অর্থনৈতিক সক্ষমতা নয়, আবেগের প্রতীক
মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী | ২৪ জুন, ২০২২ ০০:০০
বহুল কাক্সিক্ষত সোনালি স্বপ্নের দ্বার পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আবেগ বিজড়িত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দক্ষিণের ২১ জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বয়ে আনবে এক নতুন বিপ্লব। নির্মিত সেতুটি নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ৬.১৫ কিলোমিটারের এ সেতুকে ঘিরে যত গল্পকথা, আলোচনা ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা যেন স্থাপত্য ইতিহাসে এক বিরল মহাকাব্য। সেতুর একপ্রান্ত মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও অন্যপ্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরায় মিলিত হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষের সেতুবন্ধন তৈরি করবে সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে। মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী যার স্বপ্নে বিভোর ছিল গত অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে যুগলবদ্ধ হয় স্রোতস্বিনী পদ্মার দু’কূল। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার চালিকাশক্তি হিসেবে পদ্মা সেতু অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে অনুরণিত হয় বারংবার।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ঘনবসতিপূর্ণ। যে কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা শুধু চ্যালেঞ্জিংই নয় বরং দুরূহও বটে। বাংলাদেশের বুক চিড়ে প্রায় সাতশ নদ-নদীর গড়ে ওঠা নেটওয়ার্কের মধ্যে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন পদ্মাই অন্যতম যা দিয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলধারা বঙ্গোপসাগরে মেশে। বিশে^র সবচেয়ে খরস্রোতা নদী আমাজনের পরেই পদ্মার অবস্থান যার খরস্রোতা প্রকৃতির কারণে দু’কূলের মানুষ দিশেহারা হয়ে এর নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। জলপ্রবাহের এমন বিধ্বংসী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা ছিল যত না চ্যালেঞ্জের, তার চেয়ে ঢের সাহসিকতার। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে চ্যালেঞ্জ জয়ে প্রস্তুত আজ বাংলাদেশ। সোনালি স্বপ্নের উন্মোচন অতি সন্নিকটে।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। এ আশা বঙ্গীয় বদ্বীপের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হররোজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ (পৃষ্ঠা-৫) এ বিশেষ অঙ্গীকার হিসেবে মেগা প্রকল্পের দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে যার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ উল্লেখ করা হয় ‘মেগা প্রকল্প লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’য় অবকাঠামো রূপান্তরের লক্ষ্যে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, কক্সবাজার-দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ত্বরান্বিত করার কথাও ইশতেহারে বলা হয়েছে। এ প্রকল্পসমূহের শতকরা ৮০ ভাগ অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতিতে আমূল পরিবর্তন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। একটি সেতুকে কেন্দ্র করে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণের জনপদ, উন্নয়ন ঘটছে জীবনমানের। বিশ^ব্যাংকের তথ্যমতে পদ্মা সেতুর ফলে আঞ্চলিক বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ ও দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশেরও অধিক হারে বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে সংযোগকারী সেতুটি স্থানীয় দারিদ্র্য ১.৯ শতাংশ এবং জাতীয় দারিদ্র্য ০.৯ শতাংশ হ্রাস করবে যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ।
কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যেও পদ্মা সেতু নিয়ে আসবে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে অগ্রগতি আসবে ১০ শতাংশেরও বেশি। গত কয়েক বছরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে আধুনিক কৃষির ব্যাপক আয়োজন ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। নানা ধরনের কর্মকা- শুরু করেছে কৃষক ও কৃষির সঙ্গে জড়িত খামারি ও ব্যবসায়ীরা। পরিবহনের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ, ধান, পান, ফুলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই সরাসরি ঢাকায় আসতে পারত না। আর এলেও দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সরবরাহের পরিমাণ ছিল কম। ফলে, ঢাকায় চড়া দাম হলেও স্থানীয় বাজারে তা সস্তায় বিক্রি হতো। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষক পণ্য নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর শিকল ভেঙে ঢাকায় আসবে। ফলে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হবে, অন্যদিকে কমে আসবে নিত্যপণ্যের দাম।
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে বিশে^র স্বনামধন্য অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানসমূহ করতে শুরু করেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালেই তার বাৎসরিক রিটার্ন দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। শিল্পের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের জেলাগুলোতে গড়ে উঠছে বড় বড় সব শিল্পকারখানা। পদ্মার ওপারে গেলে শত-শত কোম্পানির বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড থেকে বুঝা যায় ভারী শিল্পের এক অনন্য জনপদে পরিণত হতে প্রস্তুত হচ্ছে অঞ্চলটি। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে আনুমানিক ২-৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা যাবে এ অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নে যার ফলে কর্মসংস্থান হবে ১০ লাখের বেশি মানুষের।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় শিল্পায়ন, ব্যবসা খাত ও বাণিজ্যের বিকাশের বদৌলতে ২.৫ কোটির অধিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজ করছে পৃথিবীর বৃহৎ নদীশাসন বিশেষজ্ঞ কোম্পানি চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। নদীশাসনের জন্য প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে ৯ হাজার হেক্টরের বেশি আবাদি জমি যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু যে শুধু দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকেই জোড়া লাগাবে তা নয় ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বড় নিয়ামক হয়ে উঠবে। ১ লাখ ৪১ হাজার কিমি দৈর্ঘের এ হাইওয়ে পদ্মা সেতুতে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। শুল্ক আদায় হবে স্বাভাবিকের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। দক্ষিণের কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ভোলার শত-শত নয়নাভিরাম চর, এমনকি পদ্মা সেতুর দুই পাড় হয়ে উঠবে পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার মানুষ ব্যস্ততার কারণে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে হাজার কোটি টাকার পর্যটন শিল্প।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছি। আগামী ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে পদ্মা সেতু অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি’র ১ নম্বর লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন, ২ নম্বর লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তি, ৮ নম্বর লক্ষ্য কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, ৯ নম্বর লক্ষ্য উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, ১০ নম্বর লক্ষ্য বৈষম্য হ্রাস, ১১ নম্বর লক্ষ্য টেকসই নগর ও সম্প্রদায়, ১৫ নম্বর লক্ষ্য ভূমির টেকসই ব্যবহার ও ১৭ নম্বর লক্ষ্য টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সবকটি লক্ষ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। সরকার শত বছরের যে ‘ডেলটা প্ল্যান-১০০’ হাতে নিয়েছে তার প্রাথমিক পদক্ষেপ পদ্মা সেতু।
পদ্মা পাড়ের মানুষ অধীর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছেন ২৫ জুন দিনটির জন্য। দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত্তির পরিচায়ক সেতুটি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ৫০ বছরের দুঃখের অবসান হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে সাংবাদিকদের নিয়ে কৌতুক করে তাদের বলা হয়েছে ‘পিলার সাংবাদিকতা, স্প্যান সাংবাদিকতা’ ইত্যাদি। তবে, একটি স্বনামধন্য দৈনিক সংবাদপত্রের মতে চমকপ্রদ তথ্য হলো ‘পদ্মা ব্রিজ’ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে আসছে ২৩ লাখ তথ্য, ‘পদ্মা সেতু’ লিখলে আসে ১৬ লাখ ২০ হাজার তথ্য আর ‘পদ্মা সেতু সংবাদ’ লিখলে আসে ১০ লাখ তথ্য। ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় আস্থার প্রতীক এ সেতুটিতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১২০ মিটার লম্বা পাইলিং পদ্ধতি।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে হঠাৎ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করে যা ১৬ কোটি বাঙালির জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিছু সুনির্দিষ্ট লোকের স্বার্থের জন্য বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জোয়েলিককে তার শেষ কর্মদিবসে ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন বাতিলে প্রলুব্ধ করে। একে একে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় জাইকা, এডিবি ও আইডিবির মতো দাতা সংস্থাগুলোও। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যেখানে দাতা সংস্থাগুলো অনুদানই করেনি, সেখানে উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। কোনো অলীক কল্পনা বা স্বপ্ন নয়। কোনো ষড়যন্ত্রই টেকেনি জনগণের টাকায় নির্মিত এ স্থাপনা নির্মাণে। যার নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের মে মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ঘোষণার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু হবে আমাদের নিজের টাকায়। আর গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে জ্বলে ওঠে স্ট্রিটলাইট। এ যেন অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমার আলো।
পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তার কথা আরও একবার জানল বিশ্ব সম্প্রদায়। বিশ্বব্যাংকের মতো মোড়ল প্রতিষ্ঠানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করেই ফেলল বাংলাদেশ। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আগামীতে দেশে বৃহৎ প্রকল্প নির্মাণে বিশ্ব দাতা সংস্থাগুলোকে এই বার্তা দিল যে বাংলাদেশ বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান। তাই ২০২০ সালে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য আগাম প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছেন এডিবির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকাহিকো নাকাও। পদ্মা সেতুর প্রশংসা করতে গিয়ে পাকিস্তানের শিক্ষাবিদ ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক পাকিস্তানের বহুল প্রচলিত ‘ডেইলি টাইমস’-Story of Bangladesh’s Padma Bridge: More Than Just A Bridge?' কলামে ভূয়সী প্রশংসা করেন। এছাড়া দেশে-বিদেশে নানান আলোচনা ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে এ সেতু।
প্রায় শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে পদ্মা সেতুর। সর্বশেষ পরিচ্ছন্নতা ও পুনঃনিরীক্ষণের কাজ চলছে। চলমান করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২৩ সাল নির্মাণ সমাপ্তি ধরা হলেও সরকারের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ২০২২ সালের ২৫ জুনেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যমতে, একটি সেতু বদলে দেবে দেশ। আমাদেরও উচ্চাকাক্সক্ষা এই সেতুর মধ্য দিয়েই সূচিত হবে ২০৪১ সালে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীত।
লেখক কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
শেয়ার করুন
মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী | ২৪ জুন, ২০২২ ০০:০০

বহুল কাক্সিক্ষত সোনালি স্বপ্নের দ্বার পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আবেগ বিজড়িত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দক্ষিণের ২১ জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বয়ে আনবে এক নতুন বিপ্লব। নির্মিত সেতুটি নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ৬.১৫ কিলোমিটারের এ সেতুকে ঘিরে যত গল্পকথা, আলোচনা ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা যেন স্থাপত্য ইতিহাসে এক বিরল মহাকাব্য। সেতুর একপ্রান্ত মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও অন্যপ্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরায় মিলিত হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষের সেতুবন্ধন তৈরি করবে সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে। মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী যার স্বপ্নে বিভোর ছিল গত অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে যুগলবদ্ধ হয় স্রোতস্বিনী পদ্মার দু’কূল। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার চালিকাশক্তি হিসেবে পদ্মা সেতু অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে অনুরণিত হয় বারংবার।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ঘনবসতিপূর্ণ। যে কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা শুধু চ্যালেঞ্জিংই নয় বরং দুরূহও বটে। বাংলাদেশের বুক চিড়ে প্রায় সাতশ নদ-নদীর গড়ে ওঠা নেটওয়ার্কের মধ্যে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন পদ্মাই অন্যতম যা দিয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলধারা বঙ্গোপসাগরে মেশে। বিশে^র সবচেয়ে খরস্রোতা নদী আমাজনের পরেই পদ্মার অবস্থান যার খরস্রোতা প্রকৃতির কারণে দু’কূলের মানুষ দিশেহারা হয়ে এর নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। জলপ্রবাহের এমন বিধ্বংসী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা ছিল যত না চ্যালেঞ্জের, তার চেয়ে ঢের সাহসিকতার। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে চ্যালেঞ্জ জয়ে প্রস্তুত আজ বাংলাদেশ। সোনালি স্বপ্নের উন্মোচন অতি সন্নিকটে।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। এ আশা বঙ্গীয় বদ্বীপের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হররোজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ (পৃষ্ঠা-৫) এ বিশেষ অঙ্গীকার হিসেবে মেগা প্রকল্পের দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে যার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ উল্লেখ করা হয় ‘মেগা প্রকল্প লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’য় অবকাঠামো রূপান্তরের লক্ষ্যে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, কক্সবাজার-দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ত্বরান্বিত করার কথাও ইশতেহারে বলা হয়েছে। এ প্রকল্পসমূহের শতকরা ৮০ ভাগ অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতিতে আমূল পরিবর্তন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। একটি সেতুকে কেন্দ্র করে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণের জনপদ, উন্নয়ন ঘটছে জীবনমানের। বিশ^ব্যাংকের তথ্যমতে পদ্মা সেতুর ফলে আঞ্চলিক বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ ও দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশেরও অধিক হারে বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে সংযোগকারী সেতুটি স্থানীয় দারিদ্র্য ১.৯ শতাংশ এবং জাতীয় দারিদ্র্য ০.৯ শতাংশ হ্রাস করবে যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ।
কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যেও পদ্মা সেতু নিয়ে আসবে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে অগ্রগতি আসবে ১০ শতাংশেরও বেশি। গত কয়েক বছরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে আধুনিক কৃষির ব্যাপক আয়োজন ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। নানা ধরনের কর্মকা- শুরু করেছে কৃষক ও কৃষির সঙ্গে জড়িত খামারি ও ব্যবসায়ীরা। পরিবহনের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ, ধান, পান, ফুলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই সরাসরি ঢাকায় আসতে পারত না। আর এলেও দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সরবরাহের পরিমাণ ছিল কম। ফলে, ঢাকায় চড়া দাম হলেও স্থানীয় বাজারে তা সস্তায় বিক্রি হতো। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষক পণ্য নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর শিকল ভেঙে ঢাকায় আসবে। ফলে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হবে, অন্যদিকে কমে আসবে নিত্যপণ্যের দাম।
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে বিশে^র স্বনামধন্য অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানসমূহ করতে শুরু করেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালেই তার বাৎসরিক রিটার্ন দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। শিল্পের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের জেলাগুলোতে গড়ে উঠছে বড় বড় সব শিল্পকারখানা। পদ্মার ওপারে গেলে শত-শত কোম্পানির বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড থেকে বুঝা যায় ভারী শিল্পের এক অনন্য জনপদে পরিণত হতে প্রস্তুত হচ্ছে অঞ্চলটি। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে আনুমানিক ২-৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা যাবে এ অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নে যার ফলে কর্মসংস্থান হবে ১০ লাখের বেশি মানুষের।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় শিল্পায়ন, ব্যবসা খাত ও বাণিজ্যের বিকাশের বদৌলতে ২.৫ কোটির অধিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজ করছে পৃথিবীর বৃহৎ নদীশাসন বিশেষজ্ঞ কোম্পানি চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। নদীশাসনের জন্য প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে ৯ হাজার হেক্টরের বেশি আবাদি জমি যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু যে শুধু দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকেই জোড়া লাগাবে তা নয় ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বড় নিয়ামক হয়ে উঠবে। ১ লাখ ৪১ হাজার কিমি দৈর্ঘের এ হাইওয়ে পদ্মা সেতুতে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। শুল্ক আদায় হবে স্বাভাবিকের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। দক্ষিণের কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ভোলার শত-শত নয়নাভিরাম চর, এমনকি পদ্মা সেতুর দুই পাড় হয়ে উঠবে পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার মানুষ ব্যস্ততার কারণে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে হাজার কোটি টাকার পর্যটন শিল্প।