জাভেদ ওমরের কাছে ২৫৮ বলে ৪৩ রানই সেরা ইনিংস
ক্রীড়া ডেস্ক | ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
কচ্ছপ গতিতে ব্যাট করতেন বলে জাভেদ ওমর কোনোদিন পপুলার চয়েস ছিলেন না। অথচ তার সংগ্রামী ইনিংস দলকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাত। ২০০১ সালে বুলাওয়ে টেস্টে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেছিলেন। ওটা ছিল বিদেশের মাটিতে খেলা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট। যেখানে ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিংয়ের রেকর্ড গড়েন জাভেদ ওমর। অপরাজিত ছিলেন ৮৫ রানে।
বাংলাদেশের হয়ে ৪০ টেস্টে ১৭২০ রান করেছেন। গড় ২২.০৫। স্টাইক রেট ৩৮.১৪। ওয়ানডেতেও তার স্ট্রাইকরেট মাঝারি, ৫১.৮৯। ৫৯ ম্যাচে ২৩.৮৫ গড়ে রান করেছেন ১৩১২। একটিও সেঞ্চুরি নেই। টেস্টে একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে। ওয়ানডেতে দশটা হাফ সেঞ্চুরি থাকলেও তা দর্শক মনে খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মন্থর ব্যাটিংয়ের কারণে বরাবর সমালোচিত হয়েছেন জাভেদ ওমর। অথচ ওপেনিংয়ে নেমে তিনি ধৈর্য ধরে না দাঁড়ালে টেস্টে বাংলাদেশের বিপর্যয়ের ইতিহাস আরও লম্বা হতো। সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে একবার জাভেদ বলেছিলেন, ‘আমি জানি দর্শকদের বেশির ভাগই আমার ব্যাটিং পছন্দ করত না। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, কখনো নিজের জন্য খেলিনি, দলের জন্য খেলতাম। আমরা শুরুতে কী সংগ্রামই না করেছি। দ্রুতই আমাদের ৪/৫টা উইকেট পড়ে যেত। শেষের দিকে (খালেদ মাসুদ) পাইলটরা যা একটু খেলে মোটামুটি কিছু একটা স্কোর করত। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছি, টেস্ট ক্রিকেট অন্য এক খেলা। এখানে আপনি মেরে খেলে ৬০ বলে ৬০ করলে হাততালি পাবেন। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে, কিন্তু দলের লাভ হবে না। টেস্টে রানের চেয়ে বলের খেলা বেশি। এখানে সেশনের হিসাব আছে, প্রতি দিন ৯০ ওভারের হিসাব আছে। ওই ৬০ রানটাই যদি আপনি ১০০ বলে করে দিতে পারেন, তাতে বেশি উপকার।’
ঘরোয়া ক্রিকেটে ১০২টা ফার্স্টক্লাস ম্যাচ খেলেছেন জাভেদ ওমর। ২৮.৭৭ গড়ে ৫৩৫৩ রান করেছেন। ১০টা সেঞ্চুরিও আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তুলনায় ফার্স্টক্লাসে রানটা দ্রুতই তুলতেন। একবার অভিমানের সুরে বলেছিলেন জাভেদ, ‘দশর্কদের নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমার কষ্ট হয়, যখন ক্রিকেট বোঝে এমন কেউ আমাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে কি আমি মেরে খেলিনি? আমি কি মেরে খেলতে পারতাম না? সেই সময়ে আমার স্ট্রাইক রেট বাকিদের তুলনায় কতটা খারাপ?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সমসাময়িক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেটের তুলনায় খুব পিছিয়ে নেই জাভেদ ওমর।
অভিযোগ আছে জাভেদ ওমর মারার বলও মারতেন না। তিনি সেই অভিযোগ দুই-একবার মেনেও নিয়েছেন। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৮ বলে ৪৩ রান করেছিলেন। ৩৪০ মিনিট ব্যাটিং করার পরও ফিফটি না-করতে পারার নজির টেস্ট ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ২০১৫ সালে দিল্লি টেস্টে ৩৪৫ মিনিট ব্যাট করে ঠিক ৪৩ রানই করেছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স, যার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৫৪.৫১। যা দেখে জাভেদ বলেন, ‘ব্যাট ক্যারি করার রেকর্ডেও আমার নাম পাবেন। কিন্তু এটা কিছুই না, আমি সব সময়ই বলি, আমার জীবনের সেরা ইনিংস হচ্ছে ওই ৪৩। আমার স্পষ্ট মনে আছে, চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার আগে আমাদের টিম মিটিং হয়েছিল। অনেকেই বলছিল, ওভারে তিন করেও লাগে না, আমাদের চেজ করা উচিত। আমি হাত তুলে বললাম, ওটা করতে গেলেই আমরা বিপদে পড়ব। দ্রুত প্রথম কয়েকটা উইকেট পড়ে গেলে আর কিছুতেই এই ম্যাচ বাঁচানো যাবে না। আমরা সিরিজটাই আর জিততে পারব না। চতুর্থ-পঞ্চম দিনে ব্যাটিং করা অত সহজ না। টেস্টের পঞ্চম দিনে ব্যাটিং করার অভিজ্ঞতা তখন ওরকম ছিলই না। আমি বলেছিলাম, শুরুতে আক্রমণ নয়, বরং সাবধানে খেলতে হবে। সাবধানে খেলা মানে কিন্তু রান না-করা নয়। ঢাকা টেস্টের সেই ইনিংসে, অনেক হাফ ভলি, অনেক শর্ট পিচ বলও আমি মারিনি। মারলে চার পেতাম, দর্শকের তালি পেতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, চারটা পাওয়ার চেয়ে একটা বল নিরাপদে পার করে দেওয়া বেশি জরুরি।’
প্রায় দেড় দিন ব্যাট করে ঢাকা টেস্ট ড্র করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন জাভেদ ওমর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই টেস্টে ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করেছিলেন নাফিস ইকবাল। সেই সেঞ্চুরির জৌলুশে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে জন্ম নেওয়া গুল্লু (স্থানীয়রা আদর করে তাকে এই নামেই ডাকে) হারিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিও কেউ তার মূল্য বোঝেনি। আজ ৪৪তম জন্মদিনেও অনেকেই তার মূল্য বুঝবে বলে মনে হয় না।
শেয়ার করুন
ক্রীড়া ডেস্ক | ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

কচ্ছপ গতিতে ব্যাট করতেন বলে জাভেদ ওমর কোনোদিন পপুলার চয়েস ছিলেন না। অথচ তার সংগ্রামী ইনিংস দলকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাত। ২০০১ সালে বুলাওয়ে টেস্টে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেছিলেন। ওটা ছিল বিদেশের মাটিতে খেলা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট। যেখানে ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিংয়ের রেকর্ড গড়েন জাভেদ ওমর। অপরাজিত ছিলেন ৮৫ রানে।
বাংলাদেশের হয়ে ৪০ টেস্টে ১৭২০ রান করেছেন। গড় ২২.০৫। স্টাইক রেট ৩৮.১৪। ওয়ানডেতেও তার স্ট্রাইকরেট মাঝারি, ৫১.৮৯। ৫৯ ম্যাচে ২৩.৮৫ গড়ে রান করেছেন ১৩১২। একটিও সেঞ্চুরি নেই। টেস্টে একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে। ওয়ানডেতে দশটা হাফ সেঞ্চুরি থাকলেও তা দর্শক মনে খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মন্থর ব্যাটিংয়ের কারণে বরাবর সমালোচিত হয়েছেন জাভেদ ওমর। অথচ ওপেনিংয়ে নেমে তিনি ধৈর্য ধরে না দাঁড়ালে টেস্টে বাংলাদেশের বিপর্যয়ের ইতিহাস আরও লম্বা হতো। সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে একবার জাভেদ বলেছিলেন, ‘আমি জানি দর্শকদের বেশির ভাগই আমার ব্যাটিং পছন্দ করত না। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, কখনো নিজের জন্য খেলিনি, দলের জন্য খেলতাম। আমরা শুরুতে কী সংগ্রামই না করেছি। দ্রুতই আমাদের ৪/৫টা উইকেট পড়ে যেত। শেষের দিকে (খালেদ মাসুদ) পাইলটরা যা একটু খেলে মোটামুটি কিছু একটা স্কোর করত। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছি, টেস্ট ক্রিকেট অন্য এক খেলা। এখানে আপনি মেরে খেলে ৬০ বলে ৬০ করলে হাততালি পাবেন। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে, কিন্তু দলের লাভ হবে না। টেস্টে রানের চেয়ে বলের খেলা বেশি। এখানে সেশনের হিসাব আছে, প্রতি দিন ৯০ ওভারের হিসাব আছে। ওই ৬০ রানটাই যদি আপনি ১০০ বলে করে দিতে পারেন, তাতে বেশি উপকার।’
ঘরোয়া ক্রিকেটে ১০২টা ফার্স্টক্লাস ম্যাচ খেলেছেন জাভেদ ওমর। ২৮.৭৭ গড়ে ৫৩৫৩ রান করেছেন। ১০টা সেঞ্চুরিও আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তুলনায় ফার্স্টক্লাসে রানটা দ্রুতই তুলতেন। একবার অভিমানের সুরে বলেছিলেন জাভেদ, ‘দশর্কদের নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমার কষ্ট হয়, যখন ক্রিকেট বোঝে এমন কেউ আমাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে কি আমি মেরে খেলিনি? আমি কি মেরে খেলতে পারতাম না? সেই সময়ে আমার স্ট্রাইক রেট বাকিদের তুলনায় কতটা খারাপ?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সমসাময়িক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেটের তুলনায় খুব পিছিয়ে নেই জাভেদ ওমর।
অভিযোগ আছে জাভেদ ওমর মারার বলও মারতেন না। তিনি সেই অভিযোগ দুই-একবার মেনেও নিয়েছেন। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৮ বলে ৪৩ রান করেছিলেন। ৩৪০ মিনিট ব্যাটিং করার পরও ফিফটি না-করতে পারার নজির টেস্ট ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ২০১৫ সালে দিল্লি টেস্টে ৩৪৫ মিনিট ব্যাট করে ঠিক ৪৩ রানই করেছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স, যার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৫৪.৫১। যা দেখে জাভেদ বলেন, ‘ব্যাট ক্যারি করার রেকর্ডেও আমার নাম পাবেন। কিন্তু এটা কিছুই না, আমি সব সময়ই বলি, আমার জীবনের সেরা ইনিংস হচ্ছে ওই ৪৩। আমার স্পষ্ট মনে আছে, চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার আগে আমাদের টিম মিটিং হয়েছিল। অনেকেই বলছিল, ওভারে তিন করেও লাগে না, আমাদের চেজ করা উচিত। আমি হাত তুলে বললাম, ওটা করতে গেলেই আমরা বিপদে পড়ব। দ্রুত প্রথম কয়েকটা উইকেট পড়ে গেলে আর কিছুতেই এই ম্যাচ বাঁচানো যাবে না। আমরা সিরিজটাই আর জিততে পারব না। চতুর্থ-পঞ্চম দিনে ব্যাটিং করা অত সহজ না। টেস্টের পঞ্চম দিনে ব্যাটিং করার অভিজ্ঞতা তখন ওরকম ছিলই না। আমি বলেছিলাম, শুরুতে আক্রমণ নয়, বরং সাবধানে খেলতে হবে। সাবধানে খেলা মানে কিন্তু রান না-করা নয়। ঢাকা টেস্টের সেই ইনিংসে, অনেক হাফ ভলি, অনেক শর্ট পিচ বলও আমি মারিনি। মারলে চার পেতাম, দর্শকের তালি পেতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, চারটা পাওয়ার চেয়ে একটা বল নিরাপদে পার করে দেওয়া বেশি জরুরি।’
প্রায় দেড় দিন ব্যাট করে ঢাকা টেস্ট ড্র করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন জাভেদ ওমর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই টেস্টে ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করেছিলেন নাফিস ইকবাল। সেই সেঞ্চুরির জৌলুশে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে জন্ম নেওয়া গুল্লু (স্থানীয়রা আদর করে তাকে এই নামেই ডাকে) হারিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিও কেউ তার মূল্য বোঝেনি। আজ ৪৪তম জন্মদিনেও অনেকেই তার মূল্য বুঝবে বলে মনে হয় না।