বুলি ফোটার আগেই চোখ কেড়ে নিল ‘পেলেট গান’
অনলাইন ডেস্ক | ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১০:১৪
পেলেট গানে চোখ হারানো সবচেয়ে কম বয়সী কাশ্মিরী হিবা। ছবি: আলজাজিরা
হিবা নিসার। মাত্র ১৮ মাস বয়সী হিবার মুখে এখনো ঠিকমতো কথা ফোটেনি। এই বয়সেই তার চোখের আলো নিভতে বসেছে ভারতীয় সেনাদের ছোঁড়া পেলেট গানে। অধিকৃত কাশ্মিরে ‘কুখ্যাত’ পেলেট গানের শিকার সবচেয়ে কম বয়সী হিবা।
অন্য শিশুদের সঙ্গে তার খেলনা সাইকেল চালাতে নাছোড় বান্দা হিবা। কিন্তু তাকে বাড়ির আঙিনায় ছাড়তে চান না মা মুরসালা জান। কারণ, চোখে ধুলাবালি পড়লে ইনফেকশন হতে পারে। ঠিকমতো কথা বলতে না পারলেও মাঝেমধ্যেই হিবা কান্না শুরু করে এবং ব্যথা বোঝাতে চোখের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে।
শ্রী মহারাজা হরি সিং মেডিকেল হাসপাতালের সুপার ডা. সালীম তাক আলজাজিরাকে বলেন, “হিবা তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।”
“তার কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্নিয়াল সারফেস নষ্ট হওয়ায় এমনটা হয়েছে। যখন একটি পেলেট গান চোখে আঘাত করে, তখন এটি সেখানে একটি গর্তের সৃষ্টি করে।”
সালীম বলেন, “হিবার চোখের ভেতর একটি পেলেট ঢুকে আছে। চোখ হলো ওয়াটার বলের মতো স্পর্শকাতর। চোখে অস্ত্রোপচার সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তার চোখে এক দফা অস্ত্রোপচার করেছি, আরো কয়েক দফা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।”
ঘটনার সূত্রপাত
গত ২৩ নভেম্বর বড়ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিল হিবা। এরই মধ্যে সোপিয়ান জেলার কাপরান গ্রামের কাছেই আটকে পড়া স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। এতে ছয় স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাই নিহত হন।
চোখের ব্যথা ভুলে খেলায় মেতে থাকতে চায় হিবা। ছবি: আলজাজিরা
খবর পেয়ে ওই এলাকায় জড়ো হতে থাকেন স্থানীয়রা। তারা ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ারশেল এবং ‘পেলেট গান’ নিক্ষেপ করতে থাকে।
হিবাদের বাড়ির প্রবেশপ্রথ থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরেই নিরাপত্তা বাহিনী এবং এলাকাবাসীর মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ।
“আমি সকালের নাশতা বানাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। টিয়ারশেলে গোটা ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ক্রমশই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল” বলছিলেন হিবার মা।
“হিবা বমি করতে শুরু করে আর আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না।”
পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় মুরসালা জান মেয়েকে কোলে নেন আর ছেলেকে আরেক হাতে ধরে দ্রুত ঘর থেকে বের হন। ঘর থেকেই বের হতেই তারা সংঘর্ষরত দুই পক্ষের মাঝে পড়ে যান।
মুরসালা জান বিবিসি-কে বলেন, “আমি দেখি নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। ছেলেকে টেনে আমার পেছনে নিয়ে যাই। আর হিবার মুখ হাত দিয়ে ঢেকে দেই।”
একজন সেনাসদস্য মুরসাল জানকে লক্ষ্য করে তিনটি ‘পেলেট গান’ ছুঁড়েন। কিন্তু এর একটি হিবার ডান চোখে গিয়ে বিঁধে।
‘মা, পুড়ে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার করে ওঠে হিবা। তার চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। মেয়ের এ অবস্থা দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মুরসাল জান। পরে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন প্রতিবেশিরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
অধিকৃত কাশ্মিরে ‘অন্ধ চোখের মহামারি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে এই পেলেট গান। ছবি: বিবিসি
সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভ দমনে ‘পেলেট গান’র ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। গত কয়েক বছরে প্রায় ৬,০০০ কাশ্মিরী পেলেট গানে চোখে আঘাত পেয়েছেন, যাদের অনেকেই এক চোখ হারিয়েছেন। আবার অনেকেরই দু’চোখের আলোই নিভে গেছে। অধিকৃত কাশ্মিরে ‘অন্ধ চোখের মহামারি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে এই পেলেট গান।
পেলেট গানে চোখ হারানো এরকম ১,২৩৩ কাশ্মিরীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুহাম্মদ আশরাফ ওয়ানি। তিনি বলেন, পেলেট গানে চোখ হারানো সবচেয়ে কম বয়সী কাশ্মিরী হিবা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরের শাসক মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দিলে এই রক্তপাতের সূত্রপাত হয়। এনিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান।
স্বাধীনতার জন্য ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে কাশ্মিরীরা ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিলে সহিংসতা নতুন মাত্রা পায়। সাম্প্রতিক সময়ে এই সহিংসতা ফের বাড়তে শুরু করেছে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
অনলাইন ডেস্ক | ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১০:১৪

হিবা নিসার। মাত্র ১৮ মাস বয়সী হিবার মুখে এখনো ঠিকমতো কথা ফোটেনি। এই বয়সেই তার চোখের আলো নিভতে বসেছে ভারতীয় সেনাদের ছোঁড়া পেলেট গানে। অধিকৃত কাশ্মিরে ‘কুখ্যাত’ পেলেট গানের শিকার সবচেয়ে কম বয়সী হিবা।
অন্য শিশুদের সঙ্গে তার খেলনা সাইকেল চালাতে নাছোড় বান্দা হিবা। কিন্তু তাকে বাড়ির আঙিনায় ছাড়তে চান না মা মুরসালা জান। কারণ, চোখে ধুলাবালি পড়লে ইনফেকশন হতে পারে। ঠিকমতো কথা বলতে না পারলেও মাঝেমধ্যেই হিবা কান্না শুরু করে এবং ব্যথা বোঝাতে চোখের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে।
শ্রী মহারাজা হরি সিং মেডিকেল হাসপাতালের সুপার ডা. সালীম তাক আলজাজিরাকে বলেন, “হিবা তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।”
“তার কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্নিয়াল সারফেস নষ্ট হওয়ায় এমনটা হয়েছে। যখন একটি পেলেট গান চোখে আঘাত করে, তখন এটি সেখানে একটি গর্তের সৃষ্টি করে।”
সালীম বলেন, “হিবার চোখের ভেতর একটি পেলেট ঢুকে আছে। চোখ হলো ওয়াটার বলের মতো স্পর্শকাতর। চোখে অস্ত্রোপচার সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তার চোখে এক দফা অস্ত্রোপচার করেছি, আরো কয়েক দফা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।”
ঘটনার সূত্রপাত
গত ২৩ নভেম্বর বড়ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিল হিবা। এরই মধ্যে সোপিয়ান জেলার কাপরান গ্রামের কাছেই আটকে পড়া স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। এতে ছয় স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাই নিহত হন।

চোখের ব্যথা ভুলে খেলায় মেতে থাকতে চায় হিবা। ছবি: আলজাজিরা
খবর পেয়ে ওই এলাকায় জড়ো হতে থাকেন স্থানীয়রা। তারা ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ারশেল এবং ‘পেলেট গান’ নিক্ষেপ করতে থাকে।
হিবাদের বাড়ির প্রবেশপ্রথ থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরেই নিরাপত্তা বাহিনী এবং এলাকাবাসীর মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ।
“আমি সকালের নাশতা বানাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। টিয়ারশেলে গোটা ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ক্রমশই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল” বলছিলেন হিবার মা।
“হিবা বমি করতে শুরু করে আর আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না।”
পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় মুরসালা জান মেয়েকে কোলে নেন আর ছেলেকে আরেক হাতে ধরে দ্রুত ঘর থেকে বের হন। ঘর থেকেই বের হতেই তারা সংঘর্ষরত দুই পক্ষের মাঝে পড়ে যান।
মুরসালা জান বিবিসি-কে বলেন, “আমি দেখি নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। ছেলেকে টেনে আমার পেছনে নিয়ে যাই। আর হিবার মুখ হাত দিয়ে ঢেকে দেই।”
একজন সেনাসদস্য মুরসাল জানকে লক্ষ্য করে তিনটি ‘পেলেট গান’ ছুঁড়েন। কিন্তু এর একটি হিবার ডান চোখে গিয়ে বিঁধে।
‘মা, পুড়ে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার করে ওঠে হিবা। তার চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। মেয়ের এ অবস্থা দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মুরসাল জান। পরে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন প্রতিবেশিরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

অধিকৃত কাশ্মিরে ‘অন্ধ চোখের মহামারি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে এই পেলেট গান। ছবি: বিবিসি
সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভ দমনে ‘পেলেট গান’র ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। গত কয়েক বছরে প্রায় ৬,০০০ কাশ্মিরী পেলেট গানে চোখে আঘাত পেয়েছেন, যাদের অনেকেই এক চোখ হারিয়েছেন। আবার অনেকেরই দু’চোখের আলোই নিভে গেছে। অধিকৃত কাশ্মিরে ‘অন্ধ চোখের মহামারি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে এই পেলেট গান।
পেলেট গানে চোখ হারানো এরকম ১,২৩৩ কাশ্মিরীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুহাম্মদ আশরাফ ওয়ানি। তিনি বলেন, পেলেট গানে চোখ হারানো সবচেয়ে কম বয়সী কাশ্মিরী হিবা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরের শাসক মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দিলে এই রক্তপাতের সূত্রপাত হয়। এনিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান।
স্বাধীনতার জন্য ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে কাশ্মিরীরা ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিলে সহিংসতা নতুন মাত্রা পায়। সাম্প্রতিক সময়ে এই সহিংসতা ফের বাড়তে শুরু করেছে।