টিপ্পি দেগ্রে : বাস্তবের এক মোগলি
পরাগ মাঝি | ১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলা চরিত্রগুলোর মধ্যে মোগলি অন্যতম। রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোগলি ছিল এক মানবশিশু। ঘটনাচক্রে ভারতের এক গহিন জঙ্গলে পশুপাখির সঙ্গে বেড়ে ওঠে সে। গল্পের মোগলির চেয়েও কম রোমাঞ্চকর নয় বাস্তবের টিপ্পি দেগ্রের অভিজ্ঞতা। জন্মের পর থেকে আফ্রিকার হিংস্র পশুগুলোর সংস্পর্শে কেটেছে তার জীবনের প্রথম দশ বছর। লিখেছেন পরাগ মাঝি
আফ্রিকায় এক ফরা সি পরিবার
এক ফরাসি দম্পতির ঘরে ১৯৯০ সালের জুনে আফ্রিকার নামিবিয়ায় টিপ্পি দেগ্রের জন্ম। তার বাবা অ্যালেইন দেগ্রে এবং মা সিলভি রবার্ট বন্য পশুপাখিদের ছবি তোলার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও কাজ করেন। পেশাগত কারণেই জঙ্গল থেকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন তারা। অভিনেত্রী টিপ্পি হ্যাদ্রেনের ভক্ত ছিলেন এই দম্পতি। তাই তার নামেই নিজেদের কন্যার নাম রাখেন।
টিপ্পির জন্মের পরই অ্যালেইন আর সিলভি চিন্তা করলেন তাদের কন্যা স্বাভাবিক শিশুদের নয়, বরং কিছুটা বুনো প্রকৃতিতে বেড়ে উঠবে। তাই ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির ছিল অবাধ স্বাধীনতা। আফ্রিকার জলে জঙ্গলে এই স্বাধীনতা তাকে কেবল বুনোই করেনি, বনের অনেক হিংস্র প্রাণীরও বন্ধু হয়ে উঠেছিল সে। জন্মের পর থেকে জীবনের প্রথম দশ বছর এভাবেই কেটেছে তার। এই সময়ের মধ্যে বনের হাতিদের সঙ্গে ছুটোছুটিই শুধু নয়, হিংস্র লিওপার্ডদেরও বন্ধু হয়ে উঠেছিল সে।
নিজের কন্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিলভি বলেছিলেন, ‘সে খুবই ভাগ্যবান যে, জীবনের প্রথম দশ বছর বুনো প্রকৃতি তাকে গড়ে দিয়েছে। আমরা তিন জন এমন একটা এলাকায় থাকতাম যেখানে বনের পশুপাখিদের ছিল অবাধ বিচরণ, আর সেই তুলনায় মানুষ ছিল খুবই কম।’
টেলিগ্রাফকে সিলভি জানান, টিপ্পি যখন সবে কথা বলতে শিখেছে তখনই একটি পাম গাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহরত বিশাল এক হাতিকে দেখে বাবা-মায়ের উদ্দেশে বলেছিল- ‘শান্ত হও। আমরা তাকে ভয় পাইয়ে দিতে যাচ্ছি।’
নির্ভীক এক শিশু
জীবনের শুরুতেই টিপ্পির বাবা-মা বুঝে গিয়েছিলেন তাদের কন্যা নির্ভীক। মোটের ওপর বনের বিশাল আকৃতির প্রাণী থেকে শুরু করে হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে বসবাসকেই সহজ এবং স্বাভাবিক মনে করেছিল টিপ্পি।
টিপ্পি সম্পর্কে সিলভি বলেন, ‘ওইসব প্রাণীর সঙ্গে মানসিকভাবেই সে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে, তাদের নিজের সমবয়সী এবং বন্ধু মনে করত।’
মজার ব্যাপার হলো বনের সবচেয়ে হিংস্র পশুরাই ছিল টিপ্পির সবচেয়ে ভালো বন্ধু। শিশু অবস্থায় বনে বাদাড়ে সে এমনভাবে ঘুরে বেড়াত যেভাবে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় অন্যান্য পশু শাবকরা। মাত্র দশ মাস বয়সেই টিপ্পি হাঁটতে শিখে গিয়েছিল। আর সেই বয়স থেকেই তার ছুটোছুটি। অন্য শিশুদের মনে যেভাবে ভয় কাজ করে ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির মধ্যে এমন কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো- সে এমন জায়গায়ই বেড়ে উঠেছে যেখানে হিংস্র পশুরা সবসময় তাদের শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এই কারণেই টিকে থাকার সব ধরনের কৌশল সে আয়ত্ত করে নিয়েছিল।
বাড়ির বাইরে বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে খেলা করে বেড়ানোর সময় খুব বেশি নাক গলাতেন না টিপ্পির বাবা-মা। তবে, এর মানে এই না যে, তারা সাবধানী ছিলেন না।
একটা ঘটনার কথাই বলা যাক- একবার মুফাসা নামে একটি সিংহশাবকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে টিপ্পির। তাদের প্রথম পরিচয়ের প্রায় এক বছর পর টিপ্পির সঙ্গে তার বাবা-মাও দেখা করতে গিয়েছিলেন মুফাসার সঙ্গে। বন্ধুত্বের খাতিরেই ওই সিংহ শাবকটি ছুটে এসে টিপ্পিকে অভিবাদন জানায়। কিন্তু অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখাতে গিয়ে টিপ্পিকে নখের আঁচড়ও দিয়ে বসে। তাই মুফাসার সঙ্গে মেলামেশায় টিপ্পিকে সাবধান করে দেয় বাবা-মা।
মজার ব্যপার হলো- ভয়ংকর সাপও টিপ্পির সান্নিধ্যে নিরীহ সময় কাটাত। অজগর সাপ তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরত যেন, টিপ্পি তার কত দিনের চেনা!
