মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

রাজনৈতিক দলের ঠিকানা শ্বশুরবাড়ি স্টোররুম!

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৩৩ পিএম

রাজধানীর পুরান ঢাকার রমাকান্ত নন্দী লেনের ১৬ নম্বর বাড়িটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধন পাওয়ার আবেদন করেছে বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণময় পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দল। উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই নামে কোনো দলের কার্যালয় সেখানে নেই। দলের সাইনবোর্ডও পাওয়া যায়নি।

ঠিক নিচেই একটি মুদি দোকান রয়েছে ভবনের মালিকের। তার কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে চাইলে বেশ অবাক হন তিনি। বলেন, ‘আমার ভবনের ওপরে সব ফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্ট। নিচের তলার ঘরগুলো দোকানের জন্য ভাড়া দেওয়া। এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস নেই। এই প্রথম দলটির নাম শুনলাম। তাদের কোনো কার্যক্রম কখনো দেখিনি।’

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. শিপন ভূঁইয়া এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে হাজি মো. বাখু মৃধার নাম উল্লেখ রয়েছে। আবেদনে উল্লিখিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে কয়েক মিনিট পর হাজির শিপন ভূঁইয়া। দলের কার্যালয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পাশের একটি গলিপথ দিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। এরপর তালাবদ্ধ একটি স্টোররুম খুলে বলেন, ‘এটাই আমাদের কার্যালয়।’

দেখা গেল, ভেতরে মাত্র ২০-৩০ স্কয়ার ফিট জায়গা। সেখানে চশমার বিভিন্ন জিনিস রাখা হয়েছে। স্টোররুমের পাশেই ঘি তৈরির কারখানা আর ভাজা-পোড়ার দোকান।

তিনি জানান, ‘আমরা এটাকেই পার্টি অফিস বানাব। এখন স্টোররুম। ছেলেদের বলেছি পরিষ্কার করতে। দু-একদিনের মধ্যে চেয়ার-টেবিল আনা হবে।’

নিবন্ধনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতি আমার পছন্দ না। তাই নিজেই দল গড়ছি। গত ছয় মাসে কিছু মিটিং হয়েছে; খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে কাজ হচ্ছে।’ তিনি নিজেকে প্রবাসফেরত পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘প্রবাসীরাই আমার দলের সমর্থক।’

দলটির চেয়ারম্যান বলেন, ‘গঠনতন্ত্র বা ঘোষণাপত্র এখনো নেই। গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ চলছে, শিগগির প্রকাশ করব।’

বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি (বাজপা) নামের আরেকটি দলও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে; তাদের কার্যালয়ের  ঠিকানা: ২৭ শশীমোহন বসাক লেন। উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেটি একটি আবাসিক ভবন। দলটির খোঁজ নিতে গেলে বাড়ির ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে আসেন। তিনি নিজেকে বাড়ির মালিক দাবি করে বলেন, ‘এ বাড়িতে রাজনৈতিক দলের কোনো কার্যালয় নেই। যিনি এ ঠিকানা উল্লেখ করেছেন তিনি আগে এখানে থাকতেন; এখন থাকেন না।’

এ ব্যাপারে দলের সভাপতি ড. সৈয়দ জাভেদ মো. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এবং সংসদ সদস্যও ছিলেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। পার্টি গঠনের ২ বছর পর তার মৃত্যু হয়। তবে দলীয় কার্যক্রম থেমে থাকেনি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে আমাদের পার্টির অংশগ্রহণ ছিল।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। ওয়ারীতে আমার শ^শুরবাড়ি। সেটাকে অস্থায়ী দলীয় কার্যালয় দেখিয়েছি। মতিঝিল ও গুলশানেও আমাদের অফিস আছে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আমাদের কাজ আছে।’

নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ জনশক্তি পার্টিও। তাদের ঠিকানা রাজধানীর দিলকুশায়। ইসিতে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে কোনো সাইনবোর্ড বা দলের কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। উল্লিখিত ভবনের কেউ এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি। দলটির আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম ও সদস্য সচিব জহির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাদের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

ঢাকার বাইরে থেকেও বেশ কিছু দলের নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে ইসিতে। ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের বাসিন্দা কে এম নূর ইসলাম সিকদার বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্য দল নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন গত ১৭ এপ্রিল। ২০০৯ সালে একবার তিনি ‘বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্য দল’ নামে নিবন্ধনের আবেদন করে ব্যর্থ হন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা কে এম নূর ইসলাম সিকদার সাবেক বিজিবি সদস্য।

