প্রতিবাদী কণ্ঠ ডিয়েগো ম্যারাডোনা
জুবায়ের আহাম্মেদ | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
তার মৃত্যু সংবাদে শোক নেমেছে পৃথিবীজুড়ে। পাশ্চাত্য, প্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা কোথাও ব্যতিক্রম নেই। সর্বকালের সেরা ফুটবলার তিনি। কোটি ভক্ত তার। কিন্তু এই খ্যাতি ও সমাদরের বাইরে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আরেক ভুবন ছিল। যেখানে তিনি ছিলেন মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের অংশীদার। ম্যারাডোনার সেই অদেখা জীবন নিয়ে লিখেছেন জুবায়ের আহাম্মেদ
প্রতিবাদী ম্যারাডোনা
পৃথিবীতে অনেক মানুষ এসেছেন। তবে সর্বকালের সবচেয়ে কৌশলী বাম পা যে ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা পেয়েছিলেন তা নিয়ে সম্ভবত তর্ক নেই। এই বাম পায়ের এমনই মহিমা ছিল যে, মানুষের এই নশ্বর পৃথিবীতে তিনি অনেকের কাছেই পেয়েছেন ঈশ্বরের সম্মান। নিজ দেশ আর্জেন্টিনা তো বটেই, শত কোটি মাইল দূরে কলকাতা শহরেও তার জন্য পূজা হয়। বাংলাদেশেও তার লাখো ভক্ত। ট্রান্সফার ফি’র দুবার বিশ্বরেকর্ড গড়া একমাত্র ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন যিনি, যাকে রোনালদো ডা নাজারিও লিমা কিংবা রোনালদিনহো আদর্শ মানেন, সেই ম্যারাডোনা ছিলেন ভীষণ রকমের মানবিক। তার জীবনের আদর্শ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ঈশ্বরের তৈরি সবচেয়ে কৌশলী সেই বাম পায়ে তিনি এঁকে রেখেছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ট্যাটু। আর বাহুতে ছিলেন আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারা। ছিলেন হুগো শ্যাভেজের বন্ধু। শান্তির আশায় উঁচিয়ে ধরেছিলেন ফিলিস্তিনের পতাকা। সবকিছু ভুলে যান, ফকল্যান্ড যুদ্ধের যে প্রতিবাদ তিনি মেক্সিকোর ফুটবল মঞ্চে করেছিলেন, সেটাই তো তাকে আজীবন মনে রাখার জন্য যথেষ্ট।
বিতর্কিত আর নন্দিত সেই ম্যাচ নিয়ে বহু পরে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘ম্যাচটা যেমন আলোচনা তুলেছিল তাতে মনে হচ্ছিল আমরা আরেকটা যুদ্ধে যাচ্ছি।’ রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘যা ঘটেছিল তার জন্য ইংলিশ খেলোয়াড়দেরই দোষ দেব আমরা। আমি অবশ্যই জানতাম এটা বোকার মতো কাজ, কিন্তু আমরা আসলেই সবকিছু ইংরেজদের দোষ ভাবছিলাম। আর এটা আমাদের সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা নিজেদের পতাকা আর সন্তানদের রক্ষা করছি।’ দেশপ্রেম কিংবা ৬০০ জন নিহত আর্জেন্টাইনের জন্য ম্যারাডোনার এই প্রতিবাদকে সম্মান না জানানো হয়তো কিছুটা অসম্ভব।
বন্ধু ফিদেল, পিতৃতুল্য ফিদেল
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন অনেকেই। এ কি শরীরের হাল! ৮৬ আর ৯০-এ লিকলিকে গড়নের ম্যারাডোনার দৌড় দেখে যারা মুগ্ধ হয়েছিলেন, তারা সবাই ম্যারাডোনার ফিটনেস দেখে রীতিমতো অবাক বনে যান। ডোপ টেস্ট উত্তর দিয়ে দেয় সবার হয়ে। মাদকে আসক্ত এই জাদুকর। খ্যাতির চূড়া থেকে এক মুহূর্তেই অতল খাদে হারিয়ে যান ম্যারাডোনা। ফুটবলে তখন আরেক জাদুকর রোনালদো ডি নাজারিও লিমা এসেছেন। অবসরে ম্যারাডোনা। কেউই নেই তার পাশে। স্পন্সর থেকে শুরু করে আর্জেন্টাইন জনগণ সবাই একে একে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফুটবলটাও ছাড়তে হয়েছে। বিষণœতা ভুলতে দ্বারস্থ হলেন মাদকের। একের পর এক মাদক সেবনের জন্য মারাত্মক সমস্যায় পড়েন ম্যারাডোনা। অর্থ, যশ সব হারিয়ে তখন রীতিমতো বিপর্যস্ত অবস্থা তার। কোনো মনোবিদও তার পাশে যেতে চান না আর। একা পৃথিবীতে সেই সময় তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আরেক মহানায়ক। নাম তার ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
ক্যাস্ত্রো আর ম্যারাডোনার পরিচয় হয়েছিল ১৯৮৬ সালেই। ক্যাস্ত্রো তখন কিউবাকে নিজ হাতে আকার দিচ্ছিলেন। আর সদ্যই বিশ্ব মাতিয়ে এসেছেন ম্যারাডোনা। একজন রাজনীতির বিপ্লবী, আরেকজন ফুটবল মাঠের। দুই বিপ্লবী একসঙ্গে বসলেন। ক্যাস্ত্রোর কাছ থেকে নিলেন জীবনের দীক্ষা। সেই মহান ক্যাস্ত্রো এবার নিজেই এগিয়ে এলেন। ‘লা পেড্রেরা’ ক্লিনিকে ব্যবস্থা করে দেন ম্যারাডোনার পুনর্বাসনের জন্য। কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুনাম সেই সময় থেকেই ছিল। কিউবার চিকিৎসার পাশাপাশি ম্যারাডোনার দরকার ছিল একজন বন্ধুর। যিনি তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেন। সেই বন্ধুর দায়িত্বও নিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
৪ বছর কিউবায় কাটিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। প্রায়ই ম্যারাডোনার সকাল শুরু হতো ক্যাস্ত্রোর ব্যক্তিগত ফোন পেয়ে। খেলা থেকে রাজনীতি, সবকিছুই খোলা মনে আলোচনা করতেন দুই কিংবদন্তি। তাদের আলোচনায় বাদ যেত না কিছুই। কোনো ইভেন্টে ডাক পড়লে ম্যারাডোনাকেও নিমন্ত্রণ করতেন ক্যাস্ত্রো। ম্যারাডোনা নিজেই বলেছিলেন, ‘রাত দুটোর সময়ও ফোন করতেন ক্যাস্ত্রো। আমিও সব সময় কথা বলতে প্রস্তুত থাকতাম। কোনো ইভেন্ট থাকলে জানতে চাইতেন, আমি যেতে চাই কি না। এগুলো আমি ভুলব না।’
এতকিছুর বিনিময়ে কিছুই চাননি ক্যাস্ত্রো। না নিজের নাম, না ম্যারাডোনার নাম ভাঙিয়ে কিউবার সমৃদ্ধি। এমনকি কিউবান ফুটবলের জন্যও কিছু করতে হয়নি ম্যারাডোনাকে। ফুটবলার ম্যারাডোনাকে, মানুষ ম্যারাডোনার দীক্ষা সে সময়েই দিয়েছিলেন তিনি। আর তাইতো ২০১৬ সালে যখন ক্যাস্ত্রো মারা যান, জলভরা চোখে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বাবার মতো। আর্জেন্টিনায় যখন আমার সামনে দরজাগুলো বন্ধ হচ্ছিল, তখন উনি কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।’ ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুর পর কিউবান রাষ্ট্রীয় শোকেও গিয়েছেন ম্যারাডোনা। বলেছিলেন, ‘আমি এই সময় কিউবার মানুষের পাশে থাকতে চাই। আর বিদায় জানাতে চাই আমার বন্ধু ফিদেলকে।’
কমিউনিস্ট নন, ফিদেলিস্তা
ঠোঁটে তার চে গুয়েভারা কিংবা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর আইকনিক হাভানা চুরুট আর বাহুতে চে’র ট্যাটু। গুগলে ম্যারাডোনার এমন অজস্র ছবিই আপনার নজরে আসবে। সারা বিশ্ব তাকে জানত ক্যাস্ত্রোর বন্ধু হিসেবে। প্রশ্ন উঠত, ম্যারাডোনা কি তবে কমিউনিস্ট? ব্যক্তিজীবনে জটিল ম্যারাডোনা আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন সাবলীল। অবলীলায় জানিয়েছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। মৃত্যু পর্যন্ত আমি ফিদেলিস্তা।’ ম্যারাডোনা ডানপন্থি কিংবা বামপন্থি না, ছিলেন ফিদেলপন্থি। ফিদেল ক্যাস্ত্রো যেমন আজীবন গান গেয়েছেন নিপীড়িত মানুষের জন্য, তেমনি গান গেয়েছেন ম্যারাডোনাও। ’৮৬ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে জানিয়েছিলেন, এটা নিপীড়নের শিকার হওয়া আর্জেন্টিনার সঙ্গে শাসক ইংল্যান্ডের যুদ্ধ। গতানুগতিক কোনো ফুটবল ম্যাচ সেটি ছিল না। ম্যারাডোনার বিশ্বাস ছিল সেদিন ঈশ্বর চেয়েছিলেন নিপীড়িত আর্জেন্টাইনদের পাশে থাকবেন। যে কারণে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর। আর ৯ মিনিট পরের সর্বকালের সেরা গোলটি যেন ছিল শাসকের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ।
আসলে ম্যারাডোনার জীবনের এমন চিত্রনাট্য সম্ভবত ঈশ্বর এভাবেই লিখতে চেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের সবচেয়ে দরিদ্র এক অঞ্চল থেকে উঠেছেন বিশ্বসেরার মঞ্চে। মাঝে সঙ্গী ছিল চরম ক্ষুধা, ছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে এক অসম লড়াই। নিজের সময়ে তার পা বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করেছে। আর তার মুখে ছিল অসহায় মানুষের জয়গান। আর্জেন্টিনা যে ঠিক কতটা দরিদ্র তা বর্তমান বিশ্বের আরেক সেরা মেসির কথায় পরিষ্কার হয়। ‘আর্জেন্টিনায় এমন অনেক শিশু আছে যাদের জীবিকা নির্বাহের কাজ খোঁজা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই।’ সময় বদলেছে, আর্জেন্টিনার বুকে সেসব শিশু আজও আছে। তবে তাদের ভাগ্য ঘোরাতে শিখিয়েছিলেন যিনি, তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টাইন কিশোরদের দেখিয়েছেন ফুটবল খেলেও যে দারিদ্র্য ঘোচানো যায়। যার ফলাফল মাশ্চেরানো, ম্যাক্সি রড্রিগেজ, বাতিস্তুতা থেকে শুরু করে হালের সেনসেশন মেসি, ডি মারিয়া কিংবা আগুয়েরো।
ক্ষ্যাপাটে বক্তব্যের জন্য শিরোনাম হলেও ম্যারাডোনা সত্য আর অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সারা জীবন। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ইস্পাত-দৃঢ় মনোভাব পুরোটাই নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন তিনি। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির ছোট মানুষটা নিজেকে যেমন ফিদেলিস্তা দাবি করেছেন, নিজের আচরণের ক্ষেত্রেও তেমনই এক ফিদেলকে সবার সামনে এনেছিলেন বারবার। অল্প কয়েকদিন আগে সার্বিয়ান এক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাতে ম্যারাডোনা সরাসরিই বলেন, ‘বুয়েন্স আয়ার্সের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে আমার জন্ম। আমার এলাকার দারিদ্র্য এখনো আগের মতোই আছে। বন্ধুরাও সেই আগের মতোই আছে। শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিন দিন ধনী হয়েছে।’ ম্যারাডোনা খুব সহজভাবেই বলেছেন, ধনী হওয়ার সুযোগ তারও ছিল। কিন্তু তিনি সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি। গরিবের পেটে লাথি মেরে তাদের কাছ থেকে চুরি করার সেই শিক্ষা ফিদেলিস্তা ম্যারাডোনার জীবনে অন্তত ছিল না।
যুদ্ধের প্রতিবাদে
২০০৫ সাল। ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনায় পা রাখলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। বুশ প্রশাসনের হাতে ততদিনে শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য আগ্রাসন। ইরাক, আফগানিস্তান আর ফিলিস্তিনের মাটি লাল হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের রক্তে। এরইমাঝে আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাটায় সামিট অফ দ্য আমেরিকাস-এ এসেছেন প্রেসিডেন্ট বুশ। মানুষ ম্যারাডোনার তা সইল না। প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ফুটবলে যার সম্মান ঈশ্বরের মতো, তিনিই হয়ে গেলেন জীবন্ত এক ব্যানার। তার বুকের সাদা টি-শার্টে লেখা ছিল ‘ঝঞঙচ ইটঝঐ’। বুশকে তিনি তুলনা করলেন ‘আবর্জনা’র সঙ্গে।
আসলে সমাজতন্ত্র কিংবা বামপন্থিদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ একদিনের না। সেই ¯œায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই জন এফ কেনেডির হাত থেকে বিরোধ শুরু। কেনেডির শত্রুসম মানুষ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যাস্ত্রোর আজন্ম শত্রু। ম্যারাডোনাও তাই মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন উত্তর আমেরিকার এই দেশকে। একটা সময় তিনি প্রকাশ্যেই তার মার্কিন বিদ্বেষী মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমার সর্বশক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করি। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সবকিছুই ঘৃণা করি।’ ২০০৫ সালেই ভ্রমণ করেন হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনেজুয়েলাতে। তেল সংক্রান্ত ইস্যুতে শ্যাভেজের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। নিজেকে সেবার শ্যাভিস্তা দাবি করেন ম্যারাডোনা। ফিদেল বা শ্যাভেজ যাই-ই করে তাই ঠিক বলে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থানও নেন এই কিংবদন্তি।
মানুষের জন্য
প্রয়োজনে খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ গুরু পোপকেও প্রশ্ন করতে ছাড়েননি তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন দরিদ্র মানুষের জন্য। ‘ভ্যাটিকানে গিয়ে আমি দেখেছি সোনায় মোড়া ছাদগুলো। এদিকে পোপ বলছেন দরিদ্রদের ব্যাপারে তারা সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন। তাহলে ওই ছাদগুলো বেচে দিচ্ছেন না কেন? দিন না! অন্তত কিছু তো একটা হবে!’ পোপ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। সোনায় মোড়ানো সেসব ছাদ রয়ে গিয়েছে। পোপরাও আছেন। চলে গেলেন দরিদ্র মানুষের জন্য কথা বলা মানুষটা।
২০০৮ সালে আচমকা ফিফা ঘোষণা দিল, দুই হাজার মিটারের চেয়ে বেশি উচ্চতায় ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ। কিন্তু লাতিন আমেরিকার দুই দেশ বলিভিয়া ও ইকুয়েডরের ফুটবল যে তাতে শেষ হয়ে যাবে! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর উচ্চতা আড়াই হাজার মিটার আর বলিভিয়ার লাপাজের উচ্চতা সাড়ে তিন হাজার মিটারেরও বেশি। ম্যারাডোনা চলে গেলেন বলিভিয়াতে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে লাখো প্রতিবাদী জনতার সামনে আবেগঘন ভাষায় ম্যারাডোনা বললেন, ‘ফুটবল খেলা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষের এ অধিকার স্বয়ং ঈশ্বরও কেড়ে নিতে পারেন না। আর এ তো সামান্য ফিফা!’ নিজেদের সিদ্ধান্ত ঘুরিয়ে নেয় ফিফা। পরে আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে বলিভিয়াতেই ৬ গোল হজম করেন ম্যারাডোনা। সেদিন ম্যাচ হারলেও ফুটবল আর বলিভিয়ার জনগণকে ঠিকই জিতিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা!
২০১৮ বিশ্বকাপ। রাশিয়াতে এলেন ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ম্যারাডোনা এগিয়ে এসে তাকে বুকে জড়ালেন। সারা বিশ্বের মিডিয়ার সামনে বলে গেলেন, মন থেকে আমি একজন আরব। আমি একজন প্যালেস্টাইনি! স্বাধীনতার পক্ষে ধুঁকতে থাকা ফিলিস্তিনের জন্য এ ছিল অনেক বড় এক বার্তা। ফুটবল জাদুর বাইরেও হাজারও মানুষের মনের জাদু যে নিজের ভেতর নিয়ে রেখেছিলেন সে খবর ক’জনই বা জানতাম।
ম্যারাডোনা আর ক্যাস্ত্রোর গভীর বন্ধুত্বের মাঝে সবচেয়ে বড় চমক তাদের মৃত্যুর তারিখে। একবার স্মরণ করে দেখুন তারিখটা। ২৫ নভেম্বর। ঠিক চার বছর আগে এইদিনে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন ক্যাস্ত্রো। সেই ২৫ নভেম্বরেই ম্যারাডোনা নিজেও রওনা দিলেন বন্ধু কিংবা দ্বিতীয় পিতা ক্যাস্ত্রোর কাছে। কে জানে, সেখানে আবারও দুই বন্ধু আক্ষেপ করবেন নিপীড়িত মানুষের জন্য। হয়তো দেখা মিলবে আরেক কিংবদন্তি চে গুয়েভারার সঙ্গেও। অন্যলোকে কি হাভানা চুরুট থাকে? যদি থাকে, তবে তিনজনের কাছেই হয়তো হাভানা চুরুট থাকবে।
শেয়ার করুন
জুবায়ের আহাম্মেদ | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

তার মৃত্যু সংবাদে শোক নেমেছে পৃথিবীজুড়ে। পাশ্চাত্য, প্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা কোথাও ব্যতিক্রম নেই। সর্বকালের সেরা ফুটবলার তিনি। কোটি ভক্ত তার। কিন্তু এই খ্যাতি ও সমাদরের বাইরে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আরেক ভুবন ছিল। যেখানে তিনি ছিলেন মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের অংশীদার। ম্যারাডোনার সেই অদেখা জীবন নিয়ে লিখেছেন জুবায়ের আহাম্মেদ
প্রতিবাদী ম্যারাডোনা
পৃথিবীতে অনেক মানুষ এসেছেন। তবে সর্বকালের সবচেয়ে কৌশলী বাম পা যে ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা পেয়েছিলেন তা নিয়ে সম্ভবত তর্ক নেই। এই বাম পায়ের এমনই মহিমা ছিল যে, মানুষের এই নশ্বর পৃথিবীতে তিনি অনেকের কাছেই পেয়েছেন ঈশ্বরের সম্মান। নিজ দেশ আর্জেন্টিনা তো বটেই, শত কোটি মাইল দূরে কলকাতা শহরেও তার জন্য পূজা হয়। বাংলাদেশেও তার লাখো ভক্ত। ট্রান্সফার ফি’র দুবার বিশ্বরেকর্ড গড়া একমাত্র ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন যিনি, যাকে রোনালদো ডা নাজারিও লিমা কিংবা রোনালদিনহো আদর্শ মানেন, সেই ম্যারাডোনা ছিলেন ভীষণ রকমের মানবিক। তার জীবনের আদর্শ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ঈশ্বরের তৈরি সবচেয়ে কৌশলী সেই বাম পায়ে তিনি এঁকে রেখেছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ট্যাটু। আর বাহুতে ছিলেন আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারা। ছিলেন হুগো শ্যাভেজের বন্ধু। শান্তির আশায় উঁচিয়ে ধরেছিলেন ফিলিস্তিনের পতাকা। সবকিছু ভুলে যান, ফকল্যান্ড যুদ্ধের যে প্রতিবাদ তিনি মেক্সিকোর ফুটবল মঞ্চে করেছিলেন, সেটাই তো তাকে আজীবন মনে রাখার জন্য যথেষ্ট।
বিতর্কিত আর নন্দিত সেই ম্যাচ নিয়ে বহু পরে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘ম্যাচটা যেমন আলোচনা তুলেছিল তাতে মনে হচ্ছিল আমরা আরেকটা যুদ্ধে যাচ্ছি।’ রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘যা ঘটেছিল তার জন্য ইংলিশ খেলোয়াড়দেরই দোষ দেব আমরা। আমি অবশ্যই জানতাম এটা বোকার মতো কাজ, কিন্তু আমরা আসলেই সবকিছু ইংরেজদের দোষ ভাবছিলাম। আর এটা আমাদের সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা নিজেদের পতাকা আর সন্তানদের রক্ষা করছি।’ দেশপ্রেম কিংবা ৬০০ জন নিহত আর্জেন্টাইনের জন্য ম্যারাডোনার এই প্রতিবাদকে সম্মান না জানানো হয়তো কিছুটা অসম্ভব।
বন্ধু ফিদেল, পিতৃতুল্য ফিদেল
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন অনেকেই। এ কি শরীরের হাল! ৮৬ আর ৯০-এ লিকলিকে গড়নের ম্যারাডোনার দৌড় দেখে যারা মুগ্ধ হয়েছিলেন, তারা সবাই ম্যারাডোনার ফিটনেস দেখে রীতিমতো অবাক বনে যান। ডোপ টেস্ট উত্তর দিয়ে দেয় সবার হয়ে। মাদকে আসক্ত এই জাদুকর। খ্যাতির চূড়া থেকে এক মুহূর্তেই অতল খাদে হারিয়ে যান ম্যারাডোনা। ফুটবলে তখন আরেক জাদুকর রোনালদো ডি নাজারিও লিমা এসেছেন। অবসরে ম্যারাডোনা। কেউই নেই তার পাশে। স্পন্সর থেকে শুরু করে আর্জেন্টাইন জনগণ সবাই একে একে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফুটবলটাও ছাড়তে হয়েছে। বিষণœতা ভুলতে দ্বারস্থ হলেন মাদকের। একের পর এক মাদক সেবনের জন্য মারাত্মক সমস্যায় পড়েন ম্যারাডোনা। অর্থ, যশ সব হারিয়ে তখন রীতিমতো বিপর্যস্ত অবস্থা তার। কোনো মনোবিদও তার পাশে যেতে চান না আর। একা পৃথিবীতে সেই সময় তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আরেক মহানায়ক। নাম তার ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