নিজের কন্যা স্বাভাবিক শিশুর মতো বড় না করে বন্য পরিবেশে বাড়তে দেওয়ার জন্য অ্যালেইন ও সিলভি দম্পতির কোনো দুঃখ নেই। এই ব্যাপারটির জন্য তারা বরং গর্ব করেন। কন্যার প্রথম দশ বছরের অভিজ্ঞতা তাদের কাছে সুখস্মৃতির মতো।
জঙ্গলে টিপ্পির সেরা বন্ধু যারা
মাত্র দেড় বছর বয়সে টিপ্পির সঙ্গে দেখা হয় আবু নামে একটি হাতির। কিন্তু ওই বয়সেই হাতির সঙ্গে ভাব জমে ওঠে তার। এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিলভি জানান, প্রথমবারের মতো হাতির মুখোমুখি হলেও বিশাল এই প্রাণীটিকে দেখে টিপ্পির চেহারায় ভয়ের কোনো চিহ্নই ছিল না। তার বদলে তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় এবং কৌতূহল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবু তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে গেল।
টিপ্পির সঙ্গে শুধু আবু নামে হাতিটিরই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। জিনবি নামে একটি লিওপার্ডের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব জমে ওঠে। হিংস্র এই পশুটির মা মনুষ্য নির্মিত একটি ফাঁদে আটকা পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল। তার পর থেকেই সে স্থানীয় এক কৃষকের আদর যত্নে পরিণত হয়ে ওঠে। টিপ্পির সান্নিধ্য সবসময়ই উপভোগ করত জিনবি। একবার অন্য একটি আদিবাসী শিশুকে আক্রমণ করেছিল লিওপার্ডটি। কিন্তু টিপ্পি তাকে তৎক্ষণাৎ এমনটি করতে নিষেধ করে। টিপ্পির নিষেধাজ্ঞায় সঙ্গে সঙ্গেই শান্ত হয়ে যায় জিনবি। শুধু তাই নয়, লজ্জা পেয়ে কয়েকদিনের জন্য জঙ্গলের ভেতর আত্মগোপন করে সে।
শুধু ওই লিওপার্ডটিই নয়, জঙ্গলের অন্যান্য আরও বেশ কয়েকটি সিংহ এবং বাঘের সঙ্গে টিপ্পির ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। এসব হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানো কিংবা খেলাধুলাই শুধু নয়, তাদের সঙ্গে ঘুমানোরও অভিজ্ঞতা আছে তার। বনের জেব্রারাও এসে ভাব জমাত তার সঙ্গে। বানরের সঙ্গে তার খেলাধুলা আর সময় কাটানো দেখে অন্য প্রাণীরাও হিংসা করত।
আফ্রিকার হাতিকেই বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলজ প্রাণী। ২ থেকে ৭ টন ওজনের ওই হাতিগুলোর উচ্চতা হয় সাধারণত ৮ থেকে ১৩ মিটারের মতো। বিশাল আকারের এই প্রাণীগুলো দল বেঁধে থাকতেই পছন্দ করে। অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্য যে, টিপ্পিকেও ওইসব দুর্ধর্ষ হাতিরা নিজেদের দলভুক্ত মনে করত। দেখা যেত- হাতির পিঠে চড়ে তাদের পালের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে টিপ্পি কিংবা কোনো জলাধারে হাতিদের সঙ্গেই গোসল করতে নেমে গেছে সে।
এটা পরিষ্কার যে, বন্য প্রাণীদের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই যোগাযোগ করতে সক্ষম টিপ্পি। তার এই যোগাযোগের উপায়টি বেশ অভিনব। এ বিষয়ে তার মা বলেন, ‘প্রাণীদের সঙ্গে টিপ্পির যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত।’ এই ক্ষমতার জন্য বন্য প্রাণীরা তাকে বিশ্বাস করত।
বড় বড় আর হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গেই শুধু টিপ্পির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি, অনেক ছোট ছোট প্রাণীর সঙ্গেও তার সখ্য ছিল। যেখানে অন্য শিশুরা সাধারণ একটি ব্যাঙ দেখে স্পর্শ করা তো দূরের কথা ভয়েই আঁতকে ওঠে, সেখানে টিপ্পি আফ্রিকার বড় বড় বুলফ্রগদেরও কোলে নিয়ে আদর করত।
টিপ্পিরা যে এলাকাটিতে থাকত সেখানে বেশ কিছু উটপাখিও ছিল। পারতপক্ষে এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে না। কিন্তু একদিন সিলভি হঠাৎ দেখেন তার কন্যা লিন্ডা নামে একটি বুনো উটপাখির পিঠে চড়ে বসেছে। সিলভি সঙ্গে সঙ্গেই সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখেন। ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানো অবস্থায় টিপ্পির প্রায় সব ছবিই ক্যামেরায় ধারণ করেছে তার বাবা-মা। তবে, ছবি তোলার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ছিল এক ধরনের অনীহা।
টিপ্পির বাবা-মা জানায়, টিপ্পির অসংখ্য ছবির মধ্যে বেশিরভাগই পুরোপুরি বন্য পশুদের সঙ্গে। তবে, এর মধ্যে কিছু পালিত পশুও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় এতিম হয়ে যাওয়া পশু শাবকদের ওই অঞ্চলের কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে এনে লালন পালন করে। মানুষের সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত হলেও হিংস্রতায় এরা কোনো অংশেই কম নয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত এত বুনো প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে টিপ্পিকে কি কখনো আক্রমণের শিকার হতে হয়নি? বলা যায়, সেরকম কোনো অভিজ্ঞতাই হয়নি টিপ্পির। বন্য প্রাণীদের সে যেমন তার কোমল হাত দুটি দিয়ে স্পর্শ করত, ওই সব প্রাণীও তেমনি তার সঙ্গে সতর্ক আচরণ করত। তবে, একবার বেজি জাতীয় প্রাণী মিরাক্যাটের আক্রমণের শিকার হয়েছিল টিপ্পি। আরেকবার একটি বেবুন তার চুল ধরে জোরে টান দিয়েছিল। টিপ্পির মা সিলভি বলেন, ‘বেবুনটি এই কাজটি করেছিল হিংসাকাতর হয়ে। কারণ, অন্য প্রাণীদের সঙ্গে টিপ্পির মেলামেশা তারা পছন্দ করত না।’
স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গেও ভাব
আফ্রিকায় অবস্থানকালে অসংখ্য আদিবাসীর সংস্পর্শে গেছে দেগ্রে পরিবার। তার মধ্যে কালাহারি অঞ্চলের বুশম্যান এবং হিম্বা আদিবাসীদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠেছিল টিপ্পির। এই আদিবাসীরা টিপ্পিকে শুধু তাদের ভাষাই শেখায়নি, একইসঙ্গে তীর-ধনুক চালনা এবং শিকড়-বাকড় খেয়ে বেঁচে থাকার উপায়ও শিখিয়েছে। একবার তার বাবা-মা উত্তর নামিবিয়ায় বুশম্যান আদিবাসীরাই একটি গোত্র স্যান’দের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। সেদিন ওই গোত্রের মানুষের সঙ্গে টিপ্পিকে নিজের মতো করে ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা। গোত্রের অন্য শিশুদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের সঙ্গেই সারাটি দিন কাটিয়ে দেয় সে। গোত্রগুলোর সঙ্গেও মাত্র দুই মিনিটে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলে টিপ্পির। উপজাতি শিশু থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সবাই টিপ্পির সংস্পর্শে দারুণ আনন্দ পেত।
পেশাগত কারণেই টিপ্পির বাবা-মা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছে। সব জায়গায়ই টিপ্পি তার আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেয়েছে। একবার তার বাবা-মা দক্ষিণ আফ্রিকার সিবার্ড আইল্যান্ডে গেলে, সেখানকার পাখিদের সঙ্গেও বেশ ভাব জমে ওঠে টিপ্পির। সে সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর।
টিপ্পির শিক্ষা সাজ-পোশাক
ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির সাজ-পোশাকেও ছিল কিছুটা ভিন্নতা। তার বয়সী মেয়েরা সাধারণত নানা রকম রং-বেরঙের সাজ-পোশাক পরতে ভালোবাসে। কিন্তু টিপ্পির পোশাকের সঙ্গে গল্পের মোগলি চরিত্রটির বেশ মিল রয়েছে। আফ্রিকার রুক্ষ পরিবেশে খোলামেলা পোশাকই সে পছন্দ করত। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় চামড়া দিয়ে তৈরি একধরনের নেংটি ব্যবহার করত সে। তার অন্যান্য সরঞ্জামের মধ্যে স্থানীয় গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি একটি স্যুটকেসও ছিল।
জীবনের প্রথম দশ বছর সে কোনো স্কুলে পড়েনি। এই সময়ের মধ্যে নিজের বুনো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সব শিক্ষাই সে পেয়েছে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তার বয়সী ছেলে-মেয়েরা যা শিখে তার সব শিক্ষাই দিয়েছেন তারা। এছাড়াও বন্য পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও তাকে সচেতন করে তুলেছিল বাবা-মা। বনের পশুপাখিদের কাছ থেকেও সে অনেক কিছু শিখেছে। যেমন- কচ্ছপের কাছ থেকে সে একাগ্রতা আর ধৈর্যের পাঠ নিয়েছে।
