৬ অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর কথা
আরফাতুন নাবিলা | ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
সম্প্রতি বিবিসি অনুপ্রেরণাদায়ী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন দেশের নারীদের এ তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের দুজন নারীও। বিরূপ পরিস্থিতিতে সাহসী পদক্ষেপের জন্য তাদের সেরা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তালিকার ১০০ নারীর মধ্য থেকে ৬ নারীর গল্প লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
লিও ই-সিন
কভিড-১৯ মহামারীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য সিঙ্গাপুরের সংক্রামক রোগ-বিশেষজ্ঞ প্রফেসর লিও ই-সিন বিবিসির এ বছরের সেরা নারীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। ৬১ বছর বয়সী প্রফেসর লিও ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশিয়াস ডিজিজের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই তালিকায় নিজের নাম দেখে বেশ আনন্দিত লিও। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারায় তিনি গর্বিতও। স্বাস্থ্য খাতে যারা কাজ করছেন, বিশেষ করে কভিড-১৯-এর এই যুদ্ধে যারা সাহসের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে গেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন লিও। এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সামনে হয়তো আরও বাধা আসবে, তবু নিরলস কাজ করে যেতে চান লিও। সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করায় নেতৃত্ব প্রদান ছাড়াও প্রফেসর লিও দেশটিতে এইচআইভির চিকিৎসার উন্নতি নিয়েও কাজ করছেন। এর আগে সিঙ্গাপুরের বেশ কয়েকটি প্রাদুর্ভাবের সময়ও লিও তার দল নিয়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ছিল ১৯৯৯ সালের নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের আক্রমণ, ২০০৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী এবং ২০১৬ সালের জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। গত বছর সিঙ্গাপুরে মাংকিপক্স নামে যে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটি নিয়েও তিনি সফলভাবে কাজ করেন। কয়েক বছর আগে ডেঙ্গু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল-সহকারে যে কাজ করা হয়, সেটিরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লিও।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য খাতে বছরের পর বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য প্রফেসর লিও বেশ কটি পুরস্কার জিতেছেন। সারসের বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে কাজ করেছেন, পাবলিক সার্ভিস স্টারসহ সেটি ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। এই বছরের আগস্ট মাসে ন্যাশনাল ডে অ্যাওয়ার্ডসে পেয়েছেন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মেডেলও (সিলভার) । চিকিৎসাসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা লিও বরাবর পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট পেয়েছেন। লিওর স্বামী একজন বায়োটেকনোলজিস্ট, যিনি নিজের একটি কোম্পানি চালান। সংসার জীবনে তিন সন্তানের মা তিনি।
মেডিকেলে পড়ার সময় কখনোই ইমিউনোলজি নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন না লিও। আবার এ বিষয় নিয়ে কোনো ট্রেনিং করবেন তেমন ব্যবস্থাও ছিল না। পরে ১৯৮৯ সালে তার পরিচয় হয় আমেরিকান ইনফেকশিয়াস ডিজিজ ফিজিশিয়ান ডেভিড অ্যালেনের সঙ্গে। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কথা বলে এ বিষয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। ডেভিডের কয়েকটি লেকচার শুনে লিও ইমিউনোলজি নিয়ে পড়তে আগ্রহী হন। এরপরই নিজেকে সঁপে দেন চিকিৎসাসেবায়।
