
কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ এশিয়ার শক্তিশালী সৌদি আরব। আর্জেন্টিনার ফুটবল ঐতিহ্যের কাছে যারা আসলে কিছুই না! তারপরও এটা বিশ্বকাপ। এখানে কোনো দলকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে এটা তো বলাই যায়, সবার চোখ থাকবে আজ আর্জেন্টিনা কত ব্যবধানে জেতে সেই দিকে। দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের একটি দল। সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার সময় থেকে। এখন পর্যন্ত লিওনেল মেসি যে ব্যাটনটা ধরে রেখেছেন। সমর্থকদের অনেক প্রত্যাশাও তার ও তাদের দলের ওপর। সেই দিক থেকে আজকের ম্যাচটিতে তাদের পারফরম্যান্স কেমন হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে তাদের যাত্রার অনেক কিছু নির্ভর করবে এই ম্যাচটির ওপর।
সৌদি আরব এশিয়ার শক্তিধর হলেও আমাদের দেশের সব দর্শকই আসলে আর্জেন্টিনার পক্ষেই থাকবে। কেউ সৌদি আরবের পক্ষে থাকবে না। ম্যাচটি আর্জেন্টিনার জন্য আবার চ্যালেঞ্জিংও। প্রথম ম্যাচে যদি কোনো কিছু করার থাকে, সেই কাজটি তারা সেভাবেই করবে। আশা করি ম্যাচটি অসম্ভব ভালো হবে।
মেসির কাছে এবার সবারই বাড়তি চাওয়া আছে। কারণ এই বিশ্বকাপই তার শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। মেসি একটা বিশ্বকাপ পাক এই চাওয়াটা আসলে সবারই। এত বড় একজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপে ট্রফি জিততে না পারলে অপূর্ণতা তো থেকেই যায়। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে বিশ্বকাপের ট্রফি তার হাতে উঠলে পৃথিবীর সব মানুষ খুব খুশি হবে। গত বছর কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। মেসিকে ট্রফি হাতে উদযাপন করতে দেখে কে না খুশি হয়েছে। বিশ্বকাপেও সেটা হতেই পারে।
আর্জেন্টিনার বর্তমান দলটাকে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সেরা বলে মনে হচ্ছে। যদিও লো সেলসো ইনজুরির কারণে দলে নেই। নিকো গনসালেস ও হোয়াকিন কোরেয়া পরে ছিটকে গেছে। তবে সব পজিশনেই তাদের কার্যকরী খেলোয়াড় রয়েছে। তাই অতটা ভয়ের কিছুও দেখছি না আমি। এখন যারা দলে আছে তাদের সুস্থ থেকে পুরো টুর্নামেন্ট শেষ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সৌদি আরবের বিপক্ষে মেসি মাঠে একাই অনেক কিছু। প্রথম ম্যাচে যদি সে ঝলসে ওঠে এবং সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করবে সে। মেসির সেই ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বসে আছে। কাতারে যারা মাঠে বসে খেলা দেখবে তারাও বসে আছে। সারা পৃথিবীর মানুষই অপেক্ষা করছে। সবার প্রত্যাশা মেসি ভালো খেলবে এবং তার দল ভালো খেলবে। আর আর্জেন্টিনার অন্য খেলোয়াড়রাও মেসির জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইবে। গ্রহের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের শেষ বিশ্বকাপটা তারাও চাইবে রঙিন করতে। মেসিকে বিশেষ কিছু উপহার দিতে।
এটা আমরা বলতেই পারি, বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া থাকবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল অনেক দূর যাক। কারণ ব্রাজিলেরও অনেক সমর্থক আছে। বিশ্বকাপে যে দলগুলো এসেছে প্রতিটি দলকেই সমীহ করতে হবে। এখানে তুলনামূলকভাবে আর্জেন্টিনা এগিয়েই আছে অনেকটা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো গোল করেছে তারা। অপরাজিত আছে টানা ৩৬ ম্যাচে। সেই দিক থেকে আর্জেন্টিনা দল খুব ভালো পারফরম্যান্স করবে বলেই আমি আশাবাদী। তাদের বর্তমান দলটা যে ধারার মধ্যে আছে, আমার মনে হয় না সৌদি আরবের বিপক্ষে জিততে বেগ পেতে হবে তাদের। সবার চোখ যেহেতু মেসির দিকে থাকবে, তাই চাইব মেসি কিছু একটা করুক। তার জাদু দেখতে সারা পৃথিবীর মানুষই বসে আছে।
আরও এক ফেভারিট ফ্রান্স মাঠে নামবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। যেহেতু তারা বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, তাদের দিকেও নজর থাকবে সবার। করিম বেনজেমা চোটের কারণে ছিটকে গেছে। পল পগবা নেই। তবে কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো সময়ের সেরা খেলোয়াড় আছে তাদের দলে। ২০১৮ সালে যে দলটি খেলেছিল সেই দলের সঙ্গে তুলনা করলে বলব, এই দলটায় মিডফিল্ড ও ডিফেন্স এরিয়ায় একটু ঘাটতি আছে। প্রতিপক্ষ যেহেতু অস্ট্রেলিয়া, ওরাও খুব খারাপ দল না। বিশ্বকাপে সবার প্রথম ম্যাচে কিন্তু নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারও থাকে। যেহেতু দীর্ঘদিন খেলোয়াড়রা ক্লাব ফুটবলে জড়িত ছিল। সবাই বিশ্বকাপের মাত্র কিছুদিন আগে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ কারণেই গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। প্রথম ম্যাচটা ভালো হলে যে কাজটা সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফ্রান্সকে ফেভারিট ধরা যায়। যদি নিজেদের মতো করে খেলতে পারে তাহলে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ওদের জিততে অসুবিধা হবে না বলেই আমি মনে করি।
