ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কি তাইওয়ানে গড়াবে?
তৃষা বড়ুয়া | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০
রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার ঘটনায় অনিরাপদ বোধ করছে শক্তিশালী দেশের পার্শ্ববর্তী ছোট দেশগুলো। প্রতিবেশী তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনতে মরিয়া চীন। তাইওয়ানে সংঘর্ষ বাধলে কেবল অর্থনীতি নয়, এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও গুরুতর প্রভাব পড়বে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউরোপের ক্ষেত্রে। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
পূর্ব এশিয়ার দেশ তাইওয়ান। ৩৬ হাজার ১৯৭ বর্গকিলোমিটারের এ দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে তাইওয়ান। তাইওয়ান প্রণালি দেশটিকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তাইওয়ানকে নিজের ‘প্রদেশ’ হিসেবে দেখে আসছে চীন। এ কারণে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া ‘প্রদেশকে’ মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার অঙ্গীকার প্রায়ই করে থাকে দেশটি। তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন ২০১৬ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসার পর দেশটিকে নিজের আওতায় আনতে উঠেপড়ে লাগে চীন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাও অনেক বেড়ে যায়। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হংকংকে ঘিরে দেশটির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া যদি ছোট ও দুর্বল প্রতিবেশী দেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তোয়াক্কা না করে আক্রমণ চালাতে পারে, তাহলে চীনের তাইওয়ানে হামলা অনিবার্য। তাইওয়ানকে কবজা করতে চীনের সাম্প্রতিক আয়োজন বিশ্লেষকদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা মনে করছেন, চীন তাইওয়ান দখল করলে এশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে এর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে।
চীন ও তাইওয়ান
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাইওয়ানকে তিনটি দেশ শাসন করে। দেশগুলো হচ্ছে নেদারল্যান্ডস, চীন ও জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সম্মতিতে তাইওয়ানকে পরিচালনা করে চীন। যুদ্ধের পরপরই চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট আর্মি সে সময় জাতীয়তাবাদী শাসক চিয়াং কাই-শেককে মূল ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে। পরে ১৯৪৯ সালে চিয়াং কাই-শেক ও তার সরকার তাইওয়ানে পালিয়ে যান। বহু বছর তারা তাইওয়ানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যদিও নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠীর হার ২০ শতাংশের কম ছিল। চিয়াং ও তার উত্তরসূরিরা কয়েক দশক পর্যন্ত মূলত তাইওয়ানে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। ২০০০ সালে চেন শুই-বিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে প্রথম গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করে দেশটি। চেন তাইওয়ানের ক্ষমতায় বসার পর দুদেশের দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা দুশ্চিন্তায় ফেলে চীনকে।
আশির দশকের শুরুতে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নামে এক শাসনকাঠামো প্রস্তাব করে চীন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, চীনের সঙ্গে যুক্ত হলে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাবে তাইওয়ান। চীনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশটি। তবে চীনের বিনিয়োগ ও চীনাদের ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি শিথিল করে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। তাইওয়ানের সাবেক প্রেসিডেন্ট চেন শুই-বিয়ান রাজনীতি জীবনের শুরু থেকেই দেশটির স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চেন দ্বিতীয়বার অংশ নেওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী আইনপ্রণয়ন করে চীন। এতে বলা হয়, মূল ভূখণ্ড থেকে বের হেওয়ার চেষ্টা করলে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে পেইচিং।
২০১৬ সালে তাইওয়ানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন সাই ইং-ওয়েন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি চীন থেকে পুরোপুরি স্বাধীন হওয়ার পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং অনেকবার জোর দিয়ে বলেন, তাইওয়ান এক দিন না এক দিন চীনের সঙ্গে মিলিত হবে। তার এই বক্তব্যের সম্প্রতি পাল্টা জবাব দেন সাই। তিনি বলেন, হংকংয়ে চীনের সাম্প্রতিক দমনমূলক পদক্ষেপ এটাই প্রমাণ করে যে, দেশটির ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি আদৌ কার্যকর নয়। তাইওয়ানের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা দেশটির প্রেসিডেন্ট সাইয়ের ওই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। কারও দাদা ১৯৪৯ সালে মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানে এসেছেন কি না, এটি এক প্রজন্ম আগেও তাইওয়ানিজদের কাছে বড় ব্যাপার ছিল। এখন তারা চীনে চেয়ে তাইওয়ানকেই বেশি আপন মনে করে। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, দেশটির ৬৪ শতাংশের বেশি বাসিন্দা তাইওয়ানিজ, কেবল ৩ শতাংশ চাইনিজ। তাইওয়ানভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, ৭৭ শতাংশের বেশি তাইওয়ানিজ জানিয়েছেন, চীন হামলা করলে তারা লড়াই করতে প্রস্তুত। দেশের প্রতি তাইওয়ানের নাগরিকদের ভালোবাসা অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখেও দেখে না। বিশ্বের মাত্র ১৫টি রাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাইওয়ান ও চীন উভয়ের সঙ্গে কোনো দেশের সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। জাতিসংঘে তাইওয়ানের কোনো আসন নেই। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে কাজ করে না। চীনের নির্দেশে তারা তাইওয়ানের অংশীদারও হতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও দ্বীপ রাষ্ট্রটির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। শুধু তাই নয়, তাইওয়ানকে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহেরও অঙ্গীকার করেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র অনেকবার জোর দিয়ে জানায়, তাইওয়ানে চীনের যেকোনো ধরনের হামলা ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
আশঙ্কা
তাইওয়ানে চীনের হামলার আশঙ্কা ও সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক এক কমান্ডার সতর্ক করে বলেন, তাইওয়ানে দ্রুতই হামলা করবে চীন। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের একাংশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেন। ওই প্রতিবেদনে ২০৪৯ সালের মধ্যে চীন ও তাইওয়ানের পুনর্মিলনের সময়সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে সিনিয়র ফেলো রায়ান হাস বলেন, ‘তাইওয়ান-সংক্রান্ত নীতি নিয়ে চীনের ভেতরে কখনো বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায়নি। তাইওয়ান ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শিকে দেশের অভ্যন্তরে কোনো চাপে পড়তে হচ্ছে না।’ রায়ান হাস মনে করেন, তাইওয়ানে হামলা করা চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বরং তাইওয়ান প্রণালি জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে তাইওয়ানকে কর্র্তৃপক্ষকে আলোচনায় বসাতে চায় চীন।
বিশেষজ্ঞদের আরেক অংশ অবশ্য মনে করেন, ইউক্রেনে রুশ হামলা চীনের হিসাব-নিকাশে পরিবর্তন আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক মাইকেল শুম্যান সতর্ক করে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ড পেইচিংকে তাইওয়ান দখলে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে যে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তা এখন পতনের দিকে। দুনিয়াজুড়ে স্বৈরশাসকরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে চাইছে। বিশ্বব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন বা নতুন মেরুকরণের (রাশিয়া-চীন নেতৃত্বাধীন) বিষয়ে তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা নিয়েও তাদের খুব একটা চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে না। মাইকেল শুম্যানের মূল্যায়ন অবশ্য অনেকে মানতে রাজি নন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া ও চীনের সমরনীতি সম্পূর্ণ আলাদা। রাশিয়া যেখানে বারবার তার সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের বাইরে অভিযানে পাঠাচ্ছে, সেখানে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম দখলের পর চীন দেশের বাইরে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ, আক্রমণ বা দখল থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে।
ইউএসআইপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও আগের প্রেসিডেন্টরা বিভিন্ন সময়ে চীনের হামলা থেকে তাইওয়ানকে রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন। সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে চীনের নেতারা অনেকটা নিশ্চিত, আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপিত না হলেও যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ানের সম্পর্ক বেশ মজবুত। ইউক্রেনে হামলার পর একের পর এক অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়া। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের এমন কঠোর অবস্থান দেখে সাবধানে পা ফেলছে চীন। রাশিয়ার মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না দেশটি। তার ওপর চীনের অর্থনীতির গতি সম্প্রতি হ্রাস পাওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে মিলে নতুন মেরু করার চিন্তা আপাতত পেইচিংয়ের নেই। তবে এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যতই সামরিক সহায়তা পাক না কেন, আক্রমণ হলে তাইওয়ান নিজেকে বেশি দিন রক্ষা করতে পারবে না।
চার কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ওরিয়ানা মাস্ত্রো জানান, তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিতে চার ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে চীন। প্রথমত, দ্বীপ রাষ্ট্রটির সরকার, সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ করে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালাতে পারে পেইচিং। দ্বিতীয়ত, কৌশল অবরোধ। এর মাধ্যমে নৌ-অভিযান ও সাইবার হামলার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানকে পুরোপুরি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে। তৃতীয়ত, প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ও ঘাঁটিতে হামলা করা। এটি হলে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে মার্কিন সরকার, তাইওয়ানের পাশে দাঁড়ানো তখন কঠিন হয়ে পড়বে ওয়াশিংটনের। সর্বশেষ কৌশল হতে পারে জলে ও স্থলে তাইওয়ানের ওপর সরাসরি হামলা করা যেমনটা রাশিয়া ইউক্রেনে করেছে। মাস্ত্রো মনে করেন, চীনের সামরিক অবকাঠামো আধুনিক ও শক্তিশালী হওয়ায় এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রথম তিন কৌশলের পথে হাঁটলে পেইচিং সফল হবে। তবে তাইওয়ানের ওপর সর্বাত্মক হামলা চীন করবে কি না এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ানে সর্বাত্মক হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়ানোর আয়োজন থামাবে না পেইচিং। তবে দ্বীপ দেশটিতে অভিযানের চেষ্টা চীনের সেনাবাহিনীকে চাপে ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা কুড়াবে। এ বিষয়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো হারলান উলম্যান বলেন, ‘সরাসরি হামলা না করে ভিন্ন কৌশল নিতে পারে চীন। তাইওয়ান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোতে অনুপ্রবেশ করে জনসমর্থন পরিবর্তন বা প্রভাবিত করতে পারে চীন। এর ফলে রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। তখন বাধ্য হয়ে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে আপস করতে পারে তাইওয়ান। এই কৌশলের অবধারিত ফল হবে চীন-তাইওয়ান পুনর্মিলন।’
প্রভাব
চীন যদি তাইওয়ান সফলভাবে দখলে নিতে পারে, তাহলে সে চাইবেই দখল জারি রাখতে। সে ক্ষেত্রে এর প্রভাব কেবল চীন-তাইওয়ানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বব্যবস্থাতেও দখলের প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের তাইওয়ান দখলের বড় প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ওপর। তাইওয়ান বিশ্বের প্রথম সারির সেমি-কন্ডাক্টর চিপের উৎপাদক। এসব চিপ স্মার্টফোন, যানবাহন, অস্ত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক আরও নানা ধরনের পণ্যে ব্যবহার করা হয়। তাইওয়ানের চিপ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালে দেশটিকে ৬০ শতাংশের বেশি রাজস্ব এনে দেয়। মার্কিন সংস্থা এয়ার ফোর্স অফিস অব কমার্শিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যানালিসিস মনে করে, চীন তাইওয়ান দখল করলে বৈশ্বিক সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ (চীন নিজেও চিপ উৎপাদন করে) নিয়ন্ত্রণ করবে পেইচিং। এমনটা হলে মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মতো বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান ও সামরিক ঠিকাদারদের চিপ পেতে চীনের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আইন পাস করতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র চিপ উৎপাদন বাড়ালেও তাইওয়ানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কাছাকাছি পৌঁছাতে তার অনেক সময় লাগবে। চলমান সমস্যা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র চীনের মাইক্রোচিপের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এতটা নির্ভরশীলতা গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেখা যায়নি।
তাইওয়ানের ওপর চীন পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো আঞ্চলিক খেলোয়াড়রা চিন্তায় পড়বে। এশিয়ার দেশগুলো ‘অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য’ তত্ত্ব মেনে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলো চীনের উত্থানে সহযোগিতা করবে। বিনিময়ে চীন তাদের সুযোগ-সুবিধা দেবে। চীন যদি এশিয়া জুড়ে নির্বিঘ্নে একক আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে তার চাহিদা দিন দিন বাড়বে, যা জাপান ও ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। জাপানের কাছ থেকে অঞ্চল বাগানোর চেষ্টা করছে পেইচিং। আর ভারত তার উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এশিয়ার অন্য যেসব দেশ চীনের দিক থেকে সরাসরি নিরাপত্তা হুমকিতে এখনো পড়েনি, তারাও তাইওয়ান দখলে সৃষ্ট আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে পারবে না। এ ছাড়া তাইওয়ানের সঙ্গে চলমান অর্থনৈতিক সম্পর্কও তারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে।
সবশেষে চীনের দখল এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য যুগের সম্ভাব্য ইতি টানতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকাতে এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির ওপর বহু বছর ধরে নির্ভর করে আসছে মহাদেশটির কয়েকটি দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক ঘাঁটি হাতছাড়া হলে সুপারপাওয়ারের মর্যাদা খোয়ানোর ঝুঁকিতে পড়বে মার্কিন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক মাইক গালাঘের বলেন, ‘চীনের কর্র্তৃত্বমূলক পদক্ষেপের কারণে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র গণতান্ত্রিক দেশগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায়ে ব্যর্থ হয়, তবে তা তার প্রভাব ও বিশ্বাসযোগ্যতায় গুরুতর আঘাত হানবে। এর ফলে আর সুপারপাওয়ার থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র।’
শেয়ার করুন
তৃষা বড়ুয়া | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার ঘটনায় অনিরাপদ বোধ করছে শক্তিশালী দেশের পার্শ্ববর্তী ছোট দেশগুলো। প্রতিবেশী তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনতে মরিয়া চীন। তাইওয়ানে সংঘর্ষ বাধলে কেবল অর্থনীতি নয়, এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও গুরুতর প্রভাব পড়বে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউরোপের ক্ষেত্রে। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
পূর্ব এশিয়ার দেশ তাইওয়ান। ৩৬ হাজার ১৯৭ বর্গকিলোমিটারের এ দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে তাইওয়ান। তাইওয়ান প্রণালি দেশটিকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তাইওয়ানকে নিজের ‘প্রদেশ’ হিসেবে দেখে আসছে চীন। এ কারণে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া ‘প্রদেশকে’ মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার অঙ্গীকার প্রায়ই করে থাকে দেশটি। তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন ২০১৬ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসার পর দেশটিকে নিজের আওতায় আনতে উঠেপড়ে লাগে চীন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাও অনেক বেড়ে যায়। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হংকংকে ঘিরে দেশটির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া যদি ছোট ও দুর্বল প্রতিবেশী দেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তোয়াক্কা না করে আক্রমণ চালাতে পারে, তাহলে চীনের তাইওয়ানে হামলা অনিবার্য। তাইওয়ানকে কবজা করতে চীনের সাম্প্রতিক আয়োজন বিশ্লেষকদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা মনে করছেন, চীন তাইওয়ান দখল করলে এশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে এর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে।
চীন ও তাইওয়ান
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাইওয়ানকে তিনটি দেশ শাসন করে। দেশগুলো হচ্ছে নেদারল্যান্ডস, চীন ও জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সম্মতিতে তাইওয়ানকে পরিচালনা করে চীন। যুদ্ধের পরপরই চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট আর্মি সে সময় জাতীয়তাবাদী শাসক চিয়াং কাই-শেককে মূল ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে। পরে ১৯৪৯ সালে চিয়াং কাই-শেক ও তার সরকার তাইওয়ানে পালিয়ে যান। বহু বছর তারা তাইওয়ানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যদিও নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠীর হার ২০ শতাংশের কম ছিল। চিয়াং ও তার উত্তরসূরিরা কয়েক দশক পর্যন্ত মূলত তাইওয়ানে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। ২০০০ সালে চেন শুই-বিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে প্রথম গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করে দেশটি। চেন তাইওয়ানের ক্ষমতায় বসার পর দুদেশের দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা দুশ্চিন্তায় ফেলে চীনকে।
আশির দশকের শুরুতে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নামে এক শাসনকাঠামো প্রস্তাব করে চীন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, চীনের সঙ্গে যুক্ত হলে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাবে তাইওয়ান। চীনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশটি। তবে চীনের বিনিয়োগ ও চীনাদের ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি শিথিল করে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। তাইওয়ানের সাবেক প্রেসিডেন্ট চেন শুই-বিয়ান রাজনীতি জীবনের শুরু থেকেই দেশটির স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চেন দ্বিতীয়বার অংশ নেওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী আইনপ্রণয়ন করে চীন। এতে বলা হয়, মূল ভূখণ্ড থেকে বের হেওয়ার চেষ্টা করলে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে পেইচিং।
২০১৬ সালে তাইওয়ানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন সাই ইং-ওয়েন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি চীন থেকে পুরোপুরি স্বাধীন হওয়ার পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং অনেকবার জোর দিয়ে বলেন, তাইওয়ান এক দিন না এক দিন চীনের সঙ্গে মিলিত হবে। তার এই বক্তব্যের সম্প্রতি পাল্টা জবাব দেন সাই। তিনি বলেন, হংকংয়ে চীনের সাম্প্রতিক দমনমূলক পদক্ষেপ এটাই প্রমাণ করে যে, দেশটির ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি আদৌ কার্যকর নয়। তাইওয়ানের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা দেশটির প্রেসিডেন্ট সাইয়ের ওই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। কারও দাদা ১৯৪৯ সালে মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানে এসেছেন কি না, এটি এক প্রজন্ম আগেও তাইওয়ানিজদের কাছে বড় ব্যাপার ছিল। এখন তারা চীনে চেয়ে তাইওয়ানকেই বেশি আপন মনে করে। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, দেশটির ৬৪ শতাংশের বেশি বাসিন্দা তাইওয়ানিজ, কেবল ৩ শতাংশ চাইনিজ। তাইওয়ানভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, ৭৭ শতাংশের বেশি তাইওয়ানিজ জানিয়েছেন, চীন হামলা করলে তারা লড়াই করতে প্রস্তুত। দেশের প্রতি তাইওয়ানের নাগরিকদের ভালোবাসা অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখেও দেখে না। বিশ্বের মাত্র ১৫টি রাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাইওয়ান ও চীন উভয়ের সঙ্গে কোনো দেশের সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। জাতিসংঘে তাইওয়ানের কোনো আসন নেই। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে কাজ করে না। চীনের নির্দেশে তারা তাইওয়ানের অংশীদারও হতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও দ্বীপ রাষ্ট্রটির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। শুধু তাই নয়, তাইওয়ানকে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহেরও অঙ্গীকার করেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র অনেকবার জোর দিয়ে জানায়, তাইওয়ানে চীনের যেকোনো ধরনের হামলা ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
আশঙ্কা
তাইওয়ানে চীনের হামলার আশঙ্কা ও সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক এক কমান্ডার সতর্ক করে বলেন, তাইওয়ানে দ্রুতই হামলা করবে চীন। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের একাংশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেন। ওই প্রতিবেদনে ২০৪৯ সালের মধ্যে চীন ও তাইওয়ানের পুনর্মিলনের সময়সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে সিনিয়র ফেলো রায়ান হাস বলেন, ‘তাইওয়ান-সংক্রান্ত নীতি নিয়ে চীনের ভেতরে কখনো বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায়নি। তাইওয়ান ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শিকে দেশের অভ্যন্তরে কোনো চাপে পড়তে হচ্ছে না।’ রায়ান হাস মনে করেন, তাইওয়ানে হামলা করা চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বরং তাইওয়ান প্রণালি জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে তাইওয়ানকে কর্র্তৃপক্ষকে আলোচনায় বসাতে চায় চীন।
বিশেষজ্ঞদের আরেক অংশ অবশ্য মনে করেন, ইউক্রেনে রুশ হামলা চীনের হিসাব-নিকাশে পরিবর্তন আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক মাইকেল শুম্যান সতর্ক করে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ড পেইচিংকে তাইওয়ান দখলে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে যে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তা এখন পতনের দিকে। দুনিয়াজুড়ে স্বৈরশাসকরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে চাইছে। বিশ্বব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন বা নতুন মেরুকরণের (রাশিয়া-চীন নেতৃত্বাধীন) বিষয়ে তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা নিয়েও তাদের খুব একটা চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে না। মাইকেল শুম্যানের মূল্যায়ন অবশ্য অনেকে মানতে রাজি নন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া ও চীনের সমরনীতি সম্পূর্ণ আলাদা। রাশিয়া যেখানে বারবার তার সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের বাইরে অভিযানে পাঠাচ্ছে, সেখানে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম দখলের পর চীন দেশের বাইরে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ, আক্রমণ বা দখল থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে।
ইউএসআইপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও আগের প্রেসিডেন্টরা বিভিন্ন সময়ে চীনের হামলা থেকে তাইওয়ানকে রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন। সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে চীনের নেতারা অনেকটা নিশ্চিত, আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপিত না হলেও যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ানের সম্পর্ক বেশ মজবুত। ইউক্রেনে হামলার পর একের পর এক অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়া। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের এমন কঠোর অবস্থান দেখে সাবধানে পা ফেলছে চীন। রাশিয়ার মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না দেশটি। তার ওপর চীনের অর্থনীতির গতি সম্প্রতি হ্রাস পাওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে মিলে নতুন মেরু করার চিন্তা আপাতত পেইচিংয়ের নেই। তবে এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যতই সামরিক সহায়তা পাক না কেন, আক্রমণ হলে তাইওয়ান নিজেকে বেশি দিন রক্ষা করতে পারবে না।
চার কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ওরিয়ানা মাস্ত্রো জানান, তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিতে চার ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে চীন। প্রথমত, দ্বীপ রাষ্ট্রটির সরকার, সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ করে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালাতে পারে পেইচিং। দ্বিতীয়ত, কৌশল অবরোধ। এর মাধ্যমে নৌ-অভিযান ও সাইবার হামলার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানকে পুরোপুরি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে। তৃতীয়ত, প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ও ঘাঁটিতে হামলা করা। এটি হলে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে মার্কিন সরকার, তাইওয়ানের পাশে দাঁড়ানো তখন কঠিন হয়ে পড়বে ওয়াশিংটনের। সর্বশেষ কৌশল হতে পারে জলে ও স্থলে তাইওয়ানের ওপর সরাসরি হামলা করা যেমনটা রাশিয়া ইউক্রেনে করেছে। মাস্ত্রো মনে করেন, চীনের সামরিক অবকাঠামো আধুনিক ও শক্তিশালী হওয়ায় এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রথম তিন কৌশলের পথে হাঁটলে পেইচিং সফল হবে। তবে তাইওয়ানের ওপর সর্বাত্মক হামলা চীন করবে কি না এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ানে সর্বাত্মক হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়ানোর আয়োজন থামাবে না পেইচিং। তবে দ্বীপ দেশটিতে অভিযানের চেষ্টা চীনের সেনাবাহিনীকে চাপে ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা কুড়াবে। এ বিষয়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো হারলান উলম্যান বলেন, ‘সরাসরি হামলা না করে ভিন্ন কৌশল নিতে পারে চীন। তাইওয়ান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোতে অনুপ্রবেশ করে জনসমর্থন পরিবর্তন বা প্রভাবিত করতে পারে চীন। এর ফলে রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। তখন বাধ্য হয়ে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে আপস করতে পারে তাইওয়ান। এই কৌশলের অবধারিত ফল হবে চীন-তাইওয়ান পুনর্মিলন।’
প্রভাব
চীন যদি তাইওয়ান সফলভাবে দখলে নিতে পারে, তাহলে সে চাইবেই দখল জারি রাখতে। সে ক্ষেত্রে এর প্রভাব কেবল চীন-তাইওয়ানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বব্যবস্থাতেও দখলের প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের তাইওয়ান দখলের বড় প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ওপর। তাইওয়ান বিশ্বের প্রথম সারির সেমি-কন্ডাক্টর চিপের উৎপাদক। এসব চিপ স্মার্টফোন, যানবাহন, অস্ত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক আরও নানা ধরনের পণ্যে ব্যবহার করা হয়। তাইওয়ানের চিপ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালে দেশটিকে ৬০ শতাংশের বেশি রাজস্ব এনে দেয়। মার্কিন সংস্থা এয়ার ফোর্স অফিস অব কমার্শিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যানালিসিস মনে করে, চীন তাইওয়ান দখল করলে বৈশ্বিক সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ (চীন নিজেও চিপ উৎপাদন করে) নিয়ন্ত্রণ করবে পেইচিং। এমনটা হলে মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মতো বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান ও সামরিক ঠিকাদারদের চিপ পেতে চীনের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আইন পাস করতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র চিপ উৎপাদন বাড়ালেও তাইওয়ানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কাছাকাছি পৌঁছাতে তার অনেক সময় লাগবে। চলমান সমস্যা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র চীনের মাইক্রোচিপের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এতটা নির্ভরশীলতা গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেখা যায়নি।
তাইওয়ানের ওপর চীন পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো আঞ্চলিক খেলোয়াড়রা চিন্তায় পড়বে। এশিয়ার দেশগুলো ‘অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য’ তত্ত্ব মেনে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলো চীনের উত্থানে সহযোগিতা করবে। বিনিময়ে চীন তাদের সুযোগ-সুবিধা দেবে। চীন যদি এশিয়া জুড়ে নির্বিঘ্নে একক আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে তার চাহিদা দিন দিন বাড়বে, যা জাপান ও ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। জাপানের কাছ থেকে অঞ্চল বাগানোর চেষ্টা করছে পেইচিং। আর ভারত তার উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এশিয়ার অন্য যেসব দেশ চীনের দিক থেকে সরাসরি নিরাপত্তা হুমকিতে এখনো পড়েনি, তারাও তাইওয়ান দখলে সৃষ্ট আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে পারবে না। এ ছাড়া তাইওয়ানের সঙ্গে চলমান অর্থনৈতিক সম্পর্কও তারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে।
সবশেষে চীনের দখল এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য যুগের সম্ভাব্য ইতি টানতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকাতে এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির ওপর বহু বছর ধরে নির্ভর করে আসছে মহাদেশটির কয়েকটি দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক ঘাঁটি হাতছাড়া হলে সুপারপাওয়ারের মর্যাদা খোয়ানোর ঝুঁকিতে পড়বে মার্কিন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক মাইক গালাঘের বলেন, ‘চীনের কর্র্তৃত্বমূলক পদক্ষেপের কারণে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র গণতান্ত্রিক দেশগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায়ে ব্যর্থ হয়, তবে তা তার প্রভাব ও বিশ্বাসযোগ্যতায় গুরুতর আঘাত হানবে। এর ফলে আর সুপারপাওয়ার থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র।’