রিনা আক্তার
বিশ্বজুড়ে বিবিসির অনুপ্রেরণামূলক ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের রিনা আক্তার। তিনি আগে একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। এ বছর করোনা মহামারীতে রিনা তার দলের কয়েকজন সদস্য নিয়ে মানুষকে সাহায্য করতে মাঠে নামেন। প্রতি সপ্তাহে ভাত, সবজি, ডিম, মাংসসহ প্রায় ৪০০ প্যাকেট খাবার সরবরাহ করতেন তারা। ঢাকায় যেসব যৌনকর্মী মহামারীতে খাবারের কষ্টে ছিলেন, তাদের সবাইকে সাহায্য করেছে তার দল। বিবিসিকে রিনা জানিয়েছেন, ‘লোকে আমাদের কাজকে খুব ছোট করে দেখে। কিন্তু আমাদেরও খাবার কিনে খেতে হয়। এই কাজে থেকেও আমি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি যারা এই কাজ করে খেত তারা যেন কেউ খাবারের কষ্ট না পায়। এই পেশায় যারা এখন আছে, তাদের সন্তানদের যেন এমন কাজ করতে না হয়, সেজন্যও আমরা কাজ করছি।’ গোপীবাগে যৌনকর্মীদের জন্য একটি শেল্টার করেছেন রিনা আক্তার। যাদের রাতে কাজ করতে হয় তারা সকালে এখানে এসে গোসল, খাওয়া ও বিশ্রাম করতে পারেন। এমনকি কেউ যদি অসুস্থও হন তাদের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থাও আছে এখানে।
রিমা সুলতানা রিমু
১৮ বছর বয়সী রিমা সুলতানা রিমু একজন শিক্ষক এবং তিনি কক্সবাজারভিত্তিক ইয়াং উইমেন লিডার্স ফর পিসের একজন সদস্য। এই কর্মসূচিটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব উইমেন পিসবিল্ডার্সের অংশ, যার মূল উদ্দেশ্য সংঘাতসংকুল দেশগুলো থে কে আসা তরুণ নারীদের ক্ষমতায়ন করা, যাতে তারা নেতৃত্ব দেওয়া ও শান্তির এজেন্টে পরিণত হবেন। রিমা তার মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলায়। রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের যাদের শিক্ষার সুযোগ নেই, তাদের জন্য লিঙ্গ সংবেদনশীল ও বয়সভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। রেডিও ব্রডকাস্ট ও থিয়েটার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তিনি নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করেছেন।
সুমাইয়া ফারুকী
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর চিকিৎসাসেবায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় ভেন্টিলেটরের। আর এই ভেন্টিলেটর মানেই অর্থের পরিমাণ বেশি। করোনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য দিন দিন ভেন্টিলেটরের সংকটও দেখা দিচ্ছিল। আফগানিস্তানে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রথম রোগী পাওয়া যায় হেরাত প্রদেশে। একবার যখন ভাইরাস দেশে প্রবেশ করেছে তখন রোগীর সংখ্যাও বাড়বে এবং ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হবে এমনটি বুঝতে পেরেছিলেন হেরাতের রোয়া মাহবুব নামে একজন টেক উদ্যোক্তা। দ্রুত ভেন্টিলেটর বানানোর জন্য তিনি ‘আফগান ড্রিমারস’ নামে একটি রোবটিকস টিম গঠন করেন। এই টিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এখানে সবাই ছিল মেয়ে আর এদের সবার বয়স ১৫ থেকে ১৭-এর মধ্যে। সবাই ছিল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী। তারা সবাই মিলে টয়োটা করোলার মোটর দিয়ে একটি ভেন্টিলেটর বানায়, যার মূল্য অনেক কম। এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সুমাইয়া ফারুকী।
২০০২ সালে হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন সুমাইয়া। বয়স অল্প হলেও ইতিমধ্যে সামাজিক নানা কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্বীকৃতি হিসেবে সাহসী পদক্ষেপের জন্য সিলভার মেডেল, ওয়ার্ল্ড সামিট এআইতে মানবতার পুরস্কার, র-সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে ড্রিম অ্যাওয়ার্ড, এস্তোনিয়ায় ইউরোপের সবচেয়ে বড় রোবটিকস ফেস্টিভ্যালে রোবটিকসে উদ্যোক্তা চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ। স্কুলে পড়াকালে সামাজিক কাজে নিজেকে এভাবে যুক্ত রাখায় ইতিমধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন সুমাইয়া। তিনি ও তার দল এখন আফগানিস্তানে শুধু নায়কই নন, নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণাও। আফগান ড্রিমারস টিমের সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছেন তাদের এই ভেন্টিলেটরের নকশা মিনিস্ট্রি অব পাবলিক হেলথে দেখাবেন। যদি তাদের দেখানো প্রোটোটাইপ অনুমোদন পায়, তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে এটি ব্যবহার করা যাবে। বিশ্বব্যাপী মহামারীর এ সময়ে নিজ দেশের মানুষের সেবায় অবদান রাখার জন্য বিবিসির এ বছরের অনুপ্রেরণাদায়ক ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সুমাইয়া।
লরনা প্রেনডারগাস্ট
২০১৯ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে দারুণ একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সেখানে উপস্থিত সবাই। ৯০ বছর বয়সী লরনা প্রেনডারগাস্ট এই ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন সে বছর। রয়্যাল এক্সিবিশন বিল্ডিংয়ে তিনি যখন গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট নিচ্ছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল দুই নাতনি, দর্শকসারিতে বসেছিল তার সন্তানরা। সে বছর লরনার গ্র্যাজুয়েশনের এই খবর বেশ কটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লরনা তার এই ডিগ্রি উৎসর্গ করেন প্রয়াত স্বামী জিমকে। এই পুরো ডিগ্রি লরনা অনলাইনে সম্পন্ন করেছেন। অনলাইনে পড়ার সময় তিনি সংগীত ও ডিমেনশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ বছরের জুলাই মাসে, ইস্ট গিপসল্যান্ডস নার্সিং হোমসের ডিমেনশিয়া ওয়ার্ডে মিউজিক থেরাপি নিয়ে কাজ শুরু করেন লরনা। তাদের জীবনযাপন উন্নত করার জন্য এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য নিয়মিত চেষ্টা করতে থাকেন।
এই কাজের জন্য স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে অনুদানও পেয়েছিলেন লরনা। রোটারি সানরাইজ অর্গানাইজেশন যারা এই ডিমেনশিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করে, তাদের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এই অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে লরনার গবেষণার জন্য হেডফোন সরবরাহ করা হয়। স্বামী জিমকে তিনি এই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে জীবনের শেষপর্যায় পর্যন্ত যেতে দেখেছেন। তাই এ বিষয় নিয়ে গবেষণায় লরনার ছিল আলাদা রকমের আগ্রহ। শিক্ষার্থী জীবনে, তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। আর গবেষক হিসেবে বর্তমানে ডিমেনশিয়া রোগীদের সুস্থ জীবনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, বিবিসি তাকে এ বছর অনুপ্রেরণাদায়ক সেরা ১০০ নারীর তালিকায় স্থান দিয়েছে। লরনার মতে, ‘পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য তোমার বয়স কত, তুমি তরুণ নাকি বৃদ্ধ, এগুলো কোনো বিষয় নয়।’
ওয়াদ আল-কাতিব
২০১৯ সালের ১৫ মে কান উৎসবের লালগালিচা। অনেক অতিথির মধ্যে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন সিরিয়ার নারী নির্মাতা ওয়াদ আল-কাতিব, চিকিৎসক হামজা আল-কাতিব ও ব্রিটিশ পরিচালক এডওয়ার্ড ওয়াটস। তাদের তিনজনের হাতে আলাদা আলাদা কাগজে লেখা ‘স্টপ বোম্বিং হসপিটালস’, অর্থাৎ হাসপাতালে বোমা নিক্ষেপ বন্ধ করুন। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের হাসপাতালে বোমা নিক্ষেপের কারণে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তিনজনে একসঙ্গে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন। সেই কান উৎসবেই প্রদর্শিত হয় ওয়াদ আল-কাতিবের নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ফর সামা’। উপস্থিত সবাই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন এই প্রামাণ্যচিত্র দেখে।
ওয়াদ আল-কাতিব একজন সিরিয়ান সমাজকর্মী ও সাংবাদিক। ২০১১ সালে শিক্ষার্থী জীবন শুরুর পর থেকেই ওয়াদ সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের প্রতিদিনের জীবন ভিডিও রেকর্ডিং করা শুরু করেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালে শহরের প্রতিবাদ ও সহিংসতা নিয়ে ওয়াদ যে তথ্য দিতেন তা দিয়ে নিয়মিত খবর প্রচারিত হতো ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরে। আলেপ্পো শহরে শেষ কয়েকজন বেঁচে থাকা চিকিৎসকের একজনকে বিয়ে করেন ওয়াদ। নিজের বিয়ের দিনের সব ঘটনা, বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খাওয়া এমনকি তার প্রেগনেন্সির ঘটনাও তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। এটিকে এক কথায় বলা যায় ‘সন্তানের জন্য চিঠি’। তাদের প্রথম সন্তান সামা। ওয়াদ যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে যেন সামা এসব চিত্র দেখে সেই সময়ের ভয়াবহতা জানতে পারে, কোন পরিস্থিতে তার জন্ম হয়েছে, তার বাবা-মাকে যুদ্ধের কেমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে, এর সবকিছুর বিস্তারিত চিত্র বোঝার জন্যই এ ভিডিও। ওয়াদ মূলত এই ভিডিও করেছিলেন শহরের চিত্র বোঝানোর জন্য। প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে তার কেন্দ্রীয় চরিত্রে তিনি থাকবেন এমন কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না। প্রামাণ্যচিত্রটিতে দেখা যায় দৃশ্যধারণ করতে করতেই কীভাবে ক্যামেরার সামনে অতর্কিত বোমা এসে পড়ছে, ঘর থেকেই ভিডিও ধারণ চলছে সরাসরি যুদ্ধের। ক্যামেরার সামনেই মারা যাচ্ছে শিশু, বৃদ্ধরা। নির্মাতারা এই ভিডিও ফুটেজ ক্ষুদ্র আকারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় ভিডিওগুলো। বিশ্ববাসী দেখতে পায় যুদ্ধের ভয়াবহতা। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ পরিচালক এডওয়ার্ড ওয়াটসের সঙ্গে মিলে ৫০০ ঘণ্টার এই ভিডিওগুলোকে সম্পাদনা করে প্রামাণ্যচিত্র ‘ফর সামা’ বানানোর পরিকল্পনা করেন ওয়াদ। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই প্রামাণ্যচিত্রটি জিতে নিয়েছিল গোল্ডেন আই পুরস্কার। আলেপ্পোর খবর প্রকাশের জন্য তিনি এমি অ্যাওয়ার্ডসও পেয়েছিলেন। ‘ফর সামা’র জন্য আরও পেয়েছেন বাফটা অ্যাওয়ার্ড, নমিনেশন পেয়েছিলেন অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে।
২০১৬ সালে আলেপ্পো থেকে দুই মেয়ে, স্বামীসহ চলে আসেন লন্ডনে। বর্তমানে কাজ করছেন চ্যানেল ফোর নিউজের জন্য। ‘ফর সামা’র জন্য ক্যাম্পেইনও করছেন, যেখানে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মানুষের জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সাহসী এই নারী বিবিসির এ বছরের অনুপ্রেরণাদায়ক ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
ওয়াদ আল-কাতিব বলেন, ‘আমরা তখনই হেরে যাই, যখন আমরা আশা ছেড়ে দিই। আপনি যেকোনো দেশের, যেকোনো দেশের নারী হোন না কেন, আপনার প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যা বিশ্বাস করেন সেটির জন্য লড়াই করতে থাকুন, স্বপ্ন দেখার সাহস করুন, এখনো এবং কখনো আশা ছাড়বেন না।’
