মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

আজিমপুর কলোনিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ

আ. লীগের দেখানো পথেই অপচয়-দুর্নীতির ছক!

  • অর্থনৈতিক সংকটেও সরকারি কর্মচারীদের জন্য ভবন নির্মাণে তোড়জোড়
  • অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রাখার অভিযোগ
  • প্রস্তাবিত বহু প্রকল্পে আগের মতোই যুক্ত থাকছে অপ্রয়োজনীয় সব অনুষঙ্গ
  • ‘অপব্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত পরিকল্পনা কমিশন কর্মকর্তাদের
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৫, ০১:০৫ এএম

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোনো প্রকার আর্থিক শৃঙ্খলা ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছিল অসংখ্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পে গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) সিলিং অনুসরণ করেনি। ফলে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। আবার যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোতে অনেক অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ যুক্ত করে খরচ অনেক বাড়ানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্যই ছিল এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প স্থগিত করা এবং নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে তা সঠিকভাবে পর্যালোচনা। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে এমন অনেক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে, যেগুলোতে আগের মতোই যুক্ত থাকছে অপ্রয়োজনীয় সব অনুষঙ্গ। আবার এসব প্রকল্প এই মুহূর্তে গ্রহণের যৌক্তিকতা কতটুকু, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

তেমন একটি প্রকল্প হচ্ছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘ঢাকাস্থ আজিমপুর সরকারি কলোনির অভ্যন্তরে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ প্রকল্প, যা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৫৪ কোটি টাকা। গত সপ্তাহে প্রকল্পটির পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ওই সভায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন একাধিক কর্মকর্তা। তা সত্ত্বেও সরকারি কর্মকর্তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ঢাকায় দেড় লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। তাদের মধ্যে ১৪ হাজার ৮০০ জনের জন্য সরকারি বাসা বরাদ্দের ব্যবস্থা আছে। তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সংকট নিরসনে আজিমপুর কলোনির বিদ্যমান ৩২টি পুরনো ভবন ভেঙে ১১টি নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। যেখানে তৈরি হবে ৮৩৬টি ফ্ল্যাট।

ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১০ জন কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ দেশে একই ধরনের বৈশিষ্ট্যের এবং এর চেয়ে জটিল প্রকৃতির অসংখ্য সরকারি ভবন এর আগেই নির্মিত হয়েছে। কাজেই সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহজেই নতুন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবন নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষায় ৪৬ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

অথচ বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট নিজস্ব ল্যাব রয়েছে এবং এ ধরনের অসংখ্য কাজ অধিদপ্তর এর আগেই সম্পন্ন করেছে। ম্যাটেরিয়াল টেস্টিংয়ে (নির্মাণসামগ্রী পরীক্ষা) ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর পুরনো ভবন অপসারণে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। কিন্তু সাধারণত পুরনো ভবন ভাঙার জন্য যাদের কাছে বিক্রি করা হয়, তারা নিজেরাই ভবন ভেঙে নিয়ে যান। কাজেই এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই।

এসব ব্যয়কে ‘অপব্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। আর প্রতি বর্গমিটার নির্মাণকাজের জন্য যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটিও বর্তমান বাজারদরের তুলনায় বেশি।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে সরকার কৃচ্ছ্রনীতি অনুসরণ করছে। এরই মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পের রেট অব রিটার্ন কম, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পটি এই মুহূর্তে তেমন অগ্রাধিকার প্রকল্প না হওয়া সত্ত্বেও কিছু কর্মকর্তার বিশেষ আগ্রহে এটি একনেকে উত্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রকল্পটি রাজধানী ঢাকার মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

ওই এলাকায় একসঙ্গে এতগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে যে পরিমাণ ট্রাফিক কনজেশন (যান চলাচল) হবে সে বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। আর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ২০২৮ সালের জুনে সম্পন্নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে কোনো প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হওয়ার নজির নেই। কাজেই এটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

এমন পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে প্রকল্পটি থেকে রিটার্ন পেতে (সুফল) কমপক্ষে তিন থেকে চার বছর সময় লাগবে, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ কতটা যুক্তিসংগত, তা ভেবে দেখা দরকার।

দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের গুরুত্ব কতটুকু সে বিষয়ে বক্তব্য জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত