ইউরোপের ফ্যাসিবাদী স্থাপত্যের কী হবে?
মুমিতুল মিম্মা | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
গোটা ইউরোপে রয়ে গেছে অনেক বিতর্কিত স্মৃতিস্তম্ভ। উত্তরাধিকারসূত্রে ফ্যাসিবাদী স্থাপত্য নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। জার্মানি ও স্পেন স্থাপত্যে স্বৈরাচারী প্রভাব মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। আর ইতালি বেছে নিয়েছে শৈল্পিক সমাধান। ইতালি ঘুরে অ্যালেক্স সাকালিসের করা প্রতিবেদন তর্জমা করেছেন মুমিতুল মিম্মা
দুই স্বৈরাচারী ভাস্কর্য
ইতালির সুদূর উত্তরের শহর বোলজানো। ইউরোপের আল্পস অঞ্চলের পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নব্বই দশকে আটটি আলপানই দেশের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত হয় আল্পস কমভেনশন চুক্তি। অন্য যেকোনো আলপাইন শহরের মতো সবুজ পাহাড় সারি সারি দুর্গ, শস্যক্ষেত্র ও গির্জা দিয়ে ঢাকা। আঁকাবাঁকা রাস্তা, প্যাস্টেল রঙের বাড়ি, বারোক ট্যাভার্নের একটি খামখেয়ালি তুষার ঝরা শহর। শহরের পশ্চিম প্রান্তে তালফার নদী অতিক্রম করতে গেলেই চোখে মিলবে ভিন্ন এক গল্প। রাস্তাগুলো প্রশস্ত। গম্ভীর ধূসর ভবনের ব্লকগুলোকে এড়িয়ে রাস্তায় চোখ বোলালে আরাম লাগবে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি থমথমে স্থাপত্য। সেটি দেখতে অদ্ভুতরকমের একঘেয়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মন ভার হয়ে আসে।
এই বিষণœ পোশাকের মধ্যে দুটি আলাদা কাঠামো। প্রথমটি হলো শহরের ট্যাক্স অফিস। বিশালাকৃতি একটি ব্লক। ৫৭টি ভাস্কর্য প্যানেল জুড়ে অবস্থিত। রোমের মার্চ থেকে আফ্রিকার ঔপনিবেশিক বিজয় পর্যন্ত ইতালির ফ্যাসিবাদের অপ্রতিরোধ্য উত্থান। ভাস্কর্যটির কেন্দ্রে ঘোড়ার পিঠে মুসোলিনির ভাস্কর্য রয়েছে। তার ডান হাত রোমান অভিবাদনে প্রসারিত। এটি ফ্যাসিবাদী স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য অংশ। একই সঙ্গে বিস্ময়কর, অনুপ্রেরণাদায়ক, সুন্দর ও বিভ্রান্তিকর। একটি ভাস্কর্যের ভেতরে এতসব একসঙ্গে জড়ো করা যেতে পারে তা এটি না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়।
অন্য ভাস্কর্যটি বোলজানো ভিক্টরি মনুমেন্ট। সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি একটি আকর্ষণীয় খিলান। সাদা কলামের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যে থাকা লাঠির বান্ডিল যা ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রতীক। লাতিন ভাষায় এখানে লেখা রয়েছে এখানে পিতৃভূমির সীমান্তে ব্যানার স্থাপন করেছি। এদিক থেকে আমরা অন্যদের ভাষা, আইন ও সংস্কৃতি দিয়ে শিক্ষিত করেছি।
ভাস্কর্যের আশপাশ দিয়ে সবুজ গাছগুলো মরীচিকার মতো লতিয়ে উঠছে। লতাগুল্মের সবুজ যেন ১৯২৮ সালে নির্মিত এ স্মৃতিসৌধের ভয়াল ছায়াকে পাশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বর্তমানে উঁচু ধাতব বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে এটিকে। একসময় এ স্থানটি অতি ডানপন্থি মিছিলের জন্য সমাবেশকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী শাসকের প্রতীক হিসেবে এ স্মৃতিসৌধকে ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ইতিহাসবিদ জেফ্রি স্ন্যাপ এটিকে ‘প্রথম সত্যিকারের ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তবুও আজ ফ্যাসিবাদী স্থাপত্য প্রচারণার দুটি স্মৃতিসৌধ ঘিরে বিতর্ক চলছে। সেখানকার জনতা আজ দুভাবে বিভক্ত। স্বৈরাচারের স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে উঠেছে একটি সাহসী যুদ্ধক্ষেত্র। বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী অর্থসহ স্মৃতিস্তম্ভ রাখা বা ধ্বংস করা হবে কি না তা বিতর্ক চলছেই। এক ভাগ চায় ইতিহাস টিকে থাকুক, আরেক ভাগ স্বৈরাচারী স্তম্ভ মুছে ফেলার পক্ষপাতী।
স্বৈরাচারী উপনিবেশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বোলজানো (অনেকের মতে এ শহরটির নাম বোজেন। উভয় নামই ঠাঁই পেয়েছে সরকারি খাতায়) ছিল দক্ষিণ টাইরোলের বৃহত্তম শহর। একই সঙ্গে এটি অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি পার্বত্য প্রদেশ। শহর ও প্রদেশ উভয়ই অপ্রতিরোধ্যভাবে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে জার্মান রাখার পক্ষপাতী ছিল। ১৯১৯ সালে শান্তি সম্মেলনে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইতালিকে পুরস্কৃত করেছিল। দক্ষিণ টাইরোল আল্পসের শৈলশিরা বরাবর ইতালিকে একটি প্রাকৃতিক উত্তর সীমান্তে ঢোকার অনুমতি দেবে এবং কৌশলগত কারণে ব্রেনার পাসের নিয়ন্ত্রণ দেবে। বলে রাখা ভালো, ব্রেনার পাস হলো আল্পসের মধ্য দিয়ে একটি পার্বত্য গিরিপথ যা ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে সীমান্ত। আল্পসের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থান করে এবং দুই দেশে যাতায়াতের জন্য অন্যতম সীমান্ত পারাপার হিসেবে বিবেচিত হয়।
অস্ট্রিয়া সীমান্ত শহর হিসেবে এ শহরে বেশিরভাগ মানুষই ইতালিয়ান ছিলেন না। কিন্তু মুসোলিনি তার তীব্র জাতীয়তাবাদী নীতির পক্ষে ছিলেন। ফলে ধীরে ধীরে টাইরোলিয়ান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। জার্মান প্রদেশের ৯০ শতাংশ স্থানীয় ভাষা কথ্য ও দাপ্তরিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
বোলজানো শহরকে একটি শিল্প অঞ্চল বানানোর চেষ্টা করা হয়। হাজার হাজার ইতালীয়দের এখানে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করা হয়েছিল। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি মুসোলিনির স্বৈরাচারী পদচারণা। ফ্যাসিবাদের গৌরবের জন্য উৎসর্গ করা হয় অসংখ্য স্মৃতিস্মম্ভ। নতুন নতুন ভবন দিয়ে শহরটিকে ফেস্টুনে আবৃত করে তোলা হয়েছিল। যুদ্ধের পর ইতালীয় সরকার মুসোলিনির যাবতীয় কার্যক্রমের প্রায়শ্চিত্ত করে। দক্ষিণ টাইরোলে অধিবাসীদের উচ্চপর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন দেয়। নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় টাইরোলের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকারকে সম্মান করা হবে, ভাষার ভিত্তিতে জনসেবার চাকরি সমানুপাতিকভাবে বরাদ্দ করা হবে এবং শহরের মোট কর রাজস্বের ৯০ শতাংশ এ অঞ্চলের জন্য খরচ করা হবে।
ইতালীয়-জার্মান বিতর্ক
যত যাই হোক না কেন, ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে মানবিক দ্বন্দ্ব কিন্তু চলছেই। জার্মান ভাষাভাষীদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভগুলো ছিল ইতালীয় ফ্যাসিবাদের প্রতীক। কারণ মুসোলিনির শাসনামলে তাদের জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার বহু চেষ্টা করা হয়েছিল। বোলজানো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইতিহাসের অধ্যাপক আন্দ্রেয়া ডি মিচেল বলেন, তারা স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল। যদিও ইতালীয়রা জানে যে, বোলজানোতে জার্মানদের হটিয়ে কৃত্রিমভাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। কিন্তু একটি জার্মানভাষী প্রদেশে ভিক্টরি মনুমেন্টের মতো একটি প্রতীক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে জার্মানদের কেমন লাগতে পারে সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। তাদের মতে, এসব স্মৃতিস্তম্ভ তাদের ইতালীয় পরিচয়ের প্রতীক।
মুসোলিনির শাসন শেষ হওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলে জার্মান বনাম ইতালীয়দের একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলছেই। কিন্তু এ দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। ক্রমাগত ভাঙচুর ও বোমা হামলার মুখে এ স্মৃতিস্তম্ভটি বাঁচাতে একটি বিশাল ধাতব গেট তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে কর অফিসটি সার্বক্ষণিক সামরিক পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। ইতালীয় ও জার্মানভাষী অতি ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের ধরে এ দুটি ভবনকেই বহুবার সমাবেশকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে এসব উগ্রপন্থির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সমাধানের কোনো কার্যকরী আশ্বাস আসেনি কোনো পক্ষ থেকেই, এমনকি স্থানীয় সরকারের কাছ থেকেও।
পথ দেখাচ্ছে স্পেন
ফ্যাসিবাদী যুগের স্থাপত্যের উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই করা দেশের তালিকায় ইতালি একাই নেই। এই দলে আছে স্পেনও। স্পেনে ‘ভুলে যাওয়ার চুক্তি’ মানে ফ্রাঙ্কো যুগের ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভগুলো ২০০৭ সাল পর্যন্ত নির্বিঘেœই ছিল। যদিও ঐতিহাসিক মেমরি ল তাদের অপসারণের জন্য একটি আইনি কাঠামো দিয়েছিল। ২০১০ সালে স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ছাদ থেকে ফ্রাঙ্কোকে মহান হিসেবে বিবৃত করা একটি শিলালিপি সরিয়ে ফেলা হয়। যার ফলাফল হিসেবে দর্শনীয় স্থানের একটি অংশ ফাঁকা রয়ে যায়। এদিকে ফ্রাঙ্কোর সর্বশেষ প্রকাশ্য মূর্তিটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নামিয়ে ফেলা হয়।
স্বৈরাচারী শাসকের তৈরি ভবন ভেঙে ফেলার পক্ষে দেশটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে যাচ্ছে। গিহং বিশ্ববিদ্যালয় স্পেনের সবচেয়ে বড় ভবন। ফ্রাঙ্কো শাসনের প্রথম দিকে ‘নিও হেরিরিয়ান’ শৈলীতে এ ভবনটি তৈরি করা হয়। ব্যতিক্রমী স্থাপত্য হিসেবে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপরও স্পেনের বামপন্থি কাউন্সিল ইউনেস্কোর এ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে বলেছে, ফ্রাঙ্কোইজমের সঙ্গে যুক্ত একটি ভবন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হতে পারে না।
ফ্রাঙ্কোর সবচেয়ে কুখ্যাত স্থাপত্য হলো ভ্যালি অব দ্য ফলন। এটি একটি বিশাল প্রাঙ্গণ যেখানে ব্যাসিলিকা, গেস্ট হাউজ, বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ, ৩০ হাজারেরও বেশি লোকের মৃতদেহ সৎকারের একটি সমাধিস্থল তৈরি করেছিলেন। ফ্রাঙ্কো এ স্থাপত্যকে জাতীয় পুনর্মিলনের একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাকিরা এটিকে ফ্রাঙ্কোইজমের উচ্ছ্বাস বলে মনে করে। অনেকে এটিকে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা
করেছে। ২০১৯ সালে এ স্থাপত্য থেকে ফ্রাঙ্কোর দেহাবশেষ সরিয়ে ফেলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে স্পেন সরকার এ স্থাপত্যের সমাধিস্থলকে একটি নাগরিক কবরস্থানে পরিণত করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিতর্কটি যখন ‘হয় রাখো নয় সরাও’র মতো বাইনারি সিদ্ধান্তে এসে ঠেকেছে সেখানে সরকারের সংরক্ষণ ও পরিমার্জন নীতি কাজে দেয়নি। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কোইসট শাসনের উত্তরাধিকার বিতর্ক তাই ক্রমাগত জটিল হবে এটিই স্বাভাবিক।
এদিকে জার্মানিতে নাৎসি যুগ থেকে যেকোনো স্থাপত্য খুঁজে পেতে গেলে ঘাম ঝরবে। কারণ যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের পরে দেশটিতে নাৎসিসংক্রান্ত যেকোনো স্থাপত্যের বেশিরভাগই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। টিকে থাকা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী ভবন ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদী প্রতীকও ঘষামাজা করে পুনরায় তৈরি করা হয়। যেমন বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গের কংগ্রেস হলের মতো অন্য বড় বড় ভবনকে নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টার হিসেবে রাখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। এসব দালানকোটা হিটলারের স্থাপত্য উচ্চাকাক্সক্ষার অহং ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হিসেবে চর্চার ফল বিবেচনা করা হয়।
ইতালিতে মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের স্থায়ীরূপ হিসেবে স্থাপত্য বেছে নিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ রুথ বেন গিয়াত লিখেছেন, ‘ইতালিতে যারা ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে প্রশ্নাতীতভাবে টিকে থাকতে দিয়েছে তাদের ঝুঁকি ভিন্ন। যদি স্মৃতিস্মম্ভগুলোকে শুধু রাজনীতিমুক্ত নান্দনিক বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয় তখন ভয় রয়ে যায় যে, অতি ডানপন্থিরা (এসব স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাতার) কুৎসিত মতাদর্শকে কাজে লাগাতে পারে।’
২০১৪ সালে বোলজানোতে ইতিহাসবিদ ও শিল্পীদের একটি অসাম্প্রদায়িক দল এক মুক্ত আলোচনা আহ্বান করেছিল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষের বিপরীতে অহিংসভাবে কী করা যায় এ নিয়ে আলোচনা চলে। কালে কালে প্রতিটি ভবনই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয়তা ও স্বৈরাচারবিরোধী অনুভূতিকে সমানভাবে আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কী করা যেতে পারে তার স্থায়ী সমাধান খোঁজা হচ্ছিল।
ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইতিহাসের অধ্যাপক ও বোলজানো সমস্যার সমাধান খোঁজার গুরুতর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের একজন হ্যানেস ওবেরমাইর বলেন, ‘হয় ধ্বংস করা অথবা যা আছে তা ঠিকঠাক রাখার মতো ভাবনার কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার জটিলতায় যাচ্ছি না। (কারণ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে) যদি স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে অপসারণ করা হয় তাহলে ইতিহাসের প্রমাণগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস ও পরিচয়ের জটিল স্তরগুলো মোকাবিলা করা এড়িয়ে যেতে হবে। নইলে বিতর্ক বাড়বে। অন্যথায় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে চ্যালেঞ্জ না করে তাদের ওপরে ঝুলিয়ে রাখা ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে স্বাভাবিক করে তুলুন।’
বিরোধের শৈল্পিক সমাধান
শেষমেশ সবাই মিলে একটি সৃজনশীল সমাধান খুঁজে পায়। শহরটিকে ইতালীয় ও জার্মানদের একত্রিত করতে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার উত্তেজনা নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। সমাধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে পুনরায় বর্তমান সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তোলা, তাদের শৈল্পিক অখণ্ডতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বজায় রাখা, একই সঙ্গে তাদের ওপরে ঝুলিয়ে রাখা ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে নিষ্ক্রিয় ও বিকৃত করা।
ওবেরমাইর বলেন, ‘শহরের ইতিহাস সম্পর্কে কথোপকথনের একটি সুযোগ ছিল। মানুষের বিরোধের সঙ্গে অতীতের সম্পর্ক নেই। তাহলে আমরা অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে পড়ে আছি কেন? আমরা কি অতীতের মতাদর্শ নিয়ে চলব নাকি একটি গণতান্ত্রিক ও বহুসংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা একটি সমাজে সহিষ্ণুতা এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধার মূল্যবোধে বিশ্বাস করব?’
বিরোধ সমাধানে প্রথমে আসে ভিক্টরি মনুমেন্ট। স্পষ্টতই এ ভাস্কর্য ফ্যাসিবাদী, দক্ষিণ টাইরোলের বিজয় ও উপনিবেশ এবং লাতিন সভ্যতার কথিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে। কিন্তু শহরের জার্মান ও ইতালীয় নাগরিকদের মতাদর্শের ভিন্নতায় এটি হয়ে দাঁড়ায় জটিল এক বাঁক। অথচ স্বৈরাচারের ছাপ ছাড়াও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় বিজয়ের উদযাপন ও যুদ্ধে ইতালীয় সৈন্যদের স্মৃতিসৌধ হিসেবেও দেখা হয় এ মনুমেন্টকে।
এ সৌধের আরেকটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রথম ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ফরাসি আর্ট ডেকো ও জার্মান বাউহসের মতো আধুনিক স্থাপত্যের বিকাশে এ স্থানকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। সে সময় ইতালীয় শিল্পী মার্চেল্লো পিয়াচেন্তিনি ও আদোলফো উইলদতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ও স্থপতিরা এ সৌধ নির্মাণে কাজ করেছিলেন।
প্রথম হস্তক্ষেপ হিসেবে একেকটি কলামের চারপাশে একটি এলইডি রিং লাগানো, স্মৃতিসৌধের শৈল্পিক অখণ্ডতার ক্ষতি না করে ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে প্রতীকীভাবে দমিয়ে দেওয়া। এরপর ভবনের নিচে একটি জাদুঘর নির্মিত হয় যা বোলজানোর আধুনিক ইতিহাসের বিশদ বিবরণ দেয়, স্মৃতিস্তম্ভের সৃষ্টির প্রেক্ষাপটের কাহিনীকে জীবন্ত করে তোলে।
উভয় সম্প্রদায়ের রাজনীতি ও সুশীল সমাজের মানুষ এ শৈল্পিক হস্তক্ষেপকে উদারচিত্তে গ্রহণ করেছে। যদিও এ সমাধান দুপক্ষের মাঝে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দমন করতে পারেনি তবে আশা করা যায় যে, এ আলোচনার মাধ্যমে স্থাপত্য নিয়ে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে।
