
পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ) এ এম এ কবীর প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব এ কিউ আনসারিকে যে প্রতিবেদন (ইংরেজিতে লিখিত) প্রেরণ করেন, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলায় সংক্ষেপে ভাষান্তর করা হলো :
প্রতিবেদনের বিষয় : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস উদযাপন
১. অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালন করছে। বৃহৎ কলেবরে যথারীতি ঢাকাতেই অনুষ্ঠানগুলো হয়েছে, বয়োজ্যেষ্ঠরা সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন।
২. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ১২ জানুয়ারি ১৯৬১ পার্টির কর্মীদের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, তাতে শহীদ দিবস উদযাপনের সময় নিম্নবর্ণিত দাবিনামা পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয় :
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
খ. সংসদীয় সরকার
গ. শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা
ঘ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন
ঙ. শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্তকরণ
সরকারের বিরোধিতার পরও যদি জনগণকে সংঘবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে এটি সফল প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে প্রজ্ঞাপনে পরামর্শ দেওয়া হয়। পার্টির ঢাকা জেলা সাংগঠনিক কমিটিও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ছাত্রদের মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তিনটি দাবিনামার উল্লেখ করেছে :
ক. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
খ. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
গ. উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা চালু করা।
৩. উল্লেখ করা যেতে পারে, ১ জানুয়ারি ১৯৬১ নারায়ণগঞ্জ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যথাবিহিত মর্যাদার সঙ্গে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ছাত্রদের কাঁধে না চাপিয়ে যুবক এবং জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৪. ইস্ট পাকিস্তান ইয়ুথ লিগের কর্মীরা ২৭ জানুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস মর্যাদার সঙ্গে পালনের উদ্দেশ্যে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। তারা শহীদ মিনার সাজানোর জন্য ছাত্রদের কাছে আবেদন জানান এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশের দাবিও করেন।
৫. ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সংবাদ অসমাপ্ত শহীদ মিনারের ছবিও মুদ্রণ করে। পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক এবং সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস বন্ধ রাখলেও পরদিনের পত্রিকা ছাপার আয়োজন করে এবং যথারীতি পত্রিকা বেরোয়।
৬. ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মূলত প্রধান পদসমূহ দখল করে আছে। তারা এবং বিভিন্ন হলে তাদের সমর্থকরা শহীদ দিবস পালনে প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৭. ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্স ইউনিয়ন (এপসু) ১ ফেব্রুয়ারি এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে শহীদ দিবসের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে। সব হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি এবং ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের নিয়ে আরও একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়; প্যামফ্লেট ও পোস্টার মুদ্রণ, প্রভাতফেরি বের করা ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার দাবি জানানো হবে এবং সন্ধ্যায় উদ্যোক্তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।
৮. যথারীতি ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ এপসুর নেত্রী জাহান আরা আকতারের (তিনি তখন ডাকসুর ভিপি) সভাপতিত্বে ডাকসু অফিসে বৈঠক হয়। যদি এপসুই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা ডানপন্থি সংগঠন এনএসএফ, এসএফ এবং ইপিএসএল প্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রণ জানান। যথাযথভাবে শহীদ দিবস পালনের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভিপি ও জিএস-এর স্বাক্ষরে বিবৃতি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার চালুর দাবি জানানো হবে। প্রভাতফেরি সংগঠিত করাসহ শহীদ দিবসের বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। পরদিন ৯.২.৬১ তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত লিফলেট ছড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। জগন্নাথ কলেজ, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ঢাকা হলের অডিটোরিয়ামে পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়। কিছু বে-নামা পোস্টারও দেখা যায়। রমনা এলাকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার দেখা যায়।
৯. কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ভোরে স্ব-স্ব হলে জমায়েত হন, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের জন্য মোনাজাত করে যার যার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, আবদুর রহমান খান হল এবং জগন্নাথ কলেজ কম্পাউন্ডে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
তারপর তারা কালোব্যাজ ধারণ করে নগ্নপদে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আজিমপুর গোরস্তানে গমন করে। কালোব্যাজে এবং সাদা কাপড়ে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ’।
প্রভাফেরিতে আসার পথে শিক্ষার্থীরা সজোরে নিচের সেøাগানগুলো দেন :
১. ২১ ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ
২. শহীদ স্মৃতি অমর হোক
৩. রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না
৪. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করো
৫. শহীদ মনুমেন্ট তৈরি করো
৬. ছাত্র-জনতা এক হও
৭. ধোঁকাবাজি চলবে না
