নিয়ম আনল সেরার স্বীকৃতি
ইমানুল সোহান | ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০
প্রথমবার ভর্তিই হতে পারেননি কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বার পেরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগে প্রথম হয়েছেন ৩.৯৬ স্কোর করে। ইমরান উদ্দিন ভুঁইয়া পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক। তাকে নিয়ে লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন ইমানুল সোহান
বাবা খোরশেদ আলম ভুঁইয়া স্কুল মাস্টার। নিয়ম করে ক্লাস নিতে যান, ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেন। নিজেকেও সেভাবে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচালিত করেন। সমাজে, পরিবারে তার খুব সুনাম। বাবাকে সারাজীবন এভাবে চলতে দেখেছেন চার ভাই-বোন। সবার ছোট ইমরানেরও তেমন হতে মন চাইল। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। বাড়িতে পড়ার পরিবেশ আছে, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বাবার, অন্যদেরও তাই দেখে ও পড়ার প্রতি তাকে মনোযোগী করে তোলায় ইমরানের লেখাপড়ায় মন খুব।
পড়ালেখায় তিনি বরাবরই কৃতি। উত্তর-পশ্চিম নুরুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মেধাবৃত্তি পেয়েছেন। ছেলের কৃতিত্বে চমকে গিয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘ইমরান ভালো করে পড়ো, আমি তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই।’ লক্ষ্মীপুর জেলার এই ছেলেটি এরপর ভর্তি হলেন তাদের রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলেরই শিক্ষক তার বাবা। বাংলা, ইংরেজি, কোনো কোনো সময় বিজ্ঞান পড়ান। বাবার স্কুল বলে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হয়। আবার অন্যদের সঙ্গে আরও অনেক বেশি ভালো ব্যবহার করতে হয়। বাড়িতে এসে দিনের পড়া দিনে পড়ে ফেলতে হয়। পরদিন শ্রেণিকক্ষে থাকতে হয় মনোযোগী। এভাবেই দিনে দিনের পড়া পড়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে উঠল তার। সেটি এখনো ধরে রেখেছেন। সে কারণে সাফল্যও পেয়েছেন। প্রতিটি শ্রেণিতেই প্রথম হয়ে পাস করেছেন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই সেরা ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞানই বেছে নিলেন। তবে রসায়ন ও জীববিজ্ঞান কেন যেন ভালো লাগলো না। তারপরও বাবার মুখের দিকে চেয়ে পড়ে গেলেন। একসময় না পেরে বললেনও, ‘বাবা, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব তো? জীববিজ্ঞান আর রসায়ন পড়তে তো মোটেও ভালো লাগে না।’ ছেলের দিকে চেয়ে সারা জীবন ছাত্রদের নিয়ে কাটানো মানুষটি কেবল উত্তর করলেন, ‘লেগে থাকলে, ভালোভাবে পড়লে অবশ্যই পারা সম্ভব। সারা জীবন তাই দেখেছি।’ আর কথা বাড়েনি। ছেলের তো লেগে থাকার অভ্যাস সব সময়ই আছে। ফলও পেলেন হাতেনাতে। এসএসসি ‘এ প্লাস’ নিয়ে পাস করলেন। তাদের সবার খুশি দেখে কে! এরপর ভর্তি হলেন নোয়াখালী সরকারি কলেজে। কলেজটি অনেক পুরনো। অসংখ্য বিখ্যাত ছাত্রের জন্ম দিয়েছে। বাবার সঙ্গ এই প্রথম পেলেন না তিনি। মেসে থাকেন বলে বাইরে থাকার জীবন শুরু হলো। কলেজে বাধা নেই, খেয়াল মতো চলার জীবনের স্বাদও পেলেন। প্রথম বর্ষে মনোযোগ দিয়ে তাই পড়েননিÑ বলে ফেললেন সরল ছেলেটি। তবে একসময় তার পেছনে তাড়া করতে লাগল স্কুল শিক্ষক বাবার প্রকৌশলী ছেলের স্বপ্নপূরণের সেই ইচ্ছে। তাই আবার লেখাপড়ায় মন দিলেন। বিজ্ঞান ভালোভাবে, মজা করে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠল। পদার্থ ও রসায়নে আশপাশের উদাহরণ মনে করে পড়া শুরু করলেন। কলেজের ক্লাসেও হলেন নিয়মিত। সেই থেকে শ্রেণিকক্ষে স্যারদের লেকচার মনোযাগ দিয়ে শুনে নোট করার অভ্যাসটি তার তৈরি হয়েছে। এটি তাকে দিয়েছে চরম সাফল্য। তখন একটি, দুটি দুর্বল বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। বরাবরের সেই মনোযোগ এইচএসসিতেও এনে দিয়েছে ‘এ প্লাস’। তবে ভালো ফলাফল করার খুশিতে মনোযোগ দিতে পারেননি বলে কোনো সরকারি বিশ^বিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারলেন না ইমরান উদ্দিন ভুঁইয়া। তবে সে জন্য নিজে যতটা ব্যথা পেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন বাবাÑ জানালেন। গ্রামের লোকেরা, আশপাশের মানুষ, সমাজের পরিচিত, বন্ধুরাÑ ইমরানের খবর কী? বললেই বাবাকে মুখ গোমড়া করে বলতে হয়েছে, ‘আমার ছেলে ভর্তি পরীক্ষায় টেকেনি।’ পরের বছর নিয়মিত প্রায় সারা দিন পড়া, নোট করাÑতাকে সুযোগ পাইয়ে দিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে। অনেক দিন ছেলের সঙ্গে কথা না বলা বাবা এরপর থেকে হাসিমুখে কথা বলেছেন। তারা একসঙ্গে আলাপ করেছেন। ২০১০-১১ সেশনে তিনি বেছে নিলেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়। তার পড়ার বিষয়টি নতুনÑ ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই)’।
ইমরান বিশ^বিদ্যালয়ের বিরাট ক্যাম্পাসে এসে হলে উঠলেন। ঠিকানা জিয়াউর রহমান হল। প্রথম বর্ষ থেকেই আগের সেই নিয়মিত পড়ার অভ্যাসটি ভেতরে জেগে উঠল। স্যার, ম্যাডামদের ক্লাস লেকচার ভালোভাবে শুনতেন, সেগুলো খাতায় ভালো করে নোট করতেন। রুমে ফিরে অন্তত ছয় ঘণ্টা পড়তেনই। বন্ধের দিনেও ছয় ঘণ্টা পড়ার নিয়ম বাদ দেননি। কোনো বড় ভাইয়ের নোট অনুসরণ করেননি, কারও কাছে চানওনি। নিজেই প্রতিদিনের পড়া ক্লাসে ভালোভাবে টুকে প্রয়োজনে, অবসরে নোট করেছেন। সেগুলোই তার ইনকোর্স, সেমিস্টার ফাইনালের সময় সহায় ও অনন্যতার কারণ হয়েছে। দুই সেমিস্টার মিলিয়ে প্রথম বর্ষেই যখন ‘৩.৮৯ সিজিপিএ’ নিয়ে বিভাগে প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিলেন; এতটুকু অবাক হলেন না ইমরান। কারণ তিনি জানেন, নিয়মিত ভালোভাবে পড়লে পারা যায়, এই তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা। সেকথা বলেছেনও অন্যদের। তারপর তাকে আলাদা করে ফেললেন শিক্ষকরা। অন্যসব ছাত্রদের যেভাবে মায়া করেছেন, তার পাশেও তারা থেকেছেন সবসময়। যেকোনো সমস্যার সমাধানে তো ছিলেনই। সিনিয়রদের ভালোবাসাও পেয়েছেন। তবে লেখাপড়ার বিষয়ে একটু বেশি আগ্রহ আছে বলে তাতে যারা ভালো, তারা আলাদা নজরে দেখেছেন ছোট প্রিয় ভাইটিকে। বিভাগের এক শিক্ষক অবসরে নিজে রোজগারের জন্য ও চলার প্রয়োজনে তাকে তিনটি টিউশনি দিয়েছিলেন। সেগুলো করেছেন নিষ্ঠাতেই। তারপরও পড়ায় ফাঁকি দেননি। সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ছাত্র পড়িয়ে নিজে পড়েছেন রাত ১টা পর্যন্ত। মোবাইল ফোনটিও ভালোভাবে ব্যবহার করেননি। যখন তার টেবিলে বই-খাতা আছে, তিনি চেয়ারে বসে পড়ছেন; তখন মোবাইলটি ছিল খাটের ওপর বা অন্য কোথাও। তাতে মনোযোগ বেড়েছে অনেক। সবসময়ই প্রশ্নে যা চাওয়া হয়েছেÑ সেটিরই উত্তর করেছেন মনটি দিয়ে। খাতায় পরিষ্কারভাবে উত্তর করেছেন, কাটাছেঁড়াও কম ছিল, বানান ভুলও তেমন ছিল না। সংশ্লিষ্ট ও প্রয়োজনীয় ছবি আঁকা, কোট করাÑ ইত্যাদি সৃজনশীলতাও ছিল। তাই এই অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটির অনার্সে সিজিপিএ হয়েছে ‘৩.৯৬’। এটি বিভাগের সেরা ছাত্র হিসেবে রেকর্ড। আরও রেকর্ড করেছেন তিনি বিভাগের হয়ে, বিশ^বিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকের জন্য মনোনীত হয়ে। সে পদক এবার লাভ করবেন।
ইমরানের চাকরি জীবনেরও শুরু হচ্ছে। জনতা ব্যাংক লিমিটেডের আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) বিভাগে অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে মনোনীত হয়েছেন। দুটি খুশির খবর একসঙ্গে দিয়ে বললেন, ‘সুযোগ থাকলে বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেব। নবধারার গবেষণার প্রতি আমার খুব আগ্রহ আছে। টান্সপারেন্ট সিকিউরিটি ট্রানজেকশন সিস্টেমে খুব কৌতুহল। এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স সাইটগুলো ব্যবহার করছে। এই গবেষণায় নামব। সুযোগ পেলে বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেব।’
শেয়ার করুন
ইমানুল সোহান | ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০

প্রথমবার ভর্তিই হতে পারেননি কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বার পেরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগে প্রথম হয়েছেন ৩.৯৬ স্কোর করে। ইমরান উদ্দিন ভুঁইয়া পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক। তাকে নিয়ে লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন ইমানুল সোহান
বাবা খোরশেদ আলম ভুঁইয়া স্কুল মাস্টার। নিয়ম করে ক্লাস নিতে যান, ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেন। নিজেকেও সেভাবে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচালিত করেন। সমাজে, পরিবারে তার খুব সুনাম। বাবাকে সারাজীবন এভাবে চলতে দেখেছেন চার ভাই-বোন। সবার ছোট ইমরানেরও তেমন হতে মন চাইল। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। বাড়িতে পড়ার পরিবেশ আছে, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বাবার, অন্যদেরও তাই দেখে ও পড়ার প্রতি তাকে মনোযোগী করে তোলায় ইমরানের লেখাপড়ায় মন খুব।
পড়ালেখায় তিনি বরাবরই কৃতি। উত্তর-পশ্চিম নুরুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মেধাবৃত্তি পেয়েছেন। ছেলের কৃতিত্বে চমকে গিয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘ইমরান ভালো করে পড়ো, আমি তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই।’ লক্ষ্মীপুর জেলার এই ছেলেটি এরপর ভর্তি হলেন তাদের রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলেরই শিক্ষক তার বাবা। বাংলা, ইংরেজি, কোনো কোনো সময় বিজ্ঞান পড়ান। বাবার স্কুল বলে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হয়। আবার অন্যদের সঙ্গে আরও অনেক বেশি ভালো ব্যবহার করতে হয়। বাড়িতে এসে দিনের পড়া দিনে পড়ে ফেলতে হয়। পরদিন শ্রেণিকক্ষে থাকতে হয় মনোযোগী। এভাবেই দিনে দিনের পড়া পড়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে উঠল তার। সেটি এখনো ধরে রেখেছেন। সে কারণে সাফল্যও পেয়েছেন। প্রতিটি শ্রেণিতেই প্রথম হয়ে পাস করেছেন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই সেরা ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞানই বেছে নিলেন। তবে রসায়ন ও জীববিজ্ঞান কেন যেন ভালো লাগলো না। তারপরও বাবার মুখের দিকে চেয়ে পড়ে গেলেন। একসময় না পেরে বললেনও, ‘বাবা, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব তো? জীববিজ্ঞান আর রসায়ন পড়তে তো মোটেও ভালো লাগে না।’ ছেলের দিকে চেয়ে সারা জীবন ছাত্রদের নিয়ে কাটানো মানুষটি কেবল উত্তর করলেন, ‘লেগে থাকলে, ভালোভাবে পড়লে অবশ্যই পারা সম্ভব। সারা জীবন তাই দেখেছি।’ আর কথা বাড়েনি। ছেলের তো লেগে থাকার অভ্যাস সব সময়ই আছে। ফলও পেলেন হাতেনাতে। এসএসসি ‘এ প্লাস’ নিয়ে পাস করলেন। তাদের সবার খুশি দেখে কে! এরপর ভর্তি হলেন নোয়াখালী সরকারি কলেজে। কলেজটি অনেক পুরনো। অসংখ্য বিখ্যাত ছাত্রের জন্ম দিয়েছে। বাবার সঙ্গ এই প্রথম পেলেন না তিনি। মেসে থাকেন বলে বাইরে থাকার জীবন শুরু হলো। কলেজে বাধা নেই, খেয়াল মতো চলার জীবনের স্বাদও পেলেন। প্রথম বর্ষে মনোযোগ দিয়ে তাই পড়েননিÑ বলে ফেললেন সরল ছেলেটি। তবে একসময় তার পেছনে তাড়া করতে লাগল স্কুল শিক্ষক বাবার প্রকৌশলী ছেলের স্বপ্নপূরণের সেই ইচ্ছে। তাই আবার লেখাপড়ায় মন দিলেন। বিজ্ঞান ভালোভাবে, মজা করে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠল। পদার্থ ও রসায়নে আশপাশের উদাহরণ মনে করে পড়া শুরু করলেন। কলেজের ক্লাসেও হলেন নিয়মিত। সেই থেকে শ্রেণিকক্ষে স্যারদের লেকচার মনোযাগ দিয়ে শুনে নোট করার অভ্যাসটি তার তৈরি হয়েছে। এটি তাকে দিয়েছে চরম সাফল্য। তখন একটি, দুটি দুর্বল বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। বরাবরের সেই মনোযোগ এইচএসসিতেও এনে দিয়েছে ‘এ প্লাস’। তবে ভালো ফলাফল করার খুশিতে মনোযোগ দিতে পারেননি বলে কোনো সরকারি বিশ^বিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারলেন না ইমরান উদ্দিন ভুঁইয়া। তবে সে জন্য নিজে যতটা ব্যথা পেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন বাবাÑ জানালেন। গ্রামের লোকেরা, আশপাশের মানুষ, সমাজের পরিচিত, বন্ধুরাÑ ইমরানের খবর কী? বললেই বাবাকে মুখ গোমড়া করে বলতে হয়েছে, ‘আমার ছেলে ভর্তি পরীক্ষায় টেকেনি।’ পরের বছর নিয়মিত প্রায় সারা দিন পড়া, নোট করাÑতাকে সুযোগ পাইয়ে দিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে। অনেক দিন ছেলের সঙ্গে কথা না বলা বাবা এরপর থেকে হাসিমুখে কথা বলেছেন। তারা একসঙ্গে আলাপ করেছেন। ২০১০-১১ সেশনে তিনি বেছে নিলেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়। তার পড়ার বিষয়টি নতুনÑ ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই)’।
ইমরান বিশ^বিদ্যালয়ের বিরাট ক্যাম্পাসে এসে হলে উঠলেন। ঠিকানা জিয়াউর রহমান হল। প্রথম বর্ষ থেকেই আগের সেই নিয়মিত পড়ার অভ্যাসটি ভেতরে জেগে উঠল। স্যার, ম্যাডামদের ক্লাস লেকচার ভালোভাবে শুনতেন, সেগুলো খাতায় ভালো করে নোট করতেন। রুমে ফিরে অন্তত ছয় ঘণ্টা পড়তেনই। বন্ধের দিনেও ছয় ঘণ্টা পড়ার নিয়ম বাদ দেননি। কোনো বড় ভাইয়ের নোট অনুসরণ করেননি, কারও কাছে চানওনি। নিজেই প্রতিদিনের পড়া ক্লাসে ভালোভাবে টুকে প্রয়োজনে, অবসরে নোট করেছেন। সেগুলোই তার ইনকোর্স, সেমিস্টার ফাইনালের সময় সহায় ও অনন্যতার কারণ হয়েছে। দুই সেমিস্টার মিলিয়ে প্রথম বর্ষেই যখন ‘৩.৮৯ সিজিপিএ’ নিয়ে বিভাগে প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিলেন; এতটুকু অবাক হলেন না ইমরান। কারণ তিনি জানেন, নিয়মিত ভালোভাবে পড়লে পারা যায়, এই তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা। সেকথা বলেছেনও অন্যদের। তারপর তাকে আলাদা করে ফেললেন শিক্ষকরা। অন্যসব ছাত্রদের যেভাবে মায়া করেছেন, তার পাশেও তারা থেকেছেন সবসময়। যেকোনো সমস্যার সমাধানে তো ছিলেনই। সিনিয়রদের ভালোবাসাও পেয়েছেন। তবে লেখাপড়ার বিষয়ে একটু বেশি আগ্রহ আছে বলে তাতে যারা ভালো, তারা আলাদা নজরে দেখেছেন ছোট প্রিয় ভাইটিকে। বিভাগের এক শিক্ষক অবসরে নিজে রোজগারের জন্য ও চলার প্রয়োজনে তাকে তিনটি টিউশনি দিয়েছিলেন। সেগুলো করেছেন নিষ্ঠাতেই। তারপরও পড়ায় ফাঁকি দেননি। সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ছাত্র পড়িয়ে নিজে পড়েছেন রাত ১টা পর্যন্ত। মোবাইল ফোনটিও ভালোভাবে ব্যবহার করেননি। যখন তার টেবিলে বই-খাতা আছে, তিনি চেয়ারে বসে পড়ছেন; তখন মোবাইলটি ছিল খাটের ওপর বা অন্য কোথাও। তাতে মনোযোগ বেড়েছে অনেক। সবসময়ই প্রশ্নে যা চাওয়া হয়েছেÑ সেটিরই উত্তর করেছেন মনটি দিয়ে। খাতায় পরিষ্কারভাবে উত্তর করেছেন, কাটাছেঁড়াও কম ছিল, বানান ভুলও তেমন ছিল না। সংশ্লিষ্ট ও প্রয়োজনীয় ছবি আঁকা, কোট করাÑ ইত্যাদি সৃজনশীলতাও ছিল। তাই এই অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটির অনার্সে সিজিপিএ হয়েছে ‘৩.৯৬’। এটি বিভাগের সেরা ছাত্র হিসেবে রেকর্ড। আরও রেকর্ড করেছেন তিনি বিভাগের হয়ে, বিশ^বিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকের জন্য মনোনীত হয়ে। সে পদক এবার লাভ করবেন।
ইমরানের চাকরি জীবনেরও শুরু হচ্ছে। জনতা ব্যাংক লিমিটেডের আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) বিভাগে অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে মনোনীত হয়েছেন। দুটি খুশির খবর একসঙ্গে দিয়ে বললেন, ‘সুযোগ থাকলে বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেব। নবধারার গবেষণার প্রতি আমার খুব আগ্রহ আছে। টান্সপারেন্ট সিকিউরিটি ট্রানজেকশন সিস্টেমে খুব কৌতুহল। এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স সাইটগুলো ব্যবহার করছে। এই গবেষণায় নামব। সুযোগ পেলে বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেব।’