ববি পিন থেকে বাড়ি জেতার গল্প
আরফাতুন নাবিলা | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
করোনা সংক্রমণের সময়ে সবাই যখন ঘরবন্দি হয়ে সময় কাটাচ্ছিল তখন সানফ্রান্সিসকোর ডেমি স্কিপার পরিকল্পনা করলেন এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে মজার কিছু করবেন। একটি ববি পিনের বদলে বাড়ির মালিক হওয়ার পরিকল্পনায় মাঠে নামেন তিনি। মাত্র ছয় মাসেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়। কীভাবে এই পরিকল্পনা সফল করেছিলেন স্কিপার তা নিয়ে লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
পরিকল্পনার শুরু
২০০৫ সালে কানাডিয়ান ব্লগার কেলি ম্যাকডোনাল্ড একটি ঘটনা দিয়ে বেশ পরিচিত হয়েছিলেন। ছোট্ট একটি লাল রঙের পেপারক্লিপ দিয়ে বদলা-বদলি শুরু করে ১৪ বারের মাথায় দুই রুমের একটি ফার্ম হাউজের মালিক হয়ে যান তিনি। এই ঘটনাটি দারুণ উৎসাহিত করেছিল সানফ্রান্সিসকোর ২৯ বছর বয়সী ডেমি স্কিপারকে। ভাবলেন এমন কিছু তিনিও করতে পারেন কি না। যেই ভাবা সেই কাজ। পুরনো সেই ঘটনাকে নতুন করে আরও একবার সামনে আনতে মাঠে নামলেন তিনি। যদিও জানতেন না ঠিক কতটুকু সফল হবেন। তবু ভাবলেন, কেলি যখন পেরেছেন, তখন তার পক্ষেও সম্ভব। অন্তত চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টে লিখলেন ‘ববি পিন দিয়ে যাত্রা শুরু হলো, বাড়ির মালিক হলে এই যাত্রার শেষ হবে।’ কথাগুলো শুনতে একটু পাগলামির মতো মনে হলেও বেশ কয়েকটি জিনিস দিয়ে এই লেনদেন হয়েছে এবং যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে।
ডেমি যখন টিকটকে ট্রেড মি প্রজেক্টের শুরু করেন তখন ছিল মহামারীর সময়। স্কিপার বলেন, “সময় কারও জন্যই খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। চারপাশে শুধু মন খারাপের খবর। তখন ভাবলাম মজার কিছু করা যাক। ঠিক তখনই এই আইডিয়ার কথা মাথায় এলো। শুরু করলাম ‘ট্রেড মি প্রজেক্ট’।” তার মজার এই প্রজেক্টে স্থবির সে সময়েও প্রচুর মানুষ তাকে ফলো করেছে। সাড়ে তিন মিলিয়ন ফলোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে লাইক ছিল ২৪.৭ মিলিয়ন। তবে লেনদেন করে যে বাড়ি পাওয়ার ইচ্ছা স্কিপার করেছিলেন সেটি তার নিজের জন্য নয়। চেয়েছিলেন এই প্রজেক্টে যত মানুষ যুক্ত হবেন, তাদের মধ্যে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাকে বাড়িটি উপহার হিসেবে দেবেন।
কনসেপ্টটি শুরু হয়েছিল স্কিপারের নিজের কাছে থাকা জিনিস দিয়ে। ‘আমার নিজের কাছে এমন কিছু দিয়েই প্রথমে শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে চুলে লাগানোর জন্য ববি পিন ছিল। যার এই পিন দরকার সে এটি নিয়ে এর বদলে আমাকে এর চেয়ে বড় ও ব্যবহারযোগ্য অন্য কিছু দেবে এটাই ছিল আইডিয়া। যখন শুরু করেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম এ তো শুধু ছোট্ট একটি ববি পিন। এগুলো দিয়ে সর্বোচ্চ কি-ই বা আর পেতে পারি। বাড়ি পাব কখনোই নিশ্চিত ছিলাম না। অথচ দেখুন, ছোট হলেও একটি বাড়ির মালিক আমি এখন!’
রেস্টুরেন্ট রিজার্ভেশন অ্যাপে চাকরির পাশাপাশি বিয়ের পোশাক ভাড়া দেওয়ার একটি ব্যবসাও পরিচালনা করেন স্কিপার। ছোট থেকেই নানা ধরনের কাজ করে বড় হয়েছেন। ট্রেড মি প্রজেক্টের জন্য অন্যকে বুঝিয়ে জিনিস অদল-বদলের করার কৌশলটাকে জন্মগত অভিজ্ঞতাই বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এতকিছু করার পরে কোয়ারেন্টাইনে থেকে নতুন প্রজেক্ট শুরু করার সিদ্ধান্ত খুব সহজ কিছু ছিল না। তবে এই প্রজেক্টটি যে এতটা আলোচিত হবে তা তিনি ভাবেননি। তবে নিজের প্রতি ডেমি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি বাড়ি তিনি না পাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা ছিল লেনদেনের কাজটি চালিয়ে যাওয়া।
গত বছর মে মাসে শুরু হওয়া এই প্রজেক্ট চালুর পর স্কিপার দুটো নিয়ম খুব কঠিনভাবে মেনে চলেছেন। এক. পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব কারও সঙ্গে লেনদেন করেননি। দুই. আরও ভালো জিনিস লেনদেন করা যাবে সে উদ্দেশে বেশি দামের জিনিস যুক্ত করা বা লেনদেনের জিনিসপত্র সারিয়ে তোলেননি।
আধুনিক এ সময়ে প্রথাটি কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও এই বিনিময় প্রথা বেশ পরিচিত সংস্কৃতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় জাপানের একটি লোককাহিনীর কথা। ‘স্ট্র মিলিয়নিয়ার’ নামে এই লোককাহিনীতে একজন জাপানিজ কিংবদন্তি ছিলেন। শুরুতে তিনি গরিব থাকলেও একটি স্ট্র দিয়ে বিনিময় প্রথা শুরু করে একসময় ধনী হয়ে যান। পুরনো হলেও এই প্রথায় নতুনভাবে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই।
লেনদেনে যা ছিল
ডেমি স্কিপারের প্রথম পোস্ট ছিল একটি ববি পিন নিয়ে। তার প্রথম পোস্ট দেখে প্রচুর কমেন্ট এসেছিল। অবশ্য বেশিরভাগই ছিল বিদ্রুপ করা কমেন্ট। সবাই ভেবেছিল, স্কিপার পাগলামি করছেন। শুধু একজন ব্যক্তি জানিয়েছিলেন তিনি ববি পিনের বদলে কানের দুল দিতে চান। তবে শর্ত হচ্ছে, তিনি যখন বাড়ির মালিক হবেন তখন সেখানে তাকে দাওয়াত দিতে হবে। এভাবে শুরু হলো স্কিপারের লেনদেন বাণিজ্য। ০.০১ ডলারের ববি পিন থেকে লেনদেন শুরু করে ১০ ডলারের কানের দুল, ২৪ ডলারের মার্গারিটা গ্লাস, ৬০ ডলারের বাইসেল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ৯৫ ডলারের স্নো বোর্ড। ‘ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটি পাওয়ার পর সেটি দিয়ে বেশ কয়েকটি জিনিস পরিষ্কার করেছি আমি। আবার লেনদেনের আগে অবশ্যই সেটিও পরিষ্কার করে রেখেছিলাম। এটি নেওয়ার জন্য প্রায় এক হাজার মানুষ যোগাযোগ করেছিলেন। এদের মধ্যে খুঁজে একজনকে বের করেছিলাম। ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে ভ্যাকুয়ামের বদলে নিয়ে এসেছিলাম স্নো বোর্ড।’
স্নো বোর্ডের বদলে পেয়েছিলেন ১৮০ ডলারের অ্যাপল টিভি ফোর কে, ২২০ ডলারের বোস নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোন, ৩২০ ডলারের এক্সবক্স ওয়ান +২ গেমস+২ কন্ট্রোলারস+কিনেক্ট সেন্সর বার, ৪০০ ডলারের ম্যাকবুক প্রো ২০১১, ৫৫০ ডলারের ক্যানন ক্যামেরা সেট, ৭৫০ ডলারের অফ হোয়াইট নাইকি ব্লেজারস সাইজ নাইন মেনস, অফ হোয়াইট নাইকি হাইপারডাংক্স, জর্ডান ১ রিভার্স শ্যাটারড ব্যাকবোর্ড, আইফোন ১১ প্রো ম্যাক্স, ১০৯৫ ডলারের ২০০৮ ডজ ক্যারাভান, ১৪০০ ডলারের বুস্টেড বোর্ড ভি৩ প্লাস, ১৫ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো, ৪০০০ ডলারের ইলেকট্রিক বাইক ফুড ট্রাক, মিনি কুপার কনভার্টেবল কার, ১৯,৫০০ ডলারের ডায়মন্ড সেট, ২০০০ ডলারের ব্র্যান্ড নিউ ফিটনেস বাইক, বাইক বদলে মাসটাং, মাসটাং বদলে ২০১১ সালের জিপ প্যাট্রিয়ট। অবশেষে এই জিপের বদলে পেলেন একটি ছোট্ট ঘর (চার চাকার ওপর কাঠের একটি কেবিন)।
বাড়ির আগে গাড়ি
প্রতিটি লেনদেনের গল্পই স্কিপারের জন্য স্মরণীয়। তবে ১০৯৫ ডলারের ২০০৮ জজ ক্যারাভানের মুহূর্তটুকু হয়তো বেশি আবেগের তার কাছে। এই গাড়িটি পেয়েছিলেন আকু ও নুরাহ দম্পতির কাছ থেকে। অথচ আকু কখনোই টিকটক ভিডিও দেখায় উৎসাহী ছিলেন না। নুরাহের আগ্রহের কারণেই তিনি স্কিপারের সবগুলো ভিডিও দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এই কাজে তিনিও অংশীদার হবেন।
প্রতি লেনদেনের সময় লেনদেনের পদ্ধতি টিকটকে রেকর্ড করে রাখতেন স্কিপার। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, তার অ্যাকাউন্ট অনুসরণ করা শুরু করে সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ। এই ফলোয়ারদের মধ্যেই ছিলেন আকু ও নুরাহ সাবির। নুরাহ বলেন, ‘আমার স্বামী সাধারণত টিকটক পছন্দ করে না। কিন্তু তাকে যখন আমি স্কিপারের এই ঘটনা জানালাম তখন সেও বেশ আগ্রহী হলো বিষয়টি জানতে। তখনই সে স্কিপারের সবগুলো ভিডিও দেখে ফেলে।’ নুরাহর স্বামী আকু তার সবগুলো ভিডিও দেখে স্কিপারের আইফোন ১১ এর বদলে তাকে দেন ২০০৮ সালে বানানো ডজ গ্র্যান্ড ক্যারাভান। আকু বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আপনি যদি ভালো কিছু করেন, আপনি অবশ্যই তার বদলে ভালোই পাবেন। আর এই বিষয়টি আমাদের বেশ উদ্বুদ্ধ করে। তার জন্য কিছু করার জন্য আমরা উৎসাহী হই।’ এই ভাবনা থেকেই স্কিপারের বাণিজ্যযাত্রাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আকু ও নুরাহ গাড়ি চালিয়ে চলে যান সানফ্রান্সিসকোর মিনেসোটায়।
নুরাহ ও আকু সর্বমোট ৩১ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছান। তাদের সঙ্গে দেখা করার পর স্কিপার আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে ববি পিনের মতো ছোট্ট একটা জিনিস তাকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলবে যে কেউ তার সঙ্গে ৩১ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তার বাণিজ্যকে নতুন মাত্রা দিতে এতদূর চলে আসবেন। ‘আমি জানতাম না এমন কিছুও সম্ভব। এতগুলো আনন্দের মুহূর্ত একসঙ্গে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল যে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি বলতে এই মানুষগুলো এখন আমার সবচেয়ে বেশি সময়ের বন্ধু হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আমি রোজ তাদের দুজনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। এটাও খুব বিশেষ মুহূর্ত ছিল।’
কীভাবে পরিচিতি পেল
স্কিপারের মতে, একটি সফল বাণিজ্যের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি থেকে বাইরে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। কেউ কিন্তু নতুন আইফোনের বদলে পুরনো আইফোন চায় না। কিন্তু দামি স্নিকার্সের বদলে আইফোন ১১ প্রো ম্যাক্স পাওয়া খুব একটা শক্ত হয়নি। লেনদেনের জন্য ফেইসবুক, ক্রেইগলিস্ট (নিউ ইয়র্ক সিটি জবস, অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় করার সাইট) এবং আরও বেশ কয়েকটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করেছেন তিনি জিনিস বদল করতে চান এমন মানুষ খুঁজে বের করার জন্য। অবশ্য পরিচিত হয়ে যাওয়ার পর তার কাছেই বরং অফার আসতে থাকে।
তৃতীয় বদল যখন শুরু হয় অর্থাৎ ২৪ ডলারের মার্গারিটা গ্লাস যখন ৬০ ডলারের বাইসেল ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সঙ্গে বদল করা হয়, সেটি ছিল স্কিপারের জন্য নিজ লক্ষ্যপূরণে সবচেয়ে ভালো সুযোগ। এ সময়েই স্কিপার বুঝতে পেরেছিলেন, নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তার খুব বেশি সময় লাগবে না। অবশ্য ক্যারাভান বদলের সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ এই ক্যারাভানের নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেউ অন্য কিছু কিনতে চাইবে কি না স্কিপার বুঝতে পারছিলেন না।
পরিবারের সহযোগিতা
সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছিল, ২৯ বছর বয়সী ডেমি মনে হয় পাগল হয়ে গিয়েছেন, তখনই ভিডিওতে কেলির রেড পেপারক্লিপের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিনিময় প্রথা শুরুর পর প্রতিদিন হাজার হাজার মেসেজ পেয়েছেন স্কিপার। পেয়েছেন যানবাহন, এমনকি নৌকা, রিয়েল এস্টেট বদলের অফারও। প্রতি লেনদেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগত। কিন্তু এটিকে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বিষয়টি আসলে ঠিক ততটা সহজ নয়। জিনিস বদলের জন্য তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। ‘সবাই শুধু এক মিনিটের টিকটক ভিডিওটাই দেখেছেন। অথচ এই ভিডিও বানানোর পেছনে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে, সেটি কেউ দেখতে পারেন না।’
স্কিপারের এই কাজের পুরোটা সময়ে তার সঙ্গে সহযোগী হয়ে ছিলেন তার স্বামী। এক বছরের সংসারে তিনি স্কিপারকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। টিকটক ভিডিও বানাতে স্কিপারের ক্যামেরার পেছনে তিনি কাজ করেছেন। কেবিনে একজন মানুষ বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারবেন। কেবিনে থাকার জন্য একটি বিছানা, রান্নার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা করা আছে। এক জায়গায় ভালো না লাগলে নতুন জায়গাতে চাইলেই যাওয়া সম্ভব। দারুণ এই জিনিসটি এখন নতুন কারও হাতে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
শেয়ার করুন
আরফাতুন নাবিলা | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

করোনা সংক্রমণের সময়ে সবাই যখন ঘরবন্দি হয়ে সময় কাটাচ্ছিল তখন সানফ্রান্সিসকোর ডেমি স্কিপার পরিকল্পনা করলেন এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে মজার কিছু করবেন। একটি ববি পিনের বদলে বাড়ির মালিক হওয়ার পরিকল্পনায় মাঠে নামেন তিনি। মাত্র ছয় মাসেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়। কীভাবে এই পরিকল্পনা সফল করেছিলেন স্কিপার তা নিয়ে লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
পরিকল্পনার শুরু
২০০৫ সালে কানাডিয়ান ব্লগার কেলি ম্যাকডোনাল্ড একটি ঘটনা দিয়ে বেশ পরিচিত হয়েছিলেন। ছোট্ট একটি লাল রঙের পেপারক্লিপ দিয়ে বদলা-বদলি শুরু করে ১৪ বারের মাথায় দুই রুমের একটি ফার্ম হাউজের মালিক হয়ে যান তিনি। এই ঘটনাটি দারুণ উৎসাহিত করেছিল সানফ্রান্সিসকোর ২৯ বছর বয়সী ডেমি স্কিপারকে। ভাবলেন এমন কিছু তিনিও করতে পারেন কি না। যেই ভাবা সেই কাজ। পুরনো সেই ঘটনাকে নতুন করে আরও একবার সামনে আনতে মাঠে নামলেন তিনি। যদিও জানতেন না ঠিক কতটুকু সফল হবেন। তবু ভাবলেন, কেলি যখন পেরেছেন, তখন তার পক্ষেও সম্ভব। অন্তত চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টে লিখলেন ‘ববি পিন দিয়ে যাত্রা শুরু হলো, বাড়ির মালিক হলে এই যাত্রার শেষ হবে।’ কথাগুলো শুনতে একটু পাগলামির মতো মনে হলেও বেশ কয়েকটি জিনিস দিয়ে এই লেনদেন হয়েছে এবং যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে।
ডেমি যখন টিকটকে ট্রেড মি প্রজেক্টের শুরু করেন তখন ছিল মহামারীর সময়। স্কিপার বলেন, “সময় কারও জন্যই খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। চারপাশে শুধু মন খারাপের খবর। তখন ভাবলাম মজার কিছু করা যাক। ঠিক তখনই এই আইডিয়ার কথা মাথায় এলো। শুরু করলাম ‘ট্রেড মি প্রজেক্ট’।” তার মজার এই প্রজেক্টে স্থবির সে সময়েও প্রচুর মানুষ তাকে ফলো করেছে। সাড়ে তিন মিলিয়ন ফলোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে লাইক ছিল ২৪.৭ মিলিয়ন। তবে লেনদেন করে যে বাড়ি পাওয়ার ইচ্ছা স্কিপার করেছিলেন সেটি তার নিজের জন্য নয়। চেয়েছিলেন এই প্রজেক্টে যত মানুষ যুক্ত হবেন, তাদের মধ্যে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাকে বাড়িটি উপহার হিসেবে দেবেন।
কনসেপ্টটি শুরু হয়েছিল স্কিপারের নিজের কাছে থাকা জিনিস দিয়ে। ‘আমার নিজের কাছে এমন কিছু দিয়েই প্রথমে শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে চুলে লাগানোর জন্য ববি পিন ছিল। যার এই পিন দরকার সে এটি নিয়ে এর বদলে আমাকে এর চেয়ে বড় ও ব্যবহারযোগ্য অন্য কিছু দেবে এটাই ছিল আইডিয়া। যখন শুরু করেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম এ তো শুধু ছোট্ট একটি ববি পিন। এগুলো দিয়ে সর্বোচ্চ কি-ই বা আর পেতে পারি। বাড়ি পাব কখনোই নিশ্চিত ছিলাম না। অথচ দেখুন, ছোট হলেও একটি বাড়ির মালিক আমি এখন!’
রেস্টুরেন্ট রিজার্ভেশন অ্যাপে চাকরির পাশাপাশি বিয়ের পোশাক ভাড়া দেওয়ার একটি ব্যবসাও পরিচালনা করেন স্কিপার। ছোট থেকেই নানা ধরনের কাজ করে বড় হয়েছেন। ট্রেড মি প্রজেক্টের জন্য অন্যকে বুঝিয়ে জিনিস অদল-বদলের করার কৌশলটাকে জন্মগত অভিজ্ঞতাই বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এতকিছু করার পরে কোয়ারেন্টাইনে থেকে নতুন প্রজেক্ট শুরু করার সিদ্ধান্ত খুব সহজ কিছু ছিল না। তবে এই প্রজেক্টটি যে এতটা আলোচিত হবে তা তিনি ভাবেননি। তবে নিজের প্রতি ডেমি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি বাড়ি তিনি না পাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা ছিল লেনদেনের কাজটি চালিয়ে যাওয়া।
গত বছর মে মাসে শুরু হওয়া এই প্রজেক্ট চালুর পর স্কিপার দুটো নিয়ম খুব কঠিনভাবে মেনে চলেছেন। এক. পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব কারও সঙ্গে লেনদেন করেননি। দুই. আরও ভালো জিনিস লেনদেন করা যাবে সে উদ্দেশে বেশি দামের জিনিস যুক্ত করা বা লেনদেনের জিনিসপত্র সারিয়ে তোলেননি।
আধুনিক এ সময়ে প্রথাটি কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও এই বিনিময় প্রথা বেশ পরিচিত সংস্কৃতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় জাপানের একটি লোককাহিনীর কথা। ‘স্ট্র মিলিয়নিয়ার’ নামে এই লোককাহিনীতে একজন জাপানিজ কিংবদন্তি ছিলেন। শুরুতে তিনি গরিব থাকলেও একটি স্ট্র দিয়ে বিনিময় প্রথা শুরু করে একসময় ধনী হয়ে যান। পুরনো হলেও এই প্রথায় নতুনভাবে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই।
লেনদেনে যা ছিল
ডেমি স্কিপারের প্রথম পোস্ট ছিল একটি ববি পিন নিয়ে। তার প্রথম পোস্ট দেখে প্রচুর কমেন্ট এসেছিল। অবশ্য বেশিরভাগই ছিল বিদ্রুপ করা কমেন্ট। সবাই ভেবেছিল, স্কিপার পাগলামি করছেন। শুধু একজন ব্যক্তি জানিয়েছিলেন তিনি ববি পিনের বদলে কানের দুল দিতে চান। তবে শর্ত হচ্ছে, তিনি যখন বাড়ির মালিক হবেন তখন সেখানে তাকে দাওয়াত দিতে হবে। এভাবে শুরু হলো স্কিপারের লেনদেন বাণিজ্য। ০.০১ ডলারের ববি পিন থেকে লেনদেন শুরু করে ১০ ডলারের কানের দুল, ২৪ ডলারের মার্গারিটা গ্লাস, ৬০ ডলারের বাইসেল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ৯৫ ডলারের স্নো বোর্ড। ‘ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটি পাওয়ার পর সেটি দিয়ে বেশ কয়েকটি জিনিস পরিষ্কার করেছি আমি। আবার লেনদেনের আগে অবশ্যই সেটিও পরিষ্কার করে রেখেছিলাম। এটি নেওয়ার জন্য প্রায় এক হাজার মানুষ যোগাযোগ করেছিলেন। এদের মধ্যে খুঁজে একজনকে বের করেছিলাম। ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে ভ্যাকুয়ামের বদলে নিয়ে এসেছিলাম স্নো বোর্ড।’
স্নো বোর্ডের বদলে পেয়েছিলেন ১৮০ ডলারের অ্যাপল টিভি ফোর কে, ২২০ ডলারের বোস নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোন, ৩২০ ডলারের এক্সবক্স ওয়ান +২ গেমস+২ কন্ট্রোলারস+কিনেক্ট সেন্সর বার, ৪০০ ডলারের ম্যাকবুক প্রো ২০১১, ৫৫০ ডলারের ক্যানন ক্যামেরা সেট, ৭৫০ ডলারের অফ হোয়াইট নাইকি ব্লেজারস সাইজ নাইন মেনস, অফ হোয়াইট নাইকি হাইপারডাংক্স, জর্ডান ১ রিভার্স শ্যাটারড ব্যাকবোর্ড, আইফোন ১১ প্রো ম্যাক্স, ১০৯৫ ডলারের ২০০৮ ডজ ক্যারাভান, ১৪০০ ডলারের বুস্টেড বোর্ড ভি৩ প্লাস, ১৫ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো, ৪০০০ ডলারের ইলেকট্রিক বাইক ফুড ট্রাক, মিনি কুপার কনভার্টেবল কার, ১৯,৫০০ ডলারের ডায়মন্ড সেট, ২০০০ ডলারের ব্র্যান্ড নিউ ফিটনেস বাইক, বাইক বদলে মাসটাং, মাসটাং বদলে ২০১১ সালের জিপ প্যাট্রিয়ট। অবশেষে এই জিপের বদলে পেলেন একটি ছোট্ট ঘর (চার চাকার ওপর কাঠের একটি কেবিন)।
বাড়ির আগে গাড়ি
প্রতিটি লেনদেনের গল্পই স্কিপারের জন্য স্মরণীয়। তবে ১০৯৫ ডলারের ২০০৮ জজ ক্যারাভানের মুহূর্তটুকু হয়তো বেশি আবেগের তার কাছে। এই গাড়িটি পেয়েছিলেন আকু ও নুরাহ দম্পতির কাছ থেকে। অথচ আকু কখনোই টিকটক ভিডিও দেখায় উৎসাহী ছিলেন না। নুরাহের আগ্রহের কারণেই তিনি স্কিপারের সবগুলো ভিডিও দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এই কাজে তিনিও অংশীদার হবেন।
প্রতি লেনদেনের সময় লেনদেনের পদ্ধতি টিকটকে রেকর্ড করে রাখতেন স্কিপার। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, তার অ্যাকাউন্ট অনুসরণ করা শুরু করে সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ। এই ফলোয়ারদের মধ্যেই ছিলেন আকু ও নুরাহ সাবির। নুরাহ বলেন, ‘আমার স্বামী সাধারণত টিকটক পছন্দ করে না। কিন্তু তাকে যখন আমি স্কিপারের এই ঘটনা জানালাম তখন সেও বেশ আগ্রহী হলো বিষয়টি জানতে। তখনই সে স্কিপারের সবগুলো ভিডিও দেখে ফেলে।’ নুরাহর স্বামী আকু তার সবগুলো ভিডিও দেখে স্কিপারের আইফোন ১১ এর বদলে তাকে দেন ২০০৮ সালে বানানো ডজ গ্র্যান্ড ক্যারাভান। আকু বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আপনি যদি ভালো কিছু করেন, আপনি অবশ্যই তার বদলে ভালোই পাবেন। আর এই বিষয়টি আমাদের বেশ উদ্বুদ্ধ করে। তার জন্য কিছু করার জন্য আমরা উৎসাহী হই।’ এই ভাবনা থেকেই স্কিপারের বাণিজ্যযাত্রাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আকু ও নুরাহ গাড়ি চালিয়ে চলে যান সানফ্রান্সিসকোর মিনেসোটায়।
নুরাহ ও আকু সর্বমোট ৩১ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছান। তাদের সঙ্গে দেখা করার পর স্কিপার আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে ববি পিনের মতো ছোট্ট একটা জিনিস তাকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলবে যে কেউ তার সঙ্গে ৩১ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তার বাণিজ্যকে নতুন মাত্রা দিতে এতদূর চলে আসবেন। ‘আমি জানতাম না এমন কিছুও সম্ভব। এতগুলো আনন্দের মুহূর্ত একসঙ্গে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল যে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি বলতে এই মানুষগুলো এখন আমার সবচেয়ে বেশি সময়ের বন্ধু হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আমি রোজ তাদের দুজনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। এটাও খুব বিশেষ মুহূর্ত ছিল।’
কীভাবে পরিচিতি পেল
স্কিপারের মতে, একটি সফল বাণিজ্যের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি থেকে বাইরে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। কেউ কিন্তু নতুন আইফোনের বদলে পুরনো আইফোন চায় না। কিন্তু দামি স্নিকার্সের বদলে আইফোন ১১ প্রো ম্যাক্স পাওয়া খুব একটা শক্ত হয়নি। লেনদেনের জন্য ফেইসবুক, ক্রেইগলিস্ট (নিউ ইয়র্ক সিটি জবস, অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় করার সাইট) এবং আরও বেশ কয়েকটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করেছেন তিনি জিনিস বদল করতে চান এমন মানুষ খুঁজে বের করার জন্য। অবশ্য পরিচিত হয়ে যাওয়ার পর তার কাছেই বরং অফার আসতে থাকে।
তৃতীয় বদল যখন শুরু হয় অর্থাৎ ২৪ ডলারের মার্গারিটা গ্লাস যখন ৬০ ডলারের বাইসেল ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সঙ্গে বদল করা হয়, সেটি ছিল স্কিপারের জন্য নিজ লক্ষ্যপূরণে সবচেয়ে ভালো সুযোগ। এ সময়েই স্কিপার বুঝতে পেরেছিলেন, নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তার খুব বেশি সময় লাগবে না। অবশ্য ক্যারাভান বদলের সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ এই ক্যারাভানের নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেউ অন্য কিছু কিনতে চাইবে কি না স্কিপার বুঝতে পারছিলেন না।
পরিবারের সহযোগিতা
সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছিল, ২৯ বছর বয়সী ডেমি মনে হয় পাগল হয়ে গিয়েছেন, তখনই ভিডিওতে কেলির রেড পেপারক্লিপের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিনিময় প্রথা শুরুর পর প্রতিদিন হাজার হাজার মেসেজ পেয়েছেন স্কিপার। পেয়েছেন যানবাহন, এমনকি নৌকা, রিয়েল এস্টেট বদলের অফারও। প্রতি লেনদেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগত। কিন্তু এটিকে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বিষয়টি আসলে ঠিক ততটা সহজ নয়। জিনিস বদলের জন্য তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। ‘সবাই শুধু এক মিনিটের টিকটক ভিডিওটাই দেখেছেন। অথচ এই ভিডিও বানানোর পেছনে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে, সেটি কেউ দেখতে পারেন না।’
স্কিপারের এই কাজের পুরোটা সময়ে তার সঙ্গে সহযোগী হয়ে ছিলেন তার স্বামী। এক বছরের সংসারে তিনি স্কিপারকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। টিকটক ভিডিও বানাতে স্কিপারের ক্যামেরার পেছনে তিনি কাজ করেছেন। কেবিনে একজন মানুষ বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারবেন। কেবিনে থাকার জন্য একটি বিছানা, রান্নার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা করা আছে। এক জায়গায় ভালো না লাগলে নতুন জায়গাতে চাইলেই যাওয়া সম্ভব। দারুণ এই জিনিসটি এখন নতুন কারও হাতে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।