শেয়ার করুন
মুমিতুল মিম্মা | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

গোটা ইউরোপে রয়ে গেছে অনেক বিতর্কিত স্মৃতিস্তম্ভ। উত্তরাধিকারসূত্রে ফ্যাসিবাদী স্থাপত্য নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। জার্মানি ও স্পেন স্থাপত্যে স্বৈরাচারী প্রভাব মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। আর ইতালি বেছে নিয়েছে শৈল্পিক সমাধান। ইতালি ঘুরে অ্যালেক্স সাকালিসের করা প্রতিবেদন তর্জমা করেছেন মুমিতুল মিম্মা
দুই স্বৈরাচারী ভাস্কর্য
ইতালির সুদূর উত্তরের শহর বোলজানো। ইউরোপের আল্পস অঞ্চলের পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নব্বই দশকে আটটি আলপানই দেশের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত হয় আল্পস কমভেনশন চুক্তি। অন্য যেকোনো আলপাইন শহরের মতো সবুজ পাহাড় সারি সারি দুর্গ, শস্যক্ষেত্র ও গির্জা দিয়ে ঢাকা। আঁকাবাঁকা রাস্তা, প্যাস্টেল রঙের বাড়ি, বারোক ট্যাভার্নের একটি খামখেয়ালি তুষার ঝরা শহর। শহরের পশ্চিম প্রান্তে তালফার নদী অতিক্রম করতে গেলেই চোখে মিলবে ভিন্ন এক গল্প। রাস্তাগুলো প্রশস্ত। গম্ভীর ধূসর ভবনের ব্লকগুলোকে এড়িয়ে রাস্তায় চোখ বোলালে আরাম লাগবে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি থমথমে স্থাপত্য। সেটি দেখতে অদ্ভুতরকমের একঘেয়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মন ভার হয়ে আসে।
এই বিষণœ পোশাকের মধ্যে দুটি আলাদা কাঠামো। প্রথমটি হলো শহরের ট্যাক্স অফিস। বিশালাকৃতি একটি ব্লক। ৫৭টি ভাস্কর্য প্যানেল জুড়ে অবস্থিত। রোমের মার্চ থেকে আফ্রিকার ঔপনিবেশিক বিজয় পর্যন্ত ইতালির ফ্যাসিবাদের অপ্রতিরোধ্য উত্থান। ভাস্কর্যটির কেন্দ্রে ঘোড়ার পিঠে মুসোলিনির ভাস্কর্য রয়েছে। তার ডান হাত রোমান অভিবাদনে প্রসারিত। এটি ফ্যাসিবাদী স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য অংশ। একই সঙ্গে বিস্ময়কর, অনুপ্রেরণাদায়ক, সুন্দর ও বিভ্রান্তিকর। একটি ভাস্কর্যের ভেতরে এতসব একসঙ্গে জড়ো করা যেতে পারে তা এটি না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়।
অন্য ভাস্কর্যটি বোলজানো ভিক্টরি মনুমেন্ট। সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি একটি আকর্ষণীয় খিলান। সাদা কলামের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যে থাকা লাঠির বান্ডিল যা ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রতীক। লাতিন ভাষায় এখানে লেখা রয়েছে এখানে পিতৃভূমির সীমান্তে ব্যানার স্থাপন করেছি। এদিক থেকে আমরা অন্যদের ভাষা, আইন ও সংস্কৃতি দিয়ে শিক্ষিত করেছি।
ভাস্কর্যের আশপাশ দিয়ে সবুজ গাছগুলো মরীচিকার মতো লতিয়ে উঠছে। লতাগুল্মের সবুজ যেন ১৯২৮ সালে নির্মিত এ স্মৃতিসৌধের ভয়াল ছায়াকে পাশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বর্তমানে উঁচু ধাতব বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে এটিকে। একসময় এ স্থানটি অতি ডানপন্থি মিছিলের জন্য সমাবেশকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী শাসকের প্রতীক হিসেবে এ স্মৃতিসৌধকে ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ইতিহাসবিদ জেফ্রি স্ন্যাপ এটিকে ‘প্রথম সত্যিকারের ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তবুও আজ ফ্যাসিবাদী স্থাপত্য প্রচারণার দুটি স্মৃতিসৌধ ঘিরে বিতর্ক চলছে। সেখানকার জনতা আজ দুভাবে বিভক্ত। স্বৈরাচারের স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে উঠেছে একটি সাহসী যুদ্ধক্ষেত্র। বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী অর্থসহ স্মৃতিস্তম্ভ রাখা বা ধ্বংস করা হবে কি না তা বিতর্ক চলছেই। এক ভাগ চায় ইতিহাস টিকে থাকুক, আরেক ভাগ স্বৈরাচারী স্তম্ভ মুছে ফেলার পক্ষপাতী।
