিভানের মাধ্যমে তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের একচিলতে সীমান্ত আছে। আর্মেনিয়ার পর্বতের একটি সরু সারি নাখশিভান ও আজারবাইজানকে পৃথক করেছে। আজারবাইজানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে আর্মেনীয়-অধ্যুষিত এলাকা নাগোর্নো-কারাবাখের আনুগত্য বিতর্কিত। কাস্পিয়ান সাগরে অবস্থিত অনেকগুলো দ্বীপও আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত। আজারবাইজানের রাষ্ট্রভাষা আজারবাইজানি। এখানে মূলত শিয়া মুসলিম ধর্মাবলম্বী আজেরি জাতির লোকদের বাস। কাস্পিয়ান সাগরতীরে অবস্থিত বন্দর শহর বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
ইতিহাস ও সংস্কৃতি
আজারবাইজানের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। প্রাচীনকাল থেকে বছরের পর বছর ধরে যে রীতি চলে আসছে তার অনেকটাই তারা আজও নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছেন। এর মাঝে একটি চায়ের পরিবেশন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই চায়ের সঙ্গে আজারবাইজানিদের একটি সম্পর্ক আছে। বাড়িতে মেহমান এলে তাদের প্রথম আপ্যায়নই থাকে চা। শুরুতেই অতিথিকে এক কাপ ব্ল্যাক টি-এর সঙ্গে একটি চিনির কিউব দেওয়া হয়। বলা হয়, অতীতে যে কোনো পানীয় পান করার আগে এই চিনির কিউব তাতে ফেলা হতো। বিশেষ করে যখন কোনো রাজ্যের শাসকের মধ্যে খাবারে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা কাজ করত। তখন পানীয়তে এই চিনির কিউব দেওয়ার পরীক্ষা শুরু হয়। যদি কিউবের রং বদলে যেত তাহলে বোঝা হতো তাতে বিষ মেশানো আছে। পুরনো সেই ধারা এখনো বিদ্যমান। তবে এখন মৃত্যুভয় থেকে নয়, শুধুমাত্র পরিবেশনার জন্যই এই পদ্ধতি মানা হয়।
আজারবাইজানের প্রাচীন সংস্কৃতির মাঝে উল্লেখযোগ্য আরেকটি হচ্ছে কার্পেট বোনা। এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে কার্পেট বোনার এই ধারা চলে আসছে। পুরুষেরা ভেড়ার শরীর থেকে তুলা ছাড়ায় আর নারীরা সেই তুলাকে শুকিয়ে, সুতা বুনে কার্পেট সেলাই করে। বেশিরভাগ তুলা তৈরি হয় সবুজ, লাল, হলুদ, ক্রিম আর নীল রঙের মিশেলে। প্রতিটি কার্পেটের বুনন শিল্প, নকশা আলাদা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে প্রতিটি বুননের একটি করে গল্প আছে।
১৮ ও ১৯ শতকে ককেশীয় এই দেশটি পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্য দেশের শাসনাধীন ছিল। রুশ গৃহযুদ্ধকালীন ১৯১৮ সালের ২৮ মে তৎকালীন আজারবাইজানের উত্তর অংশটি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু মাত্র ২ বছরের মাথায় ১৯২০ সালে বলশেভিক লাল সেনারা এটি আক্রমণ করে আবার রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং ১৯২২ সালে দেশটি আন্তঃককেশীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই আজারবাইজানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকার খ্রিস্টান আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। নাগোর্নো-কারাবাখের জনগণ আর্মেনিয়ার সঙ্গে একত্রিত হতে চায়। ১৯৯১ সালের ২০ অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করলে এই দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে নতুনভাবে স্বাধীন দেশটির প্রথম বছরগুলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবনতি, এবং নাগোর্নো-কারাবাখের যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। ১৯৯৪ সালের মে মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনীয়রা যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়। এখনো নাগোর্নো-কারাবাখ ও আরও ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে। ১৯৯৫ সালে আজারবাইজানে প্রথম আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বছরই সোভিয়েত পরবর্তী নতুন সংবিধান পাস করা হয়।
আজারবাইজানের বাকু তেলক্ষেত্রগুলো বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দুর্নীতি, সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ এবং দুর্বল সরকারের কারণে দেশটি খনিজ সম্পদ থেকে সম্ভাব্য মুনাফা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