শেয়ার করুন
আরফাতুন নাবিলা | ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

সম্প্রতি বিবিসি অনুপ্রেরণাদায়ী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন দেশের নারীদের এ তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের দুজন নারীও। বিরূপ পরিস্থিতিতে সাহসী পদক্ষেপের জন্য তাদের সেরা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তালিকার ১০০ নারীর মধ্য থেকে ৬ নারীর গল্প লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
লিও ই-সিন
কভিড-১৯ মহামারীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য সিঙ্গাপুরের সংক্রামক রোগ-বিশেষজ্ঞ প্রফেসর লিও ই-সিন বিবিসির এ বছরের সেরা নারীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। ৬১ বছর বয়সী প্রফেসর লিও ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশিয়াস ডিজিজের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই তালিকায় নিজের নাম দেখে বেশ আনন্দিত লিও। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারায় তিনি গর্বিতও। স্বাস্থ্য খাতে যারা কাজ করছেন, বিশেষ করে কভিড-১৯-এর এই যুদ্ধে যারা সাহসের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে গেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন লিও। এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সামনে হয়তো আরও বাধা আসবে, তবু নিরলস কাজ করে যেতে চান লিও। সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করায় নেতৃত্ব প্রদান ছাড়াও প্রফেসর লিও দেশটিতে এইচআইভির চিকিৎসার উন্নতি নিয়েও কাজ করছেন। এর আগে সিঙ্গাপুরের বেশ কয়েকটি প্রাদুর্ভাবের সময়ও লিও তার দল নিয়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ছিল ১৯৯৯ সালের নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের আক্রমণ, ২০০৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী এবং ২০১৬ সালের জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। গত বছর সিঙ্গাপুরে মাংকিপক্স নামে যে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটি নিয়েও তিনি সফলভাবে কাজ করেন। কয়েক বছর আগে ডেঙ্গু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল-সহকারে যে কাজ করা হয়, সেটিরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লিও।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য খাতে বছরের পর বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য প্রফেসর লিও বেশ কটি পুরস্কার জিতেছেন। সারসের বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে কাজ করেছেন, পাবলিক সার্ভিস স্টারসহ সেটি ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। এই বছরের আগস্ট মাসে ন্যাশনাল ডে অ্যাওয়ার্ডসে পেয়েছেন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মেডেলও (সিলভার) । চিকিৎসাসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা লিও বরাবর পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট পেয়েছেন। লিওর স্বামী একজন বায়োটেকনোলজিস্ট, যিনি নিজের একটি কোম্পানি চালান। সংসার জীবনে তিন সন্তানের মা তিনি।
মেডিকেলে পড়ার সময় কখনোই ইমিউনোলজি নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন না লিও। আবার এ বিষয় নিয়ে কোনো ট্রেনিং করবেন তেমন ব্যবস্থাও ছিল না। পরে ১৯৮৯ সালে তার পরিচয় হয় আমেরিকান ইনফেকশিয়াস ডিজিজ ফিজিশিয়ান ডেভিড অ্যালেনের সঙ্গে। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কথা বলে এ বিষয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। ডেভিডের কয়েকটি লেকচার শুনে লিও ইমিউনোলজি নিয়ে পড়তে আগ্রহী হন। এরপরই নিজেকে সঁপে দেন চিকিৎসাসেবায়।
রিনা আক্তার
বিশ্বজুড়ে বিবিসির অনুপ্রেরণামূলক ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের রিনা আক্তার। তিনি আগে একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। এ বছর করোনা মহামারীতে রিনা তার দলের কয়েকজন সদস্য নিয়ে মানুষকে সাহায্য করতে মাঠে নামেন। প্রতি সপ্তাহে ভাত, সবজি, ডিম, মাংসসহ প্রায় ৪০০ প্যাকেট খাবার সরবরাহ করতেন তারা। ঢাকায় যেসব যৌনকর্মী মহামারীতে খাবারের কষ্টে ছিলেন, তাদের সবাইকে সাহায্য করেছে তার দল। বিবিসিকে রিনা জানিয়েছেন, ‘লোকে আমাদের কাজকে খুব ছোট করে দেখে। কিন্তু আমাদেরও খাবার কিনে খেতে হয়। এই কাজে থেকেও আমি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি যারা এই কাজ করে খেত তারা যেন কেউ খাবারের কষ্ট না পায়। এই পেশায় যারা এখন আছে, তাদের সন্তানদের যেন এমন কাজ করতে না হয়, সেজন্যও আমরা কাজ করছি।’ গোপীবাগে যৌনকর্মীদের জন্য একটি শেল্টার করেছেন রিনা আক্তার। যাদের রাতে কাজ করতে হয় তারা সকালে এখানে এসে গোসল, খাওয়া ও বিশ্রাম করতে পারেন। এমনকি কেউ যদি অসুস্থও হন তাদের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থাও আছে এখানে।
রিমা সুলতানা রিমু
১৮ বছর বয়সী রিমা সুলতানা রিমু একজন শিক্ষক এবং তিনি কক্সবাজারভিত্তিক ইয়াং উইমেন লিডার্স ফর পিসের একজন সদস্য। এই কর্মসূচিটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব উইমেন পিসবিল্ডার্সের অংশ, যার মূল উদ্দেশ্য সংঘাতসংকুল দেশগুলো থে কে আসা তরুণ নারীদের ক্ষমতায়ন করা, যাতে তারা নেতৃত্ব দেওয়া ও শান্তির এজেন্টে পরিণত হবেন। রিমা তার মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলায়। রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের যাদের শিক্ষার সুযোগ নেই, তাদের জন্য লিঙ্গ সংবেদনশীল ও বয়সভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। রেডিও ব্রডকাস্ট ও থিয়েটার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তিনি নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করেছেন।
সুমাইয়া ফারুকী
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর চিকিৎসাসেবায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় ভেন্টিলেটরের। আর এই ভেন্টিলেটর মানেই অর্থের পরিমাণ বেশি। করোনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য দিন দিন ভেন্টিলেটরের সংকটও দেখা দিচ্ছিল। আফগানিস্তানে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রথম রোগী পাওয়া যায় হেরাত প্রদেশে। একবার যখন ভাইরাস দেশে প্রবেশ করেছে তখন রোগীর সংখ্যাও বাড়বে এবং ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হবে এমনটি বুঝতে পেরেছিলেন হেরাতের রোয়া মাহবুব নামে একজন টেক উদ্যোক্তা। দ্রুত ভেন্টিলেটর বানানোর জন্য তিনি ‘আফগান ড্রিমারস’ নামে একটি রোবটিকস টিম গঠন করেন। এই টিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এখানে সবাই ছিল মেয়ে আর এদের সবার বয়স ১৫ থেকে ১৭-এর মধ্যে। সবাই ছিল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী। তারা সবাই মিলে টয়োটা করোলার মোটর দিয়ে একটি ভেন্টিলেটর বানায়, যার মূল্য অনেক কম। এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সুমাইয়া ফারুকী।
২০০২ সালে হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন সুমাইয়া। বয়স অল্প হলেও ইতিমধ্যে সামাজিক নানা কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্বীকৃতি হিসেবে সাহসী পদক্ষেপের জন্য সিলভার মেডেল, ওয়ার্ল্ড সামিট এআইতে মানবতার পুরস্কার, র-সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে ড্রিম অ্যাওয়ার্ড, এস্তোনিয়ায় ইউরোপের সবচেয়ে বড় রোবটিকস ফেস্টিভ্যালে রোবটিকসে উদ্যোক্তা চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ। স্কুলে পড়াকালে সামাজিক কাজে নিজেকে এভাবে যুক্ত রাখায় ইতিমধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন সুমাইয়া। তিনি ও তার দল এখন আফগানিস্তানে শুধু নায়কই নন, নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণাও। আফগান ড্রিমারস টিমের সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছেন তাদের এই ভেন্টিলেটরের নকশা মিনিস্ট্রি অব পাবলিক হেলথে দেখাবেন। যদি তাদের দেখানো প্রোটোটাইপ অনুমোদন পায়, তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে এটি ব্যবহার করা যাবে। বিশ্বব্যাপী মহামারীর এ সময়ে নিজ দেশের মানুষের সেবায় অবদান রাখার জন্য বিবিসির এ বছরের অনুপ্রেরণাদায়ক ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সুমাইয়া।
লরনা প্রেনডারগাস্ট
২০১৯ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে দারুণ একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সেখানে উপস্থিত সবাই। ৯০ বছর বয়সী লরনা প্রেনডারগাস্ট এই ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন সে বছর। রয়্যাল এক্সিবিশন বিল্ডিংয়ে তিনি যখন গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট নিচ্ছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল দুই নাতনি, দর্শকসারিতে বসেছিল তার সন্তানরা। সে বছর লরনার গ্র্যাজুয়েশনের এই খবর বেশ কটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লরনা তার এই ডিগ্রি উৎসর্গ করেন প্রয়াত স্বামী জিমকে। এই পুরো ডিগ্রি লরনা অনলাইনে সম্পন্ন করেছেন। অনলাইনে পড়ার সময় তিনি সংগীত ও ডিমেনশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ বছরের জুলাই মাসে, ইস্ট গিপসল্যান্ডস নার্সিং হোমসের ডিমেনশিয়া ওয়ার্ডে মিউজিক থেরাপি নিয়ে কাজ শুরু করেন লরনা। তাদের জীবনযাপন উন্নত করার জন্য এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য নিয়মিত চেষ্টা করতে থাকেন।
এই কাজের জন্য স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে অনুদানও পেয়েছিলেন লরনা। রোটারি সানরাইজ অর্গানাইজেশন যারা এই ডিমেনশিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করে, তাদের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এই অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে লরনার গবেষণার জন্য হেডফোন সরবরাহ করা হয়। স্বামী জিমকে তিনি এই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে জীবনের শেষপর্যায় পর্যন্ত যেতে দেখেছেন। তাই এ বিষয় নিয়ে গবেষণায় লরনার ছিল আলাদা রকমের আগ্রহ। শিক্ষার্থী জীবনে, তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। আর গবেষক হিসেবে বর্তমানে ডিমেনশিয়া রোগীদের সুস্থ জীবনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, বিবিসি তাকে এ বছর অনুপ্রেরণাদায়ক সেরা ১০০ নারীর তালিকায় স্থান দিয়েছে। লরনার মতে, ‘পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য তোমার বয়স কত, তুমি তরুণ নাকি বৃদ্ধ, এগুলো কোনো বিষয় নয়।’
ওয়াদ আল-কাতিব
২০১৯ সালের ১৫ মে কান উৎসবের লালগালিচা। অনেক অতিথির মধ্যে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন সিরিয়ার নারী নির্মাতা ওয়াদ আল-কাতিব, চিকিৎসক হামজা আল-কাতিব ও ব্রিটিশ পরিচালক এডওয়ার্ড ওয়াটস। তাদের তিনজনের হাতে আলাদা আলাদা কাগজে লেখা ‘স্টপ বোম্বিং হসপিটালস’, অর্থাৎ হাসপাতালে বোমা নিক্ষেপ বন্ধ করুন। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের হাসপাতালে বোমা নিক্ষেপের কারণে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তিনজনে একসঙ্গে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন। সেই কান উৎসবেই প্রদর্শিত হয় ওয়াদ আল-কাতিবের নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ফর সামা’। উপস্থিত সবাই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন এই প্রামাণ্যচিত্র দেখে।
ওয়াদ আল-কাতিব একজন সিরিয়ান সমাজকর্মী ও সাংবাদিক। ২০১১ সালে শিক্ষার্থী জীবন শুরুর পর থেকেই ওয়াদ সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের প্রতিদিনের জীবন ভিডিও রেকর্ডিং করা শুরু করেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালে শহরের প্রতিবাদ ও সহিংসতা নিয়ে ওয়াদ যে তথ্য দিতেন তা দিয়ে নিয়মিত খবর প্রচারিত হতো ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরে। আলেপ্পো শহরে শেষ কয়েকজন বেঁচে থাকা চিকিৎসকের একজনকে বিয়ে করেন ওয়াদ। নিজের বিয়ের দিনের সব ঘটনা, বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খাওয়া এমনকি তার প্রেগনেন্সির ঘটনাও তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। এটিকে এক কথায় বলা যায় ‘সন্তানের জন্য চিঠি’। তাদের প্রথম সন্তান সামা। ওয়াদ যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে যেন সামা এসব চিত্র দেখে সেই সময়ের ভয়াবহতা জানতে পারে, কোন পরিস্থিতে তার জন্ম হয়েছে, তার বাবা-মাকে যুদ্ধের কেমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে, এর সবকিছুর বিস্তারিত চিত্র বোঝার জন্যই এ ভিডিও। ওয়াদ মূলত এই ভিডিও করেছিলেন শহরের চিত্র বোঝানোর জন্য। প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে তার কেন্দ্রীয় চরিত্রে তিনি থাকবেন এমন কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না। প্রামাণ্যচিত্রটিতে দেখা যায় দৃশ্যধারণ করতে করতেই কীভাবে ক্যামেরার সামনে অতর্কিত বোমা এসে পড়ছে, ঘর থেকেই ভিডিও ধারণ চলছে সরাসরি যুদ্ধের। ক্যামেরার সামনেই মারা যাচ্ছে শিশু, বৃদ্ধরা। নির্মাতারা এই ভিডিও ফুটেজ ক্ষুদ্র আকারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় ভিডিওগুলো। বিশ্ববাসী দেখতে পায় যুদ্ধের ভয়াবহতা। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ পরিচালক এডওয়ার্ড ওয়াটসের সঙ্গে মিলে ৫০০ ঘণ্টার এই ভিডিওগুলোকে সম্পাদনা করে প্রামাণ্যচিত্র ‘ফর সামা’ বানানোর পরিকল্পনা করেন ওয়াদ। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই প্রামাণ্যচিত্রটি জিতে নিয়েছিল গোল্ডেন আই পুরস্কার। আলেপ্পোর খবর প্রকাশের জন্য তিনি এমি অ্যাওয়ার্ডসও পেয়েছিলেন। ‘ফর সামা’র জন্য আরও পেয়েছেন বাফটা অ্যাওয়ার্ড, নমিনেশন পেয়েছিলেন অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে।
২০১৬ সালে আলেপ্পো থেকে দুই মেয়ে, স্বামীসহ চলে আসেন লন্ডনে। বর্তমানে কাজ করছেন চ্যানেল ফোর নিউজের জন্য। ‘ফর সামা’র জন্য ক্যাম্পেইনও করছেন, যেখানে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মানুষের জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সাহসী এই নারী বিবিসির এ বছরের অনুপ্রেরণাদায়ক ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
ওয়াদ আল-কাতিব বলেন, ‘আমরা তখনই হেরে যাই, যখন আমরা আশা ছেড়ে দিই। আপনি যেকোনো দেশের, যেকোনো দেশের নারী হোন না কেন, আপনার প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যা বিশ্বাস করেন সেটির জন্য লড়াই করতে থাকুন, স্বপ্ন দেখার সাহস করুন, এখনো এবং কখনো আশা ছাড়বেন না।’