
সমর্থনের কারণে বিভক্তি থেকে যায়। তবুও পুরো বিশ্ব যেন এক হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের শক্তি এটাই। এর বিশেষত্ব এজন্যই আলাদা। রবিবার রাতে কাতার-ইকুয়েডর ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছে ফুটবলের মহাযজ্ঞ। তবে উপদ্বীপের উন্মাদনাটা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই, যা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। এই উপত্যকার সমর্থকদের চোখ থাকবে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। যেখানে আজ মাঠে নামছে বিশ্বকাপের অভিষেক আসরের রানার্সআপ আর্জেন্টাইনরা। ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসিরা মুখোমুখি হবেন এশিয়ার আরেক দল সৌদি আরবের।
যেকোনো প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক দলের কাছে প্রথম ম্যাচ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবারই লক্ষ্য থাকে এই ম্যাচ জিতে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকা, বাকি পথটা সহজ করা। আজ আর্জেন্টিনারও সেই লক্ষ্য থাকবে। সৌদি আরবকে হারিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
চলতি শতাব্দীর পাঁচ বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরের প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। ২০০২ সাল ছাড়া প্রতিটিতেই তারা নকআউট পর্ব খেলেছে। সেবার বাতিস্তা-সেমিওয়ালাসহ তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দলটি গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। তবে বাকি আসরগুলোর একটিতে সেকেন্ড রাউন্ড, দুটিতে কোয়ার্টার ফাইনাল ও একটিতে ফাইনাল খেলেছে তারা।
ফুটবল বিশ্বকাপের অভিষেক আসর হয়েছিল ১৯৩০ সালে। উরুগুয়ের রাজধানী মোন্তেভিদেওতে এস্তাদিও পসিটস মাঠে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলেছিল আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে তারা শুভ সূচনা করেছিল। সে আসরে তারা উঠেছিল ফাইনালে। যদিও উরুগুয়ের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরের আসর ১৯৩৪ সালে ইতালির বোলোনিয়ায় সুইডেনের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে তারা। সে ম্যাচে তারা ৩-২ গোলে হেরে যায়।
পরের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ফিফার সভায় ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হয় ফ্রান্স। আয়োজক হতে না পারার আক্ষেপে তারা ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ইউরোপে বিশ্বকাপ হওয়াতে উরুগুয়েও সে আসরে অংশ নেয়নি। এরপর পৃথিবীতে নেমে আসে যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়নি।
আর্থিক বনিবনা না হওয়াতে আর্জেন্টিনার অনেক খেলোয়াড় দেশ ছেড়েছিলেন। ফলে তাদের জাতীয় দলটি হয়ে পড়ে দুর্বল। কিন্তু খর্বশক্তির দল নিয়ে খেলে লজ্জায় পড়তে চায়নি দেশটির ফেডারেশন। এছাড়া ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশনের সম্পর্কেরও অবনতি হতে থাকে। তাই ১৯৫০ বিশ্বকাপ থেকেও নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় তারা।
বিশ্বকাপ হচ্ছে অথচ আর্জেন্টিনা নেই! আকাশি-নীল দলটি ছাড়া বিশ্বকাপ কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একটু অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে, প্রথম বিশ্বকাপের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত টানা তিনটি আসরে অংশই নেয়নি! ১৯৫০ তো বটেই, ১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপও বর্জন করেছিল আর্জেন্টাইন। তবে ১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দিয়ে ৩৪ বছর পর ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসে তারা।
তবে ১৯৫৮ সালের প্রত্যাবর্তনটা তারা রাঙাতে পারেনি। ৮ জুন নিজেদের প্রথম ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে যায়। শুধু তাই নয়! সেবার তারা গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। পরের আসরে চিলিতে ১৯৬২ সালে নিজেদের প্রথম ম্যাচ তারা খেলে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে। সেদিন তারা ১-০ গোলে জিতে শুভ সূচনা করেছিল। কিন্তু এ বছরও তারা গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়।
তবে ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। সে আসরে তারা নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলেন স্পেনের বিপক্ষে ১৩ জুলাইয়ের সেই ম্যাচে ২-১ গোলে জিতে তারা শুভ সূচনা করেছিল। যদিও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে আবার তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
১৯৭৪ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। শুরুটাও খুব ভালো বলা যায় না। ইতালির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিল। নিজেদের সোনালি সময়টা যারা হেলা আর অহমের কারণে বিশ্বকাপ নামক লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলে বিদায় করেছে, সেই আকাশি-নীল জার্সিধারী আর্জেন্টাইনরা ১৯৭৮ সালে এসে শিরোপার স্বাদ পায়। সেবার নিজেদের প্রথম ম্যাচে হাঙ্গেরিকে ২-১ গোলে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছিল।
শিরোপা জয়ের পরের আসরে ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে আবার দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। সেবার বেলজিয়ামের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের। তবে ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার হাত ধরে ফের শিরোপা যায় আর্জেন্টিনাতে। মেক্সিকোতে সেবার দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-১ গোলে গুঁড়িয়ে বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে তারা। সেবার একই ম্যাচে ‘হ্যান্ড অব গড’ ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ দেখেছিল ফুটবলবিশ্ব। যার মাধ্যমে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ফুটবল ঈশ্বর।
১৯৯০ সালে ফের বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। সেবার নিজেদের প্রথম ম্যাচটাও অবশ্য ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলের হার দিয়ে শুরু করেছিল।
পরের আসর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে গ্রিসকে ৪-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে টুর্নামেন্টে শুভ সূচনা করেছিল। কিন্তু রাউন্ড ১৬ থেকেই তাদের বিদায় নিতে হয়েছিল।
ফ্রান্সে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জাপানকে ১-০ গোলে হারিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আর্জেন্টিনার। তবে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়। পরের আসরে জাপান-কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে ২০০২ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারায় সেমিওয়ালার দল। কিন্তু গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
জার্মানিতে ২০০৬ সালে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আইভেরি কোস্টের বিরুদ্ধে ১-০ গোলের জয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ২০১০ বিশ্বকাপেও এই জার্মানির কাছেই হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। তবে নাইজেরিয়াকে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলে হারায় তারা।
ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে শিরোপাবঞ্চিত হয় আর্জেন্টিনা। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানের জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপ মিশন। তবে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল তারা রাশিয়াতে। যার প্রমাণ তাদের ফলাফলে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে তারা। ফ্রান্সের কাছে হেরে রাউন্ড ১৬ থেকে বিদায় নেয়।
তবে কোপা আমেরিকা আর ফিনালিসসিমা জয়ের পর আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে আছে আর্জেন্টিনা। ঘুচিয়েছে তাদের ২৮ বছরের শিরোপা-খরা। এবার সুযোগ বিশ্বজয়ের। অঘটন না হলে যার শুরুটা হতে পারে লুসাইলে সৌদি আরবের বিপক্ষে জয় দিয়ে।
ডি গ্রুপের প্রথম ম্যাচে আজ অসম লড়াই। হ্যাঁ, খেলায় নিজের দিনে হার-জিত যেকোনো দিকে গড়াতে পারে। তবে ম্যাচের আগে পারা না পারার হিসাব তো করাই যায়। সেদিক থেকে আজ এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে ডেনমার্কের সামনে আফ্রিকান তিউনিসিয়ার জোর অনেক কমই বলতে হয়। ডেনিসরা বরাবরই ইউরোপিয়ান দ্বিতীয় শক্তির দল। তবে গত ইউরো থেকে যেন নতুন উদ্যমে জেগে উঠে তারাও জায়ান্টদের কাতারে জায়গা করে নিয়েছে। দলটিতে একঝাঁক তারকার উপস্থিতি নেই সত্যি, তবে দলগত শক্তিতে কমতি নেই কোনো। আর সেই ধারায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কোনো ম্যাচ না জিতে কাতারে আসা ডেনিসদের আজ ফেভারিট ধরতেই হয়। মালির বিপক্ষে আফ্রিকান বাছাইয়ের শেষ ধাপে দুই লেগের লড়াইয়ে কোনোমতে ১ গোলের অ্যাগ্রিগেটে জেতা তিউনিসরা অপেক্ষায় থাকবে একটি অঘটনের।
বলা হচ্ছে এই ম্যাচের কথা। অথচ ডেনিস কোচ কাসপার হুলমান্দ হুঙ্কার ছাড়লেন বিশ্বকাপ জেতার। কাল ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এই কোচের উক্তি আলোচনা ছড়াল বেশ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইরে এই আসরে স্পষ্ট ফেভারিটের নাম নেই। অনেকটা উন্মুক্ত বিশ্বকাপে তাই হাত ছোঁয়াতে চায় ডেনমার্ক। হুলমান্দ জানান, ‘আমাদের স্বপ্ন কোনো কিছু জেতা। তাই আপনি যখন এমন বিশ্বকাপের মতো কোনো টুর্নামেন্টে যাবেন তখন আমি বলব আমার এই গ্রুপ ফুটবলারদের কিছু জেতার সামর্থ্য আছে। সেই ‘কিছু’ মানে কিন্তু সব কিছুই।’
গত ইউরোয় সেমিফাইনাল খেলে ডেনমার্কের বিশ্বাস বড় হয়েছে। এতটাই যে বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচের ৯ ম্যাচ জিতেছে তারা। এই সময়ে বিপক্ষের জালে ৩০ গোল দিলেও নিজেরা হজম করেছে মাত্র ৩ গোল। আর শেষ ৮ ম্যাচে কোনো গোল খায়নি ডেনমার্ক। এই সাফল্য বিশ্বকাপে ডেনিসদের আরও উচ্ছ্বাস দিচ্ছে। সঙ্গে ইউরোর পর এই প্রথম বড় কোনো আসরে ফিরে আসা ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন দলের শক্তি বাড়াচ্ছেন। গত ইউরোতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন এরিকসেন। এই বিশ্বকাপে পুরো ফিট হয়ে উঠেছেন। সব মিলিয়ে হুলমান্দের শিরোপা জয়ের স্বপ্নটা তাই বড় হয়েছে একটু বেশিই।
বড় স্বপ্ন সত্যি করতে গ্রুপসেরা হতে হবে ডেনমার্ককে। এই পথে বড় বাধা ফ্রান্স। তবে বর্তমান বিশ্বজয়ীদের হারানোর নিকটঅতীত আছে ডেনিসদের। নেশন্স লিগের লড়াইয়ে বিশ্বকাপে গ্রুপসঙ্গী ফ্রান্সকে মুখোমুখি দেখায় দুবারই হারিয়েছে তারা। তাই আরও আত্মবিশ্বাসী হুলমান্দ বলেন, ‘আমরা ফেভারিট কিনা যদি জিজ্ঞাস করেন সবাই বলত না। আমিও তাই বলব। কিন্তু আমরা যেকোনো দিন যেকোনো দলকে হারিয়ে দিতে পারি। আমাদের আত্মবিশ্বাসটাই এমন। আমাদের দলটা সব কিছু জিততে প্রস্তুত। আর আপনি যদি বড় কিছু জিততে চান তাহলে এই নিশ্চয়তা থাকতেই হবে।’
ডেনমার্কের সঙ্গে তিউনিসিয়ার পূর্ব লড়াই মাত্র একবার। তাও ২০ বছর আগে। ২০০২ সালের প্রীতি ম্যাচে ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল ডেনমার্ক। ওই জয়ের রেশ ডেনিসদের যেমন নেই তেমনি হারের হতাশাও নেই তিউনিসিয়ার। লম্বা বিরতি পর নতুন দেখায় ম্যাচটি হবে নতুনের মতোই। তাতে তিউনিসিয়ার স্বপ্ন খুব একটা নেই। এক যদি না তারা অঘটন ঘটাতে পারে। সেই সম্ভাবনাটাও কম তিউনিসদের। আফ্রিকান বাছাইপর্বের শেষ রাউন্ডে মালির বিপক্ষে জিততে বেগ পেতে হয় দলটির। দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ অ্যাগ্রিগেটে জিতলেও সেই গোলটি ছিল আত্মঘাতী। প্রথম লেগে মালির মুসা সিসোকো ভুল না করলে তিউনিসিয়া এই বিশ্বকাপের টিকিটও পেত না।
তবে তিউনিসিয়ার হারানোর কিছু নেই। বরং না হারার চাপে থাকবে ডেনমার্কই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অঘটন উপহার দিতে চাইবে। হুলমান্দরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখলে এই অঘটন এড়াতে হবে।
আমার জীবনে, আমার টাইমিং সবসময়ই সেরা। অন্যরা কে কী ভাববে, তা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি যখন চাই, তখন কথা বলি। খেলোয়াড়রা অনেক বছর ধরে আমাকে ভালোভাবে চেনে
সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। যা বলার, বিশ্বকাপ-ভাবনা আর পর্তুগাল ক্যারিয়ার নিয়েই বলার কথা। কিন্তু কাতারে আসার পরও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ঘিরে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-বিষয়ক আলোচনা।
গত সপ্তাহে পিয়ার্স মরগানকে দেওয়া রোনালদোর সাক্ষাৎকারে ম্যানইড কোচ এরিক টেন হাগ থেকে শুরু করে ক্লাবের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষ গ্লেজার পরিবারকে নিয়ে বিস্ফোরক সব মন্তব্য করেছেন পর্তুগিজ তারকা। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বলছে, ক্ষুব্ধ ইউনাইটেড রোনালদোকে আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে দেখতে রাজি নয়। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপাতত রোনালদোর ওপরই ছেড়ে দিয়েছে ক্লাবটি।
বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামার আগে রোনালদোকে পাওয়া যাবে না বলে ধারণা ছিল অনেকের। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে আজ দোহায় পর্তুগালের হয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন রোনালদো। সেখানে সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে প্রশ্নে তার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমার জীবনে, আমার টাইমিং সবসময়ই সেরা। অন্যরা কে কী ভাববে, তা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি যখন চাই, তখন কথা বলি। খেলোয়াড়রা অনেক বছর ধরে আমাকে ভালোভাবে চেনে। তারা জানে আমি কী ধরনের মানুষ। এই দলটি উচ্চাকাক্সক্ষী এবং জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। তারা লক্ষ্যে স্থির। তাই আমি নিশ্চিত, (ওই সাক্ষাৎকারে) দলের পরিবেশ বদলাবে না এবং সবার লক্ষ্য ও মনোযোগ অটুট থাকবে।’
যেকোনো ধরনের আক্রমণের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আছে জানিয়ে ৩৭ বছর বয়সী এই তারকা যোগ করেন, ‘আমি যখন চাই, কথা বলি। আমি বুলেটপ্রুফ, লোহার পোশাক পরে আছি।’ পর্তুগাল দল কাতারে পা রাখার আগে ও পরে রোনালদো-বিষয়ক জিজ্ঞাসার মুখে পড়েছিলেন ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বার্নার্দো সিলভা ও রুবেন নেভেসরা। বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত পাঁচবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী, ‘ক্রিশ্চিয়ানো সম্পর্কে অন্যদের জিজ্ঞেস করবেন না। ওদের পর্তুগাল আর তাদের নিজেদের নিয়েই জিজ্ঞেস করুন।’
তার আশপাশে জড়িত সবই বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মন্তব্য করে রোনালদো দাবি করেন, ব্রুনোসহ পর্তুগাল দলের কারও সঙ্গেই তার দূরত্ব নেই, ‘টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এ ধরনের বিতর্ক সব সময়ই হয়। কিন্তু ব্রুনোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই চমৎকার। আসলে ক্রিশ্চিয়ানোর চারপাশে থাকা সবকিছু নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়। কিন্তু আমি বলছি, দলের সবার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক।’
দুই লিওনেলে তাকিয়ে আর্জেন্টিনা। লিওনেলদ্বয় সফল হলেই ঘুচবে ৩৬ বছরের অপেক্ষা। গত বছর কোপা আমেরিকা জিতিয়ে যে দুজন ঘুুচিয়েছিলেন ২৮ বছরের শিরোপা খরা। তারাই পারেন দেশকে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ এনে দিতে। একজন লিওনেল মেসি, আরেকজন লিওনেল স্কালোনি। একজন বহু বছর ধরেই আলবিসেলেস্তেদের স্বপ্নসারথী। অন্যজন খুব অল্প সময়ে কেড়ে নিয়েছেন আস্থার আসন। দুই লিওনেলকে ঘিরে বিশ্বজয়ের মিশন আর্জেন্টিনা শুরু করবে আজ। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব। এ মাঠেই হোক রূপকথার শুরু। ১৮ ডিসেম্বর বিজয় সংগীত গেয়ে এখানেই নিশ্চয় রূপকথার শেষটা করতে চাইবেন মেসিরা। বলে দেওয়াই যায় আরবকে এক ইঞ্চি ছাড় দেওয়ার মনোবৃত্তি দেখা যাবে না আর্জেন্টাইনদের মধ্যে। স্বপ্ন জয়ের অভিযান বলেই প্রয়োজনে ধারণ করতে হবে নিষ্ঠুর রূপ।
আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির শুরুটা সেই ২০০৫ সাল থেকে। বাঁ পায়ের জাদুকর সেই থেকে মায়াবী জাদুতে সম্মোহিত করে রেখেছেন সারা দুনিয়াকে। বার্সেলোনা একাডেমিতে বেড়ে ওঠা, তার আলোতেই স্প্যানিশ ক্লাবটি জিতেছে সম্ভাব্য সবকিছুই। ক্লাবের হয়ে মেসিও হীরে-জহরতে গেঁথেছেন সাফল্যের মালা। তবে কেন যেন আকাশি জার্সিতে হচ্ছিল না। সাফল্যের খুব কাছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। তা বিশ্বকাপ বলুন কিংবা কোপা আমেরিকা। একটা সময় মনে হচ্ছিল মেসি খেলা দিয়ে হৃদয় জিতবেন ঠিকই, তবে শিরোপা জেতা হবে না। কোনো শিরোপাই নয়। সেই মনে হওয়াটা ভুল প্রমাণিত হয় অভিষেকের ঠিক ১৬ বছর পর, গত বছর। ব্রাজিলকে তাদের মাঠে ফাইনালে হারিয়ে কোপা আমেরিকা ওঠে ফুটবলের বরপুত্রের হাতে। সেই আসরে আর্জেন্টিনার ১২ গোলের ৯টিতেই ছিল তার অবদান। করেছিলেন চার গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন পাঁচটি। সে বছরই ওয়েম্বলিতে ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কনমেবল-উয়েফা কাপ অব চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতে আর্জেন্টিনা। সেই ১৯৯৩ সালে সর্বশেষ কোপা জয়ের ২৮ বছর পর জোড়া শিরোপায় মেসির যেমন অবদান, কোচ স্কালোনির অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জর্জ সাম্পোওলির সহকারী হয়ে ২০১৬-তে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে পা রাখা। ২০১৮-তে যখন হেড কোচের দায়িত্ব পান, তখন কম সমালোচনা সইতে হয়নি। খোদ ডিয়েগো ম্যারাডোনা এমন একজনের হাতে দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনকে। সে সময়ের সমালোচনাগুলো মুখ বুজে সয়ে যাওয়া স্কালোনি একটা পন্থাই নিয়েছিলেন। মেসিকে কেন্দ্রে রেখে পুরো দলটাকে একটা পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ৪৪ বছর বয়সী কোচও বুঝেছিলেন মেসি সুখী থাকলে দলও যেমন খুশি, পুরো আর্জেন্টিনাই খুশি।
মেসিকে ভালো রাখতে জানেন বলেই দুই লিওনেলে রসায়নটা হয়েছে চমৎকার। সেই রসায়নেই এবার সময় এসেছে বিশ্বসেরা হওয়ার। আর্জেন্টিনা দোহায় পা রেখেছে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার অনন্য এক রেকর্ড নিয়ে। আজ সৌদি আরবকে হারালে তারা ছুঁয়ে ফেলবে ইতালির ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড। আর গ্রুপের পরে ম্যাচে মেক্সিকোকে হারালে রেকর্ডটা হয়ে যাবে এককভাবে তাদের। এমন ছন্দে থাকা আর্জেন্টিনা যদি এবার বিশ্বকাপ না জেতে, তাহলে অন্যায় হবে। ঘোরতর অন্যায়। এ যে মেসির সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ। বয়স তো আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে স্কালোনি তা মানছেন না। কোচ মেসিকে ২০২৬ বিশ্বকাপেও দেখতে চান। আমেরিকা-কানাডা বিশ্বকাপে মেসি থাকবেন কি না, এ নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর মানে নেই। আগে তো কাতার মিশনটা ঠিকঠাক শেষ করতে হবে।
তবে ঠিকঠাক কাজের পরিকল্পনা করতে গিয়েই স্কালোনি পড়েছেন বিপাকে। এই সুখী আর্জেন্টিনার মাঝমাঠের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন জিওভানি লো সেলসো ও রদ্রিগো ডি পল। সেই ২০১৯ থেকে। বিশ্বকাপ শুরুর আগ মুহূর্তে লো সেলসো হ্যামস্ট্রিং চোটে পড়ে ছিটকে যান। এতদিন ডি পল ও লো সেলসো মাঝমাঠ থেকে আর্জেন্টিনার খেলাটা গোছাতেন। সুবাদে মেসি অনেকটা স্বাধীন হয়ে খেলার সুযোগ পেতেন। কখনো ওপরে আবার কখনো একটু নেমে এসে জায়গা করে আক্রমণে উঠতেন। কখনো গোল করতেন, কখনো করিয়ে শান্তি পেতেন। তাই লো সেলসোর না থাকাটা বড় দুশ্চিন্তা। এটা বাদ দিয়ে এই আর্জেন্টিনার দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজ লো সেলসোর জায়গায় মাঝমাঠে ডি পলের সঙ্গী হতে দেখা যেতে পারে লিয়ান্দ্রো পারেদেসকে। ৪-৩-৩ ফরম্যাটে নাম্বার নাইন পজিশনে লাউতারো মার্তিনেজকে রেখে দু’পাশে খেলবেন মেসি ও অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। রক্ষণে স্কালোনি আস্থা রাখতে পারেন নাহুয়েল মলিনা, নিকোলাস ওতামেন্দি, ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো ও নিকোলাস তাগলিয়াফিকোর ওপর। মাঝমাঠে ডি পল ও পারেদেসকে সহায়তা দেবেন দিগো রড্রিগেজ। আর দুর্গ সামলানোর জন্য তো এমি মার্তিনেজ আছেনই।
ওদিকে সৌদি আরবের মনে শান্তি নেই। সেটা কেবল প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনার বলে নয়। পাশের ছোট্ট দেশ কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করে একটা বড় শিক্ষাই দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মোড়লদের। তারপর বেরসিক ভাগ্য প্রথম ম্যাচেই জুটিয়ে দিয়েছে মেসির দলকে। তাই পরের ধাপে যাওয়ার বড় আশা করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে ফরাসি কোচ হার্ভে রেনাঁর শিষ্যদের। তারপরও অভ্যস্ত আবহাওয়ায় খেলা বলেই যা একটু সুবিধে। বড়জোর দলের মূল শক্তির জায়গা রক্ষণভাগকে জমাট করে মেসি-মার্তিনেজ, ডি মারিয়াদের রুখে দিতে পারলেই বড় পাওয়া হবে আরবদের জন্য।
শক্তি, ঐতিহ্য, ফর্ম বিবেচনায় বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে আজ বড় জয়েই বিশ্বকাপ শুরু করতে চাইবে আর্জেন্টিনা। কাল পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, হালকা চোট থেকে সেরে মেসিও প্রস্তুত মাঠে নামতে। নামবেন না-ই বা কেন? এই বিশ্বকাপ যে অনেক কিছু পাওয়ার বিশ্বকাপ। এই শিরোপা না জিতলে যে কখনই আর্জেন্টিনা মেসির আর্জেন্টিনা হবে না। সেটা হয়ে থাকবে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। লিওনেলদের রূপকথার যাত্রাটা তাই শুরু হোক জয়ের মুকুট পরে। যেভাবে তারা কোপা জিতে হাসি ফিরিয়েছিলেন ভক্তদের মুখে, ঠিক সেভাবেই যেন লুসাইল স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বর শেষ হাসিটা হাসেন লিওনেল জুটি।
কাতার পৌঁছে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। অনেক কিছুই বদলে গেছে। নতুন বানানো সুন্দর সুন্দর সব স্টেডিয়াম, হোটেল, যাতায়াত ব্যবস্থা... সবকিছুই অনেক উন্নত হয়েছে। আমি এখানে ২০১১ আর ২০১৫ সালে এসেছিলাম। বিশ্বকাপ উপলক্ষে এরকম একটা বড় পরিবর্তন দেখতে পাব, সেটাই স্বাভাবিক। আর এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে কাতারের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে কারণেই। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে কাতার নিজেদের পুরোপুরি বদলে ফেলেছে। কাতার হয়ে উঠেছে আরও সুন্দর, আরও উন্নত। এই শহরে এসে আমি অদ্ভুত একটা শক্তি অনুভব করতে পারছি। এই নিয়ে তৃতীয়বার এলাম এবং নতুন এই দোহা দেখে সত্যিই চমকে গেছি। আমি ভেবেছিলাম শহরটা বোধহয় খুব বেশি বদলাবে না, তবে কাতার আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। একবার এখানে পা দিলেই টের পাওয়া যাবে এই দেশ কতটা বদলে গেছে। আমি আশা করব বিশ্বকাপ দেখতে আসা সবাই আয়োজনটা উপভোগ করবে।
আমার মনে হয় আর্জেন্টিনা অন্যতম ফেভারিট হয়েই কাতারে পা রেখেছে, আরও দুই ফেভারিট হচ্ছে ব্রাজিল ও ফ্রান্স। তবে এই দলগুলোর বাইরেও আরও অনেকগুলো ভালো দল আছে যারা টুর্নামেন্টে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য লড়াই করবে। এই বিশ্বকাপটা হবে কঠিন বিশ্বকাপ। প্রতিপক্ষ সহজ হোক বা দুর্বল, বিশ্বকাপের প্রথম দুটো ম্যাচ যে কোনো দলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা যে কোনো দলকেই তাদের শক্তিশালী দিক আর দুর্বল দিক খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। এই দুটো ম্যাচ যে কোনো দলকেই মাঠটা কেমন, পরিবেশটা কেমন সেটা বুঝতে সহায়তা করবে আর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারবে। সাবধানী খেলে গ্রুপ পর্বটা সহজে পার হও, পরের পর্ব থেকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেল।
এই আর্জেন্টিনা দলটার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা আমার কাছে মনে হয় দলের শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ। দলে একঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। মেসির দলটা কোনো ম্যাচ না হেরেই বিশ্বকাপে খেলতে এসেছে। কোচ লিওনেল স্কালোনি অনেকদিন ধরেই এই খেলোয়াড়দের চেনে এবং জানে।
তবে তাকে সতর্ক থাকতে হবে কারণ অনেক সময় গোটা ম্যাচ ভালো খেলেও শেষ মুহূর্তে দুর্ভাগ্যজনক কোনো কারণে ম্যাচ হারতে হতে পারে। সব খেলোয়াড়ই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল মৌসুমের মাঝপথে জাতীয় দলে এসে যোগ দিয়েছে। এটা খেলোয়াড়দের খুব সাহায্য করবে কারণ ফ্রান্সের ফুটবল লিগ অনেক কঠিন। বিশ্বকাপে রেফারিরা অনেক বেশি কড়া। প্রতিপক্ষও কঠিন। মেসির অবশ্য এরই মধ্যে সব কিছু সহ্য করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
আমার আর আমার সব সতীর্থের জন্য, ১৯৮৬’র বিশ্বকাপটা ছিল খুবই কঠিন। আমরা যখন মেক্সিকো পৌঁছাই তখন খুব চাপের মধ্যে ছিলাম। তবে ১৯৯০’র বিশ্বকাপটা আমাদের কাছে ছিল অনেক বেশি আবেগের। আমরা চোট-জর্জর হয়ে বিশ্বকাপে পৌঁছেছিলাম। আমরা ফাইনালে উঠলাম আর আমরা অন্যায্যভাবে হেরে গেলাম। যেসব খেলোয়াড়কে আমরা সেমিফাইনালে আসতে আসতে হারিয়েছি, কোনো সন্দেহ নেই তাদের ফাইনালে পেলে গল্পটা অন্য রকম হতে পারত। তবে মেসি আর তার দলের পরিস্থিতিটা আলাদা। তারা এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তাদের ওপর খুব বেশি চাপ নেই, খুব বেশি খেলোয়াড়ের চোটও নেই।
মেসি, এই বিশ্বকাপটা ম্যারাডোনার জন্য জিতে নাও আর শিরোপাটা তাকে উৎসর্গ করো। এটাই হতে পারে ম্যারাডোনার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে খেলাটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্ত, একই সঙ্গে সবচেয়ে কঠিনও। টাকা-পয়সা কিছু না, এই আকাশি-নীল জার্সির মূল্য অনেক বেশি। শুধু আমার একার নয়, গোটা আর্জেন্টিনার মানুষেরই আশা, মেসি ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপটা উৎসর্গ করবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার ম্যারাডোনাকে, যে দুই বছর আগে এই নভেম্বর মাসেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ এশিয়ার শক্তিশালী সৌদি আরব। আর্জেন্টিনার ফুটবল ঐতিহ্যের কাছে যারা আসলে কিছুই না! তারপরও এটা বিশ্বকাপ। এখানে কোনো দলকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে এটা তো বলাই যায়, সবার চোখ থাকবে আজ আর্জেন্টিনা কত ব্যবধানে জেতে সেই দিকে। দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের একটি দল। সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার সময় থেকে। এখন পর্যন্ত লিওনেল মেসি যে ব্যাটনটা ধরে রেখেছেন। সমর্থকদের অনেক প্রত্যাশাও তার ও তাদের দলের ওপর। সেই দিক থেকে আজকের ম্যাচটিতে তাদের পারফরম্যান্স কেমন হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে তাদের যাত্রার অনেক কিছু নির্ভর করবে এই ম্যাচটির ওপর।
সৌদি আরব এশিয়ার শক্তিধর হলেও আমাদের দেশের সব দর্শকই আসলে আর্জেন্টিনার পক্ষেই থাকবে। কেউ সৌদি আরবের পক্ষে থাকবে না। ম্যাচটি আর্জেন্টিনার জন্য আবার চ্যালেঞ্জিংও। প্রথম ম্যাচে যদি কোনো কিছু করার থাকে, সেই কাজটি তারা সেভাবেই করবে। আশা করি ম্যাচটি অসম্ভব ভালো হবে।
মেসির কাছে এবার সবারই বাড়তি চাওয়া আছে। কারণ এই বিশ্বকাপই তার শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। মেসি একটা বিশ্বকাপ পাক এই চাওয়াটা আসলে সবারই। এত বড় একজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপে ট্রফি জিততে না পারলে অপূর্ণতা তো থেকেই যায়। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে বিশ্বকাপের ট্রফি তার হাতে উঠলে পৃথিবীর সব মানুষ খুব খুশি হবে। গত বছর কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। মেসিকে ট্রফি হাতে উদযাপন করতে দেখে কে না খুশি হয়েছে। বিশ্বকাপেও সেটা হতেই পারে।
আর্জেন্টিনার বর্তমান দলটাকে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সেরা বলে মনে হচ্ছে। যদিও লো সেলসো ইনজুরির কারণে দলে নেই। নিকো গনসালেস ও হোয়াকিন কোরেয়া পরে ছিটকে গেছে। তবে সব পজিশনেই তাদের কার্যকরী খেলোয়াড় রয়েছে। তাই অতটা ভয়ের কিছুও দেখছি না আমি। এখন যারা দলে আছে তাদের সুস্থ থেকে পুরো টুর্নামেন্ট শেষ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সৌদি আরবের বিপক্ষে মেসি মাঠে একাই অনেক কিছু। প্রথম ম্যাচে যদি সে ঝলসে ওঠে এবং সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করবে সে। মেসির সেই ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বসে আছে। কাতারে যারা মাঠে বসে খেলা দেখবে তারাও বসে আছে। সারা পৃথিবীর মানুষই অপেক্ষা করছে। সবার প্রত্যাশা মেসি ভালো খেলবে এবং তার দল ভালো খেলবে। আর আর্জেন্টিনার অন্য খেলোয়াড়রাও মেসির জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইবে। গ্রহের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের শেষ বিশ্বকাপটা তারাও চাইবে রঙিন করতে। মেসিকে বিশেষ কিছু উপহার দিতে।
এটা আমরা বলতেই পারি, বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া থাকবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল অনেক দূর যাক। কারণ ব্রাজিলেরও অনেক সমর্থক আছে। বিশ্বকাপে যে দলগুলো এসেছে প্রতিটি দলকেই সমীহ করতে হবে। এখানে তুলনামূলকভাবে আর্জেন্টিনা এগিয়েই আছে অনেকটা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো গোল করেছে তারা। অপরাজিত আছে টানা ৩৬ ম্যাচে। সেই দিক থেকে আর্জেন্টিনা দল খুব ভালো পারফরম্যান্স করবে বলেই আমি আশাবাদী। তাদের বর্তমান দলটা যে ধারার মধ্যে আছে, আমার মনে হয় না সৌদি আরবের বিপক্ষে জিততে বেগ পেতে হবে তাদের। সবার চোখ যেহেতু মেসির দিকে থাকবে, তাই চাইব মেসি কিছু একটা করুক। তার জাদু দেখতে সারা পৃথিবীর মানুষই বসে আছে।
আরও এক ফেভারিট ফ্রান্স মাঠে নামবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। যেহেতু তারা বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, তাদের দিকেও নজর থাকবে সবার। করিম বেনজেমা চোটের কারণে ছিটকে গেছে। পল পগবা নেই। তবে কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো সময়ের সেরা খেলোয়াড় আছে তাদের দলে। ২০১৮ সালে যে দলটি খেলেছিল সেই দলের সঙ্গে তুলনা করলে বলব, এই দলটায় মিডফিল্ড ও ডিফেন্স এরিয়ায় একটু ঘাটতি আছে। প্রতিপক্ষ যেহেতু অস্ট্রেলিয়া, ওরাও খুব খারাপ দল না। বিশ্বকাপে সবার প্রথম ম্যাচে কিন্তু নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারও থাকে। যেহেতু দীর্ঘদিন খেলোয়াড়রা ক্লাব ফুটবলে জড়িত ছিল। সবাই বিশ্বকাপের মাত্র কিছুদিন আগে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ কারণেই গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। প্রথম ম্যাচটা ভালো হলে যে কাজটা সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফ্রান্সকে ফেভারিট ধরা যায়। যদি নিজেদের মতো করে খেলতে পারে তাহলে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ওদের জিততে অসুবিধা হবে না বলেই আমি মনে করি।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।