আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত গণহত্যা অভিযানের পর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয়। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর দখলদারমুক্ত হয় বাংলাদেশ। এক সাগর রক্ত আর অনিঃশেষ অশ্রুর বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। গৌরবের ৫৫তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসটি আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করবে গোটা জাতি। স্মরণ করবে একাত্তরের শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ। আজকের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামবে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তিনি বলেন, ‘দেশকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে অন্তর্বর্তী সরকার বদ্ধপরিকর।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আসুন, স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশের উন্নয়ন, শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে কাজ করার শপথ গ্রহণ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৬ বছর দেশের মানুষ এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। স্বৈরাচারী শাসক জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে তাদের স্বাধীনতা ও মৌলিক সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান দেশের মানুষকে স্বৈরাচারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছে।’
প্রত্যুষে রাজধানীতে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোর থেকে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের ঢল নামবে। স্বাধীনতা দিবসে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সাময়িকী প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টেলিভিশনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করবে। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো আজ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করবে।
সাভারে উদযাপনের প্রস্তুতি, সর্বসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
সাভার (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসের শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ দিনটিতে জাতির বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এবার ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে ইতিমধ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধকে রংতুলির আচড়ে এবং বাহারি রঙের ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এক মাস ধরে গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে দিনরাত কাজ করে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ধুয়েমুছে পরিপাটি করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মিনার, শহীদবেদি থেকে মূল ফটক পর্যন্ত হেরিংবন্ড পথ সেজেছে আলপনায়। সবুজ চত্বরের মাঝে লাল, নীল, হলুদসহ বাহারি ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌধের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।
দিবসটির প্রথম প্রহরে স্মৃতিসৌধ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তাদের দেওয়া হবে তিন বাহিনীর গার্ড অব অনার। এরপর সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, বিদেশি কূটনীতিক ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সামাজিক সংগঠনসমূহ, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শহীদবেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর জাতীয় স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, জাতীয় স্মৃতিসৌধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ২৬ মার্চ ভোরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন। এরপর সাধারণ জনগণের জন্য মূল ফটক খুলে দেওয়া হবে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রাথমিকভাবে সৌধ এলাকায় প্রবেশাধিকার সীমিত রাখা হয়েছে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবস ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি চার স্তরের নিরাপত্তাবলয়ে তিন সহস্রাধিক সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত।
এদিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিএনপি মহাসচিবের আগমন উপলক্ষে স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আশুলিয়া থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর মিয়া। তিনি বলেন, ‘এবার ভিন্ন আঙ্গিকে দলীয় হাজারো নেতাকর্মী নিয়ে তারা উপস্থিত থাকবেন।
সাভারের নবীনগর এলাকায় ৮৪ একর জমিতে ১৯৭২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরে ১৫০ ফুট উচ্চতার সৌধ মিনারসহ পুরো চত্বরটি ১৯৮৮ সালে সম্পন্ন হয়।
তারেক রহমানের বাণী
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘এদিনে দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তার ঐতিহাসিক ঘোষণায় সেই মুহূর্তে দিশেহারা জাতি পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভয়মন্ত্র। একটি শোষণ, বঞ্চনাহীন, মানবিক মর্যাদা ও সাম্যের উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে গণতন্ত্রবিনাশী শক্তির চক্রান্ত এখনো থেমে নেই।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আজও তাই এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। ফ্যাসিবাদের পতনের পর এখন সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলা নিশ্চিত করা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সংহত করা।’
সব শাখাকে স্বাধীনতা দিবস পালনের আহ্বান জামায়াতের আমিরের
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য জামায়াতের সব শাখা এবং দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘সংকটময়’ উল্লেখ করে মহান আল্লাহর কাছে দেশবাসীর কল্যাণ এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাজত কামনা করেন।
ডাকটিকিট অবমুক্ত করলেন প্রধান উপদেষ্টা
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব ড. মুশফিকুর রহমান, ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম শাহাবুদ্দিন।
বিএনপির দুই দিনের কর্মসূচি
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। গত সোমবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ইতিমধ্যে গতকাল প্রথম দিনের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।
আজ (২৬ মার্চ) ভোরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৮টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং সেখান থেকে শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও কবর প্রাঙ্গণে মিলাদ মাহফিল।
সারা দেশে জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌরসহ সব ইউনিট মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা এবং অন্যান্য কর্মসূচির আয়োজন করবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।