ফেরা
স্মৃতি রুমানা | ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:২০
স্মৃতি রুমানা
রাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায় ইদানীং। আর ঘুম ভাঙলেই বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন বের করে দেখি, রাত কত বেজেছে। আজ রাতেও ঘুম ভেঙে মুঠোফোন খুঁজতে গিয়ে দেখি আমার হাত দুটো আটকে আছে ছোট্ট দুটি হাতের বাঁধনে। ঘুমানোর সময়ই ঋতম আমার হাত টেনে বুকে নিয়ে দুহাতে চেপে রেখেছিল। কিছুটা অনভ্যস্ততার সঙ্গেই আমি আরেকটা হাত ওর মাথায় বুলাচ্ছিলাম যেন আরামে ঘুমোতে পারে বাচ্চাটা।
আমার ছোটখালার ছেলে ঋতম। পাঁচ বছর পার করে ছয় এ পা রেখেছে। ছেলেটা এমনিতেই ছোটবেলা থেকে আমার নেওটা। পায়ে-পায়ে ঘোরে, আমি যা-ই করি না কেন সেটা তারও করা চাই। আমি মাঝে মাঝে ওকে বিটকেল বলে ডাকি। তখন ও হেসে বলে তুমি তাহলে বিটকেলের বোন। রাজ্যের পাকামি আর বড়দের মতো জ্ঞান নিয়ে সবাইকে অস্থির করে রাখে। কখনো বিরক্তি প্রকাশ করলেই ঠোঁট ফুলে ওঠে ওর। অভিমানে কয়েক ফোঁটা জলও গড়ায়। তাই তখনই আদর করে দিতে বাধ্য হই।
গত মাসে আমি ওদের আগারগাঁওয়ের বাসায় এসেছি। ছোট খালু করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে, লাংসের ৬০% ড্যামেজ নিয়ে সেখানে ভর্তি হতে হয়েছে। ৮৫ লিটার করে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। বলা যায়, কোনোরকম জানটা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। জমানো যা টাকা ছিল, সেসব তুলে রোজ আইসিইউ বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। ঋতমের মা দিনরাত আইসিইউয়ের সামনে বসে থাকে। এই ঢাকা শহরে নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। গ্রামের বাড়ি থেকেও আর কেউ আসেনি তাদের কাছে। দুদিন পাশের ফ্ল্যাটে অনাত্মীয়ের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল ঋতমকে। শেষে আমিই এক বুক মায়া নিয়ে বাচ্চাটারে আগলে রাখতে চাই বলে লকডাউনের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ৩০০ কিমি পাড়ি দিয়ে এসে হাজির হয়েছি।
এখন সারা দিন নানান বায়না আর দুষ্টুমিতে পার হয় ঋতমের। কিন্তু রাত যত বাড়ে ততই মন খারাপ হতে থাকে আমাদের। রাতে শুয়ে ঋতমের কথা শুনে প্রায়ই বিস্ময় জাগে, এতটুকু ছেলে অথচ এত বোঝে! বলে কিনা আমি তো আমার পরিবারের কারো সঙ্গে নেই, তুমি তোমার হাত দুটো আমাকে দাও, না হলে আমার ঘুম হবে না।
একটু মন খারাপ করেই জানতে চাই, আমি তোমার পরিবারের কেউ না? পাকনা ছেলে সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত জড়িয়ে বলে তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমাকে। এমন করেই রাতের পর রাত কাটে। ঋতম ঘুমিয়ে গেলেও আমার চোখে ঘুম আসে না খালার কথা ভেবে। আইসিইউয়ের সামনে বসে খালা তো ঘুমায় না কত রাত। গত দুদিন দুপুরবেলায় অল্প সময়ের জন্য খালা বাসায় আসে। একটু স্নান, খাওয়ার জন্য। আমি রান্না করে, সব কাজ গুছিয়ে অপেক্ষা করি। এত করে বলি একটু ঘুমিয়ে নাও, কিছুতেই শোনে না। প্রথম কদিন এক মুহূর্তের জন্যও নড়তো না আইসিইউয়ের সামনে থেকে। যদি কোনো দরকার হয় রোগীর। অথচ এই ঘাতক রোগের জন্য রোগীর কাছে যাবারও উপায় নাই। গতকাল পিপিই পরে খালা আইসিইউয়ের কাচের দরজা দিয়ে দেখে এসেছে খালুকে। হাইফ্লো ন্যাজাল কানোলা খালুর মুখে। ভালো করে মুখটা পর্যন্ত দেখতে পায়নি খালা। ডাক্তার নার্সদের সান্ত্বনা-বাক্য খালাকে স্বস্তি দিতে পারে না। অস্থির হয়ে নামাজ রুমে গিয়ে বসে কাঁদতে থাকে। আমি জানি খালা যতটা না তার স্বামীর জন্য কষ্ট পায়, তার থেকেও বেশি প্রার্থনা করে তার সন্তানের বাবার সুস্থতার জন্য।
