
নারীবাদকে বিষয় করে নারী অধিকারকর্মীদের একটি গান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেন এমন বিশিষ্ট ৪ নারীকে গানটি গাইতে দেখা দেখা যায়।
শুক্রবার ২ মিনিট সতেরো সেকেন্ডের গানটির একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
গানটি প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’ গানের সুরে গাওয়া।
জানা গেছে, গানটি এর আগে গেয়েছিলেন নারীবাদের আইকন উপমহাদেশের প্রখ্যাত নারী অধিকারকর্মী কমলা বাসিন। তিনিই গানটি বাংলাতেই লিখেছিলেন।
আরো জানা গেছে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া গানটিতে গলা মিলিয়েছেন নারীনেত্রী খুশি কবীর, ফৌজিয়া খন্দকার ইভা, নাহিদ সুলতানা এবং সোহানা আহমেদ। হারমোনিয়ামে ছিলেন সোহানা আহমেদ।
গানটির কয়েকটি পঙ্ক্তি- ‘আমরা নারীবাদী নারীবাদী কারণ আমরা সুখী হতে চাই/ কারণ আমাদের কোনো উপায় নাই/পুরুষতন্ত্র চাই না/শ্রেণিতন্ত্র চাই না/হিংসা নিন্দা ছেড়ে আমরা ভালোবাসা চাই।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ডুডলে ভিন্নতা এনেছে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল। সাধারণত বিশেষ দিবসকে সামনে রেখে ডুডলে পরিবর্তন আনে গুগল। এবারও তাই হলো। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ডুডলকে রাঙানো হলো বেগুনি রঙে।
বুধবার (০৮ মার্চ) দেখা গেল, এবার প্রতিটি অক্ষরের ভিগনেটগুলো নারীদের বিচরণের কয়েকটি ক্ষেত্রকে হাইলাইট করেছে, যেখানে সারা বিশ্বের নারীরা একে অপরকে সমৃদ্ধ করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে সমর্থন জোগায়। ফলে গুগলের ছয়টি অক্ষরে দেখা মিলছে নারীর ছয় রকম অবস্থানের প্রতিচ্ছবি।
‘জি’ অক্ষরটিতে স্থান পেয়েছে সমাজের প্রগতিশীল নারীর চিত্র। তারা অধিকার নিয়ে কথা বলে এবং তাদের কথা সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলে। দুটি ‘ও’-এর একটিতে নারীর সাধারণ জীবনের চিত্র এবং অপরটিতে বিভিন্ন বয়সী আধুনিক নারীর চিত্র দেখা যায়।
দ্বিতীয় ‘জি’তে উঠে এসেছে নারীর মাতৃত্বের চিরচেনা রূপ। ‘এল’ অক্ষরে আছে প্রতিবাদী নারীদের মুখ। সর্বশেষ ‘ই’ অক্ষরটিতে সেবাদানকারী নারীর প্রতিচ্ছবি। চমৎকার ডুডলটি নকশা করেছেন অ্যালিসা উইনান্স।
যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে মাধ্যমেই নারীরা দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নারী অধিকার বাস্তবায়ন অনেকটাই কঠিন। তবে নির্যাতন, বৈষম্যসহ হাজারও প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে নারীরা দখল করে নিচ্ছে তাদের যথোপযুক্ত স্থান।
নারীরা এখন শুধু ঘরোয়া কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, গণমাধ্যমকর্মী, উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থানে রয়েছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তারা অবদান রাখছে অর্থনীতি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সর্বোপরি উন্নয়নে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী অধিকার বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর দিবসটি উদযাপন করা হয়। এ উপলক্ষে নারী শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়া ও ভাবনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
‘নারী তুমি মেলো তোমার ডানা নির্ভয়ে’
হাফসা আলম
আমাদের সমাজে ‘লক্ষ্ণী মেয়ে’ বলতে আমরা ধরে নিই শান্ত প্রকৃতির সেই সুবোধ মেয়েটাকে যে সমাজ ও পরিবারের কথা ভেবে হয়তো বলি দেয় তার অতি সাধের কোনো শখ অথবা স্বপ্ন। এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন সারা বিশ্ব নারীর অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, আমাদের অধিকাংশ মেয়ে এখনো পড়ে আছে তথাকথিত ‘লক্ষ্ণী মেয়ে’ হয়ে ওঠার চক্রে।
এই চক্র থেকে বের হওয়ার প্রথম উপায় অবশ্যই শিক্ষা। কিন্তু শুধু শিক্ষায় আলোকিত হলে চলবে না, জানতে হবে শিক্ষার প্রয়োগ, সচেতন হতে হবে নিজের অধিকার সম্পর্কে এবং আওয়াজ তুলতে হবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সাথে পরিবার ও সমাজের সমর্থন থাকলে, আমাদের মেয়েরাও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে বহুদূর।শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
‘বৈষম্য নয়, সাম্যই হোক মুক্তি’
রেহেনুমা নুরাইয়া তান্নি
নারী কখনো মা, কখনো মেয়ে, কখনো স্ত্রী, কখনো বোন। ইতিহাস জানে নারীর সাহসিকতায় রুখে গিয়েছিল পরাধীনতা। নারীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি সার্বভৌম দেশ। গর্ব নিয়ে বাচাঁর অধিকার। নারীরা কখনো বাধা নয়। বরং তারাই তৈরি করেছে পথ। মাতৃত্বের মমতায়, প্রিয়তমার ভালোবাসায়, বোনের স্নেহে বারবার আগলে রেখে।
প্রতিটি জাতি ও সম্প্রদায় জানে নারী মানেই শক্তি। কাজেই তাদের রক্তে মাংসে গড়া অমূল্য সৃষ্টি ভেবে ভালোবাসায়, স্নেহে, মমতায় আগলে রাখতে হবে। বৈষম্য রোধ করে হাঁটতে দিতে হবে সমতার গণপথে। এতেই জাতি শ্রেষ্ঠ হবে। নারীর জন্য চাই সহমর্মিতা, সহানুভূতি। কবি নজরুলের ভাষায় ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি
‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে চাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’
আলিফেন্নেছা আলিফ
বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশকে এগিয়ে যেতে হলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে শুধু সমান অধিকার লাভকেই বোঝায় না, দেশের সকল অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাজে অংশগ্রহণও এর উল্লেখযোগ্য অংশ।
নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে সঠিক নির্দেশনা, তথ্য ও জ্ঞানের সমাবেশে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে নারীরা। একমাত্র সচেতনতাই নারীদের মনে কর্মস্পৃহা তৈরি করেছে। সমাজের নানা কুসংস্কার, হুমকি উপেক্ষা করে নিজেদের অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে পথে দাঁড়িয়েছে নারীরা। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের চাহিদা পরিলক্ষিত।
আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা কাজ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। আত্মবিশ্বাস, নিজস্ব দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সামাজিক রীতিনীতি ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারে। আইসিটি প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি নারীদের এ খাতে অংশ নেওয়া ছাড়াও উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
‘শুধু মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে সম্মান জানানোই যথেষ্ট নয়’
মেহেরুন্নেসা ইসলাম মৌ
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে নারীদের সমতার লড়াই করা কিছুটা দুর্বোধ্যই বলা চলে। চারপাশে তাকালে দেখা যাবে, সবক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। তবে একটু হিসাব কষলেই বোঝা যাবে, এই জায়গায় পৌঁছাতে কতটুকু অন্যায়ের শিকার হয়েছে এই নারীরা। সমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে ফেমিনিজমের সূত্রপাত হয় উনিশ শতাব্দীর শেষের দিকে।
ফেমিনিজম যেমন পরিচিত একটি শব্দ, তেমনি খুব তর্কসাধ্যও বটে। আধুনিক নারীবাদী তত্ত্বের কিছু ঘোলাটে দিককে প্রাধান্য দিতে যেয়ে আমরা হয়তো নারীবিদ্বেষী সমস্যাগুলোয় আলোকপাত করতে ভুলে যাচ্ছি। নারীরা শত বাধা-বিপত্তি ছাড়িয়ে জয় করে নিচ্ছে সফলতার চূর্ণ শিখর। তবে, এই সফলতার পথটা এতটা ঝঞ্ঝার না হলেও পারত।
‘ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’ কে ‘নারীর নিরাপত্তা’র নাম দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যেন খুব সাধারণ একটি বিষয়। আদৌ নিরাপত্তা নিশ্চিতে কতটুকু জোর দেওয়া হচ্ছে, তার প্রতিফলন আশপাশে তাকালেই দেখা যাবে। চারদিকে এত উন্নয়নের মাঝে কোথাও না কোথাও নারীরা এখনো নিষ্পেষিত। সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে মোকাবিলা করতে হয় নারীবিদ্বেষী নিয়ম-কানুনের। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র ও সম্মানের সাথে বাঁচা ব্যক্তি স্বাধীনতার অংশ হলেও নারীদের জন্য যেন অন্য এক একটি যুদ্ধের নাম। এর ফলে ঝরে যায় অনেক মেধাবী প্রাণ আর সৃষ্টিশীল চেতনা, থেমে যায় সার্বিক উন্নয়নের ধারা।
এসব সমস্যা শুরু হয় দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও কিছু গোড়া চিন্তার প্রতিফলন থেকে। স্বাধীনতা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে, কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন মানসিকতা পরিবর্তন করা। নারীকে লিঙ্গভেদে নয়, বরং মানুষ হিসেবে সম্মান ও অধিকারের সাথে বাঁচতে দেওয়াই হোক নারীবাদীতত্ত্বের উদ্দেশ্য।
ফলে নারী দিবসকে সামনে রেখে শুধু মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে সম্মান জানানোই যথেষ্ট নয়। এখন সময়, বৈষম্য ছাড়িয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশিষে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করা।
শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
‘নারী-পুরুষের পারষ্পরিক সহযোগিতায় সম্ভব সামগ্রিক উন্নয়ন’
ফারহানা নৌশিন তিতিলী
নারী তার মেধা, মনন, সততা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে অতীতের সকল কালিমাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের অগ্রগতি এবং উন্নয়নে সমান ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে নারীরাও তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে ঘরে বা বাইরে কোনো জায়গাতেই উন্নয়নের কথা চিন্তা করা আর মূর্খের স্বর্গে বসবাস করা একই বিষয়। ঠিক তেমনি বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ পুরুষের সহযোগিতাও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারী, পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষার্থী, আরবী ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
‘চাকরি করতে না পারায় মায়ের আফসোস দেখেছি’
তাসমিয়া বিনতে জহির
আমার মা সারা জীবন আফসোস করেছেন চাকরি না করতে পারা নিয়ে। ছোট থেকে তিনি শিখিয়েছেন পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে নিজের একটা আলাদা পরিচয় থাকতেই হবে। এ কারণে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই আমার অন্তরাত্মায় মিশে গেছে। এমন পরিবেশে বড় হওয়ায় যখন দেখি বাল্যবিয়ের মামলার ভয়ে কোনোমতে ১৮ বছর পার করা মেয়েগুলো হুট করে বিবাহিতা হয় এবং তার ক’দিন পরেই শিশুর জন্ম দেয়, আমি কষ্ট পাই।
চিন্তা করি আমার মায়ের মতোন একজন নারীর অভাবে কতজন নিজের অস্তিত্বের স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। কত নারী নিজের প্রথম বেতনের টাকায় পরিবারকে উপহার দেওয়ার মতো সুন্দর অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হলো বা পরিবারকে নিজের যোগ্যতায় গর্বিত করা থেকে। গুটিকতক সুখী এবং সৌভাগ্যবতীদের কথা আমি বলছি না, বলছি বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্রের কথা। আমি নারী দিবসে আমার মায়ের মতোন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নারীদের অন্তর থেকে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাই।শিক্ষার্থী, সিডিএ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম
চা বাগানের সবুজ বুকে নারীদের পাতা তোলার ছবি যতটা মুগ্ধ করে, এই নারীদের জীবনের গল্প ততটা আনন্দদায়ক নয়। রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে চা বাগানের টিলায় টিলায় পাতা তুলেই নিঃশেষ হয়ে যায় নারী চা শ্রমিকের জীবন।দেশে চা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের অর্ধেকের বেশি নারী। পাতা বা কুঁড়ি তোলার প্রধান কাজটিই করেন নারী চা শ্রমিকেরা।প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারী শ্রমিকেরা এই কাজ করে গেলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তার অনেক কিছুই এখনো নাগালে আসেনি। এই নারীরা অর্থ উপার্জন করলেও এখনো পরিবারে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগানের নারী শ্রমিকেরা জানান, সাত সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সংসারের কাজ করতে হয়। বাগান দূরে হলে আগেভাগে রওনা দিতে হয়। সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার পর্যন্ত সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কেউ সকাল খেয়ে বের হন, কারও সময় না থাকলে বাটিতে খাবার নিয়েই ছুটতে হয়। দুপুরে খাবার বলতে চাল ভাজা, চায়ের কুঁড়ি পাতা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ইত্যাদি দিয়ে বানানো ‘পাতিচখা’ বা ‘পাতি চাতনি’। লাইনে (শ্রমিকদের বসতি) ফিরতে ফিরতে কারও সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা বেজে যায়। ঘরে ফিরে আবার সংসারের কাজ করতে হয় তাদের।
ক্ষোভ প্রকাশ করে কমলগঞ্জের আলীনগর ও মাধবপুর চা বাগানের নারী শ্রমিকরা জানান, ১৭০ টাকা মজুরি পেতে বাগানভেদে ২৫-৩০ কেজি চা পাতা তুলতে হয়। বাড়তি চা পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশির ভাগ নারী শ্রমিক। কাজের স্থানে নারীদের কোনো শৌচাগার না থাকায় বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে তারা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা রামভজন কৈরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, চা বাগানে অর্ধেক নারী শ্রমিক হলেও নারী হিসেবে কর্মস্থলে যে সুযোগ-সুবিধা থাকার দরকার, তা তারা পাচ্ছেন না। কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার নেই, কিন্তু চুক্তিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চা বাগানে নারীরা উপার্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। কিছু কিছু অগ্রগতি হলেও পরিবারে পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। নারীর চিন্তাভাবনা কাজে লাগছে না। নারী চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার নেই। ফলে কর্মজীবী মায়েরা তাদের সন্তানদের কোথায় রেখে কাজ করবেন তা নিয়ে যেমন চিন্তায় থাকে, একইভাবে আদর-যত্ন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। প্রতিটি চা বাগানে নারী শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ, ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপের জন্য একজন নারী কর্মকর্তা থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সামাজিক ও ট্রেড ইউনিয়নের সকল কর্মকাণ্ডেও নারী চা শ্রমিকদের কার্যকর অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।
ইসলামের সোনালি যুগ থেকেই নারীরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের অংশীদার হয়েছেন। বিচিত্র পেশায় অংশ নিয়ে সমাজে অবদান রেখেছেন। রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে নারীরা জ্ঞানচর্চা, সমাজসেবা ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা লাভ করেছেন এবং পুরুষদের মতোই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, পর্দা-শালীনতা ও ইসলামের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি তারা অবশ্যই মান্য করেছেন।
জ্ঞানচর্চা : মহানবী (সা.) বিভিন্নভাবে নারীদের জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সুযোগ দিয়েছেন। মদিনার নারীরা একবার রাসুলের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাই আপনি আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করেন; সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং দিকনির্দেশনা দিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০১)
রাসুলের যুগে অনেক প্রাজ্ঞ নারী সাহাবি ছিলেন। নবীপত্নী আয়েশা (রা.)-এর জ্ঞানের কাছে তো অনেক অভিজ্ঞ সাহাবিও হার মেনেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অসামান্য অবদান নিয়ে ৪৩ খন্ডের বিশাল এক বিশ্বকোষ রচনা করেছেন ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি। এ গ্রন্থে তিনি ১০ হাজারের বেশি নারী হাদিসবিশারদ ও শিক্ষাবিদের জীবন-কর্ম-অবদান তুলে ধরেন।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব : ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে না থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং রাজনৈতিক সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আয়েশা (রা.) মুয়াবিয়া ও আলী (রা.)-এর মধ্যকার সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন। তেমনি সাওদা বিনতে আম্মারা বিন আশতার হামদানি তার গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে যান এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। মুয়াবিয়া (রা.) তাদের দাবি মেনে নেন এবং ইবনে আরতাকে বরখাস্ত করেন। (আকদুল ফারিদ, পৃষ্ঠা : ৩৪৪-৪৬)
সমাজসেবা : সোনালি যুগে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবায়ও অংশ নেন। তারা অসংখ্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা দীর্ঘ খাল খনন করে হাজিদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। সেলজুক শাসক সুলতান মালিক শাহর স্ত্রী তুরকান বিনতে তুরাজ বাগদাদে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন। (তারিখু দাওলাতুল আব্বাসিয়া, পৃষ্ঠা ৯৭)
এ ছাড়া একাদশ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে মুসলিম নারীরা দামেস্কে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারীদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।
ব্যবসা-বাণিজ্য : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যও করতেন। নারী সাহাবি কায়লা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো এক ওমরাহ আদায়কালে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে আমি তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একজন নারী। আমি বেচাকেনা করি। আমি কোনো জিনিস কিনতে চাইলে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে কম দাম বলি। এরপর দাম বাড়িয়ে বলতে বলতে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যে গিয়ে পৌঁছাই। আবার আমি কোনো জিনিস বিক্রি করতে চাইলে কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য চাই। এরপর দাম কমাতে কমাতে অবশেষে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যে নেমে আসি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে কায়লা, এমন করো না। তুমি কিছু কিনতে চাইলে তোমার কাক্সিক্ষত মূল্যই বলো, হয় তোমাকে দেওয়া হবে, নয় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, তুমি কোনো কিছু বিক্রয় করতে চাইলে তোমার কাক্সিক্ষত দামই চাও, হয় তুমি দেবে অথবা দেবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২০৪)
চিকিৎসা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা চিকিৎসক হিসেবেও দক্ষতা অর্জন করেন। যারা শৈল্যবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) নিজেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। উরওয়া (রহ.) বলেন, ‘আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়েশা (রা.) অপেক্ষা দক্ষ মানুষ দেখিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, খালা, আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন? তিনি বলেন, আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/১৮২)
সাহাবাযুগে নারী সাহাবি উম্মে সুলাইমের নেতৃত্বে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। (আবুদাউদ, হাদিস : ১৫৭৫)
মিসরে মুসলিম শাসক কর্তৃক প্রথম আবাসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে নারীরাও চিকিৎসক ও শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। তাদের কেউ কেউ ‘মাশিখাতুত তিব’ তথা ‘মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান’ পদেও অধিষ্ঠিত হন। (আহমদ ইসা বেগ, তারিখুল বিমারিস্তান ফিল-ইসলাম)
কৃষিকাজ : মহানবী (সা.)-এর যুগে নারীরা কৃষিকাজেও অংশগ্রহণ করতেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘যখন জোবায়ের আমাকে বিয়ে করেন, তখন তার কোনো ধন-সম্পদ ছিল না। এমনকি কোনো স্থাবর জমিজমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধু কুয়া থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তার উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম, কিন্তু ভালো রুটি তৈরি করতে পারতাম না।... রাসুল (সা.) জোবায়েরকে একখণ্ড জমি দিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আঁটির বোঝা বহন করে আনতাম। ওই জমির দূরত্ব ছিল প্রায় দুই মাইল।...’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২২৪)
হস্তশিল্প : মহানবী (সা.)-এর যুগে নারীরা হস্তশিল্পের কাজ করেও অর্থ উপার্জন করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে-ই আমার সাক্ষাৎ পাবে যার হাত সর্বাধিক লম্বা’। সুতরাং তারা নিজ নিজ হাত মেপে দেখতে লাগলেন কার হাত বেশি লম্বা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অবশেষে আমাদের মধ্যে জয়নবের হাতই সবচেয়ে লম্বা স্থির হলো। কেননা তিনি হাতের কাজ করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬০৯৪)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী রায়িতা (রা.) হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করে দিতেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬০৩০)
অন্যান্য পেশা : স্পেনের অধিবাসী আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম ছিলেন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার। লুবনি ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে পারদর্শী। রাবিয়া কাসিসাহ প্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ ছিলেন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। ওমর (রা.) তাকে আদালতের ‘কাজাউল হাসাবাহ’ তথা ‘অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি কোর্ট এবং ও ‘কাজাউস সুক’ তথা ‘মার্কেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর দায়িত্বে নিয়োগ দেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৫/৭৮)
সমাজে নারীর অসামান্য ভূমিকার প্রশংসা করে তেরো শতকের প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার আল্লামা ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘সমাজের অর্ধেকই নারী। বাকি অর্ধেকেরও জন্ম দেন নারী। তাই নারীরাই যেন পুরো সমাজ।’
চাকরি খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এখনো কঠিন সময় অতিক্রম করছে বলে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৫ শতাংশ নারী চাইলেও চাকরি পাচ্ছেন না, সেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ১০.৫ শতাংশ। দুই দশক ধরেই এই লিঙ্গ ব্যবধান অব্যাহত রয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, নারী-পুরুষের আয় বৈষম্যও এখনো ব্যাপক। বিশ্বজুড়ে গড়ে একজন পুরুষ শ্রম দিয়ে এক ডলার আয় করলে তার বিপরীতে নারীর আয় ৫১ সেন্ট। অর্থাৎ বৈশ্বিক হিসাবে নারীর শ্রম আয় এখনো পুরুষের অর্ধেক। এই ব্যবধান নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে আরো বেশি। সেখানে পুরুষের প্রতি ডলার আয়ের বিপরীতে নারীর গড় আয় ৩৩ সেন্ট, তবে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে নারীর আয় ৫৮ সেন্ট। সূত্র : এএফপি, আইএলও, বিশ্বব্যাংক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।