স্বৈরাচারী উপনিবেশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বোলজানো (অনেকের মতে এ শহরটির নাম বোজেন। উভয় নামই ঠাঁই পেয়েছে সরকারি খাতায়) ছিল দক্ষিণ টাইরোলের বৃহত্তম শহর। একই সঙ্গে এটি অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি পার্বত্য প্রদেশ। শহর ও প্রদেশ উভয়ই অপ্রতিরোধ্যভাবে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে জার্মান রাখার পক্ষপাতী ছিল। ১৯১৯ সালে শান্তি সম্মেলনে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইতালিকে পুরস্কৃত করেছিল। দক্ষিণ টাইরোল আল্পসের শৈলশিরা বরাবর ইতালিকে একটি প্রাকৃতিক উত্তর সীমান্তে ঢোকার অনুমতি দেবে এবং কৌশলগত কারণে ব্রেনার পাসের নিয়ন্ত্রণ দেবে। বলে রাখা ভালো, ব্রেনার পাস হলো আল্পসের মধ্য দিয়ে একটি পার্বত্য গিরিপথ যা ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে সীমান্ত। আল্পসের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থান করে এবং দুই দেশে যাতায়াতের জন্য অন্যতম সীমান্ত পারাপার হিসেবে বিবেচিত হয়।
অস্ট্রিয়া সীমান্ত শহর হিসেবে এ শহরে বেশিরভাগ মানুষই ইতালিয়ান ছিলেন না। কিন্তু মুসোলিনি তার তীব্র জাতীয়তাবাদী নীতির পক্ষে ছিলেন। ফলে ধীরে ধীরে টাইরোলিয়ান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। জার্মান প্রদেশের ৯০ শতাংশ স্থানীয় ভাষা কথ্য ও দাপ্তরিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
বোলজানো শহরকে একটি শিল্প অঞ্চল বানানোর চেষ্টা করা হয়। হাজার হাজার ইতালীয়দের এখানে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করা হয়েছিল। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি মুসোলিনির স্বৈরাচারী পদচারণা। ফ্যাসিবাদের গৌরবের জন্য উৎসর্গ করা হয় অসংখ্য স্মৃতিস্মম্ভ। নতুন নতুন ভবন দিয়ে শহরটিকে ফেস্টুনে আবৃত করে তোলা হয়েছিল। যুদ্ধের পর ইতালীয় সরকার মুসোলিনির যাবতীয় কার্যক্রমের প্রায়শ্চিত্ত করে। দক্ষিণ টাইরোলে অধিবাসীদের উচ্চপর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন দেয়। নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় টাইরোলের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকারকে সম্মান করা হবে, ভাষার ভিত্তিতে জনসেবার চাকরি সমানুপাতিকভাবে বরাদ্দ করা হবে এবং শহরের মোট কর রাজস্বের ৯০ শতাংশ এ অঞ্চলের জন্য খরচ করা হবে।
ইতালীয়-জার্মান বিতর্ক
যত যাই হোক না কেন, ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে মানবিক দ্বন্দ্ব কিন্তু চলছেই। জার্মান ভাষাভাষীদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভগুলো ছিল ইতালীয় ফ্যাসিবাদের প্রতীক। কারণ মুসোলিনির শাসনামলে তাদের জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার বহু চেষ্টা করা হয়েছিল। বোলজানো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইতিহাসের অধ্যাপক আন্দ্রেয়া ডি মিচেল বলেন, তারা স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল। যদিও ইতালীয়রা জানে যে, বোলজানোতে জার্মানদের হটিয়ে কৃত্রিমভাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। কিন্তু একটি জার্মানভাষী প্রদেশে ভিক্টরি মনুমেন্টের মতো একটি প্রতীক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে জার্মানদের কেমন লাগতে পারে সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। তাদের মতে, এসব স্মৃতিস্তম্ভ তাদের ইতালীয় পরিচয়ের প্রতীক।
মুসোলিনির শাসন শেষ হওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলে জার্মান বনাম ইতালীয়দের একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলছেই। কিন্তু এ দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। ক্রমাগত ভাঙচুর ও বোমা হামলার মুখে এ স্মৃতিস্তম্ভটি বাঁচাতে একটি বিশাল ধাতব গেট তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে কর অফিসটি সার্বক্ষণিক সামরিক পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। ইতালীয় ও জার্মানভাষী অতি ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের ধরে এ দুটি ভবনকেই বহুবার সমাবেশকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে এসব উগ্রপন্থির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সমাধানের কোনো কার্যকরী আশ্বাস আসেনি কোনো পক্ষ থেকেই, এমনকি স্থানীয় সরকারের কাছ থেকেও।
পথ দেখাচ্ছে স্পেন
