কোথায় আছেন কিম জং উনের ভাতিজা
পরাগ মাঝি | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের বড় ভাই কিম জং নাম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীরও একই পরিণতি হবে এমন আশঙ্কা ছিল অনেকের। মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক সুকি কিম দাবি করেছেন, বর্তমানে সিআইএর নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন কিম জং নামের ছেলে কিম হান-সল। নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত সুকি কিমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন পরাগ মাঝি
কিম জং-নাম ও তার পরিবার
কিম জং উন ও কিম জং নাম ছিলেন একে অপরের সৎ ভাই। উত্তর কোরিয়ার সাবেক একনায়ক কিম জং ইলের বড় ছেলে ছিলেন কিম জং নাম। তাকে পাশ কাটিয়ে ছোট ছেলে কিম জং উনকে দেশটির পরবর্তী নেতা হিসেবে তৈরি করেছিলেন ইল। সে সময় থেকেই পরিবার থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করেন কিছুটা উদার স্বভাবের কিম জং নাম। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি ম্যাকাও, চীন ও সিঙ্গাপুরে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার অন্যতম দাবিদার হলেও বিশ্ব গণমাধ্যমে তিনি কম আলোচিত ছিলেন।
২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার একটি বিমানবন্দরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কিম জং নামকে। বিমানবন্দরের সিসি ফুটেজে দেখা যায়, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার মুখে বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে করে পালিয়ে যায় এক নারী। এরপরই অসুস্থতা বোধ করতে শুরু করেন নাম। পুলিশকে এ ব্যাপারে অবহিত করলেও কিছুক্ষণ পরই বিমানবন্দরের ভেতরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
অভিযোগ ওঠে, উত্তর কোরিয়ার বর্তমান একনায়ক কিম জং উনের নির্দেশেই তার সৎ ভাই কিম জং নামকে হত্যা করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দর থেকে ম্যাকাওগামী একটি বিমানে চড়ার কথা ছিল নামের। ধারণা করা হচ্ছিল, সেই সময়টিতে তার স্ত্রী রি হাই-কিয়ং ও সন্তানরা ম্যাকাওয়ে অবস্থান করছিল। সন্তানদের মধ্যে কিম হান-সলের নামটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কারণ তিনি ছিলেন নামের বড় ছেলে। ফলে বাবার মৃত্যুর পর হান-সলের খোঁজ জানার প্রয়াস চালায় বিভিন্ন গণমাধ্যম। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তার কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি সে সময়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বাবার মতো তাকেও হয়তো হত্যা বা গুম করা হবে। কারণ উত্তর কোরিয়ার পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতাবলয়ে বাবার মতো তিনিও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
কিম হান-সল
নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, ২৫ বছর বয়সী কিম হান-সল এখন মার্কিন গোয়েন্দাদের হেফাজতে রয়েছেন। তবে তার বাবা কিম জং নামের মৃত্যুর পর ‘ফ্রি জোসেওন’ নামে একটি দল তাকে চীন অধিভুক্ত ম্যাকাও থেকে পালাতে সহায়তা করেছিল।
২০০০ সালের দশক থেকেই কিম হান-সলের বাবা কিম জং নাম নির্বাসিত জীবন শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি উত্তর কোরিয়ায় পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ধারণা করা হয়, বাবার মতো কিম হান-সলও খোলা মনের মানুষ। ২০১২ সালে একটি ফিনিশ টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চাচা কিম জং উনকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারেও আশা প্রকাশ করেছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে নির্বাসিত জীবন কাটালেও সেই সময়ে ১৭ বছরের যুবক হান-সল দাবি করেছিলেন, প্রতি গ্রীষ্মেই তিনি উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করেন এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটান।