ডি গ্রুপের প্রথম ম্যাচে আজ অসম লড়াই। হ্যাঁ, খেলায় নিজের দিনে হার-জিত যেকোনো দিকে গড়াতে পারে। তবে ম্যাচের আগে পারা না পারার হিসাব তো করাই যায়। সেদিক থেকে আজ এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে ডেনমার্কের সামনে আফ্রিকান তিউনিসিয়ার জোর অনেক কমই বলতে হয়। ডেনিসরা বরাবরই ইউরোপিয়ান দ্বিতীয় শক্তির দল। তবে গত ইউরো থেকে যেন নতুন উদ্যমে জেগে উঠে তারাও জায়ান্টদের কাতারে জায়গা করে নিয়েছে। দলটিতে একঝাঁক তারকার উপস্থিতি নেই সত্যি, তবে দলগত শক্তিতে কমতি নেই কোনো। আর সেই ধারায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কোনো ম্যাচ না জিতে কাতারে আসা ডেনিসদের আজ ফেভারিট ধরতেই হয়। মালির বিপক্ষে আফ্রিকান বাছাইয়ের শেষ ধাপে দুই লেগের লড়াইয়ে কোনোমতে ১ গোলের অ্যাগ্রিগেটে জেতা তিউনিসরা অপেক্ষায় থাকবে একটি অঘটনের।
বলা হচ্ছে এই ম্যাচের কথা। অথচ ডেনিস কোচ কাসপার হুলমান্দ হুঙ্কার ছাড়লেন বিশ্বকাপ জেতার। কাল ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এই কোচের উক্তি আলোচনা ছড়াল বেশ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইরে এই আসরে স্পষ্ট ফেভারিটের নাম নেই। অনেকটা উন্মুক্ত বিশ্বকাপে তাই হাত ছোঁয়াতে চায় ডেনমার্ক। হুলমান্দ জানান, ‘আমাদের স্বপ্ন কোনো কিছু জেতা। তাই আপনি যখন এমন বিশ্বকাপের মতো কোনো টুর্নামেন্টে যাবেন তখন আমি বলব আমার এই গ্রুপ ফুটবলারদের কিছু জেতার সামর্থ্য আছে। সেই ‘কিছু’ মানে কিন্তু সব কিছুই।’
গত ইউরোয় সেমিফাইনাল খেলে ডেনমার্কের বিশ্বাস বড় হয়েছে। এতটাই যে বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচের ৯ ম্যাচ জিতেছে তারা। এই সময়ে বিপক্ষের জালে ৩০ গোল দিলেও নিজেরা হজম করেছে মাত্র ৩ গোল। আর শেষ ৮ ম্যাচে কোনো গোল খায়নি ডেনমার্ক। এই সাফল্য বিশ্বকাপে ডেনিসদের আরও উচ্ছ্বাস দিচ্ছে। সঙ্গে ইউরোর পর এই প্রথম বড় কোনো আসরে ফিরে আসা ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন দলের শক্তি বাড়াচ্ছেন। গত ইউরোতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন এরিকসেন। এই বিশ্বকাপে পুরো ফিট হয়ে উঠেছেন। সব মিলিয়ে হুলমান্দের শিরোপা জয়ের স্বপ্নটা তাই বড় হয়েছে একটু বেশিই।
বড় স্বপ্ন সত্যি করতে গ্রুপসেরা হতে হবে ডেনমার্ককে। এই পথে বড় বাধা ফ্রান্স। তবে বর্তমান বিশ্বজয়ীদের হারানোর নিকটঅতীত আছে ডেনিসদের। নেশন্স লিগের লড়াইয়ে বিশ্বকাপে গ্রুপসঙ্গী ফ্রান্সকে মুখোমুখি দেখায় দুবারই হারিয়েছে তারা। তাই আরও আত্মবিশ্বাসী হুলমান্দ বলেন, ‘আমরা ফেভারিট কিনা যদি জিজ্ঞাস করেন সবাই বলত না। আমিও তাই বলব। কিন্তু আমরা যেকোনো দিন যেকোনো দলকে হারিয়ে দিতে পারি। আমাদের আত্মবিশ্বাসটাই এমন। আমাদের দলটা সব কিছু জিততে প্রস্তুত। আর আপনি যদি বড় কিছু জিততে চান তাহলে এই নিশ্চয়তা থাকতেই হবে।’
ডেনমার্কের সঙ্গে তিউনিসিয়ার পূর্ব লড়াই মাত্র একবার। তাও ২০ বছর আগে। ২০০২ সালের প্রীতি ম্যাচে ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল ডেনমার্ক। ওই জয়ের রেশ ডেনিসদের যেমন নেই তেমনি হারের হতাশাও নেই তিউনিসিয়ার। লম্বা বিরতি পর নতুন দেখায় ম্যাচটি হবে নতুনের মতোই। তাতে তিউনিসিয়ার স্বপ্ন খুব একটা নেই। এক যদি না তারা অঘটন ঘটাতে পারে। সেই সম্ভাবনাটাও কম তিউনিসদের। আফ্রিকান বাছাইপর্বের শেষ রাউন্ডে মালির বিপক্ষে জিততে বেগ পেতে হয় দলটির। দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ অ্যাগ্রিগেটে জিতলেও সেই গোলটি ছিল আত্মঘাতী। প্রথম লেগে মালির মুসা সিসোকো ভুল না করলে তিউনিসিয়া এই বিশ্বকাপের টিকিটও পেত না।
তবে তিউনিসিয়ার হারানোর কিছু নেই। বরং না হারার চাপে থাকবে ডেনমার্কই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অঘটন উপহার দিতে চাইবে। হুলমান্দরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখলে এই অঘটন এড়াতে হবে।
আমার জীবনে, আমার টাইমিং সবসময়ই সেরা। অন্যরা কে কী ভাববে, তা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি যখন চাই, তখন কথা বলি। খেলোয়াড়রা অনেক বছর ধরে আমাকে ভালোভাবে চেনে
সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। যা বলার, বিশ্বকাপ-ভাবনা আর পর্তুগাল ক্যারিয়ার নিয়েই বলার কথা। কিন্তু কাতারে আসার পরও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ঘিরে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-বিষয়ক আলোচনা।
গত সপ্তাহে পিয়ার্স মরগানকে দেওয়া রোনালদোর সাক্ষাৎকারে ম্যানইড কোচ এরিক টেন হাগ থেকে শুরু করে ক্লাবের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষ গ্লেজার পরিবারকে নিয়ে বিস্ফোরক সব মন্তব্য করেছেন পর্তুগিজ তারকা। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বলছে, ক্ষুব্ধ ইউনাইটেড রোনালদোকে আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে দেখতে রাজি নয়। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপাতত রোনালদোর ওপরই ছেড়ে দিয়েছে ক্লাবটি।
বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামার আগে রোনালদোকে পাওয়া যাবে না বলে ধারণা ছিল অনেকের। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে আজ দোহায় পর্তুগালের হয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন রোনালদো। সেখানে সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে প্রশ্নে তার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমার জীবনে, আমার টাইমিং সবসময়ই সেরা। অন্যরা কে কী ভাববে, তা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি যখন চাই, তখন কথা বলি। খেলোয়াড়রা অনেক বছর ধরে আমাকে ভালোভাবে চেনে। তারা জানে আমি কী ধরনের মানুষ। এই দলটি উচ্চাকাক্সক্ষী এবং জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। তারা লক্ষ্যে স্থির। তাই আমি নিশ্চিত, (ওই সাক্ষাৎকারে) দলের পরিবেশ বদলাবে না এবং সবার লক্ষ্য ও মনোযোগ অটুট থাকবে।’
যেকোনো ধরনের আক্রমণের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আছে জানিয়ে ৩৭ বছর বয়সী এই তারকা যোগ করেন, ‘আমি যখন চাই, কথা বলি। আমি বুলেটপ্রুফ, লোহার পোশাক পরে আছি।’ পর্তুগাল দল কাতারে পা রাখার আগে ও পরে রোনালদো-বিষয়ক জিজ্ঞাসার মুখে পড়েছিলেন ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বার্নার্দো সিলভা ও রুবেন নেভেসরা। বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত পাঁচবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী, ‘ক্রিশ্চিয়ানো সম্পর্কে অন্যদের জিজ্ঞেস করবেন না। ওদের পর্তুগাল আর তাদের নিজেদের নিয়েই জিজ্ঞেস করুন।’
তার আশপাশে জড়িত সবই বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মন্তব্য করে রোনালদো দাবি করেন, ব্রুনোসহ পর্তুগাল দলের কারও সঙ্গেই তার দূরত্ব নেই, ‘টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এ ধরনের বিতর্ক সব সময়ই হয়। কিন্তু ব্রুনোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই চমৎকার। আসলে ক্রিশ্চিয়ানোর চারপাশে থাকা সবকিছু নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়। কিন্তু আমি বলছি, দলের সবার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক।’
দুই লিওনেলে তাকিয়ে আর্জেন্টিনা। লিওনেলদ্বয় সফল হলেই ঘুচবে ৩৬ বছরের অপেক্ষা। গত বছর কোপা আমেরিকা জিতিয়ে যে দুজন ঘুুচিয়েছিলেন ২৮ বছরের শিরোপা খরা। তারাই পারেন দেশকে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ এনে দিতে। একজন লিওনেল মেসি, আরেকজন লিওনেল স্কালোনি। একজন বহু বছর ধরেই আলবিসেলেস্তেদের স্বপ্নসারথী। অন্যজন খুব অল্প সময়ে কেড়ে নিয়েছেন আস্থার আসন। দুই লিওনেলকে ঘিরে বিশ্বজয়ের মিশন আর্জেন্টিনা শুরু করবে আজ। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব। এ মাঠেই হোক রূপকথার শুরু। ১৮ ডিসেম্বর বিজয় সংগীত গেয়ে এখানেই নিশ্চয় রূপকথার শেষটা করতে চাইবেন মেসিরা। বলে দেওয়াই যায় আরবকে এক ইঞ্চি ছাড় দেওয়ার মনোবৃত্তি দেখা যাবে না আর্জেন্টাইনদের মধ্যে। স্বপ্ন জয়ের অভিযান বলেই প্রয়োজনে ধারণ করতে হবে নিষ্ঠুর রূপ।
আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির শুরুটা সেই ২০০৫ সাল থেকে। বাঁ পায়ের জাদুকর সেই থেকে মায়াবী জাদুতে সম্মোহিত করে রেখেছেন সারা দুনিয়াকে। বার্সেলোনা একাডেমিতে বেড়ে ওঠা, তার আলোতেই স্প্যানিশ ক্লাবটি জিতেছে সম্ভাব্য সবকিছুই। ক্লাবের হয়ে মেসিও হীরে-জহরতে গেঁথেছেন সাফল্যের মালা। তবে কেন যেন আকাশি জার্সিতে হচ্ছিল না। সাফল্যের খুব কাছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। তা বিশ্বকাপ বলুন কিংবা কোপা আমেরিকা। একটা সময় মনে হচ্ছিল মেসি খেলা দিয়ে হৃদয় জিতবেন ঠিকই, তবে শিরোপা জেতা হবে না। কোনো শিরোপাই নয়। সেই মনে হওয়াটা ভুল প্রমাণিত হয় অভিষেকের ঠিক ১৬ বছর পর, গত বছর। ব্রাজিলকে তাদের মাঠে ফাইনালে হারিয়ে কোপা আমেরিকা ওঠে ফুটবলের বরপুত্রের হাতে। সেই আসরে আর্জেন্টিনার ১২ গোলের ৯টিতেই ছিল তার অবদান। করেছিলেন চার গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন পাঁচটি। সে বছরই ওয়েম্বলিতে ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কনমেবল-উয়েফা কাপ অব চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতে আর্জেন্টিনা। সেই ১৯৯৩ সালে সর্বশেষ কোপা জয়ের ২৮ বছর পর জোড়া শিরোপায় মেসির যেমন অবদান, কোচ স্কালোনির অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জর্জ সাম্পোওলির সহকারী হয়ে ২০১৬-তে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে পা রাখা। ২০১৮-তে যখন হেড কোচের দায়িত্ব পান, তখন কম সমালোচনা সইতে হয়নি। খোদ ডিয়েগো ম্যারাডোনা এমন একজনের হাতে দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনকে। সে সময়ের সমালোচনাগুলো মুখ বুজে সয়ে যাওয়া স্কালোনি একটা পন্থাই নিয়েছিলেন। মেসিকে কেন্দ্রে রেখে পুরো দলটাকে একটা পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ৪৪ বছর বয়সী কোচও বুঝেছিলেন মেসি সুখী থাকলে দলও যেমন খুশি, পুরো আর্জেন্টিনাই খুশি।
মেসিকে ভালো রাখতে জানেন বলেই দুই লিওনেলে রসায়নটা হয়েছে চমৎকার। সেই রসায়নেই এবার সময় এসেছে বিশ্বসেরা হওয়ার। আর্জেন্টিনা দোহায় পা রেখেছে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার অনন্য এক রেকর্ড নিয়ে। আজ সৌদি আরবকে হারালে তারা ছুঁয়ে ফেলবে ইতালির ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড। আর গ্রুপের পরে ম্যাচে মেক্সিকোকে হারালে রেকর্ডটা হয়ে যাবে এককভাবে তাদের। এমন ছন্দে থাকা আর্জেন্টিনা যদি এবার বিশ্বকাপ না জেতে, তাহলে অন্যায় হবে। ঘোরতর অন্যায়। এ যে মেসির সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ। বয়স তো আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে স্কালোনি তা মানছেন না। কোচ মেসিকে ২০২৬ বিশ্বকাপেও দেখতে চান। আমেরিকা-কানাডা বিশ্বকাপে মেসি থাকবেন কি না, এ নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর মানে নেই। আগে তো কাতার মিশনটা ঠিকঠাক শেষ করতে হবে।
তবে ঠিকঠাক কাজের পরিকল্পনা করতে গিয়েই স্কালোনি পড়েছেন বিপাকে। এই সুখী আর্জেন্টিনার মাঝমাঠের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন জিওভানি লো সেলসো ও রদ্রিগো ডি পল। সেই ২০১৯ থেকে। বিশ্বকাপ শুরুর আগ মুহূর্তে লো সেলসো হ্যামস্ট্রিং চোটে পড়ে ছিটকে যান। এতদিন ডি পল ও লো সেলসো মাঝমাঠ থেকে আর্জেন্টিনার খেলাটা গোছাতেন। সুবাদে মেসি অনেকটা স্বাধীন হয়ে খেলার সুযোগ পেতেন। কখনো ওপরে আবার কখনো একটু নেমে এসে জায়গা করে আক্রমণে উঠতেন। কখনো গোল করতেন, কখনো করিয়ে শান্তি পেতেন। তাই লো সেলসোর না থাকাটা বড় দুশ্চিন্তা। এটা বাদ দিয়ে এই আর্জেন্টিনার দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজ লো সেলসোর জায়গায় মাঝমাঠে ডি পলের সঙ্গী হতে দেখা যেতে পারে লিয়ান্দ্রো পারেদেসকে। ৪-৩-৩ ফরম্যাটে নাম্বার নাইন পজিশনে লাউতারো মার্তিনেজকে রেখে দু’পাশে খেলবেন মেসি ও অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। রক্ষণে স্কালোনি আস্থা রাখতে পারেন নাহুয়েল মলিনা, নিকোলাস ওতামেন্দি, ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো ও নিকোলাস তাগলিয়াফিকোর ওপর। মাঝমাঠে ডি পল ও পারেদেসকে সহায়তা দেবেন দিগো রড্রিগেজ। আর দুর্গ সামলানোর জন্য তো এমি মার্তিনেজ আছেনই।
ওদিকে সৌদি আরবের মনে শান্তি নেই। সেটা কেবল প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনার বলে নয়। পাশের ছোট্ট দেশ কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করে একটা বড় শিক্ষাই দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মোড়লদের। তারপর বেরসিক ভাগ্য প্রথম ম্যাচেই জুটিয়ে দিয়েছে মেসির দলকে। তাই পরের ধাপে যাওয়ার বড় আশা করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে ফরাসি কোচ হার্ভে রেনাঁর শিষ্যদের। তারপরও অভ্যস্ত আবহাওয়ায় খেলা বলেই যা একটু সুবিধে। বড়জোর দলের মূল শক্তির জায়গা রক্ষণভাগকে জমাট করে মেসি-মার্তিনেজ, ডি মারিয়াদের রুখে দিতে পারলেই বড় পাওয়া হবে আরবদের জন্য।
শক্তি, ঐতিহ্য, ফর্ম বিবেচনায় বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে আজ বড় জয়েই বিশ্বকাপ শুরু করতে চাইবে আর্জেন্টিনা। কাল পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, হালকা চোট থেকে সেরে মেসিও প্রস্তুত মাঠে নামতে। নামবেন না-ই বা কেন? এই বিশ্বকাপ যে অনেক কিছু পাওয়ার বিশ্বকাপ। এই শিরোপা না জিতলে যে কখনই আর্জেন্টিনা মেসির আর্জেন্টিনা হবে না। সেটা হয়ে থাকবে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। লিওনেলদের রূপকথার যাত্রাটা তাই শুরু হোক জয়ের মুকুট পরে। যেভাবে তারা কোপা জিতে হাসি ফিরিয়েছিলেন ভক্তদের মুখে, ঠিক সেভাবেই যেন লুসাইল স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বর শেষ হাসিটা হাসেন লিওনেল জুটি।
কাতার পৌঁছে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। অনেক কিছুই বদলে গেছে। নতুন বানানো সুন্দর সুন্দর সব স্টেডিয়াম, হোটেল, যাতায়াত ব্যবস্থা... সবকিছুই অনেক উন্নত হয়েছে। আমি এখানে ২০১১ আর ২০১৫ সালে এসেছিলাম। বিশ্বকাপ উপলক্ষে এরকম একটা বড় পরিবর্তন দেখতে পাব, সেটাই স্বাভাবিক। আর এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে কাতারের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে কারণেই। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে কাতার নিজেদের পুরোপুরি বদলে ফেলেছে। কাতার হয়ে উঠেছে আরও সুন্দর, আরও উন্নত। এই শহরে এসে আমি অদ্ভুত একটা শক্তি অনুভব করতে পারছি। এই নিয়ে তৃতীয়বার এলাম এবং নতুন এই দোহা দেখে সত্যিই চমকে গেছি। আমি ভেবেছিলাম শহরটা বোধহয় খুব বেশি বদলাবে না, তবে কাতার আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। একবার এখানে পা দিলেই টের পাওয়া যাবে এই দেশ কতটা বদলে গেছে। আমি আশা করব বিশ্বকাপ দেখতে আসা সবাই আয়োজনটা উপভোগ করবে।
আমার মনে হয় আর্জেন্টিনা অন্যতম ফেভারিট হয়েই কাতারে পা রেখেছে, আরও দুই ফেভারিট হচ্ছে ব্রাজিল ও ফ্রান্স। তবে এই দলগুলোর বাইরেও আরও অনেকগুলো ভালো দল আছে যারা টুর্নামেন্টে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য লড়াই করবে। এই বিশ্বকাপটা হবে কঠিন বিশ্বকাপ। প্রতিপক্ষ সহজ হোক বা দুর্বল, বিশ্বকাপের প্রথম দুটো ম্যাচ যে কোনো দলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা যে কোনো দলকেই তাদের শক্তিশালী দিক আর দুর্বল দিক খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। এই দুটো ম্যাচ যে কোনো দলকেই মাঠটা কেমন, পরিবেশটা কেমন সেটা বুঝতে সহায়তা করবে আর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারবে। সাবধানী খেলে গ্রুপ পর্বটা সহজে পার হও, পরের পর্ব থেকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেল।
এই আর্জেন্টিনা দলটার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা আমার কাছে মনে হয় দলের শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ। দলে একঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। মেসির দলটা কোনো ম্যাচ না হেরেই বিশ্বকাপে খেলতে এসেছে। কোচ লিওনেল স্কালোনি অনেকদিন ধরেই এই খেলোয়াড়দের চেনে এবং জানে।
তবে তাকে সতর্ক থাকতে হবে কারণ অনেক সময় গোটা ম্যাচ ভালো খেলেও শেষ মুহূর্তে দুর্ভাগ্যজনক কোনো কারণে ম্যাচ হারতে হতে পারে। সব খেলোয়াড়ই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল মৌসুমের মাঝপথে জাতীয় দলে এসে যোগ দিয়েছে। এটা খেলোয়াড়দের খুব সাহায্য করবে কারণ ফ্রান্সের ফুটবল লিগ অনেক কঠিন। বিশ্বকাপে রেফারিরা অনেক বেশি কড়া। প্রতিপক্ষও কঠিন। মেসির অবশ্য এরই মধ্যে সব কিছু সহ্য করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
আমার আর আমার সব সতীর্থের জন্য, ১৯৮৬’র বিশ্বকাপটা ছিল খুবই কঠিন। আমরা যখন মেক্সিকো পৌঁছাই তখন খুব চাপের মধ্যে ছিলাম। তবে ১৯৯০’র বিশ্বকাপটা আমাদের কাছে ছিল অনেক বেশি আবেগের। আমরা চোট-জর্জর হয়ে বিশ্বকাপে পৌঁছেছিলাম। আমরা ফাইনালে উঠলাম আর আমরা অন্যায্যভাবে হেরে গেলাম। যেসব খেলোয়াড়কে আমরা সেমিফাইনালে আসতে আসতে হারিয়েছি, কোনো সন্দেহ নেই তাদের ফাইনালে পেলে গল্পটা অন্য রকম হতে পারত। তবে মেসি আর তার দলের পরিস্থিতিটা আলাদা। তারা এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তাদের ওপর খুব বেশি চাপ নেই, খুব বেশি খেলোয়াড়ের চোটও নেই।
মেসি, এই বিশ্বকাপটা ম্যারাডোনার জন্য জিতে নাও আর শিরোপাটা তাকে উৎসর্গ করো। এটাই হতে পারে ম্যারাডোনার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে খেলাটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্ত, একই সঙ্গে সবচেয়ে কঠিনও। টাকা-পয়সা কিছু না, এই আকাশি-নীল জার্সির মূল্য অনেক বেশি। শুধু আমার একার নয়, গোটা আর্জেন্টিনার মানুষেরই আশা, মেসি ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপটা উৎসর্গ করবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার ম্যারাডোনাকে, যে দুই বছর আগে এই নভেম্বর মাসেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে।
সমর্থনের কারণে বিভক্তি থেকে যায়। তবুও পুরো বিশ্ব যেন এক হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের শক্তি এটাই। এর বিশেষত্ব এজন্যই আলাদা। রবিবার রাতে কাতার-ইকুয়েডর ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছে ফুটবলের মহাযজ্ঞ। তবে উপদ্বীপের উন্মাদনাটা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই, যা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। এই উপত্যকার সমর্থকদের চোখ থাকবে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। যেখানে আজ মাঠে নামছে বিশ্বকাপের অভিষেক আসরের রানার্সআপ আর্জেন্টাইনরা। ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসিরা মুখোমুখি হবেন এশিয়ার আরেক দল সৌদি আরবের।
যেকোনো প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক দলের কাছে প্রথম ম্যাচ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবারই লক্ষ্য থাকে এই ম্যাচ জিতে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকা, বাকি পথটা সহজ করা। আজ আর্জেন্টিনারও সেই লক্ষ্য থাকবে। সৌদি আরবকে হারিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
চলতি শতাব্দীর পাঁচ বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরের প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। ২০০২ সাল ছাড়া প্রতিটিতেই তারা নকআউট পর্ব খেলেছে। সেবার বাতিস্তা-সেমিওয়ালাসহ তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দলটি গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। তবে বাকি আসরগুলোর একটিতে সেকেন্ড রাউন্ড, দুটিতে কোয়ার্টার ফাইনাল ও একটিতে ফাইনাল খেলেছে তারা।
ফুটবল বিশ্বকাপের অভিষেক আসর হয়েছিল ১৯৩০ সালে। উরুগুয়ের রাজধানী মোন্তেভিদেওতে এস্তাদিও পসিটস মাঠে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলেছিল আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে তারা শুভ সূচনা করেছিল। সে আসরে তারা উঠেছিল ফাইনালে। যদিও উরুগুয়ের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরের আসর ১৯৩৪ সালে ইতালির বোলোনিয়ায় সুইডেনের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে তারা। সে ম্যাচে তারা ৩-২ গোলে হেরে যায়।
পরের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ফিফার সভায় ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হয় ফ্রান্স। আয়োজক হতে না পারার আক্ষেপে তারা ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ইউরোপে বিশ্বকাপ হওয়াতে উরুগুয়েও সে আসরে অংশ নেয়নি। এরপর পৃথিবীতে নেমে আসে যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়নি।
আর্থিক বনিবনা না হওয়াতে আর্জেন্টিনার অনেক খেলোয়াড় দেশ ছেড়েছিলেন। ফলে তাদের জাতীয় দলটি হয়ে পড়ে দুর্বল। কিন্তু খর্বশক্তির দল নিয়ে খেলে লজ্জায় পড়তে চায়নি দেশটির ফেডারেশন। এছাড়া ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশনের সম্পর্কেরও অবনতি হতে থাকে। তাই ১৯৫০ বিশ্বকাপ থেকেও নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় তারা।
