বাস্কেটবল কিংবদন্তি কোবি ব্রায়ান্টের মর্মান্তিক মৃত্যু
ক্রীড়া ডেস্ক | ২৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি বাস্কেটবল খেলোয়াড় কোবি ব্রায়ান্ট। দুর্ঘটনায় তার কিশোরী কন্যা জিয়ান্না, হেলিকপ্টারের বাকি ছয় যাত্রী এবং চালক প্রাণ হারান।
গত রবিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা নাগাদ একটি এস-৭৬ কপ্টার ক্যালিফোর্নিয়ার কালাবাসাসের পাহাড়ি অঞ্চলে ভেঙে পড়ে। খেলার জন্য মেয়েকে পৌঁছে দিতে নিজস্ব হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছিলেন ব্রায়ান্ট। দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে আছেন জিয়ান্নার দলের আর এক সদস্য এবং তার অভিভাবকও।
৬ ফুট ৬ ইঞ্চির ব্রায়ান্টকে বলা হতো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। হাইস্কুলের পরই তিনি সরাসরি এনবিএ লিগ খেলতে শুরু করেন ১৯৯৬ সালে। সে সময় তিনি ছিলেন লিগের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। জেরি ওয়েস্ট, উইল্ট চেম্বারলিন, করিম আবদুল জব্বার, ম্যাজিক জনসন ও মাইকেল জর্ডানের রেখে যাওয়া শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন নিজের হাতে তুলে নেন ব্রায়ান্ট। দুই দশকের বেশি ক্যারিয়ারে পাঁচবার এনবিএ খেতাবের পাশাপাশি দুবার অলিম্পিক স্বর্ণ জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্র দলের হয়ে। ক্যারিয়ারের ২০ বছর শুধু লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্সের হয়েই খেলেছেন তিনি। যে দুটি জার্সি নাম্বার তিনি পরেছিলেন, সেই ‘৮’ এবং ‘২৪’ নম্বরের জার্সি আর কাউকে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে ক্লাব। নিজের জীবন নিয়ে তৈরি করা শর্ট অ্যানিমেশন ফিল্মের জন্য অস্কার জিতেছেন কোবি ব্রায়ান্ট।
১৯৭৮-এ পেনসিলভানিয়ায় জন্ম ব্রায়ান্টের। রেস্তোরাঁর মেন্যুতে জাপানের বিখ্যাত কোবি গরুর মাংসের নামটা দেখে ছেলের নামের সঙ্গে ‘কোবি’ যুক্ত করেন বাবা জো ব্রায়ান্ট। জো নিজেও ছিলেন এনবিএ খেলোয়াড়। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার ক্যারিয়ার শেষে চলে যান ইতালিতে। কোচিং করাতেন সেখানে। মূলত সেখানেই বেড়ে ওঠা কোবি ব্রায়ান্টের। তিন বছর বয়স থেকে বাস্কেটবলে হাতেখড়ি। স্কুল বাস্কেটবল লিগে খেলতে মাঝেমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন বাবার সঙ্গে। থাকতেন পেনসিলভানিয়ার আর্ডমোরে। পড়তেন লোয়ার মেরিয়ন হাই স্কুলে। ১৯৮৬ সালের তরুণ প্রতিভার সন্ধানে লেকার্সের স্কাউটরা ফিলাডেলফিয়ায় যান। আর ঠিক তখনই লেকার্সের সাবেক খেলোয়াড় মাইকেল কুপারকে একক লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়ে নজর কাড়েন ব্রায়ান্ট। লেকার্সের কর্মকর্তাদের তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছিলেন দলটির জেনারেল ম্যানেজার জেরি ওয়েস্ট এভাবে ‘সে এই মুহূর্তে আমাদের দলের অন্য যে কারও চেয়ে ভালো।’ ড্রাফটে তাকে নিয়েছিল শার্লট হরনেটস ফ্র্যাঞ্চাইজি। নিজেদের জন্য নয়, কোবিকে তারা নেয় লেকার্সের পক্ষ হয়ে। লেকার্সের অভিজ্ঞ ভ্লাদ দিভাচের সঙ্গে কোবিকে অদলবদল করেছিল শার্লট।
এরপর ইতিহাস। টানা ২০টি মৌসুম এনবিএ রঙিন হয়েছে কোবি ব্রায়ান্টের জ্বলজ্বলে উপস্থিতিতে। ২০ মৌসুমের ১৮ বারই এনবিএ’র অলস্টার দলে জায়গা পান তিনি। ২০০৮-এ হয়েছেন এনবিএ’র মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার (এমভিপি)। লেকার্সকে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করেছেন এনবিএতে। লেকার্স ও ব্রায়ান্ট সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল এক সময়।
রত্ন চিনতে ভুল করেননি ওয়েস্ট। লেকার্সের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে আস্থার প্রতিদান দেন ব্রায়ান্ট। শুরুতে পাশে পেয়েছিলেন এনবিএ’র আরেক কিংবদন্তি শাকিল ও’নিলকে। দুজনে মিলে ১৯৯৯-২০০০ থেকে টানা তিনটি শিরোপা এনে দেন লেকার্সকে। এরপর ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ মৌসুমেও এনবিএ জেতে লেকার্স। পাঁচটি শিরোপাতেই সবচেয়ে বড় অবদান রেখে বাস্কেটবল ইতিহাসে নিজের নাম কী দারুণভাবেই না লিখে রাখেন ব্রায়ান্ট।
২০০৬ সালে টরন্টো র্যাপটর্সের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৮১ পয়েন্ট পেয়েছিলেন ব্রায়ান্ট, যা এনবিএ ইতিহাসে এক ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। সেই ব্রায়ান্ট ২০০৬ সালের এপ্রিলে নিজের বিদায়ী ম্যাচেও ইয়ুটা জ্যাজের বিপক্ষে পান ৬০ পয়েন্ট। ব্রায়ান্টের অবসরের পর তার পরা দুটি জার্সি নম্বর ৮ ও ২৪ উঠিয়ে রাখে লেকার্স। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম ১০ বছরে ৮ ও শেষ ১০ বছরে ২৪ নম্বর জার্সি পরেছেন ব্রায়ান্ট।
দুবার মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া ব্রায়ান্ট এনবিএ ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ স্কোরার। এনবিএ’র নিয়মিত মৌসুমে ৩৩৬৪৩ পয়েন্ট তার। তার ওপরে আছেন করিম আবদুল জব্বার (৩৮৩৮৭), কার্ল ম্যালন (৩৬৯২৮) ও লেব্রন জেমস (৩৩৬৫৫)।
খেলা ছাড়ার পর নিজেই বাস্কেটবল দল গঠন করেন ব্রায়ান্ট। তার মেজ মেয়ে জিয়ান্নি খেলত সেই দলে। মেয়েকে খেলতে নিতে ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টি থেকে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে বেড়িয়েছিলেন কাল। সেই যাত্রা আর শেষ হলো না।
২০১৬ সালে ‘ডিয়ার বাস্কেটবল’ নামে একটি কবিতা লিখে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন ব্রায়ান্ট। যে কবিতা নিয়ে বানানো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২০১৭ সালে অস্কার এনে দেয় তাকে। কবিতায় ব্রায়ান্ট লিখেছিলেন,
‘আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম।
এতটাই যে আমি আমার সবকিছু তোমাকে সমর্পণ করেছি আমার দেহ ও মন থেকে চেতনা ও আত্মার সব।’ ওপারে ভালো থাকবে কোবি ব্রায়ান্ট।
শেয়ার করুন
ক্রীড়া ডেস্ক | ২৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি বাস্কেটবল খেলোয়াড় কোবি ব্রায়ান্ট। দুর্ঘটনায় তার কিশোরী কন্যা জিয়ান্না, হেলিকপ্টারের বাকি ছয় যাত্রী এবং চালক প্রাণ হারান।
গত রবিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা নাগাদ একটি এস-৭৬ কপ্টার ক্যালিফোর্নিয়ার কালাবাসাসের পাহাড়ি অঞ্চলে ভেঙে পড়ে। খেলার জন্য মেয়েকে পৌঁছে দিতে নিজস্ব হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছিলেন ব্রায়ান্ট। দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে আছেন জিয়ান্নার দলের আর এক সদস্য এবং তার অভিভাবকও।
৬ ফুট ৬ ইঞ্চির ব্রায়ান্টকে বলা হতো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। হাইস্কুলের পরই তিনি সরাসরি এনবিএ লিগ খেলতে শুরু করেন ১৯৯৬ সালে। সে সময় তিনি ছিলেন লিগের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। জেরি ওয়েস্ট, উইল্ট চেম্বারলিন, করিম আবদুল জব্বার, ম্যাজিক জনসন ও মাইকেল জর্ডানের রেখে যাওয়া শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন নিজের হাতে তুলে নেন ব্রায়ান্ট। দুই দশকের বেশি ক্যারিয়ারে পাঁচবার এনবিএ খেতাবের পাশাপাশি দুবার অলিম্পিক স্বর্ণ জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্র দলের হয়ে। ক্যারিয়ারের ২০ বছর শুধু লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্সের হয়েই খেলেছেন তিনি। যে দুটি জার্সি নাম্বার তিনি পরেছিলেন, সেই ‘৮’ এবং ‘২৪’ নম্বরের জার্সি আর কাউকে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে ক্লাব। নিজের জীবন নিয়ে তৈরি করা শর্ট অ্যানিমেশন ফিল্মের জন্য অস্কার জিতেছেন কোবি ব্রায়ান্ট।
১৯৭৮-এ পেনসিলভানিয়ায় জন্ম ব্রায়ান্টের। রেস্তোরাঁর মেন্যুতে জাপানের বিখ্যাত কোবি গরুর মাংসের নামটা দেখে ছেলের নামের সঙ্গে ‘কোবি’ যুক্ত করেন বাবা জো ব্রায়ান্ট। জো নিজেও ছিলেন এনবিএ খেলোয়াড়। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার ক্যারিয়ার শেষে চলে যান ইতালিতে। কোচিং করাতেন সেখানে। মূলত সেখানেই বেড়ে ওঠা কোবি ব্রায়ান্টের। তিন বছর বয়স থেকে বাস্কেটবলে হাতেখড়ি। স্কুল বাস্কেটবল লিগে খেলতে মাঝেমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন বাবার সঙ্গে। থাকতেন পেনসিলভানিয়ার আর্ডমোরে। পড়তেন লোয়ার মেরিয়ন হাই স্কুলে। ১৯৮৬ সালের তরুণ প্রতিভার সন্ধানে লেকার্সের স্কাউটরা ফিলাডেলফিয়ায় যান। আর ঠিক তখনই লেকার্সের সাবেক খেলোয়াড় মাইকেল কুপারকে একক লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়ে নজর কাড়েন ব্রায়ান্ট। লেকার্সের কর্মকর্তাদের তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছিলেন দলটির জেনারেল ম্যানেজার জেরি ওয়েস্ট এভাবে ‘সে এই মুহূর্তে আমাদের দলের অন্য যে কারও চেয়ে ভালো।’ ড্রাফটে তাকে নিয়েছিল শার্লট হরনেটস ফ্র্যাঞ্চাইজি। নিজেদের জন্য নয়, কোবিকে তারা নেয় লেকার্সের পক্ষ হয়ে। লেকার্সের অভিজ্ঞ ভ্লাদ দিভাচের সঙ্গে কোবিকে অদলবদল করেছিল শার্লট।
এরপর ইতিহাস। টানা ২০টি মৌসুম এনবিএ রঙিন হয়েছে কোবি ব্রায়ান্টের জ্বলজ্বলে উপস্থিতিতে। ২০ মৌসুমের ১৮ বারই এনবিএ’র অলস্টার দলে জায়গা পান তিনি। ২০০৮-এ হয়েছেন এনবিএ’র মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার (এমভিপি)। লেকার্সকে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করেছেন এনবিএতে। লেকার্স ও ব্রায়ান্ট সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল এক সময়।
রত্ন চিনতে ভুল করেননি ওয়েস্ট। লেকার্সের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে আস্থার প্রতিদান দেন ব্রায়ান্ট। শুরুতে পাশে পেয়েছিলেন এনবিএ’র আরেক কিংবদন্তি শাকিল ও’নিলকে। দুজনে মিলে ১৯৯৯-২০০০ থেকে টানা তিনটি শিরোপা এনে দেন লেকার্সকে। এরপর ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ মৌসুমেও এনবিএ জেতে লেকার্স। পাঁচটি শিরোপাতেই সবচেয়ে বড় অবদান রেখে বাস্কেটবল ইতিহাসে নিজের নাম কী দারুণভাবেই না লিখে রাখেন ব্রায়ান্ট।
২০০৬ সালে টরন্টো র্যাপটর্সের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৮১ পয়েন্ট পেয়েছিলেন ব্রায়ান্ট, যা এনবিএ ইতিহাসে এক ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। সেই ব্রায়ান্ট ২০০৬ সালের এপ্রিলে নিজের বিদায়ী ম্যাচেও ইয়ুটা জ্যাজের বিপক্ষে পান ৬০ পয়েন্ট। ব্রায়ান্টের অবসরের পর তার পরা দুটি জার্সি নম্বর ৮ ও ২৪ উঠিয়ে রাখে লেকার্স। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম ১০ বছরে ৮ ও শেষ ১০ বছরে ২৪ নম্বর জার্সি পরেছেন ব্রায়ান্ট।
দুবার মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া ব্রায়ান্ট এনবিএ ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ স্কোরার। এনবিএ’র নিয়মিত মৌসুমে ৩৩৬৪৩ পয়েন্ট তার। তার ওপরে আছেন করিম আবদুল জব্বার (৩৮৩৮৭), কার্ল ম্যালন (৩৬৯২৮) ও লেব্রন জেমস (৩৩৬৫৫)।
খেলা ছাড়ার পর নিজেই বাস্কেটবল দল গঠন করেন ব্রায়ান্ট। তার মেজ মেয়ে জিয়ান্নি খেলত সেই দলে। মেয়েকে খেলতে নিতে ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টি থেকে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে বেড়িয়েছিলেন কাল। সেই যাত্রা আর শেষ হলো না।
২০১৬ সালে ‘ডিয়ার বাস্কেটবল’ নামে একটি কবিতা লিখে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন ব্রায়ান্ট। যে কবিতা নিয়ে বানানো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২০১৭ সালে অস্কার এনে দেয় তাকে। কবিতায় ব্রায়ান্ট লিখেছিলেন,
‘আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম।
এতটাই যে আমি আমার সবকিছু তোমাকে সমর্পণ করেছি আমার দেহ ও মন থেকে চেতনা ও আত্মার সব।’ ওপারে ভালো থাকবে কোবি ব্রায়ান্ট।