ইসরায়েলকে বদলে দেওয়া কিব্বুজ সমবায়
বিপুল জামান | ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
ইসরায়েলে এমন কিছু ছোট ছোট সমবায় রয়েছে যারা কৃষি, অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। শিশু লালন-পালন, সামগ্রিক জীবনযাপন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের কারণে এর সঙ্গে প্লেটোর কল্পরাজ্যের মিল পাওয়া যায়। কিব্বুজের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখেছেন বিপুল জামান
প্লেটোর কল্পরাজ্য
গ্রিক নগর রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল প্লেটোর দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তিনি এক আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেন। এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি কল্পরাজ্য হিসেবে পরিচিত। তিনি তার কল্পরাজ্যের আলোচনায় এক ধরনের সাম্যবাদী জীবনব্যবস্থার কথা বলেছেন। এর অর্থ হচ্ছে তাদের কোনো প্রকার ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। তারা একত্রে থাকবেন ও একত্রে খাবেন। তাদের থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট ও স্থায়ী স্ত্রী। মিলনের কারণে যে সন্তান জন্ম নেবে সে সন্তান বিবেচিত হবে রাষ্ট্রের সন্তান হিসেবে। তার ওপর পরিবারের কোনো অধিকার থাকবে না। প্লেটো ভেবেছিলেন এমতাবস্থায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না।
ওল্ড টেস্টামেন্টে যে পবিত্র ভূমির উল্লেখ আছে, ইহুদি জাতির সে পবিত্র ভূমিতে বসবাসের আকাক্সক্ষা ছিল অনেক দিন থেকেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন দেশের ইহুদি শরণার্থীদের সমাবেশ ঘটে প্যালেস্টাইনে। এসব শরণার্থী রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করতে শুরু করে। এসব গোষ্ঠীর আচার ও জীবনযাপনের সঙ্গে প্লেটোর কল্পরাজ্যের অধিবাসীদের আচার ও জীবনযাপনের বেশকিছু মিল রয়েছে।
কিব্বুজ
ইসরায়েলে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনসমষ্টি। এগুলো কিব্বুজ নামে পরিচিত। হিব্রু শব্দ কিব্বুজের অর্থ দল, সমষ্টি, সমগ্র ইত্যাদি। আকার, আকৃতিভেদে কিব্বুজ নানা রকম হয়ে থাকে। কোনো কিব্বুজে অধিবাসীর সংখ্যা একশ আবার কোনো কিব্বুজে অধিবাসীর সংখ্যা এক হাজার।
যেভাবে শুরু
ইসরায়েল দেশটির গোড়াপত্তনেরও ১০০ বছর পূর্বে কিব্বুজ গঠন করে কিছু মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। তারা আধুনিক রাষ্ট্র স্থাপনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এই জনগোষ্ঠী সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জায়নবাদ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় উদ্বুদ্ধ ছিল। কিব্বুজ কয়েকশ বসবাসকারীর ছোট একটি জনগোষ্ঠী, যারা সাধারণত কৃষি ও শিল্পনির্ভর উৎপাদন কাজের সঙ্গে জড়িত।
১৯০৯ সালে প্রথম কিব্বুজ প্রতিষ্ঠিত হয় গালেলি সাগরের দক্ষিণ প্রান্তেআরবের পূববর্তী উম্ম জুনি গ্রামের নিকটে এক ঊষর ভূমিতে। এই কিব্বুজ দিগানিয়া নামে পরিচিত। এই কিব্বুজকে সকল কিব্বুজের মা-ও বলা হয়ে থাকে। মূলত ইউরোপিয়ান ইহুদিরা দিগনিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা গ্রামীণ আবহের একটি বসতি গড়তে চাচ্ছিলেনযা পরবর্তীকালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের খাদ্য জোগাবে। যেসব ইহুদি আগে থেকেই প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন পুরনো শহর যেমন জেরুজালেম, হাফিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস করছিলেন তারা শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ ধরনের ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টারা এই বিকল্প চিন্তার আশ্রয় নেন। একটি দেশ গঠিত হলে খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন জোগান প্রয়োজনএ কথা মাথায় রেখেই প্রথম কিব্বুজ হিসেবে দিগানিয়া কৃষিপণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছিল।
আদি কিব্বুজ ধারণা অর্থনৈতিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সারকথা নিজেদের উপযোগী করে গৃহীত হয়েছিল, যার মূলকথা ছিল সমতা। আদি কিব্বুজ জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে তা মেনেও চলতেন।
কিব্বুজের অধিবাসীরা কিব্বুজনিক হিসেবে আখ্যায়িত হয়। কিব্বুজনিকরা তাদের পশুপালন ক্ষেত্রে, ফলের বাগানে, চত্বরের বাইরে কাজ করে এবং তাদের মজুরি একটি কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা করে। মাস শেষে প্রত্যেক কিব্বুজনিক কিব্বুজ ব্যবস্থাপনা কর্র্তৃপক্ষ থেকে সমান পরিমাণ অর্থ পায়, যে কাজই সে করুক না কেন, আর যত অর্থই সে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা রাখুক না কেন।
কিব্বুজনিকদের জন্য সে ঊষর ভূমিতে কৃষিকাজ করা ছিল ভীষণ কঠিন। কারণ তারা কৃষিকাজের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না। তা ছাড়া যে মাটিতে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তা কৃষিকাজের জন্য উপযোগীও ছিল না। প্রচুর বহিঃসাহায্য মূলত ইউরোপীয় সাহায্যের ফলে ধীরে কিব্বুজিম সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে। এগুলো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বসবাস উপযোগী ও ফলনশীল। কিন্তু এর জন্য কিব্বুজনিকদের চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তাদের অভ্যাস ও জীবনাচরণের পরিবর্তন করতে হয়েছে। দিনে দিনে তারা হয়ে উঠেছে কঠোর পরিশ্রমী, সাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ ও ভিন্ন অভ্যাসে অভ্যস্ত।
আজ দেড় লাখেরও কম মানুষ ২৭৪টি কিব্বুজে বসবাস করে যাদের মধ্যে ৭৪টি এখনো জায়নবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ। কিব্বুজিম ইসরায়েলের ৪০ শতাংশ কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ। দেশে তাদের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমতে থাকলেও এখনো ইসরায়েল ভ্রমণকারী আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে রয়েছে কিব্বুজিম।
শিশু প্রতিপালন
কিব্বুজে শিশু লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ। কিব্বুজিমের শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয় যখন তাদের বয়স মাত্র ৩ দিন। পরবর্তী কয়েক বছর এই শিশুদের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করে বসতির শিশুপালন কেন্দ্র। পরিবারের লোকেরা তাদের শিশুর সঙ্গে প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টা সময় কাটানোর অনুমতি পান। বোঝা যায় একটি শিশুর সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য এই স্বল্প সময় যথেষ্ট নয়। দেখা গেছে, যারা এমন ব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, মানসিক ও আবেগিক জটিলতা দেখা দিয়েছে।
কিব্বুজনিকরা অল্পবয়সেই কাজ শুরু করে। তারা সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়সেই কাজে যোগ দিয়ে থাকে। একজন আদর্শ কিব্বুজনিকের মতো তাদের লক্ষ্য থাকে যত বেশি পারা যায় নিজের মেধা ও শ্রম দ্বারা নিজের কিব্বুজ এবং দেশকে সেবা করা, অবদান রাখা।
প্রথমে যারা কিব্বুজে যোগদান করেছিলেন তারা স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের প্রজন্ম যদি কিব্বুজ থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করতে চায় সেক্ষেত্রেও আছে ব্যবস্থা। তারা খুবই অল্প দামে নির্দিষ্ট এক টুকরো জমি এবং গৃহনির্মাণের জন্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে। কিন্তু কিব্বুজ থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র বসবাসের ক্ষেত্রে কিব্বুজনিককে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কিব্বুজে শ্রম দিতে হবে। যারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কিব্বুজে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা তাদের গৃহনির্মাণের জন্য জমি ও গৃহনির্মাণসামগ্রী বিনামূল্যে পেয়ে থাকে। তবে কিব্বুজ থেকে আলাদা হওয়ার জন্য এবং কিব্বুজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অন্য নাগরিকদের দ্বারা ভোটে অনুমোদিত হতে হয়। যারা কিব্বুজনিকের সন্তান তারা সাধারণত সহজেই বসতির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যারা নতুন করে যোগ হতে চায় অবশ্য তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিব্বুজের কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হয়।
সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ
যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে কিব্বুজ আদর্শেও এসেছে পরিবর্তন। কিব্বুজ প্রতিষ্ঠাকারী সদস্যদের সন্তানদের অনেকেই কিব্বুজের বাইরে অন্য পেশায় যুক্ত হওয়া, কৃষির জন্য যথেষ্ট লোকবল থাকা, প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড লাভ ও একে টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকবলের চাহিদা ইত্যাদি কারণে কিব্বুজকেন্দ্রিক জনবসতিতে বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
কিব্বুজ গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল ‘পবিত্র ভূমি’-তে বসবাস এবং একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে নিজের দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার আকাক্ষা। এ কারণে কিব্বুজনিকরা সকলে তাদের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়ে গোষ্ঠীতে অবদান রাখতে চাইত। এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখত। অপরদিকে দেশ গঠন হওয়ার পর পরের প্রজন্ম ততটুকুই শ্রম দিতে ইচ্ছুক যতটুকু তারা নাগরিক সুবিধা পাবে। সামষ্টিক লাভের থেকে ব্যক্তিগত সুবিধার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এ কারণেই কিব্বুজে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ যদি গোষ্ঠী ত্যাগ করতে চায় তাহলে শর্তসাপেক্ষে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
কৃষির ওপর নির্ভর করে কিব্বুজিম তার অধিবাসীদের চলতি বিশ্বের জীবনযাত্রার মান প্রদান করতে পারে না। তা ছাড়া প্রযুক্তির কল্যাণে অধিবাসীরা নিজেরাও যেহেতু এ বিষয়ে জ্ঞাত, সে কারণে দিন দিন কিব্বুজ আদর্শের জনপ্রিয়তা কমছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের ভেঙে পড়ার কারণে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব। কিব্বুজের অধিবাসীরা আর সামষ্টিক কল্যাণে সমাজতন্ত্রের আদর্শ মেনে চলতে ইচ্ছুক না। তারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সম্পদ লাভ ও বৃদ্ধিতে আগ্রহী। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর অধিবাসীদের মনোভাব কমে যাওয়ার কারণে সবার সমান বেতনের পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন কাজের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন বেতনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যৌথ কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম দুটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। কিব্বুজের অধিবাসীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষা খাতকে ব্যক্তিমালিকানার অধীনে দেওয়া হয়েছে অনেক কিব্বুজেই। শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে কিব্বুজনিকদের মধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখা যায় না। এর ফলে স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতেও ইসরায়েলি কিব্বুজ অধিবাসীদের নির্ভর করতে হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন সেবার ওপর।
উচ্চশিক্ষা
শুরুতে কিব্বুজের অধিবাসীরা উচ্চশিক্ষার থেকে কৃষিশিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিত। কৃষির জন্য উচ্চশিক্ষা তেমন প্রয়োজন হতো না। বরং মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং শিল্পযুগে প্রবেশের পর কিব্বুজের অধিবাসীরা তাদের সন্তানকে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ১৯৯০ সালে এসে দাঁড়ায় শতকরা ৫৪ অংশ। উচ্চশিক্ষার ফি সাধারণত সমবায়ই পরিশোধ করে থাকে। কিন্তু আশির দশকে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কিব্বুজিমের অর্থনৈতিক অবস্থাও কিছুটা দুর্বল ছিল। এ সময় কিব্বুজিকরা তাদের শিক্ষার খরচ বহন করেছিল।
লৈঙ্গিক সমতা
লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কিব্বুজে চিত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কিব্বুজে নারী-পুরুষের অধিকার, কাজের ক্ষেত্র ইত্যাদি সমান। আবার কোথাও কোথাও লিঙ্গভেদে কাজের ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রতিষ্ঠাকালে কিব্বুজিমে পুরুষ সদস্যের সংখ্যাই বেশি ছিল। নারী সদস্যরাও পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সকল কাজেই অংশগ্রহণ করত। এমনকি প্রথম কয়েক দশক নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনাও তেমন ছিল না। তখন নারী-পুরুষ একত্রে উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করত এবং সমবায়বদ্ধ হয়ে সাংসারিক কাজ করত। রাতে ঘুমানোর জন্যেও ছিল না ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা। যদি কোনো নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইত তখন তারা কিব্বুজের ব্যবস্থাপনার নিকট পৃথক ঘরের জন্য আবেদন করত। বিয়ের জন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠানও অনুসরণ করা হতো না। বিয়ের নির্দিষ্ট কোনো আচার অনুসরণ না করার ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতিকে অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরতার মতো অনুশীলনকেও অস্বীকার করা হতো।
প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কিব্বুজিমের প্রতিষ্ঠাতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারা মনে করলেন, সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব এসে পড়ায় এবার হয়ত নারীকে গৃহকর্মে জড়িয়ে পড়তে হবে। এর সমাধানও তারা বের করলেন। আর তা হলো যৌথভাবে সন্তান পালন করা। কিব্বুজের প্রথম প্রজন্মের নারীরা এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল। কারণ এ ব্যবস্থায় তাদের স্বাধীনতা ছিল। পরের প্রজন্ম অনুভব করলযৌথভাবে বড় হওয়ায় তাদের আচার আচরণ ও মানসিকতায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবু তারা নিজেদের সন্তানকে নিজেরাই মানুষ করতে চাইলেন। এর ফলে কিব্বুজিমের মধ্যে পরিবারের সূচনা হলো। ফলে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবার গঠনের পরও কিছু কিব্বুজে নারী-পুরুষের সমতা ছিল। যেসব কিব্বুজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল সেখানে দায়িত্বপালনে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এসব কিব্বুজে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে ‘আমার পুরুষ’ বলে অভিহিত করে। অপরদিকে যেসব কিব্বুজ ইহুদি ধর্মের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে সেখানে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে ‘আমার প্রভু’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
ইসরায়েলের বাইরে
কিব্বুজ বুকেনভাল্ড : ১৯৪৫ সালে বুকেনভাল্ডের নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়ার পর ষোল ইহুদি যুবক কিব্বুজ বুকেনভাল্ড গঠন করেন। এটা ছিল প্যালেস্টাইনে ইহুদি বসতি গড়ে তোলার একটি পূর্ব প্রস্তুতি। এই অঞ্চলে বহুদিন যাবৎ এই কৃষিসমাজ পরিচালিত হয় এবং অনেক সদস্যকে একত্র করা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরে ১৯৪৮ সালে তারা সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
ফ্রান্সে কিব্বুজ : ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ সালে মাকহার গ্রামে গড়ে ওঠে একমাত্র ইহুদি কিব্বুজ। ব্যারন রবার্ট ডি রথচাইল্ড তরুণ ইহুদিদের জন্য একটি কৃষিখামার স্থাপন করেন, যেন তারা ইসরায়েলে যাওয়ার আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। এই কৃষিখামারে মূলত জার্মান, পোলিস, লিথুয়ানিয়ান, রাশান, হাঙ্গেরিয়ান, ডাচ বা চেক এমনকি আমেরিকান ইহুদি তরুণরাও যোগদান করে। এই কৃষিখামারের আওতায় ৫০০ থেকে ৮০০ কিব্বুজনিক প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করত।
প্লেটোর কল্পরাজ্য ও কিব্বুজ
প্লেটো তার কল্পরাজ্যকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন। শাসক, সৈনিক ও শ্রমিক। অপরদিকে কিব্বুজের অধিবাসীরা শুধু কৃষিকাজই করে। সবাই শ্রমিক। প্লেটোর কল্পরাজ্যে যেমন নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই, তেমনি কিব্বুজেও নারী-পুরুষের সমতা বিদ্যমান। প্লেটোর কল্পরাজ্যে যেমন একই শ্রেণির মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা দেখা যায়, তেমনি কিব্বুজেও অর্থনৈতিক সমতার চর্চা রয়েছে। শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রেও মিল রয়েছে প্লেটোর কল্পরাজ্য ও কিব্বুজ সমবায়ের মধ্যে।
শেয়ার করুন
বিপুল জামান | ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

ইসরায়েলে এমন কিছু ছোট ছোট সমবায় রয়েছে যারা কৃষি, অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। শিশু লালন-পালন, সামগ্রিক জীবনযাপন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের কারণে এর সঙ্গে প্লেটোর কল্পরাজ্যের মিল পাওয়া যায়। কিব্বুজের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখেছেন বিপুল জামান
প্লেটোর কল্পরাজ্য
গ্রিক নগর রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল প্লেটোর দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তিনি এক আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেন। এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি কল্পরাজ্য হিসেবে পরিচিত। তিনি তার কল্পরাজ্যের আলোচনায় এক ধরনের সাম্যবাদী জীবনব্যবস্থার কথা বলেছেন। এর অর্থ হচ্ছে তাদের কোনো প্রকার ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। তারা একত্রে থাকবেন ও একত্রে খাবেন। তাদের থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট ও স্থায়ী স্ত্রী। মিলনের কারণে যে সন্তান জন্ম নেবে সে সন্তান বিবেচিত হবে রাষ্ট্রের সন্তান হিসেবে। তার ওপর পরিবারের কোনো অধিকার থাকবে না। প্লেটো ভেবেছিলেন এমতাবস্থায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না।
ওল্ড টেস্টামেন্টে যে পবিত্র ভূমির উল্লেখ আছে, ইহুদি জাতির সে পবিত্র ভূমিতে বসবাসের আকাক্সক্ষা ছিল অনেক দিন থেকেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন দেশের ইহুদি শরণার্থীদের সমাবেশ ঘটে প্যালেস্টাইনে। এসব শরণার্থী রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করতে শুরু করে। এসব গোষ্ঠীর আচার ও জীবনযাপনের সঙ্গে প্লেটোর কল্পরাজ্যের অধিবাসীদের আচার ও জীবনযাপনের বেশকিছু মিল রয়েছে।
কিব্বুজ
ইসরায়েলে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনসমষ্টি। এগুলো কিব্বুজ নামে পরিচিত। হিব্রু শব্দ কিব্বুজের অর্থ দল, সমষ্টি, সমগ্র ইত্যাদি। আকার, আকৃতিভেদে কিব্বুজ নানা রকম হয়ে থাকে। কোনো কিব্বুজে অধিবাসীর সংখ্যা একশ আবার কোনো কিব্বুজে অধিবাসীর সংখ্যা এক হাজার।
যেভাবে শুরু
ইসরায়েল দেশটির গোড়াপত্তনেরও ১০০ বছর পূর্বে কিব্বুজ গঠন করে কিছু মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। তারা আধুনিক রাষ্ট্র স্থাপনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এই জনগোষ্ঠী সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জায়নবাদ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় উদ্বুদ্ধ ছিল। কিব্বুজ কয়েকশ বসবাসকারীর ছোট একটি জনগোষ্ঠী, যারা সাধারণত কৃষি ও শিল্পনির্ভর উৎপাদন কাজের সঙ্গে জড়িত।
১৯০৯ সালে প্রথম কিব্বুজ প্রতিষ্ঠিত হয় গালেলি সাগরের দক্ষিণ প্রান্তেআরবের পূববর্তী উম্ম জুনি গ্রামের নিকটে এক ঊষর ভূমিতে। এই কিব্বুজ দিগানিয়া নামে পরিচিত। এই কিব্বুজকে সকল কিব্বুজের মা-ও বলা হয়ে থাকে। মূলত ইউরোপিয়ান ইহুদিরা দিগনিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা গ্রামীণ আবহের একটি বসতি গড়তে চাচ্ছিলেনযা পরবর্তীকালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের খাদ্য জোগাবে। যেসব ইহুদি আগে থেকেই প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন পুরনো শহর যেমন জেরুজালেম, হাফিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস করছিলেন তারা শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ ধরনের ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টারা এই বিকল্প চিন্তার আশ্রয় নেন। একটি দেশ গঠিত হলে খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন জোগান প্রয়োজনএ কথা মাথায় রেখেই প্রথম কিব্বুজ হিসেবে দিগানিয়া কৃষিপণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছিল।
আদি কিব্বুজ ধারণা অর্থনৈতিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সারকথা নিজেদের উপযোগী করে গৃহীত হয়েছিল, যার মূলকথা ছিল সমতা। আদি কিব্বুজ জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে তা মেনেও চলতেন।
কিব্বুজের অধিবাসীরা কিব্বুজনিক হিসেবে আখ্যায়িত হয়। কিব্বুজনিকরা তাদের পশুপালন ক্ষেত্রে, ফলের বাগানে, চত্বরের বাইরে কাজ করে এবং তাদের মজুরি একটি কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা করে। মাস শেষে প্রত্যেক কিব্বুজনিক কিব্বুজ ব্যবস্থাপনা কর্র্তৃপক্ষ থেকে সমান পরিমাণ অর্থ পায়, যে কাজই সে করুক না কেন, আর যত অর্থই সে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা রাখুক না কেন।
কিব্বুজনিকদের জন্য সে ঊষর ভূমিতে কৃষিকাজ করা ছিল ভীষণ কঠিন। কারণ তারা কৃষিকাজের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না। তা ছাড়া যে মাটিতে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তা কৃষিকাজের জন্য উপযোগীও ছিল না। প্রচুর বহিঃসাহায্য মূলত ইউরোপীয় সাহায্যের ফলে ধীরে কিব্বুজিম সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে। এগুলো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বসবাস উপযোগী ও ফলনশীল। কিন্তু এর জন্য কিব্বুজনিকদের চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তাদের অভ্যাস ও জীবনাচরণের পরিবর্তন করতে হয়েছে। দিনে দিনে তারা হয়ে উঠেছে কঠোর পরিশ্রমী, সাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ ও ভিন্ন অভ্যাসে অভ্যস্ত।
আজ দেড় লাখেরও কম মানুষ ২৭৪টি কিব্বুজে বসবাস করে যাদের মধ্যে ৭৪টি এখনো জায়নবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ। কিব্বুজিম ইসরায়েলের ৪০ শতাংশ কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ। দেশে তাদের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমতে থাকলেও এখনো ইসরায়েল ভ্রমণকারী আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে রয়েছে কিব্বুজিম।
শিশু প্রতিপালন
কিব্বুজে শিশু লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ। কিব্বুজিমের শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয় যখন তাদের বয়স মাত্র ৩ দিন। পরবর্তী কয়েক বছর এই শিশুদের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করে বসতির শিশুপালন কেন্দ্র। পরিবারের লোকেরা তাদের শিশুর সঙ্গে প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টা সময় কাটানোর অনুমতি পান। বোঝা যায় একটি শিশুর সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য এই স্বল্প সময় যথেষ্ট নয়। দেখা গেছে, যারা এমন ব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, মানসিক ও আবেগিক জটিলতা দেখা দিয়েছে।
কিব্বুজনিকরা অল্পবয়সেই কাজ শুরু করে। তারা সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়সেই কাজে যোগ দিয়ে থাকে। একজন আদর্শ কিব্বুজনিকের মতো তাদের লক্ষ্য থাকে যত বেশি পারা যায় নিজের মেধা ও শ্রম দ্বারা নিজের কিব্বুজ এবং দেশকে সেবা করা, অবদান রাখা।
প্রথমে যারা কিব্বুজে যোগদান করেছিলেন তারা স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের প্রজন্ম যদি কিব্বুজ থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করতে চায় সেক্ষেত্রেও আছে ব্যবস্থা। তারা খুবই অল্প দামে নির্দিষ্ট এক টুকরো জমি এবং গৃহনির্মাণের জন্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে। কিন্তু কিব্বুজ থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র বসবাসের ক্ষেত্রে কিব্বুজনিককে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কিব্বুজে শ্রম দিতে হবে। যারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কিব্বুজে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা তাদের গৃহনির্মাণের জন্য জমি ও গৃহনির্মাণসামগ্রী বিনামূল্যে পেয়ে থাকে। তবে কিব্বুজ থেকে আলাদা হওয়ার জন্য এবং কিব্বুজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অন্য নাগরিকদের দ্বারা ভোটে অনুমোদিত হতে হয়। যারা কিব্বুজনিকের সন্তান তারা সাধারণত সহজেই বসতির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যারা নতুন করে যোগ হতে চায় অবশ্য তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিব্বুজের কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হয়।
সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ
যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে কিব্বুজ আদর্শেও এসেছে পরিবর্তন। কিব্বুজ প্রতিষ্ঠাকারী সদস্যদের সন্তানদের অনেকেই কিব্বুজের বাইরে অন্য পেশায় যুক্ত হওয়া, কৃষির জন্য যথেষ্ট লোকবল থাকা, প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড লাভ ও একে টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকবলের চাহিদা ইত্যাদি কারণে কিব্বুজকেন্দ্রিক জনবসতিতে বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
কিব্বুজ গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল ‘পবিত্র ভূমি’-তে বসবাস এবং একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে নিজের দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার আকাক্ষা। এ কারণে কিব্বুজনিকরা সকলে তাদের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়ে গোষ্ঠীতে অবদান রাখতে চাইত। এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখত। অপরদিকে দেশ গঠন হওয়ার পর পরের প্রজন্ম ততটুকুই শ্রম দিতে ইচ্ছুক যতটুকু তারা নাগরিক সুবিধা পাবে। সামষ্টিক লাভের থেকে ব্যক্তিগত সুবিধার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এ কারণেই কিব্বুজে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ যদি গোষ্ঠী ত্যাগ করতে চায় তাহলে শর্তসাপেক্ষে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
কৃষির ওপর নির্ভর করে কিব্বুজিম তার অধিবাসীদের চলতি বিশ্বের জীবনযাত্রার মান প্রদান করতে পারে না। তা ছাড়া প্রযুক্তির কল্যাণে অধিবাসীরা নিজেরাও যেহেতু এ বিষয়ে জ্ঞাত, সে কারণে দিন দিন কিব্বুজ আদর্শের জনপ্রিয়তা কমছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের ভেঙে পড়ার কারণে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব। কিব্বুজের অধিবাসীরা আর সামষ্টিক কল্যাণে সমাজতন্ত্রের আদর্শ মেনে চলতে ইচ্ছুক না। তারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সম্পদ লাভ ও বৃদ্ধিতে আগ্রহী। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর অধিবাসীদের মনোভাব কমে যাওয়ার কারণে সবার সমান বেতনের পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন কাজের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন বেতনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যৌথ কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম দুটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। কিব্বুজের অধিবাসীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষা খাতকে ব্যক্তিমালিকানার অধীনে দেওয়া হয়েছে অনেক কিব্বুজেই। শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে কিব্বুজনিকদের মধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখা যায় না। এর ফলে স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতেও ইসরায়েলি কিব্বুজ অধিবাসীদের নির্ভর করতে হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন সেবার ওপর।
উচ্চশিক্ষা
শুরুতে কিব্বুজের অধিবাসীরা উচ্চশিক্ষার থেকে কৃষিশিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিত। কৃষির জন্য উচ্চশিক্ষা তেমন প্রয়োজন হতো না। বরং মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং শিল্পযুগে প্রবেশের পর কিব্বুজের অধিবাসীরা তাদের সন্তানকে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ১৯৯০ সালে এসে দাঁড়ায় শতকরা ৫৪ অংশ। উচ্চশিক্ষার ফি সাধারণত সমবায়ই পরিশোধ করে থাকে। কিন্তু আশির দশকে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কিব্বুজিমের অর্থনৈতিক অবস্থাও কিছুটা দুর্বল ছিল। এ সময় কিব্বুজিকরা তাদের শিক্ষার খরচ বহন করেছিল।
লৈঙ্গিক সমতা
লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কিব্বুজে চিত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কিব্বুজে নারী-পুরুষের অধিকার, কাজের ক্ষেত্র ইত্যাদি সমান। আবার কোথাও কোথাও লিঙ্গভেদে কাজের ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রতিষ্ঠাকালে কিব্বুজিমে পুরুষ সদস্যের সংখ্যাই বেশি ছিল। নারী সদস্যরাও পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সকল কাজেই অংশগ্রহণ করত। এমনকি প্রথম কয়েক দশক নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনাও তেমন ছিল না। তখন নারী-পুরুষ একত্রে উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করত এবং সমবায়বদ্ধ হয়ে সাংসারিক কাজ করত। রাতে ঘুমানোর জন্যেও ছিল না ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা। যদি কোনো নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইত তখন তারা কিব্বুজের ব্যবস্থাপনার নিকট পৃথক ঘরের জন্য আবেদন করত। বিয়ের জন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠানও অনুসরণ করা হতো না। বিয়ের নির্দিষ্ট কোনো আচার অনুসরণ না করার ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতিকে অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরতার মতো অনুশীলনকেও অস্বীকার করা হতো।
প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কিব্বুজিমের প্রতিষ্ঠাতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারা মনে করলেন, সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব এসে পড়ায় এবার হয়ত নারীকে গৃহকর্মে জড়িয়ে পড়তে হবে। এর সমাধানও তারা বের করলেন। আর তা হলো যৌথভাবে সন্তান পালন করা। কিব্বুজের প্রথম প্রজন্মের নারীরা এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল। কারণ এ ব্যবস্থায় তাদের স্বাধীনতা ছিল। পরের প্রজন্ম অনুভব করলযৌথভাবে বড় হওয়ায় তাদের আচার আচরণ ও মানসিকতায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবু তারা নিজেদের সন্তানকে নিজেরাই মানুষ করতে চাইলেন। এর ফলে কিব্বুজিমের মধ্যে পরিবারের সূচনা হলো। ফলে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবার গঠনের পরও কিছু কিব্বুজে নারী-পুরুষের সমতা ছিল। যেসব কিব্বুজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল সেখানে দায়িত্বপালনে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এসব কিব্বুজে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে ‘আমার পুরুষ’ বলে অভিহিত করে। অপরদিকে যেসব কিব্বুজ ইহুদি ধর্মের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে সেখানে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে ‘আমার প্রভু’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
ইসরায়েলের বাইরে
কিব্বুজ বুকেনভাল্ড : ১৯৪৫ সালে বুকেনভাল্ডের নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়ার পর ষোল ইহুদি যুবক কিব্বুজ বুকেনভাল্ড গঠন করেন। এটা ছিল প্যালেস্টাইনে ইহুদি বসতি গড়ে তোলার একটি পূর্ব প্রস্তুতি। এই অঞ্চলে বহুদিন যাবৎ এই কৃষিসমাজ পরিচালিত হয় এবং অনেক সদস্যকে একত্র করা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরে ১৯৪৮ সালে তারা সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
ফ্রান্সে কিব্বুজ : ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ সালে মাকহার গ্রামে গড়ে ওঠে একমাত্র ইহুদি কিব্বুজ। ব্যারন রবার্ট ডি রথচাইল্ড তরুণ ইহুদিদের জন্য একটি কৃষিখামার স্থাপন করেন, যেন তারা ইসরায়েলে যাওয়ার আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। এই কৃষিখামারে মূলত জার্মান, পোলিস, লিথুয়ানিয়ান, রাশান, হাঙ্গেরিয়ান, ডাচ বা চেক এমনকি আমেরিকান ইহুদি তরুণরাও যোগদান করে। এই কৃষিখামারের আওতায় ৫০০ থেকে ৮০০ কিব্বুজনিক প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করত।
প্লেটোর কল্পরাজ্য ও কিব্বুজ
প্লেটো তার কল্পরাজ্যকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন। শাসক, সৈনিক ও শ্রমিক। অপরদিকে কিব্বুজের অধিবাসীরা শুধু কৃষিকাজই করে। সবাই শ্রমিক। প্লেটোর কল্পরাজ্যে যেমন নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই, তেমনি কিব্বুজেও নারী-পুরুষের সমতা বিদ্যমান। প্লেটোর কল্পরাজ্যে যেমন একই শ্রেণির মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা দেখা যায়, তেমনি কিব্বুজেও অর্থনৈতিক সমতার চর্চা রয়েছে। শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রেও মিল রয়েছে প্লেটোর কল্পরাজ্য ও কিব্বুজ সমবায়ের মধ্যে।