শৈশবের বেশিরভাগ সময় বুনো পরিবেশে কাটানোর পর আসে টিপ্পির মূলধারার মানব সমাজে ফেরার পালা। দশ বছর বয়সে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ফ্রান্সে ফিরে আসে। তবে, এই সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয় সে। ফ্রান্সের প্যারিসে তারা একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করত। সেখানে টিপ্পির সঙ্গী বলতে ছিল শুধু একটি কুকুর। বিস্তীর্ণ বনভূমিতে বড় হওয়া টিপ্পির কাছে শহরের জীবনটিকে খুব কোণঠাসা মনে হতো। নতুন জীবনের প্রথম দুই বছর তার জন্য খুব কঠিন সময় ছিল। প্যারিসের একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। স্কুলের অন্য শিশুদের চিন্তার সঙ্গে তার চিন্তার ছিল আকাশ-পাতাল ফারাক। মেয়ের নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে একটি বাডজি পাখি কিনে এনেছিল টিপ্পির বাবা-মা। শহুরে জীবনে ওই পাখিটা টিপ্পির এতটাই ভক্ত হয়েছিল যে, একজন অন্যজনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যায় তারা।
১২ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে আরও একবার আফ্রিকায় গিয়েছিল টিপ্পি। সেখানে ডিসকভারি চ্যানেলের একটি ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিল সিলভি ও অ্যালেইন দম্পতি। পুরনো পরিবেশ আর পুরনো বন্ধুদের মাঝে ফিরে দারুণ অভিভূত হয়ে পড়ে সে। কারণ হাতির দল, সিংহ কিংবা লিওপার্ডরাও তাকে ভুলে যায়নি। আনন্দের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল ওইসব পশুর মাঝেও।
এদিকে, টিপ্পির বুনো জীবনের কথা যখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখন সবাই তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাকে নিয়ে নির্মিত হতে থাকে একের পর এক তথ্যচিত্র। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় তাকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘লে মুন্দে সেলোন টিপ্পি’ বা ‘যেভাবে পৃথিবীকে দেখে টিপ্পি’। ২০০২ সালে মুক্তি পায় ‘টিপ্পি অ্যান আফ্রিক’ এবং ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ড উইথ টিপ্পি’ মুক্তি পায় ২০০৪ সালে।
বর্তমানে টিপ্পি
১৯৯০ সালে জন্ম নেওয়া টিপ্পি এখন ৩০ ছুঁই ছুঁই এক পরিপূর্ণ নারী। স্কুল পাস করে প্যারিসের লা সরবোন ন্যুভিল্লে ইউনিভার্সিটিতে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ডকুমেন্টারি ফিল্ম নিয়ে কাজ করছেন। প্যারিসে বসবাস করলেও ফাঁক পেলেই ছুটে যান নামিবিয়ায়। পুরনো সঙ্গীদের এখন অনেকেই নেই। তবু নামিবিয়াকেই নিজের বাড়ি মনে করেন তিনি।
২০০৪ সালে ‘অ্যারাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড উইথ টিপ্পি’ মুক্তি পাওয়ার পরই তাকে নিয়ে সাড়া পড়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। কিন্তু তিনি চান না তাকে নিয়ে এমন আলোচনা হোক। নিজেকে ক্যামেরার আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন। বর্তমানে ক্যামেরার পেছনে কাজ করতেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজ করে তার ক্যামেরা। ডিসকভারি চ্যানেলের হয়ে প্রায় সময়ই তিনি আফ্রিকায় ছুটে যান বন্য প্রাণীদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। ওইসব অঞ্চলের আদিবাসী মানুষদের নিয়েও কাজ করছেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘টিপ্পি, মাই বুক অব আফ্রিকা’ বইটি।
মাত্র দশ বছর বয়সে নিজের একটি ওয়েবসাইট চালু করেছিলেন টিপ্পি। এই সাইটে নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি টিপ্পি। আমি আফ্রিকান এবং দশ বছর আগে আমি নামিবিয়ায় জন্মেছিলাম।’
শেয়ার করুন
পরাগ মাঝি | ১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলা চরিত্রগুলোর মধ্যে মোগলি অন্যতম। রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোগলি ছিল এক মানবশিশু। ঘটনাচক্রে ভারতের এক গহিন জঙ্গলে পশুপাখির সঙ্গে বেড়ে ওঠে সে। গল্পের মোগলির চেয়েও কম রোমাঞ্চকর নয় বাস্তবের টিপ্পি দেগ্রের অভিজ্ঞতা। জন্মের পর থেকে আফ্রিকার হিংস্র পশুগুলোর সংস্পর্শে কেটেছে তার জীবনের প্রথম দশ বছর। লিখেছেন পরাগ মাঝি
আফ্রিকায় এক ফরা সি পরিবার
এক ফরাসি দম্পতির ঘরে ১৯৯০ সালের জুনে আফ্রিকার নামিবিয়ায় টিপ্পি দেগ্রের জন্ম। তার বাবা অ্যালেইন দেগ্রে এবং মা সিলভি রবার্ট বন্য পশুপাখিদের ছবি তোলার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও কাজ করেন। পেশাগত কারণেই জঙ্গল থেকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন তারা। অভিনেত্রী টিপ্পি হ্যাদ্রেনের ভক্ত ছিলেন এই দম্পতি। তাই তার নামেই নিজেদের কন্যার নাম রাখেন।
টিপ্পির জন্মের পরই অ্যালেইন আর সিলভি চিন্তা করলেন তাদের কন্যা স্বাভাবিক শিশুদের নয়, বরং কিছুটা বুনো প্রকৃতিতে বেড়ে উঠবে। তাই ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির ছিল অবাধ স্বাধীনতা। আফ্রিকার জলে জঙ্গলে এই স্বাধীনতা তাকে কেবল বুনোই করেনি, বনের অনেক হিংস্র প্রাণীরও বন্ধু হয়ে উঠেছিল সে। জন্মের পর থেকে জীবনের প্রথম দশ বছর এভাবেই কেটেছে তার। এই সময়ের মধ্যে বনের হাতিদের সঙ্গে ছুটোছুটিই শুধু নয়, হিংস্র লিওপার্ডদেরও বন্ধু হয়ে উঠেছিল সে।
নিজের কন্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিলভি বলেছিলেন, ‘সে খুবই ভাগ্যবান যে, জীবনের প্রথম দশ বছর বুনো প্রকৃতি তাকে গড়ে দিয়েছে। আমরা তিন জন এমন একটা এলাকায় থাকতাম যেখানে বনের পশুপাখিদের ছিল অবাধ বিচরণ, আর সেই তুলনায় মানুষ ছিল খুবই কম।’
টেলিগ্রাফকে সিলভি জানান, টিপ্পি যখন সবে কথা বলতে শিখেছে তখনই একটি পাম গাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহরত বিশাল এক হাতিকে দেখে বাবা-মায়ের উদ্দেশে বলেছিল- ‘শান্ত হও। আমরা তাকে ভয় পাইয়ে দিতে যাচ্ছি।’
নির্ভীক এক শিশু
জীবনের শুরুতেই টিপ্পির বাবা-মা বুঝে গিয়েছিলেন তাদের কন্যা নির্ভীক। মোটের ওপর বনের বিশাল আকৃতির প্রাণী থেকে শুরু করে হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে বসবাসকেই সহজ এবং স্বাভাবিক মনে করেছিল টিপ্পি।
টিপ্পি সম্পর্কে সিলভি বলেন, ‘ওইসব প্রাণীর সঙ্গে মানসিকভাবেই সে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে, তাদের নিজের সমবয়সী এবং বন্ধু মনে করত।’
মজার ব্যাপার হলো বনের সবচেয়ে হিংস্র পশুরাই ছিল টিপ্পির সবচেয়ে ভালো বন্ধু। শিশু অবস্থায় বনে বাদাড়ে সে এমনভাবে ঘুরে বেড়াত যেভাবে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় অন্যান্য পশু শাবকরা। মাত্র দশ মাস বয়সেই টিপ্পি হাঁটতে শিখে গিয়েছিল। আর সেই বয়স থেকেই তার ছুটোছুটি। অন্য শিশুদের মনে যেভাবে ভয় কাজ করে ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির মধ্যে এমন কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো- সে এমন জায়গায়ই বেড়ে উঠেছে যেখানে হিংস্র পশুরা সবসময় তাদের শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এই কারণেই টিকে থাকার সব ধরনের কৌশল সে আয়ত্ত করে নিয়েছিল।
বাড়ির বাইরে বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে খেলা করে বেড়ানোর সময় খুব বেশি নাক গলাতেন না টিপ্পির বাবা-মা। তবে, এর মানে এই না যে, তারা সাবধানী ছিলেন না।
একটা ঘটনার কথাই বলা যাক- একবার মুফাসা নামে একটি সিংহশাবকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে টিপ্পির। তাদের প্রথম পরিচয়ের প্রায় এক বছর পর টিপ্পির সঙ্গে তার বাবা-মাও দেখা করতে গিয়েছিলেন মুফাসার সঙ্গে। বন্ধুত্বের খাতিরেই ওই সিংহ শাবকটি ছুটে এসে টিপ্পিকে অভিবাদন জানায়। কিন্তু অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখাতে গিয়ে টিপ্পিকে নখের আঁচড়ও দিয়ে বসে। তাই মুফাসার সঙ্গে মেলামেশায় টিপ্পিকে সাবধান করে দেয় বাবা-মা।
মজার ব্যপার হলো- ভয়ংকর সাপও টিপ্পির সান্নিধ্যে নিরীহ সময় কাটাত। অজগর সাপ তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরত যেন, টিপ্পি তার কত দিনের চেনা!
নিজের কন্যা স্বাভাবিক শিশুর মতো বড় না করে বন্য পরিবেশে বাড়তে দেওয়ার জন্য অ্যালেইন ও সিলভি দম্পতির কোনো দুঃখ নেই। এই ব্যাপারটির জন্য তারা বরং গর্ব করেন। কন্যার প্রথম দশ বছরের অভিজ্ঞতা তাদের কাছে সুখস্মৃতির মতো।
জঙ্গলে টিপ্পির সেরা বন্ধু যারা
মাত্র দেড় বছর বয়সে টিপ্পির সঙ্গে দেখা হয় আবু নামে একটি হাতির। কিন্তু ওই বয়সেই হাতির সঙ্গে ভাব জমে ওঠে তার। এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিলভি জানান, প্রথমবারের মতো হাতির মুখোমুখি হলেও বিশাল এই প্রাণীটিকে দেখে টিপ্পির চেহারায় ভয়ের কোনো চিহ্নই ছিল না। তার বদলে তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় এবং কৌতূহল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবু তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে গেল।
টিপ্পির সঙ্গে শুধু আবু নামে হাতিটিরই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। জিনবি নামে একটি লিওপার্ডের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব জমে ওঠে। হিংস্র এই পশুটির মা মনুষ্য নির্মিত একটি ফাঁদে আটকা পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল। তার পর থেকেই সে স্থানীয় এক কৃষকের আদর যত্নে পরিণত হয়ে ওঠে। টিপ্পির সান্নিধ্য সবসময়ই উপভোগ করত জিনবি। একবার অন্য একটি আদিবাসী শিশুকে আক্রমণ করেছিল লিওপার্ডটি। কিন্তু টিপ্পি তাকে তৎক্ষণাৎ এমনটি করতে নিষেধ করে। টিপ্পির নিষেধাজ্ঞায় সঙ্গে সঙ্গেই শান্ত হয়ে যায় জিনবি। শুধু তাই নয়, লজ্জা পেয়ে কয়েকদিনের জন্য জঙ্গলের ভেতর আত্মগোপন করে সে।
শুধু ওই লিওপার্ডটিই নয়, জঙ্গলের অন্যান্য আরও বেশ কয়েকটি সিংহ এবং বাঘের সঙ্গে টিপ্পির ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। এসব হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানো কিংবা খেলাধুলাই শুধু নয়, তাদের সঙ্গে ঘুমানোরও অভিজ্ঞতা আছে তার। বনের জেব্রারাও এসে ভাব জমাত তার সঙ্গে। বানরের সঙ্গে তার খেলাধুলা আর সময় কাটানো দেখে অন্য প্রাণীরাও হিংসা করত।
আফ্রিকার হাতিকেই বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলজ প্রাণী। ২ থেকে ৭ টন ওজনের ওই হাতিগুলোর উচ্চতা হয় সাধারণত ৮ থেকে ১৩ মিটারের মতো। বিশাল আকারের এই প্রাণীগুলো দল বেঁধে থাকতেই পছন্দ করে। অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্য যে, টিপ্পিকেও ওইসব দুর্ধর্ষ হাতিরা নিজেদের দলভুক্ত মনে করত। দেখা যেত- হাতির পিঠে চড়ে তাদের পালের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে টিপ্পি কিংবা কোনো জলাধারে হাতিদের সঙ্গেই গোসল করতে নেমে গেছে সে।
এটা পরিষ্কার যে, বন্য প্রাণীদের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই যোগাযোগ করতে সক্ষম টিপ্পি। তার এই যোগাযোগের উপায়টি বেশ অভিনব। এ বিষয়ে তার মা বলেন, ‘প্রাণীদের সঙ্গে টিপ্পির যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত।’ এই ক্ষমতার জন্য বন্য প্রাণীরা তাকে বিশ্বাস করত।
বড় বড় আর হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গেই শুধু টিপ্পির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি, অনেক ছোট ছোট প্রাণীর সঙ্গেও তার সখ্য ছিল। যেখানে অন্য শিশুরা সাধারণ একটি ব্যাঙ দেখে স্পর্শ করা তো দূরের কথা ভয়েই আঁতকে ওঠে, সেখানে টিপ্পি আফ্রিকার বড় বড় বুলফ্রগদেরও কোলে নিয়ে আদর করত।
টিপ্পিরা যে এলাকাটিতে থাকত সেখানে বেশ কিছু উটপাখিও ছিল। পারতপক্ষে এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে না। কিন্তু একদিন সিলভি হঠাৎ দেখেন তার কন্যা লিন্ডা নামে একটি বুনো উটপাখির পিঠে চড়ে বসেছে। সিলভি সঙ্গে সঙ্গেই সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখেন। ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানো অবস্থায় টিপ্পির প্রায় সব ছবিই ক্যামেরায় ধারণ করেছে তার বাবা-মা। তবে, ছবি তোলার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ছিল এক ধরনের অনীহা।
টিপ্পির বাবা-মা জানায়, টিপ্পির অসংখ্য ছবির মধ্যে বেশিরভাগই পুরোপুরি বন্য পশুদের সঙ্গে। তবে, এর মধ্যে কিছু পালিত পশুও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় এতিম হয়ে যাওয়া পশু শাবকদের ওই অঞ্চলের কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে এনে লালন পালন করে। মানুষের সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত হলেও হিংস্রতায় এরা কোনো অংশেই কম নয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত এত বুনো প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে টিপ্পিকে কি কখনো আক্রমণের শিকার হতে হয়নি? বলা যায়, সেরকম কোনো অভিজ্ঞতাই হয়নি টিপ্পির। বন্য প্রাণীদের সে যেমন তার কোমল হাত দুটি দিয়ে স্পর্শ করত, ওই সব প্রাণীও তেমনি তার সঙ্গে সতর্ক আচরণ করত। তবে, একবার বেজি জাতীয় প্রাণী মিরাক্যাটের আক্রমণের শিকার হয়েছিল টিপ্পি। আরেকবার একটি বেবুন তার চুল ধরে জোরে টান দিয়েছিল। টিপ্পির মা সিলভি বলেন, ‘বেবুনটি এই কাজটি করেছিল হিংসাকাতর হয়ে। কারণ, অন্য প্রাণীদের সঙ্গে টিপ্পির মেলামেশা তারা পছন্দ করত না।’
স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গেও ভাব
আফ্রিকায় অবস্থানকালে অসংখ্য আদিবাসীর সংস্পর্শে গেছে দেগ্রে পরিবার। তার মধ্যে কালাহারি অঞ্চলের বুশম্যান এবং হিম্বা আদিবাসীদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠেছিল টিপ্পির। এই আদিবাসীরা টিপ্পিকে শুধু তাদের ভাষাই শেখায়নি, একইসঙ্গে তীর-ধনুক চালনা এবং শিকড়-বাকড় খেয়ে বেঁচে থাকার উপায়ও শিখিয়েছে। একবার তার বাবা-মা উত্তর নামিবিয়ায় বুশম্যান আদিবাসীরাই একটি গোত্র স্যান’দের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। সেদিন ওই গোত্রের মানুষের সঙ্গে টিপ্পিকে নিজের মতো করে ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা। গোত্রের অন্য শিশুদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের সঙ্গেই সারাটি দিন কাটিয়ে দেয় সে। গোত্রগুলোর সঙ্গেও মাত্র দুই মিনিটে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলে টিপ্পির। উপজাতি শিশু থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সবাই টিপ্পির সংস্পর্শে দারুণ আনন্দ পেত।
পেশাগত কারণেই টিপ্পির বাবা-মা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছে। সব জায়গায়ই টিপ্পি তার আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেয়েছে। একবার তার বাবা-মা দক্ষিণ আফ্রিকার সিবার্ড আইল্যান্ডে গেলে, সেখানকার পাখিদের সঙ্গেও বেশ ভাব জমে ওঠে টিপ্পির। সে সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর।
টিপ্পির শিক্ষা সাজ-পোশাক
ছোটবেলা থেকেই টিপ্পির সাজ-পোশাকেও ছিল কিছুটা ভিন্নতা। তার বয়সী মেয়েরা সাধারণত নানা রকম রং-বেরঙের সাজ-পোশাক পরতে ভালোবাসে। কিন্তু টিপ্পির পোশাকের সঙ্গে গল্পের মোগলি চরিত্রটির বেশ মিল রয়েছে। আফ্রিকার রুক্ষ পরিবেশে খোলামেলা পোশাকই সে পছন্দ করত। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় চামড়া দিয়ে তৈরি একধরনের নেংটি ব্যবহার করত সে। তার অন্যান্য সরঞ্জামের মধ্যে স্থানীয় গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি একটি স্যুটকেসও ছিল।
জীবনের প্রথম দশ বছর সে কোনো স্কুলে পড়েনি। এই সময়ের মধ্যে নিজের বুনো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সব শিক্ষাই সে পেয়েছে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তার বয়সী ছেলে-মেয়েরা যা শিখে তার সব শিক্ষাই দিয়েছেন তারা। এছাড়াও বন্য পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও তাকে সচেতন করে তুলেছিল বাবা-মা। বনের পশুপাখিদের কাছ থেকেও সে অনেক কিছু শিখেছে। যেমন- কচ্ছপের কাছ থেকে সে একাগ্রতা আর ধৈর্যের পাঠ নিয়েছে।
শৈশবের বেশিরভাগ সময় বুনো পরিবেশে কাটানোর পর আসে টিপ্পির মূলধারার মানব সমাজে ফেরার পালা। দশ বছর বয়সে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ফ্রান্সে ফিরে আসে। তবে, এই সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয় সে। ফ্রান্সের প্যারিসে তারা একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করত। সেখানে টিপ্পির সঙ্গী বলতে ছিল শুধু একটি কুকুর। বিস্তীর্ণ বনভূমিতে বড় হওয়া টিপ্পির কাছে শহরের জীবনটিকে খুব কোণঠাসা মনে হতো। নতুন জীবনের প্রথম দুই বছর তার জন্য খুব কঠিন সময় ছিল। প্যারিসের একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। স্কুলের অন্য শিশুদের চিন্তার সঙ্গে তার চিন্তার ছিল আকাশ-পাতাল ফারাক। মেয়ের নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে একটি বাডজি পাখি কিনে এনেছিল টিপ্পির বাবা-মা। শহুরে জীবনে ওই পাখিটা টিপ্পির এতটাই ভক্ত হয়েছিল যে, একজন অন্যজনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যায় তারা।
১২ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে আরও একবার আফ্রিকায় গিয়েছিল টিপ্পি। সেখানে ডিসকভারি চ্যানেলের একটি ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিল সিলভি ও অ্যালেইন দম্পতি। পুরনো পরিবেশ আর পুরনো বন্ধুদের মাঝে ফিরে দারুণ অভিভূত হয়ে পড়ে সে। কারণ হাতির দল, সিংহ কিংবা লিওপার্ডরাও তাকে ভুলে যায়নি। আনন্দের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল ওইসব পশুর মাঝেও।
এদিকে, টিপ্পির বুনো জীবনের কথা যখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখন সবাই তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাকে নিয়ে নির্মিত হতে থাকে একের পর এক তথ্যচিত্র। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় তাকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘লে মুন্দে সেলোন টিপ্পি’ বা ‘যেভাবে পৃথিবীকে দেখে টিপ্পি’। ২০০২ সালে মুক্তি পায় ‘টিপ্পি অ্যান আফ্রিক’ এবং ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ড উইথ টিপ্পি’ মুক্তি পায় ২০০৪ সালে।
বর্তমানে টিপ্পি
১৯৯০ সালে জন্ম নেওয়া টিপ্পি এখন ৩০ ছুঁই ছুঁই এক পরিপূর্ণ নারী। স্কুল পাস করে প্যারিসের লা সরবোন ন্যুভিল্লে ইউনিভার্সিটিতে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ডকুমেন্টারি ফিল্ম নিয়ে কাজ করছেন। প্যারিসে বসবাস করলেও ফাঁক পেলেই ছুটে যান নামিবিয়ায়। পুরনো সঙ্গীদের এখন অনেকেই নেই। তবু নামিবিয়াকেই নিজের বাড়ি মনে করেন তিনি।
২০০৪ সালে ‘অ্যারাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড উইথ টিপ্পি’ মুক্তি পাওয়ার পরই তাকে নিয়ে সাড়া পড়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। কিন্তু তিনি চান না তাকে নিয়ে এমন আলোচনা হোক। নিজেকে ক্যামেরার আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন। বর্তমানে ক্যামেরার পেছনে কাজ করতেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজ করে তার ক্যামেরা। ডিসকভারি চ্যানেলের হয়ে প্রায় সময়ই তিনি আফ্রিকায় ছুটে যান বন্য প্রাণীদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। ওইসব অঞ্চলের আদিবাসী মানুষদের নিয়েও কাজ করছেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘টিপ্পি, মাই বুক অব আফ্রিকা’ বইটি।
মাত্র দশ বছর বয়সে নিজের একটি ওয়েবসাইট চালু করেছিলেন টিপ্পি। এই সাইটে নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি টিপ্পি। আমি আফ্রিকান এবং দশ বছর আগে আমি নামিবিয়ায় জন্মেছিলাম।’