বিশ্বভ্রমণে চ্যাম্পিয়ন নেলি ব্লি
পরাগ মাঝি | ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
উনিশ শতকের নারী নেলি ব্লি ছিলেন একজন মার্কিন সাংবাদিক। অনেকেই বলেছিলেন, জুলভার্নের সৃষ্টি করা চরিত্র ফিলিয়াস ফগের মতো মাত্র ৮০ দিনে পুরো দুনিয়াটা চক্কর দেওয়া এই নারীর পক্ষে অসম্ভব। ১৮৯০ সালে নেলি সেই অসম্ভবকে শুধু সম্ভবই করেননি, পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে গোল পৃথিবীটাকে চক্কর দিয়ে আসতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৭২ দিন! লিখেছেন পরাগ মাঝি
জুলভার্নের ফিলিয়াস ফগই অনুপ্রেরণা
১৮৬৯ সালে আমেরিকায় চালু হয় প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় রেললাইন। তবে এ লাইনের বিস্তৃতি তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বছরই ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগ স্থাপিত হয় সুয়েজ খাল খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এক বছর পর ভারতীয় রেললাইন পুরো উপমহাদেশে বিস্তৃত হয়। তাই এমন পরিস্থিতিতে জুলভার্নের সেই কাল্পনিক কাহিনী তথা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ সত্যি সত্যিই সম্ভব কি না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
সেই আমলে মাত্র ৮০ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসার সেই রোমাঞ্চকর কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ফিলিয়াস ফগ নামে এক ব্রিটিশ, যিনি লন্ডনে বাস করতেন। ধনী এ মানুষটির সবকিছু ছিল মাপা মাপা। জেদ আর আত্মসম্মানবোধটাও বেশ টনটনে। প্রতিদিন নিয়ম করে লন্ডনের এক ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। এক দিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার সময় পত্রিকার একটা রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সবচেয়ে কম কত দিনে বিশ্ব ভ্রমণ করা সম্ভব। সেদিনের সেই আলোচনা শেষ পর্যন্ত তর্কে গড়াল।
এদিকে ফিলিয়াস সাত-পাঁচ না ভেবেই দুম করে বলে বসলেন, পুরো পৃথিবী মাত্র আশি দিনের মধ্যেই চক্কর দিতে পারবেন তিনি। এ ধরনের আড্ডায় সাধারণত যেমনটি হয়Ñ ফিলিয়াসের কয়েক বন্ধু তার সঙ্গে ২ হাজার ডলার বাজি ধরে বসলেন। সেই আমলে এই পরিমাণ ডলারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। আর সেই সময়ে মাত্র ৮০ দিনে দুনিয়াটা চক্কর দিয়ে আসা অসম্ভবই মনে করা হতো। অর্থের লোভ নয়, তীক্ষè আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ফিলিয়াস ফগের আঁতে ভীষণ ঘা লেগেছিল। কারণ তার কথাকে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিল। ভীষণ জেদ চেপে গেল তার। দুর্গম, অজানা, অচেনা পথে পদে পদে বিপদের হাতছানি। কিন্তু যা থাকে কপালে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন একরোখা ফিলিয়াস। আগপিছ না ভেবে, শর্ত অনুযায়ী চাকরকে নিয়ে পরদিনই যাত্রা শুরু করলেন তিনি। এরপর শুরু হলো একটানা রুদ্ধশ্বাস দুঃসাহসী সব অভিযান। কখনো বেলুনে, কখনো জাহাজে, কখনো হাতির পিঠে কখনোবা স্রেফ হেঁটে তিনি একসময় ভারতে পৌঁছান এবং সেখানে এক অসহায় মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। পরে সে মেয়েটিও তার সফরসঙ্গী হয়। এরপর প্রাণ হাতে নিয়ে একে একে পার হতে থাকেন সাংহাই, প্রশান্ত মহাসাগর, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লিভারপুল, আয়ারল্যান্ড। যাত্রাপথে নানা বিপদে জড়িয়ে পড়েন তারা। তবে নাটকীয়ভাবে সেসব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে অবশেষে নিজের শহরে ফিরে আসেন ফিলিয়াস। কিন্তু ততক্ষণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে তার। যদিও অনেক নাটকীয়তার পর জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের শহরে পা রেখেছিলেন তিনি।
জুলভার্নের আলোচিত ওই অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে। যদিও পরবর্তী ১৭ বছরে বাস্তবে এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করেনি কেউ। ১৮৮৯ সালে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন দুজন। মজার ব্যাপার হলোÑ সেই আমলে এমন দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা দুজনই ছিলেন নারী। দুজনই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অভিযান শেষ করেছিলেন, যদিও এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক নেলি ব্লিকে চ্যাম্পিয়ন না বলে কোনো উপায় নেই। কারণ পৃথিবী চক্কর দিতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৭২ দিন।