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছি। আগামী ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে পদ্মা সেতু অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি’র ১ নম্বর লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন, ২ নম্বর লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তি, ৮ নম্বর লক্ষ্য কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, ৯ নম্বর লক্ষ্য উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, ১০ নম্বর লক্ষ্য বৈষম্য হ্রাস, ১১ নম্বর লক্ষ্য টেকসই নগর ও সম্প্রদায়, ১৫ নম্বর লক্ষ্য ভূমির টেকসই ব্যবহার ও ১৭ নম্বর লক্ষ্য টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সবকটি লক্ষ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। সরকার শত বছরের যে ‘ডেলটা প্ল্যান-১০০’ হাতে নিয়েছে তার প্রাথমিক পদক্ষেপ পদ্মা সেতু।
পদ্মা পাড়ের মানুষ অধীর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছেন ২৫ জুন দিনটির জন্য। দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত্তির পরিচায়ক সেতুটি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ৫০ বছরের দুঃখের অবসান হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে সাংবাদিকদের নিয়ে কৌতুক করে তাদের বলা হয়েছে ‘পিলার সাংবাদিকতা, স্প্যান সাংবাদিকতা’ ইত্যাদি। তবে, একটি স্বনামধন্য দৈনিক সংবাদপত্রের মতে চমকপ্রদ তথ্য হলো ‘পদ্মা ব্রিজ’ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে আসছে ২৩ লাখ তথ্য, ‘পদ্মা সেতু’ লিখলে আসে ১৬ লাখ ২০ হাজার তথ্য আর ‘পদ্মা সেতু সংবাদ’ লিখলে আসে ১০ লাখ তথ্য। ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় আস্থার প্রতীক এ সেতুটিতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১২০ মিটার লম্বা পাইলিং পদ্ধতি।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে হঠাৎ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করে যা ১৬ কোটি বাঙালির জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিছু সুনির্দিষ্ট লোকের স্বার্থের জন্য বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জোয়েলিককে তার শেষ কর্মদিবসে ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন বাতিলে প্রলুব্ধ করে। একে একে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় জাইকা, এডিবি ও আইডিবির মতো দাতা সংস্থাগুলোও। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যেখানে দাতা সংস্থাগুলো অনুদানই করেনি, সেখানে উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। কোনো অলীক কল্পনা বা স্বপ্ন নয়। কোনো ষড়যন্ত্রই টেকেনি জনগণের টাকায় নির্মিত এ স্থাপনা নির্মাণে। যার নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের মে মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ঘোষণার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু হবে আমাদের নিজের টাকায়। আর গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে জ্বলে ওঠে স্ট্রিটলাইট। এ যেন অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমার আলো।
পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তার কথা আরও একবার জানল বিশ্ব সম্প্রদায়। বিশ্বব্যাংকের মতো মোড়ল প্রতিষ্ঠানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করেই ফেলল বাংলাদেশ। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আগামীতে দেশে বৃহৎ প্রকল্প নির্মাণে বিশ্ব দাতা সংস্থাগুলোকে এই বার্তা দিল যে বাংলাদেশ বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান। তাই ২০২০ সালে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য আগাম প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছেন এডিবির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকাহিকো নাকাও। পদ্মা সেতুর প্রশংসা করতে গিয়ে পাকিস্তানের শিক্ষাবিদ ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক পাকিস্তানের বহুল প্রচলিত ‘ডেইলি টাইমস’-Story of Bangladesh’s Padma Bridge: More Than Just A Bridge?' কলামে ভূয়সী প্রশংসা করেন। এছাড়া দেশে-বিদেশে নানান আলোচনা ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে এ সেতু।
প্রায় শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে পদ্মা সেতুর। সর্বশেষ পরিচ্ছন্নতা ও পুনঃনিরীক্ষণের কাজ চলছে। চলমান করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২৩ সাল নির্মাণ সমাপ্তি ধরা হলেও সরকারের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ২০২২ সালের ২৫ জুনেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যমতে, একটি সেতু বদলে দেবে দেশ। আমাদেরও উচ্চাকাক্সক্ষা এই সেতুর মধ্য দিয়েই সূচিত হবে ২০৪১ সালে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীত।
লেখক কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক