পারমাণবিক প্রযুক্তি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তো দূরের কথা, ন্যূনতম ধারণাও নেই যাদের তারা প্রায়ই প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও মতবিনিময় সভায় অংশ নিতে বিদেশে যান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এমন কাজ হরহামেশা করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মসূচিতে যাদের অংশ নেওয়া জরুরি সেই পরমাণু বিজ্ঞানীদের অনেককেই তারা বাধা দেন এবং নানাভাবে হয়রানি করেন। পারমাণবিক প্রযুক্তির জটিলতা ও স্পর্শকাতরতা তারা আমলেই নেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নিরাপদ সম্প্রসারণে পরমাণু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণ এবং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে জ্ঞানবিনিময়ের জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে ওইসব কর্মসূচির আয়োজন করা হয়ে থাকে। যারা পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা ও গবেষণা করেন তারাই এগুলোতে অংশ নিয়ে থাকেন। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এ কারণে দেশের পরমাণু শক্তির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অর্থের নয়ছয় হচ্ছে। অন্যদিকে যারা সত্যিই এ খাতে কাজ করতে চান তারা বঞ্চিত ও হতাশ হচ্ছেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশে পরমাণু বিষয়ক প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, মতবিনিময় সভা প্রভৃতি কর্মসূচিতে অংশ নেন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, কোরিয়া প্রভৃতি দেশ রয়েছে।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে পরের ১ বছরে প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা পরমাণু বিষয়ক নানা কর্মসূচি উপলক্ষে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বলে দেশ রূপান্তরের হাতে তথ্য রয়েছে। এর আগেও প্রতিবছর কমবেশি প্রায় একই সংখ্যক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন।
কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক ওইসব প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার বিষয়বস্তু ছিল পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও নিরাপদ পরিবহন; পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তুতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, পরমাণু বিষয়ক জ্ঞানের আদান-প্রদানে মতবিনিময়, নীতিনির্ধারণী সভা প্রভৃতি। মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা এগুলোতে একাধিকবার অংশ নিয়েছেন।
আমলাদের এ ধরনের বিদেশ ভ্রমণকে প্রশিক্ষণের নামে ‘প্লেজার ট্রিপ’ আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পারমাণবিক প্রযুক্তির মতো বিশেষায়িত বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদেরই অংশ নেওয়া দরকার যারা এ খাতে কাজ করছেন এবং যাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের লোকদের কী কাজ? বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে পরমাণু বিদ্যার মতো জটিল বিষয় তো তারা বুঝবেন না। প্রকৃতপক্ষে যাদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে ও অর্থের নয়ছয় করা হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও তা নেই।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘একটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি শক্তিশালী করতে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি। এটি করার জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। কিন্তু প্রকল্পের শুরু থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক চুল্লির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর গুণগত মান নির্ণয়ে রাশিয়া পরিদর্শন করেছেন ও বৈঠক করেছেন। তারা কীভাবে দেশের পারমাণবিক ভিতকে শক্তিশালী করছেন তা জাতি জানতে চায়। তারা ঘোরাঘুরি ছাড়া দেশের স্বার্থে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এতে ‘নিউক্লিয়ার কালচার’ নষ্ট হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পরমাণু শক্তি কমিশনেরও সংশ্লিষ্টহীন অনেকেই বহু কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন।’
পরমাণু শক্তির গবেষণা ও সম্প্রসারণে কাজ করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপে সংস্থাটি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা। তারা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। এ নিয়ে তারা আন্দোলন করছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, কমিশনের চাকরি বিধিমালা-১৯৮৫-এর অনুচ্ছেদ ৩৪ অনুযায়ী বিদেশে উচ্চশিক্ষা, ফেলোশিপ, গবেষণা, ভিজিটিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের পূর্বানুমতি ও মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের।
২০১৬ সালে কমিশনের এ অধিকার ক্ষুণœ করে মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১১ সাল থেকে বিদেশ যেতে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আগে কমিশনের অধীনেই ছিল এসব দায়িত্ব।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের কারণে আমেরিকা, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে পূর্ণ স্কলারশিপ থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু বিজ্ঞানীকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার অনুমতি না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিজ্ঞানীকে বিদেশের সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের জিও দেওয়া হয়নি।
পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আসাদ শরীফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরমাণু নিয়ে আন্তর্জাতিক কর্মসূচিগুলো উচ্চমানের। যাদের এ বিষয়ে জ্ঞান বা ডিগ্রি নেই তারা বিদেশ গিয়ে ঘোরাঘুরি আর শপিং করা ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না।’
তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণ, কর্মশালার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে জ্ঞানবিনিময়ের কাজও থাকে। নানা গবেষণা নিয়ে আলোচনা হয়। আলাপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিজেদের সমৃদ্ধ করেন। এসব আলোচনায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চুপচাপ বসেই থাকেন। অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা অনেক সময় বিরক্ত হন। এতে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হয়। তারপরও মন্ত্রণালয়ের কর্তারা এসব কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আমাদের মতো বিজ্ঞানীদের বিদেশ যেতে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। ৪-৫ মাস আগে থাইল্যান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারিনি সময়মতো মন্ত্রণালয়ের জিও না পাওয়ার কারণে।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা বিভিন্নজন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। ফলে আন্তর্জাতিক কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা কর্মশালায় কাকে পাঠালে দেশের উন্নয়ন হবে তা কমিশনই ভালো জানে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পছন্দমতো লোক মনোনয়ন দেন। সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যক্তিকেও মনোনয়ন দেয় মন্ত্রণালয়। আর বিজ্ঞানীদের মনোনয়নের পর জিও দেওয়াতেও সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে বিদেশে পাঠানো হয়। কমিশন অসহায়।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘চাকরি বিধিমালায় এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ কমিশনে চাকরি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে কমিশনের বিজ্ঞানীরা উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বঞ্চিত থাকছেন।’
যুক্তরাষ্ট্রে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়েও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখে পড়তে যেতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন পরমাণু শক্তি কমিশনের মুখ্য ভূতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান সুমন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বৃত্তি খুব কমই পাওয়া যায়। কারণ ছাড়াই আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার সচিবালয়ে তার দপ্তরে গিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।