ছায়ামানুষ
পিওনা আফরোজ | ৩১ জুলাই, ২০২১ ১২:২৯
পিওনা আফরোজ
বিকেলটা যায় যায় করছে। গোধূলিলগ্নে প্রকৃতিতে শীতের কনকনে হাওয়া। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দাঁড়াতেই দেখি অপরিচিত এক তরুণ। সুদর্শন। বললাম, আপনি?
আমি পাশেই থাকি। নতুন এসেছি।
ও,আচ্ছা। বলুন।
ভেতরে আসি?
হুম, আসুন।
আগন্তুক সোফাটা দেখিয়ে বললেন, বসব?
বসুন।
তখন ঘরে গান বাজছে। ‘জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আজও আমি সবকিছু ভুলে যেন করি লেনদেন / তুমিও তো বেশ আছো, ভালোই আছো, কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেন।’
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর এই গানটি আমার বেশ প্রিয়। প্রায়ই শোনা হয়। গান শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যাই। গানের প্রতিটি শব্দে, সুরে নিজেকে যেন হারিয়ে আবার খুঁজি। তখন কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কিন্তু আগন্তুক প্রতিবেশী। তা ওপর প্রথমবার এসেছেন। কথা না বলাটা ভালো দেখায় না ।
দু'জনে মুখোমুখি বসলাম।
তিনি বললেন, আমি আসিফ। আপনি?
আমি কেয়া।
আপনার অফিস নেই আজ?
না, আজ যাইনি।
কিছু মনে করবেন না। কোনো সমস্যা?
ঠিক বুঝলাম না। কীসের সমস্যা?
অফিস যাননি, ভাবলাম শরীর-টরীর খারাপ হলো কি না?
না।
ও বুঝতে পেরেছি। ছুটিতে আছেন?
জ্বী। কিন্তু, আমি চাকরি করি, আপনি জানলেন কীভাবে?
আপনি তো আমার বাসার পাশেই থাকেন। প্রতিদিন সকালে দেখি আপনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
অন্য কোথাও তো যেতে পারি। পারি না?
না। কারণ আমি প্রতিদিনই আপনাকে একই সময়ে যেতে দেখেছি। সেই সকালে বেরিয়ে যান আর রাতে ফেরেন। তবে আপনার যাওয়াটা অন্যরকম। এক ধরনের ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।
অবাক হয়ে ভাবলাম, কী বলছে লোকটা! যাওয়া-আসার মাঝে আবার ভালো লাগা থাকে? কে জানে? প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,
কতদিন ধরে আমাকে চেনেন, বলুন তো?
অনেকদিন...। বছর তিনেক তো হবেই।
ভাবলাম, এতগুলো দিন... পাশেই বাড়ি অথচ তাকে একবারও আমি দেখিনি! পরক্ষণেই মনে হলো, হতেই পারে। জীবনের কতো কিছুই তো আমাদের অগোচরে রয়ে যায়। দেখাশোনার বাইরে...।
তা ছাড়া বড় শহরের মানুষজন তো এ রকমই। অনেকদিন পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও কেউ কাউকে চেনে না, জানে না— এমন লোকই বেশি। তাতে কারও কিছু যায় আসে না। এই ভদ্রলোকটি হয়তো পরিচিত হতেই এসেছেন। সে জন্য সৌজন্যবোধ একটু দেখাতেই হয়। তাই বললাম, একটু বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে এসে দেখি ভদ্রলোক নেই। ব্যাপার কী! কিছু না বলেই চলে গেলেন! এ কেমন ভদ্রতা? তবুও ভাবলাম, হতে পারে জরুরী কোনো ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেছেন। বলার সুযোগটুকুও পাননি হয়তো।
ইদানীং প্রায় সময়ই আসিফ তার ব্যবসার কাজ শেষে বাসায় চলে আসে। কখনো কখনো আমি অফিস থেকে ফিরে দেখি বাসায় মায়ের সাথে বসে গল্প করছে। এক সাথে চা খাচ্ছে। আমি আসিফের এই আসা না আসার ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিই না। যদিও লক্ষ্য করছিলাম, আমাদের পরিবারের সবার সাথে তার ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
তাছাড়া বাসায় আমার কতটুকু সময়ই বা থাকা হয়! সারাদিন অফিস, সেখান থেকে টিউশনি, বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসা, তারপর ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া। কতদিন বসার ঘরে ঢুকে একটু টেলিভিশন দেখা কিংবা কারও সঙ্গে বসে একটু গল্প করারও সময় হয় না। তারপরও আসিফকে দেখলে কিছুক্ষণ বসি। এটা-সেটা নিয়ে কথাবার্তাও হয়। সাধারণত সেই বলে, আমি শুধু শুনি। সে কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দিই, অথবা হেসে চুপ থাকি। এভাবেই সময়ের স্রোতে আমাদের সম্পর্কটা কখন যেন আপনি থেকে তুমিতে এসে পৌঁছেছে, বুঝতে পারিনি।
আজ বিকেলেও আসিফ বাসায় এলো। ছুটির দিন বলে আমি বাসায় ছিলাম। ড্রয়িং রুমে একা বসে খবরের কাগজটা দেখছিলাম। মা ভেতরের ঘরে। আমার মুখোমুখি বসেই আসিফ বলল, কোথাও যাবে?
