গল্প: নিজের সঙ্গে…
জিমি আমির | ১৬ জুলাই, ২০২১ ১২:৫৮
আম, কাঁঠাল পাকা গরম চলছে। বৃষ্টি হলে একটু আরাম লাগে। বৃষ্টি না থাকলেই গরম যেন হাড়ে গিয়ে ঠেকে। তার ওপর ঢাকার রাস্তার গরম আর চারিদিকের ভবনগুলো থেকে আসা তাপ, সব মিলিয়ে খাড়া দুপুরে মনে হচ্ছে একটা ওভেনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি।
কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নেই। প্রায় ৪০ মিনিট তো মনে হয় হয়েই গেল। কোনদিকে হাঁটছি তাও বুঝতে পারছি না।
বাসায় ফিরতে হবে তো! বাস কোনদিকে পাওয়া যাবে? নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে আবার হাঁটা শুরু করি। নাহ এভাবে হাঁটলে তো আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। আচ্ছা, কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে। কি ভাববে? ধুর এত ভেবে কাজ নেই। বরং দেখি কোনো মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি।
ভাই শাহাবাগ কোনদিকে?
আপনে কোন হানে যাইবেন?
মিরপুর ১০।
উল্টা দিকে হাঁটতেছেন ক্যান? এইডা তো কাকরাইল মোড়। সামনে হাঁটতে হাঁটতে হাতের বামে যাবেন। দেখবেন একটা চারমাথা। ওইখান থাইক্যা পশ্চিম দিকে যাবেন। বাসও যায়। চিনবার পারবেন?
জ্বি পারব, ধন্যবাদ ভাই।
হারুন ভাইয়ের অফিসে দেখা করার কথা গতকাল বেশ রাতে বলেছিল শাওন। তেমন ভাবার সময় পাওয়া যায়নি। এতদূর রাস্তা আসতে হবে কে জানত! তাহলে অন্তত আরো আগে বের হওয়া যেত। অল্প সময়ের জন্য এসে বেশি কথাই হলো না। মানুষের বাসায় থাকলে কত চিন্তা করে বাসা থেকে বের হতে হয়। আবার জ্যামের ঝক্কি তো আছেই। এই শহরে এত জ্যাম! একবার গাড়ি দাঁড়ায়ে গেলে নড়ার কথা ভুলে যায়। আবার তাড়াহুড়োয় একটা জর্জেট জামা গায়ে দিয়ে এই গরমে মনে হচ্ছে ফোসকা পড়ছে!
ওইতো চারমাথা পাওয়া গেছে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে… যাক রাস্তা তো পাওয়া গেল।
এদিকটায় বেশ গাছ আছে। কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আরে ক্ষুধা পেয়ে গেল তো। সকালে খালি পেটে বের হয়েছি। হারুন ভাইয়ের অফিসে চা, শিঙারা ছিল, খেতেও বলেছেন তবে উনি ব্যস্ততায় উঠে যাওয়ার পর একা আর খাওয়ার ইচ্ছা হয়নি।
নাহ বিকেল হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করা যাবে না। হাঁটি নাকি বাসে যাব? আচ্ছা যেতে থাকি, দেখি কি হয়! রাস্তাটা ভালই। মানুষের হাঁটাচলা কম। পায়ে পায়ে ঠোকর লাগে না।
উফ! কই এসে পড়লাম রাস্তা শেষ হয় না কেন? ওহ, ওইতো শেষ পর্যন্ত বাস দেখা যাচ্ছে। ইশ ৪টা বেজে গেছে।
ভাই, মিরপুর ১০ এর একটা টিকিট দেন।
দো-তলা বাসগুলোতে কিছুটা সুবিধা আছে, মোটামুটি সিট পাওয়া যায়। আর উপরে গিয়ে বসলে ভালই লাগে। ভালয় ভালয় সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারলেই হয়। মানুষের বাসা, থাকতে দিয়েছে, কোথাও বের হলে তেমন জিজ্ঞেস না করলেও আমি জানি তাদের চোখে থাকে হাজারটা জিজ্ঞাসা।
না, জিজ্ঞাসাগুলোকে ভয় পাইনা। ভয় পাই, ওদের প্রশ্নের ধরন দেখে। খুব গৎবাধা, গতানুগতিক, আটপৌরে, সস্তা প্রশ্ন! ভাল চাকরি, বাড়ি-গাড়ি কখনো কখনো মুখ্য হলে সেখানে প্রশ্ন খুব বৈচিত্র্য হওয়ার কথা না।
আচ্ছা, এই আমি গ্রাম থেকে আসা খুবই সাধারণ মেয়েটা যে এইসব ভাবছি, আমিই বা কি বুঝি এসবের? চাকরি, টাকা বাড়ি গাড়িও তো জরুরি বিষয় তাই না? কি যে উদ্ভট চিন্তা করি! সে যাই হোক, আমি আমার মতো বুঝি, আমার মতোই বুঝব!
আচ্ছা, বাসে এত জায়গা থাকতে এখানেই আপনার দাঁড়াতে হবে? তাও আবার আমার শরীরের ওপর হেলান দিয়ে আছেন কেন? কি সমস্যা আপনার?
আমি কি করলাম? আপনি তো সিটে বসে আছেন তাও এত কথা বলেন? এতই যখন সমস্যা তাহলে নিজের গাড়ি নিয়ে চলেন?
ওইদিকে তো অনেক জায়গা আছে ওইখানে গিয়ে দাঁড়ান!
আপনি কে? এত কথা বলেন কেন?
মানুষগুলো এমন কেন!
এতক্ষণে কেবল বিজয়স্বরনী। উফ, খোদা কখন যাব। ঢাকায় বাসগুলো একেকটা বিভীষিকার মতো। আর সময়কে দেখে হাসে এই শহর। জীবন, সময়ের মূল্য এই শহরে নেই। সবাই যন্ত্রের মতো ছুটে চলে। শুধু বাঁচার আশায়। অথচ বাঁচতে গিয়ে সবাই মরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
যতক্ষণ বাসে থাকি ততক্ষণ দমটা আটকানো থাকে। অবশ্য এখনো অভিজ্ঞতা তো তেমন হয়নি। আসলামই মাত্র কয়েকদিন হলো। ভাগ্যিস বাসার কাছ থেকেই বাসে ওঠা যায়। সন্ধ্যা হলেও বাসায় ঢুকতে তেমন ঝামেলা হয় না। তবে, ঢোকার পরে নিজের কাছেই পরিবেশটা যেন কেমন মনে হয়! তবে, বাচ্চারা একটু অন্যরকম। আমাকে ওরা বেশ পছন্দ করেছে বলেই মনে হয়।
এইতো সেদিন হঠাৎই ঝোঁকের মাথায় বাড়ি থেকে চলে আসলাম। আম্মা আমার এই বোনের কাছে চিঠি লিখে দিলেন যেন আমাকে কয়েকটা দিন থাকতে দেয়। কি অদ্ভুত আম্মা আমার এই বোনকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, তার কাছেই অনুনয় করে মেয়ের জন্য চিঠি লিখেতে হলো। আর আসার পর তাদের যে চেহারা দেখছি তাতে ফিরে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেব? দেখিইনা একবার ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে! আব্বা তো জানে না আমি চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসেছি। বলে এসেছি কয়েকদিন থেকে চলে আসব। কিন্তু প্রায় মাসখানেক হতে চলল কিছুই করতে পারলাম না। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। ফিরে গেলে নিজের ভবিষ্যৎ বলতে আর কিছু থাকবে না।
হায় খোদা আজ কখন বাসায় যাব? আপা, দুলাভাই বাসায় ঢোকার আগে আমি ঢুকে যেতে পারলে গুমোট পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যেতাম।
আপা একটু সরেন নেমে যাব।
ঠিক আছে।
এখন একটু জানালার ধারে বসি। দোতলা বাসে যাতায়াতে উপরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে দেখলে অনেক ভাল্লাগে আমার। ঠিক নিজের মতো থাকা মনে হয়। তাওতো ভাল আজ সিট পেয়েছি। এর আগে একদিন বাংলামোটরে এক অফিসে আসছিলাম। বিকেলে বাসের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম এখানেই তো সিগন্যাল সহজেই উঠে যেতে পারব। কিন্তু হায় সব বাস ভর্তি হয়ে আসে। কোনো বাস খালি থাকলেও উঠতে গেলেই সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। দৌড়েও পেরে উঠিনা।
সেদিন এই অবস্থায় প্রায় ঘন্টাখানেক পর হাঁটা শুরু করলাম ফার্মগেটের দিকে। কারণ, ওই স্ট্যান্ডে বাস থেকে যাত্রী নেমে গেলে অন্তত দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু সেদিন ফার্মগেটে গিয়েও প্রায় কান্না পাচ্ছিল। একের পর এক বাস আসছে কোনো বাসেই উঠতে পারছিলাম না। বাসের মুখে মুহূর্তের মধ্যে অনেক মানুষের জটলা তৈরি হয়। তারা সবাই হাতল ধরে দরজার সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোক নামার আগেই ওঠার চেষ্টা করে। আমি বেচারি কিছুই করতে পারিনা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে একটু পর মাগরিবের আজান দেবে। কি করি এখন? এবার উঠতেই হবে যেভাবেই হোক। শেষ পর্যন্ত চাপাচাপি ঠেলে উঠতে পেরেছিলাম। ওঠার পর ঠিক দরজার কাছে জানালার সঙ্গে একটু হেলান দিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে, নড়াচড়ার কোনো উপায় ছিল না। যাক তবু তো বাসায় যাচ্ছি!
ওমা কখন এত লোক উঠল বাসে? উপরেও ভিড়ে ঠাসা। এতক্ষণ তো খেয়ালই করা হয়নি। মাত্র মানিক মিয়া এভিনিউ পার হচ্ছি। আজ খবরই আছে। বাসায় ঢুকতে কয়টা বাজবে কে জানে?
গ্রাম থেকে কেন এসেছি এই পোড়া শহরে? চাকরি পাওয়া এত সহজ? শহরের নামকরা স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে চাকরি পেতে স্যান্ডেল ক্ষয় হয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, সেখানে আমি কোন সাহসে এসেছি কে জানে? কি হল আমার? এই শহরে জায়গা পাওয়া তো ভাগ্যের বিষয়। অন্যদিকে, খালি হাতে ফিরে গেলে মুখ দেখাব কাকে? ধুর, ভাল লাগে না কিছু।
এই যাহ, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কত দূর এলাম, বৃষ্টিতে কিছু দেখাও যায় না। ছাতা নেই, এখন ভিজে বাসায় ঢুকতে হবে। তবে, বাসের ভেতর ঠাসা মানুষের গরমে শান্তি লাগছে এই বৃষ্টির ঠান্ডা।
শেওড়াপাড়া, শেওড়াপাড়া কেউ আছেন নামার?
ওহ আর একটু।
ভাই, একটু সরে দাঁড়ান নামব। মামা একটু দেখি?
আপা, নামবেন আপনি?
হ্যাঁ
এমা, এত পানি আর কাদা! স্যান্ডেলের তো ১২টা বাজবে আজ। কি মনে করে যে আপার স্যান্ডেলটা পরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়িই তো বাসায় যাব টের পাবে না। ভাগ্নিরা আমার লক্ষ্মী। ওরা আমাকে ভালোবাসে। এসব নিয়ে ওদের মাথাব্যাথা নেই। অবশ্য স্যান্ডেলটা পুরোনো, কাদামাখা দেখলে কি রাগ করবে?
নিলা আপা, ভিজা আইলেন কোত্থেকে?
আর বইলেন না ফারুক ভাই। সেই কখন বাসে উঠছি। বৃষ্টির আগেই চলে আসার কথা, দেখেন আসলাম কখন!
ঢাহা শহরে এইসব কইয়া কোনো ফায়দা নাই। কেবল তো আইছেন আস্তে আস্তে আরো কত কি দ্যাখবেন!
ফারুক ভাই, আপা দুলাভাই আসছে?
হ, আইছে একটু আগে।
ওহ।
সকালে আপনে বাইর হওনের সময় তো আপারা গাড়ি নিয়ে অফিসে যাইতেছিল, আপনে লগে গেলেও তো পারতেন। আপনে দেখি একলা হাইট্যা গেলেন।
না ফারুক ভাই, আমি অন্য দিকে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে ওঠে তো লাভ নেই।
ও আইচ্ছা।
সকালে আমার যাবার পথেই আপা, দুলা ভাইয়ের অফিস। চাইলে ওরা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারত! ইচ্ছে করলে হয়তো নিয়েও যেতে পারত!
কেয়ারটেকার ফারুক ভাই ওটা খেয়াল করেছেন। লোকটা ভালই। দেখা হলেই হাসি দিয়ে বলে নিলা আপা ভাল আছেন। বাইরে বের হলে জিজ্ঞেস করে আপা যাইতে পারবেন তো? আমার নম্বর নিয়া যান, রাস্তা না চিনলে বা ঝামেলা হইলে ফোন দিয়েন। কিন্তু দূর থেকে ফোন দিয়ে উনি কীভাবে বাঁচাবেন এটা কখনো ভাবা হয়নি। যাক, উনি আমাকে পছন্দ করেন এটাই ভাল লাগার বিষয়।
প্রায় ৭টা বেজে গেছে। কে যে এখন দরজা খুলবে। খোদা, কোনো গুমোট পরিবেশ যেন তৈরি না হয়।
সারাদিন কি এত ব্যস্ততা যে এতক্ষণ লাগল বাসায় আসতে? দরজা খুলে এই কথা বলেই পায়ের দিকে তাকাল আপা!!
শেয়ার করুন
জিমি আমির | ১৬ জুলাই, ২০২১ ১২:৫৮

আম, কাঁঠাল পাকা গরম চলছে। বৃষ্টি হলে একটু আরাম লাগে। বৃষ্টি না থাকলেই গরম যেন হাড়ে গিয়ে ঠেকে। তার ওপর ঢাকার রাস্তার গরম আর চারিদিকের ভবনগুলো থেকে আসা তাপ, সব মিলিয়ে খাড়া দুপুরে মনে হচ্ছে একটা ওভেনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি।
কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নেই। প্রায় ৪০ মিনিট তো মনে হয় হয়েই গেল। কোনদিকে হাঁটছি তাও বুঝতে পারছি না।
বাসায় ফিরতে হবে তো! বাস কোনদিকে পাওয়া যাবে? নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে আবার হাঁটা শুরু করি। নাহ এভাবে হাঁটলে তো আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। আচ্ছা, কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে। কি ভাববে? ধুর এত ভেবে কাজ নেই। বরং দেখি কোনো মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি।
ভাই শাহাবাগ কোনদিকে?
আপনে কোন হানে যাইবেন?
মিরপুর ১০।
উল্টা দিকে হাঁটতেছেন ক্যান? এইডা তো কাকরাইল মোড়। সামনে হাঁটতে হাঁটতে হাতের বামে যাবেন। দেখবেন একটা চারমাথা। ওইখান থাইক্যা পশ্চিম দিকে যাবেন। বাসও যায়। চিনবার পারবেন?
জ্বি পারব, ধন্যবাদ ভাই।
হারুন ভাইয়ের অফিসে দেখা করার কথা গতকাল বেশ রাতে বলেছিল শাওন। তেমন ভাবার সময় পাওয়া যায়নি। এতদূর রাস্তা আসতে হবে কে জানত! তাহলে অন্তত আরো আগে বের হওয়া যেত। অল্প সময়ের জন্য এসে বেশি কথাই হলো না। মানুষের বাসায় থাকলে কত চিন্তা করে বাসা থেকে বের হতে হয়। আবার জ্যামের ঝক্কি তো আছেই। এই শহরে এত জ্যাম! একবার গাড়ি দাঁড়ায়ে গেলে নড়ার কথা ভুলে যায়। আবার তাড়াহুড়োয় একটা জর্জেট জামা গায়ে দিয়ে এই গরমে মনে হচ্ছে ফোসকা পড়ছে!
ওইতো চারমাথা পাওয়া গেছে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে… যাক রাস্তা তো পাওয়া গেল।
এদিকটায় বেশ গাছ আছে। কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আরে ক্ষুধা পেয়ে গেল তো। সকালে খালি পেটে বের হয়েছি। হারুন ভাইয়ের অফিসে চা, শিঙারা ছিল, খেতেও বলেছেন তবে উনি ব্যস্ততায় উঠে যাওয়ার পর একা আর খাওয়ার ইচ্ছা হয়নি।
নাহ বিকেল হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করা যাবে না। হাঁটি নাকি বাসে যাব? আচ্ছা যেতে থাকি, দেখি কি হয়! রাস্তাটা ভালই। মানুষের হাঁটাচলা কম। পায়ে পায়ে ঠোকর লাগে না।
উফ! কই এসে পড়লাম রাস্তা শেষ হয় না কেন? ওহ, ওইতো শেষ পর্যন্ত বাস দেখা যাচ্ছে। ইশ ৪টা বেজে গেছে।
ভাই, মিরপুর ১০ এর একটা টিকিট দেন।
দো-তলা বাসগুলোতে কিছুটা সুবিধা আছে, মোটামুটি সিট পাওয়া যায়। আর উপরে গিয়ে বসলে ভালই লাগে। ভালয় ভালয় সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারলেই হয়। মানুষের বাসা, থাকতে দিয়েছে, কোথাও বের হলে তেমন জিজ্ঞেস না করলেও আমি জানি তাদের চোখে থাকে হাজারটা জিজ্ঞাসা।
না, জিজ্ঞাসাগুলোকে ভয় পাইনা। ভয় পাই, ওদের প্রশ্নের ধরন দেখে। খুব গৎবাধা, গতানুগতিক, আটপৌরে, সস্তা প্রশ্ন! ভাল চাকরি, বাড়ি-গাড়ি কখনো কখনো মুখ্য হলে সেখানে প্রশ্ন খুব বৈচিত্র্য হওয়ার কথা না।
আচ্ছা, এই আমি গ্রাম থেকে আসা খুবই সাধারণ মেয়েটা যে এইসব ভাবছি, আমিই বা কি বুঝি এসবের? চাকরি, টাকা বাড়ি গাড়িও তো জরুরি বিষয় তাই না? কি যে উদ্ভট চিন্তা করি! সে যাই হোক, আমি আমার মতো বুঝি, আমার মতোই বুঝব!
আচ্ছা, বাসে এত জায়গা থাকতে এখানেই আপনার দাঁড়াতে হবে? তাও আবার আমার শরীরের ওপর হেলান দিয়ে আছেন কেন? কি সমস্যা আপনার?
আমি কি করলাম? আপনি তো সিটে বসে আছেন তাও এত কথা বলেন? এতই যখন সমস্যা তাহলে নিজের গাড়ি নিয়ে চলেন?
ওইদিকে তো অনেক জায়গা আছে ওইখানে গিয়ে দাঁড়ান!
আপনি কে? এত কথা বলেন কেন?
মানুষগুলো এমন কেন!
এতক্ষণে কেবল বিজয়স্বরনী। উফ, খোদা কখন যাব। ঢাকায় বাসগুলো একেকটা বিভীষিকার মতো। আর সময়কে দেখে হাসে এই শহর। জীবন, সময়ের মূল্য এই শহরে নেই। সবাই যন্ত্রের মতো ছুটে চলে। শুধু বাঁচার আশায়। অথচ বাঁচতে গিয়ে সবাই মরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
যতক্ষণ বাসে থাকি ততক্ষণ দমটা আটকানো থাকে। অবশ্য এখনো অভিজ্ঞতা তো তেমন হয়নি। আসলামই মাত্র কয়েকদিন হলো। ভাগ্যিস বাসার কাছ থেকেই বাসে ওঠা যায়। সন্ধ্যা হলেও বাসায় ঢুকতে তেমন ঝামেলা হয় না। তবে, ঢোকার পরে নিজের কাছেই পরিবেশটা যেন কেমন মনে হয়! তবে, বাচ্চারা একটু অন্যরকম। আমাকে ওরা বেশ পছন্দ করেছে বলেই মনে হয়।
এইতো সেদিন হঠাৎই ঝোঁকের মাথায় বাড়ি থেকে চলে আসলাম। আম্মা আমার এই বোনের কাছে চিঠি লিখে দিলেন যেন আমাকে কয়েকটা দিন থাকতে দেয়। কি অদ্ভুত আম্মা আমার এই বোনকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, তার কাছেই অনুনয় করে মেয়ের জন্য চিঠি লিখেতে হলো। আর আসার পর তাদের যে চেহারা দেখছি তাতে ফিরে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেব? দেখিইনা একবার ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে! আব্বা তো জানে না আমি চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসেছি। বলে এসেছি কয়েকদিন থেকে চলে আসব। কিন্তু প্রায় মাসখানেক হতে চলল কিছুই করতে পারলাম না। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। ফিরে গেলে নিজের ভবিষ্যৎ বলতে আর কিছু থাকবে না।
হায় খোদা আজ কখন বাসায় যাব? আপা, দুলাভাই বাসায় ঢোকার আগে আমি ঢুকে যেতে পারলে গুমোট পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যেতাম।
আপা একটু সরেন নেমে যাব।
ঠিক আছে।
এখন একটু জানালার ধারে বসি। দোতলা বাসে যাতায়াতে উপরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে দেখলে অনেক ভাল্লাগে আমার। ঠিক নিজের মতো থাকা মনে হয়। তাওতো ভাল আজ সিট পেয়েছি। এর আগে একদিন বাংলামোটরে এক অফিসে আসছিলাম। বিকেলে বাসের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম এখানেই তো সিগন্যাল সহজেই উঠে যেতে পারব। কিন্তু হায় সব বাস ভর্তি হয়ে আসে। কোনো বাস খালি থাকলেও উঠতে গেলেই সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। দৌড়েও পেরে উঠিনা।
সেদিন এই অবস্থায় প্রায় ঘন্টাখানেক পর হাঁটা শুরু করলাম ফার্মগেটের দিকে। কারণ, ওই স্ট্যান্ডে বাস থেকে যাত্রী নেমে গেলে অন্তত দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু সেদিন ফার্মগেটে গিয়েও প্রায় কান্না পাচ্ছিল। একের পর এক বাস আসছে কোনো বাসেই উঠতে পারছিলাম না। বাসের মুখে মুহূর্তের মধ্যে অনেক মানুষের জটলা তৈরি হয়। তারা সবাই হাতল ধরে দরজার সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোক নামার আগেই ওঠার চেষ্টা করে। আমি বেচারি কিছুই করতে পারিনা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে একটু পর মাগরিবের আজান দেবে। কি করি এখন? এবার উঠতেই হবে যেভাবেই হোক। শেষ পর্যন্ত চাপাচাপি ঠেলে উঠতে পেরেছিলাম। ওঠার পর ঠিক দরজার কাছে জানালার সঙ্গে একটু হেলান দিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে, নড়াচড়ার কোনো উপায় ছিল না। যাক তবু তো বাসায় যাচ্ছি!
ওমা কখন এত লোক উঠল বাসে? উপরেও ভিড়ে ঠাসা। এতক্ষণ তো খেয়ালই করা হয়নি। মাত্র মানিক মিয়া এভিনিউ পার হচ্ছি। আজ খবরই আছে। বাসায় ঢুকতে কয়টা বাজবে কে জানে?
গ্রাম থেকে কেন এসেছি এই পোড়া শহরে? চাকরি পাওয়া এত সহজ? শহরের নামকরা স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে চাকরি পেতে স্যান্ডেল ক্ষয় হয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, সেখানে আমি কোন সাহসে এসেছি কে জানে? কি হল আমার? এই শহরে জায়গা পাওয়া তো ভাগ্যের বিষয়। অন্যদিকে, খালি হাতে ফিরে গেলে মুখ দেখাব কাকে? ধুর, ভাল লাগে না কিছু।
এই যাহ, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কত দূর এলাম, বৃষ্টিতে কিছু দেখাও যায় না। ছাতা নেই, এখন ভিজে বাসায় ঢুকতে হবে। তবে, বাসের ভেতর ঠাসা মানুষের গরমে শান্তি লাগছে এই বৃষ্টির ঠান্ডা।
শেওড়াপাড়া, শেওড়াপাড়া কেউ আছেন নামার?
ওহ আর একটু।
ভাই, একটু সরে দাঁড়ান নামব। মামা একটু দেখি?
আপা, নামবেন আপনি?
হ্যাঁ
এমা, এত পানি আর কাদা! স্যান্ডেলের তো ১২টা বাজবে আজ। কি মনে করে যে আপার স্যান্ডেলটা পরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়িই তো বাসায় যাব টের পাবে না। ভাগ্নিরা আমার লক্ষ্মী। ওরা আমাকে ভালোবাসে। এসব নিয়ে ওদের মাথাব্যাথা নেই। অবশ্য স্যান্ডেলটা পুরোনো, কাদামাখা দেখলে কি রাগ করবে?
নিলা আপা, ভিজা আইলেন কোত্থেকে?
আর বইলেন না ফারুক ভাই। সেই কখন বাসে উঠছি। বৃষ্টির আগেই চলে আসার কথা, দেখেন আসলাম কখন!
ঢাহা শহরে এইসব কইয়া কোনো ফায়দা নাই। কেবল তো আইছেন আস্তে আস্তে আরো কত কি দ্যাখবেন!
ফারুক ভাই, আপা দুলাভাই আসছে?
হ, আইছে একটু আগে।
ওহ।
সকালে আপনে বাইর হওনের সময় তো আপারা গাড়ি নিয়ে অফিসে যাইতেছিল, আপনে লগে গেলেও তো পারতেন। আপনে দেখি একলা হাইট্যা গেলেন।
না ফারুক ভাই, আমি অন্য দিকে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে ওঠে তো লাভ নেই।
ও আইচ্ছা।
সকালে আমার যাবার পথেই আপা, দুলা ভাইয়ের অফিস। চাইলে ওরা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারত! ইচ্ছে করলে হয়তো নিয়েও যেতে পারত!
কেয়ারটেকার ফারুক ভাই ওটা খেয়াল করেছেন। লোকটা ভালই। দেখা হলেই হাসি দিয়ে বলে নিলা আপা ভাল আছেন। বাইরে বের হলে জিজ্ঞেস করে আপা যাইতে পারবেন তো? আমার নম্বর নিয়া যান, রাস্তা না চিনলে বা ঝামেলা হইলে ফোন দিয়েন। কিন্তু দূর থেকে ফোন দিয়ে উনি কীভাবে বাঁচাবেন এটা কখনো ভাবা হয়নি। যাক, উনি আমাকে পছন্দ করেন এটাই ভাল লাগার বিষয়।
প্রায় ৭টা বেজে গেছে। কে যে এখন দরজা খুলবে। খোদা, কোনো গুমোট পরিবেশ যেন তৈরি না হয়।
সারাদিন কি এত ব্যস্ততা যে এতক্ষণ লাগল বাসায় আসতে? দরজা খুলে এই কথা বলেই পায়ের দিকে তাকাল আপা!!