ইথিওপিয়ায় শান্তিতে নোবেলজয়ীর যুদ্ধযাত্রা
মুফতি এনায়েতুল্লাহ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০
আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ইথিওপিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ শান্তিতে নোবেল পাওয়া শততম ব্যক্তি। সম্প্রতি তিনি নিজ দেশের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। লিখেছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ
প্রেক্ষাপট
৪ অক্টোবর ২০২১। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা সেজেছে ভিন্ন সাজে। রাজধানীর মেসকেল স্কয়ারে এমন বড় উৎসবের আয়োজন খুবই কম হয়। ওইদিনের অনুষ্ঠানের মতো বড় আয়োজন আদ্দিস আবাবার লোকজন শেষ কবে দেখেছেন তা মনে পড়ে না। সামরিক কুচকাওয়াজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা জমকালো এই আয়োজনকে প্রেসিডেন্টের শপথ কিংবা রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান ভাবলে ভুল হবে। বর্ণিল এই আয়োজনের কেন্দ্রে ছিলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন। ২০১৮ সালে তুমুল বিক্ষোভের মুখে আবির পূর্বসূরি পদত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিকে বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালান আবি। তিনি ইরিত্রিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেন। যার জন্য ২০১৯ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তবে পরবর্তী সময়ে আবির সরকার জাতিগত অস্থিরতার মুখে পড়ে। বিশেষ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তাইগ্রে রাজ্যের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ইথিওপিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৪ অক্টোবর দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব শুরু করেন আবি।
মূলত আবির ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যই ৪ অক্টোবর আদ্দিস আবাবায় জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত তিগরি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) প্রতি এটা ছিল সমুচিত জবাব। অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া উল্লসিত জনতার উদ্দেশে আবি বলেন, ‘আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আবির এমন বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ। কয়েক দশক ধরে ইথিওপিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে। গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে বলেছে, যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনা শুরু না করে, সরকারিভাবে অবরুদ্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করতে না দিলে ব্যবস্থা নেবে তারা। এ ক্ষেত্রে তাইগ্রেতে যুদ্ধে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।
অনুষ্ঠানে আবি বলেন, ‘ইথিওপিয়া কখনো বিদেশি চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না।’ আবির এমন শক্ত মনোভাব দেশটিকে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং আবি।
আবির যুদ্ধযাত্রা
আগেকার সময়ে যেমন রাজা-বাদশাহরা যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করতেন, সৈন্যদের উৎসাহ দিতেন এখন আর সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের সেভাবে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায় না। কিন্তু যুদ্ধের রাশ তাদের হাতেই থাকে। কালের বিবর্তনে এ সময়ে এসে দেখা মিলল, এমন এক সরকার প্রধানের যিনি সশরীরে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে ময়দানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এই আবি আহমেদ।
সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এবার তিনি সেনাবাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন।’ তাইগ্রের বাহিনীগুলোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অনুগত সরকারি বাহিনীর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ লড়াইয়ে দেশ একটি মানবিক সংকটের মুখোমুখি। উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ বাসিন্দা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নিহত ও ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বছরব্যাপী চলা সংঘর্ষে যখন তাইগ্রে বিদ্রোহীরা ক্রমাগত রাজধানী আদ্দিস আবাবার দিকে এগিয়ে আসছে, তখনই নতুন এই নাটকীয় পদক্ষেপের কথা বলেন তিনি।
এ সম্পর্কে ২২ নভেম্বর টুইটারে দেওয়া এক বিবৃতিতে আবি বলেন, ‘আমি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে কার্যকর করব। ইথিওপিয়ার সেসব সন্তান, যারা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে; তাদের বলি আজ দেশের জন্য নিজেকে জাগিয়ে তুলুন। লড়াইয়ের সামনে দেখা হবে।’ সাবেক সেনা সদস্য ৪৫ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী বিবৃতিতে অবশ্য এটা উল্লেখ করেননি যে, আসলে তিনি কোথায় যাবেন। ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ফানা ব্রডকাস্টিং করপোরেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবি আহমেদ এখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করে তাইগ্রে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’ তবে আবি এখন ঠিক কোথায় রয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়। তার যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার কোনো ছবি দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রচার করেনি।
বিদ্রোহী তিগরি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) ধারাবাহিকভাবে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে এবং রাজধানী থেকে সড়ক পথে ২২০ কিলোমিটার দূরের শহর শেওয়া রোবিত নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছে। এর আগে আবি ফেইসবুকে বিদ্রোহীদের ‘শত্রু’ আখ্যা দিয়ে তার অনুগত সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের মাটিতে পুঁতে ফেলার নির্দেশ দেন। তার এমন পোস্ট ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, পরে ফেইসবুক কর্র্তৃপক্ষ তা মুছে ফেলে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তাইগ্রে এলাকার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে ইথিওপিয়া সরকার এবং তাদের মিত্রবাহিনীর সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাইগ্রে অঞ্চলের বিদ্রোহী যোদ্ধারা আবি ক্ষমতায় আসার আগে দেশটির জাতীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ করত। আবির যুদ্ধ ঘোষণা ও যুদ্ধযাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেণকরা বলছেন, ‘সময় আসলেই দুর্ভেদ্য, দ্রুত সব বদলায়। এখন আমরা দেখছি একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সবচেয়ে যুদ্ধপ্রিয় ভাষা ব্যবহার করে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বাজি ধরার চেষ্টা করছেন। যে বাজিটা জীবন ও মৃত্যুর।’
কী হচ্ছে ইথিওপিয়ায়
আফ্রিকার শিংখ্যাত ইথিওপিয়ার রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই রক্তক্ষয়ী আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। ইথিওপিয়ার ১০টি আধা-স্বায়ত্তশাসিত ফেডারেল রাজ্যের একটি তাইগ্রে। উত্তরাঞ্চলীয় এ অঞ্চলটির বিরুদ্ধে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে এ সংঘাত ইথিওপিয়ায় থেমে নেই, বরং তার প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়া ও সুদানেও।
২০২০ সালের ৩ নভেম্বর তাইগ্রে বাহিনী এবং ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া-আমহারার মধ্যে লড়াই শুরু হয়। ফেডারেল মিত্রবাহিনী ২৮ নভেম্বর তাইগ্রে অঞ্চলের রাজধানী মেকেলে দখলের পর আবি তাইগ্রে অপারেশন ‘সমাপ্ত’ ঘোষণা করেন। তাইগ্রে সরকার নভেম্বরের শেষের দিকে বলে, ‘হানাদারদের’ বের না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ২৮ জুন ২০২১ তারিখে তাইগ্রে প্রতিরক্ষা বাহিনী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে এবং জুলাই মাসে আমহারা এবং আফার অঞ্চলে অগ্রসর হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরের শুরুতে, টিডিএফ ওরোমো লিবারেশন আর্মির (ওএলএ) সঙ্গে একত্রে তাইগ্রে অঞ্চল থেকে আদ্দিস আবাবার দিকে দক্ষিণে হাইওয়েতে বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। টিপিএলএফ এখন আদ্দিস আবাবার দিকে এগোচ্ছে। সাতটি ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ টিপিএলএফ ও ওএলএ জোট ঘোষণা করে, তাদের লক্ষ্য শক্তি প্রয়োগে কিংবা আলোচনার মাধ্যমে আবির সরকারের পতন ঘটানো এবং তারপর একটি ক্রান্তিকালীন কর্র্তৃপক্ষ গঠন করা।
অন্যদিকে আবি আহমেদের লক্ষ্য বিদ্রোহ দমন করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজের ক্ষমতা সুসংহত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় যা যা করার তা করতে তিনি পিছপা হচ্ছেন না। আবির যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা এমন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
পরিবেশ যেভাবে উত্তপ্ত হলো
জনবিক্ষোভের জেরে হাইলিমারিয়াম দেশালেগন সরকারের পতন হলে ক্ষমতায় বসেন আবি। এরপর থেকেই তাইগ্রের নেতারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে, সরকারের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা করে ফেলছেন আবি। রাজ্যগুলোর ক্ষমতা সীমিত করে কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অভিযোগে গত বছর আবি সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় টিপিএলএফ। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় চলতি বছর সেপ্টেম্বরে তাইগ্রেতে আঞ্চলিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সে নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা দেয় আবি সরকার। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় তাইগ্রের নির্বাচনকে বেআইনি ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপরই আবির সরকার তাইগ্রেতে বিমান হামলা চালানোর কথা জানায়।
