আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার উড়ন্ত জাদুঘর
নাসরিন শওকত | ১ জুন, ২০২২ ০০:০০
ডিয়েগো ম্যারাডোনা স্মরণে আর্জেন্টিনায় তৈরি হলো একটি বিশেষ বিমান। যেখানে এই কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাখা হয়েছে তার স্মৃতিবিজড়িত এক সংগ্রহশালা। গত ২৫ মে ভালোবাসার ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করে উন্মুক্ত করা হয়েছে এই উড়ন্ত জাদুঘর। লিখেছেন নাসরিন শওকত
শ্রদ্ধাঞ্জলি
ফুটবলের মাঠে উল্কার গতিতে ছুটে চলা ফুটবলের জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনা পায়ের নিপুণ কারুকাজে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন পুরো বিশ্বকে। ২০২০ এর ২৫ নভেম্বরে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এবার আর্জেন্টিনার একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই বিশেষ বিমানটি তৈরি করেছে। ফুটবলের রাজপুত্র ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই বিমান তৈরি করেছে তারা। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্যাঙ্গো ডি১০এস’ (Tango D10S)। ম্যারাডোনাকে স্মরণে ১০ আসনের বিমানটি মূলত একটি উড়ন্ত সংগ্রহশালা বা জাদুঘর। বিমানের বাইরের গায়ে ম্যারাডোনার অমূল্য ছবি ও ভেতরে তার স্মৃতিবিজড়িত এক সংগ্রহশালা রয়েছে। এই জাদুঘরের ভেতরে হলোগ্রাফিক ম্যারাডোনাকে উপস্থিত করে তার ভক্তদের জন্য বিশেষ চমকের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে । ট্যাঙ্গো ডি১০এস আগামী জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। এ সময় আর্জেন্টিনার বিভিন্ন প্রদেশ ও বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে ঘুরে প্রয়াত ম্যারাডোনার ভক্তদের বার্তা ও সই সংগ্রহ করবে। এরপর নভেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠেয় ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে যোগ দেবে এই জাদুঘর। আর্জেন্টিনার জাতীয় দিবসে এই জাদুঘর উদ্বোধন করে ফুটবলের এই কিংবদন্তিকে বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করেছে আর্জেন্টিনা।
ট্যাঙ্গো ডি১০এস
এখন থেকে ছবি ও স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে সাজানো এই জাদুঘরে কিংবদন্তি ম্যারাডোনাকে ভ্রমণ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে পারবেন তার অগণিত ভক্ত। প্রয়াত ম্যারাডোনাকে স্মরণ করে বুয়েনস আয়ার্সে উদ্বোধন করা হয়েছে উড়ন্ত জাদুঘরটি । গত ২৫ মে এল পালোমার মরন বিমানবন্দরে ‘ট্যাঙ্গো ডি১০এস’ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এসময় সাবেক লেফটব্যাক হুয়ান পাবলো সোরিন এবং সংবাদকর্মী ও মডেল অগাস্তিনা কাসানোভা অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন। আর্জেন্টিনার খ্যাতিমান গায়ক ও গীতিকার হুয়ান সেবাস্তিয়ান গুতিরেজ ম্যারাডোনাকে নিয়ে লেখা ‘ফরেভার ডিয়েগো’ গান গেয়েছেন। আর্জেন্টিনার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গিভ অ্যান্ড গেট এই বিশেষ মডেলের বিমানটি তৈরি করেছে। প্লাস্টিক ভাস্কর ম্যাক্সিমিলিয়ানো ব্যাগনাস্কো বিমানটির পুরো নকশা এঁকেছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্যাসটন কোলকার জানান, প্রাথমিকভাবে বিমানটি আর্জেন্টিনার ভেতরে ব্যক্তিগত ফ্লাইট চালু রাখবে। এরপর এটি মেক্সিকো, নেপলস, দুবাই হয়ে ম্যারাডোনার জীবনঘনিষ্ঠ সব স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। ট্যাঙ্গো ডি১০এস আগামী ২০২২ ফুটবল বিশ^কাপে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
উদ্বোধনের পর আর্জেন্টিনায় উড়াল দেওয়ার আগে জাদুঘরটি প্রথমবারের মতো ম্যারাডোনার ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এসময় তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সহায়তায় (হলোগ্রাফিক) ম্যারাডোনাকে অডিও ও ভিডিওতে আগে থেকে তৈরি কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পান। এ ভ্রমণ শ্রদ্ধাঞ্জলি শুরু হলে বিমান ভ্রমণের সময় তার ভক্ত যাত্রীরা অডিও ও ভিডিওতে প্রিয় খেলোয়াড়কে নানা প্রশ্ন করতে পারবেন। সেসব প্রশ্নের জবাবও দেবেন ম্যারাডোনা।
পুরো বিমানজুড়ে ম্যারাডোনার স্মরণীয় বেশ কিছু ছবি রয়েছে। বিমানের বাইরের অংশে জার্সি পরা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চুম্বনরত ম্যারাডোনাকে দেখা যায়। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করে। তবে ১৯৯০ সালে তার দল ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরেও যায়।
বিমানটির দুটি ডানায় ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনার করা দুটি গোলের ছবি আঁকা রয়েছে। এর মধ্যে বাঁ-দিকের ডানায় রয়েছে ম্যারাডোনার হাতে থাকা ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের মুহূর্ত ও সইয়ের ছাপসহ ছবি। বিমানের লেজের অংশে রয়েছে ম্যারাডোনার মুখের ছবি।
ম্যারাডোনার পরিবারের সদস্য, ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনার সাবেক খেলোয়াড় ও তার ভক্তদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। ম্যারাডোনার দুই মেয়ে ডালমা ও জিয়ানিন্না ম্যারাডোনা বিমানটিতে প্রথম প্রবেশ করেন। বাবার এমন মর্যাদাপূর্ণ স্মরণে অভিভূত ডালমা ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘আমরা এমন পাগলামিকে সত্যিই বুঝে উঠতে বা বিশ্বাস করতে পারছি না। তার (ম্যারাডোনার) প্রতি এদেশের মানুষের ভালোবাসা কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ সে সময় ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ খেলোয়াড় সার্জিও বাতিস্তা বলেন, ‘আপনি যখন আর্জেন্টিনায় থাকবেন, তখন বাকি বিশে^র জন্য ডিয়েগো কী অর্থ বহন করে তা উপলব্ধিই করতে পারবেন না। এ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর মধ্য পুরো বিশ^ এক সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।’
১০ আসনের উড়ন্ত জাদুঘরটির ভেতরে ম্যারাডোনার প্রাণপ্রিয় হালকা নীল ও সাদা রঙের আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে তার ব্যবহার করা জার্সি ও বুট। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ইনফোবে’ জানিয়েছে, বিমানে ভ্রমণকারীরা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন। তারা ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবনের জার্সি ও বুট দেখার সুযোগ যেমন পাবেন, তেমনি কিংবদন্তির জন্য তাদের ব্যক্তিগত বার্তাও রেকর্ড করে রেখে আসতে পারবেন। ওই বার্তা ‘স্বর্গে থাকা’ ম্যারাডোনার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে গিভ অ্যান্ড গেট।
চূড়ান্ত গন্তব্য
গিভ অ্যান্ড গেট-এর প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী জুলাইয়ে ট্যাঙ্গো ডি১০এস উড়াল দেওয়ার পর আর্জেন্টিার বিভিন্ন শহর ঘুরে তার ভক্ত-অনুরাগীর শ্রদ্ধা সংগ্রহ করবে। এরপর বার্সেলোনা ও নেপলসও ভ্রমণ করবে। তারপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে কাতারে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ পৌঁছে যাবে। এর আগে ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো এ ভ্রমণে বিমানটি বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে তার ভক্ত যাত্রীদের সই সংগ্রহ করবে। সবশেষে কোনো সংস্থার কাছে বিমানটি নিলামে তুলবে গিভ অ্যান্ড গেট । এ শ্রদ্ধাঞ্জলি কর্মসূচি নিয়ে গিভ অ্যান্ড গেট-এর প্রধান কর্মকর্তা গ্যাসটন কোলকার বলেছেন, ‘আমি ম্যারাডোনার পাগল এক ভক্ত। এমন একজন মানুষ যে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ম্যারাডোনার ভিডিও দেখে। ম্যারাডোনা চলে যাওয়ার পর এটাই প্রথম বিশ্বকাপ হতে চলেছে। হয়তো লিওনেল মেসিরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। তাই ডিয়েগোর জন্যই আমি এই বিমানটি তৈরি করলাম। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপজয়ী দলের সতীর্থরা এই বিমান দেখে চমকে গিয়েছেন। এটি আর্জেন্টিনার বিভিন্ন শহরে ঘুরবে। কাতার বিশ্বকাপের আলাদা করে ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধাও জানানো হবে।’
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। তার বাবা ডিয়েগো ম্যারাডোনা কারখানার একজন শ্রমিক ছিলেন। তিনি স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত ও আর্জেন্টিনার গুয়ারানি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য। মা ডালমা সালভাদোরা ফ্রাঙ্কো ইতালীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। আর্জেন্টিনার করিয়েন্তেস প্রদেশ থেকে দরিদ্র এই পরিবারটি লানুসের পলিক্লিনিকো প্রদেশে আসে। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ভিলা ফিওরিটোতে বেড়ে ওঠেন। ম্যারাডোনা আট ভাইবোনের পরিবারের প্রথম সন্তান ছিলেন। ডিয়াগো ম্যারাডোনাকে ১৯৮০’র দশকে আর্জেন্টিনার শীর্ষ ফুটবলার ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে গণ্য করা হয়।
বুয়েনস আয়ার্সের শহরতলি বা রাস্তায় কাগজের বল নাচানো ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোর কখন যে গোটা বিশে্ব ফুটবলের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তা রীতিমতো এক বিস্ময়। গোঁড়া ক্যাথলিক বাবা ও মা ইসকুনিয়া প্রদেশে স্থায়ীভাবে বাস করতেন। ১৯৫০ সালে তারা ইসকুনিয়া ছেড়ে বুয়েনস আয়ার্সে চলে আসেন। বাবা লানুসের এক রাসায়নিক কারখানায় কাজ করতেন। পরিবারে অভাব সত্ত্বেও ৮ বছরের ছোট্ট ম্যারাডোনা ফুটবলে অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়েছিলেন। ফুটবল স্কাউটদের নজরে পড়েন দ্রুতই। ম্যারাডোনার বয়স তখন ১৪। বুয়েনস আয়ার্সের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স তাকে সই করায়। ১৯৭৬ সালে প্রথম ডিভিশন লিগে তার অভিষেক ঘটে। ১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার সামনে এ ক্লাবের সিনিয়র দলের দরজা খুলে যায়। সিনিয়র দলে ডিয়েগোর প্রথম মৌসুম। সেবারেই স্থানীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ক্লাব। সে-সময় তাকে ‘ফিওরিতো’ (ফুলের মতো সুন্দর) নামে ডাকা শুরু হয়। তবে বয়স কম হওয়ার কারণে ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ^কাপ দল থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭। দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন ম্যারাডোনা। নীল-সাদা জার্সি ‘অ্যালবিসেলেস্তে’-এর হয়ে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে অভিষেক খেলেন ম্যারাডোনা। ১৬ বছর বয়সে ৫-১ গোলে সেই খেলায় জয় পায় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনায় পরের বছর বিশ্বকাপের আসর বসল। কিন্তু জাতীয় কোচ লুই মেনত্তি অভিজ্ঞতা কম থাকার অজুহাতে তাকে দল থেকে বাদ দেন। নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করেছিল আর্জেন্টিনা। অনূর্ধ -২০ দলের সেই খেলায় স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জয় পায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন ম্যারাডানা।
ফুটবলের ছয় দশক
বিশ^ ফুটবলের সর্বসেরা খেলোয়াড় ব্রাজিলের পেলের পর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ম্যারাডোনাকে গণ্য করা হয়। তিনি ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে পেশাদার খেলা শুরু করেন। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব বিশ দলের হয়ে খেলে প্রথমবার ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপ জয় করেন। তার অধিনায়কত্বে ১৯৮৬’র ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোর এ বিশ^কাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনা তার ‘হ্যান্ড অব গড’ কিংবদন্তি গোলটি দেন। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ সালে ইতালির বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা দলকে নেতৃত্ব দেন ম্যারাডোনা। ওই খেলায় পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ১৯৯১ সালে তার শরীরে মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়লে তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনা আবার আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব করেন। তবে সে সময় অবৈধ মাদক পরীক্ষায় হেরে গিয়ে তাকে আর্জেন্টিনা ফিরে যেতে হয়। ১৯৯৭ সালে ৩৭তম জন্মদিনে ম্যারাডোনা পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন। সে-সময় তিনি আর্জেন্টিনার বড় দল বোকা জুনিয়র্সে খেলছিলেন। ম্যারাডোনা ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচ নিযুক্ত হন। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা জার্মানির কাছে হেরে যায়। এরপরে তিনি কোচের পদ থেকে অবসর নেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বিশ^ ফুটবলের এই কিংবদন্তি।
১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পান ফুটবলের জাদুকর ম্যারাডোনা। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে ধৈর্য্য হারিয়ে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। সেই খেলায় ৩-১ গোলে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যায় আর্জেন্টিনাও। কিন্তু ততদিনে ম্যারাডোনার দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল গ-ি পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছে গিয়েছে। সে সময় প্রায় ১১ লাখ পাউন্ডে তাকে সই করিয়েছিল বার্সেলোনা। ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজার সেই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস মেনত্তি।
যত রেকর্ড
বিশ্ব ফুটবলের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন হলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পেশাগত ফুটবল জীবনে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেছেন। দলের অধিনায়ক হিসেবে আর্জেন্টিনাকে তিনি দুই বার বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান। তিনি ৪টি বিশ্বকাপ ম্যাচে খেলেছেন। ম্যারাডোনা বার্সেলোনা ও নাপোলির মতো ক্লাবেও খেলেছেন। নাপোলির হয়ে ২টি ইতালীয় লিগ সিরি’আ ট্রফি জিতেছেন। ২০০০ সালে ফিফার শতাব্দী সেরা খেলোয়াড় খেতাব অর্জন করেন।১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার করা বিশেষ গোলের সুবাদে ২-১ গোলে সেই খেলা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ওই বিখ্যাত দুটি গোল ‘হ্যান্ড অব গড’ (Hand of God) ও গোল অব দ্য সেঞ্চুরি (Goal of the Century) নামে পরিচিত। ফুটবলের এই রাজপুত্র যে জার্সি পরে ওই ঐতিহাসিক গোল করেছিলেন সেটি অনলাইন নিলামে বিক্রি হয়েছে রেকর্ড ৭১ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ পাউন্ডে। বাংলাদেশের মূল্যে যা ৭৭ কোটি ৪৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭২ টাকা।
মৃত্যু
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর সেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিশ্ব ফুটবলের নক্ষত্র ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তার মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি চিকিৎসকদের অবহেলায় হত্যা এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। তার মেয়েরা অভিযোগ করেছিলেন, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসকদের অবহেলা ছিল। তদন্ত শেষে ম্যারাডোনার চিকিৎসকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আর্জেন্টিনার চিকিৎসক নেলসন কাস্ত্রো দাবি করেছেন, হৃৎপিন্ড ছাড়াই নাকি সমাহিত করা হয়েছে ম্যারাডোনাকে। ক্যারিয়ারের একটা বড় সময়জুড়ে মাদক সংক্রান্ত বিতর্ক ও ভগ্নস্বাস্থ্য ম্যারাডোনাকে তাড়া করে ফেরে।
১৯৮৬ সালে মাঠে মার খেতে খেতে যিনি একাই বিশ^কাপ জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। ম্যারাডোনা ইতালির নাপোলিকে ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব করে গড়ে তুলেছিলেন। খেটে খাওয়া সংগ্রামী মানুষের ত্রাণকর্তা ভাবা হতো তাকে। মারা যাওয়ার পর থেকেই ফুটবলের এই অমর জাদুকরের প্রতি বিশ্বের নানা প্রান্তে শ্রদ্ধা জানানো অব্যাহত রয়েছে। আর্জেন্টিনায় আদরের ‘পেলুসা’ তিনি। মেক্সিকোয় রোসারিওর ভক্তরা তাকে ঈশ^ররূপে বরণ করে ‘ইগেলেসিয়া ম্যারাডোনিয়া’ নামে গির্জা খুলেছে। ম্যারাডোনা ইতালির ক্লাব নাপোলিকে বিশ্বমানের দলে পরিণত করেছিলেন। নেপলসবাসীর কাছে তাই তিনি ‘ঈশ্বরতুল্য’ মর্যাদা পান ফটবলের এই বরপুত্র।
শেয়ার করুন
নাসরিন শওকত | ১ জুন, ২০২২ ০০:০০

ডিয়েগো ম্যারাডোনা স্মরণে আর্জেন্টিনায় তৈরি হলো একটি বিশেষ বিমান। যেখানে এই কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাখা হয়েছে তার স্মৃতিবিজড়িত এক সংগ্রহশালা। গত ২৫ মে ভালোবাসার ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করে উন্মুক্ত করা হয়েছে এই উড়ন্ত জাদুঘর। লিখেছেন নাসরিন শওকত
শ্রদ্ধাঞ্জলি
ফুটবলের মাঠে উল্কার গতিতে ছুটে চলা ফুটবলের জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনা পায়ের নিপুণ কারুকাজে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন পুরো বিশ্বকে। ২০২০ এর ২৫ নভেম্বরে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এবার আর্জেন্টিনার একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই বিশেষ বিমানটি তৈরি করেছে। ফুটবলের রাজপুত্র ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই বিমান তৈরি করেছে তারা। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্যাঙ্গো ডি১০এস’ (Tango D10S)। ম্যারাডোনাকে স্মরণে ১০ আসনের বিমানটি মূলত একটি উড়ন্ত সংগ্রহশালা বা জাদুঘর। বিমানের বাইরের গায়ে ম্যারাডোনার অমূল্য ছবি ও ভেতরে তার স্মৃতিবিজড়িত এক সংগ্রহশালা রয়েছে। এই জাদুঘরের ভেতরে হলোগ্রাফিক ম্যারাডোনাকে উপস্থিত করে তার ভক্তদের জন্য বিশেষ চমকের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে । ট্যাঙ্গো ডি১০এস আগামী জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। এ সময় আর্জেন্টিনার বিভিন্ন প্রদেশ ও বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে ঘুরে প্রয়াত ম্যারাডোনার ভক্তদের বার্তা ও সই সংগ্রহ করবে। এরপর নভেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠেয় ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে যোগ দেবে এই জাদুঘর। আর্জেন্টিনার জাতীয় দিবসে এই জাদুঘর উদ্বোধন করে ফুটবলের এই কিংবদন্তিকে বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করেছে আর্জেন্টিনা।
ট্যাঙ্গো ডি১০এস
এখন থেকে ছবি ও স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে সাজানো এই জাদুঘরে কিংবদন্তি ম্যারাডোনাকে ভ্রমণ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে পারবেন তার অগণিত ভক্ত। প্রয়াত ম্যারাডোনাকে স্মরণ করে বুয়েনস আয়ার্সে উদ্বোধন করা হয়েছে উড়ন্ত জাদুঘরটি । গত ২৫ মে এল পালোমার মরন বিমানবন্দরে ‘ট্যাঙ্গো ডি১০এস’ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এসময় সাবেক লেফটব্যাক হুয়ান পাবলো সোরিন এবং সংবাদকর্মী ও মডেল অগাস্তিনা কাসানোভা অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন। আর্জেন্টিনার খ্যাতিমান গায়ক ও গীতিকার হুয়ান সেবাস্তিয়ান গুতিরেজ ম্যারাডোনাকে নিয়ে লেখা ‘ফরেভার ডিয়েগো’ গান গেয়েছেন। আর্জেন্টিনার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গিভ অ্যান্ড গেট এই বিশেষ মডেলের বিমানটি তৈরি করেছে। প্লাস্টিক ভাস্কর ম্যাক্সিমিলিয়ানো ব্যাগনাস্কো বিমানটির পুরো নকশা এঁকেছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্যাসটন কোলকার জানান, প্রাথমিকভাবে বিমানটি আর্জেন্টিনার ভেতরে ব্যক্তিগত ফ্লাইট চালু রাখবে। এরপর এটি মেক্সিকো, নেপলস, দুবাই হয়ে ম্যারাডোনার জীবনঘনিষ্ঠ সব স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। ট্যাঙ্গো ডি১০এস আগামী ২০২২ ফুটবল বিশ^কাপে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
উদ্বোধনের পর আর্জেন্টিনায় উড়াল দেওয়ার আগে জাদুঘরটি প্রথমবারের মতো ম্যারাডোনার ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এসময় তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সহায়তায় (হলোগ্রাফিক) ম্যারাডোনাকে অডিও ও ভিডিওতে আগে থেকে তৈরি কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পান। এ ভ্রমণ শ্রদ্ধাঞ্জলি শুরু হলে বিমান ভ্রমণের সময় তার ভক্ত যাত্রীরা অডিও ও ভিডিওতে প্রিয় খেলোয়াড়কে নানা প্রশ্ন করতে পারবেন। সেসব প্রশ্নের জবাবও দেবেন ম্যারাডোনা।
পুরো বিমানজুড়ে ম্যারাডোনার স্মরণীয় বেশ কিছু ছবি রয়েছে। বিমানের বাইরের অংশে জার্সি পরা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চুম্বনরত ম্যারাডোনাকে দেখা যায়। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করে। তবে ১৯৯০ সালে তার দল ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরেও যায়।
বিমানটির দুটি ডানায় ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনার করা দুটি গোলের ছবি আঁকা রয়েছে। এর মধ্যে বাঁ-দিকের ডানায় রয়েছে ম্যারাডোনার হাতে থাকা ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের মুহূর্ত ও সইয়ের ছাপসহ ছবি। বিমানের লেজের অংশে রয়েছে ম্যারাডোনার মুখের ছবি।
ম্যারাডোনার পরিবারের সদস্য, ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনার সাবেক খেলোয়াড় ও তার ভক্তদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। ম্যারাডোনার দুই মেয়ে ডালমা ও জিয়ানিন্না ম্যারাডোনা বিমানটিতে প্রথম প্রবেশ করেন। বাবার এমন মর্যাদাপূর্ণ স্মরণে অভিভূত ডালমা ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘আমরা এমন পাগলামিকে সত্যিই বুঝে উঠতে বা বিশ্বাস করতে পারছি না। তার (ম্যারাডোনার) প্রতি এদেশের মানুষের ভালোবাসা কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ সে সময় ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ খেলোয়াড় সার্জিও বাতিস্তা বলেন, ‘আপনি যখন আর্জেন্টিনায় থাকবেন, তখন বাকি বিশে^র জন্য ডিয়েগো কী অর্থ বহন করে তা উপলব্ধিই করতে পারবেন না। এ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর মধ্য পুরো বিশ^ এক সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।’
১০ আসনের উড়ন্ত জাদুঘরটির ভেতরে ম্যারাডোনার প্রাণপ্রিয় হালকা নীল ও সাদা রঙের আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে তার ব্যবহার করা জার্সি ও বুট। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ইনফোবে’ জানিয়েছে, বিমানে ভ্রমণকারীরা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন। তারা ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবনের জার্সি ও বুট দেখার সুযোগ যেমন পাবেন, তেমনি কিংবদন্তির জন্য তাদের ব্যক্তিগত বার্তাও রেকর্ড করে রেখে আসতে পারবেন। ওই বার্তা ‘স্বর্গে থাকা’ ম্যারাডোনার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে গিভ অ্যান্ড গেট।
চূড়ান্ত গন্তব্য
গিভ অ্যান্ড গেট-এর প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী জুলাইয়ে ট্যাঙ্গো ডি১০এস উড়াল দেওয়ার পর আর্জেন্টিার বিভিন্ন শহর ঘুরে তার ভক্ত-অনুরাগীর শ্রদ্ধা সংগ্রহ করবে। এরপর বার্সেলোনা ও নেপলসও ভ্রমণ করবে। তারপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে কাতারে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ পৌঁছে যাবে। এর আগে ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো এ ভ্রমণে বিমানটি বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে তার ভক্ত যাত্রীদের সই সংগ্রহ করবে। সবশেষে কোনো সংস্থার কাছে বিমানটি নিলামে তুলবে গিভ অ্যান্ড গেট । এ শ্রদ্ধাঞ্জলি কর্মসূচি নিয়ে গিভ অ্যান্ড গেট-এর প্রধান কর্মকর্তা গ্যাসটন কোলকার বলেছেন, ‘আমি ম্যারাডোনার পাগল এক ভক্ত। এমন একজন মানুষ যে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ম্যারাডোনার ভিডিও দেখে। ম্যারাডোনা চলে যাওয়ার পর এটাই প্রথম বিশ্বকাপ হতে চলেছে। হয়তো লিওনেল মেসিরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। তাই ডিয়েগোর জন্যই আমি এই বিমানটি তৈরি করলাম। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপজয়ী দলের সতীর্থরা এই বিমান দেখে চমকে গিয়েছেন। এটি আর্জেন্টিনার বিভিন্ন শহরে ঘুরবে। কাতার বিশ্বকাপের আলাদা করে ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধাও জানানো হবে।’
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। তার বাবা ডিয়েগো ম্যারাডোনা কারখানার একজন শ্রমিক ছিলেন। তিনি স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত ও আর্জেন্টিনার গুয়ারানি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য। মা ডালমা সালভাদোরা ফ্রাঙ্কো ইতালীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। আর্জেন্টিনার করিয়েন্তেস প্রদেশ থেকে দরিদ্র এই পরিবারটি লানুসের পলিক্লিনিকো প্রদেশে আসে। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ভিলা ফিওরিটোতে বেড়ে ওঠেন। ম্যারাডোনা আট ভাইবোনের পরিবারের প্রথম সন্তান ছিলেন। ডিয়াগো ম্যারাডোনাকে ১৯৮০’র দশকে আর্জেন্টিনার শীর্ষ ফুটবলার ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে গণ্য করা হয়।
বুয়েনস আয়ার্সের শহরতলি বা রাস্তায় কাগজের বল নাচানো ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোর কখন যে গোটা বিশে্ব ফুটবলের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তা রীতিমতো এক বিস্ময়। গোঁড়া ক্যাথলিক বাবা ও মা ইসকুনিয়া প্রদেশে স্থায়ীভাবে বাস করতেন। ১৯৫০ সালে তারা ইসকুনিয়া ছেড়ে বুয়েনস আয়ার্সে চলে আসেন। বাবা লানুসের এক রাসায়নিক কারখানায় কাজ করতেন। পরিবারে অভাব সত্ত্বেও ৮ বছরের ছোট্ট ম্যারাডোনা ফুটবলে অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়েছিলেন। ফুটবল স্কাউটদের নজরে পড়েন দ্রুতই। ম্যারাডোনার বয়স তখন ১৪। বুয়েনস আয়ার্সের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স তাকে সই করায়। ১৯৭৬ সালে প্রথম ডিভিশন লিগে তার অভিষেক ঘটে। ১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার সামনে এ ক্লাবের সিনিয়র দলের দরজা খুলে যায়। সিনিয়র দলে ডিয়েগোর প্রথম মৌসুম। সেবারেই স্থানীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ক্লাব। সে-সময় তাকে ‘ফিওরিতো’ (ফুলের মতো সুন্দর) নামে ডাকা শুরু হয়। তবে বয়স কম হওয়ার কারণে ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ^কাপ দল থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭। দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন ম্যারাডোনা। নীল-সাদা জার্সি ‘অ্যালবিসেলেস্তে’-এর হয়ে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে অভিষেক খেলেন ম্যারাডোনা। ১৬ বছর বয়সে ৫-১ গোলে সেই খেলায় জয় পায় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনায় পরের বছর বিশ্বকাপের আসর বসল। কিন্তু জাতীয় কোচ লুই মেনত্তি অভিজ্ঞতা কম থাকার অজুহাতে তাকে দল থেকে বাদ দেন। নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করেছিল আর্জেন্টিনা। অনূর্ধ -২০ দলের সেই খেলায় স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জয় পায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন ম্যারাডানা।
ফুটবলের ছয় দশক
বিশ^ ফুটবলের সর্বসেরা খেলোয়াড় ব্রাজিলের পেলের পর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ম্যারাডোনাকে গণ্য করা হয়। তিনি ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে পেশাদার খেলা শুরু করেন। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব বিশ দলের হয়ে খেলে প্রথমবার ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপ জয় করেন। তার অধিনায়কত্বে ১৯৮৬’র ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোর এ বিশ^কাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনা তার ‘হ্যান্ড অব গড’ কিংবদন্তি গোলটি দেন। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ সালে ইতালির বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা দলকে নেতৃত্ব দেন ম্যারাডোনা। ওই খেলায় পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ১৯৯১ সালে তার শরীরে মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়লে তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনা আবার আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব করেন। তবে সে সময় অবৈধ মাদক পরীক্ষায় হেরে গিয়ে তাকে আর্জেন্টিনা ফিরে যেতে হয়। ১৯৯৭ সালে ৩৭তম জন্মদিনে ম্যারাডোনা পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন। সে-সময় তিনি আর্জেন্টিনার বড় দল বোকা জুনিয়র্সে খেলছিলেন। ম্যারাডোনা ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচ নিযুক্ত হন। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা জার্মানির কাছে হেরে যায়। এরপরে তিনি কোচের পদ থেকে অবসর নেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বিশ^ ফুটবলের এই কিংবদন্তি।
১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পান ফুটবলের জাদুকর ম্যারাডোনা। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে ধৈর্য্য হারিয়ে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। সেই খেলায় ৩-১ গোলে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যায় আর্জেন্টিনাও। কিন্তু ততদিনে ম্যারাডোনার দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল গ-ি পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছে গিয়েছে। সে সময় প্রায় ১১ লাখ পাউন্ডে তাকে সই করিয়েছিল বার্সেলোনা। ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজার সেই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস মেনত্তি।
যত রেকর্ড
বিশ্ব ফুটবলের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন হলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পেশাগত ফুটবল জীবনে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেছেন। দলের অধিনায়ক হিসেবে আর্জেন্টিনাকে তিনি দুই বার বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান। তিনি ৪টি বিশ্বকাপ ম্যাচে খেলেছেন। ম্যারাডোনা বার্সেলোনা ও নাপোলির মতো ক্লাবেও খেলেছেন। নাপোলির হয়ে ২টি ইতালীয় লিগ সিরি’আ ট্রফি জিতেছেন। ২০০০ সালে ফিফার শতাব্দী সেরা খেলোয়াড় খেতাব অর্জন করেন।১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার করা বিশেষ গোলের সুবাদে ২-১ গোলে সেই খেলা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ওই বিখ্যাত দুটি গোল ‘হ্যান্ড অব গড’ (Hand of God) ও গোল অব দ্য সেঞ্চুরি (Goal of the Century) নামে পরিচিত। ফুটবলের এই রাজপুত্র যে জার্সি পরে ওই ঐতিহাসিক গোল করেছিলেন সেটি অনলাইন নিলামে বিক্রি হয়েছে রেকর্ড ৭১ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ পাউন্ডে। বাংলাদেশের মূল্যে যা ৭৭ কোটি ৪৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭২ টাকা।
মৃত্যু
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর সেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিশ্ব ফুটবলের নক্ষত্র ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তার মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি চিকিৎসকদের অবহেলায় হত্যা এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। তার মেয়েরা অভিযোগ করেছিলেন, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসকদের অবহেলা ছিল। তদন্ত শেষে ম্যারাডোনার চিকিৎসকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আর্জেন্টিনার চিকিৎসক নেলসন কাস্ত্রো দাবি করেছেন, হৃৎপিন্ড ছাড়াই নাকি সমাহিত করা হয়েছে ম্যারাডোনাকে। ক্যারিয়ারের একটা বড় সময়জুড়ে মাদক সংক্রান্ত বিতর্ক ও ভগ্নস্বাস্থ্য ম্যারাডোনাকে তাড়া করে ফেরে।
১৯৮৬ সালে মাঠে মার খেতে খেতে যিনি একাই বিশ^কাপ জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। ম্যারাডোনা ইতালির নাপোলিকে ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব করে গড়ে তুলেছিলেন। খেটে খাওয়া সংগ্রামী মানুষের ত্রাণকর্তা ভাবা হতো তাকে। মারা যাওয়ার পর থেকেই ফুটবলের এই অমর জাদুকরের প্রতি বিশ্বের নানা প্রান্তে শ্রদ্ধা জানানো অব্যাহত রয়েছে। আর্জেন্টিনায় আদরের ‘পেলুসা’ তিনি। মেক্সিকোয় রোসারিওর ভক্তরা তাকে ঈশ^ররূপে বরণ করে ‘ইগেলেসিয়া ম্যারাডোনিয়া’ নামে গির্জা খুলেছে। ম্যারাডোনা ইতালির ক্লাব নাপোলিকে বিশ্বমানের দলে পরিণত করেছিলেন। নেপলসবাসীর কাছে তাই তিনি ‘ঈশ্বরতুল্য’ মর্যাদা পান ফটবলের এই বরপুত্র।