ফাহমিদা খাতুনের গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শোনা বিরল ও অসাধারণ অভিজ্ঞতা প্রিয় এই শিল্পীর ভালো-মন্দ ভুবনে ঘুরে এসেছেন আসিফ আল আজাদ ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান বোনের ছায়ায় ছায়ায় বেড়ে ওঠা
বড় বোন সনজীদা খাতুনের ছায়ায় বেড়ে উঠেছি। বাবা ড. কাজী মোতাহার হোসেনের প্রভাবও এই জীবনে অসামান্য। ছোটবেলায় গাইতাম না, নাচতাম; সেও বোনের জন্য। সনজীদা খাতুনের অনেক শখ ছিল। কোনোটিই সাংগঠনিক ব্যস্ততায় পূরণ হয়নি; সেগুলোই আপা আমাকে দিয়ে পূরণ করেছেন। তিনি কোথাও আবৃত্তি করলে সেটি নাচে তুলে ধরতাম।
ছেড়ে গেল নাচ
১২ বছর বয়সে পড়েছি, বাবা ডেকে বললেন, মা এগুলো বাদ দাও, আমাদের দেশের মানুষ নাচ ভালোভাবে গ্রহণ করেন না। ফলে ছাড়তে হলো। আপা কিন্তু আমার দুঃখ টের পেলেন। বললেনও, ‘মন খারাপ করিস না, আমি তোকে গান শেখাব।’ ফলে চলে এলাম গানে। তিনি রবীন্দ্রনাথের কোন গানের কী অর্থ পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে তারপর গলায় তুলতে দিতেন। অনেক শিখিয়েছেন আমায়।
হতে চাইনি কিছুই
বিখ্যাত গায়িকা বা শিক্ষক হব সেসব শখ কোনোকালেই ছিল না। দীর্ঘকাল তো বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে কেটেছে। তবে এই জীবনটি গড়ে দেওয়ায় আপা অসামান্য অবদান রেখেছেন। এমনও হয়েছি, পরীক্ষার আগে গোসল করছি, আপা বাইরে থেকে বই পড়ে শোনাচ্ছেন, টেনশনে খেতে পারি না, আপা মেয়ের স্নেহে খাইয়ে দিচ্ছেন। গানে নামও করলাম হঠাৎ। বাড়িতে বা কোনো আয়োজনে সবাই ছোট বোনের গানই বেশি শুনতে চাইতেন, সে গাইত। আমার মোটেও ঈর্ষা হতো না। আমার গান যে তাদের ভালো লাগত না। পরে আপা ধরে ধরে সব শেখালেন, ভুলগুলো শুধরে দিলেন। এরপর থেকে এগিয়ে গেলাম। সময় দিতে না পারায় বোনটি আমার গান থেকে হারিয়ে গেল। গলাটি কিন্তু ভারি মিষ্টি ছিল। কলিম (শরাফী) ভাইয়ের গান শুনে তো পুরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী সুন্দর গলা, কত সহজে গান তুলে ফেলেন! তার কাছেই শিখব। অনেকদিন শেখালেন। পরে বাবার গানের গুরু ওস্তাদ মনির হোসেনই আমায় শিখিয়েছেন। তিনি পুরান ঢাকা থেকে বাড়িতে আসতেন। উচ্চাঙ্গসংগীত শেখাতেন। ফলে গোড়া শক্ত হয়ে গেল। গানও আয়ত্তে এসে গেল। পাঁচ বছর গুরুর কাছে শেখা হলো। বিখ্যাত ফেরদৌসী রহমান বছর দুই সিনিয়র ছিলেন, ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেছিলেন। তিনি চতুর্থ বিষয় হিসেবে গান বেছে নিয়েছিলেন। সেই শুরু হলো গানের ক্লাস করা সবার। আমিও এরপর গানকে বিষয় হিসেবে নিলাম। ভাগ্য খুব ভালোই বলতে হবে, মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়), নীলিমা সেনও এদেশে এলে আমাকে শিখিয়েছেন। গণসংগীত গেয়েছি, ফলে গলায় বৈচিত্র্য এসেছে। এই গানের জন্যই ডাক্তার হওয়া হলো না। শাহজাহান হাফিজ নামে পরিচিত এক ডাক্তার শখ শুনে বললেন, ‘খবরদার ও পথে যাবে না। মেডিকেলে পড়ে আমরা খুব ভুগছি, কিছুই পূরণ হয় না। গান নিয়েই থাকো।’
রেডিওতে ডেকে নিল
আপা কয়েকবার অডিশন দিলেও কোনোদিন ওপথে পা বাড়াইনি; যদি মানা করে দেয়, তাহলে তো সহ্য করতে পারব না। গান যে মোর খুব ভালোবাসার ফল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের আয়োজন চারিদিকে, কলকাতার আকাশবাণী এই দেশে বহু বছর কাটিয়েছেন বলে কবিগুরুর গানগুলো নিয়ে এ দেশের শিল্পীদের গাইয়ে একটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিল। এরপর তারাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে গান রেকর্ড করে নিল। এই শুরু, তখন কলেজে পড়ি মাত্র! তারপর তো ঢাকা বেতারও নিয়মিত ডেকে নিয়ে গেল। কোনো অনুষ্ঠানেই দ্বিতীয় হইনি। তবে কারও সঙ্গে রেষারেষিও আমার নেই। ভালো গাইছে বলে হিংসা করিনি। আমি তো মনের খুশিতে গেয়েছি, পাওয়ার লোভে নয়।
ভালোবাসার গান
গান আমায় অনেক দিয়েছে। একবার কলকাতায় আবু সায়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রবীন্দ্র গবেষক তখন খুব অসুস্থ। সারা দিন বিছানায় থাকেন, বিকেলে কিছুটা ভালো বোধ করেন। তখন সময় দিলেন। দেখা করে গান গেয়ে ফেরার সময় শুনি তিনি গুনগুন করে আমার গাওয়া ‘এখনো তাকে চোখে দেখিনি’ গাইছেন। খুব মনে পড়ে। শামসুর রাহমান তো আমার গান শুনে লিখেছেন ‘ঋণী তারই কাছে আজীবন’।
আছে শখ
গানের বিরাট এক সংগ্রহশালা আছে। সবগুলোই পুরনো দিনের ক্যাসেট। ক্যাসেট থেকে গান গলায় তুলতাম। শুভ গুহঠাকুরতা বলেছিলেন, ‘তোমার স্টক খুব ভালো।’ বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালাও আছে। বাবার, বড় আপা জুবাঈদা মীর্জার, সন্্জীদা আপার বইগুলো আছে। নিজের প্রিয় বিভূতি, মানিক, তারাশংকরের কালেকশন তো আছে।