নারীর অগ্রযাত্রায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ স্পেনের
তৃষা বড়ুয়া | ৫ জুন, ২০২২ ০০:০০
কর্মজীবী নারীদের পিরিয়ডের সময় ছুটির খসড়া আইন অনুমোদন করেছে স্পেনের মন্ত্রিসভা। পার্লামেন্টে আইনটি পাস হলে স্পেন হবে ইউরোপে নারীদের পিরিয়ডের সময় ছুটি কার্যকর করা প্রথম দেশ। গর্ভপাত আইন পরিবর্তনের কথাও আইনটিতে বলা হয়েছে। পিরিয়ড ও গর্ভপাত সংক্রান্ত এ আইনটি নিয়ে স্পেনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
পিরিয়ডের ছুটি
স্পেনের মন্ত্রিসভা সম্প্রতি চাকরিজীবী নারীদের জন্য এক যুগান্তকারী খসড়া আইন অনুমোদন করেছে। প্রতি মাসে মাসিকের সময় তীব্র যন্ত্রণায় ভোগা নারীরা যাতে বৈতনিক ছুটি পান, তা এই আইনে বলা হয়েছে। খসড়া আইনটি পার্লামেন্টে পাস হলে স্পেন হবে ইউরোপের প্রথম দেশ, যে মাসিকের সময় নারীদের ছুটি দেবে। এই সময়ে বেতনও পাবেন তারা। ১৭ মে অনুমোদন পাওয়া খসড়া আইনে বলা হয়েছে, নারীরা মাসিকের সময় তিন দিনের ছুটি পাবে। শারীরিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই ছুটি পাঁচ দিনও হতে পারে। মাসিকের সময় কর্মস্থলে নারীদের ছুটি বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে চালু আছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, জাম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য নারীদের মাসিক ছুটির জন্য রাষ্ট্র কবে আইন প্রণয়ন করবে, তার জন্য অপেক্ষা করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক জেন্ডার সমতাবিষয়ক সংস্থা ভিক্টোরিয়ান উইমেনস ট্রাস্ট যারা নারীকর্মীদের ১২ দিনের মাসিক ও মেনোপজের ছুটি দেয়। এ ছাড়া রয়েছে ভারতের ফুড ডেলিভারি কোম্পানি জোম্যাটো। তারা মাসিকের সময় নারীকর্মীদের ১০ দিন ছুটি দেয়। ফরাসি সমবায় প্রতিষ্ঠান লা কালেক্টিভ প্রতি মাসে নারীদের এক দিনের মাসিক ছুটি দিয়ে থাকে।
স্পেনের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়া আইনটিতে স্কুলপড়ুয়া কিশোরীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের বিনামূল্যে স্যানিটারি পণ্য বিতরণ ও গর্ভপাতের আইন পরিবর্তনের বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে। ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতাও আইনটিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে যাতে নারীরা গর্ভপাত করতে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হন, খসড়া আইনে তারও উল্লেখ রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, স্পেনে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত সারোগেট প্রেগন্যান্সি (এক নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণ পদ্ধতি) নারীর প্রতি এক ধরনের সহিংসতা।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু বামপন্থি জোট সরকার ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর নারী অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। দেশটির মন্ত্রিসভায় আট পুরুষ ও ১৪ নারী রয়েছেন। ক্ষমতাসীন জোট সরকার পার্লামেন্টে খসড়া ওই আইন পাস করতে আইনপ্রণেতাদের পর্যাপ্ত সমর্থন পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই আইন নিয়ে গত মাস থেকে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খসড়া আইনটি স্পেনের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করা নারীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে নাকি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে খোদ নারীদের মধ্যেই। স্প্যানিশ নারীদের একাংশ মনে করেন, মাসিকের সময় ছুটি তাদের প্রয়োজন। ওই সময় পেটে তীব্র ব্যথার কারণে অফিসের কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
স্পেনের ২৮ বছর বয়সী অভিনেত্রী ও গায়িকা ক্রিস্টিনা ডিয়াজ বলেন, ‘কর্মস্থলে সবাই শারীরিক নানা ধরনের সমস্যায় ছুটি নিয়ে থাকেন। নারীরাও যদি মাসিকের সময় ছুটি পান, তাহলে আমি মনে করি এটি দুর্দান্ত বিষয় হবে।’ অন্যদিকে আইনের বিরোধিতাকারীরা মনে করছেন, এই আইন নারী-পুরুষের বৈষম্য বাড়াবে বৈ কমাবে না। স্পেনের ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী পাবলো বেলটান মার্টিন বলেন, ‘আইনটি পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যেতে পারে। নিয়োগকর্তারা নারীকর্মীদের নিয়োগ দিতে অনুৎসাহিত বোধ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।’ স্পেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন ইউজিটির উপমহাসচিব ক্রিস্টিনা অ্যানটোন্যানজাসও সতর্ক করে বলেন, ‘এই আইন শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশাধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।’ দেশটির অর্থনীতিমন্ত্রী নাদিয়া ক্যালভিনো মনে করেন, চাকরির প্রতিযোগিতায় নারীরা এই আইনের কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন।
অবশ্য স্পেনের সমতামন্ত্রী আইরিন মনটেরো জানান, মাসিকের সময় ছুটি দিয়ে নারীদের শারীরিক এক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে এতদিন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মন্ত্রিসভায় খসড়া আইনটি অনুমোদনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নারীদের মাসিককে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। আইনটি পাস হলে মানুষ আর মাসিককে ট্যাবু হিসেবে দেখবে না। যন্ত্রণাদায়ক মাসিকের অস্থায়ী ছুটি চলাকালে নারীরা যে বেতন পাবেন, সেই ব্যয় পুরোপুরি স্পেন রাষ্ট্র বহন করবে। ইউরোপের আর কোনো দেশে নারীদের মাসিকের ছুটি দেওয়া হয় না। পার্লামেন্টের অনুমোদন পেলে ইউরোপের নারীদের মধ্যে স্প্যানিশরাই প্রথম এই সুবিধা ভোগ করবে।’
মন্ত্রী মনটেরো আরও বলেন, ‘মাসিকের সময় ছুটি পেলে নারীদের আর ব্যথা নিয়ে কাজ করতে হবে না। কর্মস্থলে আসার আগে তাদের ব্যথানাশক ওষুধ খেতে হবে না, ব্যথাও গোপন করতে হবে না। আজ আমরা বিশ্বের সব নারীকে এক স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই। দেশে দেশে যৌন ও প্রজনন অধিকার নিয়ে অনেক নারী লড়াই করছেন। মাসিকের ছুটি সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সেসব লড়াকু নারীদের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। নিজেদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সিদ্ধান্ত নারীদেরই নেওয়ার সময় এসেছে।’ সমতামন্ত্রী মনটেরো স্পেনের কট্টর বামপন্থি রাজনৈতিক দল পোদেমস পার্টির নেতা। এই দল সানচেজ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশ। মাসিকের ছুটি সংক্রান্ত খসড়া আইন প্রণয়নে পোদেমস পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
গর্ভপাত আইন পরিবর্তন
মাসিকের ছুটি ছাড়াও স্পেনে বিদ্যমান গর্ভপাত আইন পরিবর্তনের কথা নতুন খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। গর্ভপাত আইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ডানপন্থি ও অধিকারকর্মীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে। স্প্যানিশ নারীরা গর্ভপাত করাতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তা করতে অস্বীকৃতি জানান। নতুন এই আইনে বলা হয়েছে, গর্ভপাত করাতে ইচ্ছুক নারী সরকারি হাসপাতালে গেলে সেখানে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অবশ্যই থাকতে হবে। এ বিষয়ে ৩৭ বছর বয়সী স্প্যানিশ নারী মার্তা ভিগারা গার্সিয়া বলেন, ‘নতুন গর্ভপাত আইন শুনে খুশি হয়েছি। নারীদের গর্ভপাত করানো নিয়ে এখন আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। ২০১৮ সালে আমার গর্ভের সন্তানের বেঁচে থাকার আশা খুব ক্ষীণ জেনে গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সে সময় গর্ভপাত করানোর মতো চিকিৎসক পেতে আমাকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা সে সময় আমাকে জানিয়েছিলেন, যেহেতু পেটের শিশুটির হৃদস্পন্দন চলছে, তাই তারা গর্ভপাত করাবেন না। আমাকে তখন বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে গর্ভপাত করাতে হয়েছিল।’
১৯৮৫ সালে ধর্ষণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা বন্ধ করে গর্ভপাত আইন প্রণয়ন করেছিল স্পেন সরকার। এ ছাড়া ভ্রƒণ বিকৃত হয়ে গেলে বা প্রসবের আগে গর্ভবতী মা গুরুতর শারীরিক-মানসিক সমস্যায় পড়লে গর্ভপাত করানোর কথা ওই আইনে উল্লেখ করা হয়। ২০১০ সালে আইনটি আরও বিস্তৃত করা হয়। সে সময় বলা হয়, গর্ভাবস্থার ১৪ সপ্তাহের মধ্যে চাইলে গর্ভপাত করানো যাবে। পাশাপাশি ২২ সপ্তাহ পর্যন্ত ভ্রুণে গুরুতর অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে গর্ভপাতের বৈধতা দেওয়া হয়। তবে আইনের মাধ্যমে গর্ভপাত প্রক্রিয়া শিথিল করা হলেও স্পেনে এ নিয়ে পরিস্থিতি জটিলই থেকে যায় কারণ দেশটির সরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক গর্ভপাত করাতে সচরাচর রাজি হন না।
রক্ষণশীল সমাজ
স্পেনের জনসংখ্যার বড় অংশ রক্ষণশীল ক্যাথলিক। তাদের অনেকে দেশটির বিদ্যমান গর্ভপাত আইনের প্রবল বিরোধী। স্পেনের সাবেক রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় ক্ষমতায় আসার আগে দেশের গর্ভপাত আইন কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে তার দলের নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে মতভেদ হওয়ায় ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওই অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করায় রাহয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয় স্পেনের গর্ভপাতবিরোধী সংগঠনসহ রক্ষণশীল সমাজ। তাদের সন্তুষ্ট করতে গর্ভপাত আইন কিছুটা সংস্কার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাহয়। ১৬ ও ১৭ বছরের কিশোরীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন তিনি। গর্ভপাত অধিকার ঘিরে স্পেনে মতাদর্শিক লড়াই চলছে দীর্ঘকাল ধরে। দেশটির ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ও ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা সম্প্রতি গর্ভপাত আইন রদ করতে সাংবিধানিক আদালতের প্রতি আহ্বান জানায়। দেশটির ডানপন্থি আইনপ্রণেতাদের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত যদি গর্ভপাত আইন বাতিল করা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে, তবে স্পেন পারবে না কেন?
স্তম্ভিত যুক্তরাষ্ট্র
১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এক আদালত যুগান্তকারী রায় দেয়। নারীদের গর্ভপাতের স্বাধীনতা ওই রায়ে রক্ষা করা হয়। ১৯৬৯ সালে নরমা ম্যাকর্ভি (আইনি ছদ্মনাম জেইন রো) নামের এক মার্কিন নারী তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। টেক্সাসের বাসিন্দা রো সে সময় গর্ভপাত করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু অঙ্গরাজ্যটিতে গর্ভপাত সে সময় বেআইনি ছিল। গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হলে কেবল টেক্সাসের নারীরা গর্ভপাত করাতে পারতেন।
রোয়ের আইনজীবী সারা ওয়েডিংটন ও লিন্ডা কফি ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে স্থানীয় আইনজীবী হেনরি ওয়েডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন অসাংবিধানিক। মামলার শুনানি শেষে তিন বিচারকের প্যানেল রোয়ের পক্ষে রায় দেয়। সেই থেকে ওই রায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রো বনাম ওয়েড নামে পরিচিত।
গত মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের একটি খসড়া মতামত ফাঁস হয়। সেখানে বলা হয়, রো বনাম ওয়েড বাতিল করার পরিকল্পনা করছে সুপ্রিম কোর্ট। ফাঁস হওয়া ওই তথ্যে স্তম্ভিত হয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৯৭৩ সালের ওই রায় যদি বাতিল করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য গর্ভপাতকে আইনি অথবা বেআইনি হিসেবে ঘোষণা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গাটমাকার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, রো বনাম ওয়েড বাতিল হলে দেশটির বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্য গর্ভপাতকে বেআইনি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ২২টি অঙ্গরাজ্যে এটি নিয়ে বেশ কড়াকড়ি হতে পারে আর কমপক্ষে চারটি অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাত গুরুতর হুমকির মুখে পড়তে পারে। সুপ্রিম কোর্টের ওই খসড়া মতামত ফাঁস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করা হলে দেশটির ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের এ ধরনের পদক্ষেপে উৎসাহিত হবে অন্য দেশের সরকারসহ মানবাধিকারের বিপক্ষে অবস্থান করা সংগঠনগুলো।’
গর্ভপাত ঘিরে বিতর্ক
গর্ভপাত নিয়ে বিশ্বজনমত দুভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের যুক্তি, গর্ভবতী নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে গর্ভপাত না করানোর মানে হয় না। অন্য পক্ষ মনে করে, এর মাধ্যমে একটি জীবনকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গর্ভপাতের অধিকার দেওয়া হলে নারী তার গর্ভের মেয়েশিশু বা গুরুতর শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিতে যাওয়া শিশু নষ্ট করতে পারে। গর্ভপাত বৈধ করার পর এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায় বলেও মনে করে এই পক্ষ।
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক দল অর্থনীতিবিদ জানান, গর্ভপাতকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোতে জন্মহার ৪ থেকে ১১ শতাংশ কমে যায়। অবশ্য তারা এও জানান, ওইসব অঙ্গরাজ্যের কমবয়সী ও দরিদ্র নারীদের মধ্যে গর্ভপাত করানোর হার বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, যেসব দেশ গর্ভপাতকে অবৈধ হিসেবে দেখে, সেসব দেশে গর্ভপাতের হার বৈধ ঘোষণা দেওয়া দেশের চেয়ে বেশি। ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা মনে করেন, গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে জীবনের সূচনা হয়। গর্ভপাতকে সেক্ষেত্রে হত্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। ক্যাথলিক খ্রিস্টান নেতাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য অন্য ধর্মের চেয়ে ভিন্ন।
হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমতে, ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গর্ভবতী নারীর জীবন বাঁচাতে যদি গর্ভপাত দরকার হয়ে পড়ে, তা হলে তাতে ক্ষতি নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভপাত ঘিরে ধর্মীয় ও মতাদর্শিক বিতর্ক চলতেই থাকবে। সংবেদনশীল এই বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক নীতি গ্রহণ ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভবতী হওয়া নারীদের পাশে দাঁড়ানোও জরুরি।
শেয়ার করুন
তৃষা বড়ুয়া | ৫ জুন, ২০২২ ০০:০০

কর্মজীবী নারীদের পিরিয়ডের সময় ছুটির খসড়া আইন অনুমোদন করেছে স্পেনের মন্ত্রিসভা। পার্লামেন্টে আইনটি পাস হলে স্পেন হবে ইউরোপে নারীদের পিরিয়ডের সময় ছুটি কার্যকর করা প্রথম দেশ। গর্ভপাত আইন পরিবর্তনের কথাও আইনটিতে বলা হয়েছে। পিরিয়ড ও গর্ভপাত সংক্রান্ত এ আইনটি নিয়ে স্পেনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
পিরিয়ডের ছুটি
স্পেনের মন্ত্রিসভা সম্প্রতি চাকরিজীবী নারীদের জন্য এক যুগান্তকারী খসড়া আইন অনুমোদন করেছে। প্রতি মাসে মাসিকের সময় তীব্র যন্ত্রণায় ভোগা নারীরা যাতে বৈতনিক ছুটি পান, তা এই আইনে বলা হয়েছে। খসড়া আইনটি পার্লামেন্টে পাস হলে স্পেন হবে ইউরোপের প্রথম দেশ, যে মাসিকের সময় নারীদের ছুটি দেবে। এই সময়ে বেতনও পাবেন তারা। ১৭ মে অনুমোদন পাওয়া খসড়া আইনে বলা হয়েছে, নারীরা মাসিকের সময় তিন দিনের ছুটি পাবে। শারীরিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই ছুটি পাঁচ দিনও হতে পারে। মাসিকের সময় কর্মস্থলে নারীদের ছুটি বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে চালু আছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, জাম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য নারীদের মাসিক ছুটির জন্য রাষ্ট্র কবে আইন প্রণয়ন করবে, তার জন্য অপেক্ষা করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক জেন্ডার সমতাবিষয়ক সংস্থা ভিক্টোরিয়ান উইমেনস ট্রাস্ট যারা নারীকর্মীদের ১২ দিনের মাসিক ও মেনোপজের ছুটি দেয়। এ ছাড়া রয়েছে ভারতের ফুড ডেলিভারি কোম্পানি জোম্যাটো। তারা মাসিকের সময় নারীকর্মীদের ১০ দিন ছুটি দেয়। ফরাসি সমবায় প্রতিষ্ঠান লা কালেক্টিভ প্রতি মাসে নারীদের এক দিনের মাসিক ছুটি দিয়ে থাকে।
স্পেনের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়া আইনটিতে স্কুলপড়ুয়া কিশোরীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের বিনামূল্যে স্যানিটারি পণ্য বিতরণ ও গর্ভপাতের আইন পরিবর্তনের বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে। ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতাও আইনটিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে যাতে নারীরা গর্ভপাত করতে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হন, খসড়া আইনে তারও উল্লেখ রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, স্পেনে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত সারোগেট প্রেগন্যান্সি (এক নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণ পদ্ধতি) নারীর প্রতি এক ধরনের সহিংসতা।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু বামপন্থি জোট সরকার ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর নারী অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। দেশটির মন্ত্রিসভায় আট পুরুষ ও ১৪ নারী রয়েছেন। ক্ষমতাসীন জোট সরকার পার্লামেন্টে খসড়া ওই আইন পাস করতে আইনপ্রণেতাদের পর্যাপ্ত সমর্থন পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই আইন নিয়ে গত মাস থেকে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খসড়া আইনটি স্পেনের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করা নারীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে নাকি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে খোদ নারীদের মধ্যেই। স্প্যানিশ নারীদের একাংশ মনে করেন, মাসিকের সময় ছুটি তাদের প্রয়োজন। ওই সময় পেটে তীব্র ব্যথার কারণে অফিসের কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
স্পেনের ২৮ বছর বয়সী অভিনেত্রী ও গায়িকা ক্রিস্টিনা ডিয়াজ বলেন, ‘কর্মস্থলে সবাই শারীরিক নানা ধরনের সমস্যায় ছুটি নিয়ে থাকেন। নারীরাও যদি মাসিকের সময় ছুটি পান, তাহলে আমি মনে করি এটি দুর্দান্ত বিষয় হবে।’ অন্যদিকে আইনের বিরোধিতাকারীরা মনে করছেন, এই আইন নারী-পুরুষের বৈষম্য বাড়াবে বৈ কমাবে না। স্পেনের ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী পাবলো বেলটান মার্টিন বলেন, ‘আইনটি পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যেতে পারে। নিয়োগকর্তারা নারীকর্মীদের নিয়োগ দিতে অনুৎসাহিত বোধ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।’ স্পেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন ইউজিটির উপমহাসচিব ক্রিস্টিনা অ্যানটোন্যানজাসও সতর্ক করে বলেন, ‘এই আইন শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশাধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।’ দেশটির অর্থনীতিমন্ত্রী নাদিয়া ক্যালভিনো মনে করেন, চাকরির প্রতিযোগিতায় নারীরা এই আইনের কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন।
অবশ্য স্পেনের সমতামন্ত্রী আইরিন মনটেরো জানান, মাসিকের সময় ছুটি দিয়ে নারীদের শারীরিক এক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে এতদিন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মন্ত্রিসভায় খসড়া আইনটি অনুমোদনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নারীদের মাসিককে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। আইনটি পাস হলে মানুষ আর মাসিককে ট্যাবু হিসেবে দেখবে না। যন্ত্রণাদায়ক মাসিকের অস্থায়ী ছুটি চলাকালে নারীরা যে বেতন পাবেন, সেই ব্যয় পুরোপুরি স্পেন রাষ্ট্র বহন করবে। ইউরোপের আর কোনো দেশে নারীদের মাসিকের ছুটি দেওয়া হয় না। পার্লামেন্টের অনুমোদন পেলে ইউরোপের নারীদের মধ্যে স্প্যানিশরাই প্রথম এই সুবিধা ভোগ করবে।’
মন্ত্রী মনটেরো আরও বলেন, ‘মাসিকের সময় ছুটি পেলে নারীদের আর ব্যথা নিয়ে কাজ করতে হবে না। কর্মস্থলে আসার আগে তাদের ব্যথানাশক ওষুধ খেতে হবে না, ব্যথাও গোপন করতে হবে না। আজ আমরা বিশ্বের সব নারীকে এক স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই। দেশে দেশে যৌন ও প্রজনন অধিকার নিয়ে অনেক নারী লড়াই করছেন। মাসিকের ছুটি সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সেসব লড়াকু নারীদের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। নিজেদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সিদ্ধান্ত নারীদেরই নেওয়ার সময় এসেছে।’ সমতামন্ত্রী মনটেরো স্পেনের কট্টর বামপন্থি রাজনৈতিক দল পোদেমস পার্টির নেতা। এই দল সানচেজ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশ। মাসিকের ছুটি সংক্রান্ত খসড়া আইন প্রণয়নে পোদেমস পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
গর্ভপাত আইন পরিবর্তন
মাসিকের ছুটি ছাড়াও স্পেনে বিদ্যমান গর্ভপাত আইন পরিবর্তনের কথা নতুন খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। গর্ভপাত আইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ডানপন্থি ও অধিকারকর্মীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে। স্প্যানিশ নারীরা গর্ভপাত করাতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তা করতে অস্বীকৃতি জানান। নতুন এই আইনে বলা হয়েছে, গর্ভপাত করাতে ইচ্ছুক নারী সরকারি হাসপাতালে গেলে সেখানে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অবশ্যই থাকতে হবে। এ বিষয়ে ৩৭ বছর বয়সী স্প্যানিশ নারী মার্তা ভিগারা গার্সিয়া বলেন, ‘নতুন গর্ভপাত আইন শুনে খুশি হয়েছি। নারীদের গর্ভপাত করানো নিয়ে এখন আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। ২০১৮ সালে আমার গর্ভের সন্তানের বেঁচে থাকার আশা খুব ক্ষীণ জেনে গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সে সময় গর্ভপাত করানোর মতো চিকিৎসক পেতে আমাকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা সে সময় আমাকে জানিয়েছিলেন, যেহেতু পেটের শিশুটির হৃদস্পন্দন চলছে, তাই তারা গর্ভপাত করাবেন না। আমাকে তখন বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে গর্ভপাত করাতে হয়েছিল।’
১৯৮৫ সালে ধর্ষণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা বন্ধ করে গর্ভপাত আইন প্রণয়ন করেছিল স্পেন সরকার। এ ছাড়া ভ্রƒণ বিকৃত হয়ে গেলে বা প্রসবের আগে গর্ভবতী মা গুরুতর শারীরিক-মানসিক সমস্যায় পড়লে গর্ভপাত করানোর কথা ওই আইনে উল্লেখ করা হয়। ২০১০ সালে আইনটি আরও বিস্তৃত করা হয়। সে সময় বলা হয়, গর্ভাবস্থার ১৪ সপ্তাহের মধ্যে চাইলে গর্ভপাত করানো যাবে। পাশাপাশি ২২ সপ্তাহ পর্যন্ত ভ্রুণে গুরুতর অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে গর্ভপাতের বৈধতা দেওয়া হয়। তবে আইনের মাধ্যমে গর্ভপাত প্রক্রিয়া শিথিল করা হলেও স্পেনে এ নিয়ে পরিস্থিতি জটিলই থেকে যায় কারণ দেশটির সরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক গর্ভপাত করাতে সচরাচর রাজি হন না।
রক্ষণশীল সমাজ
স্পেনের জনসংখ্যার বড় অংশ রক্ষণশীল ক্যাথলিক। তাদের অনেকে দেশটির বিদ্যমান গর্ভপাত আইনের প্রবল বিরোধী। স্পেনের সাবেক রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় ক্ষমতায় আসার আগে দেশের গর্ভপাত আইন কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে তার দলের নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে মতভেদ হওয়ায় ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওই অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করায় রাহয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয় স্পেনের গর্ভপাতবিরোধী সংগঠনসহ রক্ষণশীল সমাজ। তাদের সন্তুষ্ট করতে গর্ভপাত আইন কিছুটা সংস্কার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাহয়। ১৬ ও ১৭ বছরের কিশোরীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন তিনি। গর্ভপাত অধিকার ঘিরে স্পেনে মতাদর্শিক লড়াই চলছে দীর্ঘকাল ধরে। দেশটির ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ও ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা সম্প্রতি গর্ভপাত আইন রদ করতে সাংবিধানিক আদালতের প্রতি আহ্বান জানায়। দেশটির ডানপন্থি আইনপ্রণেতাদের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত যদি গর্ভপাত আইন বাতিল করা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে, তবে স্পেন পারবে না কেন?
স্তম্ভিত যুক্তরাষ্ট্র
১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এক আদালত যুগান্তকারী রায় দেয়। নারীদের গর্ভপাতের স্বাধীনতা ওই রায়ে রক্ষা করা হয়। ১৯৬৯ সালে নরমা ম্যাকর্ভি (আইনি ছদ্মনাম জেইন রো) নামের এক মার্কিন নারী তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। টেক্সাসের বাসিন্দা রো সে সময় গর্ভপাত করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু অঙ্গরাজ্যটিতে গর্ভপাত সে সময় বেআইনি ছিল। গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হলে কেবল টেক্সাসের নারীরা গর্ভপাত করাতে পারতেন।
রোয়ের আইনজীবী সারা ওয়েডিংটন ও লিন্ডা কফি ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে স্থানীয় আইনজীবী হেনরি ওয়েডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন অসাংবিধানিক। মামলার শুনানি শেষে তিন বিচারকের প্যানেল রোয়ের পক্ষে রায় দেয়। সেই থেকে ওই রায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রো বনাম ওয়েড নামে পরিচিত।
গত মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের একটি খসড়া মতামত ফাঁস হয়। সেখানে বলা হয়, রো বনাম ওয়েড বাতিল করার পরিকল্পনা করছে সুপ্রিম কোর্ট। ফাঁস হওয়া ওই তথ্যে স্তম্ভিত হয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৯৭৩ সালের ওই রায় যদি বাতিল করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য গর্ভপাতকে আইনি অথবা বেআইনি হিসেবে ঘোষণা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গাটমাকার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, রো বনাম ওয়েড বাতিল হলে দেশটির বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্য গর্ভপাতকে বেআইনি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ২২টি অঙ্গরাজ্যে এটি নিয়ে বেশ কড়াকড়ি হতে পারে আর কমপক্ষে চারটি অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাত গুরুতর হুমকির মুখে পড়তে পারে। সুপ্রিম কোর্টের ওই খসড়া মতামত ফাঁস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করা হলে দেশটির ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের এ ধরনের পদক্ষেপে উৎসাহিত হবে অন্য দেশের সরকারসহ মানবাধিকারের বিপক্ষে অবস্থান করা সংগঠনগুলো।’
গর্ভপাত ঘিরে বিতর্ক
গর্ভপাত নিয়ে বিশ্বজনমত দুভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের যুক্তি, গর্ভবতী নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে গর্ভপাত না করানোর মানে হয় না। অন্য পক্ষ মনে করে, এর মাধ্যমে একটি জীবনকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গর্ভপাতের অধিকার দেওয়া হলে নারী তার গর্ভের মেয়েশিশু বা গুরুতর শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিতে যাওয়া শিশু নষ্ট করতে পারে। গর্ভপাত বৈধ করার পর এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায় বলেও মনে করে এই পক্ষ।
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক দল অর্থনীতিবিদ জানান, গর্ভপাতকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোতে জন্মহার ৪ থেকে ১১ শতাংশ কমে যায়। অবশ্য তারা এও জানান, ওইসব অঙ্গরাজ্যের কমবয়সী ও দরিদ্র নারীদের মধ্যে গর্ভপাত করানোর হার বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, যেসব দেশ গর্ভপাতকে অবৈধ হিসেবে দেখে, সেসব দেশে গর্ভপাতের হার বৈধ ঘোষণা দেওয়া দেশের চেয়ে বেশি। ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা মনে করেন, গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে জীবনের সূচনা হয়। গর্ভপাতকে সেক্ষেত্রে হত্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। ক্যাথলিক খ্রিস্টান নেতাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য অন্য ধর্মের চেয়ে ভিন্ন।
হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমতে, ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গর্ভবতী নারীর জীবন বাঁচাতে যদি গর্ভপাত দরকার হয়ে পড়ে, তা হলে তাতে ক্ষতি নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভপাত ঘিরে ধর্মীয় ও মতাদর্শিক বিতর্ক চলতেই থাকবে। সংবেদনশীল এই বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক নীতি গ্রহণ ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভবতী হওয়া নারীদের পাশে দাঁড়ানোও জরুরি।