শেয়ার করুন
আরফাতুন নাবিলা | ২১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০

আর্মেনিয়া, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যবর্তী একটি দেশ আজারবাইজান। দেশটির বিভিন্ন এলাকার মাটিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলার ঘটনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে আগুন জ্বলছে এই অঞ্চলে। বৃষ্টি, বাতাস, বরফেও এই আগুন নেভেনি কখনো। হাজার বছর ধরে জ্বলতে থাকা এই অগ্নিভূমি নিয়ে লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
পাহাড়ের গায়ে আগুন
পাহাড়ের গায়ে আগুন জ্বলছে এমন একটি দৃশ্য নিঃসন্দেহে সব দর্শকের জন্যই আগ্রহের একটি বিষয়। দিনের বেলা আগুনের এই রূপ ভালো করে বোঝা না গেলেও রাতে কিংবা শীতের সময় প্রকৃতির এই রহস্য দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। রাতের বেলায় ঘন অন্ধকারের মধ্যে যখন শুধু পাহাড়ের গায়ে আগুন জ্বলতে থাকে তখনই এর আসল রূপ চোখে পড়ে। আর শীতের সময় শ্বেতশুভ্র তুষার যখন মাটি না ছুঁয়েই ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে মিশে যায়, সেই দৃশ্যও মন ছুঁয়ে যায় দর্শনার্থীদের।
আজারবাইজানের অ্যাবশেরন উপদ্বীপে নিরন্তর জ্বলে চলা প্রাচীন পাহাড়ি একটি জায়গার নাম ইয়ানার ড্যাগ। বহুকাল আগে থেকেই এই জায়গাকে ‘অগ্নি পর্বত’ বলা হয়। পর্বতের চেয়ে পাহাড় বললেই সম্ভবত বেশি মানানসই হবে। পাহাড়ের গায়ের ১০ মিটার উচ্চতায় সব সময় জ্বলতে থাকা আগুন সত্যিই বিস্ময়কর। ঐতিহাসিক লেখক মার্কো পোলোও আজারবাইজানের বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
অনেকেই দাবি করেন, ইয়ানার ডাগে এমন একটি স্থান রয়েছে যেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলছে ১৯৫০ সাল থেকে। এই আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, পাহাড়ি এলাকা বলে ওই স্থানে অনেক রাখালই মেষ চড়াতে আসতেন। তাদের মাঝেই কোনো একজন রাখাল না বুঝে অল্প জ্বলতে থাকা আগুনের মাঝে একটি ম্যাচের টুকরো ফেলে দেন। আর তারপর থেকেই এই আগুনের পরিমাণ বেড়ে যায়। মুষলধারে বৃষ্টি, তুষার ঝড় কিংবা বাতাস কোনো কিছুই নেভাতে পারেনি এই আগুন। সারা দিন ধরে আগুন জ্বলার কারণে আশপাশের এলাকাটির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে।
আজারবাইজানকে ‘অগ্নিভূমি’ বলার কারণ
আজারবাইজানের প্রাচীন পার্সিয়ান নাম ‘অতুরপাতাকান’-এর অর্থ ‘যে ভূমিতে আগুন জমা আছে’। বর্তমানে ‘আজার’-এর পার্সিয়ান অর্থ দাঁড়ায় ‘আগুন’। প্রাচীন গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, দেবতার কাছ থেকে আগুন চুরি করে ককেশাস পর্বতে নিয়ে রেখেছিলেন
প্রমিথিউস। আর সে কারণে জিউস তাকে বেঁধে রাখেন। পৌরাণিক সেই গল্প থেকেই মূলত আজারবাইজান নামটি এসেছে।
প্রায় চার হাজার বছর ধরে দেশটির বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলছে। মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলসমৃদ্ধ দেশটির অনেক স্থানেই এই ধরনের আগুনের দেখা মেলে।
এক সময় দেশটিতে এই ধরনের জ্বলন্ত আগুনের ঘটনা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে এটি বেশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে আগুনের ঘটনা বেশ কমে এসেছে। এখনো টিকে থাকা এই ধরনের আগুনগুলোরই একটি হলো ‘ইয়ানার ড্যাগ’। চিত্তাকর্ষক এই অগ্নিকুণ্ডটি তাই অনেক পর্যটককেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। স্থানীয় এমনকি বহু বিদেশি পর্যটক আসে এটি দেখতে। প্রতি বছর এখানে গড়ে প্রায় ২৫ হাজার পর্যটক ভ্রমণে আসে। আজারবাইজান ভ্রমণে পর্যটকদের কাছে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে উত্তর দিকে অবস্থিত এই জায়গাটি। পুরো এলাকায় শুধু একটি ক্যাফে ছাড়া তেমন কিছু নেই। চাইলে পাবলিক বাসে করেও সেখানে যাওয়া যায়। পাবলিক বাসে না চড়তে চাইলে মেট্রোরেলও আছে ইয়ানার ডাগে যাওয়ার জন্য।
আগুন জ্বলার কারণ কী?
আজারবাইজানে তেল এবং ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি বড় আধার রয়েছে। রোমানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও তারা আজারবাইজানের এই উপদ্বীপ থেকে তেল উত্তোলন করেছিল। বাইজেন্টাইনদের মতে, পঞ্চম শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ অবধি আজারবাইজানের ইয়ানার ডাগ জ্বলছে।
গ্যাস স্টোভে গ্যাসের মাধ্যমে আগুন কীভাবে জ্বলে আমরা জানি। গ্যাস স্টোভের মাঝে গ্যাস সংরক্ষিত থাকে। যখন নব ঘুরানো হয় তখন গ্যাস বাতাসের সংস্পর্শে আসে। তাতে আগুন দিলেই জ্বলে ওঠে। আগুনের জ্বালানি মূলত এই গ্যাসই। যতক্ষণ এই জ্বালানি বেরুতে থাকবে ততক্ষণ আগুনও জ্বলতে থাকবে। গ্যাসের কারণে আজারবাইজানের পাহাড় আর অগ্নি মন্দিরের সার্বক্ষণিক আগুন জ্বলতে থাকার রহস্যটাও ঠিক এমনই।
প্রাচীন বিশ্বাস অগ্নিপূজা
ইতিহাসের যে সময়টাতে প্রাচীন জরোস্ট্রিয়ান (অগ্নিপূজক) ধর্মের উপস্থিতি ছিল সে সময় থেকেই আজারবাইজানের আগুনের কথা জানা যায়। শুরুর দিকে এই ধরনের আগুনের খোঁজ পাওয়া যায় ইরানে। পরে খ্রিস্টপূর্বের প্রথম শতকে আজারবাইজানে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
অগ্নিপূজারীরা বিশ্বাস করত, আগুন হচ্ছে মানুষ এবং অপার্থিব পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করার একটি মাধ্যম। শুধু তাই নয়, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি এবং জ্ঞান অর্জন করারও মাধ্যম এটি। এই আগুন শুদ্ধ, জীবন বাঁচিয়ে রাখে এবং পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইতিহাস অনুযায়ী, অগ্নিপূজারীদের জন্য ইয়ানার ডাগ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হলেও বর্তমানে দর্শনার্থীরা এখানে পূজার জন্য আসেন না। তারা আসেন শুধু প্রাচীন এই জায়গাটা ঘুরে দেখতে।
আতিশগহ অগ্নি মন্দির
আজারবাইজানের অগ্নিপূজার ইতিহাস অনেক দর্শনার্থী খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চান। ইতিহাসপ্রেমীরা তাই এখানে চলে আসেন। সেই অগ্নি ইতিহাস জানতে বাকুতে আছে ‘আতিশগহ অগ্নি মন্দির’। বাকু থেকে পশ্চিম দিকে সুরাখানি শহরে গেলেই এই মন্দিরের দেখা মেলে। পার্সিয়ান শিলালিপির ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই মন্দিরে হিন্দু, শিখ আর অগ্নিপূজকরা উপাসনা করতেন। মন্দির অর্থাৎ পেন্টাগল (পঞ্চকোণী) কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হয়েছিল ১৭ থেকে ১৮ শতকের দিকে। বাকুর ভারতীয় বাসিন্দারা এটি নির্মাণ করেন। প্রাচীনকাল থেকেই তারা ভাবতেন, জায়গাটিতে তাদের ভগবান থাকেন। দশম শতক বা তারও আগে থেকে আগুনের পূজা হয়ে আসছিল। আতিশগহ নামটি এসেছে পার্সিয়ান শব্দ ‘আগুনের ঘর’ থেকে। এই কমপ্লেক্সের একটি বেদীতে প্রাকৃতিক গ্যাসযুক্ত একটি গম্বুজের ওপর আগুন জ্বালানো আছে। ১৯৬৯ সাল থেকে এই জায়গাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে আগুন জ্বলত। কিন্তু বর্তমানে এই আগুন জ্বলে বাকুর প্রধান গ্যাস সরবরাহ করার জায়গা থেকে। আর এটি শুধু দর্শনার্থীদের জন্য। মন্দিরে অগ্নিপূজকদের নিয়ম মানা হলেও ইতিহাস মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় হিসেবেই এটির ব্যবহার ছিল।
