বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ক্যানভাসে আঁকা জীবন ও যন্ত্রণার আখ্যান

আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৭ এএম

ফ্রিদা কাহলো এক ব্যতিক্রমী চিত্রকর, যিনি তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন, মেক্সিকোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর নারীর আত্মপরিচয়ের গভীর দর্শন। তার জন্মদিন আজ। তাকে নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

ফ্রিদা কাহলো এই নামটি যেন এক প্রতিধ্বনি, যা যুগ যুগ ধরে সংগ্রামী মানুষদের হৃদয়ে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণার সুর তোলে। তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পী নন, বরং এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যিনি তার শারীরিক যন্ত্রণাকে, মানসিক টানাপড়েনকে, প্রেম-বিচ্ছেদকে, এমনকি মৃত্যুর ছায়াকেও তার শিল্পে রূপ দিয়েছেন আত্মজৈবনিক ভাষায়। তিনি এক ব্যতিক্রমী চিত্রকর, যিনি তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন, মেক্সিকোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর নারীর আত্মপরিচয়ের গভীর দর্শন। তার শিল্পকর্ম শুধু চিত্র নয়, যেন তার জীবনেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

ফ্রিদার জীবন ছিল অসাধারণভাবে জটিল, কঠিন এবং তবু সৃজনশীলতায় ভরপুর। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পোলিওতে আক্রান্ত হন, যার ফলে তার ডান পা ক্রমশ ক্ষীণ ও বিকৃত হয়ে পড়ে। এরপর, ১৮ বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা একটি ট্রাম দুর্ঘটনায় তার মেরুদ-, পেলভিস, পা ও কাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তিনি হয়তো আর কখনো হাঁটতেই পারবেন না। সেই সময় শুয়ে শুয়ে কাটানো অসংখ্য একাকী দিনের ভেতরেই তার হাতে তুলি ওঠে। ক্যানভাসে তিনি আঁকতে থাকেন নিজেকে নিজের দেহ, নিজের ক্ষত, নিজের যন্ত্রণা, নিজের ভালোবাসা, আর নিজের সমাজকে। এই জায়গাটাই ফ্রিদাকে অনন্য করে তোলে। অধিকাংশ মানুষ যখন কষ্ট থেকে পালাতে চান, ফ্রিদা কষ্টকে চিত্রকর্মে পরিণত করেন। নিজের দেহ, নারীত্ব, মাতৃত্বহীনতা, ভালোবাসার জটিলতা এই সব বিষয় তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ফ্রিদার চিত্রকলা আত্মজৈবনিক, কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং দার্শনিক। তার চিত্রে যেভাবে শরীর ও মন, যন্ত্রণা ও সৌন্দর্য, দেশপ্রেম ও বিদ্রোহ একত্র হয়েছে, তা কেবল একজন সংগ্রামী মানুষই করতে পারেন। তিনি নিছক একটি ‘ভিক্টিম’ নন তিনি যন্ত্রণাকে নান্দনিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি একাধারে একজন নারীবাদী, একজন প্রতিবন্ধী শিল্পী, একজন মেক্সিকান রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মী এবং এক অন্তর থেকে ফুটে ওঠা চিত্রশিল্পী। ফ্রিদা নিজেকে নিছক ‘স্ত্রী’, ‘ব্রতী’, কিংবা ‘নারীমাত্র’ হিসেবে কখনো সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং, সমাজ ও সংস্কৃতির সীমারেখাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন এক সর্বজনীন মানবিক চেতনার ধারক হিসেবে।

তার বিখ্যাত উক্তি “Feet, what do I need you for when I have wings to fly?” এই কথাটি শুধু তার শারীরিক সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বরং প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের হৃদয়ের জন্য এক উদ্দীপনা। ফ্রিদা শেখান, শরীরের সীমা থাকলেও চেতনার কোনো সীমানা নেই।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপন্ন, বঞ্চিত এবং ব্যথাতুর মানুষের কাছে ফ্রিদা এক বিশাল শক্তির নাম। যারা যুদ্ধ করছেন নিজের দেহের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, ভালোবাসার বিভ্রান্তির সঙ্গে কিংবা একটি অর্থপূর্ণ পরিচয়ের সন্ধানে তাদের কাছে ফ্রিদার জীবন এক অনুপম শিক্ষা। তার প্রতিটি চিত্র, প্রতিটি আত্মপ্রতিকৃতি আমাদের শেখায়, কীভাবে যন্ত্রণাকে রঙে রূপ দেওয়া যায়, কীভাবে নিঃসঙ্গতা থেকেও সৃষ্টি করা যায় সাহসের ভাষা।

আজ যখন আমরা নিজেদের ভেতরের ভাঙাচোরা অংশগুলো নিয়ে লড়াই করি, তখন ফ্রিদা কাহলো আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তিনি বলেন না, ‘দুঃখকে অস্বীকার করো’, বরং বলেন, ‘তোমার দুঃখকেও ভালোবাসো, কারণ সেটাই তোমাকে গড়ে তোলে’।

যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ও আত্মপ্রতিকৃতি

ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকলার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আত্মপ্রতিকৃতি (Self-portraits)। প্রায় ১৪৩টি ছবির মধ্যে ৫৫টিরও বেশি ছিল তার নিজের প্রতিচ্ছবি। এগুলো কেবল চেহারার বর্ণনা ছিল না, বরং তার ভেতরের জগৎ, তার আবেগ, অনুভূতি এবং বাস্তবতার প্রতীকী উপস্থাপন। শৈশবের পোলিও আর ১৯২৫ সালের ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। মেরুদন্ড, পা ও পেলভিসে গুরুতর আঘাতের পর তাকে দীর্ঘ সময় বিছানায় কাটাতে হয়, অসংখ্য অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই শারীরিক যন্ত্রণা ও কষ্ট (Physical Pain and Suffering) তার প্রতিটি ছবিতে ধরা পড়েছে নির্মম সত্য রূপে। ‘দ্য ব্রোকেন কলাম’ (The Broken Column) ছবিতে দেখা যায়, তার শরীর যেন একটি ভাঙা স্তম্ভের মতো, যেখানে পেরেক বিদ্ধ হয়ে আছে। এই চিত্রকর্মগুলো শুধুমাত্র শারীরিক কষ্টের চিত্র নয়, বরং নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে তার এক অবিরাম লড়াইয়ের কাহিনি। ফ্রিদা বলতেন, ‘আমি স্বপ্ন আঁকি না, আমি আমার নিজের বাস্তবতা আঁকি।’ তার ছবিতে বাস্তবতা প্রায়শই পরাবাস্তব উপাদানের সঙ্গে মিশে যেত, যা তার ভেতরের জগৎকে এক ভিন্ন মাত্রা দিত।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রঙ

ফ্রিদা ছিলেন তার জন্মভূমি মেক্সিকোর প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত। তার চিত্রকর্মে বারবার ফিরে এসেছে মেক্সিকান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (গবীরপধহ ঈঁষঃঁৎব ধহফ ঞৎধফরঃরড়হ)। তিনি মেক্সিকান লোকশিল্প, প্রাক-হিস্পানিক ভাস্কর্য এবং ক্যাথলিক ধর্মীয় রপড়হড়মৎধঢ়যু-এর প্রভাব তার কাজে এনেছেন। রঙিন মেক্সিকান পোশাক, স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ব্যবহার করে তিনি যেন নিজের জাতীয়তাবাদী সত্তাকেই তুলে ধরতেন।

মেক্সিকান বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাসী ফ্রিদা তার শিল্পে নিজস্ব জাতিসত্তার এক শক্তিশালী পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। 

নারীর কণ্ঠস্বর

ফ্রিদা কাহলো কেবল একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন নারী। তার চিত্রকর্মে তিনি নারীর ভূমিকা ও লিঙ্গ পরিচয় (Mexican Culture and Tradition) নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রচলিত সামাজিক প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে তিনি নারীর ক্ষমতা, দুর্বলতা এবং আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কিছু ছবিতে তিনি প্রচলিত নারীত্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, এমনকি নিজের বাইসেক্সুয়ালিটি এবং জেন্ডার ফ্লুইডিটি প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি। তার কাছে শিল্প ছিল নিজেকে প্রকাশ করার, নিজের কষ্ট, আনন্দ, স্বপ্ন এবং বিভ্রমকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার একটি মাধ্যম।

মৃত্যু ও পুনর্জন্ম

মেক্সিকান সংস্কৃতিতে মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ফ্রিদার চিত্রকর্মেও বারবার দেখা যায়। তিনি জীবনের এই অনিবার্য অংশকে ভয় পাননি, বরং একে পুনর্জন্মের এক নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখেছেন। তার ছবিতে মৃত্যু এবং জীবনের চক্রাকার প্রবাহের এক দার্শনিক অন্বেষণ দেখা যায়, যা মেক্সিকান ‘ডে অফ দ্য ডেড’ (উধু ড়ভ ঃযব উবধফ) উৎসবের ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

ফ্রিদা কাহলোর শিল্প আজও বিশ্ব জুড়ে মানুষকে মুগ্ধ করে। কারণ এটি কেবল একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত গল্প নয়, বরং মানবিক কষ্ট, টিকে থাকার আকাক্সক্ষা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আত্ম-আবিষ্কারের এক শক্তিশালী ও মর্মস্পর্শী আখ্যান। তার জীবন এবং কাজ যেন এক অবিরাম কথোপকথন, যা আজও আমাদের ভেতরের জগৎকে নাড়া দেয়।

আরও কিছু সংগ্রামী শিল্পী

ফ্রিদা কাহলো একজন বিরল শিল্পী তার মতো গভীর আত্মচেতনা, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার প্রকাশ এবং রাজনৈতিক অবস্থানকে শিল্পে মূর্ত করে তোলা সত্যিই দুর্লভ। তবে ফ্রিদার মতোই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন কিছু শিল্পী আছেন, যাদের কাজও আত্মজৈবনিক, সমাজ সচেতন এবং অস্তিত্বগত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে এক নান্দনিক ভাষায়। পাঠক যদি ফ্রিদার কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পান, তবে এদের কাজও দেখার মতো কারণ এরাও শিল্পকে ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত ক্ষত থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক সঙ্কেত তৈরির মাধ্যমে। ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া লুইস বুউর্জোয়া, যিনি জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত শিল্পচর্চা করে গেছেন, তার শিল্পে শৈশবের ট্রমা, পারিবারিক জটিলতা, নারীত্ব ও দেহ নিয়ে গভীর অনুসন্ধান রয়েছে। তার বিশাল মাকড়সা ভাস্কর্য ‘গধসধহ’ নিছক একটি প্রাণীর মূর্তি নয় তা মায়ের প্রতীক, এক নারীর জটিল অস্তিত্বের রূপক। আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উঠে আসা যায়না ব্যাসেট, যিনি নিজেকে ‘ভিজ্যুয়াল অ্যাক্টিভিস্ট’ বলেন, ফটোগ্রাফির মাধ্যমে তার নিজস্ব কুইয়ার পরিচয় ও আশপাশের নিপীড়িত সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে দৃশ্যমান করেছেন। সমাজে যারা প্রান্তিক, যাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না, যায়নার ক্যামেরা সেই নিঃশব্দগুলোর কথা বলে। জাপানের ইয়ায়োই কুসামা এক ভিন্নধারার শিল্পী, যার শিল্পজগৎ গঠিত হয়েছে মানসিক বিকার, হ্যালুসিনেশন ও নিজের অস্তিত্বের সংকট থেকে। আজীবন মানসিক চিকিৎসায় থেকেও তিনি সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন তার পোলকা ডট আর অন্তহীন ঘূর্ণায়মান জগৎ দিয়ে, যা যেন এক নারীর অন্তর্জগতের বিপুল বিস্তার। ভারতের আমৃতা শের-গিলের জীবনও ছিল ফ্রিদার মতোই দ্বন্দ্বময় তিনি ইউরোপে শিক্ষিত এক আধুনিক নারী, কিন্তু তার শিল্প গভীরভাবে ভারতীয়, দেশজ এবং প্রান্তিক নারীদের বাস্তবতা ঘিরে আবর্তিত। তার কাজেও রয়েছে ফ্রিদার মতো আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা এবং ঔপনিবেশিক সমাজে নারীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন।

এছাড়াও, ব্রিটিশ শিল্পী ত্রেসি এমিন তার শিল্পে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন নারীদেহ, যৌনতা, গর্ভপাত, নিঃসঙ্গতা ও মানসিক ভাঙনের প্রতিচ্ছবি। তিনি যেমন নিজেকে কখনো লুকাননি, তেমনি দর্শকের চোখেও রাখেননি কোনো রঙচঙে পর্দা। অন্যদিকে, ইরানি শিল্পী শিরিন নেশাত ইসলামি সংস্কৃতি ও নারীর দেহ নিয়ে যে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন তার ভিডিও এবং স্থিরচিত্রে, তা আজকের মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এদের প্রত্যেকের মধ্যে ফ্রিদার ছায়া আছে কিন্তু তারা কেউ ফ্রিদার নকল নন। বরং তারা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ব্যথা, নিজস্ব ইতিহাস এবং নিজস্ব বাস্তবতা থেকে শিল্প রচনা করেছেন এবং তাতে উঠে এসেছে এমন কণ্ঠ, যা প্রথা ভেঙে নতুন ভাষা তৈরি করেছে। পাঠক চাইলে ফ্রিদা কাহলো ছাড়াও এই শিল্পীদের কাজ দেখতে পারেন। কারণ এই শিল্পীরাও যন্ত্রণাকে সাহস, নিঃসঙ্গতাকে সৌন্দর্য এবং প্রান্তিক অবস্থানকে প্রতিবাদের রূপ দিয়েছেন। তাদের শিল্পও, ফ্রিদার মতোই, ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, নান্দনিক এবং আঘাতময় আর ঠিক সেখানেই তারা হয়ে ওঠেন সংগ্রামী আত্মাদের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত