যারা শব্দের রং দেখতে পান
মুমিতুল মিম্মা | ২৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
যাদের সিনেস্থেশিয়া আছে তারা শব্দের বিভিন্ন রং দেখতে পান এবং রঙের আওয়াজও শুনতে পান। সিনেস্থেশিয়া কোনো রোগ নয়। শব্দ ও রং নিয়ে সিনেস্থেটদের বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন মুমিতুল মিম্মা
হুমায়ূন আহমেদের ‘লীলাবতীর মৃত্যু’
হুমায়ূন আহমেদ তার ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ বইয়ে নিজের ছোট ভাই সম্বন্ধে লিখেছেন, “আহসান হাবীব শব্দের রং দেখতে পায়। সে বলে যখনই কোনো শব্দ হয় তখনই সে সেই শব্দের রং দেখে। কখনো নীল, কখনো লাল, সবুজ ও কমলা। মাঝেমধ্যে এমন সব রং দেখে যার অস্তিত্ব বাস্তব পৃথিবীতে নেই। তরুণ গবেষক হিসেবে আমি তাকে নিয়ে গবেষণাও করি। হারমোনিয়ামের একেক রিড একেক ফ্রিকোয়েন্সিতে বাজে। আমি তাকে আলাদা করে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সি বাজিয়ে শোনালাম। সে রং বলল। আমি লিখে রাখলাম।
পনেরো দিন পর আবার সেই পরীক্ষা। রংগুলো যদি বানিয়ে বানিয়ে বলে তাহলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় এলোমেলো ফল আসবে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। গানের সাতটা স্বর হলো সা রে গা মা পা ধা নি। প্রথমবারের পরীক্ষায় সে বলেছে সা : নীল, রে : সবুজ, গা : গাঢ় সবুজ, মা : কমলা ইত্যাদি। পনেরো দিন পর একই পরীক্ষা যদি করা হয়, তাহলে একই উত্তর তাকে দিতে হবে। ভিন্ন উত্তর দিলে বুঝতে হবে রঙের ব্যাপারটা সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
ঘটনা সে রকম ঘটল না। সে একই উত্তর দিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ ধরনের রং দেখার কারও ক্ষমতা আছে তা আমাদের চিন্তায়ও ছিল না। তার মতো ক্ষমতা যে আরও কিছু মানুষের আছে তা জানলাম রাশিয়ান একটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার নাম স্পুতনিক। রিডার্স ডাইজেস্টের মতো পত্রিকা। সেখানে বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার বিষয় ‘কিছু কিছু মানুষের শব্দের রং দেখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা’।”
অবাক করার মতো বিষয় হলো, শব্দের রং অনুভব করা ক্ষমতা নিয়েও মানুষ জন্মগ্রহণ করেন। শব্দকে রঙে পরিবর্তন করার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যারা জন্ম নেন, তাদের বলা হয় সিনেস্থেট (ঝুহবংঃযবঃ) আর তাদের এই সামগ্রিক অবস্থাকে বলা হয় সিনেস্থেশিয়া (ঝুহবংঃযবংরধ)। শব্দটি এসেছে দুটি পৃথক গ্রিক শব্দ ঝুহ (একসঙ্গে) এবং অরংঃযবংরং (প্রত্যক্ষ) থেকে। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায়, একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা অনুভব করা।
এমনিতে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতিটির কাজ আলাদা। এদের প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে। কিন্তু সিনেস্থেটদের ক্ষেত্রে এই ইন্দ্রিয়গুলো বেশির ভাগই আলাদাভাবে কাজ না করে একীভূত হয় এবং একজোট হয়ে কাজ করে। কোনো কিছু দেখার সঙ্গে হয়তো শব্দ শোনার মতো অনুভূতি একীভূত হয়ে যাচ্ছে অথবা স্বাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে স্পর্শের মতো কোনো অনুভূতি। যখন একটা ইন্দ্রিয় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন অনুভূতিগুলোর এ রকম পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দেখা যায়। একেই সিনেস্থেশিয়া পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
কারা শব্দের রং দেখতে পান