১০. আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছে তারা বরকত ও সালামের কবরে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে তারা নিহত হন। বাঁশের খুঁটি গেড়ে লাল কাগজে তাতে টানানো পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘হে আমার দেশ, বন্যার মতো, প্রচন্ড অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে সরিয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি এখানে আমাদের মৃত্যু ও জীবনের সমাপ্তি।’
ছাত্রদের রেখে যাওয়া অন্য পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘আমার ভাষা বাংলা, আমি বাঙ্গালী, এই মহান বার্তা নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গজননীর সেই শহীদ প্রিয় সন্তান।’
অন্য একটিতে লেখা হয়েছে :
‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে।’
১১. কবরস্থান থেকে ১০০ ছাত্রীসহ ৩০০ শিক্ষার্থীর দুটি সিঙ্গেল লাইন মিছিল ৭টা ৪৫ মিনিটে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায়, তারা কালো পতাকা বহন করেন এবং প্রচলিত কিছু সেøাগান দেন। একটি কালো ব্যানারে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস সরকারি ছুটি ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্ত করা এবং সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবি মুদ্রিত ছিল। অন্যটিতে শহীদ স্মৃতি অমর হোক। প্রথমটি বহন করেছেন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা, দ্বিতীয়টি ঢাকা হলের ছাত্ররা।’
১২. মিছিল ধীরে ধীরে পিলখানা রোড, ফুলার রোড, নীলক্ষেত রোড, ময়মনসিংহ রোড, ওল্ড গভর্নমেন্ট হাউজ রোড, আবদুল গণি রোড, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রোড, সেক্রেটারিয়েট রোড (ঢাকা মেডিকেল কলেজের আগে পর্যন্ত) প্রদক্ষিণ করে সকাল ১০টায় মেডিকেল কলেজ গেটের কাছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে মিছিলকারীরা পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন এবং সেখানে জড়ো হতে থাকেন।
সমাবেশের সামনে বক্তৃতা দেন ঢাকা হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু), তিনি ভবিষ্যতেও এই দিনটি উদযাপনের আহ্বান জানান। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বরকত, তার বাবার প্রেরিত বার্তা পড়ে শোনান এ কে এম জিয় উদ্দিন (এপসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) সহসভাপতি জাহান আরা আকতার সিদ্ধান্তসমূহ (দাবিনামা) পাঠ করে শোনান।
ক. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
খ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
গ. জাতীয় জীবন ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন
ঘ. বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিতে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম জোরদার করা।
সোয়া ১০টার পর থেকে মিছিলে লোক কমতে থাকে।
১৩. ফুল দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সাজানো হয়। একটি বড় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। মিনারের মেঝে কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। লাল কাগজের পোস্টারে দাবিনামা লেখা হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে ভাষা দিবসের গুরুত্ব নিয়ে লেখা রচনা দেয়ালপত্র স্থাপন করা হয়। এগুলো হচ্ছে :
ক. চতুষ্কোণ : ঢাকা হল ইউনিয়ন
খ. শিখা : ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন
গ. পদক্ষেপ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়ন
ঘ. রক্ত অক্ষর : সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়ন
১৪. শহীদ দিবস উদযাপনে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হচ্ছেন :
১. বদরুল হক (এপসু) ইকবাল হল
২. মওদুদ আহমদ (পিএসএফ) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
৩. তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ইউনিয়ন
৪. বীরেন্দ্রনাথ হালদার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি জগন্নাথ হল ইউনিয়ন
৫. এ কে এম জিয়া উদ্দিন (এপসু) ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়
৬. অমূল্য কুমার রায় (এপসু সমর্থক) সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
৭. জাহান আরা আকতার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ডাকসু
৮. এ জেড এনায়েত উল্লাহ খান (এপসু)
৯. আবদুল লতিফ মল্লিক, মেডিকেল কলেজ
১০. জাহাঙ্গির খালিদ (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
১১. আমিনুল ইসলাম (এপসু) সাবেক সহসভাপতি, ডাকসু
১২. আশরাফ উদ্দিন মঘবুল (এপসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
১৩. এ এন এম শহীদ ওরফে শহীদ সিং (এপসু) সহসভাপতি, ঢাকা হল।
এ আর ইউসুফ একটি মিছিলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন।
১৫. এ ছাড়া বাইরের যারা এসেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন : কাজী জহিরুল হক, আবদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আবদুর রশীদ, শামছুল আরেফিন, শাহ আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ (অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজ) এবং আনোয়ার জাহিদ।
১৬. বিকেলে বাংলা একাডেমি, কার্জন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।
১৭. বাংলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমি প্রাঙ্গণে বিকেল ৩:৩০ থেকে ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডক্টর সৈয়দ আলী আহসান, সাহিত্যমোদী প্রায় ৬০ জন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিশিষ্টজনদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক হাসান জামান, অধ্যাপক আবুল কাশেম ও রওশন আরা বেগম। সভাপতি বলেন, যে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে, সে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
১৮. কার্জন হলে বহুল উপস্থিতিতে ডাকসুর একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন। ভাইস চ্যান্সেলরও এতে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান (নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য), সাবেক মন্ত্রী মাহমুদ আলী (নিষিদ্ধ ন্যাপের সদস্য) এবং আরও কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামন, ডক্টর জি সি দেব, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল মোমেন বক্তব্য দেন। তাদের দাবিনামায় তিনটি অতিরিক্ত বিষয় যোগ হয় :
ক. বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বাংলা একাডেমিকে সক্রিয় করা।
খ. রোমান হরফে বাংলা চালুর চেষ্টা কিংবা অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সহ্য করা হবে না।
গ. পুলিশের গুলিতে নিহতদের কবর রাষ্ট্রীয় খরচে পাকা করা।
গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে ডক্টর কাজী মোতাহের হোসেন আপত্তি জানালে হাত তুলে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা সমর্থন জানান। বাংলা ভাষাও এই দিবসের প্রশংসা করে গীত সংগীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
১৯. সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রভোস্ট ডক্টর এম হক এবং ফজলুল হক ও জগন্নাথ হলের সভায় সভাপতি ছিলেন সংশ্লিষ্ট হল ইউনিয়নের সহসভাপতি। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের লেকচার গ্যালারির অনুষ্ঠানে কমিনিউস্ট পার্টির সদস্য এবং সাবেক নিরাপত্তা কারাবন্দি রনেশ দাশ গুপ্ত। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক।
২০. কিছুসংখ্যক ছাত্র সন্ধ্যাবেলায় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালিত করে সম্মান জানান।
২১. ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ যে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে কালো পতাকা উত্তোলন, মিছিল, সেøাগান এবং শহীদ মিনারের সভা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। স্লোগানগুলো নতুন কিছু নয়। গত বছরও তারা একই স্লোগান দিয়েছেন। গত বছরও মিছিল হয়েছে কিন্তু তা শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার অনেক বড় আকারে মিছিল হয়েছে এবং সচিবালয়ের সামনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা রাস্তায়ও মিছিল চলেছে।
২২. পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট শহীদ মিনারে মিছিল ও মিটিং সামরিক আইনের বরখেলাপ কি না এ নিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত গ্রহণ করেছেন। এ মতামত তেমন কোনো কাজে আসেনি।
২৩. ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ‘দিবস’ পালন-সংক্রান্ত সরকারের নীতিমালা জারি হয়েছে। কোনো রাজনীতিবিদের সক্রিয় অনুপ্রেরণা বা নাশকতামূলক কাজে উৎসাহ প্রদানের প্রমাণ না পাওয়া গেলেও আমি মনে করি শহীদ মিনারের সভায় ও মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো দরকার, যাতে তিনি তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন।
যদিও বাইরের কাউকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভায় বা মিছিলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, আমরা প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলো আরও পরীক্ষা করব। সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী কেউ শনাক্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ এম এ কবির
ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ
(ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ)
পূর্ব পাকিস্তান, ঢাকা
পাবলিক প্রসিকিউটরের অভিমত
প্রেরিত কাগজপত্র দেখেছি, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও বলেছি।
২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা কিছুসংখ্যক ছাত্রের উদ্যোগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আয়োজন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করেছে। তবে গতকাল (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১) ছাত্রটা যে মিছিল করেছে তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো সংস্রব ছিল না। যদি মিছিলে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে না থাকে এবং তা যদি নিহতদের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়ে তাকে তাহলে এ মিছিলকে রাজনৈতিক প্রকৃতির বলা যাবে না। আর তা যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা মার্শাল ল রেগুলেশন নম্বর ৫৫ এ-র আওতায় আসবে।
পুলিশ রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সভা হয়েছে, তবে সভায় কেউ সভাপতিত্ব করেননি, কিন্তু জনব্যবহার্য স্থানে একটি সভা হয়েছে, যা বেআইনি এবং এমএলআর ৫৫ এ-র পরিপন্থী।
মুদ্রিত লিফলেট প্রসঙ্গে বলা যায়, এতে শহীদ দিবস উদযাপনের কর্মসূচি লিপিবদ্ধ ছিল। তাদের কিছু অভিযোগ প্রশমনের দাবিদাওয়া এতে ছিল।
মো. আবদুল আলীম
পাবলিক প্রসিকিউটর, ঢাকা
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১
পাদটীকা :
এ এম এ কবীর হচ্ছেন পরবর্তীকালের পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল। তার জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯১১, মৃত্যু ১০ জানুয়ারি ১৯৯৬। তিনি ১৯৩২ সালের ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দেন। ঘাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তাদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের মধ্যে মওদুদ আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং এ জেড এনায়েতুল্লাহ খান পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
লেখক : সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
মুচলেকা, নাকে খত, নির্মূল, উৎখাত অথবা হনুমানের ভেংচি বা গাধার হাসি; মোটেই অভিধান বহির্ভূত শব্দ নয়। কাউকে চুবিয়ে-ডুবিয়ে মারা, মাজা ভেঙে দেওয়া, শাড়ি ধরে টেনে নামানো ধরনের শব্দ-বাক্যও আছে বাংলা অভিধানে। তাই বলে যা-তা ভাবে ব্যবহারের শব্দ নয় এগুলো। শুনতে বা লিখতেও কেমন লাগে? এগুলো সচরাচর ভাষার সৌন্দর্য-গাম্ভীর্যের জন্যও মানায় না। কিন্তু, আমরা ব্যবহারের নামে সমানে অপব্যবহার করছি। এমনকি এই ভাষার মাসে কোনো ছাড় দিচ্ছি না। প্রসঙ্গেরও ধার ধারছি না।
কখনো বাতকে বাত, কখনো শালীনতার তোয়াক্কা না করে বা ব্যাকরণের কঠিন বেড়াজালে, কখনো ব্যাকরণ ভেঙেচুরে স্বেচ্ছাচারিতায় প্রকারান্তরে প্রিয় ভাষাটির সর্বনাশ করে ছাড়ছি। বাংলা চর্চায় অতি রক্ষণশীলতা বা উদারতা দুটোই বিপজ্জনক। ক্ষেত্রভেদে হঠকারিতাও। প্রকারান্তরে এটি ভাষার সঙ্গে জবরদস্তি, নাশকতা। তা শব্দ, বানান, বাক্যসহ গোটা বাংলা ভাষাটিরই সাবলীলতা নষ্ট হচ্ছে। একসময় বানান ও বাক্যে ভুলের মহোৎসব দেখা যেত বাস-ট্রাকে। দোকানপাটের সাইনবোর্ডে। ‘ঐ দেকা জায় গুলিস্থান, ব্যভহারে বংসের পরিচয়, ১০০ বা ৫০০ টাকার বাংতি নাই, কিসু পেলে গেলেন কি’Ñ ধরনের বানান ও কথাবার্তা এখন ভরপুর ফেসবুকে। যার মনে যা চায় স্ট্যাটাস লিখছেন। কমেন্টসও আচ্ছা রকমের। দৈনন্দিন যাপিত জীবনেও ভাষার ক্ষেত্রে সবাই এখানে স্বাধীন, সার্বভৌম, মহাপরাক্রমশালী।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি সুপরিণতির দিকে নিতে চাইলে দেশে বাংলার চর্চা কোন স্তরে, কোন পর্যায়ে তা ভাবা জরুরি। ভাষার সঠিক চর্চা নিশ্চিতে অভিধানের চেয়েও বেশি শক্তি গণমাধ্যমের। দেশের সব ঘরে অভিধান নেই।
থাকলেও সেটা পড়ে থাকছে শো-পিসের মতো। কিন্তু সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ফেসবুকের মতো গণমাধ্যম রয়েছে ঘরে ঘরে। এসব গণমাধ্যমে ব্যবহৃত শব্দ, বানান, বাক্যের গতি, শক্তি অভিধানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে সেখানেও বিস্তর গোলমাল। অর্থগতভাবে পর্যন্ত ছারখার করে ফেলা হচ্ছে রক্তাার্জিত বাংলাকে। ভুল স্বীকার না হোক, অন্তত শুদ্ধটা জানানোর তাগিদও চোখে পড়ে না। বানানের সঙ্গে বাক্য গঠনেও অরাজকতা। ডায়রিয়ায় ১৭ জন নিহত, বন্যার পানিতে ১৫ জন নিহত, অপুষ্টির অভাবে শিশুর মৃত্যু, নিহত হয়ে চারজনের মৃত্যুবরণ, দ্রব্যমূল্যের দাম আরও বেড়েছে, সিদ্দিকের চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে, তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, বাস না পেয়ে পায়ে হাঁটতে হয়েছে পাঁচ মাইল, এইচএসসিতে শতকরা গড় পাসের হার ৬৮.৯১ শতাংশ, পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধরে আনার চেষ্টা চলছেÑ ধরনের বাক্যের অর্থ অডিয়েন্স বুঝে নিচ্ছে সত্য। কিন্তু, বাক্যগুলোর অর্থ-প্রয়োগে বাংলার করুণ দশা স্পষ্ট। কী বলতে গিয়ে কী বলা হচ্ছে? তথ্যই বা কী দাঁড়াচ্ছে? কেউ তা রোখার চেষ্টা করলে যুক্তির তেজে চুপ মেরে যেতে হয়। অর্থ, স্বকীয়তা, বিশেষত্ব ও ভাষা-ব্যাকরণের শুদ্ধরূপের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা হজম করা ছাড়া আর গতি থাকে না।
বিশুদ্ধতা ও জাতপাত খোয়ানোর পরও ইংরেজি ভাষা কেন গোটা বিশ্বে প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলছেÑ এমন বাঁকা প্রশ্নও ছোড়া হয়? ইংরেজি জানা সারা দুনিয়াতেই স্মার্টনেসের ব্যাপার? বিশ্বের অনেকে বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষাও শিখছেন। আগে কেবল পণ্ডিতরা শিখতেন, এখন শিখছেন অনেক সাধারণ মানুষও। জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শেখার পেছনেও বাণিজ্যিক ও কর্মসংস্থান বিষয়ক ঘটনা রয়েছে। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যও এখানে প্রাসঙ্গিক। সেই তুলনায় বাংলার বাজার কেন জমছে না এ প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসে ভাষাকে একঘরে হয়ে যাওয়ার বহু তথ্য রয়েছে। সময়-অসময়ে বিভিন্ন ভাষা নেতিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রায় একই। কারও কারও মানতে কষ্ট হয়, ভাষার সঙ্গে রুটি-রুজিসহ কর্মজগতের বিশাল সম্পর্কের কথা। মানুষ অজস্র ভাষা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পারে অপব্যবহারে, খামখেয়ালিতে ভাষার সর্বনাশ করতেও। কোনো ভাষাকে শক্তিধর রাখতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দরকার। বিকৃতি আর শক্তিহীনতার কারণে পৃথিবীর একসময়ের শক্তিধর ভাষাগুলোর কিছু দুর্বল হয়েছে। কিছু হারিয়েই গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসিডোনিয়ায় আজ কজনে কথা বলে? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার অন্যতম যিশুখ্রিস্টের ভাষাও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো ভাষাই শুধু আবেগ, চেতনা আর ভালোবাসার ওপর ভর করে টিকে থাকে না। বাংলা ভাষা মোটেই ধনেজনে দুর্বল নয়। যথেষ্ট সমৃদ্ধÑ সামর্থ্যবান। তার ওপর বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা অসীম। কিন্তু খামখেয়ালি, শুধু আবেগ, ভালোবাসা, চেতনায় ভাষা বা কোনো কিছুর শেষরক্ষা হয় না। কারও আদেশ-নির্দেশেও হয় না। বিশ্বব্যাপী ইংরেজির এত চাহিদা কারও হুকুমে হয়নি। এর ভোক্তা বা গ্রহীতা দেশে দেশে। প্রয়োজনেই কোনো কিছুর ব্যবহার বাড়ে। আর ব্যবহার না হলে প্রেম-ভালোবাসাও বাড়ে না। অর্থাৎ চাহিদাই মূল বিষয়। প্রয়োজন প্রশ্নে আমরা পড়ে গেছি ‘লাভ বাংলা, ইউজ ইংরেজি’ থিওরিতে। রিজিকের তাগিদে আমরা ইংরেজিকে ব্যবহার করি। আর ভালোবাসি বাংলাকে। ঘর-সংসারের জন্য উপযুক্ত একজন, ভালোবাসার জন্য আরেকজন।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে জীবন-জীবিকার সঙ্গে জোরালোভাবে সম্পর্কিত করার আবশ্যকতা এ কারণেই। বাংলার মধ্যে হরদম ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিছুটা প্রয়োজনে। কিছুটা অবচেতনে-অজান্তে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসের বাংলা বইগুলো এখনো মানে অনেক পিছিয়ে। পেরে উঠছে না ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে। নিজ ভাষার সম্মান-ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে ইংরেজির শরণাপন্ন হতেই হচ্ছে। যার জেরে ‘আপ-ডাউন’ ছাড়া দেশে এখন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমসহ প্রায় সবদিকের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের ছড়াছড়ি। এদিক, সেদিক, অন্যদিক কোনো দিকই আর বাদ নেই। আবার রয়েছে দু’দিক মেলানো নামও। নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, সাউথ ইস্ট, নর্দার্ন, সাউদার্ন, ইস্টার্ন নাম ঠেকানো কঠিন। তাচ্ছিল্য করারও অবস্থা নেই। তাছাড়া, বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে গিয়ে কখনো কখনো ভুল প্রতিশব্দ জন্ম নিচ্ছে। বাংলা ব্যবহারে ভুলের ছড়াছড়িতে ‘আমি বড় শৃঙ্খলায় পড়ে গেছি, আপনার রান্নাটা বড় জটিল হয়েছে, আপনার জামাটা বেশ অস্থির লাগছে’ ধরনের কথায় কী বোঝাতে কী বলে ফেলা হচ্ছে? বাংলার জন্য তা আতঙ্কের। বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর কথাকে অন্যদৃষ্টিতে দেখেন কেউ কেউ। ভাষা হিসেবে বাংলা জীবন-জীবিকার সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত? ইংরেজিকে পাস কাটানোর কারণে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। উল্টাপাল্টা বোঝার ঘটনাও ঘটছে। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কারণে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধের পথে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজি বই পড়তে অনেকের নাকানি-চুবানি ছুটছে। এমনটি মোটেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে কাম্য ছিল না। স্বাধীনতার নামে শব্দ-বাক্যের যাচ্ছেতাই প্রয়োগও নিশ্চয়ই আকাক্সিক্ষত ছিল না। যার ছায়া পড়ছে কবিতা, চিত্রনাট্য, গল্পসহ সৃষ্টিশীলতার মাঝে। ‘খাইয়া ফালামু, তোরে খাইছি, ন্যাংটা করে ক্ষমতা ছাড়া করুম’ ধরনের শব্দ-বাক্য ভাষার জন্য মোটেই মর্যাদার নয়। গল্প, কবিতা, নাটক, ছায়াছবির নামকরণ-সংলাপে এগুলো দেদার ব্যবহার হচ্ছে। বাজারও পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ভাষাকে কদাকার করে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলার শব্দ ভা-ার এত দুর্বল নয় যে এগুলোর বিকল্প বা প্রতিশব্দ নেই। এ নোংরামি বছরের পর বছর ধরে চলছে আমাদের জায়গার নামকরণেও। মৌজা, সিএস, আরএস, কাগজে-কলমে, সাইনবোর্ডে বোদা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা। অথচ এ নাম বা শব্দটি কেবল অসুন্দর নয়, অশ্লীলও। কঠিন এ বাস্তবতায় জায়গাটির নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে অনেকবার। কিন্তু, দাবি জোরালো হয়নি। তবে, ‘মানুষমারা’ জায়গাকে ‘মানুষগড়া’ করার দৃষ্টান্ত আছে। দশ কাজের এক কাজের মতো তা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীলফামারী সদরের ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয়েছে ‘মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে শুধু স্কুল নয়, পাল্টে গেল জায়গাটির নামও। এই নাম নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি অনেক দিনের। চিত্ত-পিত্ত দুটোই পুড়ছিল তাদের। অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে বিশ্রি নামটি পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম এবং অসংখ্য জায়গার মধ্যে ‘মানুষমারা’র চেয়েও উচ্চারণ অযোগ্য বহু নাম রয়েছে। কোনো কোনোটি ভদ্র-শিক্ষিত কারও সামনে উচ্চারণ করা কষ্টকর-লজ্জাকর। রুচিতে বাধলেও নামগুলো দলিল-মৌজা, খতিয়ান এমনকি বইপত্রসহ মুদ্রণে অটুট থাকছে।
কুত্তামারা, সোনাডাংগা, ছাগীপাড়া স্পষ্ট উচ্চারণও বিব্রতকর। হাঁটুভাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঘোড়ামারা, ঠেঙ্গামারা, ছাগীপাড়া, ছেঙ্গারচর, কাউয়ারচর, ফাজিলপুর, ভুয়াপুর, ভুরুঙ্গামারী, ধরি কিলা, বলদপুর ধরনের নাম হজম করতে হয় বাধ্য হয়ে। যতই বলা হোক, নামে কিছু যায় আসে না। আসলে নামে অনেক কিছুই যায় আসে। নামটি অবশ্যই একটি ভাষা। এ ভাষাটির মর্যাদা-সৌন্দর্য কি ভাবতে নেই?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
আবদুল হাকিম জন্মেছিলেন ১৬২০ সালে। মারা যান ১৬৯০ সালে। লিখে যান ৮টি কাব্যগ্রন্থ। এর একটি ‘নূরনামা কাব্য’। সেখানে তিনি লিখেন, ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ অন্যদিকে বাংলা পঞ্চকবির একজন অতুল প্রসাদ সেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭১ সালে। মারা যান ১৯৩৪ সালে। এ সময়ের মধ্যে গীতিকার, গায়ক, কবি অতুল প্রসাদ লিখে যান অসংখ্য গান। বাংলা সংগীত জগতে, অন্যান্য গানের সঙ্গে আমরা পাই সেই দুর্লভ গানÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’। এরপর আসে পাকিস্তান আমলের নির্মম অত্যাচারের ২৪ বছর।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ। ৯ দিনের সফরে পূর্ববঙ্গ আসেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ইংরেজিতে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ভারত-ভাগের আগেই। অবাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন উর্দু ভাষার কথা। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আকাক্সক্ষা অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতারই একটা অংশ হচ্ছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বেলা ১১টা ৩০ মিনিট। ১৪৪ ধারা মানেননি ছাত্র-জনতা। ভাষার দাবিতে রাজপথে খণ্ড খণ্ড মিছিল। লাঠি চালায় পুলিশ। আরও বেগবান হয় আন্দোলন, যোগ দেন সাধারণ মানুষ। সবার মুখে একটিই দাবিÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই মিছিল ঠেকাতে চলল গুলি। রাজপথে লুটিয়ে পড়লেনÑ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই। ২২ ফেব্রুয়ারি হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ মিছিল। দাবি ওঠে শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণের। মাত্র এক দিনের প্রস্তুতিতে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। এতে সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভেঙে ফেলে শহীদ মিনার।
বর্তমানে আমরা যে শহীদ মিনার দেখছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান। অমর একুশের গান লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’Ñ এই অবিনশ^র গানের প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ। পরে সুরারোপ করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪ সাল থেকে, যা আজও চলছে।
মাতৃভাষার এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল স্বাধীনতার। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিল পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
পার হয়েছে সুদীর্ঘকাল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩। এই ৫২ বছরে, অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বিদেশে থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, তার দুই কন্যা। তবু থেমে থাকেনি নরঘাতকের দল। এর পরও চলে হত্যাকা-। জাতীয় চার নেতাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হন বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। একই সঙ্গে চলে দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র।
আবার ফিরে আসে নবজাগরণের ইতিহাস। জেগে ওঠে সভ্যতা। দেশের হাল ধরেন স্বাধীনতার সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনিই আজ ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তবু কি দুখিনী বাংলার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বদল হয়েছে? কমেছে কি শাসন-শোষণের পাহাড়সম বৈষম্য?
আমাদের রক্তে নব উদ্যমে কথা বলুক, একুশের চেতনা। মানুষ যেন মানুষের জন্য হয়। বাঙালি চেতনায় জেগে উঠুক বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করা কালজয়ী গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-এর স্রষ্টা কবি ও গীতিকার গোবিন্দ হালদার ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার রচিত প্রথম কবিতা ‘আর কতদিন’। তিনি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কবিতা ও গান লিখেছেন। তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূর দিগন্ত’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত তার লেখা গানসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক’ ও ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার বাংলার মাটি’ অন্যতম। বন্ধু কামাল আহমেদের অনুপ্রেরণায় এবং উৎসাহে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান রচনা করেন। কামাল আহমেদ তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্ণধার কামাল লোহানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার হাতে ১৫টি গানের একটি খাতা দেন। এ গানগুলোর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথম প্রচারিত হয় সমর দাসের সুরারোপিত ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই তার আরও কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর প্রচারিত হয়Ñ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না’ গানটি, যা সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ এবং মূল কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বপ্না রায়, আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা। গোবিন্দ হালদার ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা-পুলিশের সদস্যরা ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে গণহারে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেছেন চাক্তাই রাজাখালী এলাকার কিছু ব্যবসায়ী। তারা বলেছেন, বাকলিয়া থানায় কর্মরত পাঁচজন এসআই এক মাস ধরে ব্যবসায়ীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। গভীর রাতে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গুদামে হানা দিয়ে নিম্নমানের পণ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে লাখ লাখ টাকা আদায় করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায়ও রাজাখালী এলাকায় কথিত অভিযানে যান বাকলিয়া থানার এসআই আসাদুল্লাহসহ আরও কিছু পুলিশ সদস্য।
এ সময় আপেল মার্কা ‘আরজে সেমাই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেন তারা। ময়দা নিম্নমানের, ট্রেড লাইসেন্স না থাকা এমন বিভিন্ন অভিযোগ তুলে প্রতিষ্ঠানের মালিক রাকিবকে ধরে থানায় নিয়ে যান এসআই আসাদুল্লাহ। বেলা ১১টা থেকে গতকাল এই প্রতিবেদন লেখার সময় (সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত) রাকিবকে থানায় ‘আটক’ করে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাকলিয়া থানায় ‘আটক’ অবস্থা থেকে রাকিব মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আজ বেলা ১১টার দিকে এসআই আসাদুল্লাহসহ কিছু পুলিশ কনস্টেবল আমার প্রতিষ্ঠানে আসেন। এ সময় এসআই আসাদুল্লাহ আমার প্রতিষ্ঠানের ময়দার মান খারাপ বলে অভিযোগ করে আমাকে থানায় এনে আটক করে রেখেছেন। আমি তাদের বলেছি, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য পণ্য কেনার সব কাগজপত্র আমার কাছে আছে। আমার এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। তবুও কেন আমাকে থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।’
রাকিবকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এসআই আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আজ সকালে রাজাখালী এলাকায় গিয়েছিলাম জমিজমা-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত করতে। এ সময় রাকিবের প্রতিষ্ঠানে যাই। থানার সেকেন্ড অফিসার তাকে (রাকিব) থানায় আনতে বলেছেন।’
রাকিবের এবং তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। তা ছাড়া গতকাল সেখানে ভেজালবিরোধী কোনো অভিযানও হয়নি, তাহলে কেন রাকিবকে থানায় নিয়ে আটক করে রাখলেন? এমন প্রশ্ন করলে এসআই আসাদুল্লাহ বলেন, সেকেন্ড অফিসার বিস্তারিত জানাবেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে জানান, গত এক মাসের ব্যবধানে চাক্তাই-রাজাখালী এলাকার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রায় আট লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন আলোচ্য পুলিশ কর্মকর্তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে নিজেদের ব্যবসায়ী সংগঠন চাক্তাই শিল্প ও বণিক সমিতি কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন ভুক্তভোগীরা।
তাদের মধ্যে অন্যতম মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিডের মালিক রিকু সেন অভিযোগ করে বলেন, ‘এক মাস ধরে বাকলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন, মোরশেদ, বেলাল, আসাদ উল্লাহ ও তাজুল ইসলাম বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গভীর রাতে অভিযান পরিচালনার নামে ব্যবসায়ীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রির অভিযোগ দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে এক মাসে ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত আট লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন এই পাঁচ সাব-ইন্সপেক্টর।’
এক মাস ধরে চাঁদাবাজি চললেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ী রিকু সেন বলেন, ‘আমরা আজ রাতে সমিতির কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে বসব। এরপর সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করব।’
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশ চাঁদা আদায় করেছে সেগুলো হলো মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, আবদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, চাল ব্যবসায়ী আহমদ হোসেন, মেসার্স দেলোয়ার সওদাগরের সেমাই ফ্যাক্টরি, রাজাখালী রোডের আক্কাস সওদাগর ও মেসার্স জয়নাল সওদাগরের ময়দার ফ্যাক্টরি।
ভুক্তভোগী আহাম্মদ নুর সওদাগর অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিম্নমানের চাল মজুদের অভিযোগ তুলে ১৬-১৭ দিন আগে এসআই আমীর আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যান। এর ২০-২২ দিন আগে চাল গুদামজাত করার সময় একই অজুহাত তুলে আমার প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার শফির কাছ থেকে সাব-ইন্সপেক্টর মোরশেদ আড়াই লাখ টাকা নিয়েছেন।’
মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রোপ্রাইটর রিকু সেন অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য আনা ছোলা, মসুর ডাল ও সরিষা ট্রাক থেকে গুদামে নেওয়ার সময় নিম্নমানের অভিযোগ তুলে সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন।’
ভুক্তভোগী রাজাখালী এলাকার পেঁপে মার্কা সেমাই কারখানার মালিক দেলোয়ার সওদাগর বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে মজুদ থাকা ময়দার মান নিম্নমানের বলে অজুহাত তুলে ৬৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বাকলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন।’
ব্যবসায়ীরা জানান, একইভাবে মেসার্স আবদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মালিক সোহাগের গুদামে ‘অভিযান’ চালিয়ে নিম্নমানের মৎস্য খাদ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। সোহাগের গুদামে ‘অভিযানের’ নেতৃত্ব দেন এসআই বেলাল, এসআই আমীর হোসেন ও এসআই তাজুল। রাজাখালী রোডের জনতা বিল্ডিংয়ের সামনে মেসার্স জয়নাল সওদাগরের সেমাই ফ্যাক্টরির ময়দার মান খারাপ বলে আদায় করা হয় ১০ হাজার টাকা, মুসলিম বেকারি গলিতে মেসার্স আবুল কালাম ফিড মিলের পণ্য ট্রাক থেকে নামানোর সময় নেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা, রাজাখালী রোডের তেল ব্যবসায়ী আক্কাস সওদাগর থেকে নেওয়া হয় ৬৫ হাজার টাকা এবং চাক্তাই মুসলিম বেকারি গলির ভেতরে ঘি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কুইন কাউ নামক কারখানা থেকে এসআই আমীর নেন ৭০ হাজার টাকা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মনি বেগম, মোহাম্মদ কালু ও মো. আকাশ নামে তিনজন মাদক কারবারি চক্রের সদস্য। রাজাখালী ফায়ার সার্ভিস এলাকায় জুয়ার আসর চালায় কালু। স্থানীয় মুসলিম বেকারি গলি এলাকায় মাদক বিক্রি করে মনি বেগম। কিছু পুলিশের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সখ্যকে পুঁজি করে চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের তারা নিয়মিত হয়রানি ও চাঁদাবাজি করছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় বাকলিয়া থানার এসআই আমীর হোসেনকে কিছুদিন আগে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।
তবে বাকলিয়া থানার ওসি আবদুর রহিমের দাবি, পদোন্নতি পাওয়ার পর এসআই আমীরকে কিছুদিন আগে সদরঘাট থানাধীন মাদারবাড়ী ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত রবিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে এসআই আমীর হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে নিজের থানায় কর্মরত পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন চাঁদাবাজির অভিযোগ শুনে বিস্মিত হয়েছেন ওসি আবদুর রহিম। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী। এটা কি মগের মুল্লুক? ব্যবসায়ীরা কেন পুলিশকে বারবার টাকা দেবেন? তারা আমাকে জানাননি কেন? তবে অভিযোগের সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওসি আবদুর রহিমের সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পর অভিযোগকারীদের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর তাকে (ওসি) হোয়াটসঅ্যাপে দেন এই প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলারও অনুরোধ করা হয়। এক ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যায় কল করলে ওসি আবদুর রহিম বলেন, ‘ভাই আমি অন্য কাজে ব্যস্ত আছি।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ড. সাদিক আহমেদ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ে গবেষণাধর্মী একটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণভাবে, তিনি নির্বাচিত কিছু দেশের যারা মোটামুটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে বলা চলে, প্রচেষ্টার আলোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশের মুদ্রানীতির সীমাবদ্ধতা নিয়েও তার প্রাজ্ঞ প্রতিক্রিয়া পেশ করেছেন। তার এই পর্যবেক্ষণ নীতিনির্ধারক এমনকি সাধারণ পাঠকের নজরে থাকা উচিত বলে মনে করি।
২০২২ সালে বিশ্বে চলমান ‘মারমুখী মূল্যস্ফীতির’ কথা আমরা সবাই জানি। সম্ভবত ২০০৮ সালের পর এমন ঝরোগতিতে বড় অভিঘাত সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নেই। চলমান মূল্যস্ফীতি কতটা মারমুখী, তা উপলব্ধি করার জন্য কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছেন সাদিক আহমেদ যা উল্লেখ না করলেই নয়।
একমাত্র আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির হার ২০২১ সালের ১.৪ শতাংশ থেকে ২০২২ সালের জুনে ৯.১ শতাংশে পৌঁছায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সেই হার এক বছরের মধ্যে ১.৯ শতাংশ থেকে ১০.৬ শতাংশ লাফিয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের প্রথম সাত মাসে ৩.২ থেকে ৭.৯ শতাংশ, ভারতে এক বছরে দ্বিগুণ, বাংলাদেশে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৫.৯ শতাংশ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯.৫ শতাংশে অবস্থান নেয় মূল্যস্ফীতির হার।
বিশেষত দেশগুলোর বিদ্যমান পরিবেশ ও নীতি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন মাসে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে মূল্যস্ফীতি চূড়ায় ওঠা প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ সব জায়গায় ভোগান্তি মোটামুটি একইরকম। তবে জনগণের অসন্তুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতির মুখে নীতিগত প্রতিক্রিয়া অধিকতর দ্রুত এবং দৃঢ় ছিল ঐ সমস্ত দেশে যারা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়।
মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে ওঠার মূলে আছে দুটো কারণ : (ক) কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যৌথ প্রভাবের জন্য জোগানে ঘাটতি ঘটে এবং (খ) আমেরিকা ও ইউরোপে চাহিদা চাঙ্গা করার লক্ষ্যে প্রদত্ত কভিডবিরোধী প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন।
যদিও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী তীক্ষèতার উৎস ছিল জোগানের ঘাটতি এবং সেইহেতু পণ্যের দামের উল্লম্ফন। বিশেষত জ্বালানি দ্রব্য, তারপর নীতিনির্ধারকরা চটজলদি অনুভাবন করতে পেরেছিলেন যে, সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মুদ্রা কর্র্তৃপক্ষ খুব দ্রুত সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রেখে আগ্রাসী চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করলেন (কত আগ্রাসী তার প্রমাণ সুদের হার ত্বরান্বিত হওয়ার কারণে আমেরিকার দুটো ব্যাংকে ধস নামা)। এই পদক্ষেপ পদে পদে এবং চাহিদার প্রকৃতি সংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। থাইল্যান্ড, ভারত এবং ভিয়েতনামও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা সংকোচন নীতি আলিঙ্গন করেছে।
একমাত্র বাংলাদেশ ব্যতিক্রম যেখানে চাহিদা সংকোচন নীতি গ্রহণ করেইনি বরং চাহিদার চাপে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে ব্যক্তি খাতে ঋণ সম্প্রসারণ এবং রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি। যে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত দশ শতাংশেরও কম সেই দেশে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়া ছাড়া অর্থায়নের উৎস কোথায়?