ক্যাস্ত্রো আর ম্যারাডোনার পরিচয় হয়েছিল ১৯৮৬ সালেই। ক্যাস্ত্রো তখন কিউবাকে নিজ হাতে আকার দিচ্ছিলেন। আর সদ্যই বিশ্ব মাতিয়ে এসেছেন ম্যারাডোনা। একজন রাজনীতির বিপ্লবী, আরেকজন ফুটবল মাঠের। দুই বিপ্লবী একসঙ্গে বসলেন। ক্যাস্ত্রোর কাছ থেকে নিলেন জীবনের দীক্ষা। সেই মহান ক্যাস্ত্রো এবার নিজেই এগিয়ে এলেন। ‘লা পেড্রেরা’ ক্লিনিকে ব্যবস্থা করে দেন ম্যারাডোনার পুনর্বাসনের জন্য। কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুনাম সেই সময় থেকেই ছিল। কিউবার চিকিৎসার পাশাপাশি ম্যারাডোনার দরকার ছিল একজন বন্ধুর। যিনি তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেন। সেই বন্ধুর দায়িত্বও নিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
৪ বছর কিউবায় কাটিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। প্রায়ই ম্যারাডোনার সকাল শুরু হতো ক্যাস্ত্রোর ব্যক্তিগত ফোন পেয়ে। খেলা থেকে রাজনীতি, সবকিছুই খোলা মনে আলোচনা করতেন দুই কিংবদন্তি। তাদের আলোচনায় বাদ যেত না কিছুই। কোনো ইভেন্টে ডাক পড়লে ম্যারাডোনাকেও নিমন্ত্রণ করতেন ক্যাস্ত্রো। ম্যারাডোনা নিজেই বলেছিলেন, ‘রাত দুটোর সময়ও ফোন করতেন ক্যাস্ত্রো। আমিও সব সময় কথা বলতে প্রস্তুত থাকতাম। কোনো ইভেন্ট থাকলে জানতে চাইতেন, আমি যেতে চাই কি না। এগুলো আমি ভুলব না।’
এতকিছুর বিনিময়ে কিছুই চাননি ক্যাস্ত্রো। না নিজের নাম, না ম্যারাডোনার নাম ভাঙিয়ে কিউবার সমৃদ্ধি। এমনকি কিউবান ফুটবলের জন্যও কিছু করতে হয়নি ম্যারাডোনাকে। ফুটবলার ম্যারাডোনাকে, মানুষ ম্যারাডোনার দীক্ষা সে সময়েই দিয়েছিলেন তিনি। আর তাইতো ২০১৬ সালে যখন ক্যাস্ত্রো মারা যান, জলভরা চোখে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বাবার মতো। আর্জেন্টিনায় যখন আমার সামনে দরজাগুলো বন্ধ হচ্ছিল, তখন উনি কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।’ ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুর পর কিউবান রাষ্ট্রীয় শোকেও গিয়েছেন ম্যারাডোনা। বলেছিলেন, ‘আমি এই সময় কিউবার মানুষের পাশে থাকতে চাই। আর বিদায় জানাতে চাই আমার বন্ধু ফিদেলকে।’
কমিউনিস্ট নন, ফিদেলিস্তা
ঠোঁটে তার চে গুয়েভারা কিংবা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর আইকনিক হাভানা চুরুট আর বাহুতে চে’র ট্যাটু। গুগলে ম্যারাডোনার এমন অজস্র ছবিই আপনার নজরে আসবে। সারা বিশ্ব তাকে জানত ক্যাস্ত্রোর বন্ধু হিসেবে। প্রশ্ন উঠত, ম্যারাডোনা কি তবে কমিউনিস্ট? ব্যক্তিজীবনে জটিল ম্যারাডোনা আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন সাবলীল। অবলীলায় জানিয়েছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। মৃত্যু পর্যন্ত আমি ফিদেলিস্তা।’ ম্যারাডোনা ডানপন্থি কিংবা বামপন্থি না, ছিলেন ফিদেলপন্থি। ফিদেল ক্যাস্ত্রো যেমন আজীবন গান গেয়েছেন নিপীড়িত মানুষের জন্য, তেমনি গান গেয়েছেন ম্যারাডোনাও। ’৮৬ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে জানিয়েছিলেন, এটা নিপীড়নের শিকার হওয়া আর্জেন্টিনার সঙ্গে শাসক ইংল্যান্ডের যুদ্ধ। গতানুগতিক কোনো ফুটবল ম্যাচ সেটি ছিল না। ম্যারাডোনার বিশ্বাস ছিল সেদিন ঈশ্বর চেয়েছিলেন নিপীড়িত আর্জেন্টাইনদের পাশে থাকবেন। যে কারণে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর। আর ৯ মিনিট পরের সর্বকালের সেরা গোলটি যেন ছিল শাসকের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ।