প্রতি পঁচিশ হাজার মানুষের মধ্যে একজন সিনেস্থেটের দেখা মেলে। এটি একটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে আসে। তবে বাবা নাকি মা কার তরফ থেকে এটি পরের প্রজন্মে বর্তায় তা নিয়ে গবেষকদের ভেতরে মতভেদ রয়েছে।
পুরুষের তুলনায় নারীদের ভেতরে সিনেস্থেট হওয়ার সম্ভাবনা ছয় গুণ বেশি। ফলে প্রথমদিকে গবেষকদের ধারণা ছিল এটি মায়ের মাধ্যমে তার উত্তরসূরিদের ভেতরে প্রবাহিত হয়। সময়ের সঙ্গে গবেষণার ব্যাপ্তি যত বেড়েছে, তত একটি নির্দিষ্ট জিন বৈশিষ্ট্যের ধারণা থেকে তারা সরে এসেছেন। গবেষকরা আশা করছেন ডিএনএ নিয়ে গবেষণার একপর্যায়ে তারা এর সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
আইজাক নিউটন
সাধারণ মানুষদের তুলনায় সিনেস্থেটদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার সম্ভাবনা আট গুণ বেশি। সে ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট যে, তাদের অনুভূতির তারল্য ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায় এবং শিল্প-সাহিত্যমনা করে তোলে। সিনেস্থেশিয়া শুধু রং বা শব্দ অনুভবের বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে সিনেস্থেটদের মস্তিষ্কের অনেক বেশি অংশ কর্মক্ষম। মূলত এ কারণেই তারা প্রচলিত বৃত্তের অনেক বেশি বাইরে বেরিয়ে ভাবতে সক্ষম।
সিনেস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ ডক্টর রামাচন্দ্রনের ভাষ্য মতে, ‘আইজাক নিউটন আলোক বর্ণালি তত্ত্বে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে রঙের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়েছেন। তার বহু দিন আগে থেকেই শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল কিন্তু এর সঙ্গে রঙের কোনো সম্পর্ক কারও ভাবনায় আসেনি। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি নিউটনের সিনেস্থেশিয়া ছিল কি না। বিশেষ করে তিনি যে খেলনা বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, সেখানে আলাদা আলাদা মিউজিক নোটের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ঝলকানি ছিল। এটাই আমার ভাবনাকে দৃঢ় করে।’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যত দূর জানা যায়, শব্দ ও রঙের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন মিলানের শিল্পী গুইসেপি আরকিমবোল্ডো। সেটি ছিল ষোড়শ শতকের শেষভাগে। প্রাগের তৎকালীন শাসক দ্বিতীয় রুডলফের দরবারের একজন সংগীতজ্ঞের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তারা দুজনে মিলে সংগীতের সঙ্গে রঙের সম্পর্ক নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেন। এর ফলে গ্রাভিচেম্বালো নামক একটি পিয়ানো জাতীয় বাদ্যযন্ত্রে মিউজিক নোট অনুসারে নানা রঙের কাগজ যুক্ত করেন গুইসেপি।
প্রকারভেদ
সিনেস্থেশিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। দৃশ্যগত ও অনুভবগত। দৃশ্যগত সিনেস্থেশিয়ায় উদ্দীপ্ত অবস্থায় রং, আকার, আকৃতি দেখা যায়। অনুভবগত সিনেস্থেশিয়ায় উত্তেজিত অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উদ্দীপক ও অনুভূতির একটা দৃঢ় সংযোগ টের পাওয়া যায়।
সিনেস্থেশিয়ার নানা প্রকারভেদ থাকলেও সবগুলো তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ডক্টর নিকোলাস রোথেনের মতে, সাধারণভাবে যে সিনেস্থেশিয়ার রকমভেদগুলোর দেখা যায় তা হলো, শব্দ থেকে রং (যারা শব্দের রং দেখতে পান), গ্রাফিম থেকে রং (যারা অক্ষর এবং পাঠ্যের বিভিন্ন রং দেখতে পান), ক্রম থেকে স্থান (যারা সংখ্যাক্রম যেমন মাসের তারিখগুলোকে উপস্থাপিত নির্দিষ্ট স্থানে না দেখে ভিন্ন স্থানে সজ্জিত দেখতে পান), সংখ্যা থেকে আকৃতি (যারা উপস্থাপিত সংখ্যাকে যেকোনো আকৃতিতে সজ্জিত অবস্থায় দেখতে পান) ইত্যাদি।
সিনেস্থেট শিল্পীরা
আমাদের পরিচিত অনেক শিল্পীই সিনেস্থেট। বিলি জোয়েল, লেডি গাগা থেকে নিয়ে ভøাদিমির নাবোকভ, ডিউক এলিংটন বা স্টিভ উওন্ডার পর্যন্ত অনেক মিউজিশিয়ানের মধ্যেই নানা মাত্রায় সিনেস্থেশিয়ার উপস্থিতি আছে। নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের ভাষ্য মতে, মেরিলিন মনরোও সামান্য মাত্রায় সিনেস্থেটিক ছিলেন। আবার চিত্রশিল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ওয়াসিলি কান্ডিনস্কি, ডেভিড হকনি, চার্লস এফারিম বার্চফিল্ড, জন মিচেল এমনকি ভিনসেন্ট ভ্যান গগ পর্যন্ত সিনেস্থেট ছিলেন।
তাদের অনেকে নিজের এই পরিস্থিতি নিয়ে নিজেরাও লেখালেখি করেছেন। সিনক্রোনিজম ও ডার ব্লাউ রেইটারের মতো শিল্প আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে সিনেস্থেশিয়া। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে, প্যালিওলিথিক গুহাচিত্রের যুগেও সিনেস্থেশিয়ার ছাপ মেলে। সময়ের সঙ্গে সিনেস্থিশিয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে এর ব্যবহার সম্পর্কেও জানা সম্ভব হচ্ছে। ব্রিটেনের টেইট আর্ট মিউজিয়াম সিনেস্থেশিয়াকে আলাদা আর্ট ফর্ম হিসেবে সংজ্ঞায়ন করেছে। ডেনভার আর্ট মিউজিয়ামে কানডিনস্কির চিত্রকর্ম নিয়ে বিশ্লেষণে সিনেস্থেশিয়াকে একটা আলাদা অধ্যায় হিসেবে দেখাচ্ছে। সাহিত্যে সিনেস্থেশিয়াকে অনেক ক্ষেত্রেই ‘উপমা’ হিসেবে দেখানো হয়। যেমন তেতো সত্য। অবাক করার বিষয় হচ্ছে মানুষের জিভের টেস্টবাড দিয়ে সত্যকে চেখে স্বাদ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু উপমা হিসেবে হরহামেশাই আমরা এগুলোকে ব্যবহার করে থাকি।
সম্প্রতি পুরো মিউজিক ফেস্টিভ্যালকে একটা ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী জ্যাক কাল্টার যিনি নিজে একজন সিনেস্থেট। তিনি তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘জীবনে প্রথমবারের মতো আমি আমার সিনেস্থেশিয়া টের পাই নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরে রঙের স্ফূরণ দেখে। তখন ভেবেছিলাম এটা আমার স্বাভাবিক বৃদ্ধিরই অংশ। ঠিক সেদিনই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। দেখলাম বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ঘিরে শতসহস্র রঙের অনুরণন। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম রঙের মাধ্যমে। এগারো বছর বয়সে আমার শিক্ষক আমাকে হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন জীবন থেকে নেওয়া কিছু আঁকার জন্য।
আমার সহপাঠীরা সবাই ফলের ঝুড়ি বা পরিবারের লোকদের ছবি এঁকে নিয়ে গেল। আমি দুই পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু রং নিয়ে আমার উপলব্ধি এঁকে গেছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সব সময় এভাবেই আঁকি কি না। আমি আমার ভাষায় জীবনকে ব্যক্ত করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনুভূতিকে মুখের ভাষায় প্রকাশ না করে অন্যভাবেও ব্যক্ত করা সম্ভব। প্রতিটি সিনেস্থেশিয়াই অনন্য। প্রতি মুহূর্তের এই শব্দ-রঙের পাল্টাপাল্টি খেলা আমার শক্তিকে ক্ষয় করতে থাকে। একই সঙ্গে ঘটতে থাকা দুটো প্যারাডাইম বাস্তবতা ও আমার মাথার ভেতরে চলমান রঙের খেলা। এই দুই মাত্রা প্রতি মুহূর্তে আমার মধ্যে দুটো পৃথক অনুভূতির জন্ম দেয়। এক প্যারাডাইমে মাঝেমধ্যেই আমি ভুলে যাই আমি কে, অন্য প্যারাডাইমটি বর্ণনাতীত সুন্দর। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে, যে কেউ দুটো প্যারাডাইমকে সামাল দিতে শিখে যায়। তাদের ভেতরেও উত্থান-পতন হয়। সিনেস্থেশিয়া আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ আমি একজন শিল্পী এবং আমার রোজকার জীবন দৃশ্যমান রঙে ভরপুর।’ সিনেস্থেটদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘একজন সিনেস্থেটকে অনেক সময় ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস হিসেবে রোমান্টিসাইজ করা হয়। এটা আমার জন্য প্রশংসাই বটে। সিনেস্থেটিক মানে এই না যে আমি অন্যদের চেয়ে বেশি ভালো। আমি শুধু আমার অধিকতর রঙিন দুনিয়াকে উপলব্ধি করছি, যা আমার শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। এটুকুই একজন শিল্পী এবং সিনেস্থেটের জন্য বড় পাওয়া।’
চিত্রশিল্পী ক্যারোল স্টিন বলেছেন, ‘আমার কাছে পিয়ানো হচ্ছে গোলাপি রঙের, ভায়োলিন কমলা এবং চেলো হচ্ছে সবুজ। যখন কেউ পিয়ানো বাজায় আমার আশপাশে, তখন প্রথমেই আমি মাথার ভেতরে গোলাপি রঙের ঝলকানি দেখি।’ নিউরোসায়েন্সে সিনেস্থেশিয়ারকে কোনো অসুখ হিসেবে দেখা হয় না। এর কোনো চিকিৎসা নেই। এটাকে বিবেচনা করা হয় শিল্পসত্তার অংশ হিসেবে। তাই বেশির ভাগ সিনেস্থেটরাই তাদের এই পরিস্থিতিকে আনন্দদায়ক হিসেবে দেখেন। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে একটু আলাদাভাবে পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু সব সিনেস্থেট নিজের পরিস্থিতিকে আনন্দদায়ক হিসেবে নাও দেখতে পারেন। সিনেস্থেশিয়া পরিস্থিতি তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। তারা এই সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক মানুষদের বোঝাতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান। তারা যখন বুঝতে পারেন ‘সাধারণের চেয়ে তারা আলাদা’, তখন একাকী হয়ে যাওয়ার ভয় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভীত করে রাখে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেভিড ইগলম্যানের ভাষায়, ‘দুটো দেশের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে রাখা সত্ত্বেও তারা কথা বলছে সিনেস্থেশিয়া হচ্ছে অনেকটা এ রকম পরিস্থিতি।’ ২০০৫ সালে ইলগম্যান তার ওয়েবসাইট ‘সিনেস্থেশিয়া ব্যাটারি’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে অনলাইন-টেস্টের মাধ্যমে বলে দেওয়া যাবে কে সিনেস্থেশিয়ায় আক্রান্ত এবং কার কোন ধরনের সিনেস্থেশিয়া রয়েছে। ইতিমধ্যে চল্লিশ হাজারেরও বেশি সিনেস্থেটকে তারা চিহ্নিত করেছে।
সিনেস্থেটদের প্রতিষ্ঠান
সিনেস্থেটদের পথচলাকে সুগম করতে চিত্রশিল্পী ক্যারোল স্টিন ও লেখক প্যাট্রিসিয়া লিন ডাফি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান সিনেস্থেশিয়া অ্যাসোসিয়েশন’।
প্রতিষ্ঠানটির মিশন হচ্ছে সিনেস্থেটদের শিক্ষার ভার নেওয়া, সিনেস্থেশিয়া নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার কাজকে প্রচার করা এবং যারা সিনেস্থেশিয়া নিয়ে কাজ করছেন তাদের নিয়ে প্রচার করা। এখনো পর্যন্ত আমেরিকার বারোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেস্থেশিয়া নিয়ে কনফারেন্সের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সালে বার্নাডেট শেরিডান গ্রাফিম-কালার সিনেস্থেশিয়া নিয়ে ‘সিনেস্থেশিয়া ডট মি’ নামক একটি প্রজেক্ট চালু করেছেন। প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে ‘হোয়াট কালার ইজ ইয়োর নেম’ নামক একটি সেকশন রয়েছে। যেখানে যেকোনো গ্রাহক ইংরেজি অক্ষরে তার নাম লিখলে নামটিকে সে সিনেস্থেটদের ভাষায় সেটা রঙিন দাগযুক্ত একটি ছবিতে রূপান্তরিত করে। ভাষান্তরের এই পারস্পরিক রূপটি সিনেস্থেটদের পৃথিবীকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।
শেয়ার করুন
মুমিতুল মিম্মা | ২৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

যাদের সিনেস্থেশিয়া আছে তারা শব্দের বিভিন্ন রং দেখতে পান এবং রঙের আওয়াজও শুনতে পান। সিনেস্থেশিয়া কোনো রোগ নয়। শব্দ ও রং নিয়ে সিনেস্থেটদের বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন মুমিতুল মিম্মা
হুমায়ূন আহমেদের ‘লীলাবতীর মৃত্যু’
হুমায়ূন আহমেদ তার ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ বইয়ে নিজের ছোট ভাই সম্বন্ধে লিখেছেন, “আহসান হাবীব শব্দের রং দেখতে পায়। সে বলে যখনই কোনো শব্দ হয় তখনই সে সেই শব্দের রং দেখে। কখনো নীল, কখনো লাল, সবুজ ও কমলা। মাঝেমধ্যে এমন সব রং দেখে যার অস্তিত্ব বাস্তব পৃথিবীতে নেই। তরুণ গবেষক হিসেবে আমি তাকে নিয়ে গবেষণাও করি। হারমোনিয়ামের একেক রিড একেক ফ্রিকোয়েন্সিতে বাজে। আমি তাকে আলাদা করে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সি বাজিয়ে শোনালাম। সে রং বলল। আমি লিখে রাখলাম।
পনেরো দিন পর আবার সেই পরীক্ষা। রংগুলো যদি বানিয়ে বানিয়ে বলে তাহলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় এলোমেলো ফল আসবে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। গানের সাতটা স্বর হলো সা রে গা মা পা ধা নি। প্রথমবারের পরীক্ষায় সে বলেছে সা : নীল, রে : সবুজ, গা : গাঢ় সবুজ, মা : কমলা ইত্যাদি। পনেরো দিন পর একই পরীক্ষা যদি করা হয়, তাহলে একই উত্তর তাকে দিতে হবে। ভিন্ন উত্তর দিলে বুঝতে হবে রঙের ব্যাপারটা সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
ঘটনা সে রকম ঘটল না। সে একই উত্তর দিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ ধরনের রং দেখার কারও ক্ষমতা আছে তা আমাদের চিন্তায়ও ছিল না। তার মতো ক্ষমতা যে আরও কিছু মানুষের আছে তা জানলাম রাশিয়ান একটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার নাম স্পুতনিক। রিডার্স ডাইজেস্টের মতো পত্রিকা। সেখানে বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার বিষয় ‘কিছু কিছু মানুষের শব্দের রং দেখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা’।”
অবাক করার মতো বিষয় হলো, শব্দের রং অনুভব করা ক্ষমতা নিয়েও মানুষ জন্মগ্রহণ করেন। শব্দকে রঙে পরিবর্তন করার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যারা জন্ম নেন, তাদের বলা হয় সিনেস্থেট (ঝুহবংঃযবঃ) আর তাদের এই সামগ্রিক অবস্থাকে বলা হয় সিনেস্থেশিয়া (ঝুহবংঃযবংরধ)। শব্দটি এসেছে দুটি পৃথক গ্রিক শব্দ ঝুহ (একসঙ্গে) এবং অরংঃযবংরং (প্রত্যক্ষ) থেকে। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায়, একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা অনুভব করা।
এমনিতে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতিটির কাজ আলাদা। এদের প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে। কিন্তু সিনেস্থেটদের ক্ষেত্রে এই ইন্দ্রিয়গুলো বেশির ভাগই আলাদাভাবে কাজ না করে একীভূত হয় এবং একজোট হয়ে কাজ করে। কোনো কিছু দেখার সঙ্গে হয়তো শব্দ শোনার মতো অনুভূতি একীভূত হয়ে যাচ্ছে অথবা স্বাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে স্পর্শের মতো কোনো অনুভূতি। যখন একটা ইন্দ্রিয় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন অনুভূতিগুলোর এ রকম পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দেখা যায়। একেই সিনেস্থেশিয়া পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
কারা শব্দের রং দেখতে পান
প্রতি পঁচিশ হাজার মানুষের মধ্যে একজন সিনেস্থেটের দেখা মেলে। এটি একটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে আসে। তবে বাবা নাকি মা কার তরফ থেকে এটি পরের প্রজন্মে বর্তায় তা নিয়ে গবেষকদের ভেতরে মতভেদ রয়েছে।
পুরুষের তুলনায় নারীদের ভেতরে সিনেস্থেট হওয়ার সম্ভাবনা ছয় গুণ বেশি। ফলে প্রথমদিকে গবেষকদের ধারণা ছিল এটি মায়ের মাধ্যমে তার উত্তরসূরিদের ভেতরে প্রবাহিত হয়। সময়ের সঙ্গে গবেষণার ব্যাপ্তি যত বেড়েছে, তত একটি নির্দিষ্ট জিন বৈশিষ্ট্যের ধারণা থেকে তারা সরে এসেছেন। গবেষকরা আশা করছেন ডিএনএ নিয়ে গবেষণার একপর্যায়ে তারা এর সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
আইজাক নিউটন
সাধারণ মানুষদের তুলনায় সিনেস্থেটদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার সম্ভাবনা আট গুণ বেশি। সে ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট যে, তাদের অনুভূতির তারল্য ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায় এবং শিল্প-সাহিত্যমনা করে তোলে। সিনেস্থেশিয়া শুধু রং বা শব্দ অনুভবের বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে সিনেস্থেটদের মস্তিষ্কের অনেক বেশি অংশ কর্মক্ষম। মূলত এ কারণেই তারা প্রচলিত বৃত্তের অনেক বেশি বাইরে বেরিয়ে ভাবতে সক্ষম।
সিনেস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ ডক্টর রামাচন্দ্রনের ভাষ্য মতে, ‘আইজাক নিউটন আলোক বর্ণালি তত্ত্বে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে রঙের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়েছেন। তার বহু দিন আগে থেকেই শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল কিন্তু এর সঙ্গে রঙের কোনো সম্পর্ক কারও ভাবনায় আসেনি। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি নিউটনের সিনেস্থেশিয়া ছিল কি না। বিশেষ করে তিনি যে খেলনা বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, সেখানে আলাদা আলাদা মিউজিক নোটের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ঝলকানি ছিল। এটাই আমার ভাবনাকে দৃঢ় করে।’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যত দূর জানা যায়, শব্দ ও রঙের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন মিলানের শিল্পী গুইসেপি আরকিমবোল্ডো। সেটি ছিল ষোড়শ শতকের শেষভাগে। প্রাগের তৎকালীন শাসক দ্বিতীয় রুডলফের দরবারের একজন সংগীতজ্ঞের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তারা দুজনে মিলে সংগীতের সঙ্গে রঙের সম্পর্ক নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেন। এর ফলে গ্রাভিচেম্বালো নামক একটি পিয়ানো জাতীয় বাদ্যযন্ত্রে মিউজিক নোট অনুসারে নানা রঙের কাগজ যুক্ত করেন গুইসেপি।
প্রকারভেদ
সিনেস্থেশিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। দৃশ্যগত ও অনুভবগত। দৃশ্যগত সিনেস্থেশিয়ায় উদ্দীপ্ত অবস্থায় রং, আকার, আকৃতি দেখা যায়। অনুভবগত সিনেস্থেশিয়ায় উত্তেজিত অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উদ্দীপক ও অনুভূতির একটা দৃঢ় সংযোগ টের পাওয়া যায়।
সিনেস্থেশিয়ার নানা প্রকারভেদ থাকলেও সবগুলো তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ডক্টর নিকোলাস রোথেনের মতে, সাধারণভাবে যে সিনেস্থেশিয়ার রকমভেদগুলোর দেখা যায় তা হলো, শব্দ থেকে রং (যারা শব্দের রং দেখতে পান), গ্রাফিম থেকে রং (যারা অক্ষর এবং পাঠ্যের বিভিন্ন রং দেখতে পান), ক্রম থেকে স্থান (যারা সংখ্যাক্রম যেমন মাসের তারিখগুলোকে উপস্থাপিত নির্দিষ্ট স্থানে না দেখে ভিন্ন স্থানে সজ্জিত দেখতে পান), সংখ্যা থেকে আকৃতি (যারা উপস্থাপিত সংখ্যাকে যেকোনো আকৃতিতে সজ্জিত অবস্থায় দেখতে পান) ইত্যাদি।
সিনেস্থেট শিল্পীরা
আমাদের পরিচিত অনেক শিল্পীই সিনেস্থেট। বিলি জোয়েল, লেডি গাগা থেকে নিয়ে ভøাদিমির নাবোকভ, ডিউক এলিংটন বা স্টিভ উওন্ডার পর্যন্ত অনেক মিউজিশিয়ানের মধ্যেই নানা মাত্রায় সিনেস্থেশিয়ার উপস্থিতি আছে। নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের ভাষ্য মতে, মেরিলিন মনরোও সামান্য মাত্রায় সিনেস্থেটিক ছিলেন। আবার চিত্রশিল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ওয়াসিলি কান্ডিনস্কি, ডেভিড হকনি, চার্লস এফারিম বার্চফিল্ড, জন মিচেল এমনকি ভিনসেন্ট ভ্যান গগ পর্যন্ত সিনেস্থেট ছিলেন।
তাদের অনেকে নিজের এই পরিস্থিতি নিয়ে নিজেরাও লেখালেখি করেছেন। সিনক্রোনিজম ও ডার ব্লাউ রেইটারের মতো শিল্প আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে সিনেস্থেশিয়া। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে, প্যালিওলিথিক গুহাচিত্রের যুগেও সিনেস্থেশিয়ার ছাপ মেলে। সময়ের সঙ্গে সিনেস্থিশিয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে এর ব্যবহার সম্পর্কেও জানা সম্ভব হচ্ছে। ব্রিটেনের টেইট আর্ট মিউজিয়াম সিনেস্থেশিয়াকে আলাদা আর্ট ফর্ম হিসেবে সংজ্ঞায়ন করেছে। ডেনভার আর্ট মিউজিয়ামে কানডিনস্কির চিত্রকর্ম নিয়ে বিশ্লেষণে সিনেস্থেশিয়াকে একটা আলাদা অধ্যায় হিসেবে দেখাচ্ছে। সাহিত্যে সিনেস্থেশিয়াকে অনেক ক্ষেত্রেই ‘উপমা’ হিসেবে দেখানো হয়। যেমন তেতো সত্য। অবাক করার বিষয় হচ্ছে মানুষের জিভের টেস্টবাড দিয়ে সত্যকে চেখে স্বাদ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু উপমা হিসেবে হরহামেশাই আমরা এগুলোকে ব্যবহার করে থাকি।
সম্প্রতি পুরো মিউজিক ফেস্টিভ্যালকে একটা ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী জ্যাক কাল্টার যিনি নিজে একজন সিনেস্থেট। তিনি তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘জীবনে প্রথমবারের মতো আমি আমার সিনেস্থেশিয়া টের পাই নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরে রঙের স্ফূরণ দেখে। তখন ভেবেছিলাম এটা আমার স্বাভাবিক বৃদ্ধিরই অংশ। ঠিক সেদিনই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। দেখলাম বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ঘিরে শতসহস্র রঙের অনুরণন। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম রঙের মাধ্যমে। এগারো বছর বয়সে আমার শিক্ষক আমাকে হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন জীবন থেকে নেওয়া কিছু আঁকার জন্য।
আমার সহপাঠীরা সবাই ফলের ঝুড়ি বা পরিবারের লোকদের ছবি এঁকে নিয়ে গেল। আমি দুই পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু রং নিয়ে আমার উপলব্ধি এঁকে গেছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সব সময় এভাবেই আঁকি কি না। আমি আমার ভাষায় জীবনকে ব্যক্ত করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনুভূতিকে মুখের ভাষায় প্রকাশ না করে অন্যভাবেও ব্যক্ত করা সম্ভব। প্রতিটি সিনেস্থেশিয়াই অনন্য। প্রতি মুহূর্তের এই শব্দ-রঙের পাল্টাপাল্টি খেলা আমার শক্তিকে ক্ষয় করতে থাকে। একই সঙ্গে ঘটতে থাকা দুটো প্যারাডাইম বাস্তবতা ও আমার মাথার ভেতরে চলমান রঙের খেলা। এই দুই মাত্রা প্রতি মুহূর্তে আমার মধ্যে দুটো পৃথক অনুভূতির জন্ম দেয়। এক প্যারাডাইমে মাঝেমধ্যেই আমি ভুলে যাই আমি কে, অন্য প্যারাডাইমটি বর্ণনাতীত সুন্দর। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে, যে কেউ দুটো প্যারাডাইমকে সামাল দিতে শিখে যায়। তাদের ভেতরেও উত্থান-পতন হয়। সিনেস্থেশিয়া আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ আমি একজন শিল্পী এবং আমার রোজকার জীবন দৃশ্যমান রঙে ভরপুর।’ সিনেস্থেটদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘একজন সিনেস্থেটকে অনেক সময় ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস হিসেবে রোমান্টিসাইজ করা হয়। এটা আমার জন্য প্রশংসাই বটে। সিনেস্থেটিক মানে এই না যে আমি অন্যদের চেয়ে বেশি ভালো। আমি শুধু আমার অধিকতর রঙিন দুনিয়াকে উপলব্ধি করছি, যা আমার শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। এটুকুই একজন শিল্পী এবং সিনেস্থেটের জন্য বড় পাওয়া।’
চিত্রশিল্পী ক্যারোল স্টিন বলেছেন, ‘আমার কাছে পিয়ানো হচ্ছে গোলাপি রঙের, ভায়োলিন কমলা এবং চেলো হচ্ছে সবুজ। যখন কেউ পিয়ানো বাজায় আমার আশপাশে, তখন প্রথমেই আমি মাথার ভেতরে গোলাপি রঙের ঝলকানি দেখি।’ নিউরোসায়েন্সে সিনেস্থেশিয়ারকে কোনো অসুখ হিসেবে দেখা হয় না। এর কোনো চিকিৎসা নেই। এটাকে বিবেচনা করা হয় শিল্পসত্তার অংশ হিসেবে। তাই বেশির ভাগ সিনেস্থেটরাই তাদের এই পরিস্থিতিকে আনন্দদায়ক হিসেবে দেখেন। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে একটু আলাদাভাবে পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু সব সিনেস্থেট নিজের পরিস্থিতিকে আনন্দদায়ক হিসেবে নাও দেখতে পারেন। সিনেস্থেশিয়া পরিস্থিতি তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। তারা এই সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক মানুষদের বোঝাতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান। তারা যখন বুঝতে পারেন ‘সাধারণের চেয়ে তারা আলাদা’, তখন একাকী হয়ে যাওয়ার ভয় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভীত করে রাখে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেভিড ইগলম্যানের ভাষায়, ‘দুটো দেশের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে রাখা সত্ত্বেও তারা কথা বলছে সিনেস্থেশিয়া হচ্ছে অনেকটা এ রকম পরিস্থিতি।’ ২০০৫ সালে ইলগম্যান তার ওয়েবসাইট ‘সিনেস্থেশিয়া ব্যাটারি’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে অনলাইন-টেস্টের মাধ্যমে বলে দেওয়া যাবে কে সিনেস্থেশিয়ায় আক্রান্ত এবং কার কোন ধরনের সিনেস্থেশিয়া রয়েছে। ইতিমধ্যে চল্লিশ হাজারেরও বেশি সিনেস্থেটকে তারা চিহ্নিত করেছে।
সিনেস্থেটদের প্রতিষ্ঠান
সিনেস্থেটদের পথচলাকে সুগম করতে চিত্রশিল্পী ক্যারোল স্টিন ও লেখক প্যাট্রিসিয়া লিন ডাফি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান সিনেস্থেশিয়া অ্যাসোসিয়েশন’।
প্রতিষ্ঠানটির মিশন হচ্ছে সিনেস্থেটদের শিক্ষার ভার নেওয়া, সিনেস্থেশিয়া নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার কাজকে প্রচার করা এবং যারা সিনেস্থেশিয়া নিয়ে কাজ করছেন তাদের নিয়ে প্রচার করা। এখনো পর্যন্ত আমেরিকার বারোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেস্থেশিয়া নিয়ে কনফারেন্সের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সালে বার্নাডেট শেরিডান গ্রাফিম-কালার সিনেস্থেশিয়া নিয়ে ‘সিনেস্থেশিয়া ডট মি’ নামক একটি প্রজেক্ট চালু করেছেন। প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে ‘হোয়াট কালার ইজ ইয়োর নেম’ নামক একটি সেকশন রয়েছে। যেখানে যেকোনো গ্রাহক ইংরেজি অক্ষরে তার নাম লিখলে নামটিকে সে সিনেস্থেটদের ভাষায় সেটা রঙিন দাগযুক্ত একটি ছবিতে রূপান্তরিত করে। ভাষান্তরের এই পারস্পরিক রূপটি সিনেস্থেটদের পৃথিবীকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।