টোব্যাকো অ্যাটলাসের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকের ব্যবহারজনিত কারণে মারা যাচ্ছে, যা দৈনিক গড়ে ৪৪২ জন।
এ ছাড়া তামাকের কারণে দেশে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ কোটি ৬২ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ তামাক ব্যবহারকারী এবং ৩ কোটি ৮৪ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।
এমনকি গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো জরিপের তথ্যমতে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশে ধূমপান আসক্ত কিশোর-কিশোরীর হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ১২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত ধূমপানে আসক্ত।
গণমাধ্যমে পাঠানো ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকের কর বৃদ্ধি ও মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরেছেন গ্যাভি সিএসও স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ।
প্রবন্ধে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতির অন্যতম প্রধান অংশ হলো তামাকজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি একটি কার্যকর পদ্ধতি। তামাকপণ্যের দাম বাড়ালে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ বিশেষত তরুণরা ধূমপান থেকে বিরত থাকবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দাম ১০% বাড়ালে তামাকের ব্যবহার গড়ে ৪%-৬% হ্রাস পায়। বিশেষ করে, দরিদ্র ও যুব সমাজ এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তামাকের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করলে ধারনা করা হয় যে, তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমবে এবং এই সকল পন্য ব্যবহারের কারনে মানুষ যে যে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেসকল রোগ কমতে থাকবে কালানুক্রমিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমে আসবে । তাই উচ্চ কর আরোপ করা হলে সরকারের আয় বাড়বে এবং স্বাস্থ্য খাতে অধিক বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধির ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা একটি বিশ্বব্যাপী পরীক্ষীত পদ্ধতি, কিন্তু বাংলাদেশের তামাক কর ব্যবস্থায় বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশে সিগারেট চারটি স্তরে কর আরোপ করা হয়—নিম্ন, মধ্য, উচ্চ ও প্রিমিয়াম। এই জটিল কর কাঠামোর কারণে কর ফাঁকির সুযোগ থেকে যায় এবং নিম্নস্তরের সস্তা সিগারেট সহজলভ্য থাকে।
ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে সিগারেট, বিড়ি সহ অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের উপর কর কাঠামো বিদ্যমান কিন্তু এই কর কাঠামো দুর্বল হওয়ায় তা এখনও কার্যকরভাবে তামাকপণ্যের ব্যবহার কমাতে পারেনি। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে নিম্ন স্তর এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে প্রতি শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হলে, এছাড়াও সকল স্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৭% করা হলে তামাকের ব্যবহার কমবে। এছাড়া উচ্চ স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার প্যাকেটের সর্বনিম্ন মূল্য ১৪০ টাকা, এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার প্যাকেটের সর্বনিম্ন মূল্য ১৯০ টাকা করা হলে তামাকপণ্যের ব্যবহার কমবে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হবে।
প্রবন্ধে বলা হয়, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৪-২৫, এই ছয় অর্থবছরের প্রতিটিতেই সকল স্তরের শলাকার প্যাকেটের দাম অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়েছে। তবে সিগারেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে এক ধাক্কায় অনেকখানি করে দাম বাড়ানো দরকার। অল্প অল্প করে সিগারেটের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখা সম্ভব হয়না। তাতে সিগারেট বরং সহজলভ্য হয়ে ওঠে অন্যান্য পণ্যের তুলনায়। এই কারনেই আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে সিগারেটের দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বাড়ালে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং এর ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। অন্যথায় তামাক কোম্পানিগুলো তরুণদের লক্ষ করে নানা প্রচার চালায়। যদি তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়, তবে তরুণদের মধ্যে ধূমপান শুরুর হার কমে যাবে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা মানুষকে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট নয়। আসন্ন ২০২৫-২৬ বাজেটে তামাকপণ্যের প্রস্তাবিত কর বাড়ানো হলে ৬৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রত্যাশিত রাজস্বের চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে, যা বর্তমানের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি। দীর্ঘমেয়াদে ১৭ লাখ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব (৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫৮ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৮ লাখ ৬৯ হাজার ০৭৯ তরুণ জনগোষ্ঠি), ২৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ধূমপান থেকে বিরত রাখা সম্ভব এবং ১৭ লাখ তরুণকে ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব।
প্রবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দিতে তামাকজাত পণ্যের কর এবং মূল্য বৃদ্ধি করার এখনই উপযুক্ত সময়। কালক্ষেপণ না করে এখনই তামাকপণ্যের উপর কার্যকরীভাবে করারোপ করুন, তামাক কোম্পানির কালো ছায়া থেকে জাতি তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করুন।