ইতিহাসের আলোচিত ৩ ছাত্র আন্দোলন
মুমিতুল মিম্মা | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের ফুঁসে ওঠার ঘটনা বহু প্রাচীন। ‘আন্দোলনরত’ বা ‘বিক্ষুব্ধ’ ছাত্র এ পরিচয়ের ভেতরে লীন হয়ে যায় জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জাতীয়তা। আলোচিত তিন ছাত্র আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন মুমিতুল মিম্মা
ছাত্র আন্দোলন
বিশ্বের নানা স্থানে যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণ সমাজের সক্রিয়তার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০ শতকের শুরুতে নাগরিক অধিকারের বিক্ষোভ থেকে শুরু করে অস্ত্রবিরোধী মিছিল কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবি যেকোনো ন্যায্য দাবিতে তরুণ সমাজ তাদের প্রতিবাদ জারি রেখেছে। কখনো কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা তাদের ন্যায্য দাবিতে অটল থাকে। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আইভি লিগ স্কুল সবখানেই আছে বিদ্রোহী ছাত্রদের দাপুটে পদচিহ্ন। যেকোনো স্থানের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করে যেকোনো স্থানের সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তারা কতটা সচেষ্ট। নারী অধিকার, জাতিগত সমতা, শান্তি ও গণতন্ত্র, সাশ্রয়ী শিক্ষা, পুলিশের জবাবদিহি, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণসহ অনেক গুরুতর বিষয়ে ছাত্ররা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের মত প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিজেদের ন্যায্য দাবির প্রতি অটল থাকেন তারা। ফলে যেখানেই শাসক গোষ্ঠী কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ছাত্রসমাজ। ফলে জন্ম নিয়েছে বড় বড় বিপ্লব।
ছাত্র বিপ্লবের বিপরীতে প্রতি ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ধরনের। কখনো ছাত্রদের অবাধে প্রতিবাদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কখনো তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে, কখনো বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সহিংসভাবে চড়াও হয়েছে তাদের ওপর। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, মারধর এমনকি গুলি চালানোর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে পিছু হটতে বাধ্য করার ইতিহাস বহু পুরনো। মজার ব্যাপার হলেও সত্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যখনই সহিংস হয়ে উঠেছে, তখনই আরও ঘনীভূত হয়েছে প্রতিবাদ। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যতবার দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়, তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মৌন সমর্থন তত বাড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যুত্থান, ১৯৬৮
১৯৬৮ সাল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের বছর। ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে সরাসরি মার্কিন বাহিনীর জড়িয়ে পড়া মেনে নিতে পারেননি আমেরিকার নাগরিকদের কেউই। যুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়। এদিকে আমেরিকার নিয়ম করে দেয় ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোনো তরুণ এ যুদ্ধে নামতে বাধ্য থাকবে, অন্যথায় কারাবরণ করতে হবে তাদের। ফলে তরুণদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী অংশ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। প্রতিবাদ হয়, প্রতিরোধ হয়। একই সঙ্গে একাধিক মহাদেশে ছাত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এসব ছাত্র আন্দোলন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল, কিছু ক্ষেত্রে তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কোনো আন্দোলনই আসলে ব্যর্থ নয়। বেশির ভাগ আন্দোলনই ভবিষ্যতের বীজ বপন করে যায়। যার ফল দেখা যায় পরবর্তী কোনো আন্দোলনে।
১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে ঐতিহাসিকভাবে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজারেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করে। এ ছাড়া অনেকে তাদের ডরমিটরিতে অবরোধ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে, পাঠ্যক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপরে জোর দেয়, ছাত্রদের নিয়ে বিচারব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং বিক্ষোভে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তৃতীয় ও চতুর্থ দাবিতে একমত হয়।
এ ঘটনার ঠিক এক মাস পেরিয়েছে। কলম্বিয়ায় একই সঙ্গে কয়েকটি ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণকে সমর্থনকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের কিছু নথি খুঁজে পায় এক ছাত্র। শুধু তাই-ই নয়, মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্র গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রমাণ মেলে সেখানে। এ ঘটনা জনপ্রকাশ্যে এলে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণমুখী ও শান্তিপ্রিয়। সেখানে কেন অশান্তির চর্চা হবে? প্রায় একই সময় মর্নিংসাইড পার্কে নির্মিত একটি ব্যায়ামাগার নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে গণরোষ চরমে ওঠে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দানা বাঁধে ক্ষোভ।
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই ধরনের আন্দোলন শুরু করে। এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কটি ভবন দখল করে রাখে তারা। আন্দোলন চলাকালে প্রায় এক হাজার পুলিশ কর্মকর্তা তাদের উচ্ছেদ করতে ক্যাম্পাসে হামলা চালায়। একদিকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন, অন্যদিকে ন্যায্য দাবির পক্ষে থাকা। সেমিস্টারের বাকি সময়ও আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের দখল ছাড়েনি। ক্যাম্পাস দখলমুক্ত রাখতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ভিয়েতনাম যুগের অস্ত্র গবেষণা থিংক ট্যাংকের চুক্তি থেকে সরে আসে। একই সঙ্গে হারমেলের মর্নিংসাইড পার্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম তৈরি করার ব্যাপারে সম্মত হয়। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা সীমিত সুযোগে জিম ব্যবহারের অনুমতি পান।
আটলান্টিকের ওপারে ফ্রান্স ও পোল্যান্ডে বিদ্রোহ শুরু হয়। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে জানুয়ারি মাসে ৩০০ জন শিক্ষার্থীর শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মার্চ মাসে ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কঠোর হাতে এ আন্দোলন দমন করে। প্যারিসে মে মাসে প্রায় ২০ হাজার লোক সরবোনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফরাসি শ্রমিক সংগঠন ও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটে যোগ দেন। যার ফলে জাতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাষ্ট্রপতি চার্লস ডি গলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয় তারা।
তিয়েন আনমেন স্কয়ার, ১৯৮৯
মাও-পরবর্তী চীনের চীনে দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পটভূমিতে ভূমিকা রাখেন হু ইয়াওবাং। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদে ছিলেন সংস্কারপন্থি এ নেতা। আশির দশক জুড়ে হুয়ের নেতৃত্বে চীন জুড়ে একের পর এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারকাজ চলতে থাকে। এ সংস্কার কার্যক্রম তাকে অনেক শক্তিশালী নেতার শত্রু করে তুলেছিল।
চীনের বিপ্লবী নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরোধী। কিন্তু হু জানতেন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে গেলে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রয়োজন আছে। তার পদত্যাগের পর ১৯৮৭ সালে চীনজুড়ে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন হু-বিরোধী নেতারা দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য হুয়ের জনবান্ধব নীতিকে দোষারোপ করেন। তাদের ভাষ্য মতে, হু শক্ত হাতে দেশের হাল ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই সে সময় চীনে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর দলীয় অন্তঃকোন্দলের একপর্যায়ে পার্টির পদ থেকে সরে দাঁড়ান হু ইয়াওবাং। পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করে হুয়ের রাজনৈতিক উত্তরসূরি ঝাও জিয়াং। হুয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন তিনি। ১৯৮৯ সালে হু হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সে সময় চীনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াং শানকুন।
তার মৃত্যুতে চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে হোঁচট খায়। একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বৈধ করার দাবিতে ক্ষোভ জড়ো হতে থাকে সবার মধ্যে। সে সময় টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি বেড়ে যায় এবং প্রায় একই সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ওপর বাদ সাধে ক্ষমতাসীন দল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সংবাদপত্র ও মানুষের বাক-স্বাধীনতার মতো অধিকারের দাবি। হু মারা যাওয়ার এক দিন পর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে ছাত্রদের একটি ছোট দল তিয়েন আনমেন স্কয়ারে জড়ো হয়। যোগ্য কাউকে রাষ্ট্রের ভার অর্পণ করার দাবি জানায় তারা। ধীরে ধীরে তিয়েন আনমেন স্কয়ার হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এক সপ্তাহ পর হুর শেষকৃত্যের আগের দিন প্রায় ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ বিক্ষোভে ১০ লাখ মানুষ এসে জড়ো হয়।
বিক্ষোভের পরপরই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের টনক নড়ে। কর্র্তৃপক্ষ সমঝোতামূলক ও কট্টরপন্থি উভয় কৌশলের মাধ্যমে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে সচেষ্ট থাকে। বিক্ষোভ সারা দেশের ছাত্রদের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে।
৪ জুন তিয়েন আনমেন স্কয়ারে হাজার হাজার চীনা সৈন্য বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ইয়াং ইয়াং শানকুনের সৎভাই জেনারেল ইয়াং বাইবিংয়ের কমান্ডের অধীনে সামরিক অভিযান ছিল। চীনের তিয়েন আনমেন স্কয়ারের গণহত্যাকে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত ছাত্র বিক্ষোভ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর থেকেই সচেতন হয়ে যায় শাসকগোষ্ঠী। চীন সরকার চীনের মূল ভূখণ্ডে হুয়ের জীবনী আংশিকভাবে প্রকাশ করে। কিন্তু তিয়েন আনমেন স্কয়ারে হুয়ের প্রতি গণসমর্থনের যে নমুনা দেখা গিয়েছি ইতিহাসের পাতায় তা আজও উজ্জ্বল। ছাত্রসহ শত শত সাধারণ মানুষ, ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে, হাজার হাজার মানুষ এ গণহত্যায় নিহত হয়। মৃতের সঠিক সংখ্যা কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, ২০১১
পুঁজিবাদবিরোধী কানাডিয়ান পত্রিকা ‘অ্যাডবাস্টারস’ ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে একটি সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে বসে। খবরের শিরোনাম ছিল ‘ওয়াল স্ট্রিটে ১০ লাখ মানুষের মার্চ’। সেই প্রতিবাদের ডাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় সরকারের লোভ, দুর্নীতি ও সরকারি নীতির ওপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অযাচিত প্রভাব মানুষকে নিষ্পেষিত হতে বাধ্য করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনী ব্যক্তি ও সাধারণ জনতার মধ্যে আয়ের ফারাককে উপলক্ষ করে বিপ্লবের উত্থান।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়াল স্ট্রিটের জুকোটি পার্কে জড়ো হতে থাকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। ‘আমরাই ৯৯%’ সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ওয়াল স্ট্রিট। আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হটিয়ে দিলেই ছত্রভঙ্গ হবে সবাই। এ চিন্তা থেকেই নভেম্বর মাসে বিক্ষোভকারীদের জুকোটি পার্ক থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও পিছু হটেনি আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভকারীরা তারপর ব্যাংক, করপোরেট সদর দপ্তর, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দখলের দিকে মন দেয় তারা।
এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল রাজনীতিতে আর্থিক করপোরেশনের প্রভাব হ্রাস, আয়ের সুষম বণ্টন, চাকরির সুযোগ, ব্যাংকিং নীতির সংস্কার (বিশেষ করে ঋণে সুদের হার কমানো), ছাত্রদের জন্য ঋণের সুদ মাফ ও ঋণগ্রস্ত ছাত্রদের জন্য অন্যান্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এই আন্দোলনকে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখা হয়েছিল।
নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টগলিটজ এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘এ আন্দোলন করপোরেট আমেরিকার সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেছে। শুধু আর্থিক খাত নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি খাত, আমেরিকান প্রযুক্তি খাত সবই পুঁজিবাদী আবহে চালিত হয়েছে। এই করপোরেট খাত সত্যিই আমেরিকার স্বার্থ তুলে ধরছে না।’
এ আন্দোলনে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস শুধু প্রতিবাদী চেতনাই জাগিয়ে তোলেনি। বরং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। হালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার এবং পুরনো দিনের আন্দোলনের মতো অবিরাম শারীরিক উপস্থিতির সমান অন্তর্ভুক্তি এই আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল। দুই সপ্তাহের এই আন্দোলনে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বহুদিন পর আমেরিকার নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর কাছে আমেরিকার নাগরিকের দাবি তুলে ধরেছিল। ভ্লাদিমির লেলিন যেমন লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো দশকে কিছুই ঘটে না, আবার কিছু ক্ষেত্রে সপ্তাহ আসে দশকের ব্যাপ্তি নিয়ে।’ লেলিনের মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে তুলেছিল অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট।