ফ্যাসিবাদী যুগের স্থাপত্যের উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই করা দেশের তালিকায় ইতালি একাই নেই। এই দলে আছে স্পেনও। স্পেনে ‘ভুলে যাওয়ার চুক্তি’ মানে ফ্রাঙ্কো যুগের ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভগুলো ২০০৭ সাল পর্যন্ত নির্বিঘেœই ছিল। যদিও ঐতিহাসিক মেমরি ল তাদের অপসারণের জন্য একটি আইনি কাঠামো দিয়েছিল। ২০১০ সালে স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ছাদ থেকে ফ্রাঙ্কোকে মহান হিসেবে বিবৃত করা একটি শিলালিপি সরিয়ে ফেলা হয়। যার ফলাফল হিসেবে দর্শনীয় স্থানের একটি অংশ ফাঁকা রয়ে যায়। এদিকে ফ্রাঙ্কোর সর্বশেষ প্রকাশ্য মূর্তিটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নামিয়ে ফেলা হয়।
স্বৈরাচারী শাসকের তৈরি ভবন ভেঙে ফেলার পক্ষে দেশটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে যাচ্ছে। গিহং বিশ্ববিদ্যালয় স্পেনের সবচেয়ে বড় ভবন। ফ্রাঙ্কো শাসনের প্রথম দিকে ‘নিও হেরিরিয়ান’ শৈলীতে এ ভবনটি তৈরি করা হয়। ব্যতিক্রমী স্থাপত্য হিসেবে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপরও স্পেনের বামপন্থি কাউন্সিল ইউনেস্কোর এ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে বলেছে, ফ্রাঙ্কোইজমের সঙ্গে যুক্ত একটি ভবন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হতে পারে না।
ফ্রাঙ্কোর সবচেয়ে কুখ্যাত স্থাপত্য হলো ভ্যালি অব দ্য ফলন। এটি একটি বিশাল প্রাঙ্গণ যেখানে ব্যাসিলিকা, গেস্ট হাউজ, বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ, ৩০ হাজারেরও বেশি লোকের মৃতদেহ সৎকারের একটি সমাধিস্থল তৈরি করেছিলেন। ফ্রাঙ্কো এ স্থাপত্যকে জাতীয় পুনর্মিলনের একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাকিরা এটিকে ফ্রাঙ্কোইজমের উচ্ছ্বাস বলে মনে করে। অনেকে এটিকে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা
করেছে। ২০১৯ সালে এ স্থাপত্য থেকে ফ্রাঙ্কোর দেহাবশেষ সরিয়ে ফেলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে স্পেন সরকার এ স্থাপত্যের সমাধিস্থলকে একটি নাগরিক কবরস্থানে পরিণত করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিতর্কটি যখন ‘হয় রাখো নয় সরাও’র মতো বাইনারি সিদ্ধান্তে এসে ঠেকেছে সেখানে সরকারের সংরক্ষণ ও পরিমার্জন নীতি কাজে দেয়নি। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কোইসট শাসনের উত্তরাধিকার বিতর্ক তাই ক্রমাগত জটিল হবে এটিই স্বাভাবিক।
এদিকে জার্মানিতে নাৎসি যুগ থেকে যেকোনো স্থাপত্য খুঁজে পেতে গেলে ঘাম ঝরবে। কারণ যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের পরে দেশটিতে নাৎসিসংক্রান্ত যেকোনো স্থাপত্যের বেশিরভাগই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। টিকে থাকা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী ভবন ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদী প্রতীকও ঘষামাজা করে পুনরায় তৈরি করা হয়। যেমন বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গের কংগ্রেস হলের মতো অন্য বড় বড় ভবনকে নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টার হিসেবে রাখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। এসব দালানকোটা হিটলারের স্থাপত্য উচ্চাকাক্সক্ষার অহং ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হিসেবে চর্চার ফল বিবেচনা করা হয়।
ইতালিতে মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের স্থায়ীরূপ হিসেবে স্থাপত্য বেছে নিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ রুথ বেন গিয়াত লিখেছেন, ‘ইতালিতে যারা ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে প্রশ্নাতীতভাবে টিকে থাকতে দিয়েছে তাদের ঝুঁকি ভিন্ন। যদি স্মৃতিস্মম্ভগুলোকে শুধু রাজনীতিমুক্ত নান্দনিক বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয় তখন ভয় রয়ে যায় যে, অতি ডানপন্থিরা (এসব স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাতার) কুৎসিত মতাদর্শকে কাজে লাগাতে পারে।’
২০১৪ সালে বোলজানোতে ইতিহাসবিদ ও শিল্পীদের একটি অসাম্প্রদায়িক দল এক মুক্ত আলোচনা আহ্বান করেছিল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষের বিপরীতে অহিংসভাবে কী করা যায় এ নিয়ে আলোচনা চলে। কালে কালে প্রতিটি ভবনই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয়তা ও স্বৈরাচারবিরোধী অনুভূতিকে সমানভাবে আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কী করা যেতে পারে তার স্থায়ী সমাধান খোঁজা হচ্ছিল।
ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইতিহাসের অধ্যাপক ও বোলজানো সমস্যার সমাধান খোঁজার গুরুতর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের একজন হ্যানেস ওবেরমাইর বলেন, ‘হয় ধ্বংস করা অথবা যা আছে তা ঠিকঠাক রাখার মতো ভাবনার কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার জটিলতায় যাচ্ছি না। (কারণ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে) যদি স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে অপসারণ করা হয় তাহলে ইতিহাসের প্রমাণগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস ও পরিচয়ের জটিল স্তরগুলো মোকাবিলা করা এড়িয়ে যেতে হবে। নইলে বিতর্ক বাড়বে। অন্যথায় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে চ্যালেঞ্জ না করে তাদের ওপরে ঝুলিয়ে রাখা ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে স্বাভাবিক করে তুলুন।’
বিরোধের শৈল্পিক সমাধান
শেষমেশ সবাই মিলে একটি সৃজনশীল সমাধান খুঁজে পায়। শহরটিকে ইতালীয় ও জার্মানদের একত্রিত করতে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার উত্তেজনা নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। সমাধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে পুনরায় বর্তমান সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তোলা, তাদের শৈল্পিক অখণ্ডতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বজায় রাখা, একই সঙ্গে তাদের ওপরে ঝুলিয়ে রাখা ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে নিষ্ক্রিয় ও বিকৃত করা।
ওবেরমাইর বলেন, ‘শহরের ইতিহাস সম্পর্কে কথোপকথনের একটি সুযোগ ছিল। মানুষের বিরোধের সঙ্গে অতীতের সম্পর্ক নেই। তাহলে আমরা অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে পড়ে আছি কেন? আমরা কি অতীতের মতাদর্শ নিয়ে চলব নাকি একটি গণতান্ত্রিক ও বহুসংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা একটি সমাজে সহিষ্ণুতা এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধার মূল্যবোধে বিশ্বাস করব?’
বিরোধ সমাধানে প্রথমে আসে ভিক্টরি মনুমেন্ট। স্পষ্টতই এ ভাস্কর্য ফ্যাসিবাদী, দক্ষিণ টাইরোলের বিজয় ও উপনিবেশ এবং লাতিন সভ্যতার কথিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে। কিন্তু শহরের জার্মান ও ইতালীয় নাগরিকদের মতাদর্শের ভিন্নতায় এটি হয়ে দাঁড়ায় জটিল এক বাঁক। অথচ স্বৈরাচারের ছাপ ছাড়াও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় বিজয়ের উদযাপন ও যুদ্ধে ইতালীয় সৈন্যদের স্মৃতিসৌধ হিসেবেও দেখা হয় এ মনুমেন্টকে।
এ সৌধের আরেকটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রথম ফ্যাসিবাদী স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ফরাসি আর্ট ডেকো ও জার্মান বাউহসের মতো আধুনিক স্থাপত্যের বিকাশে এ স্থানকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। সে সময় ইতালীয় শিল্পী মার্চেল্লো পিয়াচেন্তিনি ও আদোলফো উইলদতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ও স্থপতিরা এ সৌধ নির্মাণে কাজ করেছিলেন।
প্রথম হস্তক্ষেপ হিসেবে একেকটি কলামের চারপাশে একটি এলইডি রিং লাগানো, স্মৃতিসৌধের শৈল্পিক অখণ্ডতার ক্ষতি না করে ফ্যাসিবাদী বাক্যবাণকে প্রতীকীভাবে দমিয়ে দেওয়া। এরপর ভবনের নিচে একটি জাদুঘর নির্মিত হয় যা বোলজানোর আধুনিক ইতিহাসের বিশদ বিবরণ দেয়, স্মৃতিস্তম্ভের সৃষ্টির প্রেক্ষাপটের কাহিনীকে জীবন্ত করে তোলে।
উভয় সম্প্রদায়ের রাজনীতি ও সুশীল সমাজের মানুষ এ শৈল্পিক হস্তক্ষেপকে উদারচিত্তে গ্রহণ করেছে। যদিও এ সমাধান দুপক্ষের মাঝে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দমন করতে পারেনি তবে আশা করা যায় যে, এ আলোচনার মাধ্যমে স্থাপত্য নিয়ে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে।