
বাঁ পায়ের খুদে জাদুকর জাদুর বাক্স খুললেন, পুরো ৯০ মিনিটে সেই জাদুতে সম্মোহিত করে রাখলেন লুসাইল স্টেডিয়ামের বিশাল গ্যালারিকে। পেনাল্টি থেকে গোল করে বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইনদের এগিয়ে নেওয়ার পর জুলিয়ান আলভারেজকে দিয়ে করালেন জোড়া গোল। তাতেই ভেঙে গেল ক্রোয়েশিয়ার সব প্রতিরোধ। ৩৬ বছরের স্বপ্নপূরণের পথে দেশকে আরেকটি অসাধারণ জয় উপহার দিলেন লিওনেল মেসি। ৩-০ গোলের জয়ে আর্জেন্টিনা আট বছর পর ফের ফাইনালের মঞ্চে। লাউতারো মার্তিনেজের অফ-ফর্ম এই বিশ্বকাপে একাদশে সুযোগ করে দেয় ২২ বছরের ম্যানসিটি স্ট্রাইকার আলভারেজকে। সে সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে এর মধ্যেই বিশ্বকাপে চতুর্থ গোলের দেখা পেয়েছেন এ তরুণ। ৩৫-এর মেসির সঙ্গে ১৩ বছরের ছোট আলভারেজের রসায়নটা জমে ক্ষীর। তাই তো তিনি মেসির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গোলের কাজটা করছেন ঠিকঠাক। আবার নায়ককে উপহার দিচ্ছেন পেনাল্টি।
দুটি বাধ্যতামূলক পরিবর্তন করে একাদশ সাজান আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি। কার্ডে কাটা পড়া আকুনার জায়গায় লেফট ব্যাকে খেলান তাগলিয়াফিকোকে। আর ক্রোয়াটদের সঙ্গে মাঝমাঠে সেয়ানে সেয়ানে লড়তে অভিজ্ঞ পারেদেসকে খেলান লিসান্দ্রো মার্তিনেজের জায়গায়। তাতে কাজ হয়েছে, মাঝমাঠে লুকা মদ্রিচের নেতৃত্বে ক্রোয়াটরা সেভাবে আধিপত্য ফলাতে পারেনি। যা মেসি, আলভারেজকে দিয়েছে আক্রমণে ওঠার অবারিত সুযোগ। ৩৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে মেসির সফল লক্ষ্যভেদের কৃতিত্ব পাবেন আলভারেজ। মাঝমাঠ থেকে সতীর্থের বল পেয়ে আলভারেজ দ্রুত বক্সে ঢুকে টোকা দেওয়ার আগেই আগুয়ান ক্রোয়াট কিপার লিভাকোভিচ গুঁতো দিয়ে ফেলে দেন। সেই পেনাল্টির সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেসি এ বিশ্বকাপে করেন পঞ্চম গোল। গোলের হিসাবে ছুঁয়ে ফেলেন ফরাসি তারকা এমবাপ্পেকে। সব মিলিয়ে ১১ গোল করে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে যান। ছয় মিনিট পর প্রতিআক্রমণ থেকে ব্যবধান বাড়ান আলভারেজ। নিজেদের অর্ধ থেকে বল বাড়িয়েছিলেন মেসি। ক্রোয়েশিয়ার অর্ধের প্রায় পুরোটা দৌড়ে তিনজনকে কাটিয়ে ডান পায়ের ভলিতে বিশ্বকাপে তৃতীয় গোলের দেখা পান তিনি।
বিরতি থেকে ফিরেও একই কৌশলে খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। ৬৯ মিনিটে আবারও জাদুর বাক্স খোলেন জাদুকর। ধীরলয়ের মেসি বল পেয়েই সেই ট্রেডমার্ক ছুট। বাঁদিক থেকে সারাক্ষণ গায়ে গায়ে লেগে থেকেও মেসিকে রুখতে পারেননি জসকো ভারদিওল। অসাধারণ ড্রিবলিংয়ের আরও এগিয়ে ছোট্ট পাস থালায় সাজিয়ে দেন আলভারেজকে। নাম্বার নাইন তাতে আলতো টোকায় ৩-০ করেন। তাতেই লুসাইলের আরব্য রজনী নায়ক হয়ে যান মেসি।
উত্তর আফ্রিকার আটলান্টিক তীরবর্তী দেশ মরক্কো। এক পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এটলাস পর্বতমালা। সেখানেই বাস দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিমান সিংহের। মরোক্কানদের কাছে পর্বতের পাদদেশে বাস করা ভয়ংকর প্রাণীটি গর্বের প্রতীক। এই বিশ্বকাপে তাদের ফুটবলার একেকজন যেন একেকটা এটলাস লায়ন্স। একেবারে হিসাবের বাইরে থেকে তারা জন্ম দিয়ে চলছে একের পর এক বিস্ময়। হিংস্র সিংহের থাবায় একে একে রক্তাক্ত করেছে ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের। এবার পালা ফ্রান্সের। সেমিফাইনালে আজ তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারলেই নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হবে গোটা বিশ্ব। তবে এটলাস লায়ন্সদেরও ভয় আছে। ফরাসি ভা-ারে আছে ভয়ংকর এক ক্ষেপণাস্ত্র। নাম তার কিলিয়েন এমবাপ্পে। যিনি শুরু থেকেই বিস্ফোরিত হচ্ছেন। ৬০ বছর আগে ব্রাজিলের গড়া টানা দুই শিরোপা জয়ের স্বপ্ন বুকে লালন করে ২৩ বছরের ফরাসি রাজা ছুটছেন দুর্বার গতিতে। এর মধ্যেই করে ফেলেছেন পাঁচ গোল। ফ্রান্সের শেষ ১৫ ম্যাচে তার ১৬ গোল। খুনে এই ফরোয়ার্ডের নান্দনিক পায়ে এটলাস লায়ন্সদের বসাতে হবে মরণ কামড়। তাতে অবশ্য দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ারও আছে ঝুঁকি। এই এমবাপ্পেকে বেঁধে রাখতে পারেনি বিশ্বের অনেক বড় বড় দলের শক্তিশালী রক্ষণভাগ। প্রতিপক্ষরাই স্বীকার করে নিয়েছেন এমবাপ্পে মানুষ নন, এলিয়েন।
এই এলিয়েন ২৩ বছর বয়সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্বসেরা হওয়ার। চার বছর আগে রাশিয়ায় করেছিলেন ৪ গোল। যার তিনটিই নকআউটপর্বে। এবার ৫ গোল করে গোল্ডেন বুটের রেসে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। গ্রুপপর্বে ডেনমার্কের বিপক্ষে জোড়া গোলে দলকে জেতানোর পর ও দ্বিতীয়পর্বে পোল্যান্ডের বিপক্ষেও তার জোড়ায় কোয়ার্টারে আসে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। ৯ গোলে তিনি ছাড়িয়েছেন ম্যারাডোনাকে। আজ হেরে গেলেও তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকবে। তার মানে আরও দুই ম্যাচে এমবাপ্পের সামনে সুযোগ নিজের গোল সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার।
ডান দিক চেপে খেলেন বলেই এমবাপ্পেকে থামানোর মূল দায়িত্বটা থাকবে ইয়াহিয়া আতিয়াত ও রোমান সাইসের। তবে একের পর এক ম্যাচে ভয়ংকর গতি, নিখুঁত ড্রিবলিং-এ যেভাবে বল্গাহীন হয়ে উঠেছেন পিএসজি তারকা, তাতে মরোক্কানদের এতদিনের সব প্রতিরোধ তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আচ্ছা ধরে নিন, গেল পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক গোল হজম করা মরক্কোর রক্ষণ রুখে দিল এমবাপ্পেকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড যেমন তাকে গোল করতে দেয়নি। তাতে কি খুব ক্ষতি হয়েছে ফ্রান্সের? সে দলে যে গোল করার মানুষের আকাল পড়েনি। অলিভিয়ে জেরুদ ছুটছেন ঠিক তার পেছন পেছন। এই অভিজ্ঞ স্ট্রাইকারের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে চার গোল। আচ্ছা না হয় জিরুদও পারলেন না। আন্তোইন গ্রিজমান, অরলিয়েন শুয়ামেনি, আদ্রিয়ের রবিয়ট, উসমান দেম্বেলেদের আটকাবেন কী করে? এমবাপ্পে-জিরুদ ঝড় আটকাতে ব্যস্ত থাকা মরক্কোর রক্ষণভাগ কতদিক সামলাবে?
তাই বলে তো আর আশা ছেড়ে দিলে চলবে না। পুরো আসর জুড়েই আশার পালে চড়েই তো বড় বড় সব তারকাখচিত দলকে ঘায়েল করে আজ সেমিফাইনালের মঞ্চে মরক্কো। সেটাও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রথম কোনো দল হিসেবে। সুতরাং এই মরক্কোতে বাজি ধরতেই পারেন। দলটির ৪৭ বছর বয়সী কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই তার দলটাকে মাত্র আড়াই মাসে অজেয় রূপ দিয়েছেন। অদম্য মনোবলের জোরে তারা বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে বারবার। এ দলের ফুটবলারদের একটা বড় অংশের জন্ম ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সে সব দেশের ফুটবল আস্বাদনে তাদের বড়ে ওঠা এবং ফুটবলার হয়ে ওঠা। আর সব শক্তিকে একীভূত করে একতাবদ্ধ হয়ে খেলার মন্ত্রটা তাদের হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছে ফ্রান্সেই জন্ম নেওয়া কোচ রেগরাগুই। স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে ইয়াসিন বোনোর বীরত্বে জিতেছিল মরক্কো। দলটির নিরেট রক্ষণের নেতৃত্ব দেন পিএসজি তারকা এবং এমবাপ্পের বন্ধু আশরাফ হাকিমি। এই রাইটব্যাকের ঠিক ওপরে আক্রমণে দায়িত্বে থাকেন চেলসি ফরোয়ার্ড হাকিম জিয়েচ। নাম্বার নাইন পজিশনে ইউসেফ এন-নাসেরির গোলে পর্তুগাল কোয়ার্টার ফাইনালে কাঁদায় দলটি। এছাড়া মাঝমাঠের দখলের মূল দায়িত্বে সুফিয়ান আমরাবাত। আজও ওয়ালিদকে ভয়ংকর হয়ে ওঠা ফরাসি আক্রমণভাগকে রুখতে নিতে হবে আক্রমণাত্মক কৌশল। যে....... কাজে লাগিয়েই এতদূর আসা তাদের। তারপরও এমবাপ্পে নেতৃত্বাধীন ফরাসি ফরোয়ার্ড লাইনের কাছে তাদের দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ফরাসি গোলকিপার হুগো লরিসকে পাল্টা পরীক্ষায় ফেলার আগে ফরাসি রক্ষণের মুখোমুখি হতে হবে হাকিম জিয়েচ, ইউসেফ এন-নাসেরিদের। এত এত পরীক্ষা উতরেই তাদের পেতে হবে কাক্সিক্ষত জয়। যে জয়ে হয়তো বদলে দেবে ফুটবল নিয়ে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি।
বিশ্বকাপ মঞ্চে দুদলের এটি প্রথম সাক্ষাৎ। ২০০৭ সালে সর্বশেষ মুখোমুখি লড়াইটা শেষ হয়েছিল ২-২ ড্রয়ে। বিশ্বকাপের আগে তাই মরক্কো ছিল বড্ড অজানা। তবে সময় যত গড়িয়েছে দলটি নিজেদের চিনিয়েছে। আর এই চেনার কাজটা গত দুদিন খুব বেশি করতে হয়েছে ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশমকে। তার সংবাদ সম্মেলনের আগে মরক্কো কোচ ওয়ালিদ দিয়ে গেছেন সতর্কবার্তা। ২০০৮-এ দেশম নিজেকে সেরা প্রমাণ করাটা তার কাছে এখন কিছু যায় আসে না। এ কথা শুনে দেশম হেসে বলেছেন, ‘এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমিও খুব বন্ধুপরায়ণ থাকব না (হাসি)। এটাই স্বাভাবিক যে তারাও চাইবে ফাইনাল খেলতে। দলটির রক্ষণভাগ অনেক শক্তিশালী। এখন পর্যন্ত কেউই তাদের গোলের দরজা খুলতে পারেনি। আশা করছি আমরা সেই সমস্যার সমাধান আগামীকাল পেয়ে যাব। পরিসংখ্যান হয়তো তাদের পক্ষে কথা বলবে না, তবে সবকিছুরই একটা বৈপরীত্য থাকে। ছোট ছোট ভুলগুলোই হয়তো ম্যাচের নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবে। গ্যালারি থেকে তাদের অনেক সমর্থন থাকবে। আমাদের নিজেদের খেলাটাই খেলতে হবে। ছেলেরা সতর্ক হয়েই মাঠে নামবে।’
ওয়ালিদ সাফ জানিয়েছেন, তারা বিশ্বকাপ জিততে চান। কথাটায় আপনি ঔদ্ধত্য খুঁজে পেতে পারেন। তবে ৪৭ বছরের মাস্টারমাইন্ড তার কথায় অবিচল, যেন গোটা এটলাস পর্বতমালাটাই বুকে ধারণ করেছেন মরোক্কান কোচ, ‘আমরা বিশ্বকাপ জিততে চাই। এটা শুধু বলার জন্য বলা নয়। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। হয়তো এরকম সুযোগ আমরা আর কখনো পাব না। আমরা হয়তো ফেভারিট নই। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী। হয়তো এটাই আমাকে খ্যাপাটে করে তুলেছে। তবে কখনো কখনো খ্যাপাটে হওয়ার প্রয়োজন আছে।’ ওয়ালিদের ভাবনায় এমবাপ্পে আছেন ফ্রান্সের আর দশজন খেলোয়াড়ের মতোই, ‘আমরা আসলে চাইব নিজেদের খেলাটাই খেলতে। আর তার জন্য বিশেষ একজনকে নিয়ে বাড়তি কোনো পরিকল্পনা করার প্রয়োজন নেই। নিজেদের কাজটা করি আগে, এরপর দেখা যাবে মাঠে কী হয়।’
এমনধারা কথা ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সব দলের কোচই বলেন। ইংল্যান্ড শিবির থেকেও শোনা গিয়েছিল একই কথা। তবে মাঠে দেখা গেছে এমবাপ্পেকে বোতলবন্দি করার গ্যারেথ সাউথগেটের বিশেষ কৌশল। সেটা ঠিকঠাক হলেও রোখা যায়নি অন্যদের। তাই আরেকবার বিদায়ের সাগরে ভাসতে হয়েছিল ইংলিশদের।
মরক্কোর কোচও বলছেন একই কথা। তবে তার কথায় কেন যেন আছে এক অদৃশ্য শক্তি। সত্যিই যদি আরেকবার রাতটা এটলাস লায়ন্সদের হয়, ফরাসি আস্ফালন যদি এটলাস পর্বতে থমকে যায়, এ সময়ের মহাতারকা এমবাপ্পেকে রুখে দিয়ে আশরাফ হাকিমি, এন-নাসেরি যদি আবারও আলো কেড়ে নেন, সেটাকে নিশ্চয় আর অঘটন বলবেন না? কারণ অঘটন ঘটিয়ে একটা-দুইটা ম্যাচ জেতা যায়, বিশ্বকাপ নয়।
ফ্রান্স কি টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে পারবে? যে কৃতিত্বটা আছে শুধু ইতালি ও ব্রাজিলের। ইংল্যান্ড কঠিন পরীক্ষাই নিয়েছে ফরাসিদের। অন্যদিকে স্বপ্নযাত্রা চলছে মরক্কোর। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বাইরে কোনো দেশ আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতেনি। প্রথম কোনো আরব দেশ এবং আফ্রিকার দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মরক্কো। কতটা দূর যাবে তারা?
বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ফ্রান্স আর মরক্কো হবে মুখোমুখি। যে দলগুলো সেমিফাইনালে পৌঁছেছে, ধরে নেওয়া হয় এই চারটা দলই আসরের সেরা। এই পর্যায়ে এসে বিজয়ী নিয়ে পূর্বানুমান করা কঠিন। তবুও বিগত কয়েক মাসের পারফরম্যান্স আর বিশ্বকাপের প্রথম দিকের রাউন্ডের খেলাগুলো পর্যালোচনা করলে বলা যায়, ফ্রান্স সহজেই মরক্কোকে হারিয়ে ফাইনালে খেলবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মরক্কোর লড়াকু মনোভাব ছিল প্রশংসা করার মতো। লড়াকু মনোভাবের কথা বললেই আসলে আবেগ চলে আসে। আবেগের কথা বললে, মরক্কো দারুণ একটা বিশ্বকাপ কাটাচ্ছে, ওদের খেলোয়াড়রা ইউরোপের বড় বড় লিগে নামি ফুটবলারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলছে। সেমিফাইনালে খেলা প্রথম আফ্রিকান দল, ইতিহাসটা আরেকটু সমৃদ্ধ তারা করতেই পারে!
মরক্কো বিশ্বকাপে হারিয়েছে বেলজিয়াম, সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন আর সাবেক ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালকে। তারা চাইবেই এই গতিতে এগিয়ে যেতে, সামনে বাধা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। মরোক্কানরা চাইবেই রূপকথাটা নতুন করে লিখতে।
মরক্কোতে বেশ কয়েকজন ভালো ফুটবলার আছে যারা ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবে খেলে। আশরাফ হাকিমি খেলে প্যারিস সেন্ত জার্মেইতে, হাকিম জিয়েচ চেলসির উইঙ্গার আর সেভিয়ার গোলরক্ষক বুনু। তাদের প্রত্যেকের কাছেই ভালো খেলার প্রত্যাশা করেছিল দেশটি। তবে এতটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করেনি যে তারা একটার পর একটা ম্যাচে নিজেদের ভালো খেলার মাত্রাটা বাড়িয়ে দেবে আর বিশ্বকাপের শেষ চারে উঠে আসবে। মরক্কোর আগে আফ্রিকার কোনো দলের সেরা সাফল্য ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানা এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিল।
মরক্কোর এই বিশ্বকাপে সফল হওয়ার কারণ তারা খেলার গতিটা কমিয়ে এনে রক্ষণে সুদৃঢ় এক দেয়াল তৈরি করতে পেরেছে। তারা খুবই কম গোল হজম করেছে। ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপের পর কোনো দলকে এতটা সফলভাবে রক্ষণ আগলে রাখতে দেখা যায়নি। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইতালি, তারা রক্ষণে খুবই সফল ছিল, সেমিফাইনালে আসার পথে তারা বোধহয় মাত্র ১ গোল হজম করেছিল সেটাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে।
আফ্রিকান দলগুলো খুব কঠিন রক্ষণ আর কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর খেলা খেলে। মরক্কোও সেরকমই খেলেছে। পাঁচটা ম্যাচে তারা প্রতিপক্ষের গোলে শট নিয়েছে ১০ বার। অন্যদিকে মরক্কো মাত্র একটা গোল হজম করেছে, সেটাও আত্মঘাতী। নায়েফ অগার্দের গোলের পরও সেই ম্যাচটা তারা কানাডার বিপক্ষে জিতেছিল ২-১ গোলে। ইউরোপের বড় বড় সব দল বেলজিয়াম, স্পেন ও পর্তুগালকে হারিয়ে মরক্কো আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছে।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ফ্রান্স দেখিয়েছে কেন তারা বিশ্বের সেরা দল। এমবাপ্পেকে ওরা বোতলবন্দি করে রেখেছিল। তারপরও দেশমের শিষ্যরা দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সাহসী, পরিণত আর দক্ষ একটা দল। যে কোনো মুহূর্ত থেকে ফ্রান্স দলটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং তারা সেটা করে দেখিয়েছে, এজন্য তাদের দলে প্রতিভাবান ফুটবলারের যে অবিরাম প্রবাহ সেটাই একটা বড় কারণ। যারাই দলে আসে, তারা নিখুঁতভাবে দলের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। এজন্য দেশম এবং ফেডারেশনকে কৃতিত্ব দিতেই হবে কারণ ছোটবেলা থেকেই তারা খেলোয়াড়দের মনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জয়ের মানসিকতাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের পরিণতবোধের কারণে দলটা অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণও। ফ্রান্স খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে কারণ তাদের সেটা করার মতো সামর্থ্য আছে। তারা জানে কখন গতি বাড়াতে হবে আর কখন ধৈর্য ধারণ করতে হবে, এটা তারা করতে পারে কারণ তাদের হাতে খেলোয়াড় আছে। তাই কাতারে যদি পারফরম্যান্স গণনা করি, তাহলে বলতে হবে ফ্রান্সের কথা আর যদি আবেগের কথা বলি তাহলে বলতে হবে মরক্কোর কথা।