শেয়ার করুন
মুমিতুল মিম্মা | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের ফুঁসে ওঠার ঘটনা বহু প্রাচীন। ‘আন্দোলনরত’ বা ‘বিক্ষুব্ধ’ ছাত্র এ পরিচয়ের ভেতরে লীন হয়ে যায় জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জাতীয়তা। আলোচিত তিন ছাত্র আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন মুমিতুল মিম্মা
ছাত্র আন্দোলন
বিশ্বের নানা স্থানে যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণ সমাজের সক্রিয়তার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০ শতকের শুরুতে নাগরিক অধিকারের বিক্ষোভ থেকে শুরু করে অস্ত্রবিরোধী মিছিল কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবি যেকোনো ন্যায্য দাবিতে তরুণ সমাজ তাদের প্রতিবাদ জারি রেখেছে। কখনো কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা তাদের ন্যায্য দাবিতে অটল থাকে। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আইভি লিগ স্কুল সবখানেই আছে বিদ্রোহী ছাত্রদের দাপুটে পদচিহ্ন। যেকোনো স্থানের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করে যেকোনো স্থানের সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তারা কতটা সচেষ্ট। নারী অধিকার, জাতিগত সমতা, শান্তি ও গণতন্ত্র, সাশ্রয়ী শিক্ষা, পুলিশের জবাবদিহি, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণসহ অনেক গুরুতর বিষয়ে ছাত্ররা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের মত প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিজেদের ন্যায্য দাবির প্রতি অটল থাকেন তারা। ফলে যেখানেই শাসক গোষ্ঠী কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ছাত্রসমাজ। ফলে জন্ম নিয়েছে বড় বড় বিপ্লব।
ছাত্র বিপ্লবের বিপরীতে প্রতি ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ধরনের। কখনো ছাত্রদের অবাধে প্রতিবাদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কখনো তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে, কখনো বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সহিংসভাবে চড়াও হয়েছে তাদের ওপর। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, মারধর এমনকি গুলি চালানোর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে পিছু হটতে বাধ্য করার ইতিহাস বহু পুরনো। মজার ব্যাপার হলেও সত্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যখনই সহিংস হয়ে উঠেছে, তখনই আরও ঘনীভূত হয়েছে প্রতিবাদ। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যতবার দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়, তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মৌন সমর্থন তত বাড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যুত্থান, ১৯৬৮
১৯৬৮ সাল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের বছর। ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে সরাসরি মার্কিন বাহিনীর জড়িয়ে পড়া মেনে নিতে পারেননি আমেরিকার নাগরিকদের কেউই। যুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়। এদিকে আমেরিকার নিয়ম করে দেয় ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোনো তরুণ এ যুদ্ধে নামতে বাধ্য থাকবে, অন্যথায় কারাবরণ করতে হবে তাদের। ফলে তরুণদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী অংশ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। প্রতিবাদ হয়, প্রতিরোধ হয়। একই সঙ্গে একাধিক মহাদেশে ছাত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এসব ছাত্র আন্দোলন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল, কিছু ক্ষেত্রে তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কোনো আন্দোলনই আসলে ব্যর্থ নয়। বেশির ভাগ আন্দোলনই ভবিষ্যতের বীজ বপন করে যায়। যার ফল দেখা যায় পরবর্তী কোনো আন্দোলনে।
১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে ঐতিহাসিকভাবে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজারেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করে। এ ছাড়া অনেকে তাদের ডরমিটরিতে অবরোধ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে, পাঠ্যক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপরে জোর দেয়, ছাত্রদের নিয়ে বিচারব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং বিক্ষোভে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তৃতীয় ও চতুর্থ দাবিতে একমত হয়।
এ ঘটনার ঠিক এক মাস পেরিয়েছে। কলম্বিয়ায় একই সঙ্গে কয়েকটি ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণকে সমর্থনকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের কিছু নথি খুঁজে পায় এক ছাত্র। শুধু তাই-ই নয়, মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্র গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রমাণ মেলে সেখানে। এ ঘটনা জনপ্রকাশ্যে এলে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণমুখী ও শান্তিপ্রিয়। সেখানে কেন অশান্তির চর্চা হবে? প্রায় একই সময় মর্নিংসাইড পার্কে নির্মিত একটি ব্যায়ামাগার নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে গণরোষ চরমে ওঠে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দানা বাঁধে ক্ষোভ।
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই ধরনের আন্দোলন শুরু করে। এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কটি ভবন দখল করে রাখে তারা। আন্দোলন চলাকালে প্রায় এক হাজার পুলিশ কর্মকর্তা তাদের উচ্ছেদ করতে ক্যাম্পাসে হামলা চালায়। একদিকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন, অন্যদিকে ন্যায্য দাবির পক্ষে থাকা। সেমিস্টারের বাকি সময়ও আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের দখল ছাড়েনি। ক্যাম্পাস দখলমুক্ত রাখতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ভিয়েতনাম যুগের অস্ত্র গবেষণা থিংক ট্যাংকের চুক্তি থেকে সরে আসে। একই সঙ্গে হারমেলের মর্নিংসাইড পার্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম তৈরি করার ব্যাপারে সম্মত হয়। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা সীমিত সুযোগে জিম ব্যবহারের অনুমতি পান।
আটলান্টিকের ওপারে ফ্রান্স ও পোল্যান্ডে বিদ্রোহ শুরু হয়। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে জানুয়ারি মাসে ৩০০ জন শিক্ষার্থীর শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মার্চ মাসে ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কঠোর হাতে এ আন্দোলন দমন করে। প্যারিসে মে মাসে প্রায় ২০ হাজার লোক সরবোনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফরাসি শ্রমিক সংগঠন ও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটে যোগ দেন। যার ফলে জাতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাষ্ট্রপতি চার্লস ডি গলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয় তারা।
তিয়েন আনমেন স্কয়ার, ১৯৮৯
মাও-পরবর্তী চীনের চীনে দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পটভূমিতে ভূমিকা রাখেন হু ইয়াওবাং। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদে ছিলেন সংস্কারপন্থি এ নেতা। আশির দশক জুড়ে হুয়ের নেতৃত্বে চীন জুড়ে একের পর এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারকাজ চলতে থাকে। এ সংস্কার কার্যক্রম তাকে অনেক শক্তিশালী নেতার শত্রু করে তুলেছিল।
চীনের বিপ্লবী নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরোধী। কিন্তু হু জানতেন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে গেলে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রয়োজন আছে। তার পদত্যাগের পর ১৯৮৭ সালে চীনজুড়ে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন হু-বিরোধী নেতারা দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য হুয়ের জনবান্ধব নীতিকে দোষারোপ করেন। তাদের ভাষ্য মতে, হু শক্ত হাতে দেশের হাল ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই সে সময় চীনে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর দলীয় অন্তঃকোন্দলের একপর্যায়ে পার্টির পদ থেকে সরে দাঁড়ান হু ইয়াওবাং। পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করে হুয়ের রাজনৈতিক উত্তরসূরি ঝাও জিয়াং। হুয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন তিনি। ১৯৮৯ সালে হু হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সে সময় চীনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াং শানকুন।
তার মৃত্যুতে চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে হোঁচট খায়। একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বৈধ করার দাবিতে ক্ষোভ জড়ো হতে থাকে সবার মধ্যে। সে সময় টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি বেড়ে যায় এবং প্রায় একই সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ওপর বাদ সাধে ক্ষমতাসীন দল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সংবাদপত্র ও মানুষের বাক-স্বাধীনতার মতো অধিকারের দাবি। হু মারা যাওয়ার এক দিন পর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে ছাত্রদের একটি ছোট দল তিয়েন আনমেন স্কয়ারে জড়ো হয়। যোগ্য কাউকে রাষ্ট্রের ভার অর্পণ করার দাবি জানায় তারা। ধীরে ধীরে তিয়েন আনমেন স্কয়ার হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এক সপ্তাহ পর হুর শেষকৃত্যের আগের দিন প্রায় ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ বিক্ষোভে ১০ লাখ মানুষ এসে জড়ো হয়।
বিক্ষোভের পরপরই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের টনক নড়ে। কর্র্তৃপক্ষ সমঝোতামূলক ও কট্টরপন্থি উভয় কৌশলের মাধ্যমে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে সচেষ্ট থাকে। বিক্ষোভ সারা দেশের ছাত্রদের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে।
৪ জুন তিয়েন আনমেন স্কয়ারে হাজার হাজার চীনা সৈন্য বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ইয়াং ইয়াং শানকুনের সৎভাই জেনারেল ইয়াং বাইবিংয়ের কমান্ডের অধীনে সামরিক অভিযান ছিল। চীনের তিয়েন আনমেন স্কয়ারের গণহত্যাকে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত ছাত্র বিক্ষোভ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর থেকেই সচেতন হয়ে যায় শাসকগোষ্ঠী। চীন সরকার চীনের মূল ভূখণ্ডে হুয়ের জীবনী আংশিকভাবে প্রকাশ করে। কিন্তু তিয়েন আনমেন স্কয়ারে হুয়ের প্রতি গণসমর্থনের যে নমুনা দেখা গিয়েছি ইতিহাসের পাতায় তা আজও উজ্জ্বল। ছাত্রসহ শত শত সাধারণ মানুষ, ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে, হাজার হাজার মানুষ এ গণহত্যায় নিহত হয়। মৃতের সঠিক সংখ্যা কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, ২০১১
পুঁজিবাদবিরোধী কানাডিয়ান পত্রিকা ‘অ্যাডবাস্টারস’ ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে একটি সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে বসে। খবরের শিরোনাম ছিল ‘ওয়াল স্ট্রিটে ১০ লাখ মানুষের মার্চ’। সেই প্রতিবাদের ডাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় সরকারের লোভ, দুর্নীতি ও সরকারি নীতির ওপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অযাচিত প্রভাব মানুষকে নিষ্পেষিত হতে বাধ্য করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনী ব্যক্তি ও সাধারণ জনতার মধ্যে আয়ের ফারাককে উপলক্ষ করে বিপ্লবের উত্থান।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়াল স্ট্রিটের জুকোটি পার্কে জড়ো হতে থাকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। ‘আমরাই ৯৯%’ সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ওয়াল স্ট্রিট। আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হটিয়ে দিলেই ছত্রভঙ্গ হবে সবাই। এ চিন্তা থেকেই নভেম্বর মাসে বিক্ষোভকারীদের জুকোটি পার্ক থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও পিছু হটেনি আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভকারীরা তারপর ব্যাংক, করপোরেট সদর দপ্তর, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দখলের দিকে মন দেয় তারা।
এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল রাজনীতিতে আর্থিক করপোরেশনের প্রভাব হ্রাস, আয়ের সুষম বণ্টন, চাকরির সুযোগ, ব্যাংকিং নীতির সংস্কার (বিশেষ করে ঋণে সুদের হার কমানো), ছাত্রদের জন্য ঋণের সুদ মাফ ও ঋণগ্রস্ত ছাত্রদের জন্য অন্যান্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এই আন্দোলনকে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখা হয়েছিল।
নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টগলিটজ এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘এ আন্দোলন করপোরেট আমেরিকার সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেছে। শুধু আর্থিক খাত নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি খাত, আমেরিকান প্রযুক্তি খাত সবই পুঁজিবাদী আবহে চালিত হয়েছে। এই করপোরেট খাত সত্যিই আমেরিকার স্বার্থ তুলে ধরছে না।’
এ আন্দোলনে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস শুধু প্রতিবাদী চেতনাই জাগিয়ে তোলেনি। বরং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। হালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার এবং পুরনো দিনের আন্দোলনের মতো অবিরাম শারীরিক উপস্থিতির সমান অন্তর্ভুক্তি এই আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল। দুই সপ্তাহের এই আন্দোলনে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বহুদিন পর আমেরিকার নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর কাছে আমেরিকার নাগরিকের দাবি তুলে ধরেছিল। ভ্লাদিমির লেলিন যেমন লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো দশকে কিছুই ঘটে না, আবার কিছু ক্ষেত্রে সপ্তাহ আসে দশকের ব্যাপ্তি নিয়ে।’ লেলিনের মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে তুলেছিল অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট।