সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হকের মুক্তিযুদ্ধ
পুষ্পেন চৌধুরী | ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০
মুক্তিযুদ্ধে মেজর নাজমুল হক ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অনন্য অবদান রাখলেও গত ৪৯ বছরে কোনো পদক বা সম্মান পাননি তিনি। মেজর নাজমুলের পরিবার লড়ে যাচ্ছে মহান বীর সেনানায়কের উপযুক্ত সম্মানের জন্য। লিখেছেন পুষ্পেন চৌধুরী
একাত্তরের বীর নায়ক
একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারা দেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বারুদের মতো ফুঁসছে। দফায় দফায় ছাত্র, জনতা, কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্তসহ সবার আন্দোলন চলছে। উইং কমান্ডার নাজমুল হকের দেশ পাকিস্তানের শোষণ ও শাসন থেকে থেকে মুক্তির জন্য লড়ছে। এই সময়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সব জনতা। এর মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সশস্ত্র সংঘাত হচ্ছে। অনেক নিরীহ ও প্রতিবাদী বাঙালি আহত, নিহত হচ্ছেন। রাজশাহীতে গুলি চলছে। সব খবরই পাচ্ছেন মেজর নাজমুল হক। তাদের স্তব্ধ করে দিয়ে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে কালরাত নেমে এলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করল। নাজমুল বুঝতে পারলেন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে পারেননি নাজমুল। পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে চাপ দিতে থাকলেন তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য। শুধু চাপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি নাজমুল, যুদ্ধের জন্য বাঙালি কর্মকর্তা, জওয়ানদের এক করে ফেলেছেন। যদিও কোনো বাঙালির কাছে দায়িত্ব দিতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত নাজমুলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেন পাঞ্জাবি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম।
২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। নওগাঁয় সে খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজমুল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬ মার্চ নওগাঁর মহকুমাকে মুক্তাঞ্চল (স্বাধীন বাংলার অংশ) ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গড়ে তুললেন ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) নেতৃত্বে তার ‘ইপিআর-মুজাহিদ বাহিনী’।
কর্ম-অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ সেনা অফিসারের জীবন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি হৃদয় দিয়ে টের পেয়েছিলেন নাজমুল হক। ভাবতেন তার দেশের মুক্তিযুদ্ধ হবে ‘গণযুদ্ধ’। ছাত্র, যুব, কৃষক ও জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদের গেরিলাযুদ্ধ চলবে। এ সময় সবাই মিলে জমিতে ফসল উৎপাদন করে খাবারের সংস্থান করতে হবে। পাশাপাশি অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। বাঙালির রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে। সব সময় তাই সাধারণ মানুষ ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বলতেন ‘আপনারা সবাই যদি প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যান, তাহলে তো আমাদের কৃষিজমিগুলো পড়ে থাকবে। চরম খাদ্য সংকট দেখা দেবে। কী খেয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করব?’ এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৭ নম্বর সেক্টরের কৃষক-জনতা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। অবসরে কৃষিকাজে নেমে পড়েছেন।
নাজমুলের মুক্তিবাহিনী
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার নিয়োগ হলেন। জুলাইয়ে তাকে ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। নাজমুল হকের যুদ্ধ এলাকাগুলো ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুরের অংশবিশেষ। সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামের বালুরঘাটের কাছের তরঙ্গপুর। মেজর নাজমুল হকের অধীনে মোট ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। তার নিয়মিত বাহিনীতে সৈন্য ছিলেন ২ হাজার ৫০০ জন। নাজমুল হকের গণবাহিনীতে ১২ হাজার ৫০০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রতিটি সেক্টরের মতো তার অধীনেও আটটি সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
অনেকগুলো স্মরণীয় অপারেশন করে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছেন সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক। এই নামটি সারা মুক্তাঞ্চলে প্রথম ছড়াল ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের অপারেশনের পর। মেজর নাজমুল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সাহায্যে এই দিন তার ইপিআর-মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় অপারেশন পরিচালনা করলেন। তারা পাকিস্তানিদের হতাহত করে নবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত করলেন। এরপর এখান থেকে এবং নাটোর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে রাজশাহীতে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টিকতে না পরে পিছু হটতে থাকল। আহত ও নিহত হলো অনেকে। পেছাতে পেছাতে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিল তারা, কিন্তু দক্ষ সেনা কমান্ডার নাজমুল হক তাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবরুদ্ধ করে ফেললেন।
সাধারণ বাঙালি পোশাক লুঙ্গি, মাথায় গামছা বাঁধা মাত্র ২৪ জন মুক্তিসেনাকে নিয়ে পুনর্ভবা নদীর তীরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র রহনপুরে হাজির হয়েছেন নাজমুল। দু®প্রাপ্য মর্টার মাইলের পর মাইল হেঁটে বয়ে নিয়েছেন। শত্রুর ছাউনি থেকে মাত্র ২০০ গজের ভেতরে ঢুকেছেন এবং মর্টারে আক্রমণ করে হারিয়েছেন। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন বগুড়া। জেলাটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যামুনেশান প্লাটুন)। এখানে রংপুরের ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদ সঞ্চিত রাখা হতো। মেজর নাজমুল তার মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকেই ৯১ আইপিএ প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন রংপুরেও যেতে না পারে সেজন্য অভিযান পরিচালনা করলেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী থেকে পাবনার প্রতিটি প্রতিরোধ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মেজর নাজমুল হকের নির্দেশ ও পরিকল্পনায়। অকুতোভয় ও ভীষণ দেশপ্রেমিক এই সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সেক্টরের প্রতি সাব-সেক্টরের প্রতিটি অপারেশনে সরাসরি যুক্ত থেকেছেন। তিনি ও তার মুক্তিবাহিনী মরণপণ যুদ্ধ করেছেন।
১৯৭১ সালের ১০ মে বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক মিলান জে কিউবিকের নেওয়া আঞ্চলিক কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে মুক্তিবাহিনীর মেজর বলেছেন, ‘আমাদের কাপুরুষের মৃত্যুর চেয়ে রাইফেল হাতে বীরের মতো মৃত্যু অনেক শ্রেয় বলে আমি মনে করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যত ধ্বংসযজ্ঞই চালাক না কেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এতটুকু মনোবল হারায়নি। শিগগিরই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য চূড়ান্ত বিজয় লাভ করব। সময় আসছে পাকিস্তানি সেনারা গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো পালানোর পথ খুঁজবে।’
১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তার অধীনে শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন। একটি অপারেশনের কথা তিনি সব সময় বলতেন, ‘দিনাজপুরের ধনধনিয়া পাড়ায় ১৮ জুন আমাদের মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হলো। মেজর নিজেই যুদ্ধটি পরিচালনা করেছেন। ফলে ১৪ পাকিস্তানি সেনাকে নিহত করে পাড়াটি মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেল। ৪ জুলাই মেজরের নেতৃত্বে দিনাজপুরের কাঞ্চন সেতুর ওপরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করলাম। তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’
শিক্ষাজীবন
নাজমুল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট, নানাবাড়ি লোহাগাড়ার চুনতি রশিদারঘোনা গ্রামে। মা বড় আদর করে ডাকতেন ‘টুলু’। পরিবারের বড়রা যেখানে পড়াশোনা শেষে উচ্চপর্যায়ে যুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে নাজমুল নিজেও হেঁটেছেন তাদের দেখানো পথে। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় তার দারুণ উৎসাহ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কুমিল্লার বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালা থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। পরে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট) ভর্তি হলেন। তবে নাজমুলের ছিল দেশের প্রতি ভীষণ টান। শিক্ষাজীবনে এগিয়ে তো ছিলেনই, দেশের জন্য পড়া ছেড়ে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে।
পরিবার
শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের জন্ম সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দাদা আহমদুর রহমানের প্রথম পেশা ছিল ওকালতি। ব্রিটিশ আদালতের নাজির হিসেবে চাকরি করেছেন, রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। এই পদটি এখন পরিচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নামে। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। বাবা হাফেজ আহমদ খান অ্যাডভোকেট। সিএসপি পাস করে হয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতার বিখ্যাত আলীপুর আদালতে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দুই বছর পর ১৯৪৯ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাকে বদলি করা হয়েছে পূর্ববাংলার কুমিল্লায়। তার শ্বশুর আসাদ উল্লাহও পেশায় ব্রিটিশদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বড়জন গজনফর আলী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। দ্বিতীয়জন অধ্যাপক আজমত উল্লাহ। মেয়ে জয়নাব বেগম, হাফেজ আহমদের স্ত্রী। হাফেজ-জয়নাব দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। নাজমুল হক দ্বিতীয়।
সেনা অফিসারের জীবন
সেনাজীবনেও নাজমুল রেখেছিলেন সফলতার স্বাক্ষর। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর নিজ যোগ্যতায় পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি, কাকুল থেকে আর্টিলারি কোর বা গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করলেন। চাকরিতে থাকাকালে ১৯৬৮ সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রাম রাইফেলস ক্লাবে নওসাবা মিলির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সবাই ভাবলেন নাজমুল হকের সংসার জীবনের শুরু হলো। এবার ঘরে মন বসবে তার। কিন্তু সংসার নাজমুলকে সেভাবে টানেনি, যতটা টেনেছে তার পরাধীন জন্মভূমি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত যোগ্য এই বাঙালি অফিসার রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। দেশকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পাকিস্তানিদের বঞ্চনা ও বিরোধের প্রতিশোধ নেবেন বলে স্বপ্ন দেখতেন গেরিলাযুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার। তবে স্বপ্ন শুধু তার মধ্যেই বড় হচ্ছিল তা নয়, পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা বুঝে যান সব। তিনি জানতেন জীবনের শঙ্কা আছে, তবু দেশে আসতে ব্যাকুল ছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মেজর নাজমুল হককে উইং কমান্ডার হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হলো নওগাঁয়। তার পরও তিনি নিজের কাজ করে চলেছেন অবিচল। পরের মাসে ছোট ভাই আতাউল হকের বিয়েতে আমিরাবাদ এসেছেন। হঠাৎ পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর থেকে জরুরি চিঠি এলো। তাকে কর্মস্থলে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভীষণ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রত্যেকে যেতে মানা করলেন, কিন্তু নাজমুল হক কারও অনুরোধ রাখতে পারলেন না। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন বলে বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করে তিনি নিজের মরিস মাইনর জিপটি নিয়ে ফেরত চলে গেলেন নওগাঁ।
শহীদ হলেন যেভাবে
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে মিত্রবাহিনীর গোপন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিলেন নাজমুল হক। আলোচনাটি হলো পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি শহরে। সভা শেষে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে গোপনে রাতের অন্ধকারে ফিরছিলেন সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হক। তার গাড়ি চালাচ্ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা চালক। তাকে ক্লান্ত দেখে মেজর বললেন, ‘তুমি তো খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো। এবার বরং আমি চালাই।’ তারা আসন বদলালেন, কিন্তু তিনিও যে ভীষণ ক্লান্ত। তুমুল বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ি পথে গাড়ি রাতের নিকষ আঁধারে হঠাৎ রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল। সেখানেই মারা গেলেন মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সেনা অফিসার মেজর নাজমুল হক। ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে তার সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান জামান ও তার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর (মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ) স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের দুই মেয়ে ইসরাত জাহান সুরভী ও নওরীন সাবা শিউলী তখন একেবারেই শিশু। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে শায়িত করা হয় নাজমুল হককে।
শেয়ার করুন
পুষ্পেন চৌধুরী | ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০

মুক্তিযুদ্ধে মেজর নাজমুল হক ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অনন্য অবদান রাখলেও গত ৪৯ বছরে কোনো পদক বা সম্মান পাননি তিনি। মেজর নাজমুলের পরিবার লড়ে যাচ্ছে মহান বীর সেনানায়কের উপযুক্ত সম্মানের জন্য। লিখেছেন পুষ্পেন চৌধুরী
একাত্তরের বীর নায়ক
একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারা দেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বারুদের মতো ফুঁসছে। দফায় দফায় ছাত্র, জনতা, কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্তসহ সবার আন্দোলন চলছে। উইং কমান্ডার নাজমুল হকের দেশ পাকিস্তানের শোষণ ও শাসন থেকে থেকে মুক্তির জন্য লড়ছে। এই সময়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সব জনতা। এর মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সশস্ত্র সংঘাত হচ্ছে। অনেক নিরীহ ও প্রতিবাদী বাঙালি আহত, নিহত হচ্ছেন। রাজশাহীতে গুলি চলছে। সব খবরই পাচ্ছেন মেজর নাজমুল হক। তাদের স্তব্ধ করে দিয়ে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে কালরাত নেমে এলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করল। নাজমুল বুঝতে পারলেন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে পারেননি নাজমুল। পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে চাপ দিতে থাকলেন তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য। শুধু চাপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি নাজমুল, যুদ্ধের জন্য বাঙালি কর্মকর্তা, জওয়ানদের এক করে ফেলেছেন। যদিও কোনো বাঙালির কাছে দায়িত্ব দিতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত নাজমুলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেন পাঞ্জাবি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম।
২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। নওগাঁয় সে খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজমুল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬ মার্চ নওগাঁর মহকুমাকে মুক্তাঞ্চল (স্বাধীন বাংলার অংশ) ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গড়ে তুললেন ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) নেতৃত্বে তার ‘ইপিআর-মুজাহিদ বাহিনী’।
কর্ম-অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ সেনা অফিসারের জীবন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি হৃদয় দিয়ে টের পেয়েছিলেন নাজমুল হক। ভাবতেন তার দেশের মুক্তিযুদ্ধ হবে ‘গণযুদ্ধ’। ছাত্র, যুব, কৃষক ও জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদের গেরিলাযুদ্ধ চলবে। এ সময় সবাই মিলে জমিতে ফসল উৎপাদন করে খাবারের সংস্থান করতে হবে। পাশাপাশি অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। বাঙালির রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে। সব সময় তাই সাধারণ মানুষ ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বলতেন ‘আপনারা সবাই যদি প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যান, তাহলে তো আমাদের কৃষিজমিগুলো পড়ে থাকবে। চরম খাদ্য সংকট দেখা দেবে। কী খেয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করব?’ এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৭ নম্বর সেক্টরের কৃষক-জনতা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। অবসরে কৃষিকাজে নেমে পড়েছেন।
নাজমুলের মুক্তিবাহিনী
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার নিয়োগ হলেন। জুলাইয়ে তাকে ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। নাজমুল হকের যুদ্ধ এলাকাগুলো ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুরের অংশবিশেষ। সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামের বালুরঘাটের কাছের তরঙ্গপুর। মেজর নাজমুল হকের অধীনে মোট ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। তার নিয়মিত বাহিনীতে সৈন্য ছিলেন ২ হাজার ৫০০ জন। নাজমুল হকের গণবাহিনীতে ১২ হাজার ৫০০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রতিটি সেক্টরের মতো তার অধীনেও আটটি সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
অনেকগুলো স্মরণীয় অপারেশন করে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছেন সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক। এই নামটি সারা মুক্তাঞ্চলে প্রথম ছড়াল ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের অপারেশনের পর। মেজর নাজমুল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সাহায্যে এই দিন তার ইপিআর-মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় অপারেশন পরিচালনা করলেন। তারা পাকিস্তানিদের হতাহত করে নবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত করলেন। এরপর এখান থেকে এবং নাটোর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে রাজশাহীতে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টিকতে না পরে পিছু হটতে থাকল। আহত ও নিহত হলো অনেকে। পেছাতে পেছাতে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিল তারা, কিন্তু দক্ষ সেনা কমান্ডার নাজমুল হক তাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবরুদ্ধ করে ফেললেন।
সাধারণ বাঙালি পোশাক লুঙ্গি, মাথায় গামছা বাঁধা মাত্র ২৪ জন মুক্তিসেনাকে নিয়ে পুনর্ভবা নদীর তীরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র রহনপুরে হাজির হয়েছেন নাজমুল। দু®প্রাপ্য মর্টার মাইলের পর মাইল হেঁটে বয়ে নিয়েছেন। শত্রুর ছাউনি থেকে মাত্র ২০০ গজের ভেতরে ঢুকেছেন এবং মর্টারে আক্রমণ করে হারিয়েছেন। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন বগুড়া। জেলাটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যামুনেশান প্লাটুন)। এখানে রংপুরের ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদ সঞ্চিত রাখা হতো। মেজর নাজমুল তার মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকেই ৯১ আইপিএ প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন রংপুরেও যেতে না পারে সেজন্য অভিযান পরিচালনা করলেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী থেকে পাবনার প্রতিটি প্রতিরোধ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মেজর নাজমুল হকের নির্দেশ ও পরিকল্পনায়। অকুতোভয় ও ভীষণ দেশপ্রেমিক এই সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সেক্টরের প্রতি সাব-সেক্টরের প্রতিটি অপারেশনে সরাসরি যুক্ত থেকেছেন। তিনি ও তার মুক্তিবাহিনী মরণপণ যুদ্ধ করেছেন।
১৯৭১ সালের ১০ মে বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক মিলান জে কিউবিকের নেওয়া আঞ্চলিক কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে মুক্তিবাহিনীর মেজর বলেছেন, ‘আমাদের কাপুরুষের মৃত্যুর চেয়ে রাইফেল হাতে বীরের মতো মৃত্যু অনেক শ্রেয় বলে আমি মনে করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যত ধ্বংসযজ্ঞই চালাক না কেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এতটুকু মনোবল হারায়নি। শিগগিরই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য চূড়ান্ত বিজয় লাভ করব। সময় আসছে পাকিস্তানি সেনারা গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো পালানোর পথ খুঁজবে।’
১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তার অধীনে শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন। একটি অপারেশনের কথা তিনি সব সময় বলতেন, ‘দিনাজপুরের ধনধনিয়া পাড়ায় ১৮ জুন আমাদের মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হলো। মেজর নিজেই যুদ্ধটি পরিচালনা করেছেন। ফলে ১৪ পাকিস্তানি সেনাকে নিহত করে পাড়াটি মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেল। ৪ জুলাই মেজরের নেতৃত্বে দিনাজপুরের কাঞ্চন সেতুর ওপরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করলাম। তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’
শিক্ষাজীবন
নাজমুল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট, নানাবাড়ি লোহাগাড়ার চুনতি রশিদারঘোনা গ্রামে। মা বড় আদর করে ডাকতেন ‘টুলু’। পরিবারের বড়রা যেখানে পড়াশোনা শেষে উচ্চপর্যায়ে যুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে নাজমুল নিজেও হেঁটেছেন তাদের দেখানো পথে। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় তার দারুণ উৎসাহ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কুমিল্লার বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালা থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। পরে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট) ভর্তি হলেন। তবে নাজমুলের ছিল দেশের প্রতি ভীষণ টান। শিক্ষাজীবনে এগিয়ে তো ছিলেনই, দেশের জন্য পড়া ছেড়ে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে।
পরিবার
শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের জন্ম সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দাদা আহমদুর রহমানের প্রথম পেশা ছিল ওকালতি। ব্রিটিশ আদালতের নাজির হিসেবে চাকরি করেছেন, রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। এই পদটি এখন পরিচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নামে। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। বাবা হাফেজ আহমদ খান অ্যাডভোকেট। সিএসপি পাস করে হয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতার বিখ্যাত আলীপুর আদালতে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দুই বছর পর ১৯৪৯ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাকে বদলি করা হয়েছে পূর্ববাংলার কুমিল্লায়। তার শ্বশুর আসাদ উল্লাহও পেশায় ব্রিটিশদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বড়জন গজনফর আলী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। দ্বিতীয়জন অধ্যাপক আজমত উল্লাহ। মেয়ে জয়নাব বেগম, হাফেজ আহমদের স্ত্রী। হাফেজ-জয়নাব দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। নাজমুল হক দ্বিতীয়।
সেনা অফিসারের জীবন
সেনাজীবনেও নাজমুল রেখেছিলেন সফলতার স্বাক্ষর। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর নিজ যোগ্যতায় পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি, কাকুল থেকে আর্টিলারি কোর বা গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করলেন। চাকরিতে থাকাকালে ১৯৬৮ সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রাম রাইফেলস ক্লাবে নওসাবা মিলির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সবাই ভাবলেন নাজমুল হকের সংসার জীবনের শুরু হলো। এবার ঘরে মন বসবে তার। কিন্তু সংসার নাজমুলকে সেভাবে টানেনি, যতটা টেনেছে তার পরাধীন জন্মভূমি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত যোগ্য এই বাঙালি অফিসার রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। দেশকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পাকিস্তানিদের বঞ্চনা ও বিরোধের প্রতিশোধ নেবেন বলে স্বপ্ন দেখতেন গেরিলাযুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার। তবে স্বপ্ন শুধু তার মধ্যেই বড় হচ্ছিল তা নয়, পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা বুঝে যান সব। তিনি জানতেন জীবনের শঙ্কা আছে, তবু দেশে আসতে ব্যাকুল ছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মেজর নাজমুল হককে উইং কমান্ডার হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হলো নওগাঁয়। তার পরও তিনি নিজের কাজ করে চলেছেন অবিচল। পরের মাসে ছোট ভাই আতাউল হকের বিয়েতে আমিরাবাদ এসেছেন। হঠাৎ পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর থেকে জরুরি চিঠি এলো। তাকে কর্মস্থলে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভীষণ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রত্যেকে যেতে মানা করলেন, কিন্তু নাজমুল হক কারও অনুরোধ রাখতে পারলেন না। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন বলে বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করে তিনি নিজের মরিস মাইনর জিপটি নিয়ে ফেরত চলে গেলেন নওগাঁ।
শহীদ হলেন যেভাবে
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে মিত্রবাহিনীর গোপন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিলেন নাজমুল হক। আলোচনাটি হলো পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি শহরে। সভা শেষে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে গোপনে রাতের অন্ধকারে ফিরছিলেন সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হক। তার গাড়ি চালাচ্ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা চালক। তাকে ক্লান্ত দেখে মেজর বললেন, ‘তুমি তো খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো। এবার বরং আমি চালাই।’ তারা আসন বদলালেন, কিন্তু তিনিও যে ভীষণ ক্লান্ত। তুমুল বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ি পথে গাড়ি রাতের নিকষ আঁধারে হঠাৎ রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল। সেখানেই মারা গেলেন মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সেনা অফিসার মেজর নাজমুল হক। ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে তার সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান জামান ও তার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর (মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ) স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের দুই মেয়ে ইসরাত জাহান সুরভী ও নওরীন সাবা শিউলী তখন একেবারেই শিশু। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে শায়িত করা হয় নাজমুল হককে।