ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতেই সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি বন্য প্রাণী মারা গেছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত একশত ৩৮ টি বন্য প্রাণির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৭ বছরে সুন্দরবনে ১২টি ঘর্ণিঝড় আঘাত হানলেও এতো সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি কখনও। এর আগে সিডরে মারা গিয়েছিল বাঘসহ ৩২টি বন্য প্রাণী।
তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল অন্তত ৪৮ ঘণ্টা। দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এবার বন্যপ্রাণী মৃতের সংখ্যা বেশি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক এস এম রুবায়ত আব্দুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্যপ্রাণী পানিতে ডুবে ও গাছের আঘাতে মারা গেছে। মেঘের ডাকে বন্য প্রাণি এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে। এছাড়া রিমালে সুন্দরবন ৫ থেকে ৬ ফুট পানিতে ডুবে ছিল। সে কারণে এবার প্রাণহানির সংখ্যা বেশি। তবে বন্য প্রাণী সুরক্ষায় গবেষণা দরকার। গবেষণা অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৭ বছরে সুন্দরবনে ১২টি ঘর্ণিঝড় আঘাত হানে। ২০০৭ সালে ঘর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৭ সালে মোড়া, ২০১৯ সালের ফণি ও বুলবুল, ২০২০ সালে আম্ফান, ২০২১ সালে ইয়াস, ২০২২ সালে সিত্রাং, ২০২৩ সালে মোখা ও মৃথিলী ও ২০২৪ সালে রিমাল। সব ঝড়ে বন্য প্রাণীর প্রাণহানি ঘটেনি। শুধুই ২০০৭ সালে সিডরে ৩১টি হরিণ ও ১টি বাঘ ও ২০২১ সালে ইয়াসে ৪ হরিণ মারা গিয়েছিল। তবে চলতি বছর রিমালের আঘাতে মারা গেছে সর্বোচ্চ ১৩৪ টি হরিণ ও ৪টি শুকর। ১৮টি হরিণ উদ্ধার করার পর শুশ্রূষা করে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগ আরও জানায়, জেটি, রাস্তা ও বাঁধ, ব্যারাক, ওয়্যারলেস টাওয়ার, পল্টুনসহ অবকাঠামোয় ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের মিষ্টি পানির আধার শতাধিক পুকুর লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বিঘা বিঘা গোলপাতার বাগান।
সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অঙ্কে হিসাব করা সম্ভব না। একইসঙ্গে কি পরিমাণ গাছপালা ও ভূমি ক্ষয়সহ নানা ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে সময় দরকার। তবে ৪৮ ঘণ্টা ধরে সুন্দরবন জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত ছিল। পানির উচ্চতা অনেক বেশি ছিল। এ সময় নদ-নদীতে ঘূর্ণি বাতাসের সঙ্গে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। ফলে হরিণসহ বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছে গাছে অসংখ্য পাখির বাসা ছিল। যাতে ডিম ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। কমবেশি সব প্রাণীই তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে। ক্ষতিগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসছে।
বন প্রাণীর সুরক্ষা সম্পর্কে বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনে সুরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ১২টি স্থানে বাঘের কিল্লা নির্মিত হচ্ছে। বাঘের কিল্লা হচ্ছে উঁচু স্থান যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য বন্যপ্রাণীরা আশ্রয় নেয়। যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে বণ্যপ্রাণী আশ্রয় নিতে পারবে। মিঠা পানির পুকুরের পাড় উঁচু করা হচ্ছে। তাছাড়া বনপ্রাণী সুরক্ষায় গবেষণা ও অন্য প্রকল্পও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি ৪ হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি ১ হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমি ও জলাভূমিতে ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ ও ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণীর বসবাস।