বললাম, কোথায়?
চলো, বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।
আজ নয়। আমার ভালো লাগছে না।
বেরোলেই ভালো লাগবে।
আসিফের মধ্যে কিছুদিন ধরেই একটা বিষয় লক্ষ্য করছিলাম, মানুষটার কথায় কী রকম যেন একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। কিছু বললে না করা যায় না। আজও শেষ পর্যন্ত তাই হলো।
আমি আসিফকে বসিয়ে রেখেই তৈরি হয়ে নিলাম। নীল শাড়ি পরলাম। কপালে নীল টিপ, খোলা চুল, চোখে কাজল। এমন করে আর কখনো সাজিনি। অবাক হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের জন্য খুব যত্ন করে নিজেকে সাজালাম। গয়না পরতে আমার তেমন ভালো লাগে না। আজ হালকা গয়নাও পরলাম।
ছোটবেলায় বাবার দেওয়া চেইনটা অনেকদিন পর গলায় পরলাম। মনে হলো, যেন বাবার স্পর্শ পেলাম। আমার দেরি দেখে আসিফ হয়তো অস্থির হয়ে উঠছিল। তাই হয়তো একবার দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখল। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলল না। হয়তোবা আমি সেজেছি দেখে তার মুগ্ধতার কথা জানাতে চেয়েছিল। কি জানি?
মাকে বলে দু'জনে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় উঠে আসিফ রিকশাওয়ালাকে বলল আশুলিয়ার দিকে যেতে। রিকশার ঝাঁকুনিতে দু’জনের শরীর বারবার দুজনের শরীরে ধাক্কা খাচ্ছে। নিজেকে যতই গুটিয়ে নিতে চাইছি, কিছুতেই এই অসভ্য ঝাঁকুনি থেকে মুক্তি মিলছে না। আসিফ কয়েকবার আমার চোখে চোখ রেখে তাকাল। মনে হলো সেও লজ্জা পাচ্ছে। আবার এরকমটাও হতে পারে, মনে মনে রিকশাওয়ালা আর ভাঙা রাস্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, কে জানে? আশুলিয়ায় পৌঁছবার পর আসিফ এক জায়গায় রিকশাটাকে থামতে বলল। আমার হাত ছুঁয়ে সে আমাকে রিকশা থেকে নামালো। তার হাতের স্পর্শে আমার সারা শরীরে কী রকম যেন একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনে এমন অনুভূতি আমার আর কখনো হয়নি।
চটপটির একটা দোকানের পাশে আমরা বসলাম। তখন ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। চটপটির প্লেট হাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দু’জন গল্পের মাঝে হারিয়ে গেলাম। দু’জনে কত শত বিষয় নিয়ে গল্প করি। কথা ফুরিয়ে গেলে মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করে আসিফ। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে ওর গান শুনি।
আচ্ছা, ও কি আমার মনটা পড়তে পারছে? তা না হলে আমার ভালো লাগার মত করে কথাগুলো বলছে কীভাবে? আমার পছন্দের গান ও গাইছে, কী করে?
সময়টা বেশ কাটছিল আমাদের। হঠাৎই আকাশটা গাঢ় অন্ধকার হয়ে এল। চোখে, মুখে বৃষ্টির দু-একটা ফোটা এসে পড়ছে। তারপর টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির এমন রসিকতা ভালো লাগেনি। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। বৃষ্টি আরও তেড়ে আসার আগেই আমরা বাসার দিকে রওনা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামল। সেই সাথে ঝোড়ো বাতাস। কিন্তু আমার অনুভূতিটা এবার অন্যরকম। রিকশার ঝাঁকুনি, বৃষ্টির ছাঁট, ঠান্ডা বাতাস, পাশে পুরুষের উষ্ণতা, বেশ লাগছিল। নিজেকে অন্য এক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। এ যেন অন্য কোনো কেয়া, যার জীবনে কখনো দুঃখের আঁচড় লাগেনি। যার কোনো না পাওয়ার বেদনা নেই। নেই সংসারের নিত্য অভাবের সঙ্গে পরিচয় ।
স্মৃতিতে রাখা সোনালি দিনের মতো একটি দিন দু'জনে একসাথে কাটালাম। ভালো লাগার অনুভূতিগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, এমনকি পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেও তার রেশটুকু অনুভব করছিলাম।
এরপর মাঝে মধ্যেই আসিফের সাথে বাইরে বেরোতাম। ঘরে-বাইরে যখনই দেখা হতো কত কিছু নিয়ে যে আমাদের মধ্যে কথা হতো। ঘরের গল্প, অফিসের গল্প, কলিগের সাথে বসের প্রেমের গল্প। ধীরে ধীরে সাংসারিক নানা বিষয়েও ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। মাও মনে হয় বুঝেশুনেই ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতেন। এভাবেই দিনগুলো বেশ কাটছিল ।
এরই মধ্যে একদিন নতুন একটা অফিসে চাকরির ইন্টারভিউর ডাক পড়েছে। ইন্টারভিউ শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি, মা আর ছোট বোন দুজনেই চেয়ারে ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। বিছানায় পড়ে আছে একটি গয়নার বাক্স। জানতাম তাতে ছিল একটা চেইন আর মায়ের কিছু পুরোনো হালকা ওজনের সোনার গয়না। আমাকে দেওয়া বাবার সেই চেইনটাও ছিল। অনেক অভাবের মধ্যেও বাবার স্মৃতিচিহ্ন বলে যা যত্ন করে আগলে রেখেছিলাম।
কিন্তু বাক্সটা খালি কেন? চেইনটাই বা কোথায়? বাসার সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারে না।
কোনোভাবেই ভেবে পেলাম না, কে নিতে পারে, কে করতে পারে এমন কাজ? চোর বা অন্য কেউ বাসায় ঢুকেছে তাও তো নয়।
কী করব কিছু ভেবে না পেয়ে আসিফকে খবর দেয়ার কথা বলি। মা শুনে বললেন, আসিফ সকালেই এসেছিল। ওকে আর বলে কী হবে?
তবুও আমি ওর নম্বরে ফোন করলাম। কখনো ফোনে রিং হয়, কেউ রিসিভ করে না। কখনো বা ফোন বন্ধ পেলাম। এভাবে বারবার রিং হওয়ার পর আমার মনে হলো, ফোনটা তো হারিয়েও যেতে পারে। কিন্তু তাহলেও মানুষটা কোথায়? জলজ্যান্ত একটা মানুষ, সেও হারিয়ে গেল?
এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। বিষয়টা নিয়ে বাসায় আর কেউ কথা বলেনি। কিংবা বলে, আমার সামনে নয়। আমি কিন্তু এখনো ভাবি, হয়তো হঠাৎ কোনো ছুটির দিনে কিংবা সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে আসিফ আবার আগের মতোই আমার দরজায় এসে দাঁড়াবে। বলবে, কেয়া, কী হয়েছে? তোমার মনটা কী খুব খারাপ? চল, বেড়িয়ে আসি, ভালো লাগবে।
নাকি আমি যা ভাবছি,সব ভুল। হয়তো সে এখন অন্য কেউ। অন্য কোনো দরজায় কড়া নাড়ছে...।
লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক পিওনা আফরোজের জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি। বেড়ে উঠেছেন নোয়াখালী ও ঢাকায়। তার প্রকাশিত উপন্যাস কাছের মানুষ দূরের মানুষ । প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ নিহত জ্যোৎস্না ।
শেয়ার করুন
পিওনা আফরোজ | ৩১ জুলাই, ২০২১ ১২:২৯

বিকেলটা যায় যায় করছে। গোধূলিলগ্নে প্রকৃতিতে শীতের কনকনে হাওয়া। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দাঁড়াতেই দেখি অপরিচিত এক তরুণ। সুদর্শন। বললাম, আপনি?
আমি পাশেই থাকি। নতুন এসেছি।
ও,আচ্ছা। বলুন।
ভেতরে আসি?
হুম, আসুন।
আগন্তুক সোফাটা দেখিয়ে বললেন, বসব?
বসুন।
তখন ঘরে গান বাজছে। ‘জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আজও আমি সবকিছু ভুলে যেন করি লেনদেন / তুমিও তো বেশ আছো, ভালোই আছো, কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেন।’
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর এই গানটি আমার বেশ প্রিয়। প্রায়ই শোনা হয়। গান শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যাই। গানের প্রতিটি শব্দে, সুরে নিজেকে যেন হারিয়ে আবার খুঁজি। তখন কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কিন্তু আগন্তুক প্রতিবেশী। তা ওপর প্রথমবার এসেছেন। কথা না বলাটা ভালো দেখায় না ।
দু'জনে মুখোমুখি বসলাম।
তিনি বললেন, আমি আসিফ। আপনি?
আমি কেয়া।
আপনার অফিস নেই আজ?
না, আজ যাইনি।
কিছু মনে করবেন না। কোনো সমস্যা?
ঠিক বুঝলাম না। কীসের সমস্যা?
অফিস যাননি, ভাবলাম শরীর-টরীর খারাপ হলো কি না?
না।
ও বুঝতে পেরেছি। ছুটিতে আছেন?
জ্বী। কিন্তু, আমি চাকরি করি, আপনি জানলেন কীভাবে?
আপনি তো আমার বাসার পাশেই থাকেন। প্রতিদিন সকালে দেখি আপনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
অন্য কোথাও তো যেতে পারি। পারি না?
না। কারণ আমি প্রতিদিনই আপনাকে একই সময়ে যেতে দেখেছি। সেই সকালে বেরিয়ে যান আর রাতে ফেরেন। তবে আপনার যাওয়াটা অন্যরকম। এক ধরনের ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।
অবাক হয়ে ভাবলাম, কী বলছে লোকটা! যাওয়া-আসার মাঝে আবার ভালো লাগা থাকে? কে জানে? প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,
কতদিন ধরে আমাকে চেনেন, বলুন তো?
অনেকদিন...। বছর তিনেক তো হবেই।
ভাবলাম, এতগুলো দিন... পাশেই বাড়ি অথচ তাকে একবারও আমি দেখিনি! পরক্ষণেই মনে হলো, হতেই পারে। জীবনের কতো কিছুই তো আমাদের অগোচরে রয়ে যায়। দেখাশোনার বাইরে...।
তা ছাড়া বড় শহরের মানুষজন তো এ রকমই। অনেকদিন পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও কেউ কাউকে চেনে না, জানে না— এমন লোকই বেশি। তাতে কারও কিছু যায় আসে না। এই ভদ্রলোকটি হয়তো পরিচিত হতেই এসেছেন। সে জন্য সৌজন্যবোধ একটু দেখাতেই হয়। তাই বললাম, একটু বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে এসে দেখি ভদ্রলোক নেই। ব্যাপার কী! কিছু না বলেই চলে গেলেন! এ কেমন ভদ্রতা? তবুও ভাবলাম, হতে পারে জরুরী কোনো ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেছেন। বলার সুযোগটুকুও পাননি হয়তো।
ইদানীং প্রায় সময়ই আসিফ তার ব্যবসার কাজ শেষে বাসায় চলে আসে। কখনো কখনো আমি অফিস থেকে ফিরে দেখি বাসায় মায়ের সাথে বসে গল্প করছে। এক সাথে চা খাচ্ছে। আমি আসিফের এই আসা না আসার ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিই না। যদিও লক্ষ্য করছিলাম, আমাদের পরিবারের সবার সাথে তার ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
তাছাড়া বাসায় আমার কতটুকু সময়ই বা থাকা হয়! সারাদিন অফিস, সেখান থেকে টিউশনি, বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসা, তারপর ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া। কতদিন বসার ঘরে ঢুকে একটু টেলিভিশন দেখা কিংবা কারও সঙ্গে বসে একটু গল্প করারও সময় হয় না। তারপরও আসিফকে দেখলে কিছুক্ষণ বসি। এটা-সেটা নিয়ে কথাবার্তাও হয়। সাধারণত সেই বলে, আমি শুধু শুনি। সে কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দিই, অথবা হেসে চুপ থাকি। এভাবেই সময়ের স্রোতে আমাদের সম্পর্কটা কখন যেন আপনি থেকে তুমিতে এসে পৌঁছেছে, বুঝতে পারিনি।
আজ বিকেলেও আসিফ বাসায় এলো। ছুটির দিন বলে আমি বাসায় ছিলাম। ড্রয়িং রুমে একা বসে খবরের কাগজটা দেখছিলাম। মা ভেতরের ঘরে। আমার মুখোমুখি বসেই আসিফ বলল, কোথাও যাবে?
বললাম, কোথায়?
চলো, বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।
আজ নয়। আমার ভালো লাগছে না।
বেরোলেই ভালো লাগবে।
আসিফের মধ্যে কিছুদিন ধরেই একটা বিষয় লক্ষ্য করছিলাম, মানুষটার কথায় কী রকম যেন একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। কিছু বললে না করা যায় না। আজও শেষ পর্যন্ত তাই হলো।
আমি আসিফকে বসিয়ে রেখেই তৈরি হয়ে নিলাম। নীল শাড়ি পরলাম। কপালে নীল টিপ, খোলা চুল, চোখে কাজল। এমন করে আর কখনো সাজিনি। অবাক হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের জন্য খুব যত্ন করে নিজেকে সাজালাম। গয়না পরতে আমার তেমন ভালো লাগে না। আজ হালকা গয়নাও পরলাম।
ছোটবেলায় বাবার দেওয়া চেইনটা অনেকদিন পর গলায় পরলাম। মনে হলো, যেন বাবার স্পর্শ পেলাম। আমার দেরি দেখে আসিফ হয়তো অস্থির হয়ে উঠছিল। তাই হয়তো একবার দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখল। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলল না। হয়তোবা আমি সেজেছি দেখে তার মুগ্ধতার কথা জানাতে চেয়েছিল। কি জানি?
মাকে বলে দু'জনে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় উঠে আসিফ রিকশাওয়ালাকে বলল আশুলিয়ার দিকে যেতে। রিকশার ঝাঁকুনিতে দু’জনের শরীর বারবার দুজনের শরীরে ধাক্কা খাচ্ছে। নিজেকে যতই গুটিয়ে নিতে চাইছি, কিছুতেই এই অসভ্য ঝাঁকুনি থেকে মুক্তি মিলছে না। আসিফ কয়েকবার আমার চোখে চোখ রেখে তাকাল। মনে হলো সেও লজ্জা পাচ্ছে। আবার এরকমটাও হতে পারে, মনে মনে রিকশাওয়ালা আর ভাঙা রাস্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, কে জানে? আশুলিয়ায় পৌঁছবার পর আসিফ এক জায়গায় রিকশাটাকে থামতে বলল। আমার হাত ছুঁয়ে সে আমাকে রিকশা থেকে নামালো। তার হাতের স্পর্শে আমার সারা শরীরে কী রকম যেন একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনে এমন অনুভূতি আমার আর কখনো হয়নি।
চটপটির একটা দোকানের পাশে আমরা বসলাম। তখন ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। চটপটির প্লেট হাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দু’জন গল্পের মাঝে হারিয়ে গেলাম। দু’জনে কত শত বিষয় নিয়ে গল্প করি। কথা ফুরিয়ে গেলে মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করে আসিফ। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে ওর গান শুনি।
আচ্ছা, ও কি আমার মনটা পড়তে পারছে? তা না হলে আমার ভালো লাগার মত করে কথাগুলো বলছে কীভাবে? আমার পছন্দের গান ও গাইছে, কী করে?
সময়টা বেশ কাটছিল আমাদের। হঠাৎই আকাশটা গাঢ় অন্ধকার হয়ে এল। চোখে, মুখে বৃষ্টির দু-একটা ফোটা এসে পড়ছে। তারপর টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির এমন রসিকতা ভালো লাগেনি। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। বৃষ্টি আরও তেড়ে আসার আগেই আমরা বাসার দিকে রওনা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামল। সেই সাথে ঝোড়ো বাতাস। কিন্তু আমার অনুভূতিটা এবার অন্যরকম। রিকশার ঝাঁকুনি, বৃষ্টির ছাঁট, ঠান্ডা বাতাস, পাশে পুরুষের উষ্ণতা, বেশ লাগছিল। নিজেকে অন্য এক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। এ যেন অন্য কোনো কেয়া, যার জীবনে কখনো দুঃখের আঁচড় লাগেনি। যার কোনো না পাওয়ার বেদনা নেই। নেই সংসারের নিত্য অভাবের সঙ্গে পরিচয় ।
স্মৃতিতে রাখা সোনালি দিনের মতো একটি দিন দু'জনে একসাথে কাটালাম। ভালো লাগার অনুভূতিগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, এমনকি পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেও তার রেশটুকু অনুভব করছিলাম।
এরপর মাঝে মধ্যেই আসিফের সাথে বাইরে বেরোতাম। ঘরে-বাইরে যখনই দেখা হতো কত কিছু নিয়ে যে আমাদের মধ্যে কথা হতো। ঘরের গল্প, অফিসের গল্প, কলিগের সাথে বসের প্রেমের গল্প। ধীরে ধীরে সাংসারিক নানা বিষয়েও ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। মাও মনে হয় বুঝেশুনেই ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতেন। এভাবেই দিনগুলো বেশ কাটছিল ।
এরই মধ্যে একদিন নতুন একটা অফিসে চাকরির ইন্টারভিউর ডাক পড়েছে। ইন্টারভিউ শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি, মা আর ছোট বোন দুজনেই চেয়ারে ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। বিছানায় পড়ে আছে একটি গয়নার বাক্স। জানতাম তাতে ছিল একটা চেইন আর মায়ের কিছু পুরোনো হালকা ওজনের সোনার গয়না। আমাকে দেওয়া বাবার সেই চেইনটাও ছিল। অনেক অভাবের মধ্যেও বাবার স্মৃতিচিহ্ন বলে যা যত্ন করে আগলে রেখেছিলাম।
কিন্তু বাক্সটা খালি কেন? চেইনটাই বা কোথায়? বাসার সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারে না।
কোনোভাবেই ভেবে পেলাম না, কে নিতে পারে, কে করতে পারে এমন কাজ? চোর বা অন্য কেউ বাসায় ঢুকেছে তাও তো নয়।
কী করব কিছু ভেবে না পেয়ে আসিফকে খবর দেয়ার কথা বলি। মা শুনে বললেন, আসিফ সকালেই এসেছিল। ওকে আর বলে কী হবে?
তবুও আমি ওর নম্বরে ফোন করলাম। কখনো ফোনে রিং হয়, কেউ রিসিভ করে না। কখনো বা ফোন বন্ধ পেলাম। এভাবে বারবার রিং হওয়ার পর আমার মনে হলো, ফোনটা তো হারিয়েও যেতে পারে। কিন্তু তাহলেও মানুষটা কোথায়? জলজ্যান্ত একটা মানুষ, সেও হারিয়ে গেল?
এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। বিষয়টা নিয়ে বাসায় আর কেউ কথা বলেনি। কিংবা বলে, আমার সামনে নয়। আমি কিন্তু এখনো ভাবি, হয়তো হঠাৎ কোনো ছুটির দিনে কিংবা সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে আসিফ আবার আগের মতোই আমার দরজায় এসে দাঁড়াবে। বলবে, কেয়া, কী হয়েছে? তোমার মনটা কী খুব খারাপ? চল, বেড়িয়ে আসি, ভালো লাগবে।
নাকি আমি যা ভাবছি,সব ভুল। হয়তো সে এখন অন্য কেউ। অন্য কোনো দরজায় কড়া নাড়ছে...।
লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক পিওনা আফরোজের জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি। বেড়ে উঠেছেন নোয়াখালী ও ঢাকায়। তার প্রকাশিত উপন্যাস কাছের মানুষ দূরের মানুষ । প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ নিহত জ্যোৎস্না ।