
জামশেদুল আলম চট্টগ্রাম জেলার প্রথম বাংলা চ্যানেল বিজয়ী। পেশাদার সাঁতারু। বিখ্যাত ম্যারাথন রানার। নামকরা দাবাড়ু, জলবায়ু পরিবর্তনের আপসহীন যোদ্ধা। তাকে নিয়ে লিখেছেন জাহেদুল হক
জামশেদুল আলমের পূর্বপুরুষের ভিটা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর ইউনিয়নের পীরখাইন গ্রাম। তার জন্ম ৪ ডিসেম্বর ১৯৯২ সাল। রাঙ্গামাটি জেলার কোতোয়ালি থানার কাঁঠালতলিতে বড় হয়েছেন। বাবা মোহাম্মদ আবুল হাশেম, মা শাহিদা বেগম। দুই ভাই, বোনের মধ্যে জামশেদ ছোট। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাবা-মার সঙ্গে, কাঁঠালতলিতে। রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পাস। এর পর পর বাবা সবাইকে নিয়ে চলে এলেন গ্রামের বাড়িতে। চন্দনাইশ উপজেলার বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস তিনি। বিজিসি ট্রাস্ট অ্যাকাডেমি কলেজ থেকে এইচএসসি। গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে বিবিএ। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে এমবিএস।
স্কুলজীবনে জামশেদ বাংলাদেশ স্কাউটসের বয় স্কাউট ছিলেন। স্কাউটসের প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। কাব ক্যাম্পুরিগুলোতে, ক্যাম্পে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হয়ে অংশ নিয়েছেন। ভালো পারফরমেন্সে পুরস্কারও জিতেছেন। ছাত্রজীবনে তার খেলাধুলায় আগ্রহ ছিল বেশি। কৈশোরে ফুটবলার হিসেবে খুব সফল ও জনপ্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন ক্লাবে ভাড়ায় ফুটবল খেলতে যেতেন। নাম কুড়াতেন। দৌড়, সাঁতার, দাবা খেলায়ও ছিলেন খুব পারদর্শী। স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে খেলাধুলায় হাঁটতে, হাঁটতে এতটুকু এসেছেন তিনি।
জামশেদের ভ্রমণের শখ সেই শৈশব থেকে। বাবা-মার সঙ্গে রাঙ্গামাটিতে থাকতেন। তখনই পঞ্চম শ্রেণিরতে পড়া অবস্থায় দুর্গম পাহাড়ের অনেক এলাকায় ঘুরে দেখেছেন। রাঙ্গামাটির পাহাড় প্রকৃতি দেখে তখন থেকেই ভ্রমণের নেশা তার। সেই থেকে দেশকে জানার জন্য প্রবল ইচ্ছা জাগে তার মনে। বিভিন্ন সময়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের অনেক দুর্গম পাহাড়ি পাড়ায় গিয়ে অধিবাসীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে কাজ করেছেন। সেখানকার অধিবাসীদের বিভিন্ন সময় বিনামূল্যে ওষুধ বিলি করেছেন। অনেক উঁচু পাহাড়েও উঠেছেন তিনি। বান্দরবানের থানচি ও রুমার কটি দুর্গম পাহাড় আছে। রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির বেশ কয়েকটি পাহাড়ে সামিট করেছেন।
দেশের সর্ব-দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ থেকে সর্ব-দক্ষিণের দ্বীপ সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ১৬.১ কিলোমিটার দীর্ঘ জলপথটি বাংলা চ্যানেল নামে পরিচিত। চ্যানেলে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ ১৪তম ফরচুন বাংলা চ্যানেল সুইমিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার ও এক্সট্রিম বাংলা যৌথভাবে আয়োজন করেছে। ৪০ জন প্রতিযোগী সাঁতরে উত্তাল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী মিশনে অংশ নিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলার একমাত্র প্রতিযোগী ছিলেন জামশেদুল আলম। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে বাংলা চ্যানেল জয় করতে তার সময় লেগেছে চার ঘণ্টার কিছু বেশি। সেটি মোট ৩১ জন সাঁতারু একসঙ্গে জয় করেছেন এই বাংলাদেশ। এর আগে এত বেশি সাঁতারু এ দুর্গম পথটি পাড়ি দেননি। চট্টগ্রামের প্রথম বাংলা চ্যানেলজয়ী কৃতী সাঁতারু জামশেদুল আলম। বললেন, ছাত্রজীবন থেকে সাঁতার কাটতে পছন্দ করতেন। স্কুলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছেন। বাংলা চ্যানেল জয়ের পর চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) তাকে সম্মাননা দিয়েছে। পুরস্কার হিসেবে সিজেকেএস সুইমিং পুলে বিনা ফিতে সাঁতার প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ও সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন তার হাতে সম্মাননা তুলে দিয়েছেন। আনোয়ারা উপজেলার দক্ষিণ বন্দর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী চৌধুরীর পারিবারিক পুকুরে শিশুদের এখন তিনি নিয়মিত সাঁতার শেখান। সেখানে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ও কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (কাফকো) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিশু সন্তানরাসহ এলাকার সাঁতার না জানা অনেক শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে তার উদ্যোগে। তিনিই তাদের কোচ। সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে গোটা উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেশ সাড়া ফেলেছেন তিনি।
তার আরও কীর্তি আছে। দেশে প্রথমবারের মতো পূর্ণ ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে। ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ম্যারাথনটির খেলার আয়োজন করে ম্যারাথন বাংলাদেশ। ৪২.২ কিলোমিটারের ফুল ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ও বিজয়ী হয়েছেন জামশেদুল আলম। জয়দেবপুর সড়কের সাড়ে ১০ কিলোমিটার অংশে বিরতিহীন ৪ রাউন্ডের নির্ধারিত সময় ৭ ঘণ্টা ছিল। তিনি সাড়ে ৪ ঘণ্টা সময়ে ম্যারাথন শেষ করে রেকর্ড গড়েছেন। তাদের উপজেলা ও জেলাতে তিনি বেশ কয়েকটি দৌড় প্রতিযোগিতায় হাফ ম্যারাথন রানারের সাফল্য অর্জন করেছেন।
খেলাকে তিনি জীবনের অংশ মনে করেন। নানা ধরনের খেলায় অংশ নিতে উৎসাহ দেন। হাঁটা, দৌড় ও ভ্রমণকে উৎসাহিত করতে গত বছরের ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা থেকে ৪১ কিলোমিটার হেঁটে বান্দরবানের প্রান্তিক লেকে গিয়েছেন জামশেদুল আলম। ভ্রমণ গ্রুপ বাংলাদেশিয়ানের আয়োজনে এই হাঁটার অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্য বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করা। ভোর ৫টায় আনোয়ারার বরকল সেতু থেকে হাঁটা শুরু করে বান্দরবানের প্রান্তিক লেকে পৌঁছান বেলা ৩টায়। চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজ গেট, সাতকানিয়ার কেরানীহাটে বিরতি নিয়েছেন। নিজের ক্লান্তি ভুলেছেন। ৪১ কিলোমিটারের দীর্ঘপথ হেঁটে বান্দরবানে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। তারপরও জামশেদুল আলম বলেছেন, এই ইভেন্ট সহজ ছিল না জানি। তারপরও হাঁটা, দৌড় ও ভ্রমণকে উৎসাহিত করতেই এমন আয়োজন ভবিষ্যতেও করব।’ ২০ কিলোমিটারের বেশি হেঁটেছেন তিনি পারকি সমুদ্র সৈকত থেকে গহিরা প্যারাবন, বাঁশখালী চা বাগান, বান্দরবানের থানচি থেকে নাফাকুম ও রুমা থেকে কেওকারাড়ং-সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে।
২০১৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) থেকে দাবা খেলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার দাবা প্রতিযোগিতা, পটিয়া এবিটস কাপ দাবা প্রতিযোগিতা, আন্তঃকলেজ দাবা প্রতিযোগিতাসহ বেশ কয়েকটি দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। পটিয়া এবিটস কাপ ও আন্তঃকলেজ দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন মেধাবী এই দাবাড়ু।
দেশের প্রায় ৩৫টি জেলায় ভ্রমণ করেছেন জামশেদুল আলম। উল্লেখযোগ্য– পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বগুড়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, রাজশাহী, সাতক্ষীরা ও যশোর। ভ্রমণে এসব জেলার কৃষ্টি-কালচার, প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা হয়েছে তার। ভালোবেসেন সরল এই মানুষগুলো, তাদের জীবন।
খেলাধুলার পাশাপাশি মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর ১১ জন সমমনাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আনোয়ারা ব্লাড ডোনেট গ্রুপ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনের মাধ্যমে আনোয়ারা উপজেলার ১১ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামে, গ্রামে রক্তদানের নানা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেন তারা। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি রোগীকে রক্ত সহায়তা করেছে তাদের সংগঠন।
উপজেলার ১১ ইউনিয়নের স্কুল-কলেজে ১২টি রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচি ও থ্যালাসেমিয়া রোগের সচেতনতা সভা করেছেন। সেগুলোতে উপজেলার ৫ হাজারের বেশি মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়েছে। চারটি ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পের মাধ্যমে অন্তত এক হাজার নারী-পুরুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে তাদের সংগঠনে। ১শ নারী-পুরুষের এই সংগঠনের জামশেদ নিজেও নিয়মিত একজন রক্তদাতা। এ পর্যন্ত নয়জন নারী-পুরুষকে ৯টি ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।
প্রিয় বাংলাদেশ নামে আরেকটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। ২০১৯ সালে এই সংগঠনের যুক্ত হয়েছেন। সংগঠনটি ফুটপাতের গরিব-অসহায় বা হতদরিদ্রদের খাবার দিয়ে সহায়তা করে। প্রিয় বাংলাদেশের ‘ফুড ফোর্স’ নামের স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে অভুক্তদের খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন তারা। সংগঠনের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামের বন্যার্ত ,রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ও টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণের সুযোগ হয়েছে তার।
ইউটিউবে থ্রায়থলন ও বাংলাদেশিয়ান নামে জামশেদুল আলমের দুটি চ্যানেল রয়েছে। ২০১৮ সালে সাঁতার, দৌড় ও সাইক্লিং (থ্রায়থলন) ভিডিওর মাধ্যমে থ্রায়থলন চ্যানেলটি চালু করা হয়। এটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় একটি চ্যানেল। সাবস্ক্রাইব ২১শ। সাবস্ক্রাইব ও ভিডিওর বিচারে বিশ্বে থ্রায়থলন চ্যানেলের মধ্যে অষ্টম, এশিয়া মহাদেশে প্রথম অবস্থানে আছে। ইংল্যান্ডের বন্ধু রিক তাকে চ্যানেলটি বাংলাদেশ থেকে পরিচালনা করতে সাহায্য করেন। জামশেদ বাংলাদেশে থ্রায়থলন প্রচার ও প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন এখানে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশিয়ান নামে আরেকটি ইউটিউব চ্যানেল চালু করেছেন। চ্যানেলে ভ্রমণ নিয়ে ভিডিও আপলোড করা হয়। দেশের বিভিন্ন আকর্ষনীয় ও দর্শনীয় স্থানগুলো বিবরণ, ভিডিওসহ তুলে ধরা হয়। কোন স্থানে কীভাবে যাবেন, থাকা-খাওয়া সব গাইডলাইন থাকে। চ্যানেলটি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সুফল, কুফল নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তিনি চালু করেছেন জলবায়ু বিষয়ক প্রথম ওয়েবসাইট ‘বাংলাদেশিয়ান ডট কম’। তাতে জলবায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন আর্টিকেল লেখা ও ছাপা হয়। ‘সেভ ট্রিস সেভ বাংলাদেশ’ স্লোগানে জনসচেতনতা তৈরি করতে তাদের আলাদা স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
ঝুঁকি নিয়ে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি এই জীবনে। আদিবাসীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করেছেন অনেকবার। জঙ্গলের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। অনেক সময় নির্ভয়ে ঘাসের ওপর ঘুমিয়ে রাত পার করেছেন। সাগরের স্রোতের সঙ্গে তার যে লড়াই, তা বিয়ার গ্রিলসের চেয়ে কম কীসে?
জামশেদুল আলম থামেননি। বিচক্ষণ পরিকল্পনার ম্যাপ সাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পথ থেকে পথে। তার এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননাও পেয়েছেন অনেক। সিজেকেএস সম্মাননা, স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশন সম্মাননা, প্রিয় বাংলাদেশ সম্মাননা, বাংলা চ্যানেল সুইমিং সম্মাননা ও ম্যারাথন বাংলাদেশ সম্মাননা অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন বার্তা নিয়ে দূরপাল্লার সাঁতার ও ম্যারাথনে অংশ নেওয়াসহ খেলাধুলাকে জনপ্রিয় করতে করতে চান তিনি। মনে করেন–‘সুস্থ দেহে সুস্থ মনের বাস’। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি খেলাধুলার চর্চা করা খুব প্রয়োজন। খেলা ছাড়া জীবন পূর্ণতা পায় না।’
অবিশ্বাস্য তার দেশপ্রেম, অসাধারণ কর্মবীর তিনি। বিশ্বের সেরা ও এক নম্বর ব্যাংক ‘ব্যাংক অব আমেরিকা’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট একজন বাংলাদেশি; নারী–‘বুশরা আহমেদ’। নিজের জন্মভূমির তরুণ, তরুণীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজের অবিশ্বাস্য সুন্দর এক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমেছেন। অনেক তার স্মরণীয় সাফল্য, অনেক যোগ্যতা। কথা বলে তার ভাষায় লিখেছেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন আকরাম হোসেন
১.
আমি ‘ব্যাংক অব আমেরিকা’য় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট–‘এন্টারপ্রাইজ ডিজিটাল ব্যাংকিং’ বিভাগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩ কোটি মানুষের সাড়ে সাত কোটি আমাদের কাস্টমার বা ভোক্তা। তাদের মোট সাড়ে চার কোটি আমাদের অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কাস্টমার। এত মানুষের একজনকেও কখনো ব্যাংকে পা রাখতে হয় না। তারা সব লেনদেনই মোবাইলে সারেন। টাকা জমা, তোলা, বিল শোধ–সবই করেন নিজের স্মার্ট ফোনে। আমাদের সিইও ব্রায়ান ময়নাহান এই পুরো কাজটিকে বলেন ‘ব্যাংক ইন ইউর পকেট।’ স্মার্টকার্ড নয়, আমাদের ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রমানবী ‘এরিকা’ কাজগুলো করে। যদি বলি, ‘এরিকা, ট্রান্সফার ১০ ডলারস’, কয়েক সেকেন্ডে সেই ক্রেতার অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যায়। আমাদের সব ধরনের কাজই হয় মুখে বা মোবাইলে। বিশ্বের মোট আড়াই লাখ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনসের মধ্যে ব্যাংক অব আমেরিকার মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনই জে.ডি. পাওয়ারের সার্টিফিকেট পেয়েছে। এটি মার্কিন ডাটা অ্যানালিটিকস অ্যান্ড কনজিউমার ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি।
২.
এখানেও নেই, আমেরিকাতেও নেই–দুনিয়ার কোথাও, কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষ, নারীতে সমতা নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বহু চেষ্টা করেও মহিলারা নেতা বা প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। অবিশ্বাস্য এই কাজ বাংলাদেশে আমরা করেছি। একজন নারী আমাদের নেতা! সেজন্য ভিন দেশে খুব গর্বিত হই। নারীর ক্ষমতায়নে আমি বিশ্বাস করি। যুক্তরাষ্ট্রে আমার কাজ মানুষের বৈচিত্র্য ও নারীর অন্তর্ভুক্তিতে। ব্যাংক অব আমেরিকার গড়া শুধু মহিলাদের জন্য নেতৃত্ব, শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কাউন্সিল মেম্বার। আমাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে ‘পাওয়ার অব টেন’। ১০ জন ক্ষমতাবান নারী মিলে প্রতিষ্ঠানটি গড়েছি। মেয়েদের শেখাই–কীভাবে নেতা হতে হবে। এমন কাজ দেশেও করতে চাই।
৩.
নেতৃত্ব দেওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরেও কীভাবে ভালো নেতা হতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখব বলে গিয়েছিলাম বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে (এইচবিএস), ‘এক্সিকিউটিভ এমবিএ’ করব। এখানে এই এমবিএ করতে ১৫-২০ বছরের নেতৃত্ব দেবার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ডিগ্রিটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘করপোরেট স্পন্সরশিপ’। যার মানে, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তাদের হার্ভার্ডকে লিখিত দিতে হয়, আপনি তাদের অন্যতম নেতা। আপনার যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠানের শতভাগ বিশ্বাস আছে। ব্যাংক অব আমেরিকার এই লিখিত স্পনসরশিপ ও আমার শিক্ষাগত যোগ্যতায় এইচবিএসে পড়ার সুযোগ পেলাম। লিডারশিপ শিখতে গিয়ে তাদের কাছে শিখে এলাম, কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও বা প্রধান নির্বাহী অফিসার হওয়াতেই জীবন সার্থক হয় না। জীবনে সার্থক হতে হলে ভালো মানুষ, ভালো মা, ভালো বন্ধু–‘ভালো’ হতে হয়। একেক জনের কাছে সাফল্য একেক রকমের। তবে তাতে বড় বা ছোট হওয়ার ব্যাপারই নেই। এই আমার জীবনের একটি স্বপ্ন ছিল –করপোরেট আমেরিকায় কোনো এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের ‘নাম্বার ওয়ান’ হব; হার্ভার্ড সে ধ্যান ধারণাই পাল্টে দিল। এরপর থেকে সারা জীবন ধরে একজন ভালো মানুষ, ভালো মা, ভালো প্রেমিকা, ভালো বন্ধু হতে চাই। জীবনের এই চিরসত্য বোধগুলো গড়ে দেওয়ায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
৪.
‘শিক্ষকতা’ বোধহয় রক্তেই আছে। মা–আমাতুর রশিদ, ২৭ বছর বাংলাদেশে শিক্ষকতা করেছেন। এখন অবসরে। চট্টগ্রামের জামালখানের সেন্ট মেরিস স্কুলে পড়িয়েছেন। এটি মিশনারি স্কুল। মায়ের রক্তের এই ধারা আমার মধ্যে আছে। না হলে এত ভালো ব্যাংকে চাকরি করে কেন এদিকে আসব? মানুষ বলেনও, তুমি পড়াতে যাও কেন? তারা তো তোমাকে ওভাবে পয়সা দিতে পারবেন না, কিন্তু মানুষকে বোঝানো কঠিন–সবকিছু পয়সা দিয়ে মাপা, যাচাই হয় না। কোনো বিষয়ে ‘প্যাশন’ বা তীব্র অনুরাগ আসে ভেতরের বোধ থেকে; শিক্ষকতা আমার প্যাশন, আমার ডাক। মা ছোটবেলায় আমাকে বলতেন, যদি একটি বাচ্চারও ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পার, তাহলে তোমার জীবন ও পৃথিবীতে আসা সার্থক। আমার মনে হয়, শিক্ষকতা সেই সুযোগটিই আমাকে দেয়। ছাত্র, ছাত্রীদের সবসময় প্রথম দিন ক্লাসে বলি, আমার একটি লক্ষ্য, যেদিন তোমরা এই ক্লাস থেকে বের হবে, যেকোনো পাঁচটি নতুন বিষয় শিখে যাবে। সারা জীবন কাজে লাগবে। ক্লাসের শেষদিন তাদের প্রশ্ন করি, তোমরা কি পাঁচটি বিষয় শিখেছো? অনেকে বলে, ২০টি, ৯টি বিষয় শিখেছি। আমার ছাত্রছাত্রীদের যে যা শেখে, সেটি আমার পুরস্কার হয়। আমার কাছ থেকে তারা শিখে কাজে লাগাতে পারলে আমি ধন্য হই। আমার অস্ট্রেলিয়ার ছাত্র, ছাত্রীরা মেইল পাঠিয়ে বলে, প্রফেসর বুশরা আহমেদ, আপনার ক্লাস নেওয়ার পর প্রমোশন পেয়েছি। কেউ লেখে, নিজের ব্যবসা শুরু করতে পেরেছি। কারও বক্তব্য, ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেছি, বসকে চ্যালেঞ্জ করেছি। এমনসব প্রাপ্তি তো পয়সা দিয়ে মাপা যায় না।
৫.
মায়ের ও নিজের বোধে সব সময় আমার শখ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব। স্বপ্নগুলো আমার বড়। শুরুতেই পোস্ট গ্রাজুয়েটে পড়াতে চেয়েছি। অ্যাকাডেমিক লাইনে না থাকলে তা পূরণ হয় না। সেজন্য পেশাদার অধ্যাপক হতে হয়। প্রথমে খোঁজ নিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে আমাকে কী করতে হবে। বলা হলো ‘এ অসম্ভব। অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা ছাড়া তো হবে না।’ অসম্ভবে আমি বিশ্বাস করি না। সবই সম্ভব যদি আন্তরিক চেষ্টা ও পরিশ্রম থাকে। ইউনিভার্সিটি অব হিউসটন ও হার্ভার্ডের ডিগ্রি এবং তার চেয়েও দামি ২০ বছরের বেশি আমার ব্যাংকিং ও শিল্প জগতের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের শার্লট শহরের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা শার্লট (ইউএনসি শার্লট)’র বিজনেস স্কুল–‘বেল্ক স্কুল অব বিজনেস’-এ আমাকে অ্যাসোসিয়েট ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়োগ দিল। তাদের মতে, আমার মতো এক ইন্ডাস্ট্রি লিডার যখন ক্লাসে যান; তিনি বাস্তব ও ২৩ বছরের টানা অভিজ্ঞতা নিয়ে পড়ান। মূল্যই আলাদা। এভাবে চেষ্টায় ও পরিশ্রমে আমি বুশরা আহমেদ এখন ৩টি পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়াই।
৬.
ইউএনসি শার্লটে পড়ানোর আগে আমার অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা ছিল ‘হার্ভাড বিজনেস স্কুল ক্লাব অব শার্লট’-এ। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্লাব আছে। সাবেক ছাত্র, ছাত্রীদের সংগঠন। আমরা সমাজের জন্য অলাভজনক কাজ করি। আমাদের সামাজিক বা কমিউনিটি ওয়ার্ক হয়। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্লাব অব শার্লটে আমরা একটি সার্টিফিকেশন কোর্স করাই। নাম ‘মিনি এমবিএ’। কোর্সটি তাদের জন্যে যাদের কোম্পানির ১০-১৫ বছরের ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনার কর্মঅভিজ্ঞতা আছে। অধ্যাপনা করে টাকাগুলো পাই, আমরা পুরোটাই চ্যারিটি বা দাতব্য হিসেবে অলাভজনক কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিই। আমি বা অন্য ফ্যাকাল্টিরা টাকাগুলো নিই না। এভাবেও সমাজের উন্নয়নে আমরা কাজ করি। কাজগুলো সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি। ব্যাংক, শিক্ষকতা, অন্যান্য কাজের বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি নানা ধরনের অলাভজনক কাজ করি। এই মুহূর্তে একটি অলাভজনক বোর্ডে কাজ করছি -‘শার্লট বাইল্যাংগুয়েল’। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডে আমি মার্কেটিং মেম্বার। যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকেন; সেই বাবা-মাদের আমরা শেখাই, কীভাবে সন্তান মানুষ করতে হয়, তাদের জীবন গড়ে দিতে হয়। এর বাইরেও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্লাব অব শার্লটের আমি বোর্ড মেম্বার। পদবি ‘ডিরেক্টর অব মার্কেটিং’। যখন ইউএনসি শার্লটে শিক্ষকতা করতে আগ্রহী হলাম, কাকতালীয়ভাবে তখন ব্যাংক অব আমেরিকার একজন ‘এক্সিকিউটিভ কোচ’ হিসেবে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। তাদের কিছু ছাত্র, ছাত্রীকে কোচিং বা প্রশিক্ষণ দিতাম। আমাদের ব্যাংকে তাদের শেখাতাম, কীভাবে কাজ করতে হয়, কীভাবে মিটিং চালাতে হয়। সাধারণ দক্ষতাগুলোই শেখাতাম। ফলে ইউএনসি শার্লট কর্তৃপক্ষ আমার কাজ সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতেন। সবকিছু বিচার করে ২০১৫ সালের শুরুতে ‘অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর’ পদে তারা আমার সঙ্গে চুক্তি করলেন। তারা বললেন, ‘আপনি দয়া করে চূড়ান্ত নিয়োগের আগে অপেক্ষাধীন সময় প্রবেশনাল পিরিয়ড হিসেবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।’ অধ্যাপনার শুরু হলো।
৭.
সেই ২০১৫ সালেই আমি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেরা অধ্যাপক’ হয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আলাদাভাবে অধ্যাপকদের তালিকা করা হয়। আমার এমবিএর ছাত্র, ছাত্রীরা আমাকে মূল্যায়ন করেছেন। শিক্ষকতার প্রথম বছরেই সেরা প্রফেসর তালিকার প্রথমে আমি থেকেছি। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্লাব অব শার্লটে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছি। অনলাইনে গুগল করলে আমাকে পাবেন। ফ্যাকাল্টিদের প্রথম নামটিই আমার। কারণ শেষ নামটি– আহমেদ। বেল্ক স্কুল অব বিজনেসে পড়াই। এখানে একটি ক্লাস নিয়ে শুরু করেছিলাম। পরে তারা আমাকে ভালো করছি বলে আরও দুটি ক্লাস দিতে চাইলেন। এখানে প্রথম যে কাজটি করলাম–ছাত্র, ছাত্রীদের করপোরেট সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কোর্স হিসেবে পড়াতে শুরু করলাম। আমরা ফেইসবুক, লিংকডইনসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখানে থাকতে হয়, কাজ করতে হয়। আমার এই কোর্সে ছাত্রছাত্রীদের আমি শেখাতাম কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে মার্কেটিং করতে হবে। এখানে প্রতিষ্ঠানের কাজ কী? সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠান কীভাবে সবার চেয়ে ভালো করতে পারে? ইত্যাদি পড়াতাম। ব্যাংক অব আমেরিকার বাস্তব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতাম। ব্যাংকের ‘সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং টেকনোলজি প্লাটফর্ম’র তখন আমি লিডার। কোর্সটিতে আমাদের সাফল্যের পরে ইউএনসি শার্লট অনুরোধ করলেন মিসেস বুশরা আহমেদ আপনি বিগ ডেটা এনালিটিক্স পড়ান। তারা জানতেন, ব্যাংক অব আমেরিকায় ডেটা এনালিটিক্স, হাডুপ, বিগ ডেটা নিয়ে আমি কাজ করতাম। ব্যাংকে আমার দলটি অবিশ্বাস্য ডেটা ভলিউম নিয়ে কাজ করত। বিশ্ববিদ্যালয় তখন অনুরোধ করল, আমি সেই টেকনোলজি যেন তাদের ছাত্রছাত্রীদের শেখাই। চাকরি করে এত ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে বললাম, তাহলে আমি সোশ্যাল মিডিয়া পড়াতে পারব না। আমার দুটি সন্তান আছে। তাদের পড়ালেখা শেখাই, সঙ্গে থাকি। ছেলেদের সময় থেকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নই। তাদের সময় দিতে আমি কম ঘুমাই। এত কষ্টের কারণ আমার সন্তানরা যেন কোনোদিন বলতে না পারে, আমাদের মা পেশাজীবন করতে গিয়ে আমাদের সময় দেননি। মাতৃত্বের দায়িত্ব আমার প্রথম অগ্রাধিকার। এই প্রসঙ্গে বলি, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি ২০১৯ সালে। সমাজসেবার জন্য ‘আগামী ফাউন্ডেশন’ নর্থ ক্যারোলিনার ‘সেরা মা’ হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ৫০ জন সেরা বাঙালি নারীকে নির্বাচন করেছে, যারা রোল মডেল। শিক্ষা, শিল্প, সমাজসেবা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রের একজন নির্বাচন করেছে। অনেক অ্যাওয়ার্ড পাই, কিন্তু ‘সেরা মা’ সম্মান ছিল খুব সম্মানের। যা বলছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়কে বললাম, বাচ্চাদের পর আমার ব্যাংক অব আমেরিকা, তারপর ইউনিভার্সিটি, নানা ধরনের সামাজিক কাজ। যেখানে সুযোগ পাই, কাজ করি। আমি তথ্যবিজ্ঞান (ডেটা সায়েন্স) পড়াতে আবেদন করিনি। তারা আমাকে বলেছেন। বললাম, এমবিএ-ই পড়াব। তারা বললেন, ডেটা সায়েন্স পড়ান। এ বিভাগে আমাদের ভালো শিক্ষকের দরকার। হাতে-কলমে, ইন্ডাস্ট্রিতে যার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। বিষয়টি এখন বিশ্বজুড়ে এক নম্বর বিষয়। নাসা থেকে পৃথিবীর যত জায়গা আছে বিশেষত মার্কিন রাজনীতি, নির্বাচনসহ তাদের ও অন্যদেরও দুনিয়ায় একটি বিষয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে–তথ্য বা ডেটা। তথ্য ছাড়া কিছুই চলে না। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা শার্লটের ডেটা শিক্ষা বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিখ্যাত বিষয়গুলোর একটি। এমন সমৃদ্ধ বিভাগ খুব কমই আছে। বোধহয় যুক্তরাষ্ট্রের মোটে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিটি অফার করে।
৮.
