
নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তার আমলে কম রক্তপাত দেখেনি পাকিস্তান। এ কারণে বিদায়ের সময় জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন তিনি। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান ও দশম প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ৫ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে এক হাসপাতালে ৭৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ২০০১ সালের ২০ জুন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোশাররফ। ছিলেন ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন কারণ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে মোশাররফ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। নওয়াজ শরিফ ফের ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের ওই সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মোশাররফের সহকর্মীরা তাকে সাহসী ও স্পষ্টভাষী হিসেবে দেখতেন। তবে এসব গুণের কোনোটিই মোশাররফের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বরং পাকিস্তানের সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে বিভেদ সৃষ্টিকারী, সংবিধান পরোয়া না করা এক সামরিক শাসক হিসেবেই ইতিহাস মনে রাখবে, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে তার শাসনামলে কয়েক দশক পেছনে নিয়ে যান।
শৈশব
১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট দিল্লিতে এক উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মোশাররফ। তার বাবার নাম সৈয়দ মোশাররফ উদ্দিন আর মায়ের নাম বেগম জারিন মোশাররফ। মোশাররফ ও জারিনের তিন ছেলে। পারভেজ মোশাররফ তাদের দ্বিতীয় সন্তান। বড় ছেলে অর্থনীতিবিদ জাভেদ মোশাররফ রোমে থাকেন। তিনি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছোট ছেলে নাভেদ মোশাররফ একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। ছোটবেলায় পারভেজ মোশাররফ দিল্লিতে যে বাড়িতে বড় হন, তার নাম নেহার ওয়ালি হাভেলি। ওই বাড়ির পাশে থাকতেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমদের পরিবার। ভারতে মুসলমান জাতীয়বাদের অগ্রদূত এই ব্যক্তিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের জনক বলা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। সে সময় মোশাররফের বয়স ছিল চার। ১৫ আগস্টের কয়েক দিন আগে তার পরিবার ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানে তার বাবা সৈয়দ মোশাররফ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। বছরখানেক পর তিনি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করা শুরু করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯৪৯ সালে তাকে তুরস্কে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে তিনি সপরিবারে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় থাকা শুরু করেন। আঙ্কারায় ছোট্ট পারভেজ মোশাররফ ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন। পরের বছর তিনি মা-বাবা ও ভাইদের সঙ্গে করাচিতে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর তার মা-বাবা তাকে সেন্ট প্যাট্রিকস স্কুলে ভর্তি করান। পরে তিনি লাহোরে ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। ছাত্র জীবনে গণিত ছিল মোশাররফের প্রিয় বিষয়। পরে তার অর্থনীতির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ১৮ বছর বয়সে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন মোশাররফ।
কারগিল যুদ্ধ
পাকিস্তানের স্পেশাল সার্ভিস কমান্ডো গ্রুপে সাত বছর ছিলেন মোশাররফ। জেনারেল পদে পদোন্নতির পর ১৯৯৮ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তাকে সেনাপ্রধান করেন। ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের চেষ্টার ঘটনায় জেনারেল মোশাররফের হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়। ওই অনুপ্রবেশের কারণে কারগিল যুদ্ধের সূচনা হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের কারগিল জেলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ওই যুদ্ধ ১৯৯৯ সালের মে মাসে শুরু হয়ে শেষ হয় একই বছরের জুলাইয়ে। যুদ্ধে ৫২৭ জনের মৃত্যু হয় বলে দাবি করে ভারত সরকার। অন্যদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফের দাবি, যুদ্ধে ১ হাজার ৬০০ মানুষের প্রাণহানি হয়। কারগিল : দ্য হাইটস অব ব্রেভারি বইয়ের লেখক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক আজাদ সিং রাঠোর বলেন, ‘ওই সময় সেনাপ্রধান মোশাররফ পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি পরিকল্পনা হাজির করে। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে উত্তেজনা সৃষ্টি করা গেলে সেখানকার পাকিস্তানপন্থি দলের পাকিস্তানের আরও সমর্থন ও যোদ্ধার দরকার পড়বে। পাকিস্তান সরকার ও জেনারেল মোশাররফ ভেবেছিলেন, ভারত সে ক্ষেত্রে বদলা নিতে পারবে না কারণ তারা জানে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র আছে।’ নওয়াজ শরিফ ও মোশাররফের এই ভাবনা যে ভুল ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুদ্ধে কোনো কিছু অর্জিত না হওয়ায় উল্টো প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ায় ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে একপর্যায়ে নওয়াজ শরিফ তার সেনাদের কাশ্মীরের পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কারগিল যুদ্ধের পর শরিফ তার সেনাপ্রধান মোশাররফকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে রক্তপাতহীন তবে নাটকীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শরিফকে গদিচ্যুত করেন মোশাররফ।
নাটকীয় অভ্যুত্থান
প্রশ্ন উঠতে পারে, মোশাররফের উত্থান নাটকীয় কেন? ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবরের ঘটনা। নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধান মোশাররফকে বরখাস্ত করেন। নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউদ্দীন বাট। যে মুহূর্তে এই নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়, ঠিক তখন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে উড়োজাহাজে করে করাচিতে ফিরছিলেন পারভেজ মোশাররফ। উড়োজাহাজটির ককপিট থেকে করাচি বিমানবন্দরের কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত ব্যক্তিকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি আমার কুকুরদের নাম বলতে পারবেন? উত্তর আসে, ‘ডট আর বাডি, স্যার।’ উত্তরদাতা ছিলেন করাচির এক আর্মি ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল মালিক ইফতিখার আলি খান। বলা বাহুল্য, পারভেজকে দেওয়া উত্তর ছিল গোপন পাসওয়ার্ড। মোশাররফকে সরিয়ে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগের সময় নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মোশাররফকে বহনকারী উড়োজাহাজটি যেন করাচিতে কোনোভাবে অবতরণ না করে। ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মোশাররফ সমর্থিত গ্রুপের দায়িত্ব ছিল, যেকোনোভাবে বিমানটির অবতরণ নিশ্চিত করা এবং করাচি বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। এসব কাজ গ্রুপটি তার উড়োজাহাজে থাকার সময় করতে পেরেছিল কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ককপিট থেকে ওই প্রশ্ন ছুড়েছিলেন মোশাররফ। ১২ অক্টোবর একদিকে নওয়াজ শরিফ মোশাররফকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অপসারণের আয়োজন করছিলেন, অন্যদিকে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আয়োজন প্রায় শেষ করে ফেলেছিল মোশাররফপন্থি গ্রুপ। শেষ পর্যন্ত মোশাররফসহ ১৯৮ যাত্রী নিয়ে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিমানটি এবং ক্ষমতা থেকে ওইদিনই বিদায় নিতে বাধ্য হন নওয়াজ।
মোশাররফের শাসন
মোশাররফের চুরুট ও বিদেশি হুইস্কির প্রতি আসক্তি এবং মুসলমানদের প্রতি যুক্তিসংগত সংযমের আহ্বান পশ্চিমাদের মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে নিউ ইয়র্কে ৯/১১ হামলার পর তার প্রতি পশ্চিমা দেশের নেতাদের মুগ্ধতা বেড়ে যায়। ওই হামলা নিয়ে আত্মজীবনীতে মোশাররফ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই আহত ভালুকের মতো হিংস্র প্রতিক্রিয়া জানাবে যদি তারা নিশ্চিত হয় ৯/১১ হামলার জন্য আল-কায়েদা দায়ী। আহত ভালুক তখন ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসবে।’ হামলার কয়েক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল মোশাররফকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে পারে অথবা বিপক্ষেও যেতে পারে।’ মোশাররফ আত্মজীবনীতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা তাকে সে সময় হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে বোমা মেরে দেশটিকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিতান্ত বাধ্য হয়ে সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, এমনটা ভাবার অবশ্য কোনো কারণ নেই। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিবিড় সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও সর্বজনবিদিত।
নারী অধিকারের পক্ষে আইন প্রণয়ন করে ও পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে লাইসেন্সের অনুমতি দিয়ে মধ্যপন্থি শাসক হিসেবে পরিচিতি পান মোশাররফ। তার সময়ে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আগ্রহ দেখান মোশাররফ। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদে সার্কের সম্মেলন চলাকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোশাররফ যৌথ বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে উভয় দেশের নেতা কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদসহ আট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়েছিলেন।
পদত্যাগের কারণ
২০০৮ সালে মোশাররফের ক্ষমতা থেকে বিদায় একটি কারণে হয়নি। কারণ ছিল বহুবিধ। পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে মোশাররফ বরখাস্ত করলে দেশটির আইনজীবীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর তিনি জরুরি অবস্থা জারি করলে তার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পাশাপাশি ২০০৮ সালে নির্বাচনের সপ্তাহ কয়েক আগে নির্বাচনী প্রচারণায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো হত্যার পেছনে মোশাররফের হাত ছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনা মোশাররফের পতনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ওই সামরিক শাসকের গদিচ্যুতির পেছনে প্রধান কারণ ছিল ২০০৭ সালে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে তার নির্দেশে সামরিক অভিযান পরিচালনা। ওই ঘটনা শুধু মোশাররফের গদিই নড়বড়ে করেনি, ইসলামি জঙ্গিবাদের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটায়। লাল মসজিদে অভিযানের কারণেই পাকিস্তানে জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বা পাকিস্তানি তালেবানের উত্থান ঘটে।
১৯৬৫ সালে ইসলামাবাদে লাল মসজিদ নির্মাণ করা হয়। শুরু থেকে এটি চরমপন্থি মতাদর্শ প্রচারের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ গাজি জিহাদের পক্ষে প্রচারণা চালাতেন। আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করলে ওই মসজিদ থেকে নিয়মিত যোদ্ধা দেশটিতে পাঠানো হতো রেড আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে। যুদ্ধের পর লাল মসজিদ চরমপন্থি মতাদর্শ প্রচারের পাশাপাশি আশপাশের মাদ্রাসায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা করে। ১৯৯৮ সালে গাজি নিহত হলে তার ছেলে আবদুল আজিজ ও আবদুল রশিদ মসজিদটি পরিচালনা করেন। এই দুজনের সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনসহ আল-কায়েদার বেশ কয়েকজন নেতার সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ আছে। ৯/১১ হামলার পর মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেররের পক্ষে সমর্থন দিলে লাল মসজিদের নেতা ও শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে কঠোর নিন্দা জানান। ২০০৭ সালের জুনে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। ওই সময় লাল মসজিদের ছাত্রছাত্রীরা পতিতালয়ের অভিযোগ তুলে ইসলামাবাদের একটি মাসাজ পার্লারে হামলা চালায় এবং সেখানে কর্মরত নয়জনকে অপহরণ করে। এদের মধ্যে সাতজন চীনের নাগরিক ছিলেন। পরের দিন তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চীন সরকার পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে। লাল মসজিদের নেতা-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কয়েক মাস দ্বিধান্বিত ছিল মোশাররফ সরকার।
অবশেষে ২০০৭ সালের ৩ জুলাই মোশাররফের নির্দেশে ট্যাংক ও গোলা-বারুদ নিয়ে লাল মসজিদ ঘিরে ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তিন দিন পর সেনাবাহিনী মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ, হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন সংগঠনের জিনিসপত্রের পাশাপাশি কালাশনিকভ রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড, পেট্রোলবোমা ও রকেট লঞ্চার উদ্ধার করে। অভিযানে সেনাবাহিনীর কমান্ডোসহ একশর বেশি মানুষ নিহত হন। ওই ঘটনার পর চরমপন্থিরা মোশাররফের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। লাল মসজিদের ঘটনা মোশাররফকে কোণঠাসা করে। ক্ষমতাসীন জোট অভিশংসনের সিদ্ধান্ত নিলে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। পদত্যাগের ঘোষণার সময় মোশাররফ বলেছিলেন, ‘আশা করি, এক দিন দেশ ও দেশের মানুষ আমার ভুলগুলো মাফ করবেন।’
হোয়াটসঅ্যাপে যোগ হয়েছে মেসেজ ডিলিট করার অপশন। এর ফলে মেসেজ পাঠানোর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই মেসেজ ডিলিট করা সম্ভব। ব্যক্তিগত চ্যাট ও গ্রুপ চ্যাটে সবার জন্যই মেসেজ ডিলিট করা সম্ভব। যদিও এমন অনেক সময় আসে যখন মনে হয় ডিলিট হওয়া সেই মেসেজ যদি পড়া যেত।
তবে একবার মেসেজ ডিলিট হলে হোয়াটসঅ্যাপ অফিশিয়াল অ্যাপ থেকে সেই মেসেজ পড়ার কোনো উপায় থাকে না। যদিও থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করে অ্যান্ড্রয়েড গ্রাহকরা হোয়াটসঅ্যাপে ডিলিট হওয়া মেসেজ পড়তে পারবেন। ডিলিট হওয়া মেসেজ পড়ার জন্য প্রথমে প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করুন নোটিসেভ অ্যাপ। এই অ্যাপ ডাউনলোড করে নির্দিষ্ট কিছু ধাপ অনুসরণ করলেই হোয়াটসঅ্যাপের ডিলিট হওয়া মেসেজ পড়া যাবে। শুধু টেক্সট মেসেজ নয়, নোটিসেভ অ্যাপ ব্যবহার করে ডিলিট হওয়া ছবি ও ভিডিও দেখে নেওয়া যাবে। এবার ডিলিট হওয়া হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পড়া যাবে কীভাবে তা দেখা নেওয়া যাক।
হোয়াটসঅ্যাপে ডিলিট হওয়া মেসেজ পড়বেন যেভাবে
ধাপ-১ : প্লে-স্টোর থেকে নোটিসেভ অ্যাপ ডাউনলোড করুন। শুধু অ্যান্ড্রয়েড গ্রাহকরাই এই অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন।
ধাপ-২ : নোটিসেভ ইনস্টল করে লগ ইন করুন।
ধাপ-৩ : লগ ইন করে নোটিসেভ অ্যাপের হোম স্ক্রিন ওপেন করুন।
ধাপ-৪ : এবার হোয়াটসঅ্যাপ আইকন সিলেক্ট করলে আপনি সব ডিলিট হওয়া মেসেজ দেখতে পাবেন।
ধাপ-৫ : নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখতে হলে কন্টাক্ট ফিল্টার ব্যবহার করুন।
যদিও বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই অ্যাপ ডাউনলোড করলে ফোনের সুরক্ষার বিষয়টির সঙ্গে আপনাকে আপস করতে হতে পারে। কারণ এ ধরনের থার্ড পার্টি অ্যাপ থেকে ফোনে ম্যালওয়্যার প্রবেশ করতে পারে। তাই নিজে ঝুঁকি নিয়ে এই অ্যাপ ব্যবহার করুন।
শজনে ডাঁটা ছাড়া শুক্তো, পাঁচমিশালি তরকারি বা মাছের ঝোল, কোনো তরকারির স্বাদ তেমন খোলতাই হয় না। অনেকেই ডাঁটা খেতে ভালোবাসেন। আবার ছোটরা একেবারেই ডাঁটা চিবোতে চায় না দাঁতে ব্যথা হওয়ার ভয়ে। কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়গুলোতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সেই প্রাচীনকাল থেকে শজনে খাওয়ার চল। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি পক্স এবং অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি যৌগের জন্য চিকিৎসকরাও এই সবজি বেশি করে খেতে বলেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও আর কোন কোন উপকারে লাগে ডাঁটা?
শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ : শর্করা বাড়তে পারে এমন খাবার না খাওয়া এবং শরীরচর্চা ছাড়াও প্রতিদিন খাবার পাতে ডাঁটা রাখলে কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
হজমে সহায়তা : শজনে ডাঁটায় রয়েছে নিয়াসিন, রাইবোফ্ল্যাবিন এবং ভিটামিন-বি-১২-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু যৌগ। শরীরে এই যৌগগুলোর ঘাটতি মেটাতে পারে শজনে ডাঁটা। এ ছাড়াও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকলে, তা-ও দূর করে।
শ্বাসযন্ত্র ভালো রাখে : এ সময় বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই সর্দি-কাশি, ফুসফুসে নানা সংক্রমণজনিত ব্যাধি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত ডাঁটা খেলে এ সমস্যা অনেকটাই কমে।
হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে : একটা বয়সের পর হাড়ের জোর কমে যাওয়া স্বাভাবিক। বাইরে থেকে ক্যালসিয়ামের ওষুধ না খেয়ে পাতে রাখতে পারেন শজনে ডাঁটা। এতে আছে উচ্চমাত্রায় ক্যালসিয়াম, যা হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।
কিডনি ভালো রাখে : কিডনি বা মূত্রাশয়ে পাথর জমার সম্ভাবনা অনেকটা কমিয়ে দেয় ডাঁটা। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভরপুর এই সবজি শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।
করোনা সংক্রমণের মধ্যে ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে। শিশুরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের ডেঙ্গুজ্বরে নানা জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি আছে। অন্যান্য বছর ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-১ বা ডেন-২ ধরনের সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু এবার এই ভাইরাসের ডেন-৩ ও ডেন-৪ ধরনের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এ কারণে জটিলতাও বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই যকৃৎ আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে, কিডনির কার্যকারিতায়ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। পানি আসছে বুকে ও পেটে এবং মাঝে মাঝে নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘাম, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবার তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর কথাও মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।
পরীক্ষা : যেকোনো জ্বরের রোগীরই ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো উচিত হবে। তবে জ্বর যদি পাঁচ দিনের বেশি থাকে, তাহলে ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে আনুষঙ্গিক অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে। এর মধ্যে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট অন্যতম। এই পরীক্ষায় প্লাটিলেট পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি শিশুর রক্তের গ্রুপ জেনে নিন। ডেঙ্গুর পরীক্ষার পাশাপাশি করোনার পরীক্ষাও করাতে হবে। কারণ, কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এখন দুটি সংক্রমণ একসঙ্গেই হতে দেখা যাচ্ছে।
করণীয় : জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ইত্যাদি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ধরা পড়লে শিশুকে বিশ্রামে রাখুন, প্রচুর পানি বা তরল খেতে দিন। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল সিরাপ বা বড়ি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর খেতে দিন। ডেঙ্গুতে ২-৩ দিন পর যখন জ্বর কমে যায়, তখনই জটিলতা দেখা দেওয়ার সময়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন রক্তের অণুচক্রিকার পরিমাণ দেখা উচিত।
অণুচক্রিকার সংখ্যা কমতে থাকলে শিশু বারবার বমি করলে, খেতে না পারলে, পেটে ব্যথা হলে, শিশুর মধ্যে অতি অস্থিরতা বা নিস্তেজ ভাব দেখা দিলে, মুখ-দাঁত-নাক দিয়ে রক্তপাত হলে কিংবা কালো পায়খানা অথবা কালো রক্তবমি কিংবা রক্তের মতো প্রস্রাব করলে অবশ্যই হাসপাতালে নিন। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে মনে হলে, হাত-পা অতিরিক্ত ঠা-া মনে হলে, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
প্রতিরোধ : মশার কামড় থেকে বাঁচাতে শিশুদের সাদা বা হালকা রঙের ফুলহাতা পোশাক পরান। হাতে-পায়ে মশানিরোধক মলম লাগাতে পারেন। বাড়িতে নেট ও মশারি ব্যবহার করুন। বাসার আশপাশ ও বারান্দা, টবে যেন পানি জমে না থাকে। নিয়মিত বাসার আশপাশে স্প্রে করুন। মনে রাখতে হবে, সবার সার্বিক প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। তাই সচেতনতা তৈরি করা উচিত।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সর্ববৃহৎ পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। গতকাল সোমবার দুপুরে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা সংকটে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়। ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর এবারই প্রথম কয়লা সংকটে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ হলো।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়লা ক্রয়ে ঋণ দিয়ে আসছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। এপ্রিল পর্যন্ত কয়লার ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিএমসি। পরে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে কয়লা আমদানির এলসি খোলার শর্ত দেয় চীনা প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসের শেষদিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক মাসে লোকসান হবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ ও কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পুরো ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এদিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বাইরে শুধু কয়লাবাবদ পিডিবির কাছে কেন্দ্রটির বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকা এ বকেয়ার টাকা পরিশোধের জন্য দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তা পরিশোধ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলছে, বৈশি^ক মন্দার পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পিডিবিকে ২৪৭ কোটি টাকা দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট করে প্রায় তিন কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল কেন্দ্রটি। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ইউনিট। গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকার মতো।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফার প্রকৃত জানা না গেলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানান, সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে তাদের নিট মুনাফা হতো ৫ থেকে ৬ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়মূল্য সাড়ে ৫ টাকা এবং মুনাফা সাড়ে ৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মাসে মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় এ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে বিসিপিসিএল। এদিকে কয়লা কেনার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। গত ছয় মাসের বেশি সময় কয়লার বিল বকেয়া থাকায় সুদের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাড়তি এ সুদের অর্থ বিসিপিসিএলকেই পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতি ইউনিটের গড়মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও পিডিবি এ বিদ্যুৎ লোকসান দিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ৮ টাকা ১০ পয়সায়। পায়রা থেকে এক মাস বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পিডিবির লোকসান আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, কয়লা দেশে পৌঁছানো এবং কেন্দ্র চালু করতে সব মিলে অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগবে। কোনো কারণে যদি কয়লা আসতে আরও দেরি হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিশে^র সেরা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক সুইচে চালু করার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বৈশি^ক কারণে ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে আমরা বসে না থেকে কেন্দ্রের মেইনটেনেন্সের কাজটি করে ফেলব, যাতে দীর্ঘদিন আর মেইনটেনেন্স করা না লাগে।’
কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে তা জানতে চাইলে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা দেশ রূপান্তরকে বলেন ‘আমরা এমনিতেই বকেয়া বিল পাচ্ছি না। এটাই বড় ক্ষতি। অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি বন্ধের কারণে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দিতে না পেরে কমফোর্ড ফিল করছি না।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেন্দ্র ভাড়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও এ ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। আর লোডশেডিং না দিয়ে সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই এই মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকার ওপর লোকসান হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডলার ছাড় ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগেই ডলার ছাড় করা উচিত ছিল। এতে বিরাট ক্ষতি হলো। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। একটি হলো যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডলার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে আরকান্দি গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার যমুনা নদীর ভাঙ্গণ এলাকার পাশ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কারণে ভাঙ্গণ এলাকায় হাজার হাজার বালুর বস্তা ডাম্পিং করেও ভাঙ্গণরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা এ বাবদ খরচ হলেও কোনো কাজেই আসছে না বালুর বস্তা ডাম্পিং করে।
অপরদিকে অব্যাহত ভাঙ্গণের তাণ্ডবে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বাড়িঘর বিলিন হয়ে যাওয়ায় এ এলাকার মানুষ গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে ও মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণগ্রামের নাজমা খাতুন আব্দুল কাদের, ইয়াহিয়া, জহুরুল ইসলাম, এমদাদুল হক মিলন, আরকান্দি গ্রামের মেহেদী হাসান, হালিমা খাতুন ও রেমান সরকার বলেন, গত ২ সপ্তাহ ধরে এখানে ব্যাপক ভাঙ্গণ শুরু হয়েছে। এই ভাঙ্গণের তাণ্ডবে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও বহু গাছপালা নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এ ভাঙ্গণের তাণ্ডবে গৃহহারা হয়ে শত শত মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার খোলাস্থানে ছাপড়া তুলে বাস করছে ও মানবেতর জীবন যাপন করছে।
তারা আরও বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ভাঙ্গণ এলাকায় বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ঠিকাদারের লোকজন ধীরগতিতে কাজ করায় তা কোনো কাজেই আসছে না। যেসব স্থানে বস্তা ফেলা হচ্ছে দুই দিন না যেতেই সেখানে আবার ভাঙ্গণ দেখা দিচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ ভাঙ্গণ এলাকার ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে বস্তা ফেলার কয়েকদিন না যেতেই ওই এলাকায় আবারও ভাঙ্গণ দেখা দিচ্ছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট হলেও ভাঙ্গণ রোধ হচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বস্তা ফেলার কাজ না করে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়ে যখন ব্যাপক ভাঙ্গণ শুরু হয়েছে, তখন ঠিকাদারের লোকজন ধীরগতিতে ২/৪ নৌকা বস্তা ফেলে চলে যায়। ২-৩ দিন না যেতেই তা আবার ভেঙ্গে যমুনায় বিলিন হয়ে যায়। ফলে এ বস্তা ফেলা কোনো কাজেই আসছে না। অপরদিকে ঠিকাদারকে বালু সরবরাহের নামে এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতিদিন ১৫/২০ ট্রলারে করে বালু অন্যত্র বিক্রি করছে। ফলে এ ভাঙ্গণের তাণ্ডব আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে বালু সরবরাহকারী খোরশেদ আলম, জয়নাল সরকার ও ফজলু ব্যাপারী এলাকাবাসীর এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে না। ঠিকাদারের লোকজন বালু উত্তোলন করে তা বস্তায় ভরে ভাঙ্গণ স্থানে ফেলছে। আমরা শুধু তাদের কাজে সহযোগিতা করছি। একটি কুচক্রিমহল ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আমাদের নামে মিথ্যা অপপ্রচার করছে।
এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদার আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন বলেন, নদীভাঙ্গণ রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে। অচিরেই এ সমস্যা আর থাকবে না।
ভাঙ্গণ এলাকার অদূরে যমুনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রির বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিয়াকত সালমান বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে খুকনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করা হলে ফোনটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কথা প্রায় সবারই জানা, তারাও ইতিমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। ফলাফল ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) বা মূল্যস্ফীতিতে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিপিআই ইনডেক্সে এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এ বাজেটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগামী অর্থবছরে সরকার কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট প্রস্তাবে কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরাবাস্তব বাজেট। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা আসলে সম্ভব নয়। গত ১১ মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আগের বছরের মে মাসে যে পণ্য গড়ে ১০০ টাকা কিনতে হয়েছে, এ বছরের মে মাসে তা কিনতে হচ্ছে গড়ে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সায়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, ধরুন আগের বছরের একই সময়ে ৫০০ টাকার একটি নোটে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি পণ্য কিনতে পেরেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এখন একই টাকায় তিনটি পণ্য কিনতে পারছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১ বছরে বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ : ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, অথচ এ বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিল মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ : বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৪ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মূল্যস্ফীতি বেশি : এক বছর আগেও শহরের মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে কম ছিল। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে পণ্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। তবে সরকারি উদ্যোগে শহরের মতো গ্রামেও কিছু স্থানে খাদ্যগুদামের ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এখন শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মে মাসে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বে কমেছে মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশে বাড়ছে : গত শনিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ আগের তুলনায় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেখান থেকে ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখান থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে ইইউ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় শুরুর দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো গত বছর আগস্টে এক ঘোষণাতেই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বর্তমানে এ সুদহার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দাবি করেছে, বিশে^র দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির যে হার, তা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এরকম এক সময়ে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এ দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
মজুরি সূচক বেড়েছে : বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশে।
দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনে তীব্র পানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনাবৃষ্টি এবং তীব্র তাপদাহে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই সংকট দেখা দিয়েছে। ৫টি ইউনিটের মধ্যে কোনরকমে মাত্র ১টি ইউনিট সচল রেখে সর্বনিম্ন ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) সকালে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের জানান, হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি জানান, পানির অভাবে কেন্দ্রের সব ক’টি ইউনিট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে ঠেকেছে। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে ১ নম্বর ইউনিটটি চালু রাখা হয়েছে। এই ইউনিট হতে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকলে প্রায় ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে পাঠানো হয়। সেখানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট।
এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, বছরের এই সময়ে কখনই পানি এতো নিচে থাকে না। এ বছর এখনো বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়ায় খুবই বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে। আমরাও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি।
কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত প্রকৌশলী জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ ৭৩ দশমিক ৬২ ফুট (মিন সি লেভেল) ছিল। রুলকার্ভ অনুযায়ী এসময় হ্রদে পানি থাকার কথা ৭৮ দশমিক ২০ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত না হলে এই সংকট হতে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে জানান প্রকৌশলীরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, অনাবৃষ্টি, বন উজার হওয়া, কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকটের কারণে পানি তলানিতে চলে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। সঙ্গতকারণে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পানি কমে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হ্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি উপজেলার সাথে নৌপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাপ্তাই হ্রদের পাশে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম জানান, ভারী বৃষ্টিপাত না হলে হ্রদে পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত সময়ে কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা প্রয়োজন। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা যেমন বাড়বে তেমনি এই সমস্যা থেকে কিছুটা সমাধান পাওয়া যাবে।
বিলাইছড়ি বাজারের ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, বিলাইছড়িতে নৌপথ বন্ধ মানেই জীবন ও জীবিকার দুর্বিষহ অবস্থা। আমরা বিলাইছড়িবাসীই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি হ্রদের পানি কমে যাওয়ায়। বৃষ্টি হতে যত দেরি হবে আমাদের কষ্ট তত বেশি দীর্ঘায়িত হবে।
তিনি বলেন, হ্রদের পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাজারের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বড় বোটতো আসতেই পারছে না, ছোট ছোট বোটে পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পণ্যও আনা যাচ্ছে না। আবার অনেক দূর থেকে পণ্য বাজারে তুলতে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক বাজারও এখন ঠিকমতো জমছে না। কারণ দূর থেকে মানুষজন আসতে পারছে না। এখন বৃষ্টি হওয়া ছাড়া পানি বাড়ার তো আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।