বিশ্বকাপ হচ্ছে অথচ আর্জেন্টিনা নেই! আকাশি-নীল দলটি ছাড়া বিশ্বকাপ কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একটু অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে, প্রথম বিশ্বকাপের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত টানা তিনটি আসরে অংশই নেয়নি! ১৯৫০ তো বটেই, ১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপও বর্জন করেছিল আর্জেন্টাইন। তবে ১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দিয়ে ৩৪ বছর পর ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসে তারা।
তবে ১৯৫৮ সালের প্রত্যাবর্তনটা তারা রাঙাতে পারেনি। ৮ জুন নিজেদের প্রথম ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে যায়। শুধু তাই নয়! সেবার তারা গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। পরের আসরে চিলিতে ১৯৬২ সালে নিজেদের প্রথম ম্যাচ তারা খেলে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে। সেদিন তারা ১-০ গোলে জিতে শুভ সূচনা করেছিল। কিন্তু এ বছরও তারা গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়।
তবে ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। সে আসরে তারা নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলেন স্পেনের বিপক্ষে ১৩ জুলাইয়ের সেই ম্যাচে ২-১ গোলে জিতে তারা শুভ সূচনা করেছিল। যদিও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে আবার তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
১৯৭৪ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। শুরুটাও খুব ভালো বলা যায় না। ইতালির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিল। নিজেদের সোনালি সময়টা যারা হেলা আর অহমের কারণে বিশ্বকাপ নামক লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলে বিদায় করেছে, সেই আকাশি-নীল জার্সিধারী আর্জেন্টাইনরা ১৯৭৮ সালে এসে শিরোপার স্বাদ পায়। সেবার নিজেদের প্রথম ম্যাচে হাঙ্গেরিকে ২-১ গোলে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছিল।
শিরোপা জয়ের পরের আসরে ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে আবার দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। সেবার বেলজিয়ামের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের। তবে ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার হাত ধরে ফের শিরোপা যায় আর্জেন্টিনাতে। মেক্সিকোতে সেবার দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-১ গোলে গুঁড়িয়ে বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে তারা। সেবার একই ম্যাচে ‘হ্যান্ড অব গড’ ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ দেখেছিল ফুটবলবিশ্ব। যার মাধ্যমে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ফুটবল ঈশ্বর।
১৯৯০ সালে ফের বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। সেবার নিজেদের প্রথম ম্যাচটাও অবশ্য ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলের হার দিয়ে শুরু করেছিল।
পরের আসর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে গ্রিসকে ৪-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে টুর্নামেন্টে শুভ সূচনা করেছিল। কিন্তু রাউন্ড ১৬ থেকেই তাদের বিদায় নিতে হয়েছিল।
ফ্রান্সে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জাপানকে ১-০ গোলে হারিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আর্জেন্টিনার। তবে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়। পরের আসরে জাপান-কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে ২০০২ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারায় সেমিওয়ালার দল। কিন্তু গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
জার্মানিতে ২০০৬ সালে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আইভেরি কোস্টের বিরুদ্ধে ১-০ গোলের জয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ২০১০ বিশ্বকাপেও এই জার্মানির কাছেই হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। তবে নাইজেরিয়াকে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলে হারায় তারা।
ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে শিরোপাবঞ্চিত হয় আর্জেন্টিনা। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানের জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপ মিশন। তবে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল তারা রাশিয়াতে। যার প্রমাণ তাদের ফলাফলে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে তারা। ফ্রান্সের কাছে হেরে রাউন্ড ১৬ থেকে বিদায় নেয়।
তবে কোপা আমেরিকা আর ফিনালিসসিমা জয়ের পর আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে আছে আর্জেন্টিনা। ঘুচিয়েছে তাদের ২৮ বছরের শিরোপা-খরা। এবার সুযোগ বিশ্বজয়ের। অঘটন না হলে যার শুরুটা হতে পারে লুসাইলে সৌদি আরবের বিপক্ষে জয় দিয়ে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
বুধবার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
হেফাজতে সুলতানার মৃত্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাবেন।’
‘এই সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণগুলিতে শিশু নিহত হয়েছে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? আমি মনে করি না এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করবে।’
এর আগে, নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানাকে (৩৮) র্যাব-৫ এর একটি টহল দল ২২ মার্চ সকালে কাজে যাওয়ার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরে নিয়ে যায়। হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার নেই।
‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন খুবই শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সমস্যা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল। তাই তারা দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। আমরা এটি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ভুয়া ভোটারদের মোকাবিলা করার জন্য ছবিসহ ভোটার আইডি তৈরি করেছি। বিগত ১৪ বছরে নির্বাচন কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।’
মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ‘জাদুকরী’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী আমাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এবং ক্রমাগত উন্নয়নের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন,‘এই স্বাধীনতা দিবসে এবং রমজানের শুরুতে, আমরা অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক চিঠি পেয়েছি।’
মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাফুফে যতটা তৎপর, সিনিয়র জাতীয় দল নিয়ে ততটাই উদাসীন। আরো একবার দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করল। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফুফে বলেছে, ‘মায়ানমার যাতায়াতের বিমান ভাড়া, ইনস্যুরেন্স ফি, সেখানে থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টশনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের সংকুলান না হওয়ায় উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আছে ‘বি’ গ্রুপে। স্বাগতিক মায়ানমারের সঙ্গে গ্রুপে আরও আছে ইরান ও মালদ্বীপ। গ্রুপের খেলাগুলো হবে আগামী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলাম এই বাছাই পর্বের স্বাগতিক হতে। কিন্তু স্বাগতিক মর্যাদা মায়ানমারকে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী এখানে অংশ নিতে হলে সব খরচ নিজেদের বহন করতে হবে, যা বহন করার মতো অবস্থায় নেই বাফুফের।’
আবু নাঈম সোহাগ আরও বলেন, ‘আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। সেই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই আমরা দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি সাবিনারা। এই সফর বাতিল হওয়ায় মাঠে নামার অপেক্ষাটা তাদের আরো বাড়ল।
মেয়েদের জাতীয় দল নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এসএ গেমসে মেয়েদের দল পাঠায়নি বাফুফে।
সেবার যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত। যেহেতু তখন মেয়েদের জাতীয় দলটি মূলত বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ছিল, তাই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খারাপ করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এই কারণের কথা বলে সেবার এসএ গেমসে দল পাঠায়নি বাফুফে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’