বাংলাদেশের মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বহু বিতর্কিত ‘ছয়/নয়’ সুদের নীতির অব্যাহত উপস্থিতি। যেখানে গেল সাত মাসের গড় ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে ল্যান্ডিং রেট ৯ শতাংশ। এই শূন্য অথবা ঋণাত্মক সুদের হার ব্যক্তি ঋণের প্রসার ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে, বর্ধিষ্ণু রাজস্ব ঘাটতি সরকারকে ব্যাংক থেকে গেল ১২ মাসে ২৮ শতাংশ হারে ঋণ নিতে বাধ্য করছে।
প্রশ্ন হলো, সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা সংকোচন নীতি কতটা ফলদায়ক অন্তত বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে? দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে সবচেয়ে বেশি কমেছে থাইল্যান্ডে (৫১ শতাংশ) তারপর আমেরিকা ৩৫ শতাংশ, ইইউ-তে ২০ শতাংশ, ভারতে আট শতাংশ। ভিয়েতনামে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি নীতিগত গুরুত্ব পাওয়ার কারণে চাহিদা ব্যবস্থাপনায় সাফল্যস্বরূপ (যেমন সুদের হার বৃদ্ধি) বিশ্বে উঁচু মূল্যস্ফীতির মধ্যেও দেশটি ৫ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে পেরেছে।
মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনায় এই ভালো ফলাফলের বিপরীতে বাংলাদেশের কৃতিত্ব যে তেমন উজ্জ্বল নয়, তা বলা বোধ করি বাহুল্য নয়। আগস্ট ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
বস্তুত সরকারি পরিসংখ্যান তাই বলছে। তাও বৈশ্বিক স্তরে খাদ্যসহ পণ্যের দাম পড়ে যাওয়ার কারণে। মোটকথা, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতি চূড়া থেকে মাত্র ৭ শতাংশ নেমেছে সংকল্পবদ্ধভাবে স্থিতিশীল রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস হিসেবে।
মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা সহজেই অনুমেয় এবং কিছু দীক্ষা আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। প্রথমত, এই ধারণাই ভুল যে যেহেতু মূল্যস্ফীতির উৎপত্তি বাইরে থেকে সুতরাং কিছুই করা যাবে না এবং তা কিছুটা আত্মপ্রবঞ্চনাপূর্ণ। মূল্যস্ফীতিকে শক্তিশালী চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতির আওতায় পোষ মানাতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সুদের হার বাড়িয়ে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ প্রয়োজন মাফিক রাখা এবং রাজস্ব ঘাটতি সংযত রাখা।
গত আট মাস ধরে চলমান মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ পৌঁছে কঠোর অভিঘাত হানছে দরিদ্র, নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের মানুষগুলোর ওপর এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা কী করছেন তাও জানা। পুষ্টির অভাব, শিক্ষা- স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হ্রাস, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি। অতএব, কালবিলম্ব না করে অচিরেই এর মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত উপদেশ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এটা করতেই হবে।
মূল্যস্ফীতি নিজে নিজে তো যাবে না। বরং তা অনমনীয় হয়ে উঠতে পারে যদি ঋণ বৃদ্ধি আর ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে ঘাটতি মেটাতে হয়। ঠিক এই মুহূর্তে সব দেশে মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব চেয়ে বড় অগ্রাধিকার। মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনাকে বি-রাজনীতিকরণের লক্ষ্যে অনেক উন্নত দেশে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে যারা সুদের হার নীতির মাধ্যমে ঋণের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ তেমন স্বাধীনতা ভোগ করে বলে বেয়াকুফও বিশ্বাস করে না। তারপরও বলতে হয় যে- (ক) বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে জরুরি ভিত্তিতে ছয় /নয় সীমা তুলে দিয়ে নমনীয় সুদের হারে ঋণপ্রবাহ ঠিক রাখা, (খ) সুদের হারভিত্তিক মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার জন্য টি-বিলস বাজার উন্নয়ন করা এবং (গ) সরকারের উচিত হবে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি কৌশলকে সাহায্য করা, রাজস্ব ঘাটতি হ্রাসে কম সুদে বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং বড় বড় পুঁজি-নিবিড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা।
পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশে করোনার কারণে কৃত্রিম চাহিদা সংকোচন লক্ষ করা গেছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল পড়ন্ত। কিন্তু যেই করোনার করাল গ্রাস থেকে ভোক্তা এবং বিনিয়োগকারী অব্যাহতি পেল, অমনি বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আছড়ে পড়ল বাজারে। এমনিতে থাকা অপেক্ষাকৃত কম জোগান তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চাহিদা-জোগান ব্যবধান বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালছে।
সুতরাং, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি একদিকে ডিমান্ড পুল অন্যদিকে কস্ট পুস। অন্তত সুদের হার বৃদ্ধি করে চাহিদা সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে পারলে আপাতত বাঁচোয়া।
ব্যবসায়ী কিংবা বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য অন্যরকম। সুদের হার বাড়লে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমবে। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সুদের হার জোর করে নিচে রাখার ফলে গেল ক’বছর বিনিয়োগ বৃদ্ধি কতটুকু হয়েছে, এর উত্তর নিশ্চয় উল্লসিত হওয়ার মতো হবে না। আসলে, ‘বিনিয়োগ’ অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে সুদের হার অন্যতম, এমনকি প্রধান নিয়ামক।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাকিস্তানে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনায় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) এক নেতাসহ অন্তত দশজন নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্যা ডন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের হাভেলিয়ানের কাছে অজ্ঞাত হামলাকারীরা একটি গাড়িকে লক্ষ্য করে রকেট চালিত গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালায়। এতে পিটিআইয়ের স্থানীয় জেলা চেয়ারম্যান আতিফ জাদুন খানসহ অন্তত নয়জন নিহত হয়।
অ্যাবোটাবাদ জেলা পুলিশ কর্মকর্তা (ডিপিও) উমর তুফায়েল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, অ্যাবোটাবাদ জেলার ল্যাংড়া এলাকার এক গ্রামে দোয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর বাড়ি ফিরছিলেন আতিফসহ আরও কয়েকজন লোক। তখনই জাদুনের গাড়িতে দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালায় ফলে গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কটি বিস্ফোরিত হয়। উমর তুফায়েলের দাবি গাড়িটিতে রকেট হামলা হয়েছিলো।
তুফায়েল জানান, মরদেহগুলো অ্যাবোটাবাদ জেলা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, ঘটনাটি পুরানো শত্রুতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে অবিলম্বে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে তাদের শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে পিটিআই।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।