প্রতি রাতে অপেক্ষা করতে থাকি, কবে দুজন এই বাসায় সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমি এই রাত জাগা থেকে মুক্তি পাব তবে।
আজকাল অফিসের কাজও ঠিকমতো করতে পারি না। কাজ বলতে সবই ভার্চ্যুয়াল। কিন্তু ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই ঋতম ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটু ছবি দেখতে দিতেই হবে তাকে অথবা একটু কার্টুন দেখবে ইউটিউবে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হই, রেগে উঠি। কিন্তু বকতে গিয়েও পারি না ওই মায়ামাখা মুখ দেখে। আবার কখনো রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে গেলেই বরং আমাকে হুমকি দেয় মাকে ফোন করে আমার নামে অভিযোগ করবে বলে। চুপ করে যাই তখন। অভিযোগের ভয়ে নয়, তার মা কষ্ট পাবে বলে।
সব কষ্ট, বিরক্তি চেপে অপেক্ষা করি ঋতমের বাবার ফিরে আসার জন্য।
খালুকে কেবিনে দেয়া হয় কিছুদিন পরেই। ডাক্তারের মতে রিস্ক অনেকটা কেটে গেছে। কিছুদিন কেবিনে থেকে ঠিকমতো সেবা পেলেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন। খালার মুখের মেঘ অনেকটা সরে গেছে। দুদিন ধরে বাসায় এসে দুপুরের খাবার পর বেশ গল্প করে খালুকে নিয়ে। উনি কী খেতে চান, কী বলেন এসব। আমার মনেও স্বস্তি ফিরতে থাকে।
বাড়ি ফেরার তাড়া অনুভব করি। কদিন পর হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে ঋতমকে নিয়ে দেখা করে আসি। খালুকে বলে আসি আমি আর থাকতে পারব না, ঋতমকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে নিয়ে আসবেন ছেলেকে। খালুর মুখে বেশ চওড়া হাসি। যদিও অক্সিজেন মাস্কের ভেতর দিয়ে প্রাণখুলে হাসা যায় না, না যায় কথা বলা। হাতের ইশারায় বাকি কথাটুকু বোঝালেন। হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথা ছুঁয়ে দিলেন। আমি অভয় দিলাম তাদের ছেলেকে যত্নে রাখব বলে।
বাইরে বের হয়ে পেছন ফিরে দেখলাম খালার চোখ ছলছল করছে। যতক্ষণ দৃষ্টির সীমানায় ছিলাম খালা তাকিয়েছিল, আমিও পেছন ফিরে বারবার দেখছিলাম। মনটা কেমন যেন করছে খালাকে এভাবে একলা রেখে আসতে। কিন্তু আমি তো নিরুপায়। আর কত এভাবে নিজের কাজকর্ম ফেলে রাখা যায়। নিউমোনিয়া ভাবটা কেটে গেলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন খালু। একটু ইনফেকশনও আছে, সেটা নিয়ে টেনশনের তেমন কিছু নাই বলে আশ্বাস দিয়েছেন ডাক্তার।
অতঃপর গন্তব্য নিজ বাড়ি।
ফিরে দুটোদিন ভালোই কাটলো। বিকেল হলেই ঋতম আমি টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম লেকের ধার দিয়ে। আরও কত নানান দুষ্টুমি, বকাবকি। তার মাঝেই অপেক্ষা একটা মানুষের সুস্থ হয়ে ফেরার। আর কটা দিন হয়তো, তারপরই তো খালারা এসে নিয়ে যাবে ঋতমকে। নানান রকম খাবার, খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখি ছেলেটাকে।
দিনগুলো একরকম ব্যস্ততায় পার হলেও রাতের বিষাদ আমাকে ছাড়তো না। মা বাবা ছাড়া এই অকালপক্ব শিশুটিকে ঘুম দিতে গিয়ে শুধুই প্রার্থনা ছিল—সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দাও তাড়াতাড়ি ওর বাবাকে। তাহলে মা-বাবা দুজনের মাঝে শান্তিতে ঘুমোবে ছেলেটা, এদিকে আমিও।
সৃষ্টিকর্তা কথা শুনেছিলেন বটে। আমি আর ঋতম মাঝরাতে ভদ্রা ‘স্মৃতি অম্লান’ মোড়ে এসে দাঁড়াই। ঋতমের বাবা আজ ফিরবেন। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। বন্ধ দোকানের সামনে কয়েকটা কুকুর ঘুমাচ্ছিল। আমাদের পায়ের শব্দে নড়ে ওঠে দু-একটা। চোখ মেলে আমাদের দেখে। পিঠ বদল করে আবার শোয়।
আমি আর ঋতম গা ছুঁয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াই। কয়েক সেকেন্ড পর পর দূরে ওই পথের প্রান্তে দেখি। গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে আমরা ঋতমদের গ্রামের বাড়ি যাব। চোখের সামনে দিয়ে কয়েকটা মাইক্রোবাস হুঁশ করে চলে যায়। আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াই। এই অপেক্ষা আমার দীর্ঘতর লাগে না। বরং মনে হতে থাকে খালারা এভাবে না ফিরলেই পারত।
একটা দৃশ্যপট মনে ভেসে ওঠে। ২৮বছর আগের সেই স্মৃতি এখনো আবছায়া খেলা করে মাথায়। জেলা কোর্টের বিচারালয়, বিচারক রায় দিয়েছেন সন্তান যেখানে চায় বাবা অথবা মা যে কারো কাছেই থাকতে পারে। সেদিন আমার খুব ইচ্ছে করেছিল বাবার সঙ্গে যেতে। কিন্তু আগের রাতে ঘুমাবার আগে মা বারবার করে বলেছেন আমি যেন বাবার সঙ্গে চলে না যাই, মা আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। মা সেই রাতে অনেক কেঁদেছিলেন। বিচারকের রায়ের পর বাবা যখন আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন আমি তখন হাত পা ছুড়ে কাঁদার চেষ্টা করেছিলাম মায়ের সঙ্গেই থাকব বলে। তখন এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে আমার বড় হবার পর যার কাছে চাইব থাকতে পারব। সেদিন বাবাকে ছাড়াই ফিরে এসেছিলাম নানাবাড়িতে। ওইটুকু বয়সে বুঝে গিয়েছিলাম বাবা ছাড়াই আমাকে বড় হতে হবে, মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে। না হলে মা অনেক কষ্ট পাবে। এরপর ঘটনা পরম্পরায় বাবা নামক এই মানুষের প্রতি একটু একটু করে আমার আবেগ ক্ষয়ে যেতে থাকে। মা অনেক চেষ্টা করতেন একাই আমার মা, বাবা দুটোর ভূমিকাই পালন করতে। কিন্তু বাবার শূন্যতা নিয়ে আমি বড় হতে থাকি। আমি জানি বাবা নামক এই মানুষটির ভূমিকা প্রত্যেকের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রাণপণে চেয়েছি ঋতমের বাবা সুস্থ হয়ে উঠুক তাড়াতাড়ি। আমার মতো শৈশব তার না হোক।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঋতমকে আমার দেবশিশুর মতো লাগে। আমার একটা হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে কৌতূহল, রাতের স্বল্প-আলোয় দূর থেকে কোনো গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখলেই আগ্রহভরে তাকায়, বলে দেখতো এই গাড়িতে বাবা আসছে নাকি? আমি তাকাতে পারি না, না কিছু বলতে পারি। শুধু মাথায় হাত রাখি ঋতমের। আমার হাতের আঙুল ঝাঁকিয়ে সে আবার বলে তুমি কথা বলো না কেন? আমরা কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। আমি অস্ফুট স্বরে বলি, এই তো আসবে।
গাড়ি আসে, একটা নয়, দুটো। অ্যাম্বুলেন্সে ঋতমের বাবার মৃতদেহ, অন্যটিতে ওর অর্ধচেতন মা।
শেয়ার করুন
স্মৃতি রুমানা | ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:২০

রাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায় ইদানীং। আর ঘুম ভাঙলেই বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন বের করে দেখি, রাত কত বেজেছে। আজ রাতেও ঘুম ভেঙে মুঠোফোন খুঁজতে গিয়ে দেখি আমার হাত দুটো আটকে আছে ছোট্ট দুটি হাতের বাঁধনে। ঘুমানোর সময়ই ঋতম আমার হাত টেনে বুকে নিয়ে দুহাতে চেপে রেখেছিল। কিছুটা অনভ্যস্ততার সঙ্গেই আমি আরেকটা হাত ওর মাথায় বুলাচ্ছিলাম যেন আরামে ঘুমোতে পারে বাচ্চাটা।
আমার ছোটখালার ছেলে ঋতম। পাঁচ বছর পার করে ছয় এ পা রেখেছে। ছেলেটা এমনিতেই ছোটবেলা থেকে আমার নেওটা। পায়ে-পায়ে ঘোরে, আমি যা-ই করি না কেন সেটা তারও করা চাই। আমি মাঝে মাঝে ওকে বিটকেল বলে ডাকি। তখন ও হেসে বলে তুমি তাহলে বিটকেলের বোন। রাজ্যের পাকামি আর বড়দের মতো জ্ঞান নিয়ে সবাইকে অস্থির করে রাখে। কখনো বিরক্তি প্রকাশ করলেই ঠোঁট ফুলে ওঠে ওর। অভিমানে কয়েক ফোঁটা জলও গড়ায়। তাই তখনই আদর করে দিতে বাধ্য হই।
গত মাসে আমি ওদের আগারগাঁওয়ের বাসায় এসেছি। ছোট খালু করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে, লাংসের ৬০% ড্যামেজ নিয়ে সেখানে ভর্তি হতে হয়েছে। ৮৫ লিটার করে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। বলা যায়, কোনোরকম জানটা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। জমানো যা টাকা ছিল, সেসব তুলে রোজ আইসিইউ বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। ঋতমের মা দিনরাত আইসিইউয়ের সামনে বসে থাকে। এই ঢাকা শহরে নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। গ্রামের বাড়ি থেকেও আর কেউ আসেনি তাদের কাছে। দুদিন পাশের ফ্ল্যাটে অনাত্মীয়ের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল ঋতমকে। শেষে আমিই এক বুক মায়া নিয়ে বাচ্চাটারে আগলে রাখতে চাই বলে লকডাউনের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ৩০০ কিমি পাড়ি দিয়ে এসে হাজির হয়েছি।
এখন সারা দিন নানান বায়না আর দুষ্টুমিতে পার হয় ঋতমের। কিন্তু রাত যত বাড়ে ততই মন খারাপ হতে থাকে আমাদের। রাতে শুয়ে ঋতমের কথা শুনে প্রায়ই বিস্ময় জাগে, এতটুকু ছেলে অথচ এত বোঝে! বলে কিনা আমি তো আমার পরিবারের কারো সঙ্গে নেই, তুমি তোমার হাত দুটো আমাকে দাও, না হলে আমার ঘুম হবে না।
একটু মন খারাপ করেই জানতে চাই, আমি তোমার পরিবারের কেউ না? পাকনা ছেলে সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত জড়িয়ে বলে তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমাকে। এমন করেই রাতের পর রাত কাটে। ঋতম ঘুমিয়ে গেলেও আমার চোখে ঘুম আসে না খালার কথা ভেবে। আইসিইউয়ের সামনে বসে খালা তো ঘুমায় না কত রাত। গত দুদিন দুপুরবেলায় অল্প সময়ের জন্য খালা বাসায় আসে। একটু স্নান, খাওয়ার জন্য। আমি রান্না করে, সব কাজ গুছিয়ে অপেক্ষা করি। এত করে বলি একটু ঘুমিয়ে নাও, কিছুতেই শোনে না। প্রথম কদিন এক মুহূর্তের জন্যও নড়তো না আইসিইউয়ের সামনে থেকে। যদি কোনো দরকার হয় রোগীর। অথচ এই ঘাতক রোগের জন্য রোগীর কাছে যাবারও উপায় নাই। গতকাল পিপিই পরে খালা আইসিইউয়ের কাচের দরজা দিয়ে দেখে এসেছে খালুকে। হাইফ্লো ন্যাজাল কানোলা খালুর মুখে। ভালো করে মুখটা পর্যন্ত দেখতে পায়নি খালা। ডাক্তার নার্সদের সান্ত্বনা-বাক্য খালাকে স্বস্তি দিতে পারে না। অস্থির হয়ে নামাজ রুমে গিয়ে বসে কাঁদতে থাকে। আমি জানি খালা যতটা না তার স্বামীর জন্য কষ্ট পায়, তার থেকেও বেশি প্রার্থনা করে তার সন্তানের বাবার সুস্থতার জন্য।
প্রতি রাতে অপেক্ষা করতে থাকি, কবে দুজন এই বাসায় সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমি এই রাত জাগা থেকে মুক্তি পাব তবে।
আজকাল অফিসের কাজও ঠিকমতো করতে পারি না। কাজ বলতে সবই ভার্চ্যুয়াল। কিন্তু ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই ঋতম ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটু ছবি দেখতে দিতেই হবে তাকে অথবা একটু কার্টুন দেখবে ইউটিউবে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হই, রেগে উঠি। কিন্তু বকতে গিয়েও পারি না ওই মায়ামাখা মুখ দেখে। আবার কখনো রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে গেলেই বরং আমাকে হুমকি দেয় মাকে ফোন করে আমার নামে অভিযোগ করবে বলে। চুপ করে যাই তখন। অভিযোগের ভয়ে নয়, তার মা কষ্ট পাবে বলে।
সব কষ্ট, বিরক্তি চেপে অপেক্ষা করি ঋতমের বাবার ফিরে আসার জন্য।
খালুকে কেবিনে দেয়া হয় কিছুদিন পরেই। ডাক্তারের মতে রিস্ক অনেকটা কেটে গেছে। কিছুদিন কেবিনে থেকে ঠিকমতো সেবা পেলেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন। খালার মুখের মেঘ অনেকটা সরে গেছে। দুদিন ধরে বাসায় এসে দুপুরের খাবার পর বেশ গল্প করে খালুকে নিয়ে। উনি কী খেতে চান, কী বলেন এসব। আমার মনেও স্বস্তি ফিরতে থাকে।
বাড়ি ফেরার তাড়া অনুভব করি। কদিন পর হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে ঋতমকে নিয়ে দেখা করে আসি। খালুকে বলে আসি আমি আর থাকতে পারব না, ঋতমকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে নিয়ে আসবেন ছেলেকে। খালুর মুখে বেশ চওড়া হাসি। যদিও অক্সিজেন মাস্কের ভেতর দিয়ে প্রাণখুলে হাসা যায় না, না যায় কথা বলা। হাতের ইশারায় বাকি কথাটুকু বোঝালেন। হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথা ছুঁয়ে দিলেন। আমি অভয় দিলাম তাদের ছেলেকে যত্নে রাখব বলে।
বাইরে বের হয়ে পেছন ফিরে দেখলাম খালার চোখ ছলছল করছে। যতক্ষণ দৃষ্টির সীমানায় ছিলাম খালা তাকিয়েছিল, আমিও পেছন ফিরে বারবার দেখছিলাম। মনটা কেমন যেন করছে খালাকে এভাবে একলা রেখে আসতে। কিন্তু আমি তো নিরুপায়। আর কত এভাবে নিজের কাজকর্ম ফেলে রাখা যায়। নিউমোনিয়া ভাবটা কেটে গেলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন খালু। একটু ইনফেকশনও আছে, সেটা নিয়ে টেনশনের তেমন কিছু নাই বলে আশ্বাস দিয়েছেন ডাক্তার।
অতঃপর গন্তব্য নিজ বাড়ি।
ফিরে দুটোদিন ভালোই কাটলো। বিকেল হলেই ঋতম আমি টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম লেকের ধার দিয়ে। আরও কত নানান দুষ্টুমি, বকাবকি। তার মাঝেই অপেক্ষা একটা মানুষের সুস্থ হয়ে ফেরার। আর কটা দিন হয়তো, তারপরই তো খালারা এসে নিয়ে যাবে ঋতমকে। নানান রকম খাবার, খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখি ছেলেটাকে।
দিনগুলো একরকম ব্যস্ততায় পার হলেও রাতের বিষাদ আমাকে ছাড়তো না। মা বাবা ছাড়া এই অকালপক্ব শিশুটিকে ঘুম দিতে গিয়ে শুধুই প্রার্থনা ছিল—সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দাও তাড়াতাড়ি ওর বাবাকে। তাহলে মা-বাবা দুজনের মাঝে শান্তিতে ঘুমোবে ছেলেটা, এদিকে আমিও।
সৃষ্টিকর্তা কথা শুনেছিলেন বটে। আমি আর ঋতম মাঝরাতে ভদ্রা ‘স্মৃতি অম্লান’ মোড়ে এসে দাঁড়াই। ঋতমের বাবা আজ ফিরবেন। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। বন্ধ দোকানের সামনে কয়েকটা কুকুর ঘুমাচ্ছিল। আমাদের পায়ের শব্দে নড়ে ওঠে দু-একটা। চোখ মেলে আমাদের দেখে। পিঠ বদল করে আবার শোয়।
আমি আর ঋতম গা ছুঁয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াই। কয়েক সেকেন্ড পর পর দূরে ওই পথের প্রান্তে দেখি। গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে আমরা ঋতমদের গ্রামের বাড়ি যাব। চোখের সামনে দিয়ে কয়েকটা মাইক্রোবাস হুঁশ করে চলে যায়। আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াই। এই অপেক্ষা আমার দীর্ঘতর লাগে না। বরং মনে হতে থাকে খালারা এভাবে না ফিরলেই পারত।
একটা দৃশ্যপট মনে ভেসে ওঠে। ২৮বছর আগের সেই স্মৃতি এখনো আবছায়া খেলা করে মাথায়। জেলা কোর্টের বিচারালয়, বিচারক রায় দিয়েছেন সন্তান যেখানে চায় বাবা অথবা মা যে কারো কাছেই থাকতে পারে। সেদিন আমার খুব ইচ্ছে করেছিল বাবার সঙ্গে যেতে। কিন্তু আগের রাতে ঘুমাবার আগে মা বারবার করে বলেছেন আমি যেন বাবার সঙ্গে চলে না যাই, মা আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। মা সেই রাতে অনেক কেঁদেছিলেন। বিচারকের রায়ের পর বাবা যখন আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন আমি তখন হাত পা ছুড়ে কাঁদার চেষ্টা করেছিলাম মায়ের সঙ্গেই থাকব বলে। তখন এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে আমার বড় হবার পর যার কাছে চাইব থাকতে পারব। সেদিন বাবাকে ছাড়াই ফিরে এসেছিলাম নানাবাড়িতে। ওইটুকু বয়সে বুঝে গিয়েছিলাম বাবা ছাড়াই আমাকে বড় হতে হবে, মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে। না হলে মা অনেক কষ্ট পাবে। এরপর ঘটনা পরম্পরায় বাবা নামক এই মানুষের প্রতি একটু একটু করে আমার আবেগ ক্ষয়ে যেতে থাকে। মা অনেক চেষ্টা করতেন একাই আমার মা, বাবা দুটোর ভূমিকাই পালন করতে। কিন্তু বাবার শূন্যতা নিয়ে আমি বড় হতে থাকি। আমি জানি বাবা নামক এই মানুষটির ভূমিকা প্রত্যেকের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রাণপণে চেয়েছি ঋতমের বাবা সুস্থ হয়ে উঠুক তাড়াতাড়ি। আমার মতো শৈশব তার না হোক।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঋতমকে আমার দেবশিশুর মতো লাগে। আমার একটা হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে কৌতূহল, রাতের স্বল্প-আলোয় দূর থেকে কোনো গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখলেই আগ্রহভরে তাকায়, বলে দেখতো এই গাড়িতে বাবা আসছে নাকি? আমি তাকাতে পারি না, না কিছু বলতে পারি। শুধু মাথায় হাত রাখি ঋতমের। আমার হাতের আঙুল ঝাঁকিয়ে সে আবার বলে তুমি কথা বলো না কেন? আমরা কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। আমি অস্ফুট স্বরে বলি, এই তো আসবে।
গাড়ি আসে, একটা নয়, দুটো। অ্যাম্বুলেন্সে ঋতমের বাবার মৃতদেহ, অন্যটিতে ওর অর্ধচেতন মা।