এমন বন্ধুত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছে লিওনেল মেসি ও নেইমারকে। হয়তো বার্সেলোনার রোনালদিনহো ও মেসিকেও। এক ক্লাবে দুজনের পথচলা খুবই মসৃণ। জাতীয় দলেও সেই মসৃণতা বজায় রাখতে চান তারা। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজে তা সম্ভব হয় না। এই বিশ্বকাপে আশরাফ হাকিমি ও কিলিয়ান এমবাপ্পের এখন এমনই অবস্থা। পিএসজিতে একসঙ্গে খেলা দুজনের এত সুন্দর বন্ধুত্ব আজ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজে এদিক-ওদিকে হতে যাচ্ছে। তবে সেমিফাইনালে ফ্রান্স ও মরক্কোর লড়াই নিশ্চিত হওয়ার পর দুজনের মধ্যে যেই হৃদ্যতা দেখা যাচ্ছে, মাঠে লড়াইয়ে হয়তো এতটা হৃদ্যতা নাও দেখা যেতে পারে! তবে সেমিফাইনালে ফ্রান্সকে পাওয়ার পরই হাকিমি এমবাপ্পেকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘দ্রুত দেখা হচ্ছে বন্ধু’। ওদিকে স্পেনের বিপক্ষে শেষ টাইব্রেকারে লক্ষ্যভেদ করা হাকিমিকে ‘মরক্কোর রাজা’ বলেছেন এমবাপ্পে। তার টুইটটা ছিল এমন আশরাফ হাকিমি, পেঙ্গুইন ইমোজি, মুকুটের ইমোজি, দুই হাতে লাভ সাইন। স্পেনের সঙ্গে শেষ টাইব্রেক শুট নেওয়ার পর পেঙ্গুইনের মতো উদযাপন করেছিলেন হাকিমি। ঠিক যেমনটা এমবাপ্পে করে থাকেন। এখন এই বন্ধুত্ব মাঠে নামছে একে অপরকে হারাতে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই আটকে থাকেনি এমবাপ্পে-হাকিমি হৃদ্যতা। দোহায় হাকিমিদের টিম হোটেলে গিয়ে দেখা করে এসেছেন এমবাপ্পে। দুজনের সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ভাইরাল। বিশ্বকাপের মধ্যে দুই দলের ফুটবলারের এমন বন্ধুত্ব সচরাচর দেখা যায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে শুভকামনা জানানো পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু একেবাবে বন্ধুর টিম হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হওয়া কখনই দেখা যায় না। সেই ব্যতিক্রম ভালোবাসা দেখিয়েছেন এমবাপ্পে। বিশ্বকাপে সচরাচর ফুটবলাররা নিজ দল নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। নিজেদের পরিকল্পনা সাজানোতেই থাকে মূল ব্যস্ততা। এর মধ্যে বিরতি পেলে নিজেদের নিয়েই সময় কাটান। যেমন এবার মেসি ও রোনালদো পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এমবাপ্পে ছুটে গেছেন বন্ধু হাকিমির কাছে।
মরক্কো ও ফ্রান্সের দুই তারকার শুরুটা ২০২১-এ। রিয়াল মাদ্রিদের দ্বিতীয় রাইট ব্যাককে কিনে নেয় পিএসজি। সেই থেকে ফরাসি ক্লাবের সেরা একাদশের একজন হাকিমি। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। কানাডায় জন্ম নেওয়া হাকিমিকে বিশ্বসেরা রাইটব্যাক বলেছেন এমবাপ্পে। এ বছর জানুয়ারিতে কাতারের বিশ্বকাপ ভেন্যু দেখতে এসেছিল পিএসজি ক্লাব। তখন এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে এক সাক্ষাৎকারে মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচ পড়লে কী করবেন এমন প্রশ্ন এমবাপ্পে জানান, ‘এডুকেশন স্টেডিয়ামটি দারুণ। এখানে ৪০ হাজার সমর্থক ধরে। এখানে খেলাটাও বেশ উপভোগ্য হবে। তবে আমরা যদি মরক্কোর বিপক্ষে খেলি তবে হাকিমির মুখোমুখি হতে হবে। তখন আমার বন্ধুকে শেষ করে দিতে হবে। ওই ম্যাচে অবশ্যই আমরা জিতব।’ এদিকে বিশ্বকাপের আগে এমবাপ্পেকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বন্ধুর প্রশংসা করে হাকিমি বলেন, ‘এমবাপ্পেকে আমি খুব ভালোবাসি। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয় মানুষ হিসেবেও সে দারুণ। ওর বড় ক্ষমতা হলো ওকে বল দিয়েই আপনার কাজ শেষ। এরপর সে নিজেই ঠিক করে নেবে বলটি দিয়ে কী করতে হবে।’
এমন হরিহর আত্মার দুই বন্ধু আজ নামবেন দেশকে এগিয়ে নিতে, ফাইনালে। এমবাপ্পে এই স্বাদ আগেই পেয়েছেন। হাকিমি যদি রাইটব্যাক পজিশনে থেকে, লেফট উইঙ্গার এমবাপ্পেকে আটকে দিতে পারেন, তবে তিনিও পাবেন ফাইনালের স্বাদ। বন্ধুত্ব এখানে তুচ্ছ হয়ে যাবে।
এবারের আসরে মরক্কোর যাত্রাটাকে বলব ‘বিস্ময়কর সুন্দর’। গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়াকে রুখে দেওয়ার পর বেলজিয়ামকে হারাল। শেষ ষোলোয় স্পেনকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালেরও স্বপ্নভঙ্গ করল। আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনালের মঞ্চে তারা। এই দলটা আরও এগিয়ে যাক, মন তো এমন চাইবেই। হ্যাঁ, কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে আমার মন মরক্কোর দিকেই। তবে মাথা বলছে এগিয়ে থাকবে ফ্রান্সই।
কাগজে কলমে ফ্রান্স অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওরা। এবারও খেলছে দুর্দান্ত। ওদের সামনে সুযোগ ৬০ বছর পর প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের শিরোপা ধরে রাখার। তবে মরক্কোর যে মানসিকতা, ওরা কখনো খুশি হয় না। দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টারে উঠেও তারা খুশি ছিল না। সেমিফাইনালে উঠেও খুশি না। ওরা ফাইনাল খেলতে চায়। এর সঙ্গে কাতারে অনেক সাপোর্টারও তাদের। এই ম্যাচ দেখতে আরও অনেক সাপোর্টার যাবে বলে শুনেছি। এটা ওদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। প্রতিপক্ষ দলের কাছে বল থাকলেও ওরা শিস বাজাচ্ছে। গ্যালারিতে ওদের দাপট থাকছে। খেলোয়াড়রা তাতে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত থাকছে।
ফ্রান্সের জন্য ইতিবাচক হচ্ছে ওদের কোনো চোট সমস্যা নেই। তবে মরক্কোর আবার এখানে দুর্ভাবনা আছে। তাদের একাধিক খেলোয়াড়ের চোট সমস্যা আছে। বিশেষ করে আগের ম্যাচে অধিনায়ক রোমান সাইস স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়েন। নুসে মাসাওয়ি ও ডিফেন্ডার নায়েফ আগের্দও গত ম্যাচের প্রথম একাদশে ছিলেন না। এই খেলোয়াড়রা খেলতে না পারলে কিছুটা হলেও দুর্বল করবে তাদের।
ফ্রান্সের আক্রমণভাগ যে বিশ্বসেরা এতে কোনো সন্দেহ নেই। মাঠে তারা সেটা প্রমাণও করে যাচ্ছে। আর দিদিয়ের দেশম তার ফুলব্যাকদের খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে থিও হার্নান্দেজকে। এমবাপ্পে যেহেতু ইনসাইডে অনেক বেশি ঢুকে যায়, তাই হার্নান্দেজ ওভারল্যাপ করে। এমবাপ্পের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে তারা জায়গা তৈরি করে দিয়ে বাধ্য করে। মজার ব্যাপার যেটা হবে মরক্কো একটু নিচের দিকে নেমে কমপ্যাক্ট ডিফেন্ডিং করে কাউন্টার অ্যাটাকে যায়। ফ্রান্সও এই জিনিসটাই করে। অনেক সময় দেখেছি বল হারালে ধীরে ধীরে নিচে ড্রপ করে। যাতে কাউন্টারে এমবাপ্পেকে ব্যবহার করা যায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অবশ্য এটা পারেনি তারা। তবে মরক্কোর বিপক্ষে ঠিকই সফল হতে চাইবে।
এখন মরক্কো যদি ওপরে না ওঠে তখন কিন্তু ফ্রান্স জায়গা পাবে না। এমন হলে ফ্রান্সকে অতিরিক্ত মুভমেন্টগুলো করতে হবে। এখানে গ্রিজম্যান, জিরু ও এমবাপ্পের কম্বিনেশন জরুরি হবে। আদ্রিওঁ রাবিওর কথাও বলব। বাম পাশে এমবাপ্পে ও হার্নান্দেজ তো আছেই। রাবিও বেশ ভালো প্রভাব রাখে। তিনজন যখন এক লাইনে চলে যায়, তখন মাঝখানে একটা জায়গা তৈরি হয়। প্রতিপক্ষ তখন ওইদিকে চাপে, যা ফ্রান্সের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য জায়গা তৈরি করে দেয়।
মরক্কোর বিপক্ষে কাউন্টার অ্যাটাক করা কঠিন। ট্রানজিশনে তারা খুব দুর্দান্ত। দেখা যায় খুব দ্রুতই তারা ৪-১-৩-২ শেপ নিয়ে ফেলে। এটা তাদের অ্যাডভান্টেজ। তবে গ্রুপ পর্বে কানাডা দেখিয়েছিল কাউন্টারে মাঝেমধ্যে অগোছালো থাকে মরক্কো। সেট পিস রোখার ক্ষেত্রেও ওরা খুব বেশি ভালো না। তাই পেনাল্টি এরিয়ার আশপাশে ফাউল করে না। কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেনি। তবে ফ্রান্স এমন সুযোগ পেলে যে মিস করবে না এটা নিশ্চিত। এই পর্যায়ে দলগুলো ভুল খুব কম করে। আর ভুল হলে কেউ পার পায় না। ফ্রান্সের সঙ্গে আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইন যেমন পেনাল্টি মিস করল। বিশ্বকাপ থেকেই তাদের বিদায় নিতে হলো।
ফ্রান্স মিডফিল্ডে ব্লক খুব ভালো করে। ইংল্যান্ডের সঙ্গেও এটা করেছে। ট্রানজিশনে দেখা যায়, নিজেদের কোন খেলোয়াড় কোথায় যাচ্ছে এটা তাদের কাছে কোনো বিষয় না। বোঝাপড়াটা ভালো। একজন আরেকজনের পজিশনে গেলেও দলের শেপটা ঠিক রাখে। অগোছালো হয় না। এক্ষেত্রে বল হারালেও ডিফেন্ডিং করতে সুবিধা হয়। মরক্কোর আবার বিল্ডআপ নিখুঁত। ওদের হাইপ্রেস করা যায় না সহজে। পর্তুগাল যেমন পারেনি। ওরা কাউন্টার অ্যাটাকনির্ভর দল হলেও তড়িঘড়ি করে না। বেশ ঠা-াভাবে ওপরে যায়। সব মিলিয়ে হাড্ডাহাড্ডি এক লড়াইয়ের অপেক্ষাতেই আছি।
বিশ্বকাপের চরিত্রটাই এমন। অচেনাকে চিনিয়ে দেওয়া, পড়তে থাকা তারকাকে তুলে ধরা অথবা সেরা তারকাদের মাটিয়ে নামিয়ে আনা। অ্যান্তোইন গিজমান ও হাকিম জিয়েচের ক্ষেত্রে হয়েছে মাঝেরটা। এই বিশ্বকাপের আগে ক’জন ফ্রান্স বা মরক্কোর হয়ে জ্বলে ওঠার সার্টিফিকেট দিতেন এ দুই ফুটবলারকে? অথচ সেমিফাইনালের আগে প্লে-মেকার হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তাদের নিয়েই। দায়িত্বে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, কিন্তু পুরো মাঠজুড়েই বিচরণ করে খেলার গতিবিধি বদলে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপকে নিজের জন্য স্মরণীয় করে রাখছেন দুজন। আজ মুখোমুখি হওয়া দু’দলের লড়াইয়ে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়ার মূল ভূমিকা তাদের পায়েই।
কিন্তু বিশ্বকাপের আগে হারিয়েই গিয়েছিলেন গ্রিজমান ও জিয়েচ। তরতর করে বেড়ে ওঠা ক্যারিয়ার যেন মুহূর্তেই ধসে পড়ছিল। হাকিম জিয়েচকে তো অবসরই নিতে হয় ফেব্রুয়ারিতে। এরপর চেলসির হয়ে এ বছর একটিও শুরুর একাদশে খেলার সুযোগ না পাওয়া। গোপন খবর জানায় ক্লাব থেকে তাকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সবুজ সংকেতও দেওয়া হয়। ওদিকে গ্রিজমান নিজের উত্থানের ক্লাব আতলেতিকোতে ফিরেছেন বটে, কিন্তু আগের মতো কিছুই পাচ্ছিলেন না। বার্সেলোনার নানা নিষেধাজ্ঞায় গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুরুর একাদশে খেলার সুযোগই হচ্ছিল না। সেই আক্ষেপ এবার ভুলিয়ে দিলেন বিশ্বকাপের দ্যুতিতে।
নেদারল্যান্ডসে এক মরোক্কান পরিবারে জন্ম জিয়েচের। তাই ডাচ অথবা মরক্কো জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ ছিল। বাবা-মা নেদারল্যান্ডসে থাকেন বলে দেশটির ফুটবলের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু ২০১৪ সালে মরক্কো বিদেশে জন্ম তবে মরোক্কান যোগ আছে এমন প্রতিভাবান ফুটবলারদের দেশটির হয়ে খেলতে উৎসাহিত করে। ওই সময় অন্য অনেকের মতোই সাড়া দেন জিয়েচও। নয়তো ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের হয়েই খেলার কথা ছিল। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে ডাক পেয়েছেন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও লাটভিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচে খেলার কথাও ছিল তার। খেলেছেন ডাচ ক্লাব হেরেনভিন ও এফসি টোয়েন্টিতে। মরক্কো জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর খেলেছেন আয়াক্সে। এই ক্লাবেই সবচেয়ে বেশি ১১২ ম্যাচ খেলে করেছেন ৩৮ গোল। ২০২০ থেকে আছেন চেলসিতে। কিন্তু ৫১ ম্যাচে মাত্র ৬ গোল করায় জিয়েচকে চেলসিতে ফ্লপ ধরা হয়। তবে এই বিশ্বকাপে কানাডার বিপক্ষে একটি গোল, বেলজিয়ামের বিপক্ষে একটি অ্যাসিস্ট ও স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে লক্ষ্যভেদ করেন। মরক্কোর আগের কোচ ভাহিদ হালিল হোদজিক জিয়েচসহ বিদেশি যোগ আছে এমন ফুটবলারদের বাইরে রেখেছিলেন। জাতীয় দলে ডাক না পেয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেন ২৯ বছর বয়সে। কিন্তু আগস্টে রাগ্রেগুই দায়িত্ব নিয়েই ওই সব ফুটবলারকে ফিরিয়ে আনেন। জিয়েচও তার কথায় অবসর ভেঙে ফিরে আসেন। এ নিয়ে খুব সমালোচনায় পড়েছিলেন রাগ্রেগুই। কিন্তু এখন সেসবের রেশ মাত্র নেই। রাগ্রেগুই জানান, ‘যেসব ফুটবলার জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে জন্ম নেয় এবং সেখানেই ফুটবলের সঙ্গে বেড়ে ওঠে ওদের এই খেলাটির ঐতিহ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি থাকে। আমি নিজেও ফ্রান্সে জন্মেছি। আমরা সবাই একসঙ্গে মিলে সবার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা দারুণ মিশ্রণ তৈরি করেছি। যা এই বিশ্বকাপে কাজে লেগেছে।’ মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদও বলেছেন, ‘মরোক্কানদের আশা ও স্বপ্ন পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে।’ সাবেক ইংলিশ তারকা ইয়ান রাইট বিশ্বকাপে জিয়েচকে দেখে মুগ্ধ। তার মতে চেলসিতে ম্যাচ সুযোগ না পাওয়া জিয়েচ দেশের হয়ে নতুন উদ্যমে ফুটে উঠেছেন।
গ্রুপ পর্বে মোট সাতটি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন জিয়েচ। ডি বক্সে মোট ৪৩ বার বল পঠিয়েছেন আর সরাসরি স্ট্রাইকার বা অন্য ফরোয়ার্ডদের ডি বক্সে পাস বাড়িয়েছেন ১৭ বার। অন্য কোনো মরোক্কান ফুটবলার এই সংখ্যার কাছেও যেতে পারেননি। তবে এসব জিয়েচকে আলাদা করতে পারবে না। যা পারবে তা হলো দলের প্রতি দায়বদ্ধতা, সতীর্থদের প্রতি সহমর্মিতা আর মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। জিয়েচ হানেরভিনে খেলার সময় তার কোচ ছিলেন ডাচ গ্রেট মার্কো ফন বাস্তেন। এই ফরোয়ার্ডকে নিয়ে বাস্তেনের মন্তব্য ছিল ‘আনম্যানেজেবল’ (যাকে সামলানো যায় না)। কিন্তু রাগ্রেগুই বলেন, ‘অনেকেই ওকে নিয়ে বাজে কথা বলে। সমালোচনা করে। কিন্তু আসল কথা হলো জিয়েচকেব স্বাধীনতা ও ভালোবাসা দিলে সে আপনার জন্য মরতেও প্রস্তুত।’
জিয়েচের মতো জ্বলে ওঠা আরেকজন গ্রিজমান। দুই বিশ্বকাপ আগে তাকেই ধরা হচ্ছিল ফ্রান্সের সেরা ফরোয়ার্ড। সেই পথে হেঁটে দেশটির সেরা স্কোরারদের তালিকায় তিনে আছেন। অথচ তার ক্যারিয়ারের গ্রাফটা কেমন যেন ওপর থেকে নিচের দিকে। ক্যারিয়ারে স্ট্রাইকার ও পরে ফরোয়ার্ড হয়ে শুরু করা গ্রিজমানের পথচলা থেমে গিয়েছিল বার্সেলোনায় গিয়ে। মেসি ও সুয়ারেজের সঙ্গে পজিশনের লড়াইয়ে নিজের জায়গাটা পাচ্ছিলেন না। ফর্ম পড়তির দিকে যাওয়ায় আবারও চলে আসেন আতলেতিকো মাদ্রিদে ধারে। পুরনো ক্লাবে ফিরলেও নিজেকে ফিরে পাননি গ্রিজমান। কিন্তু বড় মঞ্চের তারকারা বড় মঞ্চেই জ্বলে ওঠেন। গত বিশ্বকাপ জয়ী গ্রিজমানও জ্বলে উঠলেন বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। তার কাঁধে চড়ে ভরসা রাখছে ফ্রান্স।
নতুন ভূমিকায় এ বিশ্বকাপে সেরা পারফর্মটা দেখালেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে। নিখুঁত ও কার্যকর পাসের দারুণ প্রদর্শনী গড়েছিলেন গ্রিজমান। নিজের ডান পাশে থাকা উসমান দেম্বেলে ও রাইট ব্যাক জুলেস কুন্দের সঙ্গে পাস দেওয়া-নেওয়ায় দারুণ ত্রিভুজ তৈরি করেন। ম্যাচে আক্রমণ গঠনে কুন্দে ও গ্রিজমানের পাসের পরিমাণ যথাক্রমে ৪৯ ও ৪৮। ইংল্যান্ডের উঠতি তারকা ও এই বিশ্বকাপে সেরা তরুণদের একজন জুড বেলিংহামের সঙ্গে পজিশন ডুয়েল ছিল গ্রিজমানের। তবে তরুণ বেলিংহাম অভিজ্ঞতার কাছে হার মানেন।
গ্রিজমানের এই নতুন ভূমিকায় ফ্রান্স শক্তির চেষ্টা নয় বরং গাণিতিক পরিকল্পনায় ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলাতেই নজর দিচ্ছে। দেশমের এই নতুন ‘ছায়া মিডফিল্ডার’ তাকে লক্ষ্য পূরণের পথে নিয়ে চলেছে। গ্রিজমানের কারণে দেশম বিপক্ষের চিন্তায় আরও একজনকে রাখার সুযোগও পেয়েছেন। এখন এমবাপ্পে-জিরুর পাশাপাশি মরক্কোকে গ্রিজমানের ভূমিকা নিয়েও ভাবতে হবে। এতে সুবিধা কোচ দেশমের। এক দুই গুটি সামনে রেখে পেছনের গুটি দিয়ে বিপক্ষের অর্ধে হামলা দেওয়ার চাল চালতে পারছেন। শুরু থেকে না হলেও কোয়ার্টারে এই নতুন গুটির চালে দারুণ সফল দেশম। এবার সেমিতে সফল হওয়ার পালা। এই বিশ্বকাপে গ্রিজমানকে ব্যাখ্যা করে লেকিপ লিখেছে, ‘প্রতি ম্যাচে আতলেতিকো মাদ্রিদ ম্যান যেন একেক ধাপ ওপরে উঠছেন। ডেনমার্কের বিপক্ষে ম্যাচে ফেরায় একাধিক কাউন্টার অ্যাটাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পোল্যান্ডের বিপক্ষে মধ্যমাঠ থেকে গোল হয়ে ঘুরেছেন। সহযোগিতা করেছেন ডিফেন্ডারদেরও। আর থ্রি লায়নদের বিপক্ষে ওদের সেরা পরিকল্পনাকেও এলোমেলো করে দিয়েছেন। গ্রিজু’র গ্রেটনেসটা এখানেই। সময়ের সঙ্গে ওয়াইনের মতো সুপেয় হয়ে ওঠেন। অনুষ্ঠানের (খেলার) সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতা বাড়ান এবং সেরা মুহূর্তের বিশেষ বস্তু হয়ে ওঠেন।’
একই অবস্থানে থেকে জ্বলে উঠেছেন দুই তারকা। শেষ হাসিতে এই অগ্রযাত্রা শেষ করতে চান দুজন। তার আগে একই পজিশনে আজ মাঠ নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে গ্রিজমান ও জিয়েচকে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।