আসলে ম্যারাডোনার জীবনের এমন চিত্রনাট্য সম্ভবত ঈশ্বর এভাবেই লিখতে চেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের সবচেয়ে দরিদ্র এক অঞ্চল থেকে উঠেছেন বিশ্বসেরার মঞ্চে। মাঝে সঙ্গী ছিল চরম ক্ষুধা, ছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে এক অসম লড়াই। নিজের সময়ে তার পা বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করেছে। আর তার মুখে ছিল অসহায় মানুষের জয়গান। আর্জেন্টিনা যে ঠিক কতটা দরিদ্র তা বর্তমান বিশ্বের আরেক সেরা মেসির কথায় পরিষ্কার হয়। ‘আর্জেন্টিনায় এমন অনেক শিশু আছে যাদের জীবিকা নির্বাহের কাজ খোঁজা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই।’ সময় বদলেছে, আর্জেন্টিনার বুকে সেসব শিশু আজও আছে। তবে তাদের ভাগ্য ঘোরাতে শিখিয়েছিলেন যিনি, তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টাইন কিশোরদের দেখিয়েছেন ফুটবল খেলেও যে দারিদ্র্য ঘোচানো যায়। যার ফলাফল মাশ্চেরানো, ম্যাক্সি রড্রিগেজ, বাতিস্তুতা থেকে শুরু করে হালের সেনসেশন মেসি, ডি মারিয়া কিংবা আগুয়েরো।
ক্ষ্যাপাটে বক্তব্যের জন্য শিরোনাম হলেও ম্যারাডোনা সত্য আর অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সারা জীবন। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ইস্পাত-দৃঢ় মনোভাব পুরোটাই নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন তিনি। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির ছোট মানুষটা নিজেকে যেমন ফিদেলিস্তা দাবি করেছেন, নিজের আচরণের ক্ষেত্রেও তেমনই এক ফিদেলকে সবার সামনে এনেছিলেন বারবার। অল্প কয়েকদিন আগে সার্বিয়ান এক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাতে ম্যারাডোনা সরাসরিই বলেন, ‘বুয়েন্স আয়ার্সের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে আমার জন্ম। আমার এলাকার দারিদ্র্য এখনো আগের মতোই আছে। বন্ধুরাও সেই আগের মতোই আছে। শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিন দিন ধনী হয়েছে।’ ম্যারাডোনা খুব সহজভাবেই বলেছেন, ধনী হওয়ার সুযোগ তারও ছিল। কিন্তু তিনি সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি। গরিবের পেটে লাথি মেরে তাদের কাছ থেকে চুরি করার সেই শিক্ষা ফিদেলিস্তা ম্যারাডোনার জীবনে অন্তত ছিল না।
যুদ্ধের প্রতিবাদে
২০০৫ সাল। ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনায় পা রাখলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। বুশ প্রশাসনের হাতে ততদিনে শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য আগ্রাসন। ইরাক, আফগানিস্তান আর ফিলিস্তিনের মাটি লাল হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের রক্তে। এরইমাঝে আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাটায় সামিট অফ দ্য আমেরিকাস-এ এসেছেন প্রেসিডেন্ট বুশ। মানুষ ম্যারাডোনার তা সইল না। প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ফুটবলে যার সম্মান ঈশ্বরের মতো, তিনিই হয়ে গেলেন জীবন্ত এক ব্যানার। তার বুকের সাদা টি-শার্টে লেখা ছিল ‘ঝঞঙচ ইটঝঐ’। বুশকে তিনি তুলনা করলেন ‘আবর্জনা’র সঙ্গে।