যুদ্ধের বিবদমান পক্ষ
আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ইথিওপিয়া এখন আত্মহননের এক গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত। আফ্রিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দেশটির সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিক ও আঞ্চলিক নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন পক্ষকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করছেন। লড়াই শুরুর এক বছর পর, বিদ্রোহী বাহিনী এখন দেশের রাজধানীতে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুদিন আগে দেশটির নয়টি সরকারবিরোধী দল আবি আহমেদের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব ইথিওপিয়ান ফেডারেলিস্ট অ্যান্ড কনফেডারেলিস্ট ফোর্সেস নামে একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। এই জোটের মধ্যে টিপিএলএফ অন্তর্ভুক্ত, যেটি নভেম্বর ২০২০ সাল থেকে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।
চলমান যুদ্ধে ইথিওপীয় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রয়েছে ইএনডিএফ, আমহারা, আফার, বোনিসাংগুই-গুমুজ, দিরে দাওয়া, গামবেলা, হারারি, অরোমিয়া, সিডামা, সোমালি রিজিয়ন ও এসএনএনপিআর। তাইগ্রিয়ানদের দাবি অনুসারে ইরিত্রিয়া, জিবুতি সোমালিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সহায়তা করছে।
অন্যদিকে বিদ্রোহী ফ্রন্টে রয়েছে, তাইগ্রের টিডিএফ, অরোমো লিবারেশন আর্মি-ওএলএ, আর্ডোফ আগাউ লিবারেশন ফ্রন্ট, সিদামা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, বেশিংগুল পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট, সোমালি স্টেট রেসিসটেন্স, কিমান্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গামবেলা পিপলস লিবারেশন আর্মি। ইরিত্রিয়ার বিরোধী দল তাদের সমর্থন করে বলে ইথিওপীয় সরকারের দাবি। উইকিপিডিয়ার তথ্যে, ইথিওপীয় সরকারি পক্ষে ১ লাখ ৮৩ হাজার এবং বিদ্রোহী জোটের পক্ষে এক থেকে আড়াই লাখ যোদ্ধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
উভয় পক্ষের শক্তিমত্তা দেখলে মনে হয় কোনো পক্ষই দুর্বল নয়। তবে এটি যতটা না জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, তার চেয়ে বেশি কর্র্তৃত্ব দখলের লড়াই। একসময় তাইগ্রে অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা লড়াইয়ের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হতো। এখন বিদ্রোহী পক্ষের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আবি সরকারের পতন ঘটানো।
টিপিএলএফ ও তাইগ্রিয়ান কারা?
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইথিওপিয়ার মার্কসবাদী সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্র্তৃক প্রান্তিক হওয়া গোষ্ঠী তাইগ্রিয়ানদের একটি ছোট মিলিশিয়া হিসেবে টিপিএলএফ জন্ম নেয়। দেশটির দুটি বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী ওরোমো এবং আমহারা মিলিতভাবে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি আর তৃতীয় বৃহত্তম তাইগ্রায়ানরা ৭ শতাংশের মতো। এর পরও টিপিএলএফ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী হয়ে ওঠে, অবশেষে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয়, যা ১৯৯১ সালে সরকারের পতন ঘটায়।
টিপিএলএফের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী জোট ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে পরিণত হয়। টিপিএলএফের নেতৃত্বদানকারী মেলেস জেনাভি, ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়াকে নেতৃত্ব দেন। এ সময়কালে অশান্ত অঞ্চলে ইথিওপিয়া একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় দেশটিতে। কিন্তু ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আবি আহমেদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে।
শান্তি উদ্যোগে সাড়া নেই
ইথিওপিয়ার বর্তমান সংঘাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর যুদ্ধ ধর্ষণ একটি ‘দৈনন্দিন’ ঘটনা হয়ে উঠেছে। যুদ্ধে জড়িত কিছু প্রধান দলকে সম্পৃক্ত করে শান্তি আলোচনা ও মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়ন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি আলোচনার অনুরোধ করে; আবি আহমেদ শান্তি আলোচনা করতে অস্বীকার করেন।
তাইগ্রিয়ান বাহিনী আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধটি তাইগ্রের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আমহারা এবং আফার অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইথিওপিয়ার মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ওরোমিয়ার বিদ্রোহী দল ওরোমো লিবারেশন আর্মির সঙ্গে জোট করার পর টিপিএলএফের অনুগত যোদ্ধা তাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস সামনের লাইনটিকে আরও দক্ষিণে ঠেলে দিয়েছে। বিদ্রোহী যোদ্ধারা আদ্দিস আবাবার রাস্তার দুটি প্রধান শহর ডেসি এবং কমবোলচা দখল করেছে, ইথিওপিয়ার নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, রাজধানীর পতন হতে পারে। তার পরও শান্তি আলোচনায় সাড়া না দিয়ে আবির বিদ্রোহ দমনে কঠোর মনোভাব দেশটিতে রক্তক্ষয়ী পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় দরকার যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ।
আবির মুখে যুদ্ধের ভয়াবহতা
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানীর অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। এরপর দেওয়া ভাষণে আবি বলেন, ‘একজন তরুণ ইথিওপীয় সৈনিক হিসেবে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাত অবসানে তার দৃঢ় সংকল্প তৈরি করেছিল।’
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আবি বলেন, ‘কুড়ি বছর আগে, আমি সীমান্তবর্তী শহর বাডামে একটি ইথিওপীয় সেনা ইউনিটে রেডিও অপারেটর ছিলাম। ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশায় কয়েক মিনিটের জন্য ওই স্থান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে দেখি আমার পুরো ইউনিট একটি আর্টিলারি আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
যুদ্ধের এমন ভয়াবহতার সাক্ষী স্বয়ং আবি। তিনি শান্তিতে নোবেল পাওয়াদের একজন। আর এখন তার নেতৃত্বে চলমান ইথিওপিয়ায় দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষের হুমকি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, দুই পক্ষের যোদ্ধাদের মরদেহ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কখনো কখনো তাদের অস্থায়ী কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়; কখনো মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, অথবা ঘটনাস্থলেই ফেলে রাখা হয়। পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিদ্রোহী টিপিএলএফকে ঠেকাতে না পারলে তারা রাজধানীর দখলে নেবে। তখন রক্তগঙ্গা বইতে পারে। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। এটা বন্ধ করতে পারেন একমাত্র আবি। কিন্তু তিনি কি এমন উদ্যোগ নেবেন নাকি ক্ষমতার দম্ভে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে ইতিহাসের খলনায়কে পরিণত করবেন এটাই সবচেয়ে দামি প্রশ্ন।
শেয়ার করুন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০

আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ইথিওপিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ শান্তিতে নোবেল পাওয়া শততম ব্যক্তি। সম্প্রতি তিনি নিজ দেশের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। লিখেছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ
প্রেক্ষাপট
৪ অক্টোবর ২০২১। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা সেজেছে ভিন্ন সাজে। রাজধানীর মেসকেল স্কয়ারে এমন বড় উৎসবের আয়োজন খুবই কম হয়। ওইদিনের অনুষ্ঠানের মতো বড় আয়োজন আদ্দিস আবাবার লোকজন শেষ কবে দেখেছেন তা মনে পড়ে না। সামরিক কুচকাওয়াজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা জমকালো এই আয়োজনকে প্রেসিডেন্টের শপথ কিংবা রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান ভাবলে ভুল হবে। বর্ণিল এই আয়োজনের কেন্দ্রে ছিলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন। ২০১৮ সালে তুমুল বিক্ষোভের মুখে আবির পূর্বসূরি পদত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিকে বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালান আবি। তিনি ইরিত্রিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেন। যার জন্য ২০১৯ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তবে পরবর্তী সময়ে আবির সরকার জাতিগত অস্থিরতার মুখে পড়ে। বিশেষ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তাইগ্রে রাজ্যের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ইথিওপিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৪ অক্টোবর দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব শুরু করেন আবি।
মূলত আবির ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যই ৪ অক্টোবর আদ্দিস আবাবায় জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত তিগরি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) প্রতি এটা ছিল সমুচিত জবাব। অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া উল্লসিত জনতার উদ্দেশে আবি বলেন, ‘আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আবির এমন বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ। কয়েক দশক ধরে ইথিওপিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে। গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে বলেছে, যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনা শুরু না করে, সরকারিভাবে অবরুদ্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করতে না দিলে ব্যবস্থা নেবে তারা। এ ক্ষেত্রে তাইগ্রেতে যুদ্ধে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।
অনুষ্ঠানে আবি বলেন, ‘ইথিওপিয়া কখনো বিদেশি চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না।’ আবির এমন শক্ত মনোভাব দেশটিকে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং আবি।
আবির যুদ্ধযাত্রা
আগেকার সময়ে যেমন রাজা-বাদশাহরা যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করতেন, সৈন্যদের উৎসাহ দিতেন এখন আর সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের সেভাবে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায় না। কিন্তু যুদ্ধের রাশ তাদের হাতেই থাকে। কালের বিবর্তনে এ সময়ে এসে দেখা মিলল, এমন এক সরকার প্রধানের যিনি সশরীরে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে ময়দানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এই আবি আহমেদ।
সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এবার তিনি সেনাবাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন।’ তাইগ্রের বাহিনীগুলোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অনুগত সরকারি বাহিনীর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ লড়াইয়ে দেশ একটি মানবিক সংকটের মুখোমুখি। উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ বাসিন্দা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নিহত ও ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বছরব্যাপী চলা সংঘর্ষে যখন তাইগ্রে বিদ্রোহীরা ক্রমাগত রাজধানী আদ্দিস আবাবার দিকে এগিয়ে আসছে, তখনই নতুন এই নাটকীয় পদক্ষেপের কথা বলেন তিনি।
এ সম্পর্কে ২২ নভেম্বর টুইটারে দেওয়া এক বিবৃতিতে আবি বলেন, ‘আমি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে কার্যকর করব। ইথিওপিয়ার সেসব সন্তান, যারা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে; তাদের বলি আজ দেশের জন্য নিজেকে জাগিয়ে তুলুন। লড়াইয়ের সামনে দেখা হবে।’ সাবেক সেনা সদস্য ৪৫ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী বিবৃতিতে অবশ্য এটা উল্লেখ করেননি যে, আসলে তিনি কোথায় যাবেন। ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ফানা ব্রডকাস্টিং করপোরেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবি আহমেদ এখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করে তাইগ্রে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’ তবে আবি এখন ঠিক কোথায় রয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়। তার যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার কোনো ছবি দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রচার করেনি।
বিদ্রোহী তিগরি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) ধারাবাহিকভাবে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে এবং রাজধানী থেকে সড়ক পথে ২২০ কিলোমিটার দূরের শহর শেওয়া রোবিত নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছে। এর আগে আবি ফেইসবুকে বিদ্রোহীদের ‘শত্রু’ আখ্যা দিয়ে তার অনুগত সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের মাটিতে পুঁতে ফেলার নির্দেশ দেন। তার এমন পোস্ট ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, পরে ফেইসবুক কর্র্তৃপক্ষ তা মুছে ফেলে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তাইগ্রে এলাকার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে ইথিওপিয়া সরকার এবং তাদের মিত্রবাহিনীর সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাইগ্রে অঞ্চলের বিদ্রোহী যোদ্ধারা আবি ক্ষমতায় আসার আগে দেশটির জাতীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ করত। আবির যুদ্ধ ঘোষণা ও যুদ্ধযাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেণকরা বলছেন, ‘সময় আসলেই দুর্ভেদ্য, দ্রুত সব বদলায়। এখন আমরা দেখছি একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সবচেয়ে যুদ্ধপ্রিয় ভাষা ব্যবহার করে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বাজি ধরার চেষ্টা করছেন। যে বাজিটা জীবন ও মৃত্যুর।’
কী হচ্ছে ইথিওপিয়ায়
আফ্রিকার শিংখ্যাত ইথিওপিয়ার রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই রক্তক্ষয়ী আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। ইথিওপিয়ার ১০টি আধা-স্বায়ত্তশাসিত ফেডারেল রাজ্যের একটি তাইগ্রে। উত্তরাঞ্চলীয় এ অঞ্চলটির বিরুদ্ধে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে এ সংঘাত ইথিওপিয়ায় থেমে নেই, বরং তার প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়া ও সুদানেও।
২০২০ সালের ৩ নভেম্বর তাইগ্রে বাহিনী এবং ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া-আমহারার মধ্যে লড়াই শুরু হয়। ফেডারেল মিত্রবাহিনী ২৮ নভেম্বর তাইগ্রে অঞ্চলের রাজধানী মেকেলে দখলের পর আবি তাইগ্রে অপারেশন ‘সমাপ্ত’ ঘোষণা করেন। তাইগ্রে সরকার নভেম্বরের শেষের দিকে বলে, ‘হানাদারদের’ বের না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ২৮ জুন ২০২১ তারিখে তাইগ্রে প্রতিরক্ষা বাহিনী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে এবং জুলাই মাসে আমহারা এবং আফার অঞ্চলে অগ্রসর হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরের শুরুতে, টিডিএফ ওরোমো লিবারেশন আর্মির (ওএলএ) সঙ্গে একত্রে তাইগ্রে অঞ্চল থেকে আদ্দিস আবাবার দিকে দক্ষিণে হাইওয়েতে বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। টিপিএলএফ এখন আদ্দিস আবাবার দিকে এগোচ্ছে। সাতটি ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ টিপিএলএফ ও ওএলএ জোট ঘোষণা করে, তাদের লক্ষ্য শক্তি প্রয়োগে কিংবা আলোচনার মাধ্যমে আবির সরকারের পতন ঘটানো এবং তারপর একটি ক্রান্তিকালীন কর্র্তৃপক্ষ গঠন করা।
অন্যদিকে আবি আহমেদের লক্ষ্য বিদ্রোহ দমন করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজের ক্ষমতা সুসংহত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় যা যা করার তা করতে তিনি পিছপা হচ্ছেন না। আবির যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা এমন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
পরিবেশ যেভাবে উত্তপ্ত হলো
জনবিক্ষোভের জেরে হাইলিমারিয়াম দেশালেগন সরকারের পতন হলে ক্ষমতায় বসেন আবি। এরপর থেকেই তাইগ্রের নেতারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে, সরকারের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা করে ফেলছেন আবি। রাজ্যগুলোর ক্ষমতা সীমিত করে কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অভিযোগে গত বছর আবি সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় টিপিএলএফ। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় চলতি বছর সেপ্টেম্বরে তাইগ্রেতে আঞ্চলিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সে নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা দেয় আবি সরকার। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় তাইগ্রের নির্বাচনকে বেআইনি ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপরই আবির সরকার তাইগ্রেতে বিমান হামলা চালানোর কথা জানায়।
যুদ্ধের বিবদমান পক্ষ
আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ইথিওপিয়া এখন আত্মহননের এক গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত। আফ্রিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দেশটির সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিক ও আঞ্চলিক নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন পক্ষকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করছেন। লড়াই শুরুর এক বছর পর, বিদ্রোহী বাহিনী এখন দেশের রাজধানীতে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুদিন আগে দেশটির নয়টি সরকারবিরোধী দল আবি আহমেদের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব ইথিওপিয়ান ফেডারেলিস্ট অ্যান্ড কনফেডারেলিস্ট ফোর্সেস নামে একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। এই জোটের মধ্যে টিপিএলএফ অন্তর্ভুক্ত, যেটি নভেম্বর ২০২০ সাল থেকে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।
চলমান যুদ্ধে ইথিওপীয় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রয়েছে ইএনডিএফ, আমহারা, আফার, বোনিসাংগুই-গুমুজ, দিরে দাওয়া, গামবেলা, হারারি, অরোমিয়া, সিডামা, সোমালি রিজিয়ন ও এসএনএনপিআর। তাইগ্রিয়ানদের দাবি অনুসারে ইরিত্রিয়া, জিবুতি সোমালিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সহায়তা করছে।
অন্যদিকে বিদ্রোহী ফ্রন্টে রয়েছে, তাইগ্রের টিডিএফ, অরোমো লিবারেশন আর্মি-ওএলএ, আর্ডোফ আগাউ লিবারেশন ফ্রন্ট, সিদামা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, বেশিংগুল পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট, সোমালি স্টেট রেসিসটেন্স, কিমান্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গামবেলা পিপলস লিবারেশন আর্মি। ইরিত্রিয়ার বিরোধী দল তাদের সমর্থন করে বলে ইথিওপীয় সরকারের দাবি। উইকিপিডিয়ার তথ্যে, ইথিওপীয় সরকারি পক্ষে ১ লাখ ৮৩ হাজার এবং বিদ্রোহী জোটের পক্ষে এক থেকে আড়াই লাখ যোদ্ধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
উভয় পক্ষের শক্তিমত্তা দেখলে মনে হয় কোনো পক্ষই দুর্বল নয়। তবে এটি যতটা না জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, তার চেয়ে বেশি কর্র্তৃত্ব দখলের লড়াই। একসময় তাইগ্রে অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা লড়াইয়ের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হতো। এখন বিদ্রোহী পক্ষের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আবি সরকারের পতন ঘটানো।
টিপিএলএফ ও তাইগ্রিয়ান কারা?
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইথিওপিয়ার মার্কসবাদী সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্র্তৃক প্রান্তিক হওয়া গোষ্ঠী তাইগ্রিয়ানদের একটি ছোট মিলিশিয়া হিসেবে টিপিএলএফ জন্ম নেয়। দেশটির দুটি বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী ওরোমো এবং আমহারা মিলিতভাবে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি আর তৃতীয় বৃহত্তম তাইগ্রায়ানরা ৭ শতাংশের মতো। এর পরও টিপিএলএফ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী হয়ে ওঠে, অবশেষে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয়, যা ১৯৯১ সালে সরকারের পতন ঘটায়।
টিপিএলএফের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী জোট ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে পরিণত হয়। টিপিএলএফের নেতৃত্বদানকারী মেলেস জেনাভি, ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়াকে নেতৃত্ব দেন। এ সময়কালে অশান্ত অঞ্চলে ইথিওপিয়া একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় দেশটিতে। কিন্তু ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আবি আহমেদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে।
শান্তি উদ্যোগে সাড়া নেই
ইথিওপিয়ার বর্তমান সংঘাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর যুদ্ধ ধর্ষণ একটি ‘দৈনন্দিন’ ঘটনা হয়ে উঠেছে। যুদ্ধে জড়িত কিছু প্রধান দলকে সম্পৃক্ত করে শান্তি আলোচনা ও মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়ন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি আলোচনার অনুরোধ করে; আবি আহমেদ শান্তি আলোচনা করতে অস্বীকার করেন।
তাইগ্রিয়ান বাহিনী আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধটি তাইগ্রের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আমহারা এবং আফার অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইথিওপিয়ার মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ওরোমিয়ার বিদ্রোহী দল ওরোমো লিবারেশন আর্মির সঙ্গে জোট করার পর টিপিএলএফের অনুগত যোদ্ধা তাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস সামনের লাইনটিকে আরও দক্ষিণে ঠেলে দিয়েছে। বিদ্রোহী যোদ্ধারা আদ্দিস আবাবার রাস্তার দুটি প্রধান শহর ডেসি এবং কমবোলচা দখল করেছে, ইথিওপিয়ার নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, রাজধানীর পতন হতে পারে। তার পরও শান্তি আলোচনায় সাড়া না দিয়ে আবির বিদ্রোহ দমনে কঠোর মনোভাব দেশটিতে রক্তক্ষয়ী পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় দরকার যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ।
আবির মুখে যুদ্ধের ভয়াবহতা
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানীর অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। এরপর দেওয়া ভাষণে আবি বলেন, ‘একজন তরুণ ইথিওপীয় সৈনিক হিসেবে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাত অবসানে তার দৃঢ় সংকল্প তৈরি করেছিল।’
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আবি বলেন, ‘কুড়ি বছর আগে, আমি সীমান্তবর্তী শহর বাডামে একটি ইথিওপীয় সেনা ইউনিটে রেডিও অপারেটর ছিলাম। ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশায় কয়েক মিনিটের জন্য ওই স্থান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে দেখি আমার পুরো ইউনিট একটি আর্টিলারি আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
যুদ্ধের এমন ভয়াবহতার সাক্ষী স্বয়ং আবি। তিনি শান্তিতে নোবেল পাওয়াদের একজন। আর এখন তার নেতৃত্বে চলমান ইথিওপিয়ায় দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষের হুমকি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, দুই পক্ষের যোদ্ধাদের মরদেহ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কখনো কখনো তাদের অস্থায়ী কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়; কখনো মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, অথবা ঘটনাস্থলেই ফেলে রাখা হয়। পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিদ্রোহী টিপিএলএফকে ঠেকাতে না পারলে তারা রাজধানীর দখলে নেবে। তখন রক্তগঙ্গা বইতে পারে। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। এটা বন্ধ করতে পারেন একমাত্র আবি। কিন্তু তিনি কি এমন উদ্যোগ নেবেন নাকি ক্ষমতার দম্ভে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে ইতিহাসের খলনায়কে পরিণত করবেন এটাই সবচেয়ে দামি প্রশ্ন।