ভ্রমণকারীদের কথা মাথায় রেখে মন্দিরটির গঠন করা হয়েছিল সরাইখানার মতো করে। চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা আর মাঝেখানে মন্দির। দেয়ালঘেরা জায়গায় মোট ২৪টি কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহার করা হয় পথিকদের জন্য। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাদের যাত্রাপথে বিরতি নিতে হয়। তারা এখানে এসে বিশ্রাম নেন। কেউ কেউ রাতেও থাকেন। তাদের দেওয়া অনুদান এই জায়গার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়। আরও আসেন ভারী মালা পরিহিত স্থানীয় সাধু-সন্ন্যাসীরা। ১৯ শতকের শেষের দিকে মন্দিরটি থেকে পূজা করার বিষয়টি উঠে যায়। সে সময়ই তেল বিষয়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয় জোরালোভাবে।
বলা যায়, ধনীরা তখন আরও বেশি ধনী হওয়ার পথ খুঁজে পান। কমপ্লেক্সটিকে ১৯৭৫ সালে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কোর বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী জায়গা হিসেবে এই কমপ্লেক্সের নাম উঠে আসে। প্রতি বছর এখানে প্রায় ২৫ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।
রঙিন আজারবাইজান
আকাশ থেকে নিচের দিকে তাকালে যদি দেখতে পান আকাশ ছোঁয়া একটি ভবনে লাল, নীল, কমলা এক কথায় রঙিন আলো শোভা পাচ্ছে তখন বুঝবেন আপনি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে পৌঁছে গেছেন। শহরটির অনেক মানুষের কাছে উঁচু দালানের দেখা পাওয়া মানেই বাড়ি ফিরে আসা। সুউচ্চ এই ভবনটির নাম ‘ফ্লেম টাওয়ার’। শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই এই ভবনটি দেখা যায়। আর রাত হলে যেন মনে হয় শহরে প্রাণ ফিরে এসেছে।
আজারবাইজানকে বলা হয় ‘এ ল্যান্ড অব ম্যাজিক কালার্স’। এর অর্থ ‘জাদুর রঙের দেশ’। এই সেøাগানটি দেয় দেশটির পর্যটন বিভাগ। বিশ্ববাসীর কাছে রঙিন এই শহরটি বেশ সুপরিচিত। আজারবাইজান এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এটি কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত রাষ্ট্র। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া। এছাড়াও ছিটমহল নাখশিভানের মাধ্যমে তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের একচিলতে সীমান্ত আছে। আর্মেনিয়ার পর্বতের একটি সরু সারি নাখশিভান ও আজারবাইজানকে পৃথক করেছে। আজারবাইজানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে আর্মেনীয়-অধ্যুষিত এলাকা নাগোর্নো-কারাবাখের আনুগত্য বিতর্কিত। কাস্পিয়ান সাগরে অবস্থিত অনেকগুলো দ্বীপও আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত। আজারবাইজানের রাষ্ট্রভাষা আজারবাইজানি। এখানে মূলত শিয়া মুসলিম ধর্মাবলম্বী আজেরি জাতির লোকদের বাস। কাস্পিয়ান সাগরতীরে অবস্থিত বন্দর শহর বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
ইতিহাস ও সংস্কৃতি
আজারবাইজানের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। প্রাচীনকাল থেকে বছরের পর বছর ধরে যে রীতি চলে আসছে তার অনেকটাই তারা আজও নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছেন। এর মাঝে একটি চায়ের পরিবেশন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই চায়ের সঙ্গে আজারবাইজানিদের একটি সম্পর্ক আছে। বাড়িতে মেহমান এলে তাদের প্রথম আপ্যায়নই থাকে চা। শুরুতেই অতিথিকে এক কাপ ব্ল্যাক টি-এর সঙ্গে একটি চিনির কিউব দেওয়া হয়। বলা হয়, অতীতে যে কোনো পানীয় পান করার আগে এই চিনির কিউব তাতে ফেলা হতো। বিশেষ করে যখন কোনো রাজ্যের শাসকের মধ্যে খাবারে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা কাজ করত। তখন পানীয়তে এই চিনির কিউব দেওয়ার পরীক্ষা শুরু হয়। যদি কিউবের রং বদলে যেত তাহলে বোঝা হতো তাতে বিষ মেশানো আছে। পুরনো সেই ধারা এখনো বিদ্যমান। তবে এখন মৃত্যুভয় থেকে নয়, শুধুমাত্র পরিবেশনার জন্যই এই পদ্ধতি মানা হয়।
আজারবাইজানের প্রাচীন সংস্কৃতির মাঝে উল্লেখযোগ্য আরেকটি হচ্ছে কার্পেট বোনা। এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে কার্পেট বোনার এই ধারা চলে আসছে। পুরুষেরা ভেড়ার শরীর থেকে তুলা ছাড়ায় আর নারীরা সেই তুলাকে শুকিয়ে, সুতা বুনে কার্পেট সেলাই করে। বেশিরভাগ তুলা তৈরি হয় সবুজ, লাল, হলুদ, ক্রিম আর নীল রঙের মিশেলে। প্রতিটি কার্পেটের বুনন শিল্প, নকশা আলাদা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে প্রতিটি বুননের একটি করে গল্প আছে।
১৮ ও ১৯ শতকে ককেশীয় এই দেশটি পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্য দেশের শাসনাধীন ছিল। রুশ গৃহযুদ্ধকালীন ১৯১৮ সালের ২৮ মে তৎকালীন আজারবাইজানের উত্তর অংশটি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু মাত্র ২ বছরের মাথায় ১৯২০ সালে বলশেভিক লাল সেনারা এটি আক্রমণ করে আবার রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং ১৯২২ সালে দেশটি আন্তঃককেশীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই আজারবাইজানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকার খ্রিস্টান আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। নাগোর্নো-কারাবাখের জনগণ আর্মেনিয়ার সঙ্গে একত্রিত হতে চায়। ১৯৯১ সালের ২০ অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করলে এই দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে নতুনভাবে স্বাধীন দেশটির প্রথম বছরগুলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবনতি, এবং নাগোর্নো-কারাবাখের যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। ১৯৯৪ সালের মে মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনীয়রা যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়। এখনো নাগোর্নো-কারাবাখ ও আরও ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে। ১৯৯৫ সালে আজারবাইজানে প্রথম আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বছরই সোভিয়েত পরবর্তী নতুন সংবিধান পাস করা হয়।
আজারবাইজানের বাকু তেলক্ষেত্রগুলো বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দুর্নীতি, সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ এবং দুর্বল সরকারের কারণে দেশটি খনিজ সম্পদ থেকে সম্ভাব্য মুনাফা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।