কে ছিলেন নেলি ব্লি
নেলি ব্লির জন্ম ১৮৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার এক ছোট্ট শহরে। তার বাবা বিচারক মিচেল কোচরানের নামানুসারেই ছোট্ট ওই শহরটির নামকরণ করা হয়। জন্মের পর নেলির নাম রাখা হয় এলিজাবেথ জেন কোচরান। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন ত্রয়োদশতম। ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় তার পেট পুড়ে যায়। পরিচিতরা তাকে ‘পিঙ্ক’ বলে ডাকত। কারণ শৈশবে গোলাপি রঙের পোশাক পরতেই বেশি ভালোবাসতেন নেলি। পরবর্তী জীবনে তিনি একজন অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নেলি ব্লি নামে সাংবাদিকতা শুরু করেন।
মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে নেলির পরিবারে দুর্দশা নেমে এসেছিল। তার মা আরও একটি বিয়ে করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই সম্পর্কটি এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে, তা বিচ্ছেদে গড়ায়। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে নেলিকে শিক্ষক হওয়ার বাসনা জলাঞ্জলি দিতে হয়। ১৮৮০ সালে ১৬ বছর বয়সে পিটার্সবার্গে বসবাস শুরু করেন তিনি। সেখানেই ১৮৮৫ সালে ‘দ্য পিটার্সবার্গ ডিসপ্যাচ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিক্যাল পড়েন, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
‘হোয়াট গার্লস আর গুড ফর’ শিরোনামে ওই আর্টিক্যালটিতে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, চাকরি করা এবং বাড়ির বাইরে অবস্থান করাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন এক লেখক। শুধু তাই নয়, ওই নিবন্ধে কন্যাশিশু হত্যাকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছিলেন লেখক। ছদ্মনামে নিঃসঙ্গ এক এতিম বালিকার পরিচয়ে ওই নিবন্ধের তীব্র সমালোচনা করে ‘দ্য পিটার্সবার্গ ডিসপ্যাচ’ পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন নেলি। পত্রিকাটির সম্পাদক জর্জ ম্যাডেন ওই চিঠি পড়ে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি এটি তার পত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং নেলিকেও পত্রিকার সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ জানান। শুধু তাই নয়, যে নিবন্ধটিতে নারীদের সমালোচনা করা হয়েছিল তার বিপরীতে একটি পূর্ণ নিবন্ধন লেখার আমন্ত্রণ জানানো হয় নেলিকে। পরে তার লেখা ওই নিবন্ধের সূত্র ধরেই পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি পান তিনি। পত্রিকার সম্পাদক জর্জ ম্যাডেন সেই সময়ই তার আসল নামটি বদলে নেলি ব্লি নামটি রেখেছিলেন।
সেই আমলে নারীরা সাধারণত যেসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন যেমনÑ ফ্যাশন, বাগান করা কিংবা থিয়েটারের মতো কোনো বিষয়ে আগ্রহ ছিল না নেলির। এর বদলে তিনি সামাজিক নানা ইস্যু নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তার এসব লেখা কিছু স্বার্থান্বেষী মহলকে অসন্তুষ্ট করে, যারা নেলির সমালোচনাই শুধু নয়, তাকে হুমকিও দিতে শুরু করে। ফলস্বরূপ চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। পরে চলে যান মেক্সিকোতে এবং বিদেশি ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখি চালিয়ে যান। তার এ লেখালেখি ভালোই চলছিল, কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় তখনই যখন তিনি মেক্সিকোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পরফিরিও ডিয়াজের একনায়কতন্ত্রকে কটাক্ষ করতে শুরু করেন। সরকারি কর্র্তৃপক্ষ তাকে মেক্সিকো থেকে বের করে দেয় শেষ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ বা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শুরু করেন নেলি। সে সময় এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন জোসেফ পুলিৎজার। সেখানে ব্ল্যাকওয়েল আইল্যান্ডে অবস্থিত বিখ্যাত একটি মানসিক হাসপাতাল নিয়ে তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সাড়া ফেলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। এভাবে সাংবাদিক মহলে একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন নেলি ব্লি।
১৮৮৭ সালের মধ্যে নিজেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নেলি। সারাজীবন তিনি এ পরিচয়টিই বহন করেছেন। নানা ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার কলম। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীর নানা সমস্যা নিয়েও বিস্তর লিখেছেন। ১৮৮৯ সালেই প্রথম তিনি জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ বা ‘৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ’ উপন্যাসটি পড়েন। এটি পড়েই পৃথিবী চক্কর দেওয়ার পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে এবং পত্রিকার সম্পাদককে তার ইচ্ছার কথা জানান। যদিও সম্পাদক তার কথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দেন।
ফিলিয়াস ফগ হয়ে ওঠা
‘এটা তোমার দ্বারা করা অসম্ভব’ বলেছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জন অ্যা কোকেরিল। নেলিকে তিনি আরও বলেন, ‘তুমি একজন নারী, তাই এ ক্ষেত্রে তোমার একজন অভিভাবক প্রয়োজন। আর তাছাড়া যদি তুমি একাই রওনা হও তবে তোমাকে বিশাল এক ব্যাগ বহন করতে হবে, যেখানে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস থাকবে। পৃথিবী ঘুরে আসা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এটা শুধু কোনো পুরুষই পারবে, আর কেউ নয়।’
সম্পাদকের এমন কথায় আরও জেদ চেপে যায় নেলির। কোকেরিলকে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে। তবে একজন পুরুষকেই আপনি পাঠান। একই দিনে আমিও রওনা হবো এবং তাকে পরাজিত করব।’ নেলির এমন আত্মবিশ্বাস দেখে মন নরম হয় কোকেরিলের। সেই বছরই অভিযানের জন্য বেরিয়ে পড়েন নেলি। ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের নিউজার্সি থেকে একটি বাষ্পচালিত জাহাজে চড়ে বসেন তিনি। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তার পরবর্তী গন্তব্য হলো ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর।
অভিযানে ছোট্ট একটি ব্যাগ সঙ্গে নেন নেলি। ব্যাগটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪১ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ছিল ১৮ সেন্টিমিটার। খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। এসব জিনিসের মধ্যে ছিল- আন্ডারওয়্যার, প্রসাধনী, লেখার সরঞ্জাম, একটি ড্রেসিং গাউন, একটি টেনিস ব্লেজার, চা খাওয়ার জন্য একটি ফ্লাক্স ও কাপ, দুটি ক্যাপ, তিনটি ওড়না, ঘুমানোর জন্য একটি সিøপার, সুই-সুতা এবং তোয়ালে। আত্মরক্ষার জন্য কোনো আগ্নেয়াস্ত্র তিনি সঙ্গে নেননি। এ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার আত্মবিশ্বাস ছিল পুরো পৃথিবী আমাকে সেভাবেই স্বাগত জানাবে যেভাবে আমি তাদের শুভেচ্ছা জানাব।’
২৫ বছর বয়সী একজন নারীর জন্য সেই আমলে এ ধরনের অভিযান সত্যিই এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আটলান্টিক পাড়ি দিতে জাহাজে চড়েই ভীষণ জ¦রে আক্রান্ত হলেন নেলি। অসুস্থ অবস্থায় নিজের রুমে এমনভাবে পড়ে থাকতেন যে জাহাজের ক্যাপ্টেন মাঝেমধ্যে গিয়ে তাকে দেখে আসতেন বেঁচে আছেন কি না। ছয় দিন পর তার জাহাজ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে গিয়ে পৌঁছল। সেখানেই তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটির লন্ডন প্রতিনিধি ট্রাসি গ্রিভস। তিনিই জানালেন, জুলভার্ন নিজেও শুনেছেন যে, তার উপন্যাসে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮০ দিনের মধ্যে পৃথিবী চক্কর দিতে নেলির চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথা। শুধু তাই নয়, যাত্রাপথে নেলির সঙ্গে তিনি একবার সাক্ষাৎও করতে চাইলেন ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে যেখানে তিনি বাস করেন। নেলির কাছে এ প্রস্তাবটি ছিল একই সঙ্গে সম্মান এবং জুয়ার মতো একটি ব্যাপার। তিনি ভাবলেন, দেখা করতে গিয়ে আবার ভ্রমণে দেরি না হয়ে যায়। তার ভ্রমণ রুটে ফ্রান্সও ছিল। টানা দুদিন রেলে চড়ে, রাস্তায় সাধারণ যান ব্যবহার করে, হেঁটে, নৌকায় চড়ে লন্ডন হয়ে প্রথমে বোলোঙ্গে পরে সেখান থেকে অ্যামিয়েন্সে গিয়ে পৌঁছান। সেখানেই একটি স্টেশনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন জুলভার্ন ও তার স্ত্রী। সাক্ষাতের পর মাঝরাতে জুলভার্নের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন নেলি। কারণ ফ্রান্স থেকে ইতালিগামী একটি ট্রেন ছিল রাত দেড়টায়। ইতালির ব্রিনদেসি বন্দর ছিল তার পরের গন্তব্য। সেখানে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া নামে একটি স্টিমারে চড়ে বসেন তিনি। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যা মিসরের পোর্ট সাইদ বন্দরে গিয়ে নোঙর ফেলবে। পরে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে লোহিত সাগর হয়ে আরব উপদ্বীপের বিখ্যাত এডেন বন্দরে গিয়ে পৌঁছেন নেলি। সেখান থেকে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে গিয়ে হাজির হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখান থেকেই দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাকে অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে টেলিগ্রাফ করেন তিনি। আলোচিত এ অভিযান ততদিনে সারা বিশ্বেই সাড়া ফেলেছে। নেলির ভ্রমণ অগ্রগতির নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আলোচনায় ছিল তার পত্রিকা দ্য ওয়ার্ল্ডও।
শ্রীলঙ্কায় বসে যন্ত্রণাদায়ক পাঁচটি দিন কাটে নেলির। তিনি অধীর হয়ে একটি জলযানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যা তাকে সাড়ে তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হংকংয়ে পৌঁছে দেবে। শেষ পর্যন্ত তিনি চীনগামী ওরিয়েন্টাল জাহাজে চড়ে বসেন। এ জাহাজটি সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি দিয়েছিল। সেখানেই একজন ভ্রমণসঙ্গী বেছে নেন নিঃসঙ্গ নেলি। এ ভ্রমণসঙ্গীটি আর কেউ নয়, ম্যাকগিন্টি নামে একটি বানর। সিঙ্গাপুরে একরাত দেরি হয়ে যায় জাহাজটির। তাই কতক্ষণে হংকং পৌঁছবেন সেই চিন্তায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তার। তবে শেষ পর্যন্ত একটি ঝড়ের কবলে পড়েও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে জাহাজটি।
আছে এক প্রতিদ্বন্দ্বীও
পৃথিবী চক্করে দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার শোরগোলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল ‘দ্য কসমোপলিটন’ পত্রিকাও। এ ক্ষেত্রে তারাও একজন নারী অভিযাত্রীকে অভিযানে পাঠায়। সময়ের দিক দিয়ে নেলিকে পরাস্ত করাই যার প্রধান লক্ষ্য। এলিজাবেথ বিজল্যান্ড নামে ২৮ বছর বয়সী ওই নারী এবং নেলি একই দিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাত্রা শুরু করেন। তবে এলিজাবেথ রওনা হয়েছিলেন পশ্চিম দিকে আর নেলি রওনা হন পূর্বদিকে। দুই নারীর এমন প্রতিযোগিতাই অভিযান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যদিও এ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না নেলি। হংকংয়ে পা রাখার পরই তিনি প্রথম জানতে পারেন যে, এলিজাবেথ নামে আরও এক নারী পৃথিবী চক্কর দেওয়ার চ্যালেঞ্জে নেমেছে এবং নেলিকে টেক্কা দেওয়াই তার লক্ষ্য। নেলি এও জানতে পারেন, কয়েক দিন আগেই বিপরীত দিক থেকে এলিজাবেথ হংকংয়ে পৌঁছে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে জাহাজে চড়েছেন। অর্থাৎ যে পথে নেলি এত দূর এসেছেন সেই পথ ধরেই নেলির আগে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে ছুটছেন এলিজাবেথ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে নেলি বলেন, আমি কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে নেই। ৭৫ দিনের মধ্যেই আমি আমার অভিযান শেষ করতে চাই এবং এটা আমি করেই ছাড়ব।’ হংকং থেকে জাপানের ইয়োকোহমাই ছিল নেলির পরের গন্তব্য। এলিজাবেথের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে অস্বীকার করে তিনি এও বলেন, ‘আমি বরং মৃত অবস্থায় নিউ ইয়র্কে পৌঁছব, তবু বিজয়ীর বেশে নয়।’
নেলি কি পেরেছিলেন
নেলির সর্বশেষ নৌভ্রমণটি ছিল নানা বিপদ-আপদে ভরপুর। জাপান থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তার পরের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো। এই পথ পাড়ি দিতে তিনি ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর ‘ওসানিক’ জাহাজে চড়ে বসেন। বিপদ সংকুল পথে ঝড়-ঝাপ্টা পাড়ি দিয়েও ১৮৯০ সালের ২১ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই জাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটির জন্য নেলির এই অভিযান এতটাই গৌরবের ছিল যে, তাকে সান ফ্রান্সিসকো থেকে নিজের শহরে নিয়ে আসার জন্য পত্রিকার প্রকাশক পুলিৎজার একটি ট্রেন ভাড়া করে পাঠিয়েছিলেন। সেই ট্রেনটি মাত্র ৬৯ ঘণ্টায় ২ হাজার ৫৭৭ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নেলিকে নিউ ইয়র্ক শহরে নিয়ে আসে। ১৮৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি বিকেল ৩টা ৫১ মিনিটে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানে পা রাখেন নেলি। হিসাব করে দেখা যায়, পৃথিবীটা চক্কর দিয়ে আসতে তার মোট সময় লেগেছে ৭২ দিন ৬ ঘণ্টা ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। এ ক্ষেত্রে জুলভার্নের কাল্পনিক চরিত্র ফিলিয়াস ফগের চেয়েও সাত দিন আগে অভিযান শেষ করেন তিনি। ফিলিয়াস ফগের সময়কে টেক্কা দিয়েছিলেন নেলির প্রতিদ্বন্দ্বী এলিজাবেথও। যদিও নেলির পাঁচ দিন পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।
শেয়ার করুন
পরাগ মাঝি | ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

উনিশ শতকের নারী নেলি ব্লি ছিলেন একজন মার্কিন সাংবাদিক। অনেকেই বলেছিলেন, জুলভার্নের সৃষ্টি করা চরিত্র ফিলিয়াস ফগের মতো মাত্র ৮০ দিনে পুরো দুনিয়াটা চক্কর দেওয়া এই নারীর পক্ষে অসম্ভব। ১৮৯০ সালে নেলি সেই অসম্ভবকে শুধু সম্ভবই করেননি, পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে গোল পৃথিবীটাকে চক্কর দিয়ে আসতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৭২ দিন! লিখেছেন পরাগ মাঝি
জুলভার্নের ফিলিয়াস ফগই অনুপ্রেরণা
১৮৬৯ সালে আমেরিকায় চালু হয় প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় রেললাইন। তবে এ লাইনের বিস্তৃতি তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বছরই ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগ স্থাপিত হয় সুয়েজ খাল খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এক বছর পর ভারতীয় রেললাইন পুরো উপমহাদেশে বিস্তৃত হয়। তাই এমন পরিস্থিতিতে জুলভার্নের সেই কাল্পনিক কাহিনী তথা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ সত্যি সত্যিই সম্ভব কি না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
সেই আমলে মাত্র ৮০ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসার সেই রোমাঞ্চকর কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ফিলিয়াস ফগ নামে এক ব্রিটিশ, যিনি লন্ডনে বাস করতেন। ধনী এ মানুষটির সবকিছু ছিল মাপা মাপা। জেদ আর আত্মসম্মানবোধটাও বেশ টনটনে। প্রতিদিন নিয়ম করে লন্ডনের এক ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। এক দিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার সময় পত্রিকার একটা রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সবচেয়ে কম কত দিনে বিশ্ব ভ্রমণ করা সম্ভব। সেদিনের সেই আলোচনা শেষ পর্যন্ত তর্কে গড়াল।
এদিকে ফিলিয়াস সাত-পাঁচ না ভেবেই দুম করে বলে বসলেন, পুরো পৃথিবী মাত্র আশি দিনের মধ্যেই চক্কর দিতে পারবেন তিনি। এ ধরনের আড্ডায় সাধারণত যেমনটি হয়Ñ ফিলিয়াসের কয়েক বন্ধু তার সঙ্গে ২ হাজার ডলার বাজি ধরে বসলেন। সেই আমলে এই পরিমাণ ডলারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। আর সেই সময়ে মাত্র ৮০ দিনে দুনিয়াটা চক্কর দিয়ে আসা অসম্ভবই মনে করা হতো। অর্থের লোভ নয়, তীক্ষè আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ফিলিয়াস ফগের আঁতে ভীষণ ঘা লেগেছিল। কারণ তার কথাকে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিল। ভীষণ জেদ চেপে গেল তার। দুর্গম, অজানা, অচেনা পথে পদে পদে বিপদের হাতছানি। কিন্তু যা থাকে কপালে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন একরোখা ফিলিয়াস। আগপিছ না ভেবে, শর্ত অনুযায়ী চাকরকে নিয়ে পরদিনই যাত্রা শুরু করলেন তিনি। এরপর শুরু হলো একটানা রুদ্ধশ্বাস দুঃসাহসী সব অভিযান। কখনো বেলুনে, কখনো জাহাজে, কখনো হাতির পিঠে কখনোবা স্রেফ হেঁটে তিনি একসময় ভারতে পৌঁছান এবং সেখানে এক অসহায় মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। পরে সে মেয়েটিও তার সফরসঙ্গী হয়। এরপর প্রাণ হাতে নিয়ে একে একে পার হতে থাকেন সাংহাই, প্রশান্ত মহাসাগর, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লিভারপুল, আয়ারল্যান্ড। যাত্রাপথে নানা বিপদে জড়িয়ে পড়েন তারা। তবে নাটকীয়ভাবে সেসব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে অবশেষে নিজের শহরে ফিরে আসেন ফিলিয়াস। কিন্তু ততক্ষণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে তার। যদিও অনেক নাটকীয়তার পর জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের শহরে পা রেখেছিলেন তিনি।
জুলভার্নের আলোচিত ওই অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে। যদিও পরবর্তী ১৭ বছরে বাস্তবে এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করেনি কেউ। ১৮৮৯ সালে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন দুজন। মজার ব্যাপার হলোÑ সেই আমলে এমন দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা দুজনই ছিলেন নারী। দুজনই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অভিযান শেষ করেছিলেন, যদিও এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক নেলি ব্লিকে চ্যাম্পিয়ন না বলে কোনো উপায় নেই। কারণ পৃথিবী চক্কর দিতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৭২ দিন।
কে ছিলেন নেলি ব্লি
নেলি ব্লির জন্ম ১৮৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার এক ছোট্ট শহরে। তার বাবা বিচারক মিচেল কোচরানের নামানুসারেই ছোট্ট ওই শহরটির নামকরণ করা হয়। জন্মের পর নেলির নাম রাখা হয় এলিজাবেথ জেন কোচরান। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন ত্রয়োদশতম। ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় তার পেট পুড়ে যায়। পরিচিতরা তাকে ‘পিঙ্ক’ বলে ডাকত। কারণ শৈশবে গোলাপি রঙের পোশাক পরতেই বেশি ভালোবাসতেন নেলি। পরবর্তী জীবনে তিনি একজন অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নেলি ব্লি নামে সাংবাদিকতা শুরু করেন।
মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে নেলির পরিবারে দুর্দশা নেমে এসেছিল। তার মা আরও একটি বিয়ে করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই সম্পর্কটি এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে, তা বিচ্ছেদে গড়ায়। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে নেলিকে শিক্ষক হওয়ার বাসনা জলাঞ্জলি দিতে হয়। ১৮৮০ সালে ১৬ বছর বয়সে পিটার্সবার্গে বসবাস শুরু করেন তিনি। সেখানেই ১৮৮৫ সালে ‘দ্য পিটার্সবার্গ ডিসপ্যাচ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিক্যাল পড়েন, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
‘হোয়াট গার্লস আর গুড ফর’ শিরোনামে ওই আর্টিক্যালটিতে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, চাকরি করা এবং বাড়ির বাইরে অবস্থান করাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন এক লেখক। শুধু তাই নয়, ওই নিবন্ধে কন্যাশিশু হত্যাকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছিলেন লেখক। ছদ্মনামে নিঃসঙ্গ এক এতিম বালিকার পরিচয়ে ওই নিবন্ধের তীব্র সমালোচনা করে ‘দ্য পিটার্সবার্গ ডিসপ্যাচ’ পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন নেলি। পত্রিকাটির সম্পাদক জর্জ ম্যাডেন ওই চিঠি পড়ে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি এটি তার পত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং নেলিকেও পত্রিকার সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ জানান। শুধু তাই নয়, যে নিবন্ধটিতে নারীদের সমালোচনা করা হয়েছিল তার বিপরীতে একটি পূর্ণ নিবন্ধন লেখার আমন্ত্রণ জানানো হয় নেলিকে। পরে তার লেখা ওই নিবন্ধের সূত্র ধরেই পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি পান তিনি। পত্রিকার সম্পাদক জর্জ ম্যাডেন সেই সময়ই তার আসল নামটি বদলে নেলি ব্লি নামটি রেখেছিলেন।
সেই আমলে নারীরা সাধারণত যেসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন যেমনÑ ফ্যাশন, বাগান করা কিংবা থিয়েটারের মতো কোনো বিষয়ে আগ্রহ ছিল না নেলির। এর বদলে তিনি সামাজিক নানা ইস্যু নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তার এসব লেখা কিছু স্বার্থান্বেষী মহলকে অসন্তুষ্ট করে, যারা নেলির সমালোচনাই শুধু নয়, তাকে হুমকিও দিতে শুরু করে। ফলস্বরূপ চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। পরে চলে যান মেক্সিকোতে এবং বিদেশি ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখি চালিয়ে যান। তার এ লেখালেখি ভালোই চলছিল, কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় তখনই যখন তিনি মেক্সিকোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পরফিরিও ডিয়াজের একনায়কতন্ত্রকে কটাক্ষ করতে শুরু করেন। সরকারি কর্র্তৃপক্ষ তাকে মেক্সিকো থেকে বের করে দেয় শেষ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ বা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শুরু করেন নেলি। সে সময় এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন জোসেফ পুলিৎজার। সেখানে ব্ল্যাকওয়েল আইল্যান্ডে অবস্থিত বিখ্যাত একটি মানসিক হাসপাতাল নিয়ে তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সাড়া ফেলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। এভাবে সাংবাদিক মহলে একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন নেলি ব্লি।
১৮৮৭ সালের মধ্যে নিজেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নেলি। সারাজীবন তিনি এ পরিচয়টিই বহন করেছেন। নানা ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার কলম। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীর নানা সমস্যা নিয়েও বিস্তর লিখেছেন। ১৮৮৯ সালেই প্রথম তিনি জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ বা ‘৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ’ উপন্যাসটি পড়েন। এটি পড়েই পৃথিবী চক্কর দেওয়ার পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে এবং পত্রিকার সম্পাদককে তার ইচ্ছার কথা জানান। যদিও সম্পাদক তার কথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দেন।
ফিলিয়াস ফগ হয়ে ওঠা
‘এটা তোমার দ্বারা করা অসম্ভব’ বলেছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জন অ্যা কোকেরিল। নেলিকে তিনি আরও বলেন, ‘তুমি একজন নারী, তাই এ ক্ষেত্রে তোমার একজন অভিভাবক প্রয়োজন। আর তাছাড়া যদি তুমি একাই রওনা হও তবে তোমাকে বিশাল এক ব্যাগ বহন করতে হবে, যেখানে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস থাকবে। পৃথিবী ঘুরে আসা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এটা শুধু কোনো পুরুষই পারবে, আর কেউ নয়।’
সম্পাদকের এমন কথায় আরও জেদ চেপে যায় নেলির। কোকেরিলকে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে। তবে একজন পুরুষকেই আপনি পাঠান। একই দিনে আমিও রওনা হবো এবং তাকে পরাজিত করব।’ নেলির এমন আত্মবিশ্বাস দেখে মন নরম হয় কোকেরিলের। সেই বছরই অভিযানের জন্য বেরিয়ে পড়েন নেলি। ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের নিউজার্সি থেকে একটি বাষ্পচালিত জাহাজে চড়ে বসেন তিনি। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তার পরবর্তী গন্তব্য হলো ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর।
অভিযানে ছোট্ট একটি ব্যাগ সঙ্গে নেন নেলি। ব্যাগটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪১ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ছিল ১৮ সেন্টিমিটার। খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। এসব জিনিসের মধ্যে ছিল- আন্ডারওয়্যার, প্রসাধনী, লেখার সরঞ্জাম, একটি ড্রেসিং গাউন, একটি টেনিস ব্লেজার, চা খাওয়ার জন্য একটি ফ্লাক্স ও কাপ, দুটি ক্যাপ, তিনটি ওড়না, ঘুমানোর জন্য একটি সিøপার, সুই-সুতা এবং তোয়ালে। আত্মরক্ষার জন্য কোনো আগ্নেয়াস্ত্র তিনি সঙ্গে নেননি। এ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার আত্মবিশ্বাস ছিল পুরো পৃথিবী আমাকে সেভাবেই স্বাগত জানাবে যেভাবে আমি তাদের শুভেচ্ছা জানাব।’
২৫ বছর বয়সী একজন নারীর জন্য সেই আমলে এ ধরনের অভিযান সত্যিই এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আটলান্টিক পাড়ি দিতে জাহাজে চড়েই ভীষণ জ¦রে আক্রান্ত হলেন নেলি। অসুস্থ অবস্থায় নিজের রুমে এমনভাবে পড়ে থাকতেন যে জাহাজের ক্যাপ্টেন মাঝেমধ্যে গিয়ে তাকে দেখে আসতেন বেঁচে আছেন কি না। ছয় দিন পর তার জাহাজ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে গিয়ে পৌঁছল। সেখানেই তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটির লন্ডন প্রতিনিধি ট্রাসি গ্রিভস। তিনিই জানালেন, জুলভার্ন নিজেও শুনেছেন যে, তার উপন্যাসে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮০ দিনের মধ্যে পৃথিবী চক্কর দিতে নেলির চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথা। শুধু তাই নয়, যাত্রাপথে নেলির সঙ্গে তিনি একবার সাক্ষাৎও করতে চাইলেন ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে যেখানে তিনি বাস করেন। নেলির কাছে এ প্রস্তাবটি ছিল একই সঙ্গে সম্মান এবং জুয়ার মতো একটি ব্যাপার। তিনি ভাবলেন, দেখা করতে গিয়ে আবার ভ্রমণে দেরি না হয়ে যায়। তার ভ্রমণ রুটে ফ্রান্সও ছিল। টানা দুদিন রেলে চড়ে, রাস্তায় সাধারণ যান ব্যবহার করে, হেঁটে, নৌকায় চড়ে লন্ডন হয়ে প্রথমে বোলোঙ্গে পরে সেখান থেকে অ্যামিয়েন্সে গিয়ে পৌঁছান। সেখানেই একটি স্টেশনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন জুলভার্ন ও তার স্ত্রী। সাক্ষাতের পর মাঝরাতে জুলভার্নের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন নেলি। কারণ ফ্রান্স থেকে ইতালিগামী একটি ট্রেন ছিল রাত দেড়টায়। ইতালির ব্রিনদেসি বন্দর ছিল তার পরের গন্তব্য। সেখানে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া নামে একটি স্টিমারে চড়ে বসেন তিনি। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যা মিসরের পোর্ট সাইদ বন্দরে গিয়ে নোঙর ফেলবে। পরে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে লোহিত সাগর হয়ে আরব উপদ্বীপের বিখ্যাত এডেন বন্দরে গিয়ে পৌঁছেন নেলি। সেখান থেকে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে গিয়ে হাজির হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখান থেকেই দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকাকে অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে টেলিগ্রাফ করেন তিনি। আলোচিত এ অভিযান ততদিনে সারা বিশ্বেই সাড়া ফেলেছে। নেলির ভ্রমণ অগ্রগতির নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আলোচনায় ছিল তার পত্রিকা দ্য ওয়ার্ল্ডও।
শ্রীলঙ্কায় বসে যন্ত্রণাদায়ক পাঁচটি দিন কাটে নেলির। তিনি অধীর হয়ে একটি জলযানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যা তাকে সাড়ে তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হংকংয়ে পৌঁছে দেবে। শেষ পর্যন্ত তিনি চীনগামী ওরিয়েন্টাল জাহাজে চড়ে বসেন। এ জাহাজটি সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি দিয়েছিল। সেখানেই একজন ভ্রমণসঙ্গী বেছে নেন নিঃসঙ্গ নেলি। এ ভ্রমণসঙ্গীটি আর কেউ নয়, ম্যাকগিন্টি নামে একটি বানর। সিঙ্গাপুরে একরাত দেরি হয়ে যায় জাহাজটির। তাই কতক্ষণে হংকং পৌঁছবেন সেই চিন্তায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তার। তবে শেষ পর্যন্ত একটি ঝড়ের কবলে পড়েও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে জাহাজটি।
আছে এক প্রতিদ্বন্দ্বীও
পৃথিবী চক্করে দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার শোরগোলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল ‘দ্য কসমোপলিটন’ পত্রিকাও। এ ক্ষেত্রে তারাও একজন নারী অভিযাত্রীকে অভিযানে পাঠায়। সময়ের দিক দিয়ে নেলিকে পরাস্ত করাই যার প্রধান লক্ষ্য। এলিজাবেথ বিজল্যান্ড নামে ২৮ বছর বয়সী ওই নারী এবং নেলি একই দিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাত্রা শুরু করেন। তবে এলিজাবেথ রওনা হয়েছিলেন পশ্চিম দিকে আর নেলি রওনা হন পূর্বদিকে। দুই নারীর এমন প্রতিযোগিতাই অভিযান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যদিও এ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না নেলি। হংকংয়ে পা রাখার পরই তিনি প্রথম জানতে পারেন যে, এলিজাবেথ নামে আরও এক নারী পৃথিবী চক্কর দেওয়ার চ্যালেঞ্জে নেমেছে এবং নেলিকে টেক্কা দেওয়াই তার লক্ষ্য। নেলি এও জানতে পারেন, কয়েক দিন আগেই বিপরীত দিক থেকে এলিজাবেথ হংকংয়ে পৌঁছে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে জাহাজে চড়েছেন। অর্থাৎ যে পথে নেলি এত দূর এসেছেন সেই পথ ধরেই নেলির আগে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে ছুটছেন এলিজাবেথ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে নেলি বলেন, আমি কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে নেই। ৭৫ দিনের মধ্যেই আমি আমার অভিযান শেষ করতে চাই এবং এটা আমি করেই ছাড়ব।’ হংকং থেকে জাপানের ইয়োকোহমাই ছিল নেলির পরের গন্তব্য। এলিজাবেথের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে অস্বীকার করে তিনি এও বলেন, ‘আমি বরং মৃত অবস্থায় নিউ ইয়র্কে পৌঁছব, তবু বিজয়ীর বেশে নয়।’
নেলি কি পেরেছিলেন
নেলির সর্বশেষ নৌভ্রমণটি ছিল নানা বিপদ-আপদে ভরপুর। জাপান থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তার পরের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো। এই পথ পাড়ি দিতে তিনি ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর ‘ওসানিক’ জাহাজে চড়ে বসেন। বিপদ সংকুল পথে ঝড়-ঝাপ্টা পাড়ি দিয়েও ১৮৯০ সালের ২১ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই জাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটির জন্য নেলির এই অভিযান এতটাই গৌরবের ছিল যে, তাকে সান ফ্রান্সিসকো থেকে নিজের শহরে নিয়ে আসার জন্য পত্রিকার প্রকাশক পুলিৎজার একটি ট্রেন ভাড়া করে পাঠিয়েছিলেন। সেই ট্রেনটি মাত্র ৬৯ ঘণ্টায় ২ হাজার ৫৭৭ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নেলিকে নিউ ইয়র্ক শহরে নিয়ে আসে। ১৮৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি বিকেল ৩টা ৫১ মিনিটে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানে পা রাখেন নেলি। হিসাব করে দেখা যায়, পৃথিবীটা চক্কর দিয়ে আসতে তার মোট সময় লেগেছে ৭২ দিন ৬ ঘণ্টা ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। এ ক্ষেত্রে জুলভার্নের কাল্পনিক চরিত্র ফিলিয়াস ফগের চেয়েও সাত দিন আগে অভিযান শেষ করেন তিনি। ফিলিয়াস ফগের সময়কে টেক্কা দিয়েছিলেন নেলির প্রতিদ্বন্দ্বী এলিজাবেথও। যদিও নেলির পাঁচ দিন পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।