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের সব শর্ত মেনেই কে এম নূর ইসলাম সিকদার নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন দাবি করলেও তার কথার সঙ্গে বাস্তবতার অমিল দেখা গেছে। আবেদনে তিনি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার পৌর সদরের স্টেশন রোডের রহমানিয়া সুপার মার্কেটে দলটির প্রধান কার্যালয় উল্লেখ করলেও গত বুধবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দলটির কোনো কার্যালয় বা সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। মার্কেটের কেউ বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্য দলের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি।

এ ব্যাপারে কে এম নূর ইসলাম সিকদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঝড়ে সাইনবোর্ড ভেঙে গেছে।’ প্রধান কার্যালয় ঢাকায় না হয়ে কেন উপজেলায় এ প্রশ্নের সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্য দলের দেশের কোনো উপজেলা কিংবা জেলায় কার্যালয় থাকার খবর পাওয়া যায়নি। কে এম নূর ইসলাম সিকদার বলেন, ‘নির্বাচনের খবর নেই, তাই কার্যালয় নেই।’

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য গত ১০ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্বাচন কমিশন। আবেদনের সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। গত ২২ এপ্রিলের তথ্যানুযায়ী ৬৫টি দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। ইসির নিবন্ধন পেতে চায় বাংলাদেশ রক্ষণশীল দল (বিসিপি), সংবিধান বিষয়ক জনস্বার্থ পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ সংসারবন্দি পার্টি প্রভৃতি। বাহারি নামের অপরিচিত সব দল।

আরও যারা আবেদন করেছে

বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টি, বাংলাদেশ তৃণমূল জনতা পার্টি, বাংলাদেশ নাগরিক আন্দোলন পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জনতা পার্টি, জাস্টিস পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জেনারেল পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ শাহজাহান সিরাজ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), জনতার কথা বলে, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, জাতীয় পেশাজীবী দল, বাংলাদেশ জনতা ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় ইনসাফ পার্টি,  বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি , বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, বাংলাদেশ জনজোট পার্টি, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জনগণের পার্টি, অহিংস গণআন্দোলন, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, মৌলিক বাংলা, বাংলাদেশ জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন পার্টি ও বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি।

এছাড়া বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ জনগণের দল (বাজদ), ফরোয়ার্ড পার্টি, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, স্বাধীন জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ শান্তির দল, সংবিধান বিষয়ক জনস্বার্থ পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), বাংলাদেশ গণঅভিযাত্রা দল, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি, ন্যাশনাল লেবার পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ), জনতা মহাজোট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জনতার ঐক্য, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, নিউক্লিয়াস পার্টি, ইউনাইটেড বাংলাদেশ পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ মাতৃভূমি দল, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ পাক পাঞ্জাতন পার্টি, সাধারণ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি ও ন্যাপ ভাসানী।

এর বাইরেও বেশ কিছু দল গত কয়েক মাসে গঠিত হলেও তারা নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। ইসি নিবন্ধনের আবেদনের সময় ২ মাস বাড়িয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২২ জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করা যাবে।

কেন সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে জানতে চাইলে গত রবিবার ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করেছে। বিভিন্ন মেয়াদে সময়সীমা বাড়াতে বলেছে তারা। কেউ ২ মাস, কেউ ৬ মাস। সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কমিশনের।’

২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে সংশোধিত আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অনুযায়ী দলগুলোর নিবন্ধন চালু হয়। ওই সময় শর্তসাপেক্ষে ৪০টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, একটা যোগ্যতা নিয়ে যেন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়।

বিগত সময়ে নিবন্ধন পদ্ধতি এবং যেসব দলকে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেশ কয়েকটি দল। যদিও এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ওই সময়ের নির্বাচন কমিশন।

নিবন্ধনের শর্ত কিছুটা সহজ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী আনার সুপারিশ করেছে নির্বাচনীব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তাদের সুপারিশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, ফলে বিদ্যমান আইন মেনেই রাজনৈতিক দলগুলোকে আবেদন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিদ্যমান আইনেই নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। যদি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯০ (ক) ধারা অনুযায়ী, বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে চাইলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে। প্রথমত, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসনে বিজয়; দ্বিতীয়ত, সেসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন সেগুলোতে মোট ভোটের ৫ শতাংশ অর্জন এবং তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে; অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় জেলা অফিস থাকতে হবে আর অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটান থানায় অফিস থাকতে হবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ জন ভোটার থাকবে।

এছাড়া নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলের গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখা প্রভৃতি।

অন্তর্র্বর্তী সরকারের নির্বাচনীব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নিবন্ধনের জন্য কিছু শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করেছে। যেমন নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ উপজেলা বা থানায় দলের অফিস এবং দলটির কমপক্ষে পাঁচ হাজার সদস্য থাকতে হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত