রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাত সংস্কারে গঠিত প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সব মিলিয়ে ছয় সংস্কার কমিশন দুই হাজার সুপারিশ করেছে। কমিশনগুলো বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘আশু করণীয়’, ‘মধ্যমেয়াদী’, ‘দীর্ঘমেয়াদি’ এই তিন ভাগে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে ওই ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কমিশন হলো— সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও দুদক সংস্কার। বদলি হওয়া পুলিশের অনলাইনে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা, আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ, কালো টাকা সাদা করার বিধান চিরতরে বাতিলের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশনগুলো।
সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম, উপ-প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছয়টি কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, তা আগামী নির্বাচনের আগে করা যেতে পারে। যে প্রস্তাবগুলো নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো আমরাই বিবেচনা করব। প্রায় অর্ধেক আশু করণীয় বাস্তবায়ন করতে এক মাসের মধ্যে করা সম্ভব। বাকি সংস্কার করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগতে পারে। সংস্কার কার্যক্রম ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। কিছু কিছু সংস্কার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে করা হবে।’
আশু করণীয় নানা প্রস্তাব : আশু করণীয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হলো— স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আচরণবিধি প্রণয়ন, গণশুনানি এবং নাগরিকদের অভিযোগ শোনা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী নাগরিক কমিটি গঠন, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ আর রাজস্ব বোর্ড একসঙ্গে এক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
অন্যান্য আশু করণীয়ের মধ্যে রয়েছে— কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ ঘোষণা, জেলা প্রশাসককে জেলা কমিশনার হিসেবে অভিহিত করা, উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন করা।
সংস্কার কমিশন আশু করণীয় হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ, ফৌজদারি মামলা তদন্তে আলাদা ফৌজদারি সার্ভিস, বাণিজ্যিক আদালত গঠন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে আদালতে সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ, প্রতিটি আদালতে ইনফরমেশন ডেস্ক স্থাপন, বিভিন্ন মামলায় বদলি হওয়া পুলিশের অনলাইনে সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা, আদালত প্রাঙ্গণে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহারের নিয়ম প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে।
এ ছাড়া বিদ্যমান মামলাজট হ্রাস কল্পে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ, আইনজীবী-মক্কেলদের মধ্যে লিখিত চুক্তি ও রসিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা, মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠন, পুলিশদের মানবাধিকার ট্রেনিং, আচরণবিধি প্রণয়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করার পাশাপাশি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন, অনলাইন ভোটিংয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু, দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশল বাস্তবায়নে ন্যায়পাল নিয়োগ, কালো টাকা কোনো দিনও সাদা করা যাবে না-সংক্রান্ত আইনপ্রণয়ন, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী আইনে স্বচ্ছতায় শুদ্ধাচার চর্চা, বেসরকারি পর্যায়ের ঘুষ লেনদেনকে শাস্তির আওতায় আনা এবং দুদককে আরও শক্তিশালী করতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানেই নিহিত
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ১৯৭২ সালে রচিত দেশের প্রথম সংবিধানের ‘দুর্বলতাকে’ দায়ী করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের ভাষ্য, ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই নিহিত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের জমা দেওয়া পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই নিহিত ছিল। এরই ফলাফল হলো প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পুঞ্জীভবন আরও ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরও প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচার বিভাগ ক্রমেই বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহির অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরও প্রবল চেহারা নিয়েছে।
একইভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা দল, রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করেছে। এভাবে ১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দলকে কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশ জুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
সংসদের মেয়াদ চার বছর করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখাসহ দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মতো সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এ কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
১৪৪ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ হবে চার বছর করে। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না।
মন্ত্রণালয় কমিয়ে গুচ্ছ গঠনসহ জনপ্রশাসনে যত সুপারিশ
মন্ত্রণালয়গুলো যুক্তিসংগতভাবে হ্রাস করে সরকারের সব মন্ত্রণালয়কে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে সব মন্ত্রণালয়কে সমপ্রকৃতির পাঁচটি স্বল্পমেয়াদী গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংস্কার সুপারিশে পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে নতুন দুটি বিভাগ, ‘নয়াদিল্লির মতো’ কেন্দ্রশাসিত ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের জন্য সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে একটির বদলে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন এবং উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে আনার মতো প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন রয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই অধিকতর কার্যকর করতে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা গেলে নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হলে জেলা পরিষদের প্রাসঙ্গিকতা কমে যাবে। সুতরাং, জেলা পরিষদকে বাতিল করা সমীচীন হবে। পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে। কারণ চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেয় না।
জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা (নালিশি মামলা) প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়েছে, তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশে বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
সংস্কার নিয়ে এ মাসেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা
ব্রিফিংয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, আমাদের এই সরকারের অযথা সময়ক্ষেপণ করে সরকারে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আমরা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র মেরামতের মৌলিক শর্ত পূরণ করার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সংস্কারগুলো অতি জরুরি, সেগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা চলে যেতে চাই। এটা নিয়ে কোনো ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।’
সংস্কার নিয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা পুনর্ব্যক্ত করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘কমিশনগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের কথা বলেছেন, যা আগামী নির্বাচনের আগে করা যেতে পারে। আশু করণীয় কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আলোচনা শুরু করতে আগ্রহী। যদি তারা রাজি থাকেন, রোজার মধ্যেও আলোচনা চলবে। আর রাজনৈতিক দলগুলো যে দ্রুত নির্বাচন চায়, আমি মনে করি সেটা বলার অধিকার তাদের আছে এবং দ্রুত বলতে কী, সেটা (তারা) স্পেসিফাই করে বলেনি।’
নির্বাচনের সময়রেখা নিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের সময়রেখা নিয়ে বারবার প্রধান উপদেষ্টা এবং তার পক্ষে প্রেসসচিব জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আবার বর্ষার কথা বিবেচনা করে ২০২৬ সালে সেটা এগিয়ে এপ্রিল বা মার্চে হতে পারে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে অক্টোবরে প্রথম ধাপে রাষ্ট্রের ছয়টি খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করে।
এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি।
এখন বাকি রয়েছে নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত আরও পাঁচ কমিশনের (গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন) প্রতিবেদন।