কিম হান-সলের জন্ম ১৯৯৫ সালে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে। জীবনের প্রথম কয়েক বছর তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন। তবে কিম পরিবারের সদস্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে যাননি কখনোই। পরে তার বাবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর হান-সলের জীবনও বদলে যায়। সর্বশেষ বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে তিনি চীন অধিভুক্ত ম্যাকাওয়ে বসবাস করছিলেন। এর আগে তিনি বসনিয়ার মস্টারে অবস্থিত ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজে পড়াশোনা করেছেন। উত্তর কোরিয়ার বাইরে এসে তিনি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মতামতের সঙ্গে পরিচিত হন। অসংখ্য আমেরিকান ও দক্ষিণ কোরিয়ানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ২০১৩ সালে তিনি ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল সায়েন্সে পড়তে যান। পরিকল্পনা ছিল ২০১৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবেন। কিন্তু সেই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তার বাবাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের এক মাসেরও কম সময় পর ৮ মার্চ একটি ভিডিও বার্তায় হান-সল বলেছিলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এ মুহূর্তে আমি আমার মা ও বোনের সঙ্গে আছি।’ এ সময় তিনি তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ভিডিওতে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক পাসপোর্ট দেখান। বেঁচে থাকার তিনি কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো সংগঠনের নাম উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সেই নামটি প্রকাশের আগেই ভিডিওটি কাট করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঔপন্যাসিক সুকি কিম দাবি করেছেন, হান-সল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে ‘ফ্রি জসেওন’ সংগঠন কিংবা এর প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ানের নাম উচ্চারণ করেছিলেন।
সুকি কিম দাবি করেন, আদ্রিয়ানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হান-সল বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। বিশ্বখ্যাত সব নামিদামি ব্র্যান্ডের জামা-কাপড় ও পণ্য ব্যবহার করতেন। আদ্রিয়ানের সঙ্গে হান-সলের একবারই দেখা হয়েছিল ২০১৩ সালে। এ প্রসঙ্গে আদ্রিয়ান বলেছিলেন, ‘এত পয়সাওয়ালা ছেলে আমি আর কখনোই দেখিনি। টাকার বান্ডিল সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন তিনি। তার পায়ে ছিল বিশ্বখ্যাত গুচি ব্র্যান্ডের জুতো।’
আদ্রিয়ানের ভাষ্য মতে, কিম জং নাম বিপুল পরিমাণ অর্থ লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই অর্থ দিয়েই বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন তার ছেলে হান-সল। পরে বাবার মৃত্যুর পর ম্যাকাও থেকে পালাতে এই অর্থের একটি বড় অংশ খরচ করেন তিনি।
ফ্রি জসেওন ও আদ্রিয়ান হং
ফ্রি জসেওন এমন একটি সংগঠন, যা উত্তর কোরিয়া থেকে একনায়কতন্ত্রের অবসান চায়। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠাকালে সংগঠনটির পূর্বনাম ছিল ‘চেওলিমা সিভিল ডিফেন্স’। উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত ও নির্বাসিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং ঐক্য নিয়ে কাজ করে এই সংগঠনটি। এমনকি উত্তর কোরিয়া থেকে একনায়কতন্ত্র-বিরোধী ব্যক্তিদের পালিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তারা। জানা গেছে, উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত ও পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। এদের বেশির ভাগই দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করছে।
২০১৯ সালের ১ মার্চ সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ফ্রি জসেওন’। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ান হং। আদ্রিয়ানের জন্ম ১৯৮৪ সালে মেক্সিকোর সীমান্ত শহর তিজুয়ানায়। তার বাবা-মা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেখানে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। আদ্রিয়ানের বাবা ছিলেন তায়কোয়ান্দো মাস্টার। পরে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে মিশনারির জীবন বেছে নেন। বাবার কাছ থেকে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন আদ্রিয়ানও। ছয় বছর বয়সে তাকে নিয়ে তার বাবা-মা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে চলে এসেছিলেন।
আদ্রিয়ানের নেতৃত্বেই ‘ফ্রি জসেওন’-এর প্রথম নীতিমালা তৈরি করা হয়। উত্তর কোরিয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করে সংগঠনটি একটি ছায়া সরকারও গঠন করে। এ সরকারে থাকা ব্যক্তিদের সবাই উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত কিংবা পালিয়ে আসা। পরিচয় গোপন করে উত্তর কোরিয়ার ভেতরেও এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা কিম জং উনের পতন চায়। এ ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা দেশ থেকে পালিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করে ‘ফ্রি জসেওন’। সংগঠনের কর্মীরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবার যেভাবে শাসন করছে, সেই অবস্থা থেকে কিম জং উনের পতন ধীরে ধীরে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হুট করে কোনো ক্যুয়ের মাধ্যমেই তার পতন ঘটাতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে ‘ফ্রি জসেওন’।
হান-সল যেভাবে পালিয়ে যান
ফ্রি জসেওনের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ানের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে একবার যোগাযোগ হয়েছিল নিউ ইয়র্কারের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক সুকি কিমের। নতুন করে আবারও পরিচয় ঘটে গত বছর স্পেনে অবস্থিত উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসে একটি সন্ত্রাসী হামলার সূত্র ধরে। আদ্রিয়ান তখন ফেরারি। কারণ তার নেতৃত্বে ফ্রি জসেওনের কর্মীরাই দূতাবাসে প্রবেশ করে ভেতরে থাকা উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের মারপিট করেছিলেন। ফেরারি অবস্থায় আদ্রিয়ানের সঙ্গে দেখা হয় সুকি কিমের। সেই সাক্ষাৎ থেকেই সুকি জানতে পারেন, বাবার হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রি জসেওনের সহযোগিতায় ম্যাকাও থেকে পালিয়েছিলেন কিম হান-সল। পরে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় মার্কিন গোয়েন্দারা।
এ প্রসঙ্গে জানা যায়, কিম জং নাম হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার একটি বারে বসে মদ খাচ্ছিলেন ক্রিস আন নামে এক ব্যক্তি। উত্তর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন সাবেক এই মেরিন সেনা কয়েক সপ্তাহ ধরেই ম্যানিলায় অবস্থান করছিলেন। বারে থাকা অবস্থায়ই বেজে ওঠে তার মুঠোফোনটি। আমেরিকা থেকে তাকে এই কলটি করেছিলেন আদ্রিয়ান। ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। পরে নৌবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর আদ্রিয়ানের হাত ধরে ফ্রি জসেওনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন ক্রিস। আদ্রিয়ান তাকে ফোন করেছিলেন ম্যাকাওয়ে থাকা কিম হাস-সলকে পালাতে সহায়তা করার জন্য।
কিম জং নামের মৃত্যুর পরপরই আদ্রিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিম হান-সল। আদ্রিয়ানকে হান-সল জানান, বাবার মৃত্যুর পরই ম্যাকাওয়ের বাসস্থান পাহারা দেওয়া দুই পুলিশ সদস্য উধাও হয়ে গেছে। বাবার মতো নিজেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কা ছিল হান-সলের। ২০১৩ সালে পরিচয়ের সূত্র ধরেই তিনি জানতেন বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আদ্রিয়ানের বেশ সখ্য রয়েছে। তাই আদ্রিয়ানের কাছে পালিয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণের জন্য সহায়তা চান তিনি।
এদিকে, ক্রিস আনকে ফোন করে যত দ্রুত সম্ভব তাইওয়ানের তাইপে বিমানবন্দরে যাওয়ার নির্দেশ দেন আদ্রিয়ান। সেখানেই মা ও বোনকে নিয়ে হান-সলের যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আদ্রিয়ানের নির্দেশ পেয়েই ফিলিপাইন থেকে তাইওয়ানের পথে রওনা হয়ে যান ক্রিস। তিনি যখন তাইপে বিমানবন্দরে পৌঁছান তখন মাঝরাত। একই বিমানবন্দরে ম্যাকাও থেকে একটি বিমানে চড়ে হান-সল পৌঁছাবেন, এমনই কথা ছিল। তাই অপেক্ষা করতে থাকেন। আদ্রিয়ানের নির্দেশ ছিল হান-সলকে কেউ অনুসরণ করছে কি না তা খতিয়ে দেখা।
ভোরবেলায় তাইপে বিমানবন্দরে পৌঁছে হান-সল এবং তার মা ও বোনকে বহনকারী বিমানটি। তাদের সবার মুখেই তখন মাস্ক পরা ছিল। ধূলিবালি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মাস্কের এমন ব্যবহার প্রায়ই দেখা যায়। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার হান-সলের পরনে ছিল ফুলহাতা শার্ট ও কোট। চাকাওয়ালা একটি স্যুটকেস বহন করছিলেন তিনি। হান-সলের মধ্যবয়স্ক মাকে দেখে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় ক্রিসের। হান-সলের ১৭/১৮ বছর বয়সী বোনটির পরনে ছিল জিনসের পোশাক। আদ্রিয়ান তাদের বলে দিয়েছিলেন, কালো টি-শার্ট আর ডজার্স ক্যাপ পরে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেন ক্রিস। ফলে খুব সহজেই তারা একে অপরকে খুঁজে পায়। ক্রিস তাদের বিমানবন্দরের ভেতর একটি প্রাইভেট কক্ষে নিয়ে যান।
এদিকে, হান-সল ও তার পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য অন্তত তিনটি দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করছিলেন আদ্রিয়ান। সারা দিন অপেক্ষার পর সেদিন সন্ধ্যায় ক্রিসকে ফোন করে আদ্রিয়ান জানান, হান-সল ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে নেদারল্যান্ডস। তাই নেদারল্যান্ডসগামী একটি বিমানের তিনটি টিকিট কাটেন ক্রিস। কিন্তু তাদের পাসপোর্ট নিয়ে কিছুটা ঝামেলার সূত্রপাত হলে সেখানে এসে হাজির হন সিআইএ পরিচয় দেওয়া দুই ব্যক্তি। তাদের একজনের নাম ওয়েস। ততক্ষণে নির্ধারিত বিমানটি নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।
সিআইএ পরিচয় দেওয়া দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না ক্রিস ও হান-সল। সারা দিনের পর সেদিন সারা রাতও তারা বিমানবন্দরের ভেতরে সমস্যা সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা যায়, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বন্দরের কর্মকর্তারাই তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডামগামী আরেকটি বিমানের তিনটি টিকিট করতে পরামর্শ দেন তারা। কিন্তু বিমানে ওঠার আগ মুহূর্তেই দৃশ্যপটে এসে আবারও হাজির হন সিআইএ পরিচয় দেওয়া ওয়েস। ক্রিসকে তিনি বলেন, হান-সল ও তার পরিবারের সঙ্গে তিনিও যাচ্ছেন।
নেদারল্যান্ডসে বিমানবন্দরের গেটের বাইরে হান-সল ও তার পরিবারকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন ফ্রি জসেওনের নিয়োগ করা কয়েকজন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও তারা আর হান-সলের দেখা পায়নি। এর মধ্যে আদ্রিয়ানকে ফোন করে হান-সল জানান, বিমানবন্দরের ভেতরে একটি হোটেলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক খোঁজখবর করার পর আদ্রিয়ান নিশ্চিত হন যে, মার্কিন গোয়েন্দারাই হান-সলকে তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে গেছে। তবে এ মুহূর্তে তারা কোথায় তা অজানা।
শেয়ার করুন
পরাগ মাঝি | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের বড় ভাই কিম জং নাম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীরও একই পরিণতি হবে এমন আশঙ্কা ছিল অনেকের। মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক সুকি কিম দাবি করেছেন, বর্তমানে সিআইএর নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন কিম জং নামের ছেলে কিম হান-সল। নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত সুকি কিমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন পরাগ মাঝি
কিম জং-নাম ও তার পরিবার
কিম জং উন ও কিম জং নাম ছিলেন একে অপরের সৎ ভাই। উত্তর কোরিয়ার সাবেক একনায়ক কিম জং ইলের বড় ছেলে ছিলেন কিম জং নাম। তাকে পাশ কাটিয়ে ছোট ছেলে কিম জং উনকে দেশটির পরবর্তী নেতা হিসেবে তৈরি করেছিলেন ইল। সে সময় থেকেই পরিবার থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করেন কিছুটা উদার স্বভাবের কিম জং নাম। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি ম্যাকাও, চীন ও সিঙ্গাপুরে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার অন্যতম দাবিদার হলেও বিশ্ব গণমাধ্যমে তিনি কম আলোচিত ছিলেন।
২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার একটি বিমানবন্দরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কিম জং নামকে। বিমানবন্দরের সিসি ফুটেজে দেখা যায়, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার মুখে বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে করে পালিয়ে যায় এক নারী। এরপরই অসুস্থতা বোধ করতে শুরু করেন নাম। পুলিশকে এ ব্যাপারে অবহিত করলেও কিছুক্ষণ পরই বিমানবন্দরের ভেতরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
অভিযোগ ওঠে, উত্তর কোরিয়ার বর্তমান একনায়ক কিম জং উনের নির্দেশেই তার সৎ ভাই কিম জং নামকে হত্যা করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দর থেকে ম্যাকাওগামী একটি বিমানে চড়ার কথা ছিল নামের। ধারণা করা হচ্ছিল, সেই সময়টিতে তার স্ত্রী রি হাই-কিয়ং ও সন্তানরা ম্যাকাওয়ে অবস্থান করছিল। সন্তানদের মধ্যে কিম হান-সলের নামটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কারণ তিনি ছিলেন নামের বড় ছেলে। ফলে বাবার মৃত্যুর পর হান-সলের খোঁজ জানার প্রয়াস চালায় বিভিন্ন গণমাধ্যম। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তার কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি সে সময়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বাবার মতো তাকেও হয়তো হত্যা বা গুম করা হবে। কারণ উত্তর কোরিয়ার পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতাবলয়ে বাবার মতো তিনিও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
কিম হান-সল
নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, ২৫ বছর বয়সী কিম হান-সল এখন মার্কিন গোয়েন্দাদের হেফাজতে রয়েছেন। তবে তার বাবা কিম জং নামের মৃত্যুর পর ‘ফ্রি জোসেওন’ নামে একটি দল তাকে চীন অধিভুক্ত ম্যাকাও থেকে পালাতে সহায়তা করেছিল।
২০০০ সালের দশক থেকেই কিম হান-সলের বাবা কিম জং নাম নির্বাসিত জীবন শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি উত্তর কোরিয়ায় পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ধারণা করা হয়, বাবার মতো কিম হান-সলও খোলা মনের মানুষ। ২০১২ সালে একটি ফিনিশ টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চাচা কিম জং উনকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারেও আশা প্রকাশ করেছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে নির্বাসিত জীবন কাটালেও সেই সময়ে ১৭ বছরের যুবক হান-সল দাবি করেছিলেন, প্রতি গ্রীষ্মেই তিনি উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করেন এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটান।
কিম হান-সলের জন্ম ১৯৯৫ সালে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে। জীবনের প্রথম কয়েক বছর তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন। তবে কিম পরিবারের সদস্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে যাননি কখনোই। পরে তার বাবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর হান-সলের জীবনও বদলে যায়। সর্বশেষ বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে তিনি চীন অধিভুক্ত ম্যাকাওয়ে বসবাস করছিলেন। এর আগে তিনি বসনিয়ার মস্টারে অবস্থিত ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজে পড়াশোনা করেছেন। উত্তর কোরিয়ার বাইরে এসে তিনি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মতামতের সঙ্গে পরিচিত হন। অসংখ্য আমেরিকান ও দক্ষিণ কোরিয়ানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ২০১৩ সালে তিনি ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল সায়েন্সে পড়তে যান। পরিকল্পনা ছিল ২০১৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবেন। কিন্তু সেই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তার বাবাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের এক মাসেরও কম সময় পর ৮ মার্চ একটি ভিডিও বার্তায় হান-সল বলেছিলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এ মুহূর্তে আমি আমার মা ও বোনের সঙ্গে আছি।’ এ সময় তিনি তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ভিডিওতে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক পাসপোর্ট দেখান। বেঁচে থাকার তিনি কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো সংগঠনের নাম উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সেই নামটি প্রকাশের আগেই ভিডিওটি কাট করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঔপন্যাসিক সুকি কিম দাবি করেছেন, হান-সল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে ‘ফ্রি জসেওন’ সংগঠন কিংবা এর প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ানের নাম উচ্চারণ করেছিলেন।
সুকি কিম দাবি করেন, আদ্রিয়ানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হান-সল বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। বিশ্বখ্যাত সব নামিদামি ব্র্যান্ডের জামা-কাপড় ও পণ্য ব্যবহার করতেন। আদ্রিয়ানের সঙ্গে হান-সলের একবারই দেখা হয়েছিল ২০১৩ সালে। এ প্রসঙ্গে আদ্রিয়ান বলেছিলেন, ‘এত পয়সাওয়ালা ছেলে আমি আর কখনোই দেখিনি। টাকার বান্ডিল সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন তিনি। তার পায়ে ছিল বিশ্বখ্যাত গুচি ব্র্যান্ডের জুতো।’
আদ্রিয়ানের ভাষ্য মতে, কিম জং নাম বিপুল পরিমাণ অর্থ লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই অর্থ দিয়েই বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন তার ছেলে হান-সল। পরে বাবার মৃত্যুর পর ম্যাকাও থেকে পালাতে এই অর্থের একটি বড় অংশ খরচ করেন তিনি।
ফ্রি জসেওন ও আদ্রিয়ান হং
ফ্রি জসেওন এমন একটি সংগঠন, যা উত্তর কোরিয়া থেকে একনায়কতন্ত্রের অবসান চায়। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠাকালে সংগঠনটির পূর্বনাম ছিল ‘চেওলিমা সিভিল ডিফেন্স’। উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত ও নির্বাসিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং ঐক্য নিয়ে কাজ করে এই সংগঠনটি। এমনকি উত্তর কোরিয়া থেকে একনায়কতন্ত্র-বিরোধী ব্যক্তিদের পালিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তারা। জানা গেছে, উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত ও পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। এদের বেশির ভাগই দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করছে।
২০১৯ সালের ১ মার্চ সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ফ্রি জসেওন’। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ান হং। আদ্রিয়ানের জন্ম ১৯৮৪ সালে মেক্সিকোর সীমান্ত শহর তিজুয়ানায়। তার বাবা-মা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেখানে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। আদ্রিয়ানের বাবা ছিলেন তায়কোয়ান্দো মাস্টার। পরে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে মিশনারির জীবন বেছে নেন। বাবার কাছ থেকে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন আদ্রিয়ানও। ছয় বছর বয়সে তাকে নিয়ে তার বাবা-মা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে চলে এসেছিলেন।
আদ্রিয়ানের নেতৃত্বেই ‘ফ্রি জসেওন’-এর প্রথম নীতিমালা তৈরি করা হয়। উত্তর কোরিয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করে সংগঠনটি একটি ছায়া সরকারও গঠন করে। এ সরকারে থাকা ব্যক্তিদের সবাই উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত কিংবা পালিয়ে আসা। পরিচয় গোপন করে উত্তর কোরিয়ার ভেতরেও এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা কিম জং উনের পতন চায়। এ ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা দেশ থেকে পালিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করে ‘ফ্রি জসেওন’। সংগঠনের কর্মীরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবার যেভাবে শাসন করছে, সেই অবস্থা থেকে কিম জং উনের পতন ধীরে ধীরে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হুট করে কোনো ক্যুয়ের মাধ্যমেই তার পতন ঘটাতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে ‘ফ্রি জসেওন’।
হান-সল যেভাবে পালিয়ে যান
ফ্রি জসেওনের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রিয়ানের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে একবার যোগাযোগ হয়েছিল নিউ ইয়র্কারের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক সুকি কিমের। নতুন করে আবারও পরিচয় ঘটে গত বছর স্পেনে অবস্থিত উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসে একটি সন্ত্রাসী হামলার সূত্র ধরে। আদ্রিয়ান তখন ফেরারি। কারণ তার নেতৃত্বে ফ্রি জসেওনের কর্মীরাই দূতাবাসে প্রবেশ করে ভেতরে থাকা উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের মারপিট করেছিলেন। ফেরারি অবস্থায় আদ্রিয়ানের সঙ্গে দেখা হয় সুকি কিমের। সেই সাক্ষাৎ থেকেই সুকি জানতে পারেন, বাবার হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রি জসেওনের সহযোগিতায় ম্যাকাও থেকে পালিয়েছিলেন কিম হান-সল। পরে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় মার্কিন গোয়েন্দারা।
এ প্রসঙ্গে জানা যায়, কিম জং নাম হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার একটি বারে বসে মদ খাচ্ছিলেন ক্রিস আন নামে এক ব্যক্তি। উত্তর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন সাবেক এই মেরিন সেনা কয়েক সপ্তাহ ধরেই ম্যানিলায় অবস্থান করছিলেন। বারে থাকা অবস্থায়ই বেজে ওঠে তার মুঠোফোনটি। আমেরিকা থেকে তাকে এই কলটি করেছিলেন আদ্রিয়ান। ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। পরে নৌবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর আদ্রিয়ানের হাত ধরে ফ্রি জসেওনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন ক্রিস। আদ্রিয়ান তাকে ফোন করেছিলেন ম্যাকাওয়ে থাকা কিম হাস-সলকে পালাতে সহায়তা করার জন্য।
কিম জং নামের মৃত্যুর পরপরই আদ্রিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিম হান-সল। আদ্রিয়ানকে হান-সল জানান, বাবার মৃত্যুর পরই ম্যাকাওয়ের বাসস্থান পাহারা দেওয়া দুই পুলিশ সদস্য উধাও হয়ে গেছে। বাবার মতো নিজেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কা ছিল হান-সলের। ২০১৩ সালে পরিচয়ের সূত্র ধরেই তিনি জানতেন বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আদ্রিয়ানের বেশ সখ্য রয়েছে। তাই আদ্রিয়ানের কাছে পালিয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণের জন্য সহায়তা চান তিনি।
এদিকে, ক্রিস আনকে ফোন করে যত দ্রুত সম্ভব তাইওয়ানের তাইপে বিমানবন্দরে যাওয়ার নির্দেশ দেন আদ্রিয়ান। সেখানেই মা ও বোনকে নিয়ে হান-সলের যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আদ্রিয়ানের নির্দেশ পেয়েই ফিলিপাইন থেকে তাইওয়ানের পথে রওনা হয়ে যান ক্রিস। তিনি যখন তাইপে বিমানবন্দরে পৌঁছান তখন মাঝরাত। একই বিমানবন্দরে ম্যাকাও থেকে একটি বিমানে চড়ে হান-সল পৌঁছাবেন, এমনই কথা ছিল। তাই অপেক্ষা করতে থাকেন। আদ্রিয়ানের নির্দেশ ছিল হান-সলকে কেউ অনুসরণ করছে কি না তা খতিয়ে দেখা।
ভোরবেলায় তাইপে বিমানবন্দরে পৌঁছে হান-সল এবং তার মা ও বোনকে বহনকারী বিমানটি। তাদের সবার মুখেই তখন মাস্ক পরা ছিল। ধূলিবালি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মাস্কের এমন ব্যবহার প্রায়ই দেখা যায়। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার হান-সলের পরনে ছিল ফুলহাতা শার্ট ও কোট। চাকাওয়ালা একটি স্যুটকেস বহন করছিলেন তিনি। হান-সলের মধ্যবয়স্ক মাকে দেখে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় ক্রিসের। হান-সলের ১৭/১৮ বছর বয়সী বোনটির পরনে ছিল জিনসের পোশাক। আদ্রিয়ান তাদের বলে দিয়েছিলেন, কালো টি-শার্ট আর ডজার্স ক্যাপ পরে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেন ক্রিস। ফলে খুব সহজেই তারা একে অপরকে খুঁজে পায়। ক্রিস তাদের বিমানবন্দরের ভেতর একটি প্রাইভেট কক্ষে নিয়ে যান।
এদিকে, হান-সল ও তার পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য অন্তত তিনটি দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করছিলেন আদ্রিয়ান। সারা দিন অপেক্ষার পর সেদিন সন্ধ্যায় ক্রিসকে ফোন করে আদ্রিয়ান জানান, হান-সল ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে নেদারল্যান্ডস। তাই নেদারল্যান্ডসগামী একটি বিমানের তিনটি টিকিট কাটেন ক্রিস। কিন্তু তাদের পাসপোর্ট নিয়ে কিছুটা ঝামেলার সূত্রপাত হলে সেখানে এসে হাজির হন সিআইএ পরিচয় দেওয়া দুই ব্যক্তি। তাদের একজনের নাম ওয়েস। ততক্ষণে নির্ধারিত বিমানটি নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।
সিআইএ পরিচয় দেওয়া দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না ক্রিস ও হান-সল। সারা দিনের পর সেদিন সারা রাতও তারা বিমানবন্দরের ভেতরে সমস্যা সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা যায়, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বন্দরের কর্মকর্তারাই তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডামগামী আরেকটি বিমানের তিনটি টিকিট করতে পরামর্শ দেন তারা। কিন্তু বিমানে ওঠার আগ মুহূর্তেই দৃশ্যপটে এসে আবারও হাজির হন সিআইএ পরিচয় দেওয়া ওয়েস। ক্রিসকে তিনি বলেন, হান-সল ও তার পরিবারের সঙ্গে তিনিও যাচ্ছেন।
নেদারল্যান্ডসে বিমানবন্দরের গেটের বাইরে হান-সল ও তার পরিবারকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন ফ্রি জসেওনের নিয়োগ করা কয়েকজন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও তারা আর হান-সলের দেখা পায়নি। এর মধ্যে আদ্রিয়ানকে ফোন করে হান-সল জানান, বিমানবন্দরের ভেতরে একটি হোটেলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক খোঁজখবর করার পর আদ্রিয়ান নিশ্চিত হন যে, মার্কিন গোয়েন্দারাই হান-সলকে তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে গেছে। তবে এ মুহূর্তে তারা কোথায় তা অজানা।