
বিশ্ববাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচল পথ মালাক্কা প্রণালী। যে প্রণালী ভারত মহাসাগরের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। সরু এই জলপথের কাছে সংঘটিত যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বের জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর বিপর্যয়। লিখেছেন নাসরিন শওকত
মালাক্কা প্রণালী
উত্তর-পূর্বে মালয় উপদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত সরু একটি প্রণালী। স্টেইট অব মালাক্কা বা মালাক্কা প্রণালী ৫শ মাইল দীর্ঘ এবং ৪০ থেকে ১৫৫ মাইল প্রশস্ত, যা ভারত মাহাসাগরের আন্দামান সাগরের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ চীন সাগরকে যুক্ত করেছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ চলাচলের প্রধান এই জলপথটি এশিয়ার বড় সব অর্থনীতির দেশকে সরাসরি যুক্ত করেছে। এই দেশগুলো হলো- চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ফলে এটি এশিয়ার অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য একটি প্রধান বাণিজ্যপথেও পরিণত হয়েছে। জাহাজ চলাচলের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সরু পরিবহন পথগুলোরও অন্যতম এটি।
ইতিহাসের পথ ধরে
প্রাচীনকাল থেকে রোমান, গ্রিক, চীনা ও ভারতীয় বণিকরা তাদের বাণিজ্যের পথ হিসেবে মালাক্কা প্রণালীকে ব্যবহার করেছে। এর প্রাথমিক বাণিজ্য বন্দরগুলোর একটি ছিল মালয় উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য কেদাহ, যা উপদ্বীপটির পশ্চিম বন্দর হিসেবে ব্যবহার হতো। পূর্বাঞ্চলের দুই বন্দর ছিল লঙ্কাসুকা ও কেলান্তান। আরব, পারস্য ও দক্ষিণ ভারত থেকে আসা প্রথম দিকের বণিকরা গুয়াংজুতে পৌঁছানোর আগে কেদাহতে এসে পৌঁছাত। তখন কেদাহ থেকে জাহাজে করে লঙ্কাসুকা ও কেলান্তান বন্দরে পণ্য পরিবহন করত তারা । দশম শতাব্দীর পর থেকে এই জাহাজগুলো চীন থেকে যাত্রা শুরু করে। তবে ষষ্ঠ শতাব্দী পর থেকে বাণিজ্য রুট হিসেবে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। সপ্তম শতকে বিজয়া রাজবংশ সমুদ্র বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসে এবং প্রায় ৭শ’ বছর রাজত্ব করে। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান দুটি চোক সমুদ্র পয়েন্ট ছিল মালাক্কা প্রণালী ও সুন্দা প্রণালী। বিজয়া সাম্রাজ্য এই দুই চোক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চীন, ভারত ও আরবের বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য করত। এই সময়েই মালাক্কা প্রণালী ভারত ও চীনের মধ্যকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটে পরিণত হয়। ১৫ শতকে মালাক্কা সালতানাতের উত্থান ঘঠে। তার আগ পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যের নেটওয়ার্ক হিসেবে মালাক্কা প্রণালীর গুরুত্ব অব্যাহত থাকে। এদিকে ১৪০০ থেকে ১৫১১ সাল পর্যন্ত এই প্রণালী শাসন করে মালাক্কা সালতানাত। পরে ১৭ শতক পর্যন্ত প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে জাহাজ চলাচলের প্রধান চ্যানেল হয়ে ওঠে মালাক্কা প্রণালী। ১৯ শতকের শুরুর দিকে ডাচ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জোর করে এই প্রণালীর মধ্যে একটি সীমারেখা টানে। এই সীমানাই আজকের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সীমান্তে পরিণত হয়েছে।
বাণিজ্যিক গুরুত্ব
মালাক্কা প্রণালী আগের সিল্করুটের সমুদ্রভাগেরও একটি অংশ, যা পরিচালিত হতো চীন উপকূল থেকে ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত হয়ে মুম্বাসা তারপর লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল দিয়ে পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত ,আবার অ্যাড্রিয়াটিক অঞ্চল ধরে ত্রিয়েস এবং মধ্য ইউরোপ হয়ে উত্তর সাগর পর্যন্ত। তাই এই জলপথের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ খালের উদ্বোধন হয়। এরপর থেকে মালাক্কা প্রণালীর গুরুত্ব বেড়েছে কয়েক গুণ। কারণ সুয়েজ খাল ধরে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত সবচেয়ে বড় এই সমুদ্রপথটি। যার মাধ্যমে ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্যের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে অর্ধেকে। তাই বিশ্ববাণিজ্যে দিন দিন এই জলপথটির ব্যবহার বাড়ছে।
মালাক্কা প্রণালী এশিয়ার ও বিশ্বের অর্থনীতির ‘প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য’ পরিবহনের মূল জলপথ। প্রতি বছর ৯৪ হাজারেরও বেশি পণ্যবাহী জাহাজ এই প্রণালী পাড়ি দেয়। ফলে এটি বিশ্বের ব্যস্ততম প্রণালীগুলোরও একটি। এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয় বিশ্বের প্রায় ৪০ ভাগ বাণিজ্যপণ্য। এর মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত তেল, চীনের উৎপাদিত পণ্য কয়লা, পাম অয়েল, ইন্দোনেশিয়ার কফি ইত্যাদি। জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘স্টাডি অন মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১১’-এর পরিসংখ্যান মতে, ২০১০ সালে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক সমুদ্রবাহী বাণিজ্য পণ্য পরিবহন হয়েছে মালাক্কা প্রণালী এবং এর প্রতিবেশী সুন্দা ও লুম্বা প্রণালীর মধ্য দিয়ে। এশিয়ার বাজারের জন্য সমুদ্রপথে পরিবহন হওয়া বিশ্বের মোট তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয় এই প্রণালী দিয়ে। মালাক্কা প্রণালীর আকাশপথে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমান রুটগুলোর একটি। আর সাগরতল দিয়ে টানা চলে গেছে ঘন তারের সাবমেরিন কেব্ল, যা বিশ্বকে অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত করে রেখেছে। এসব কারণে মালাক্কা প্রণালীকে বিশ্বঅর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধমনিতে পরিণত করেছে।
এটি বিশ্বের ব্যস্ততম পরিবহন চোক পয়েন্টগুলোর (কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশ) একটি। যার ফলে এটি একই সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার জ্বালানি চাহিদা এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়া ও বহির্বিশে^র অর্থনীতিতে মালাক্কার অর্থনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে।
বিপর্যয়ের আশঙ্কা
বিশ্বঅর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা। এই জ্বালানিগুলোর উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সমুদ্রপথে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি চোক পয়েন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসব চোক পয়েন্টের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে মালাক্কা প্রণালী। এরই মধ্যে এই প্রণালীতে মানুষসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তার সঙ্গে জলদস্যুদের উৎপাত অঞ্চলটিকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। তা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের পুলিশ সমন্বিতভাবে এই সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে। এখানে অহরহ এক জাহাজের সঙ্গে আরেক জাহাজের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
প্রাকৃতিকভাবে মালাক্কা প্রণালী মালয়েশিয়ার মালয় দ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে। এর ফলে দ্বীপ দুটি পৃথক হয়ে পড়েছে, যা এর বিপদকে বাড়িয়ে তুলেছে। তবে এই প্রণালীর জন্য বড় হুমকি হলো, বিশ্বের সক্রিয় একাধিক আগ্নেয়গিরি ও সাম্প্রতিক ধারাবাহিক ভূমিকম্প। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, যে কোনো সময়ে মালাক্কা প্রণালীতে ভূমিকম্প, সুনামি বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। যদি নিকট ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটেই যায়, তবে তা বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের জন্য মালাক্কা প্রণালী এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, হঠাৎ যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই প্রণালীটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওই দেশগুলোর অর্থনীতিতে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
বিপর্যয়কর যত দুর্যোগ
সুমাত্রা উপকূলের সামনে দিয়ে ও জাভা দ্বীপের দক্ষিণের একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে সুন্দা খাল। এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে একগুচ্ছ ভূমিকম্পের তৎপরতা এবং বেশ কয়েকটি আগ্নেয়গিরি দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে জাভা দ্বীপে রয়েছে দুটি আগ্নেয়গিরি। এর একটি সুমেরু ও অন্যটি মেরাপি। সম্প্রতি এই দুটি আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে। এদিকে সুন্দা প্রণালীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়ে জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপ দুটিকে পৃথক করেছে। এই দুই দ্বীপের আরও পশ্চিমে রয়েছে ক্রাকাতোয়া ও তাম্বোরা আগ্নেয়গিরি।
১৮১৫ সালে এই দুটি আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। এর ফলে তখন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের সূচক (ভিইআই) অনুসারে, তাম্বোরা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাত্রা ছিল ভিই ১৭ (ভিই বলতে আগ্নেগিরির বিস্ফোরণকে বুঝায়)। লগারিদমিক স্কেলে যার সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ১৮ পর্যন্ত। তবে ১৮১৫ সালের মতো এমন ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা প্রতি সহস্রাব্দে এক বা দুবার ঘটে থাকে। কিন্তু বৈশি^ক চোক পয়েন্টে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য অতি উচ্চমাত্রার অগ্ন্যুৎপাতের প্রয়োজন হয় না।
মারাপিতে শেষ ২০১০ সালে ১৪ মাত্রার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। তবে বর্তমানে এই আগ্নেয়গিরিটিতে ১৬ মাত্রার অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা কম। কারণ এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের ফিরে আসার আনুমানিক সময় ৭৫০ বছরের মধ্যে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর স্টাডি অব এক্সস্টেনশিয়াল রিস্ক-এর আগ্নেগিরিবিদ লারা মানি বলেছেন, ‘তবুও এ সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ এই অঞ্চলের সক্রিয় অনেক আগ্নেয়গিরির মধ্যে মারাপি একটি। যদি নতুন করে মারাপিতে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে, তবে তা সত্যিকারভাবেই মালাক্কা প্রণালীকে তছনছ করে দেবে। এর কারণ, যখন একটি আগ্নেগিরিতে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়, তখন এটি কখন বন্ধ হবে তা বলা মুশকিল।’ আগ্নেয়গিরির এই অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থানের ভূমিকম্পও কিন্তু বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর যদি সেই ভূমিকম্পটি আকারে বড় হয় বা তার মাত্রা থাকে বেশি, তবে তা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই ভূমিকম্পের আঘাতে মালাক্কা প্রণালীতে আসতে পারে সুনামির আঘাত। আগ্নেয়গিরি গবেষক মানি বলেছেন, ‘এই ধরনের সুনামি সাধারণত উত্তাল স্রোতের সৃষ্টি করে, যা অনলাইন কেব্লের তারকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এর বিপরীতে বিশ^জুড়ে বাণিজ্য জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে কম ব্যাঘাত ঘটাতে দেখা যায়।
এদিকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সমুদ্রপথে চলাচল করা জাহাজগুলোর ক্ষেত্রেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এমন দুর্যোগের সময়ে সাধারণত ওই জাহাজগুলোকে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সেগুলোকে নিরাপদ রুটে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এক্ষেত্রে নতুন রুট ধরে জাহাজগুলোর সরে যাওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে। এই সময়ে বিমান চলাচলও স্থগিত হতে পারে। সমুদ্রের নিচ দিয়ে যাওয়া সাবমেরিন কেব্লগুলোর ক্ষেত্রে এর চেয়ে আরও ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, যা হতে পারে অর্থনৈতিক মহামারীর কারণ। আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞ মানি বলেন, ‘কারণ প্রতি দিন এই কেব্লগুলোর মধ্য দিয়ে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চলে। যা মূলত আমাদের আর্থিক বাজারকে চাঙ্গা করে থাকে। আমাদের সাবমেরিনের কেবলগুলো দুর্বল হওয়ার কারণে বেশ কিছু বছর ধরে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।’
সুরক্ষার উপায়
সুনামি, ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মালাক্কা প্রণালীকে সুরক্ষিত করা খুব সহজ নয়। ভূমিকম্পের বেলায় দেখা যায়, এটি এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা মানুষের পক্ষে বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। আবার সুনামির মতো দুর্যোগের জন্য আন্তঃসরকারি মহাসাগরীয় কমিশন ও ইউনেস্কোর মতো সংস্থাগুলো প্রাথমিক সতর্ক ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। আবহাওয়া বা ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয়ের জন্য রয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নেভিগেশনাল ওয়ার্নিং সার্ভিস’। এই সেবা সংস্থাটি এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষেত্রে জাহাজ চলাচলের বিষয়ে সতর্ক করে থাকে। মালাক্কা প্রণালীতে কোনো দুর্যোগ ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণে সাধারণত জাপানের উপকূলরক্ষীরা সমন্বয় করে থাকেন। তবে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ক্ষেত্রে কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, হয়তো এমন একদিন আসবে যখন মানুষ আগ্নেয়গিরির তলদেশে থাকা লাভার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে তা থামিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। তবে সে রকম বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে রয়েছি।
তাই দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন আগ্নেয়গিরিগুলোও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি হলো, বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সক্ষমতায় বৈচিত্র্য আনা। এক্ষেত্রে বাণিজ্য জাহাজ চলাচলকে সহজ ও সাশ্রয়ী করার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলো আরও বেশি সক্রিয় হতে পারে। এ লক্ষ্যে তারা আরও বেশি সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করে তাদের বর্তমান রুটে পরিবর্তন আনতে পারে যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে আরও গতি আনবে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।