চলতে চলতে পথ ফুরিয়ে যায়
দুলাল মাহমুদ | ২৮ মে, ২০২১ ০০:০১
আঙ্কেল, আমাদের সঙ্গে একটু শেয়ার করেন প্লিজ।
এমন অনুরোধে আমি রীতিমতো থতমত খেয়ে যাই। চেনা-পরিচয় নেই। এমনকি কোনো কথাও হয়নি। অথচ আমাকে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন আমি অপরিচিত কেউ নই। নিরুপায় হয়ে বললাম, আরে না না, তোমরাই খাও। আমাকে আবার কেন?
আমরা একসঙ্গেই তো যাচ্ছি। আপনার সামনে আমরাই শুধু খাবো, তা হয় নাকি?
আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, এই করোনাকালে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করাও তো ঠিক না।
আরে কিছু হবে না। আমার আম্মুর হাতে তৈরি। একটু খেয়ে দেখেন না?
এমন অকৃত্রিমভাবে অনুরোধ করায় এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। হাতে নিয়ে বললাম, এটা নিশ্চয়ই নারকেলের পুলি পিঠা। আমার খুব পছন্দসই ছিল। এখন আর খুব একটা খাওয়া হয় না। মুখে নিয়ে কামড় দিয়ে বললাম, খুবই মজা হয়েছে। কত দিন পর যে খাচ্ছি। অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। এই পিঠা নোয়াখালী এলাকায় খুব জনপ্রিয়।
আমাদের গ্রামের বাড়ি তো নোয়াখালী। আরেকটা নেন আঙ্কেল।
এই মেয়ে, এখন তো বয়স হয়েছে। বেশি মিষ্টি খাওয়া ঠিক নয়।
একদিন খেলে কিছু হবে না। খান তো।
মেয়েটা এত আন্তরিক, তাকে বারণ করতে ইচ্ছে করে না। তাই আরেকটা পিঠা নিয়ে বললাম, পরিচয় হওয়ার আগেই পিঠা খাওয়ায় ভাগ বসালাম। তোমার নামই তো জানা হলো না।
আমার নাম মাশিয়া মালিহা। কাছের মানুষরা মিম নামে ডাকে।
খুব সুন্দর নাম তো। তোমার নামের মধ্যে আলাদা একটা ব্যঞ্জনা আছে। তবে আমি তোমাকে মামা নামে ডাকবো।
মামা!
তোমার নামের প্রথম দুই অক্ষর জোড়া দিলে তো তাই হয়।
বাহ্। এমনটা তো কখনও ভেবে দেখিনি।
তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
চিটাগং ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। সঙ্গে যাচ্ছে আমার আম্মু।
মিমের আম্মুর পরনে হিজাব আর মাস্ক। চোখে চশমা। আপাদমস্তক ঢাকা। পরে আর কখনও দেখা হলেও চেনার কোনো উপায় থাকবে না। খুব চুপচাপ। ট্রেনে উঠার পর খুব একটা নড়াচড়া করতেও দেখিনি। জানালা দিয়ে বাইরের চলমান শোভা দেখতেই ব্যস্ত। মাঝে-মধ্যে মেয়ের সঙ্গে অনুচ্চ কণ্ঠে টুকটাক কথা বলেন। কখনও কখনও মেয়েকে আকারে-ইঙ্গিতে নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করেন। মেয়ে তার ইঙ্গিত থোড়াই কেয়ার করে। সে আছে তার নিজের মতো করে। পরিবেশটাকে যেন অনেকটা পারিবারিক উষ্ণতা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে।
মিমকে বললাম, সাধারণত মুখের ভাষা দিয়ে নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষদের চেনা যায়। তুমি যে নোয়াখালীর সন্তান, তোমার কথায় বোঝার একদমই উপায় নেই।
আমার তো ঢাকায় জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে উঠা। আমাকে ঢাকার মানুষ বলাই যেতে পারে। তবে পারিবারিক পরিসরে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জানালো মিম।
মেয়েটার সহজ-সরল আচরণ আর খোলামেলা কথাবার্তা আমার ভালো লেগে যায়। চলার পথে এমন একজন সঙ্গী পেলে ভ্রমণটা সরস হয়।
অনেক দিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বন্ধু বেলাল বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে অবস্থান করছে চট্টগ্রামে। তার পীড়াপীড়িতে সেখানে যাচ্ছি। বন্ধুদের মধ্যে ওই একমাত্র সবার খোঁজখবর ও যোগাযোগ রাখে। এমনকি আমরা একসময় যে এলাকায় থাকতাম, তারা এখন কে কোথায় আছে, সে খবরও তার কাছে পাওয়া যায়। বলা যায়, আমাদের শৈশব কৈশোরের সেতুবন্ধন হয়ে আছে বেলাল।
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনের এসি বার্থে উঠার পর আমার সামনের সারিতে বসা দেখতে পাই একজন মহিলা আর আরেকটা মেয়েকে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। হাসলে গালে টোল পড়ে। স্বভাবসুলভভাবে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। তারপর তো পরিচয় জানতে পারি। মিম মেয়েটার কারণে আমার একাকিত্ব ঘুচে যায়। মেয়েটা বেশ চঞ্চল। স্থিরভাবে বসে থাকছে না। যেন একটা চড়ুই পাখি। সবচেয়ে বড় গুণ, অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের। অচেনা, অজানা মানুষকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা আছে।
কথায় কথায় জানতে পারি, এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিও-৫ পেয়েছে। এখন ভর্তির জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। যেভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছে, যত্নআত্তি করছে, যেন আমি তার কত দিনের পরিচিত।
পরিচিত না হলেও কেন যেন একদম অপরিচিত মনে হচ্ছে না। খুবই চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছি না। অথচ এই মেয়েকে কোনোভাবেই চেনার প্রশ্নই আসে না। জীবনে কখনো দেখিনি। তারপরও মনের মধ্যে থেকে সংশয়টা যাচ্ছে না। মেয়েটার কথা বলার ধরন, হাসি, ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। এমন তো হতে পারে, আমার যেহেতু মেয়ে নেই, সে কারণে নিজের মেয়ে হিসেবে এমন একটা মেয়েকে কল্পনা করে আসছি। সেই কল্পনার সঙ্গে এই মেয়ের হয়তো সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছি। কিংবা আমার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন একটা মেয়ে, যার কথা ভুলতে পারিনি। তেমন হলে কে সেই মেয়ে? নাকি সবটাই আমার বয়সোচিত বিভ্রম? দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকি।
ট্রেনের দুলুনিতে কেমন ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে ভাবনা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজতে থাকি। একটু একটু করে যেন ভেসে ওঠতে থাকে একটা আবছায়া অবয়ব।
তখন আমরা শের-এ-বাংলা নগর কলোনিতে থাকি। কলোনিতে মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। অভিভাবকরা সবাই সরকারি চাকরিজীবী। বেশিরভাগই চাকরি করতেন জাতীয় সংসদ ভবনে। তবে সংসদ ভবনের এই বাসাগুলোতে অন্য অফিসের চাকরিজীবীরাও থাকতেন। সবার সঙ্গে সবার ছিল মিলমিশ। ছেলেমেয়েরা সবাই একসঙ্গে চলাফেরা খেলাধুলা করতো। গড়ে ওঠে একটা পারিবারিক বলয়। এই বলয়ের সবাই একে অপরের খোঁজ-খবর মোটামুটিভাবে রাখতো। অর্থনৈতিক আড়ম্বর না থাকলেও জীবন ছিল আনন্দদায়ক।
নোয়াখালীর মায়মুনারা ছিল অনেকগুলো ভাইবোন। আমরা সামনা-সামনি বাসায় থাকতাম। নিকটতম প্রতিবেশীই বলা যায়। মায়মুনার বাবা ছিলেন হুজুর ধরনের। ছেলেমেয়েদের মেলামেশা খুব একটা পছন্দ করতেন না। সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তাগিদ দিতেন। কিন্তু কোনো কিছু তার নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। বেশিক্ষণ খবরদারি করার সুযোগও পেতেন না। নানান কাজে এদিক-সেদিক যেতে হতো। সেই সুযোগে তার ছেলেমেয়েরাও ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করতো।
ভাইবোনদের মধ্যে মায়মুনা ছিল অসম্ভব ছটফটে। দেখতেও সুন্দর ছিল। মায়াকাড়া একটা চেহারা। হাসলে টোল পড়তো গালে। তখন সিক্স-সেভেনে পড়ে। কলোনির সর্বত্রই তার অবাধ চলাফেরা। সবার সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতো। খেলাধুলার ব্যাপারে তার কাছে ছেলে বা মেয়ে বলে আলাদা কিছু ছিল না। কাউকে রেয়াতও করতো না। সবাই তাকে একটু সমঝে চলতো। কিন্তু আমাকে কেন যেন একটু আলাদা চোখে দেখতো। খাতির করার চেষ্টা করতো।
সে সময় আমার মার্বেল খেলার প্রচণ্ড নেশা। স্কুল থেকে ফেরার পর বাসায় বই-খাতা রেখেই মার্বেল খেলতে চলে যেতাম। এইট না নাইনে পড়ি তখন। খেলতে খেলতে দুপুর পেরিয়ে গেলে মার খাওয়ার ভয়ে বাসায় ঢুকতে সাহস পেতাম না। ফিরতাম সন্ধ্যায়। তাতে কি আর রেহাই পাওয়া যায়? প্রায় প্রতিদিনই মায়ের হাতে হজম করতাম উত্তম-মধ্যম। পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো। এমনই ছিল মার্বেল খেলার দুর্বার নেশা।
একদিন ভর দুপুরে কাউকে না পেয়ে এলোমেলো ঘুরছিলাম। এমন সময় মায়মুনার সঙ্গে দেখা। ওর হাতে একটাই মার্বেল। আমাকে বলে, চলেন খেলি। বুঝতে পারতাম, আমার প্রতি ওর রয়েছে একটু দুর্বলতা। আমাকে দেখলে মোনালিসা হাসি হাসতো। তাতে বিব্রত বোধ করতাম। এ কারণে ওকে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু সেদিন কোনো খেলার সঙ্গী না পেয়ে অস্থির অস্থির লাগতে থাকে। আমি একটু দোনোমোনো করে খেলতে সম্মত হই। তখন তো ঝানু মার্বেল খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় আমার যথেষ্ট নামডাক। ভাবলাম এক দানেরই তো ব্যাপার। খেলি।
খেলতে খেলতে একপর্যায়ে আমি ফতুর হয়ে যাই। আমার তখন জেদ চেপে যায়। বাসা থেকে আরো মার্বেল নিয়ে এসে পাগলের মতো খেলতে থাকি আর হারতে থাকি। আমার শত শত মার্বেল মায়মুনার হস্তগত হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে যেতে থাকে। মায়মুনাকে বাসায় যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছে ওর ছোট ভাইবোনেরা। ও বাসায় চলে যেতে চায়। আমি তখন বেপরোয়া। তাকে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি নই। অগত্যা সে আমাকে বলে, আর খেলতে হবে না। সব মার্বেল এমনিই দিয়ে দিচ্ছি। আমি এভাবে আপষে মার্বেল নিতে রাজি নই। তা আমার আত্মসম্মানে লাগে। আমি ওকে খেলা চালিয়ে যেতে বাধ্য করি।
আমার গোঁয়ার্তুমির কাছে ওকে হার মানতে হয়। বাসায় ফিরতে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। ওর চোখে জল ছলছল করতে থাকে। দেরি হয়ে যাওয়ায় বাসায় ওর পিটুনি খেতে হবে। তাতেও আমার মন একটুও গলেনি। সেই বয়সে আমার জীবনের পরম সম্পদ ছিল মার্বেল। তারজন্য আমি সবকিছু বাজি ধরতে পারি। আর তা হারিয়ে আমি প্রায় নিঃস্ব। এটা কীভাবে মেনে নেব? আমার মনোভাব বুঝতে পেরে মায়মুনা হাল ছেড়ে দেয়। নামকাওয়াস্তে খেলতে থাকে। ততক্ষণে নেমে এসেছে সন্ধ্যা।
তারপর আমি ধীরে ধীরে খেলায় জিততে থাকি। দ্রুতই হারতে থাকে মায়মুনা। অথচ ও ছিল দুরন্ত স্বভাবের। চাইলেই মার্বেলগুলো নিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে যেতে পারতো। সেটা সে করেনি। না করার কারণ পরে বুঝতে পারি। আমার মন খারাপ হয়ে যাক, সেটা হয়তো সে চায়নি।
কিন্তু সেদিন থেকে আমার ভাবনায় দোলা দিয়ে যায় মায়মুনা। তার অশ্রুসজল চোখ যেন আমাকে অপরাধী করে তোলে। এরপর আর আমি তাকে এড়িয়ে যেতাম না। ওর দুষ্টুমি ওর চঞ্চলতা আমার ভালো লাগতে থাকে। আমার অজান্তে কীসের যেন একটা টোকা পড়ে হৃদয় মন্দিরে। বদলে যেতে থাকে আমার ভাবগতিক। ও তা বুঝতে পারে। আমাদের মধ্যে কথা হতে থাকে। ধীরে ধীরে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে থাকি। এক বাসা থেকে আরেক বাসার দূরত্ব কয়েক গজের ব্যবধান। পর্দা টানা না থাকলে কোন বাসায় কী হচ্ছে সবই দেখা যায়। তবু্ও একে অপরকে চিঠি লিখতে থাকি। তখন তো চিঠিই ছিল মনের ভাব আদান-প্রদানের কার্যকর মাধ্যম।
অপরিণত হৃদয়ের সেই চিঠিতে থাকতো কত আকুলতা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চিঠি লেখা ছিল খুব কঠিন। চিঠি বিনিময় করাও সহজ ছিল না। চালাচালি হতো মূলত সন্ধ্যার দিকে লাইটপোস্টের ধূসর আলোয়। কখনো বই লেনদেন করার উছিলায় তার ভিতরে থাকতো চিঠি। কখনো ওকে দেখিয়ে বাসার সামনে বাগানে নির্ধারিত স্থানে ইট চাপা দিয়ে চিঠি রেখে আসতাম। দূর থেকে নজরদারি করতাম। ও চিঠি নিয়ে সেখানে আরেকটি রেখে যেত। আমি ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতাম। কখনও ছোট ভাইবোনদের আইসক্রিম খাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের দিয়ে আমাকে চিঠি পাঠাতো। আমিও প্রতিত্তোর দিতাম। চিঠির সঙ্গে কখনো কখনো থাকতো গোলাপের পাপড়ি, ময়ূরের পালক। এভাবে চিঠিতে আমরা পরস্পরের হৃদয়ের কাছাকাছি হতে থাকি।
আমাদের বাসাগুলো ছিল দোতলা। দুজনেরই রুম ছিল দোতলায়। কখনো কখনো লাইট জ্বালিয়ে কিংবা নিভিয়ে একে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম। দুষ্টুমি করতাম। আকার-ইঙ্গিতে খোঁজ-খবর নিতেও সমস্যা হতো না। কোনো কোনো দিন মায়মুনা লুকিয়ে-চুরিয়ে কামিজের নিচে বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার আমার জন্য নিয়ে আসতো। সেই সময় কত দিন খেয়েছি নারকেলের পুলি পিঠা। খেতে যে কি মজা লাগতো। সুযোগ পেলে মায়মুনা কখনো সখনো আমাকে খাইয়ে দিত। সেই স্বাদ এখনো যেন ঠোঁটে লেগে আছে। আমিও বাসা থেকে টাকা-পয়সা চুরি করে ওকে গিফট কিনে দিতাম। দামি কিছু তো নয়। হয়তো ইমিটেশনের দুল, আংটি, রঙিন ফিতা কিংবা চকলেট। সেই বয়সে সেটাই ছিল অমূল্য। আমি ওকে ডাকতাম মৌনী নামে। কলেজে উঠার পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগে ওকে নিয়ে মনের কথা লিখেছি।
সম্পর্কটা গভীর হওয়ার সময় হঠাৎ যেন একটা ঘূর্ণি বাতাস ঝটিকার মতো এসে সব এলোমেলো করে দেয়। জাতীয় সংসদের চাকরিজীবীরা ছাড়া অন্যদের কলোনি ছেড়ে চলে যেতে নোটিশ দেওয়া হয়। আমাদের দুজনের পিতাই কর্মরত ছিলেন অন্য অফিসে। নোটিশপ্রাপ্তরা যেন অথৈ সাগরে পড়ে যায়। কে কোথায় ছিটকে পড়ে। আমরাও একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আর কখনও আমাদের যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু তাকে কখনও ভুলতে পারিনি।
যদিও আমাদের ভালোবাসা তখনও গভীরতর ছিল না। দূর থেকে দেখা কিংবা চিঠির মাধ্যমে টুকরো টুকরো হৃদয় বিনিময়। এর বেশি কিছু তো নয়। তবে তাতে ছিল সেই বয়সের আবেগ। কাঁচা সেই আবেগটা নিশ্চয়ই মিথ্যে ছিল না। যা আমাকে দীক্ষা দেয় ভালোলাগায়। যে কারণে তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে চিরন্তন হয়ে আছে।
আজ মিম মেয়েটিকে দেখে কত কাল আগের সেই স্মৃতি মনের মধ্যে তোলপাড় তুলছে। মনে হচ্ছে, অবিকল মৌনী যেন মিম হয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে। কোথায় যেন দুজনের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। এ কারণে তাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। এটা কি নিছক মনের কল্পনা? সেটাই তো হওয়ার কথা। কল্পনায় ছাড়া উভয়ের মধ্যে মিল হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। পরিচয়হীন দুই প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে এতটা সাদৃশ্য হয়ইবা কী করে? এটা কি নস্টালজিয়া?
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কেটে যায় ঘুম ঘুম ভাব। আমাকে সজাগ হতে দেখে মিম বলে, আঙ্কেল, আমরা তো প্রায় চলে এসেছি। আপনি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করে দিলেন। আপনার সঙ্গে তো বেশি কথাই হলো না।
একটু বিব্রত হয়ে বললাম, আসলে কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি তো। এ কারণে ক্লান্ত লাগছিল। তাই বোধহয় ঝিমুনি ভাব এসে যায়।
উৎফুল্ল হয়ে বলে মিম, জানেন আঙ্কেল, আমার কাছে ট্রেন জার্নি খুব ভালো লাগে। ইচ্ছেমতো চলাফেরা করা যায়। আমার কোথাও চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি ঢাকারই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবো। চট্টগ্রাম এলাম এই ট্রেন জার্নির লোভে। তা ছাড়া এই সুযোগে একটু ঘোরাঘুরিও করা যাবে।
আমারও কিন্তু তোমার মতো ট্রেন জার্নি পছন্দের। আর তোমার যা রেজাল্ট, তাতে ঢাকার সেরা কোনো প্রতিষ্ঠানে তুমি অনায়াসেই সুযোগ পাবে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা এখানে উঠবে কোথায়?
আমার খালার বাসায়। এই শহরেই থাকেন। আপনি কি চট্টগ্রামে কোনো কাজে যাচ্ছেন?
না না। চট্টগ্রামে আমার এক বন্ধু থাকে। তার আমন্ত্রণে বেড়াতে এসেছি। সেখানেই উঠবো।
এ সময় ফোন করে বেলাল। জানতে চায়, তুই কত দূর?
বললাম, এই তো চলে এসেছি।
আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। আয়।
ট্রেন থামার পর মিম, তার আম্মু আর আমি একসঙ্গে নামি। আমাকে দেখতে পেয়ে বেলাল কাছে আসে। বেলালকে দেখে মিমের আম্মু একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে, বেলাল ভাই আপনি এখানে?
আমাকে দেখিয়ে বেলাল বলে, আমি তো ওকে নিতে এসেছি। তোমরা কোথায় এসেছো?
মেয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য এসেছি। আপনি চট্টগ্রামে এসেছেন জানাননি তো।
আসলে বলতে খেয়াল ছিল না। এরপরে মিমের আম্মুকে দেখিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বেলাল বলে, এই, একে চিনিস?
আমি মাথা দুলিয়ে না বললাম।
একসঙ্গে এতটা পথ এলি। অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারলি না। আরে, এ তো আমাদের কলোনির মায়মুনা। মনে নেই তোর?
এতক্ষণে আমরা দুজন পরস্পরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। মায়মুনার চোখে কিশোরী বয়সের সেই চঞ্চলতাটুকু খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু ভারী চশমার আড়ালে তার চোখের ভাষা আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
শেয়ার করুন
দুলাল মাহমুদ | ২৮ মে, ২০২১ ০০:০১

আঙ্কেল, আমাদের সঙ্গে একটু শেয়ার করেন প্লিজ।
এমন অনুরোধে আমি রীতিমতো থতমত খেয়ে যাই। চেনা-পরিচয় নেই। এমনকি কোনো কথাও হয়নি। অথচ আমাকে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন আমি অপরিচিত কেউ নই। নিরুপায় হয়ে বললাম, আরে না না, তোমরাই খাও। আমাকে আবার কেন?
আমরা একসঙ্গেই তো যাচ্ছি। আপনার সামনে আমরাই শুধু খাবো, তা হয় নাকি?
আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, এই করোনাকালে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করাও তো ঠিক না।
আরে কিছু হবে না। আমার আম্মুর হাতে তৈরি। একটু খেয়ে দেখেন না?
এমন অকৃত্রিমভাবে অনুরোধ করায় এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। হাতে নিয়ে বললাম, এটা নিশ্চয়ই নারকেলের পুলি পিঠা। আমার খুব পছন্দসই ছিল। এখন আর খুব একটা খাওয়া হয় না। মুখে নিয়ে কামড় দিয়ে বললাম, খুবই মজা হয়েছে। কত দিন পর যে খাচ্ছি। অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। এই পিঠা নোয়াখালী এলাকায় খুব জনপ্রিয়।
আমাদের গ্রামের বাড়ি তো নোয়াখালী। আরেকটা নেন আঙ্কেল।
এই মেয়ে, এখন তো বয়স হয়েছে। বেশি মিষ্টি খাওয়া ঠিক নয়।
একদিন খেলে কিছু হবে না। খান তো।
মেয়েটা এত আন্তরিক, তাকে বারণ করতে ইচ্ছে করে না। তাই আরেকটা পিঠা নিয়ে বললাম, পরিচয় হওয়ার আগেই পিঠা খাওয়ায় ভাগ বসালাম। তোমার নামই তো জানা হলো না।
আমার নাম মাশিয়া মালিহা। কাছের মানুষরা মিম নামে ডাকে।
খুব সুন্দর নাম তো। তোমার নামের মধ্যে আলাদা একটা ব্যঞ্জনা আছে। তবে আমি তোমাকে মামা নামে ডাকবো।
মামা!
তোমার নামের প্রথম দুই অক্ষর জোড়া দিলে তো তাই হয়।
বাহ্। এমনটা তো কখনও ভেবে দেখিনি।
তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
চিটাগং ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। সঙ্গে যাচ্ছে আমার আম্মু।
মিমের আম্মুর পরনে হিজাব আর মাস্ক। চোখে চশমা। আপাদমস্তক ঢাকা। পরে আর কখনও দেখা হলেও চেনার কোনো উপায় থাকবে না। খুব চুপচাপ। ট্রেনে উঠার পর খুব একটা নড়াচড়া করতেও দেখিনি। জানালা দিয়ে বাইরের চলমান শোভা দেখতেই ব্যস্ত। মাঝে-মধ্যে মেয়ের সঙ্গে অনুচ্চ কণ্ঠে টুকটাক কথা বলেন। কখনও কখনও মেয়েকে আকারে-ইঙ্গিতে নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করেন। মেয়ে তার ইঙ্গিত থোড়াই কেয়ার করে। সে আছে তার নিজের মতো করে। পরিবেশটাকে যেন অনেকটা পারিবারিক উষ্ণতা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে।
মিমকে বললাম, সাধারণত মুখের ভাষা দিয়ে নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষদের চেনা যায়। তুমি যে নোয়াখালীর সন্তান, তোমার কথায় বোঝার একদমই উপায় নেই।
আমার তো ঢাকায় জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে উঠা। আমাকে ঢাকার মানুষ বলাই যেতে পারে। তবে পারিবারিক পরিসরে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জানালো মিম।
মেয়েটার সহজ-সরল আচরণ আর খোলামেলা কথাবার্তা আমার ভালো লেগে যায়। চলার পথে এমন একজন সঙ্গী পেলে ভ্রমণটা সরস হয়।
অনেক দিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বন্ধু বেলাল বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে অবস্থান করছে চট্টগ্রামে। তার পীড়াপীড়িতে সেখানে যাচ্ছি। বন্ধুদের মধ্যে ওই একমাত্র সবার খোঁজখবর ও যোগাযোগ রাখে। এমনকি আমরা একসময় যে এলাকায় থাকতাম, তারা এখন কে কোথায় আছে, সে খবরও তার কাছে পাওয়া যায়। বলা যায়, আমাদের শৈশব কৈশোরের সেতুবন্ধন হয়ে আছে বেলাল।
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনের এসি বার্থে উঠার পর আমার সামনের সারিতে বসা দেখতে পাই একজন মহিলা আর আরেকটা মেয়েকে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। হাসলে গালে টোল পড়ে। স্বভাবসুলভভাবে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। তারপর তো পরিচয় জানতে পারি। মিম মেয়েটার কারণে আমার একাকিত্ব ঘুচে যায়। মেয়েটা বেশ চঞ্চল। স্থিরভাবে বসে থাকছে না। যেন একটা চড়ুই পাখি। সবচেয়ে বড় গুণ, অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের। অচেনা, অজানা মানুষকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা আছে।
কথায় কথায় জানতে পারি, এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিও-৫ পেয়েছে। এখন ভর্তির জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। যেভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছে, যত্নআত্তি করছে, যেন আমি তার কত দিনের পরিচিত।
পরিচিত না হলেও কেন যেন একদম অপরিচিত মনে হচ্ছে না। খুবই চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছি না। অথচ এই মেয়েকে কোনোভাবেই চেনার প্রশ্নই আসে না। জীবনে কখনো দেখিনি। তারপরও মনের মধ্যে থেকে সংশয়টা যাচ্ছে না। মেয়েটার কথা বলার ধরন, হাসি, ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। এমন তো হতে পারে, আমার যেহেতু মেয়ে নেই, সে কারণে নিজের মেয়ে হিসেবে এমন একটা মেয়েকে কল্পনা করে আসছি। সেই কল্পনার সঙ্গে এই মেয়ের হয়তো সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছি। কিংবা আমার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন একটা মেয়ে, যার কথা ভুলতে পারিনি। তেমন হলে কে সেই মেয়ে? নাকি সবটাই আমার বয়সোচিত বিভ্রম? দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকি।
ট্রেনের দুলুনিতে কেমন ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে ভাবনা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজতে থাকি। একটু একটু করে যেন ভেসে ওঠতে থাকে একটা আবছায়া অবয়ব।
তখন আমরা শের-এ-বাংলা নগর কলোনিতে থাকি। কলোনিতে মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। অভিভাবকরা সবাই সরকারি চাকরিজীবী। বেশিরভাগই চাকরি করতেন জাতীয় সংসদ ভবনে। তবে সংসদ ভবনের এই বাসাগুলোতে অন্য অফিসের চাকরিজীবীরাও থাকতেন। সবার সঙ্গে সবার ছিল মিলমিশ। ছেলেমেয়েরা সবাই একসঙ্গে চলাফেরা খেলাধুলা করতো। গড়ে ওঠে একটা পারিবারিক বলয়। এই বলয়ের সবাই একে অপরের খোঁজ-খবর মোটামুটিভাবে রাখতো। অর্থনৈতিক আড়ম্বর না থাকলেও জীবন ছিল আনন্দদায়ক।
নোয়াখালীর মায়মুনারা ছিল অনেকগুলো ভাইবোন। আমরা সামনা-সামনি বাসায় থাকতাম। নিকটতম প্রতিবেশীই বলা যায়। মায়মুনার বাবা ছিলেন হুজুর ধরনের। ছেলেমেয়েদের মেলামেশা খুব একটা পছন্দ করতেন না। সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তাগিদ দিতেন। কিন্তু কোনো কিছু তার নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। বেশিক্ষণ খবরদারি করার সুযোগও পেতেন না। নানান কাজে এদিক-সেদিক যেতে হতো। সেই সুযোগে তার ছেলেমেয়েরাও ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করতো।
ভাইবোনদের মধ্যে মায়মুনা ছিল অসম্ভব ছটফটে। দেখতেও সুন্দর ছিল। মায়াকাড়া একটা চেহারা। হাসলে টোল পড়তো গালে। তখন সিক্স-সেভেনে পড়ে। কলোনির সর্বত্রই তার অবাধ চলাফেরা। সবার সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতো। খেলাধুলার ব্যাপারে তার কাছে ছেলে বা মেয়ে বলে আলাদা কিছু ছিল না। কাউকে রেয়াতও করতো না। সবাই তাকে একটু সমঝে চলতো। কিন্তু আমাকে কেন যেন একটু আলাদা চোখে দেখতো। খাতির করার চেষ্টা করতো।
সে সময় আমার মার্বেল খেলার প্রচণ্ড নেশা। স্কুল থেকে ফেরার পর বাসায় বই-খাতা রেখেই মার্বেল খেলতে চলে যেতাম। এইট না নাইনে পড়ি তখন। খেলতে খেলতে দুপুর পেরিয়ে গেলে মার খাওয়ার ভয়ে বাসায় ঢুকতে সাহস পেতাম না। ফিরতাম সন্ধ্যায়। তাতে কি আর রেহাই পাওয়া যায়? প্রায় প্রতিদিনই মায়ের হাতে হজম করতাম উত্তম-মধ্যম। পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো। এমনই ছিল মার্বেল খেলার দুর্বার নেশা।
একদিন ভর দুপুরে কাউকে না পেয়ে এলোমেলো ঘুরছিলাম। এমন সময় মায়মুনার সঙ্গে দেখা। ওর হাতে একটাই মার্বেল। আমাকে বলে, চলেন খেলি। বুঝতে পারতাম, আমার প্রতি ওর রয়েছে একটু দুর্বলতা। আমাকে দেখলে মোনালিসা হাসি হাসতো। তাতে বিব্রত বোধ করতাম। এ কারণে ওকে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু সেদিন কোনো খেলার সঙ্গী না পেয়ে অস্থির অস্থির লাগতে থাকে। আমি একটু দোনোমোনো করে খেলতে সম্মত হই। তখন তো ঝানু মার্বেল খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় আমার যথেষ্ট নামডাক। ভাবলাম এক দানেরই তো ব্যাপার। খেলি।
খেলতে খেলতে একপর্যায়ে আমি ফতুর হয়ে যাই। আমার তখন জেদ চেপে যায়। বাসা থেকে আরো মার্বেল নিয়ে এসে পাগলের মতো খেলতে থাকি আর হারতে থাকি। আমার শত শত মার্বেল মায়মুনার হস্তগত হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে যেতে থাকে। মায়মুনাকে বাসায় যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছে ওর ছোট ভাইবোনেরা। ও বাসায় চলে যেতে চায়। আমি তখন বেপরোয়া। তাকে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি নই। অগত্যা সে আমাকে বলে, আর খেলতে হবে না। সব মার্বেল এমনিই দিয়ে দিচ্ছি। আমি এভাবে আপষে মার্বেল নিতে রাজি নই। তা আমার আত্মসম্মানে লাগে। আমি ওকে খেলা চালিয়ে যেতে বাধ্য করি।
আমার গোঁয়ার্তুমির কাছে ওকে হার মানতে হয়। বাসায় ফিরতে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। ওর চোখে জল ছলছল করতে থাকে। দেরি হয়ে যাওয়ায় বাসায় ওর পিটুনি খেতে হবে। তাতেও আমার মন একটুও গলেনি। সেই বয়সে আমার জীবনের পরম সম্পদ ছিল মার্বেল। তারজন্য আমি সবকিছু বাজি ধরতে পারি। আর তা হারিয়ে আমি প্রায় নিঃস্ব। এটা কীভাবে মেনে নেব? আমার মনোভাব বুঝতে পেরে মায়মুনা হাল ছেড়ে দেয়। নামকাওয়াস্তে খেলতে থাকে। ততক্ষণে নেমে এসেছে সন্ধ্যা।
তারপর আমি ধীরে ধীরে খেলায় জিততে থাকি। দ্রুতই হারতে থাকে মায়মুনা। অথচ ও ছিল দুরন্ত স্বভাবের। চাইলেই মার্বেলগুলো নিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে যেতে পারতো। সেটা সে করেনি। না করার কারণ পরে বুঝতে পারি। আমার মন খারাপ হয়ে যাক, সেটা হয়তো সে চায়নি।
কিন্তু সেদিন থেকে আমার ভাবনায় দোলা দিয়ে যায় মায়মুনা। তার অশ্রুসজল চোখ যেন আমাকে অপরাধী করে তোলে। এরপর আর আমি তাকে এড়িয়ে যেতাম না। ওর দুষ্টুমি ওর চঞ্চলতা আমার ভালো লাগতে থাকে। আমার অজান্তে কীসের যেন একটা টোকা পড়ে হৃদয় মন্দিরে। বদলে যেতে থাকে আমার ভাবগতিক। ও তা বুঝতে পারে। আমাদের মধ্যে কথা হতে থাকে। ধীরে ধীরে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে থাকি। এক বাসা থেকে আরেক বাসার দূরত্ব কয়েক গজের ব্যবধান। পর্দা টানা না থাকলে কোন বাসায় কী হচ্ছে সবই দেখা যায়। তবু্ও একে অপরকে চিঠি লিখতে থাকি। তখন তো চিঠিই ছিল মনের ভাব আদান-প্রদানের কার্যকর মাধ্যম।
অপরিণত হৃদয়ের সেই চিঠিতে থাকতো কত আকুলতা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চিঠি লেখা ছিল খুব কঠিন। চিঠি বিনিময় করাও সহজ ছিল না। চালাচালি হতো মূলত সন্ধ্যার দিকে লাইটপোস্টের ধূসর আলোয়। কখনো বই লেনদেন করার উছিলায় তার ভিতরে থাকতো চিঠি। কখনো ওকে দেখিয়ে বাসার সামনে বাগানে নির্ধারিত স্থানে ইট চাপা দিয়ে চিঠি রেখে আসতাম। দূর থেকে নজরদারি করতাম। ও চিঠি নিয়ে সেখানে আরেকটি রেখে যেত। আমি ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতাম। কখনও ছোট ভাইবোনদের আইসক্রিম খাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের দিয়ে আমাকে চিঠি পাঠাতো। আমিও প্রতিত্তোর দিতাম। চিঠির সঙ্গে কখনো কখনো থাকতো গোলাপের পাপড়ি, ময়ূরের পালক। এভাবে চিঠিতে আমরা পরস্পরের হৃদয়ের কাছাকাছি হতে থাকি।
আমাদের বাসাগুলো ছিল দোতলা। দুজনেরই রুম ছিল দোতলায়। কখনো কখনো লাইট জ্বালিয়ে কিংবা নিভিয়ে একে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম। দুষ্টুমি করতাম। আকার-ইঙ্গিতে খোঁজ-খবর নিতেও সমস্যা হতো না। কোনো কোনো দিন মায়মুনা লুকিয়ে-চুরিয়ে কামিজের নিচে বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার আমার জন্য নিয়ে আসতো। সেই সময় কত দিন খেয়েছি নারকেলের পুলি পিঠা। খেতে যে কি মজা লাগতো। সুযোগ পেলে মায়মুনা কখনো সখনো আমাকে খাইয়ে দিত। সেই স্বাদ এখনো যেন ঠোঁটে লেগে আছে। আমিও বাসা থেকে টাকা-পয়সা চুরি করে ওকে গিফট কিনে দিতাম। দামি কিছু তো নয়। হয়তো ইমিটেশনের দুল, আংটি, রঙিন ফিতা কিংবা চকলেট। সেই বয়সে সেটাই ছিল অমূল্য। আমি ওকে ডাকতাম মৌনী নামে। কলেজে উঠার পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগে ওকে নিয়ে মনের কথা লিখেছি।
সম্পর্কটা গভীর হওয়ার সময় হঠাৎ যেন একটা ঘূর্ণি বাতাস ঝটিকার মতো এসে সব এলোমেলো করে দেয়। জাতীয় সংসদের চাকরিজীবীরা ছাড়া অন্যদের কলোনি ছেড়ে চলে যেতে নোটিশ দেওয়া হয়। আমাদের দুজনের পিতাই কর্মরত ছিলেন অন্য অফিসে। নোটিশপ্রাপ্তরা যেন অথৈ সাগরে পড়ে যায়। কে কোথায় ছিটকে পড়ে। আমরাও একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আর কখনও আমাদের যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু তাকে কখনও ভুলতে পারিনি।
যদিও আমাদের ভালোবাসা তখনও গভীরতর ছিল না। দূর থেকে দেখা কিংবা চিঠির মাধ্যমে টুকরো টুকরো হৃদয় বিনিময়। এর বেশি কিছু তো নয়। তবে তাতে ছিল সেই বয়সের আবেগ। কাঁচা সেই আবেগটা নিশ্চয়ই মিথ্যে ছিল না। যা আমাকে দীক্ষা দেয় ভালোলাগায়। যে কারণে তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে চিরন্তন হয়ে আছে।
আজ মিম মেয়েটিকে দেখে কত কাল আগের সেই স্মৃতি মনের মধ্যে তোলপাড় তুলছে। মনে হচ্ছে, অবিকল মৌনী যেন মিম হয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে। কোথায় যেন দুজনের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। এ কারণে তাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। এটা কি নিছক মনের কল্পনা? সেটাই তো হওয়ার কথা। কল্পনায় ছাড়া উভয়ের মধ্যে মিল হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। পরিচয়হীন দুই প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে এতটা সাদৃশ্য হয়ইবা কী করে? এটা কি নস্টালজিয়া?
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কেটে যায় ঘুম ঘুম ভাব। আমাকে সজাগ হতে দেখে মিম বলে, আঙ্কেল, আমরা তো প্রায় চলে এসেছি। আপনি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করে দিলেন। আপনার সঙ্গে তো বেশি কথাই হলো না।
একটু বিব্রত হয়ে বললাম, আসলে কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি তো। এ কারণে ক্লান্ত লাগছিল। তাই বোধহয় ঝিমুনি ভাব এসে যায়।
উৎফুল্ল হয়ে বলে মিম, জানেন আঙ্কেল, আমার কাছে ট্রেন জার্নি খুব ভালো লাগে। ইচ্ছেমতো চলাফেরা করা যায়। আমার কোথাও চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি ঢাকারই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবো। চট্টগ্রাম এলাম এই ট্রেন জার্নির লোভে। তা ছাড়া এই সুযোগে একটু ঘোরাঘুরিও করা যাবে।
আমারও কিন্তু তোমার মতো ট্রেন জার্নি পছন্দের। আর তোমার যা রেজাল্ট, তাতে ঢাকার সেরা কোনো প্রতিষ্ঠানে তুমি অনায়াসেই সুযোগ পাবে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা এখানে উঠবে কোথায়?
আমার খালার বাসায়। এই শহরেই থাকেন। আপনি কি চট্টগ্রামে কোনো কাজে যাচ্ছেন?
না না। চট্টগ্রামে আমার এক বন্ধু থাকে। তার আমন্ত্রণে বেড়াতে এসেছি। সেখানেই উঠবো।
এ সময় ফোন করে বেলাল। জানতে চায়, তুই কত দূর?
বললাম, এই তো চলে এসেছি।
আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। আয়।
ট্রেন থামার পর মিম, তার আম্মু আর আমি একসঙ্গে নামি। আমাকে দেখতে পেয়ে বেলাল কাছে আসে। বেলালকে দেখে মিমের আম্মু একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে, বেলাল ভাই আপনি এখানে?
আমাকে দেখিয়ে বেলাল বলে, আমি তো ওকে নিতে এসেছি। তোমরা কোথায় এসেছো?
মেয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য এসেছি। আপনি চট্টগ্রামে এসেছেন জানাননি তো।
আসলে বলতে খেয়াল ছিল না। এরপরে মিমের আম্মুকে দেখিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বেলাল বলে, এই, একে চিনিস?
আমি মাথা দুলিয়ে না বললাম।
একসঙ্গে এতটা পথ এলি। অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারলি না। আরে, এ তো আমাদের কলোনির মায়মুনা। মনে নেই তোর?
এতক্ষণে আমরা দুজন পরস্পরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। মায়মুনার চোখে কিশোরী বয়সের সেই চঞ্চলতাটুকু খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু ভারী চশমার আড়ালে তার চোখের ভাষা আমি ঠিক বুঝতে পারি না।