আমার করপোরেশন ব্যাংক অব আমেরিকায় বিগ ডেটা, অ্যানালেটিকস নিয়ে কাজ করেছি। ফলে যখন ডেটা সায়েন্স পড়াতে গেলাম, বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি এক শর্তে পড়াব। শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করব না। সিলেবাস তৈরি করে নিজেই সেভাবে পড়াব। আপনারা আমাকে কিছু বলতে পারবেন না। কারণ এ আমার ক্লাস। আমি আমার মতো করে আমার ক্লাস সাজাব। কীভাবে ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াব তাতে আমার ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবেন না।’ তারা বললেন, আপনার যেভাবে প্রয়োজন, আপনি পড়ান। পুরো স্বাধীনতা রইল। কী পড়াবেন, প্রশ্ন করবেন– সব আপনার স্বাধীনতা। এ বিশ্বাসের কারণ, তারা জানতেন, ব্যাংক অব আমেরিকা ইজ ভেরি নোন অ্যান্ড ভেরি ফেমাস ফর ডেটা সায়েন্স।
ইউএনসি শার্লটে ‘কম্পিটিটিভ অ্যাডভানটেজ উইথ বিগ ডেটা অ্যানালেটিকস (তথ্যবিজ্ঞান ব্যবহার করে কীভাবে বিভিন্ন করপোরেশন বা কোম্পানিগুলো তুলনামূলক অগ্রগতি করতে পারে)’ কোর্সটি পড়াতে শুরু করলাম। একটি কোম্পানি কীভাবে তাদের ও অন্যদের তথ্য ব্যবহার করে প্রতিযোগিতার বাজারে প্রথম হতে পারবে–এই হলো আমার বিষয়। মাস্টার্সের ছাত্র, ছাত্রীরা কোর্সটি পড়ে। আমার ৯০ শতাংশ ছাত্র, ছাত্রী চাকরি করে। স্নাতক পাস করে পড়তে এসেছে। গড় বয়স ৩০ থেকে ৬০ বছর। ডেটা সায়েন্সে আমার ছাত্র, ছাত্রীরা ডেটা সায়েন্টিস্ট। সবাই কাজ করে। পিএইচডি করা, নামকরা ডেটা সায়েন্টিস্ট আমার ছাত্রছাত্রী। বিভিন্ন কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট লিডার, হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট আছে। আমার ক্লাসরুম খুব সমৃদ্ধ। আমি শিক্ষার্থীদের বলি ‘আমার কাছ থেকে যত শিখবে, তার চেয়ে বেশি শিখতে পারবে তোমার পিআরদের (বন্ধু) কাছে। কারণ তোমরা প্রত্যেকে ডেটা সায়েন্স বিশেষজ্ঞ। আলাপ তোমাদের গড়ে দেবে। তারপরও আমাকে দরকার কারণ আমি তোমাদের সবার চেয়ে বেশি জানি। ডেটা সায়েন্সে আমার হাতেকলমে অভিজ্ঞতা ব্যাংক অব আমেরিকায় হয়েছে। বিরাট এই ব্যাংকে বিশাল বড় মাল্টিমিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট আমি ম্যানেজ করতাম। ইনচার্জ ছিলাম। আমার পরিকল্পনা ডেটা এক্সপার্টরা ব্যবহার করেছেন। ইউএনসি শার্লটে পরিকল্পনার পর্যায়ে আমি ডেটা সায়েন্স পড়াই। তথ্য কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেভাবে সফল হতে হবে, তথ্য সংগঠিত করতে হবে; দিতে হবে, মানুষকে তথ্যে বোঝাতে হবে; ডেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া, তথ্য দেখে কীভাবে বলব আগামী পাঁচ বছরে আমার কোম্পানিতে এগুলো চাই। সেগুলো নিয়ে কাজ তাদের শেখাই। তথ্যের ভিত্তিতে, দিকে তাকিয়ে, নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সফলতা পড়াই। সবই তাদের পড়াই। পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। তার একটি কারণ ওরা এর মধ্যে পর্যায়ে। এই নিয়ে তিন বছর ধরে ডেটা সায়েন্স পড়াচ্ছি। সপ্তাহে একদিন তিন ঘণ্টার ক্লাস। নিয়মিত সেমিস্টারে বুধবার সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৮টা। সামারে সপ্তাহে তিনদিন পড়াই। সামার কোর্স মোট পাঁচ সপ্তাহের। নিয়মিত সেমিস্টার চার মাসের। ইউএনসি শার্লটের ডেটা সায়েন্স বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রেই খুব মানসম্পন্ন। নাম ‘স্কুল অব ডেটা সায়েন্স।’ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মাস্টার্স করতে ছাত্র, ছাত্রীরা আসে।
৯.
ইউএনসি শার্লটে আরেকটি ডিপার্টমেন্টে অস্ট্রেলিয়ার ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াই। সামারে আমার একটি শর্ট কোর্স আছে- ‘ডিজিটাল ডেটা অ্যানালেটিকস’। ডেটার ওপরে, শিক্ষার্থীরা সব অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির। নর্থ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি, উলেঙ্গং ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সিডনির ছাত্র, ছাত্রীরা আসে আমার এই সার্টিফিকেশন কোর্সে। তিনজন অধ্যাপক কোর্সগুলো পড়ান। একজন বেল্ক কলেজের ডেটা সায়েন্স অনুষদের ডিন। আরেকজন শিক্ষক, তৃতীয়জন আমি। আমরা তিনটি মডিউল পড়াই। শেষটি আমি পড়াই–ডিজিটাল ডেটা অ্যানালেটিকস’। কারণ এখন ডিজিটালে ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করছি। এখানেও আমার পেশাগত জীবন, ইন্ডাস্ট্রি অভিজ্ঞতার কারণে তারা ক্লাসটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। প্রথম আবেদনের পর থেকে তারা আমাকে অ্যাপ্রোচ করছেন, আপনি এই, এই ক্লাসগুলো নিন। আরও কারণ, আমার ক্লাসের ফিডব্যাক ভালো। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় পড়াই। আমি পাঠ্যবই অনুসরণ করি না, খুব অ্যাপলিকেশন নির্ভর হয়। ছাত্র, ছাত্রীদের বাচ্চা বলি। মানবিক আচরণ করি। গতকাল সিলেবাস জমা দিলাম। এই সেমিস্টারে সব মিলিয়ে ১ হাজার পয়েন্ট আছে। ছাত্রছাত্রীদের ১ হাজার পয়েন্টে পরীক্ষা দিতে হবে। ১শ পয়েন্ট উপস্থিতি– কে কত কথা বলে, ইন্টারঅ্যাকটিভ কী–এর ওপর এই নম্বরগুলো দেওয়া হবে। আমার নিয়ম হলো, ক্লাসে শুধু নিজেই কথা বলব না। তুমিও বলবে, আমিও বলব। স্টুডেন্টরা এ অনুসরণ করে ও ভালোবাসে। অন্য ক্লাসের শিক্ষকরা এ কাজ অত করেন না। ২শ পয়েন্ট দিই কনটেমপরারি আর্টিকেল বা সমসাময়িক লেখায়। তাদের বলি, ফোর্বসে গিয়ে অত তারিখের এই আর্টিকেলটি পড়ে মনোভাব লেখো। মোট চারটি আর্টিকেল তাদের পড়তে দিই। আমি নম্বর দিই অ্যাসাইনমেন্টের পর। এভাবেও পড়ানোর মাধ্যমে তাদের জটিলভাবে চিন্তা করা শেখাই। পরে তারা বলে, আপনার ক্লাস করার পর আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়া অনেক গতিশীল, সংঘবদ্ধ হয়েছে। গ্রেড করি কে কত চিন্তা করতে পারে, কে অত পারে না তার ভিত্তিতেও। কত প্রকার, কী, কী প্রশ্ন করি না। এজন্য অনেক কাজ করতে হয়। কম ঘুমিয়ে, লেখাপড়া ও কারিকুলাম করি। তারপরও ভালো লাগে, তাদের কারণে আরও শিখতে পারছি। আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে প্রতিটি শিক্ষক কারিকুলাম তৈরি করেন। তাদের কাঠামো তৈরি করে দিয়ে বলা হয়, এই ফ্রেমে থাকবেন। ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কারণ আমি বহুনির্বাচনী প্রশ্নও দিই না। প্রশ্নগুলো প্রশ্নোত্তর, রচনামূলক, প্রায়োগিক কম্পিউটারভিত্তিক করি। আমার টিচিং অ্যাসিসটেন্ট আছে। সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা সাহায্য করে। আমার প্রশাসনিক কাজ করে। গ্রেডিং, পড়ালেখা সবশুদ্ধ সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিই। দিনে ৩ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ১৫-২০ ঘণ্টা নিজেকে তৈরিতে সময় দিতেই হয়।
১০.
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্লাব অব শার্লটের হয়ে মিনি এমবিএতেও বেশিরভাগই আমার চেয়ে বয়সে বড়। ওখানে বয়স ব্যাপার নয়। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেখানে ৪০ বছর বয়সেও মনে করলে স্কুলে যেতে পারবেন। এখানে এক বয়সের পর চাইলেও পড়ালেখা করতে পারেন না। ওখানে অনার্সের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেউ পড়ালেখা করেন না। ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য আন্ডার গ্রাজুয়েটই যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট বেশি ভালো ডিগ্রি। মাস্টার্স অতিরিক্ত পড়ালেখা হিসেবে, প্রেরণায় করেন। তারা আবার হয়তো দ্রুত পদোন্নতি চান, গবেষণায় যেতে যেত চান, শিক্ষকতা করতে চান। আমাদের মতো আবশ্যিক নয়। ফলে যেসব ছাত্রছাত্রী এমবিএ পড়তে আসে তারা স্বপ্রণোদিত। নিজেদের জন্য পড়ালেখা করে। কারও কথায়, চাকরি পেতে পড়ালেখা করে না। এ ধরনের ক্লাসগুলোর ৯০ ভাগ ছাত্রছাত্রী চাকরি করে। তারা আসেন কারণ তারা জানতে, শিখতে ও বিশ্বকে বুঝতে চায়।
১১.
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের সম্মান ভালো। তবে ছাত্র, ছাত্রীরা ক্লাসে উঠে দাঁড়ায় না। নিজেদের মতো থাকে। শিক্ষক বলে আমি একটুও রাগ করতে পারব না। তবে আমার ক্লাস শুরু ৫টা ৩০ মিনিটে, তারা এক মিনিট পরেও ক্লাসে ঢুকতে পারবে না। ছাত্র, ছাত্রীরা ৫টা থেকে ৫টা ২৫ মিনিটে সবাই চলে আসে। সেখানে এটি একটি সম্মান শিক্ষকের আছে যে তার ছাত্র, ছাত্রীরা কেউ ক্লাসে দেরি করে ঢোকে না। আমার কাছে সম্মান–যখন অ্যাসাইনমেন্ট দেব, দেরি করে জমা দেবে না। আমাকে প্রশ্ন করতে পারবে। এ ধরনের সম্মান পাই। তারা কিন্তু ক্লাসে চ্যালেঞ্জ করে। পরে বলে এ শিক্ষক ক্লাসে ভালো ছিলেন না, কিচ্ছু শিখতে পারিনি। আমি পয়সা ফেরত চাই। যুক্তরাষ্ট্রের সব বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বেসরকারি নয়, হার্ভার্ড বেসরকারি। সে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নেই। শুরু থেকে এমন। তাদের সংবিধানেও ছাত্ররাজনীতি নেই। তারা সেভাবেই দেশ গড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ালেখার। ছাত্ররাজনীতি বাচ্চাদের জীবনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় একে অন্যের পরিপন্থী।
১২.
ব্যাংক অব আমেরিকার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের আমি এক্সিকিউটিভ কোচ। প্রকল্পটির পুরো মানে অ্যাপ্লাইড টেকনোলজি প্রোগ্রাম (এটিপি)। যুক্তরাষ্ট্রে তারা প্রায় ১২ বছর ধরে মডেলটি বাস্তবায়ন করছেন। ব্যাংক অব আমেরিকা এখন প্রযুক্তিনির্ভর বিরাট ব্যাংক। ২০১২-১৩ সাল থেকে এটিপিতে কাজ করছি। আমার ইউএসসি শার্লটের আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের ব্যাংক অব আমেরিকায় ১৭ মাসের ব্যাংকিং খাতের এই কর্মপ্রশিক্ষণ দিই। পড়ালেখার পাশাপাশি তারা আমাদের সঙ্গে খণ্ডকালীন চাকরি করে। ব্যাংকের চাকরিতে প্রতি ছাত্র, ছাত্রীর একজন করে এক্সিকিউটিভ কোচ থাকেন। ব্যাংকে সিনিয়র লেভেলের, সিনিয়র লিডার। ছাত্র বা ছাত্রীটিকে সুপারভাইজ বা দেখাশোনা করেন, মেন্টর বা বিজ্ঞ পরামর্শদাতার কাজ করেন। কীভাবে কাজ করতে হয় শেখান। আমার অধীনে গত বছর সেরা মেধাবী চারজন ছাত্র, ছাত্রী ছিল। এক্সিকিউটিভ কোচ হিসেবে আমার সঙ্গে এক ঘণ্টা, এক ঘণ্টা করে মাসে দুইবার দেখা হয়েছে। তখন তারা আমাকে তাদের সব সমস্যার কথা বলেছে। তারা যে বিভাগে কাজ করে, সেখানে কেমন করছে জানিয়েছে। বরাবরের মতো কীভাবে করলে ভালো কাজ করতে পারবে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছি। আমার অধীনে যারা চাকরি করে, তাদের বলি দেখো, কীভাবে মিটিং চালাচ্ছি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখে শেখে কীভাবে মিটিং চালাতে হয়। বলি দেখো, আধ ঘণ্টার মধ্যে কীভাবে কত বড় সিদ্ধান্ত নিই। কীভাবে কথা বলি, কথা কীভাবে কোন লাইনে কেন যাচ্ছে। প্রশ্ন কীভাবে হ্যান্ডেল করি। কাজটি এভাবে করব, প্রজেক্টটি এভাবে। দেখো পার? সিনিয়র এক্সিকিউটিভ লেভেলে কোচিং করাই। তাদের শেখাই কীভাবে কথাও বলতে হয়। যে যে বিভাগে কাজ করে সে সেই কাজ শেখে। ছাত্র, ছাত্রী হিসেবে যতটুকু বিকাশ ঘটানোর আমরা চেষ্টা করি। ব্যাংক অব আমেরিকা প্রচণ্ড নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে কাজ করতে হয়। অসংখ্য গোপন তথ্য, নথি আছে। সব তো আর শেখাতে পারব না। তারপরও ১শ ভাগের ৩০ ভাগ কাজ তারা এভাবে জানতে ও শিখতে পারে। ১৭ মাসে তারা এত কিছু শেখে, ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে যায় বলে চাকরি পেয়ে যায়। এক্সিকিউটিভ কোচ বলে আমার সুপারিশে তাদের চাকরি হয়। যদি বলি এ ভালো নয়, আমাদের আর দরকার নেই; সেই ছাত্র বা ছাত্রী কাজটি করতে পারে না। এক্সিকিউটিভ কোচের প্রচুর ক্ষমতা। কোন ছাত্রকর্মী থাকবে, কে চাকরি পাবে তার সুপারিশের ওপর নির্ভর করে। গত সাত বছর যত শিক্ষার্থীর কোচ ছিলাম, মেন্টর হয়েছি; একজনেরই সুপারিশ করিনি। তার আচরণের অসুবিধা, সমস্যা ছিল। ব্যাংকের সংস্কৃতির সঙ্গে যাবে না বলে তাকে চাকরির জন্য রাখতে পারিনি।
১৩.
ব্যাংক অব আমেরিকার ‘অ্যাপ্লাইড টেকনোলজি প্রোগ্রাম’ বা এটিপি মডেলটিই বাংলাদেশে শুরু করছি। অবশ্য প্রেক্ষাপটসহ সব ভিন্ন হবে। দেশে এই মডেলের নাম, ‘অ্যাপ্লাইড ক্যারিয়ার প্লেসমেন্ট প্রোগ্রাম (এসিপিপি)’। প্রকল্পটির ধারণা ও নকশা আমার। মডেলটির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রোগ্রামটি আমিই প্রথম শুরু করব। দেশে এটিই আমার প্রথম কাজ। কেউ এমন কাজ কখনো করেননি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হবে। ডিআইইউ (ড্যফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)’র স্বাধীন সংস্থা এইচআরডিআই (হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি)’র সঙ্গে কাজ করব। হব তৃতীয় পক্ষ। আমি ড্যাফোডিলের নই। ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাদের সঙ্গে পরামর্শ, আলোচনায় কাজ করব। ছাত্র, ছাত্রী, অধ্যাপক, এইচআরডিআইয়ের সঙ্গে মিলে এই প্রোগ্রামটি সফল করব। ড্যাফোডিলের ছাত্র, ছাত্রীদের নিয়ে আমরা শুরুটি করব। ৮ থেকে ১১ সেমিস্টারের ছাত্র, ছাত্রীরা পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি করবে। এইচআরডিআইয়ের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো আমরা ঠিক করব। আমি থাকব কোম্পানিগুলোকে তাদের বলব, ভাই আপনারা আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন? ১০ জন ছাত্র, ছাত্রী দেব। টানা দেড় বছর কাজ করবে। নেবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন হিসেবে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা চাকরি করবে। উদ্যোগটি সফল করতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানরা আমাকে সাহায্য করছেন। যাতে পড়ালেখার রুটিনে ওরা পার্টটাইম চাকরি করতে পারে। এইচআরডিআই আমাকে সাহায্য করবে কীভাবে সবকিছু করতে হবে। কোম্পানিগুলো বাইরে থেকে এত মানুষ ভাড়া করে। ৪০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশে কোনো মেধা, দক্ষতা নেই বলে। আমাদের ১০টি ছাত্রছাত্রীকে ১৫ মাসে যা চান তাদের শেখাবেন। যখন গ্রাজুয়েশন করবে, তাদের নেন। কারণ তারা আপনাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছে। ব্যাংক অব আমেরিকায় যে মডেলে কাজ করি, সেটিই বাংলাদেশে চালু করব। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এইচআরডিআইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমরা চুক্তি করব। তারা দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশের ইন্টার্নশিপের ধারণা ও কার্যকারিতা বদলে দেবে প্রোগ্রামটি। আমি খুব আশাবাদী।
১৪.
‘করপোরেট ফেমিনোলজি’ নামে একটি বই আছে। পৃথিবীর ১৭ জন নারীনেত্রীর জীবন ও সাফল্য লেখা। হার্ভার্ড অ্যালামনাই বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাদের ১৭ মহিলা নেতাকে নির্বাচন করে লিখেছে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে ওপরের সারিতে, বিভিন্ন দেশে বড় প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। শুধুমাত্র তাদের নির্বাচন করা হয়েছে, যারা অবস্থানে খুব সফল ফিমেল লিডার। আমি একজন। একমাত্র বাংলাদেশি। তারা আমার নামের নিচে ইউএসএ পরিচয় লিখেছিলেন। বদলে ‘বাংলাদেশ’ লিখতে বলেছি। কারণ বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এই বইতে ও জীবনে পরিচিতি পেতে চাই।
১৫.
এই যে এসএপিপি শুরু করব, বাংলাদেশে চলে আসব–হয়তো হবে না। দুটি বাচ্চা ওখানে জন্মেছে, বড় হবে; তারা যেখানে থাকবে, আমি মা কাছাকাছি থাকব। তারা হয়তো কোনোদিন বাংলাদেশে থাকতে আসতে চাইবে না। এ কাজের মাধ্যমে নিজের দেশের কাছাকাছি থাকতে চাই। ওখানে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য এত কিছু করি; এখানেও করতে চাই। আমার মা বলেন, তুমি যখন ওখানে করো, সাগরে এক ফোঁটা হয়, যখন দেশে এসে করবে, বালতিতে এক ফোঁটা হবে। এখানে কাজ করো, ওখানে এমন অনেক মানুষ আছেন। এখানে নেই। যদি এখানে কিছু শুরু করতে পারি, সন্তানেরা হয়তো তার অংশ হতে চাইবে। যাদের কোনোদিনও আনতে পারতাম না, দেশে আনার একটি সুযোগ হয়তো তৈরি হবে।
লেখা ও ছবি :মোহাম্মদ আল আমিন তুষার
তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। এক রোজার ঈদের সালামিতে ৫০ টাকার চকচকে নোট পেলাম। অনেক টাকা পেয়ে খরচ করব কী–অসাধারণ সুন্দর এক মসজিদের ছবি দেখে হতবাক। এত দারুণ! ‘মা, মসজিদটি কোথায়?’ ‘আমাদের রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়।’ সেখানে নানাবাড়ি। অবশ্যই যাব, মনে মনে বলেছি। ছবির প্রতি তুমুল ভালোবাসার এই এক কারণ হলো। সেই থেকে আলো, ছায়ার; সুন্দরকে ধরে রাখার ইচ্ছের জন্ম ভেতরে। এমন অপূর্ব সৃষ্টি দেখব দেখব করে দেখা হলো না। বড় হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নানুকে আনতে গেলাম রাজশাহী। একদিনে ঘুরে এলাম শৈশবের ভালোবাসার মসজিদ। রাজশাহীর পুরনো বাস টার্মিনাল থেকে চড়ে বসলাম বাঘার বাসে। জনপ্রতি ৬০ টাকা। সকাল ১০টায় বাসে; সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার যেতে হয়। দক্ষিণ-পূর্বের এলাকা– বাঘা একটি উপজেলা। তবে বিশ্ববিখ্যাত তার অনন্য সুলতানি আমলের এই মসজিদের জন্য। তখন বাংলা শাসন করতেন নবাবরা। তাদের ওখানে যেতে বাসে লাগল মোটে দেড় ঘণ্টা। ১০ মিনিটের ভ্যানের যাত্রাপথ শেষে বললেন, ‘নামুন ভাই, এসে গেছেন।’ নেমে দেখি, অনেক বছরের এক তেঁতুল গাছ। তার নিচে ফটক। সুলতানি আমলে তৈরি বলে দেয়। বাঘা শাহী মসজিদের এই প্রবেশঘর। সামনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নীল সাইনবোর্ড টাঙানো। নানা তথ্য পড়ে জানলাম, অনুমান মতে, ১৫২৩ সাল থেকে ১৫২৪ মোটে এক বছর সময়ে বিখ্যাত, অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদটি বানানো। ‘হোসেন শাহ’ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। তার ছেলে সুলতান নাসির উদ্দিন নসরত শাহের আমলে, তার নির্দেশে তার পীরের পুণ্য স্মৃতিতে তৈরি। বাঘা মসজিদের উত্তর কোণে বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক, সুফি সাধক হযরত শাহ দৌল্লা (রহ.) ও তার পাঁচ অনুসারীর মাজার। আজও ভালোবেসে যত্ন করে, গেলাফ; ঝাড়বাতি জ্বালান সবাই। বাঘা মসজিদ তৈরি হয়েছে আরবি বছর ৯৩০ হিজরি সালে। এখন মোট ২৫৬ বিঘা জমি আছে মসজিদ এলাকার। উত্তরে মুখ করা মসজিদে প্রবেশ করলে স্নিগ্ধ, শান্ত ও অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে মন। মসজিদের আঙিনা বা ফ্লোর সমতলের আট থেকে ১০ ফিট ওপরে। খুব রহস্য! দেয়ালে, দেয়ালে চুন ও সুড়কির গাঁধুনি; মাঝে মাটির নকশাদার ইট। ভেতরে ও বাইরের দেয়ালে, সুন্দর বিশাল মোটা স্তম্ভ। মেহরাবগুলোতে এখনো কারুকাজ বেঁচে আছে–গবেষণার অমূল্য বিষয়। কারুকাজ করে মাটি পুড়িয়ে সেগুলো দিয়ে ইট বানিয়ে বসানো হয়েছে মসজিদের শরীর। কাছে গিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখি, আমগাছ, শাপলা, লতাপাতা; ফরার্সি নানা বর্ণমালা ও স্থাপত্যে খোদাই মসজিদ। ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক। এখনো কী অসাধারণ রং। কত যত্নে শিল্পীরা কাজ করেছেন! মোট ১০টি গম্বুজ। চারটি মিনার–ওপরের অংশগুলো আবার গম্বুজের মতো। এগুলো বাইরের। ভেতরে আছে ছয়টি গম্বুজ। এ ১০টিতেই বেঁচে আছে মসজিদের কাঠামো। চারটি মেহরাবের নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ানো হতো। যুদ্ধের সময় সেপাইরা থাকতেন। একটি অন্যগুলোর চেয়ে ছোট। মোয়াজ্জিন কারি মোহাম্মদ শওকতুল ইসলাম বললেন, ছোট মেহরাবে নারী মোয়াজ্জিন নামাজ পড়াতেন। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে এই বিশেষ নামাজ ঘর নারীদের জন্য ছিল। তবে সংস্কার করতে গিয়ে আর রাখা হয়নি। বাঘা শাহী মসজিদের ওপর আঘাত কম আসেনি। অনেক বছর ধরে নামি এই পবিত্র স্থানের খাদেম মোহাম্মদ মামুন আলী বললেন, ১৮৯৭ সালের ভয়ংকর ভূমিকম্পে উপজেলা ও আশপাশের এমন নামকরা, ইতিহাসের অনেক আঁতুড়ঘর ভেঙে গিয়েছে। বিরাট শক্তিশালী এ মসজিদের অসম্ভব শক্তিধর ১০টি গম্বুজ ভেঙে পড়েছে। পুরো মসজিদের ভেতর দীর্ঘকাল ভেঙে পড়ে ছিল। কেউ যেতেন না। ওপরে টিন দিয়ে ছাপড়া ঘরের মতো বানিয়ে নামাজ আদায় শুরু করলেন মুসল্লিরা। সেগুলোও ভেঙে পড়ল। এরপর তৈরি করা হয়েছে ঠিকভাবে গম্বুজগুলো। মসজিদের জীবন বেঁচেছে। কাজটি চলেছে ১৯৭৬ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই। এখন মসজিদের মূল প্রবেশপথ পাঁচটি, সবই পুব দেয়ালে। মসজিদে বিদ্যুৎ আছে। আলো আসার পর উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালের দুটি করে চারটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। মসজিদের চারদিক সুলতানি আমলের নগররাষ্ট্রের জনপদের নিয়মে প্রাচীরের। নানা আপদ-বিপদে মানুষ মসজিদে আশ্রয় নিতেন। দুপাশে দুটি প্রবেশ ফটক। অনিন্দ্য কারুকার্যের দক্ষিণেরটি ভালো আছে। তবে উত্তরের ফটক নাজুক। আগে তাদের একরকম দেখেছেন প্রবীণরা। বাঁচানো সম্ভব? বাঘা মসজিদ টেরাকোটার অপূর্ব নিদর্শন। কিছু নোনা ধরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল জায়গায় জায়গায়; ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত ‘টেরাকোটা মাস্টার আর্টিস্ট’ মদন পাল তেমন করে বানিয়ে দিলেন। রাজশাহীর আম, গোলাপ, ফুলগুলোর নকশা কাটা দেখলাম। সবসময়, সবাই আসতে পারেন বাঘা মসজিদে। প্রাচীন স্থাপত্যকর্ম তাদের মন ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়। অজু করতে পারেন পাশের দর্শনীয় ৫২ বিঘা বিশাল দিঘিতে। সুলতানই মানুষের পানি ও জীবনের প্রয়োজন মেটাতে বানিয়ে দিয়েছিলেন। চারপাশে সারি সারি নারকেল গাছ ছায়া দেয়, জল শীতল করে। চারটি বাঁধানো পাড়ে মানুষ পানি খান, অজু করেন। প্রতি শীতে লাখ মাইল পেরিয়ে জীবন বাঁচাতে অসংখ্য অতিথি পাখির দল আসে। ভরে দিঘি। এলাকা মুখর করে। মসজিদের পাশে দরগাহ শরিফ। খাদেম হাসান আলী জানালেন, দরগার প্রাণ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে হযরত শাহ আবদুল হামিদ (রহ.)’র মাজার শরিফ। এ প্রাঙ্গণকে কেন্দ্র করে প্রতি রোজার ঈদে দুই মাসের দীর্ঘ আসবাব মেলা হয়। সারা বছর জমাট মেলার রেশে ছোটখাটো খেলনা, হাতের কাজ, নানা কিছু বিক্রি হয়। কিনে নেন বছরওয়ারি বেড়ানো ও মনের বাসনা পূর্ণ করতে আসা মানুষরা। তাদের থাকার জন্য বাঘা উপজেলা ডাকবাংলো হয়েছে। কটি আবাসিক হোটেল আছে। খরচ কম। সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু একটি ছোট পাঠাগার গড়ে দিয়েছেন। মসজিদের পাশে জহর খাকি পীরের সাহেবের মাজার। মূল মাজারের উত্তরে তার কবর। প্রায় শ’ পাঁচ বয়সের বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী এই ‘বাঘা’ মসজিদ।
২৫ বছর কাটিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাস্টে কী অবদান? কেমন ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল? ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন আবদুল্লা আল মাসুদ। ছবি তিনি ও মেহেদী কবীর
প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। হাল ধরেই দেশের প্রথম, ১৯৮৬ সালে জন্ম নেওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাইলেন, গবেষণায় বিশেষ অবস্থান তৈরি করবেন। খুব ভালো সহযোদ্ধা খুঁজতে শুরু করলেন। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার অনুরোধে সায় দিলেন তরুণ গবেষক যোগ দিলেন ১৯৯৪ সালের ৪ ডিসেম্বর। শুরু করেছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের প্রধান হিসেবে। শুরু থেকে ক্লাস নিয়েছেন, হয়েছেন প্রিয়–‘জাফর স্যার’। একত্রে কাজ করেছেন অনেকে। সিএসই (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)’র সহকারী অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বিনা দ্বিধায় বললেন–‘জাফর স্যার শাহজালাল শাবিপ্রবিতে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করেছেন। প্রতিটি বিভাগে অন্তত দুটি কম্পিউটার কোর্স বাধ্যতামূলক করেছেন। আমাদের সব ছেলেমেয়ে কম্পিউটার ভালো পারে। এজন্য সিএসই বিভাগেই অনেক শিক্ষক প্রয়োজন ছিল। বিভাগের পাস করা ছেলেমেয়েরা বিদেশে চলে যাচ্ছিল। দেশে তেমন ভালো ফলের গ্রাজুয়েট নেই। তহবিল কম বলে অতিরিক্ত শিক্ষক নেওয়া যাবে না প্রশাসন বলে দিয়েছিল। সেই লোকবল নিয়ে বিভাগে, বিভাগে কম্পিউটার কোর্স পড়াতে শুরু করলেন। এখনো তার ও অন্য বিভাগগুলোর দক্ষ শিক্ষকরা মিলে কোর্সগুলো করাই। এভাবেই তো আমরা দেশকে কম্পিউটারে দক্ষ ছাত্র-ছাত্রী উপহার দিচ্ছি। জাফর স্যারের অনন্য উদ্যোগ–পুরো সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যায় অল্প ও বেশিদিনের কম্পিউটারের কোর্স চালু করেছেন। নিজেরা গিয়ে ২৫ বছর শিখিয়েছেন। এখনো চলছে। হাজার হাজার দক্ষ কম্পিউটার পেশাজীবী তৈরি হচ্ছে। দেশের লেখাপড়ার মান বাড়ানো, শিক্ষানীতি তৈরি, সৃজনশীল পদ্ধতি, পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন ইত্যাদিতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন।’ শিশু-কিশোর লেখক, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের নেতা– অনেক পরিচয়। কৃতী ও অতি বিখ্যাত লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই। তার ছোট বিখ্যাত রম্য লেখক, উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীব। অনেক স্মৃতি তাকে নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাসের। মানুষটিরও। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিলেন। বাংলাদেশের তারুণ্যের সেরা আইডলকে ভুলতে পারবে না হয়তো কোনোদিন তার শিক্ষকতার জন্ম ও ইতি টানা ক্যাম্পাস। বিভাগের ছাত্র জিল্লুর রহমান সৌরভ পড়েছেন ২০১২-’১৩ শিক্ষাবর্ষে। বারবার মনে পড়ে, “২০১২ সালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। ভাবিনি, জাফর স্যার পড়াবেন। তিনি খুব নামকরা। আদর্শ। খুব ভালো বলেন। শ্রেণিতেও মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে পড়িয়েছেন। পড়ানোর সময় বারবার আমাদের ভালো মানুষ হতে বলেছেন। বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে বয়ে দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে হবে।’ সেজন্য তার সারা জীবনভর চেষ্টা। ক ‘সব ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সবসময় বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন। পড়ালেখা, গবেষণা ও সবশেষে ক্যারিয়ার গড়তে তার উৎসাহ ও পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণা পাওয়া গিয়েছে।” অসাধারণ কর্মবীরের অবদানের আরও চমকে দেওয়া তথ্য- ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় জাফর স্যার সিএসইর অধ্যাপক হলেও ইইই (ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং), সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং (এসই) ও পদার্থবিদ্যার ক্লাস নিতেন। সিএসইর সহকর্মী অধ্যাপক ড. সেলিম রেজা দীর্ঘকাল সঙ্গে চাকরি করেছেন। বললেন, ‘তিনি প্রধান দায়িত্ব নিয়ে সিএসইর ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছেন। স্যার বড় পণ্ডিত ছিলেন, এত ভালো পড়াতেন। বিভাগের সব সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রীরা পড়তে চাইত। তাকে অনুরোধ করত। নিজের বিভাগে সাধ্যের মধ্যে বেশি কোর্স নিতেন। প্রথম ও শেষ সেমিস্টারে দুটি কোর্স অবশ্যই পড়াতেন। তারা জীবনবোধের আলোয় আলোকিত হতো। ফলে বিজ্ঞানের, সিএসইর আশপাশের ছাত্রছাত্রীরাও তার কাছে পড়তে চাইত। ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসাকে কোনোদিন উপেক্ষা করতে পারেননি প্রিয় মানুষ, লেখক। বিভাগের বাইরে প্রতিবর্ষে তিনটি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। উচ্চমানের শিক্ষক ছিলেন। ভালো লেখাপড়া আছে, পড়ানোর ধরন খুব ভালো।’ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুর রহমান তার প্রথম ব্যাচের ছাত্র। মনে পড়ে–‘স্যার মানুষ হিসেবে খুব অমায়িক, নম্র, ভদ্র ও আন্তরিক। কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেননি। হাসিমুখে কথা বলেছেন সবার সঙ্গে, সবখানে।
যেকোনো ভালো কাজে প্রেরণা ছিলেন। আমাদের ভালো কাজে সাহস দিয়েছেন। ভালো ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কীভাবে আরও ভালো মানুষ, উন্নত হতে পারব, দেশের ভালো করতে পারব–স্বপ্ন দেখিয়েছেন। চেয়েছেন, সিএসই হবে দেশের সেরা। স্যার ও আমাদের চেষ্টায় হয়েছে।’ কেমন তার ভুবন ছিল–বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্বপ্নোত্থান’র সাবেক সভাপতি দীপা চক্রবর্তী–‘আমাদের প্রায় সব স্বেচ্ছাসেবা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এলে মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যেত। বললে সবাই শুনত। সেই অভাব কীভাবে পূরণ হবে?’ এমন কীভাবে হলেন? ‘জাফর স্যার এমন নিয়ম মানতেন না যেগুলো ভালো নয়। অবস্থান, পদ নয়, মানুষকে কাজ, মন; মানুষ হিসেবে বিচার করেন। অন্য বিচার নেই। বারবার বলেছেন, সমাজের অন্ধকার, মানুষের অপচিন্তাকে দূর করতে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। সবসময় নাচ, গান, আবৃত্তি; পথশিশুদের স্কুল, ভালো উদ্যোগে ছিলেন।’ অসংখ্য মানুষের মতো লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে তার এককথা–‘বিজ্ঞানে আস্থা রাখা, প্রগতির দিকে ছুটে চলা, স্বপ্নবান সুস্থ ও খুব ভালো লেখার অধিকারী লেখক।’ অনেক ছাত্রকে শিক্ষক পদে নিয়োগদানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়েছে তাকে। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকরা সবাই তাকে চিনতেন। তিনিও। অধ্যাপক ড. সেলিম রেজার মনে পড়ে–‘সহকর্মী হিসেবে তিনি আমাদের ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। আন্তরিক ও সহযোগিতাপরায়ণ।েএই গুণগুলোতে ২৫ বছরে কোনো ঘাটতি কেউ দেখেননি। তার দীর্ঘকালের সহকর্মী হয়ে বলব, স্যার কোনোদিন নিজেকে আলাদা, বিশেষ ব্যক্তি মনে করেননি। শিক্ষক মনে করে আদর্শ শিক্ষক হতে সবসময় চেষ্টা করেছেন। শিক্ষক হিসেবে আমরা তার সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পেয়েছি। তার অন্তহীন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আছে। সেগুলোর মাধ্যমে ও চেষ্টায় সাস্টের অসংখ্য শিক্ষক, ছাত্র ও ছাত্রী দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম উজ্জ্বল করছেন।’ লেখক হিসেবে যে প্রতিষ্ঠা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার এই বয়সে পেয়ে গিয়েছেন, ইতিহাসে তার তুলনা তার বড় ভাই। প্রায় সবাই তার লেখা পড়েই এখানে ভর্তি হয়েছেন। যেকোনো আলাপে বলেছেন। পত্রিকার কলাম–‘সাদাসিধে কথা’ আছে। কিশোর, তরুণের স্বপ্নপুরুষটি তার মতো হতে চাওয়া লাখ লাখ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ গড়ছেন। সায়েন্স ফিকশন, কিশোর উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও শিশুদের বিখ্যাত লেখা আছে– ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’, ‘আমি তপু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘হাতকাটা রবিন’ ‘রাজু ও আগুন আলীর ভূত’, ‘ক্যাম্প’, ‘বিজ্ঞানী সফদর আলী’ সিরিজ, ‘টুকুনজিল’, ‘অনুরণ গোলক’, ‘ফোবিয়ানের যাত্রী’ ইত্যাদি। নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী মনিরা তাবাস্সুম নিলয় বলছেন, ‘স্যারের এক একটি বই আমাদের ছোটবেলা, কিশোরকালের সঙ্গী। অন্যদের মতো আমারও তার বই পড়ে বই পড়া, ভালো জীবন কাটানোর পাঠ শুরু হয়েছে। আমাদের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোর তিনি চিরসঙ্গী। তাকে অবহেলা করা যাবে না।’ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি ‘(এফইটি)’র সহকারী অধ্যাপক মনির হোসেনের কিশোরকালও তার গড়া। তার স্বপ্ন ধরেই কৃতী ছাত্র ও ভালো শিক্ষক হয়েছেন। বলেছেন, ‘বড়, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও এখানে চালু হওয়া এই বিভাগে ভর্তি হয়েছি শিক্ষক হতে। পরে পরিচয় হলো। ঠিক করলাম, নামকরা ভালো মানুষটির সঙ্গী হব। হয়েছি।’ লেখা ও পড়াতেই নয়, নিজের উদ্ভাবন ও গবেষণার আলোয় তিনি গড়েছেন ক্যাম্পাস। পুরো দেশ তৈরি করেছেন ভালোবাসায়। দেশের বিজ্ঞান গবেষণা ও উদ্ভাবনে শাবিপ্রবি প্রথম, এখনো সেরা। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। নানা ধরনের রোবট, প্রথম ড্রোন, সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মোবাইল ফোনে ভর্তি কার্যক্রম, টাকার ই-পেমেন্ট- কত কিছু তার ছাত্র, সহ গবেষক মিলে আবিষ্কার করেছেন! তথ্য-প্রযুক্তির প্রায় শাখায় ক্যাম্পাসের নানা উদ্ভাবনে তার অসাধারণ অবদান আছে। প্রথম দিকে শিক্ষক কম ছিলেন। বসার জায়গাও ছিল না। টাকার অভাব ছিল। তিলে তিলে সিএসই বিভাগ গড়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা তথ্য, গবেষণা ও বিজ্ঞান আবিষ্কারের বিভাগ হয়েছে। কত আবিষ্কার করেছেন। কারিগর অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল–তার শত্রুরাও স্বীকার করেন। তার অন্যতম আবিষ্কার ‘মুঠোফোনে ভর্তি’।
সবসময় বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ছাত্র, ছাত্রীদের মা, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম দিয়ে ভর্তির আবেদনপত্র সংগ্রহ করে ও পূরণ করে লাইনে দাঁড়িয়ে অমানুষিক কষ্ট করে ফর্ম জমা দিতে হতো। কোনো কাগজ না আনলে গিয়ে এনে সেভাবে আবেদন পূরণ করতে হতো। ২০০৯ সালে এই সমস্যার সমাধানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মোবাইল ফোনে ভর্তির ব্যবস্থা করল। ছাত্র ও গবেষকদের এ আবিষ্কারের নেতা অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এখন প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে ভর্তি করা হচ্ছে। কোটি, কোটি টাকা বাঁচছে। এখন মানুষ নেই, কিন্তু আকাশে ওড়ে বিমান–‘ড্রোন’র ছড়াছড়ি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা বানিয়ে ফেলেন। প্রথম তিনি ও তার দল বানিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি তাদের তৈরি ড্রোন আকাশে উড়েছিল। দুপুরে বিমানটি পুরো ক্যাম্পাস বেড়িয়েছে, সবাই দেখেছেন। সেটি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর নিরাপত্তা কাজে ব্যবহারে তৈরি ছিল। গুগলের বিকল্প আমাদের ‘পিপীলিকা’, ইংরেজি ও বাংলায় ফ্রি সার্চ ইঞ্জিন। ২০০৯ সালের বিভাগের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর ছিল একটি গবেষণা প্রকল্প মাত্র। পেছনে তিনি। শুরু হলো বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন বানানোর কাজ। দলে ছিলেন ১৩ জনের বিশাল ডেভেলপার দল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল কোম্পানি গ্রামীণফোন তাদের আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) বিভাগকে সহযোগিতা করতে দিতে রাজি হলো ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে। দেশসেরা এই আইটি বিভাগের সাহায্যে পিপীলিকা প্রকল্প পরিচালক ছিলেন জাফর স্যার। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই)র ২০০০ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও প্রধান গবেষক ছিলেন রুহুল আমিন সজীব। সার্চ ইঞ্জিনটি এখন সংবাদ পড়া, ই-লাইব্রেরি, কেনাবেচা, চাকরি খোঁজা বাংলা বানান সংশোধন, শব্দকল্পও করতে পারে। উন্নতি হচ্ছে। এখন আছেন মোট ছয়জন গবেষক ও ডেভেলপার। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্বপ্ন পূরণ হলে পিপীলিকা সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী বাংলা সার্চ ইঞ্জিন হবে। সম্ভব করছে তার পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সিএসই বিভাগ। ‘রিবো’ কথা বলতে পারে। তাও বাংলায়। রোবটটিই বাংলায় কথা বলতে পারা প্রথম রোবট।
বাংলায় লিখতে পারে। চোখের পাতা নাড়তে পারে, ঠোঁটও। নানা ধরনের মুখের ভঙ্গি করতে পারে। করমর্দন ও নাচার ক্ষমতা আছে। অসাধারণ রোবটটি জাফর স্যার ও তার ছাত্র–সিএসইর নওশাদ সজীব বানিয়েছেন। ২০১৩ সালে শুরু। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি (বিএসএফএস) বার্ষিক প্রদর্শনী করল। বলাবাহুল্য সোসাইটির তিনি অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তারা জাফর স্যারের ভাবনার কথা জেনে, রোবট দেখে এক লাখ টাকা গবেষণা অনুদান দিলেন। ক্যাম্পাসের রোবট বানানোর ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন–‘রোবো সাস্ট’কে অনুরোধ করলেন। ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে সবার সামনে এলো সেই ‘রিবো’। সবচেয়ে বেশি তিনি–দুষ্টু, মিষ্টি হাসি মুখে। একে, একে ২৫টি শিক্ষাবর্ষ এভাবে, এতকিছুতে কেটেছে তার এখানে। ১৯৯৮ সালে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতেও ছিলেন। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে গিয়েছেন বাংলার ‘তারুণ্যের আইডল’।
উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরিকে একনামে বইপ্রেমী, খুলনার মানুষরা চেনেন। ১২৪ বছরের এই গণগ্রন্থাগারের বিশাল ভুবন ঘুরে লিখেছেন সুমন্ত চক্রবর্ত্তী, ছবি তুলেছেন এইচডি হেলাল
খুলনার সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে বেশি বই ও জায়গার একটিই গণগ্রন্থাগার- উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি। গ্রন্থাগারটির সদস্যরা খুব ভালো লাইব্রেরিটিকে আরও বাড়াবেন। এখন দানের প্রয়োজন। লাইব্রেরির সামনের খোলা জায়গায় নতুন চারতলা ভবন হবে। ওপরের তলায় বই পড়া ও রাখার সম্প্রসারিত অংশ করবেন। আরেক অংশ থেকে যাবে পুরনো ভবনে। এখন তো জায়গা দিতে পারেন না। অনেকে না পড়ে ফিরে যান। ভবনের তিনতলায় আর্ট গ্যালারি করবেন। খুলনার আর্ট গ্যালারির অভাব মেটাবে। শিল্পীরা প্রদর্শনী করবেন। দ্বিতীয় তলায় কফিশপ, আড্ডার জায়গা ও কবিতা পাঠের কর্নার হবে। কফি খেতে খেতে লোকে কবিতা শুনবেন। নিচতলায় সবার জন্য, উন্মুক্ত মিলনায়তন হবে। নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হবে। এভাবে আরও বাড়বে খুলনার বইয়ের প্রধান ভুবন উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি। বইয়ের এই পবিত্র তীর্থ, মহাগ্রন্থাগারটি খুলনার গৌরব। ১২৪ বছর বয়স। এত ভুবন বিখ্যাত যে জেলার ঐতিহ্যময় গ্রন্থাগারের কথা উঠেই একবাক্যে উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি চলে আসে। পড়ন্ত বিকেলে পাঠকে ঠাসা পাঠকক্ষের কোণে কাচঘেরা ছোট্ট কক্ষে বসে বই পড়েন লাইব্রেরিয়ান, গ্রন্থাগারের প্রাণ শ্যামলকুমার দেবনাথ। গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদিরও এলেন। তারা বললেন, এই গণগ্রন্থাগার খুলনা শহরের প্রায় সমান্তরাল ও পুরনো। ১৮৮২ সালে যশোর জেলার একটি মহকুমা থেকে আলাদা জেলা হলো ‘খুলনা’। দুই বছর পর জেলা সদর, পরে পৌরসভা। ভৈরব, চিত্রা, মধুমতি নদীর এই অববাহিকাটি তারও আগে থেকে আলাদা সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল। নড়াইলের জমিদার ও সামান্তপ্রভুরা তাদের জমিদারি ছড়িয়েছেন খুলনা পর্যন্ত। খুলনায় কারও, কারও কাছারিবাড়ি। নড়াইলের অন্যতম প্রতাপশালী জমিদার রায় বাহাদুর কিরণচন্দ্র রায় তার জমিদারিতে মানুষের উপকার করবেন বলে বেশ কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বাবা জমিদার উমেশচন্দ্র রায়ের নামে ১৮৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করলেন। তাকে প্রেরণা দিলেন স্থানীয় নানা পেশার বিদ্যোৎসাহী। আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৮৯৭ সালের ১ মে। ছিল খুলনা পৌরসভার ছোট্ট ঘরে। মূল পৃষ্ঠপোষক জমিদার কিরণ চন্দ্র রায় ও তার উত্তরাধিকারীরা। দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত তারাই এই গণগ্রন্থাগার চালিয়েছেন। পাঠাগারের জন্মের দুই বছর পর ১৮৯৯ সালে পৌরসভা ভবন (এখন গড়ে উঠেছে নগর ভবন) তৈরি হলো। আরও একটু বড় জায়গা পেল পাঠাগার। নতুনভাবে শুরু করল। ১৯৩১ সালে পৌরভবন সম্প্রসারিত হলো। লাইব্রেরি দুটি কক্ষ পেল। সীমিতভাবে দীর্ঘদিন চলল। পৌরসভা বড় হলো, কাজ বাড়তে লাগল, লাইব্রেরির জায়গাটি হয় না। বইপ্রেমীরা বাঁচিয়ে রাখলেন প্রিয় উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি। বারবার আসতেন। পাঠাগার পরিচালনার গঠনতন্ত্র, বিধিও ছিল না। পাকিস্তানে লাইব্রেরির কর্তৃত্ব আর নড়াইল এই জমিদারদের কাছে থাকল না। নতুন দেশে খুব ভালোভাবে চলেনি। পৌর ভবনের লাইব্রেরির কক্ষটি বেশ কিছুদিন বন্ধ রইল। বিদ্যানুরাগীরা আবার এগিয়ে এলেন। তাদের সাহায্যে খুলনা মিউনিসিপ্যালিটি গ্রন্থাগার খুলে দিল। সাতচল্লিশের পরপর তাকে বাঁচাতে তারা নির্বাহী কমিটিতে পদাধিকারে সভাপতি খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সহসভাপতি মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যানকে করলেন। গোপালচন্দ্র বসু প্রথম সম্পাদক। ১৯৫৩ সালে কাজ ধারায় চলে এলো। অনেক সাংগঠনিক সভা হলো। ১৯৫৩ সালের ২৪ জুলাই গণগ্রন্থাগারের বিশেষ সাধারণ সভায় পরিচালনা নীতিমালায় সংশোধন এলো। নির্বাহী পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সভাপতি, সহকারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সহসভাপতি, জেলা বোর্ড-মিনিউসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান, জেলা সদরের এসডিও, জেলা স্কুল শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, বণিক সমিতির প্রেসিডেন্ট কমিটিতে ভালো পদে এলেন। তারাও গণগ্রন্থাগারের পৃষ্ঠপোষক হলেন। সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মচারী প্রতিনিধি, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী প্রতিনিধি দুজন করে থাকলেন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী প্রতিনিধি তিনজন। সভায় সিদ্ধান্ত হলো– অনুদান দিলে তারা দুজন সদস্য নির্বাহী কমিটিতেও নেবেন। পাঁচ সদস্য এলে সভা করতে পারবেন। সেই থেকে এই উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি নিয়মে চলছে। ২৮ বছর নিঃস্বার্থে সম্পাদক থেকে যতীন্দ্র মোহন সেন ১৯৫৯ সালের জুন মাসে ইস্তফা দিলেন। তখন তার মাসে সম্মানী ছিল ২৫ টাকা। সহকারী মানিক চন্দ্র ঘোষ ১৯৫৮ সালের মার্চে পদত্যাগ করলেন, সম্মানী ১৫ টাকায়, পিয়ন দেবেন্দ্র দত্ত পেতেন মাসে ১০ টাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধ রাখতে হলো। স্বাধীনতার বেশ পর চালু করা গেল। ধুঁকে ধুঁকে চলতে লাগল। তখন এম এ গফুর সম্পাদক। ১৯৭৯ সালে ছেড়ে দিলেন, অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন এলেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন দেশে খুলনা পৌরসভার প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান। তিনিও নড়াইলের ইটনা গ্রামের সন্তান। তার স্মৃতিতে, ১৯৮৩ সালে সবার চেষ্টায়, খুলনা জেলা প্রশাসন ও খুলনা পৌরসভার উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে ব্রিটিশ আমলের রয়্যাল এয়ারফোর্সের পড়ে থাকা জমিতে তৈরি হলো ‘জাহিদ স্মৃতিভবন’। পৌরসভা ও লাইব্রেরি কমিটির সিদ্ধান্তে ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণগ্রন্থাগার চলে এলো এই স্মৃতি ভবনে। ১ মে পৌর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ভবন ও জমি দান করলেন। ৮৭ বছর পর সে পেল স্থায়ী ঠিকানা। খুলনা শহরের কেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড় ধরে সোজা পুবে সামান্য এগিয়ে বামে মোড় নিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক লাগোয়া তিনতলা ‘জাহিদ স্মৃতি ভবন’– পুরোটাই ‘উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি’। এ জায়গাটিই শহর খুলনার হৃদয়। প্রবীণ জননেতা ও বিখ্যাত সংগ্রামী কমিউনিস্ট, ঘাতকের ছুরিতে নির্মম নিহত কমরেড রতন সেনের নামে এই সড়ক। জাহিদ স্মৃতি ভবনেও বইপ্রেমীদের যাতায়াত বাড়তে লাগল। অল্পদিনে এই ভবনেও পাঠক বসার আর জায়গা পান না। সমস্যা বাড়ছে। সবাই আরও ভালোভাবে বই ও বইয়ের মানুষদের রাখার চেষ্টা করছেন। ফলে ১৯৯০ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, খুলনা জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের তুমুল চেষ্টা, দানে গণগ্রন্থাগারের দোতলা ভবন তৈরি হলো। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘বেসরকারি গণগ্রন্থাগার সহায়তা প্রদান প্রকল্প’ থেকে দুবারে প্রায় সাত লাখ টাকা উন্নয়ন সহায়তা পাওয়া গেল। ১৯৯৫ সালে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় তিনতলা করা হলো। বাকি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বই কেনা হলো। এই হলো বইয়ের মূল ভাণ্ডার। এই ভবনের দোতলায় গণগ্রন্থাগার। নিচতলা ও তিনতলায় মিলনায়তন করা হলো। সেখানে শহর ও আশপাশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে লাগল। এখন নিচতলা মিলনায়তন, দোতলা গ্রন্থাগার ও পাঠকক্ষ, তিনতলা ডা. মানাফ গবেষণা পাঠকক্ষ। খুলনার এই নামকরা ভাষাসৈনিক, বিখ্যাত ডাক্তার, খুব পড়ুয়া মানুষ। ১৯৯৬ সালের আগস্টে সারা জীবনের সম্পদ, ব্যক্তিগত সংগ্রহের মূল্যবান সাত হাজার গবেষণাগ্রন্থ দান করলেন। গড়ে তোলা হলো তার স্মৃতি পাঠকক্ষ। আরও দিয়েছেন সংগ্রহের প্রায় দুই হাজার চিকিৎসা, বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ের পত্রপত্রিকা। গণগ্রন্থাগার খুব সমৃদ্ধ হলো। তিনতলায় আছে ‘স্বাধীনতা পাঠকক্ষ’। তা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস গবেষণাকেন্দ্র। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর বছর ১৯৯৬ সালে তৈরি। ১৯৯৭ সালে উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরির শতবর্ষ হলো। বর্ণাঢ্য ও উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের জন্য ডা. মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে শতবর্ষ উদযাপন কমিটি হয়েছিল। তবে টাকার অভাবে লাইব্রেরিতেই সামান্য আয়োজনে উৎসব করেছেন তারা। শ্যামলকুমার দেবনাথ জানালেন, ‘‘উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি এভাবে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজকের জায়গায় আসতে বহু কষ্ট করেছে, এখনো করছে। অনিয়মিত হলেও আমরা সাহিত্যপত্র ‘কথকতা’ প্রকাশ করছি। শিশু পাঠকদের জন্য ‘শিশু বিভাগ’ করেছি। ছোটদের বই পড়া প্রতিযোগিতা করি। তথ্য শাখাও করেছি।” পুরো খুলনা শহর ও আশপাশের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা বই পড়তে আসেন। তাদের জন্য মূল পাঠ্য ও সহায়ক বই রেখেছেন। যেগুলোর খুব দাম বাজারে। নানা শুভার্থীরাও সরবরাহ করেন। এখন মোট ৩৯ হাজার ৫০০ বই আছে। দেশের প্রায় সব কটি পত্রপত্রিকা, সাময়িকী বিখ্যাত পাঠাগারে রাখেন সাহায্যকারীরা। টাকা নেই তাদের। চাঁদা ও মিলনায়তন ভাড়ার আয় একমাত্র উৎস। আজীবন সদস্য আছেন ১৭৭ জন, সাধারণ সদস্য ৩৫০ জন। শিক্ষার্থী সদস্যও আছেন। আজীবন সদস্যরা যখন যা পারেন, সাধারণ সদস্যরা মাসে ২০ টাকা, শিক্ষার্থীরা মাসে ১৫ টাকা করে দেন। তাদের জন্য পাঠ্যবই রাখতে হয়। পড়ার পরিবেশ ও সুযোগ করে দেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের বছরে দেয় ৩০ হাজার টাকা, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বছরে ১৫ হাজার টাকার বই এবং আসবাব কেনা ও মেরামতে ১৫ হাজার টাকা বছরে দেয়। তাতে খরচ ওঠে না। ফলে বিপুল কাজ চালাতে আছেন মোটে তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। নামমাত্র পারিশ্রমিকে। বিখ্যাত এই লাইব্রেরির মায়া ছাড়তে পারেন না, বইয়ের পোকাও। লাইব্রেরিয়ান বললেন, ‘পুরো খুলনা অঞ্চলে মানসম্মত ও পাঠ উপযোগী গ্রন্থাগার নেই বললে চলে। দূর বয়রাতে খুলনার সরকারি গণগ্রন্থাগার আছে।’ রবিবার বন্ধ, প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা। অনেক পাঠক। বসার জায়গার খুব অভাব। কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির জানালেন, ‘পাঠকদের জন্য আমাদের মোট প্রায় ছয় হাজার বর্গফুট জায়গা। কুলোয় না। এত কম বই নিয়ে বিখ্যাত গণগ্রন্থাগার পাঠক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ভালো বই বাড়াতে হবে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, আইনজীবী, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুল শিক্ষার্থী আসেন। বই না থাকায় তাদের মানসিক বিকাশ পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেকের বাড়িতে বাতিল বহু বই, বুকশেলফ পড়ে থাকে। সেগুলো লাইব্রেরিতে দান করলে আমরা বাঁচি। এ অঞ্চলে সরকারিভাবে নতুন গ্রন্থাগার তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই বলে আমাদের চাপ বেশি। বই ও জায়গা বাড়াতে হবে। আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ দরকার।’ বহু বছরের লাইব্রেরিয়ান শ্যামল কুমার দেবনাথের ভালো লাগে, এখনো এই পাবলিক লাইব্রেরিতে বিভিন্ন নানা বয়সের, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দলে দলে বই পড়তে আসছেন। কোচিংনির্ভর, কম্পিউটার, ইন্টারনেটের এ যুগে পাঠকের কমতি নেই তাদের। যত পাঠক আসেন, তিনি তত ভালো থাকেন। শিশু-কিশোররা পড়তে এলে ভীষণ ভালো লাগে। খুব খুশি হন। পাঠককে দরকারি বইটি তুলে দিতে না পারলে খারাপ লাগে। নামকরা গণগ্রন্থাগারটি তারা ডিজিটাল করা শুরু করেছেন। পাঠক আরও অনেক বাড়বে– জানালেন। তার লাইব্রেরি ভালো নেই। চালানোর টাকার অভাব, বই, ম্যাগাজিনও কম। কর্মী নেই। লাইব্রেরি অন্তঃপ্রাণ বলে চিরকুমার থাকলেন। তিনি কিন্তু অধ্যাপক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এই শ্যামলকুমার দেবনাথই ৩০ বছরের বেশি হলো সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি। তিনি যে টাকা এখান থেকে পান, সামান্য। তাও গণগ্রন্থাগারের কাজেই খরচ করেন। আনোয়ার আলী, ৭২ বছরের। প্রায় সাত বছর ধরে এখানে বই পড়তে আসছেন। বললেন, ‘উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরিতে যেসব বই আছে, শহরের অন্য কোনো লাইব্রেরিতেও নেই। আগে তো অনেক বই পড়তাম। বয়স হয়েছে বলে বেশি পড়তে নিই না। ভালো লাগে বিশ্লেষণধর্মী বই।’ অনুদানেই চলে এই গণগ্রন্থাগার। আনোয়ারুল কাদির বললেন, আমাদের সভাপতি তো জেলা প্রশাসক। তিনি অনুদান দেন। সদস্যরা সাধ্যমতো চাঁদা দেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদান পাই। খুলনার অনেকে চাকরির পড়া পড়তে আসেন। তাদের অনেকে দরকারি বই কিনতে পারেন না বলে আমরা বলি তোমরা ওসব বই কিনে নিয়ে এসো। আমরা বইগুলোর দাম দিয়ে দিই। এখানে বসে পড়ালেখা করে তারা বিসিএসসহ নানা চাকরি পান। অনেকে আবার কেনা বইগুলো দান করে যান। এখন তো আমাদের ওয়াইফাই আছে। ইন্টারনেটেও পাঠকরা ফ্রি অনেক বই ডাউনলোড করে পড়তে পারছেন। কম্পিউটারে বই পড়ার সুবিধা থাকলে ভালো হতো।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন বরিশাল বিভাগ দল। সেরা গোলদাতাও তারা। অবিশ্বাস্য এই দলটির পেছনের গল্প লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন সাইফুর রহমান মিরণ
২০১৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে সাউথ এশিয়ান ফুটবল গেমসে অংশগ্রহণ করেছে রাব্বি। ভারতে হওয়া খেলায় বাংলাদেশ ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তৃতীয় ছিল
সে এখন দেশের সেরা ক্যাপ্টেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব ১৭ গোল্ডকাপে বিজয়ী বরিশাল বিভাগ দলের ক্যাপ্টেন রাশেদুল ইসলাম রাশেদ। পাড়া থেকে ফুটবল তার শুরু। খুব ভালো খেলে বলে কয়েক বছরেই বরিশাল স্টেডিয়ামে জায়গা করে নিয়েছে সে। এরপর পেছনে তাকাতে হয়নি। ২০১৫ সালে প্রথম ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলার সুযোগ ঘটেছে দারুণ মেধাবীর। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সেইলর কাপে বরিশালের হয়ে খেলেছে। ২০১৬-২০১৭ সালে পাইনিয়ার ফুটবল লিগে খেলেছে। ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে বরিশাল বিভাগের হয়ে ঢাকায় খেলেছে অল্প বয়সেই। একই বছর তৃতীয় বিভাগ লিগে বঙ্গবন্ধু স্টেয়িামে খেলেছে। ২০১৯ সালে শেখ জামালের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেছে। ম্যাচে ক্যাপ্টেন ছিল রাশেদ। বরিশালে ফিরে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব ১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে তার খেলা শুরু। বরিশাল সিটি করপোরেশনের হয়ে চ্যাম্পিয়ন দলের ট্রফি জিতেছে। বরিশাল সদর উপজেলা দলের ক্যাপ্টেন হয়েছে। জেতেন সেখানেও। জেলার পর বিভাগেও সেরা রাশেদের দল। বরিশাল বিভাগের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জাতীয়ভাবে সেরা দলের স্বীকৃতি এবং চ্যাম্পিয়ন ট্রফি পেয়েছে। সেরা ক্যাপ্টেন সে। ফাইনালে ২টি গোল করে দ্বিতীয় সেরা গোলদাতা! রাশেদ বরিশাল শহরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন বয়েজ স্কুলে পড়ে। ছোট থেকে ফুটবলে ঝুঁকে পড়েছে। পড়া বাদ দিয়ে খেলায় তার তুমুল আগ্রহ কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না বাবা মফিজুদ্দিন হাওলাদার। তবে ছেলের কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেছেন। খেলায় আগ্রহ দেখে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন। সবসময় ছেলেকে উৎসাহ দিচ্ছেন, পাশে থাকছেন মা নার্গিস বেগম। রাশেদ বলল, ‘সেরা খেলোয়াড়দের এই দলের ক্যাপ্টেন হতে পেরে আমি গর্বিত। দলের সবাই প্রতিটি ম্যাচে নৈপুণ্যে খেলেছে। প্রতিটি সদস্য এবং ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক চ্যাম্পিয়ন হতে আমাদের সাহায্য করেছে। এমন সুন্দর পরিবেশ থাকলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ভালো খেলে সম্মান অর্জন করতে পারব’। তার দল বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলে বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে থামেনি। সেরা গোলদাতার পুরস্কারও ঝুলিতে নিয়েছে। সেরা গোলতাদা হয়েছে বরিশাল বিভাগ দলের গোলাম রাব্বি। ঢাকার সাভারের বিকেএসপির ছাত্র, বরিশাল শহরের কাউনিয়ার বাসিন্দা রাব্বির শখ ছিল ফুটবলার হবে। তবে তার এনজিও কর্মকর্তা বাবা শহীদুল ইসলাম স্বপনের স্বপ্ন ছিল এই ছেলে ক্রিকেটার হবে। তাই নিজের বদলে বাবার ইচ্ছেয় ক্রিকেট খেলতে শুরু করল রাব্বি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাদের জেলার পাড়ায় ক্রিকেট খেলত। ২০১৪ সালেও বরিশাল স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলেছে। এখানেই ফুটবলার মোস্তাফিজুর রহমান রাব্বির ভেতরে ফুটবলের আগ্রহ তৈরি করে দিলেন। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর তার এই ইচ্ছা পূরণ শুরু হলো। ২০১৪ সালে বরিশালের উদ্বাস্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলে অংশ নিয়েছে সে। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছে, জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছে। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে রাব্বি। পরের বছর বিকেএসপির আয়োজনে আটটি বিভাগের অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল টুর্নামেন্টে বরিশালের হয়ে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। সে বছর বরিশাল বিভাগ রানার আপ হয়েছে। ২০১৮ সালে যুব গেমসে অংশ নিয়ে বরিশালের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলার গৌরব ছিল তার। এবারও রানার আপ বরিশাল। এই বছর বিকেএসপিতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল টুনৃামেন্টে তৃতীয় হয়েছে রাব্বির দল। খেলেছে ঢাকার শেখ জামাল, শেখ রাসেল, আবাহনীসহ জাতীয় ক্লাবগুলোর সঙ্গে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে সাউথ এশিয়ান ফুটবল গেমসে অংশগ্রহণ করেছে রাব্বি। ভারতে হওয়া খেলায় বাংলাদেশ ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তৃতীয় ছিল। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ ক্যাম্পে ডাক পেল সে। এরপর বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল দলে খেলার শুরু। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয়ভাবে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দল তারা। ফাইনালে তিনটি গোল দিয়ে সেরা গোলদাতার পুরস্কার গোলাম রাব্বির। বলল, ‘দলের ম্যানেজার, কোচ, ক্যাপ্টেন, খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো ছিল। তাই ধারাবাহিকভাবে সেরা খেলা খেলতে পেরেছি সবাই। ফল হয়েছে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।’ গত প্রায় এক বছর ধরে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য কাজ করেছেন তারা– বরিশাল জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। খেলোয়াড় বাছাইয়ে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের পরামর্শ ছিল। বরিশাল জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টের দলটি গড়ে তুলেছে। পাঁচ সদস্যের নির্বাচক কমিটিতে ছিলেন–জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা হুসাইন আহম্মেদ, বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল দলের ম্যানেজার ও বরিশাল জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম লিমন, সাবেক ফুটবলার ও বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল দলের কোচ মনিরুল ইসলাম, বরিশাল জেলার সাবেক ফুটবলার জোতিন দাস, মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী ও জেলা প্রশাসকের আর্থিক সহযোগিতা ছিল। বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড)’র সদস্য আলমগীর খান আলো ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আসাদুজ্জামান খসরু খেলোয়াড় ও কোচের সহযোগী হয়ে সবসময় পাশে ছিলেন। তাদের হাত ধরে সেরা খেলোয়াড়দের বাছাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল টুর্নামেন্টের ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে। পরে উপজেলায় বিজয়ী ও বিজিত, জেলায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ দলের সেরা খেলোয়াড়দের বাছাই করা হয়েছে। ক্যাম্পে রেখে এই সেরা খেলোয়াড়দের অনুশীলন করানো হয়েছে। সেখান থেকে মোট ৮০ জন কিশোর-তরুণ খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়েছে। তাদের থেকে সেরা ৬০ জনকে নিয়ে ১৫ দিনের ক্যাম্প হয়েছে। সেরা ২০ জনকে নিয়ে চূড়ান্ত বরিশাল বিভাগ দল হয়েছে। প্রথম ১৮জন খেলোয়াড় জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন। বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। তাদের ১৪ জনই ক্রীড়া নৈপুণ্যে দেশসেরা খেলোয়াড়ের সম্মান অর্জন করেছেন। এই পুরো কাজে বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান পূর্ণ সাহায্য করেছেন। এই চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ সাবেক ফুটবলার মনিরুল ইসলাম। নিবেদিতপ্রাণ ফুটবলার ছিলেন। ১৯৮০ সাল থেকে ফুটবলের সঙ্গে আছেন জড়িয়ে। ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ সালে এরশাদ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। ১৯৮৪ সালে জাতীয় ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে বিকেএসপির ছাত্র হয়েছেন। পরের বছর বিকেএসপির হয়ে অল ইণ্ডিয়া গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে ভারতের ইস্টবেঙ্গল ক্লাব মাঠ, মোহামডোন ক্লাব মাঠ, যাদবপুর স্টেডিয়াম ও দমদম স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৯০ সালে ঢাকার প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়ে নিয়মিত খেলেছেন। ১৯৯১ সালে ভারতে আসাম গোল্ডকাপে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নিয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাদের দল। ১৯৯৪ সালে হাঁটুর ইনজুরিতে তার খেলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে খোলোয়াড় গড়ার কাজে মন দিলেন। ২০১৯ সালে কোচ হিসেবে এএফসি (সি)’র লাইসেন্স পেয়েছেন। এই বিরাট টুর্নামেন্টের বিভাগ দল গড়তে তাকে বরিশাল জেলা ক্রীড়া সংস্থা দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি বরিশালে ফুটবল দল গঠনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়–প্রতিটি পর্বে খেলা দেখে দেখে সেরা খেলোয়াড়দের তুলে এনেছেন। এক করেছেন। তারপর কয়েক দফা ক্যাম্প করে অনুশীলন করিয়েছেন। ২০ জনের চূড়ান্ত দল করেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য। বললেন, ‘৫শ খেলোয়াড় থেকে ৮০ জনকে বাছাই করেছিলাম। তাদের নিয়ে ১৫ দিনের ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেরা ২০ জনকে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ দল গড়েছি। ১৮ জন ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের ১৪ জনের দল ফাইনাল খেলায় অংশ নেয়। সেরা খেলোয়াড়রা সেরা খেলাগুলো উপহার দেওয়ায় বরিশাল বিভাগ চ্যাম্পিয়ন। এই টিম গঠনে কোনো চাপ ছিল না আমার। সবাই সহযোগিতা করেছেন। আমার দলের বেশিরভাগই বিকেএসপির খেলোয়াড়। তারাই আসলে জাতীয়ভাবে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই দলটিকে একত্র করে মাঝেমাঝে অনুশীলন করানো দরকার। তাহলে ওরা আগামীতে আরও ভালো খেলা উপহার দিতে পারবে, বোঝাপড়া থাকবে।’ তাদের দলের ম্যানেজার ও বরিশাল জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম লিমন। বলেন, ‘আমাদের বরিশাল বিভাগ দল গঠনের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা ছিল না। বিভাগের সব জেলার সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়েই এই টিম গড়া হয়েছে। যারা বাছাই প্রক্রিয়ায় ছিলেন কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়ে কোনো খেলোয়াড় বাছাই করেননি। সেরা বাছাই করতে পেরেছি। সেরা খেলোয়াড়রা সেরা লড়েছে। তাই বরিশাল দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। জয়ী দলটি ধরে রাখতে এই চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের অনুশীলনে রাখা দরকার। তাহলে আগামীতে উজ্জ্বল আরও সম্ভাবনা তারা জাগাতে পারবে।’ বরিশাল জাতীয়ভাবে সেরা হওয়ার মূল কারণ? নির্বাচক, ম্যানেজার ও কোচ বললেন, কেবল বরিশাল জেলাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা। টিম করা, কোচের আন্তরিকতা ও সময় দিয়ে অনুশীলন, খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা, মাঠে সেরাটা দেওয়ার কারণেই চ্যাম্পিয়ন তারা। কোচ বললেন, খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা বজায় রেখে খেলা চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। বিপক্ষের খেলোয়াড়রা যাতে আমাদের ছক বুঝতে না পারে সেই দিকে তীক্ষ্ন নজর রেখেছি। মাঠের অবস্থা বুঝে ছক বদলেছি। কখনো চার+চার, কখনো চার+দুই+চার; চার+তিন+তিন ও তিন+পাঁচ+দুই ছকে খেলিয়েছি। আমার তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায়ও বিপক্ষ দল আক্রমণ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।’
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের জামালপুর ইউনিয়নের শ্রীকলা গ্রামে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল দেড় বছরের রুহান। গত মঙ্গলবার বাড়ির উঠানে খেলা করছিল শিশুটি। পরে বাড়িতে না দেখে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তাকে পাশের পুকুরে ভাসতে দেখেন স্বজনরা। পুকুর থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রুহানকে মৃত ঘোষণা করেন।
একইদিন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের আউশকান্দি ইউনিয়নের সদরাবাদ গ্রামে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো সদরাবা গ্রামের মালেক মিয়ার ছেলে ইকবাল হোসেন, বাবুল হোসেনের ছেলে রাফি আহমেদ। পরিবারের সদস্যদের অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যায় ইকবাল ও রাফি। খোঁজখুঁজির একপর্যায়ে পুকুরে তাদের লাশ দেখতে পান স্বজনরা।
দেশে কোনো না কোনো প্রান্তে প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা একশর বেশি। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬১।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো দুর্ঘটনার মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু তালিকার প্রথম দিকেই থাকবে। এটি একটি অবহেলাজনিত জাতীয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ হাজার ৪৩৮ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে মিঠাপানিতে, যেমন বাড়ির পাশের পুকুর-দীঘি-ডোবায়। খেলতে খেলতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার কখন ডুবে যাওয়া শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে একই সঙ্গে দুজন বা তারও বেশি মৃত্যুর ঘটনাও আছে। এ ছাড়া নদী বা খালে ডুবেও মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে কাজ করছে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা। সংগঠনটির হিসাবে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত পানিতে ডুবে ৩ হাজার ৮৪৬ জন মারা গেছে। এর ৮৮ শতাংশই ৫-৯ বছর বয়সী শিশু।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে মৃত্যু হয়েছিল ৮০৭ জনের। এর মধ্যে ৫ বছরের শিশু রয়েছে ২৬০টি। এর পরেই আছে ৫-৯ বছর বয়সী ২৮৭, ১০-১৪ বছর বয়সী ১০৬, ১৫-১৮ বছর বয়সী ৩০ জন। আর ১৮ বছরের বেশি বয়সী ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে মৃত্যু ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ওই বছর পানিতে ডুবে মারা গেছে ১ হাজার ৩৪৮ জন। এর মধ্যে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৯৭। তার পরেই আছে ৫-৯ বয়সী ৩৮৭, ১০-১৪ বছর বয়সী ১০৬ ও ১৫-১৮ বছর বয়সী ৪৩ জন। এ ছাড়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী তরুণ মারা গেছে ২১৫ জন।
২০২২ সালে মারা গেছে ১ হাজার ১৩০ জন। এ সময় অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ৫৬৬ জন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক। অন্যদিকে ৫-৯ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ৩৬৩ জন। এরপরই ১০-১৪ বছর বয়সী ৯৩, ১৫-১৮ বছর বয়সী ৩৮ ও ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৬৭ জন মারা গেছে।
২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে দেশে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৫৬১ জন। এর মধ্যে ২৯০ জনের বয়স ছিল ৫ বছরের মধ্যে। ৫-৯ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ১৯৪ জন। ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪৮। ১৫-১৮ বছর বয়সী রয়েছে ৯ জন। এ ছাড়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী মারা গেছে ১৩ জন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব বিভাগেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় কাছাকাছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপরের অবস্থান ঢাকা বিভাগের। এ বিভাগে রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি জেলায় গড়ে ৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
বছর জুড়ে পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সময় বর্ষার কারণে পুকুর, খাল-বিল ও নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। পানির উৎস বাড়ির যত কাছাকাছি থাকে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ততই বেড়ে যায়।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে ‘সমষ্টি’র পরিচালক মীর মাসরুর জামান রনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আমরা যে তথ্য পাই সেখান থেকে এ প্রতিবেদন তৈরি করা। বাস্তবে চিত্র আরও ভয়াবহ। মাত্র ২৫ শতাংশ মৃত্যুর সংবাদ আমরা পেয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ হচ্ছে পারিবারিক অসচেতনতা ও অবহেলা। শুধু বড় জলাশয় বা পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় বিষয়টা এমন নয়। অনেক সময় বালতির পানিতে ডুবেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে পরিবার বা বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণে। ছয় বছরের বেশি বয়সী একটি শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। অথচ এ বয়সের শিশুদের সাঁতার শেখানোর কথা। যদি তারা সাঁতার জানত তাহলে এ মৃত্যু অনেকাংশে কমে আসত।
বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুও বিবেচনা করলেও সরকারের বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত। গত বছর সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযতœ কেন্দ্রের মাধ্যমে ‘শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ নামে কর্মসূচি নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘ইনটেগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা দেশে ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার শিশুযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে। এসব যতœকেন্দ্রে কাজ পাবে ১৬ হাজার গ্রামীণ নারী। প্রতিটি যতœকেন্দ্রে ২৫ শিশুকে ভর্তি করা হবে। একই সঙ্গে ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে।
মীর মাসরুর জামান বলেন, ‘শিশুমৃত্যু ঠেকাতে হলে শহর থেকে গ্রামপর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেখানে প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা কমিউনিটির নেতাদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে।’
তিনি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমানোকে গুরুত্ব দিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমির অধীনে প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যদিও এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। প্রয়োজনে এ ধরনের প্রকল্পকে সরকারীকরণ করতে হবে।
শিশু-কিশোর সংগঠক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর বাইরেও খাল-বিল, জলা, ডোবা-পুকুর এখন যথেষ্ট রয়েছে। ফলে পানির সঙ্গে এ দেশের মানুষের মিলেমিশে বসবাস করতে হবে। এজন্য সাঁতার শেখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুলের কারিকুলামের মধ্যেই থাকবে সাঁতার শেখা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার একটা কথা বলি, আনন্দের মধ্যে এবং চারপাশের চেনা প্রতিবেশ ও পরিবেশের মধ্যে দিয়েই শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে।’
ডা. লেলিন বলেন, ‘একটি শিশু যখন স্কুলে গেল সেখানেই সাঁতার শেখানো সম্ভব। কারণ দেশের সব জায়াগায় সাঁতার শেখানোর যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব মহানগর বা শহরে সাঁতার শেখানোর জায়গার অপ্রতুলতা রয়েছে, সেসব জায়গায়ও বিশেষ ব্যবস্থায় সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে। প্রাথমিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে শিক্ষার শুরু থেকেই সাঁতার শেখানোটা বাধ্যতামূলক করলে এ সমস্যার বড় অংশ সমাধান করা যাবে। দ্বিতীয়ত অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। যেসব জায়গায় ছোট শিশু রয়েছে সেখানে জলাধারগুলোকে চারপাশে ঘেরাও দিতে হবে। যেন শিশু বাইরে থাকলেও সুরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া সরকারকে এ বিষয়ে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। যে প্রকল্পগুলো রয়েছে, সেগুলো যেন কার্যকর ভূমিকা রাখে সেটা নজরদারিতে রাখতে হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেবে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি। এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলোও এই কর্মসূচি পালন করবে। চলতি মাসে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির দুটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রের দাবি। যার প্রতিফলন দেখা গেছে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতেও।
সূত্রের দাবি, দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অন্তত তিন নেতা হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন নেতাকর্মীদের।
সূত্রগুলো বলছে, নভেম্বরের যেকোনো সময় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে ওই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। বিএনপি চাচ্ছে তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক ফয়সালা নিশ্চিত করতে। এ লক্ষ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার চিন্তা রয়েছে তাদের। এসব কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে কর্মসূচিসহ নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে দলটির অভ্যন্তরে আলোচনা রয়েছে।
জানা গেছে, এসব কর্মসূচিতে সরকার পক্ষ বাধা দিলে ‘যদি পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে’ তাহলে এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের দিকেও যেতে পারে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দুই ধাপে কর্মসূচি সাজিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ধাপের শেষ দিনের কর্মসূচি হবে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকার কঠোর হলে কর্মসূচিও কঠোর হবে। তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখতে চাইবে দলটি। পরিস্থিতি বিবেচনায় তফসিলের আগেই হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। তবে দলটির এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তফসিল ঘোষণা হলেই তারা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
এই কর্মসূচি ঘোষণার আগে আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। কীভাবে কর্মসূচি সফল করা যায় তা নিয়ে নতুন করে ছক সাজানো হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হরতালের মতো কর্মসূচির ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যতদিন আপনি (শেখ হাসিনা) থাকবেন দেশ আরও সংঘাতের দিকে যাবে, খারাপের দিকে যাবে এবং সংঘাত আরও বাড়তে থাকবে। এখনো তো সংঘাত শুরু হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে জনগণ রুখে দাঁড়াবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘শত প্ররোচনার মুখেও আমরা একেবারে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। এটার শেষ পরিণতি কী হবে তা নির্ভর করবে সরকারের আচরণ কী হচ্ছে তার ওপর।’
একই দিন পৃথক কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেন। ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে সিলেট অভিমুখী রোডমার্চ কর্মসূচির প্রথম পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা হরতাল করিনি, কিন্তু করব না সেই প্রতিজ্ঞাও করিনি। জনগণের চাপের কারণে হরতাল অবরোধ যা যা করা দরকার, গণতান্ত্রিক পন্থায় এই অবৈধ সরকারকে মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার জন্য দল, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সব ধরনের কর্মসূচি হবে। সেই জন্য আপনারা প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমাদের এবারের আন্দোলন ডু অর ডাই। হয় মরব, নয়তো লড়ব।’
আর জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সম্মেলনে প্রধান অতিথির বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জনগণকে সম্পৃক্ত করে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি। হরতাল অবরোধ শান্তির প্রবক্তারাই চালু করেছে। সরকার যদি আমাদের রোডমার্চ, মিছিলে জনগণের সম্পৃক্ততায় কোনো বার্তা না পায় বা না বোঝে তাহলে দিনের পর দিন হরতাল অবরোধ করে দেশ অচল করে দেওয়া হবে। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।’
জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। চলতি সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিন; অর্থাৎ আগামী ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সাধারণত নির্বাচনের ৪০ থেকে ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। মাঝখানে ৪৫ দিন সময় রেখে ভোটের তারিখ ছিল ২৩ ডিসেম্বর। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছিল। দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণা ও ভোট গ্রহণের মধ্যে সময় ছিল ৪০ দিন।০
আশ্বিন মাসের সন্ধ্যায় ঢাকায় নামল শ্রাবণের বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে পড়া বর্ষণে তলিয়ে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার মুষলধারে বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। মাঝরাত পর্যন্ত ওইসব সড়কে থমকে থাকে গাড়ি। অনেকেই যেমন বৃষ্টির কারণে কর্মস্থলেই আটকা পড়েন তেমনি অনেকের অপেক্ষার প্রহর কেটেছে জলমগ্ন সড়কে গাড়িতে বসেই।
এদিকে মিরপুরে সড়কের পাশে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তাদের মধ্যে এক শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ। গতকাল দিনভর মেঘলা আকাশ ও থেকে থেকে বৃষ্টির পর সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি বাড়তে শুরু করে। সঙ্গে থেমে থেমে শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, এদিন সন্ধ্যার পর ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে। আর ঢাকায় বৃষ্টি হতে পারে আজও।
গতকাল রাতের বৃষ্টিতে ঢাকার ফার্মগেট, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, মিরপুর, বনানী এলাকার সড়ক পানিতে ডুবে যায়। রাজধানীর প্রায় সব সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। দীর্ঘ সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যানবাহনকে। অনেকে জানান, তাদের ব্যক্তিগত গাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। রাতে কখন তারা বাসায় ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত।
জানা গেছে, মিরপুর ১০ নম্বরে প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে কোমরসমান পানি জমেছে। পানি প্রধান সড়কে চলাচলরত প্রাইভেট গাড়ির ভেতরেও ঢুকে গেছে।
গ্রিন রোড, নর্থ ধানমন্ডিসহ আশপাশের সব গলিতে পানি জমেছে। সেখানকার গ্রিন লাইফ হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং ল্যাবএইডে আসা রোগীরা পড়েছেন বিপদে। একই অবস্থা রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ, সিদ্ধেশ্বরী, বেইলি রোড এবং শান্তিনগরেও। মতিঝিলে রাতে লোক কম থাকলেও পানি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে।
হঠাৎ ভারী বৃষ্টির জন্য পথচারী ও ঘরমুখো মানুষরা মোটেও তৈরি ছিলেন না। এ সময় অনেকেই কাকভেজা হয়ে বাসায় ফেরেন আবার কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন যাত্রীছাউনি বা দোকানের নিচে। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাংলা মোটর মোড়ে বাসে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাহাদ হোসাইন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৃষ্টি শুরু হলে একটি উঁচু ভবনের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। বৃষ্টি কিছুটা কমলে বাসে উঠি। আধা ঘণ্টা হলো বাস একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
সরকার সৌরভ নামের একজন জানান, তার মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ আসতে ৩ ঘণ্টার বেশি লেগেছে। ফেরার পথে বাংলা মোটর মোড়েই আটকে আছেন এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে।
গতকাল রাত সাড়ে ১২টার সময়ও গুগল ম্যাপে দেখা যায় রাজধানী জুড়ে তীব্র যানজটের সংকেত। বেশিরভাগ সড়ক রেড মার্ক ছিল সে সময়। গ্রিন রোড, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ২৭, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ বেশ কয়েকটি সড়কেই ছিল যান চলাচল বন্ধের সংকেত। গুগলের তথ্য বলছিল, ওইসব এলাকায় সে সময় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
আহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শুক্রবারও রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় বজ্রপাতও হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
মিরপুরে চারজনের মৃত্যু : মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তাদের মধ্যে এক শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে আহতদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এ দুর্ঘটনার বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেন মিরপুর থানার এসআই রুহুল আমিন। তিনি বলেন, বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা, তাদের মেয়ে লিমা এবং এই তিনজনকে বাঁচাতে যাওয়া যুবক অনিক। মৃত মিজান পেশায় সিএনজি অটোরিকশাচালক ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিষেকে ২৬ মিনিট খেলে দুই অ্যাসিস্টের অবদান রাখতে পেরেছিলেন নেইমার। আল হিলাল জিতেছিল। কিন্তু পর পর দুম্যাচ খেললেন পুরো সময়। তেমন কিছুই করতে পারলেন না। ড্র করেছে আল হিলাল আবার।
এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচে শেষ দিকের গোলে ১-১ ড্র করে পরাজয় বাঁচিয়েছিল আল হিলাল। আজ সৌদি প্রো লিগে দামাক এফসির বিপক্ষে ম্যালকমের গোলে ৯ মিনিটে এগিয়ে গেলেও শেষপর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি।
সাত ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে তবুও শীর্ষেই রইলো আল হিলাল।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যাত্রীর কাছ থেকে মূল্য দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৭০০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টা ২৪ মিনিটে শারজাহ থেকে এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে আসা মোহাম্মদ আলী নামের এক যাত্রীর রাইস কুকারে এসব স্বর্ণ পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মো. আহসান উল্লাহ বলেন, আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।