আসলে সমাজতন্ত্র কিংবা বামপন্থিদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ একদিনের না। সেই ¯œায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই জন এফ কেনেডির হাত থেকে বিরোধ শুরু। কেনেডির শত্রুসম মানুষ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যাস্ত্রোর আজন্ম শত্রু। ম্যারাডোনাও তাই মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন উত্তর আমেরিকার এই দেশকে। একটা সময় তিনি প্রকাশ্যেই তার মার্কিন বিদ্বেষী মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমার সর্বশক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করি। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সবকিছুই ঘৃণা করি।’ ২০০৫ সালেই ভ্রমণ করেন হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনেজুয়েলাতে। তেল সংক্রান্ত ইস্যুতে শ্যাভেজের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। নিজেকে সেবার শ্যাভিস্তা দাবি করেন ম্যারাডোনা। ফিদেল বা শ্যাভেজ যাই-ই করে তাই ঠিক বলে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থানও নেন এই কিংবদন্তি।
মানুষের জন্য
প্রয়োজনে খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ গুরু পোপকেও প্রশ্ন করতে ছাড়েননি তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন দরিদ্র মানুষের জন্য। ‘ভ্যাটিকানে গিয়ে আমি দেখেছি সোনায় মোড়া ছাদগুলো। এদিকে পোপ বলছেন দরিদ্রদের ব্যাপারে তারা সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন। তাহলে ওই ছাদগুলো বেচে দিচ্ছেন না কেন? দিন না! অন্তত কিছু তো একটা হবে!’ পোপ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। সোনায় মোড়ানো সেসব ছাদ রয়ে গিয়েছে। পোপরাও আছেন। চলে গেলেন দরিদ্র মানুষের জন্য কথা বলা মানুষটা।
২০০৮ সালে আচমকা ফিফা ঘোষণা দিল, দুই হাজার মিটারের চেয়ে বেশি উচ্চতায় ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ। কিন্তু লাতিন আমেরিকার দুই দেশ বলিভিয়া ও ইকুয়েডরের ফুটবল যে তাতে শেষ হয়ে যাবে! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর উচ্চতা আড়াই হাজার মিটার আর বলিভিয়ার লাপাজের উচ্চতা সাড়ে তিন হাজার মিটারেরও বেশি। ম্যারাডোনা চলে গেলেন বলিভিয়াতে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে লাখো প্রতিবাদী জনতার সামনে আবেগঘন ভাষায় ম্যারাডোনা বললেন, ‘ফুটবল খেলা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষের এ অধিকার স্বয়ং ঈশ্বরও কেড়ে নিতে পারেন না। আর এ তো সামান্য ফিফা!’ নিজেদের সিদ্ধান্ত ঘুরিয়ে নেয় ফিফা। পরে আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে বলিভিয়াতেই ৬ গোল হজম করেন ম্যারাডোনা। সেদিন ম্যাচ হারলেও ফুটবল আর বলিভিয়ার জনগণকে ঠিকই জিতিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা!
২০১৮ বিশ্বকাপ। রাশিয়াতে এলেন ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ম্যারাডোনা এগিয়ে এসে তাকে বুকে জড়ালেন। সারা বিশ্বের মিডিয়ার সামনে বলে গেলেন, মন থেকে আমি একজন আরব। আমি একজন প্যালেস্টাইনি! স্বাধীনতার পক্ষে ধুঁকতে থাকা ফিলিস্তিনের জন্য এ ছিল অনেক বড় এক বার্তা। ফুটবল জাদুর বাইরেও হাজারও মানুষের মনের জাদু যে নিজের ভেতর নিয়ে রেখেছিলেন সে খবর ক’জনই বা জানতাম।
ম্যারাডোনা আর ক্যাস্ত্রোর গভীর বন্ধুত্বের মাঝে সবচেয়ে বড় চমক তাদের মৃত্যুর তারিখে। একবার স্মরণ করে দেখুন তারিখটা। ২৫ নভেম্বর। ঠিক চার বছর আগে এইদিনে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন ক্যাস্ত্রো। সেই ২৫ নভেম্বরেই ম্যারাডোনা নিজেও রওনা দিলেন বন্ধু কিংবা দ্বিতীয় পিতা ক্যাস্ত্রোর কাছে। কে জানে, সেখানে আবারও দুই বন্ধু আক্ষেপ করবেন নিপীড়িত মানুষের জন্য। হয়তো দেখা মিলবে আরেক কিংবদন্তি চে গুয়েভারার সঙ্গেও। অন্যলোকে কি হাভানা চুরুট থাকে? যদি থাকে, তবে তিনজনের কাছেই হয়তো হাভানা চুরুট থাকবে।