আরব উপদ্বীপ থেকে এক চিলতে ভূমি নেমে গেছে পারস্য উপসাগরে। আয়তনে সামান্য- মাত্র ১১ হাজার ৫৮১ বর্গকিলোমিটার। নাম তার কাতার। বাংলাদেশের তুলনায় ১৩ গুণ ছোট দেশটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র।
ওসমানীয় খেলাফতের পর কাতার ছিল আরব উপদ্বীপে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরিব। এক সময় অনেকটা বাসের অযোগ্য ছিল কাতার। লোকসংখ্যাও ছিল খুবই কম।
পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত কাতারে সে সময় মূলত বসবাস ছিল জেলেদের। ১৯৭১ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর জেলেদের ওই মরু অঞ্চলটি ধীরে ধীরে পরিণত হয় আলীবাবার গুহায়।
এখানকার মানুষেরা এক সময় মাছ বিক্রি করে এবং মুক্তা চাষ করে কোনমতে জীবন চালাতো। অথচ ৫০ বছরের ব্যবধানে জেলেদের দেশ হিসেবে পরিচিত গরীব কাতার সবচেয়ে ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। মরুভূমির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে নিজের চেহারাই বদলে ফেলেছে দেশটি।
মাছ ও মুক্তা চাষ
আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত কাতার উপদ্বীপের শুষ্ক মরুর দেশ এটি। কাতারের দক্ষিণে সৌদি আরব এবং পশ্চিমে দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন। আরব উপদ্বীপের মতো কাতারও একটি উত্তপ্ত ও শুষ্ক মরু এলাকা। পুরো কাতারজুড়ে ভূ-পৃষ্ঠে কোনও জলাশয় নেই। এমন আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও অনেক কম।
তেল আবিষ্কারের আগে কাতারি অঞ্চলের অর্থনীতি মাছ ধরা এবং মুক্তো শিকারের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। সে সময় তাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল মাছ শিকার। উপসাগর থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে পেট চালাত তারা।
এছাড়া মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তাও চাষ করে কোনমতে জীবন চালাতো কাতারের মানুষরা। তবে ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে জাপানি চাষ করা মুক্তা বিশ্ব বাজারে প্রবর্তনের পর কাতারের মুক্তা শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়।
অর্থনীতি
১৯৪০ সালে কাতারের দুখনে তেল আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কার রাজ্যের অর্থনীতিকে বদলে দেয়। মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে থাকা বিশাল জ্বালানি ভান্ডারই কাতারের অর্থের যোগানদাতা। তবে, শুধু তেলই নয়, আরো একটি সম্পদ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, আর তা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।
১৯৪০ সালে শুরু হওয়া পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের উপর ভিত্তি করে কাতারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় একচেটিয়াভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু খনিজ তেলই নয়, সেই সঙ্গে পেয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের খনি দ্য নর্থ ফিল্ড এদেশে অবস্থিত।
১৯৯৫ সালে দেশটিতে হামাদ বিন খলিফা আল থানী ক্ষমতায় আসেন। তিনি প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন।
এই পদ্ধতির নাম লিকুইফ্যাকশন বা তরলীকরণ। তরলীকৃত গ্যাস বড় বড় জাহাজে তেলের মতো পরিবহন করা যায়। গ্যাসকে তরলে পরিণত করার পর মাইনাস ১৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।
পরবর্তীতে দেশটি এই প্রযুক্তিতে আরো বিপুল অর্থায়নের ফলে তাদের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়।
কম দামে বেশি পরিমাণ তরল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানির কারণেই কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের খেতাব অর্জন করতে পেরেছে।
এছাড়া খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে গেলেও কাতারের অর্থনীতি যাতে ভেঙে না পড়ে, সেজন্য তৎকালীন আমির হামাদ বিন খলিফা আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
তিনি ২০০৫ সালে কাতার ইনভেসমেন্ট অথোরিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠান সারা পৃথিবীতে বিনিয়োগ করে থাকে। কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি ৪০টিরও বেশি দেশে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। লন্ডন শহরে ইংল্যান্ডের রানির চেয়েও বেশি সম্পদ আছে এই প্রতিষ্ঠানের।
এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে অফিস বিল্ডিং, হোটেল, অ্যাপার্টমেন্টসহ নানা ধরনের রিয়েল এস্টেট প্রজেক্ট। লন্ডন শহরের শীর্ষ ১৫টি আকাশচুম্বী অট্টালিকার ৩৪ শতাংশ কাতারের মালিকানাধীন।
এছাড়া ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের ২০ শতাংশের মালিক কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি। এমনকি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এয়ারপোর্টেরও ২৫ শতাংশের মালিক তারা।
কাতার এয়ারলাইন্স পৃথিবীর অন্যতম সেরা এয়ারলাইন্সের স্বকৃীতি পেয়েছে। এই খাত থেকে প্রচুর আয় করে দেশটি। এছাড়া আল জাজিরা সহ একাধিক চ্যানেল রয়েছে দেশটির। এসব খাত থেকেও বেশ লভ্যাংশ আসে তাদের।
নাগরিক জীবনমান
এক সময়ের জেলেদের দেশ কাতারে বর্তমানে বৈধ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান অনেক উচ্চ। দেশটি নাগরিকদের কাছ থেকে কোনো আয়কর গ্রহণ করে না। স্থানীয় নাগরিকরা বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
কাতারের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ কাতারের বাসিন্দা। আর বাকি ৮৬ শতাংশ লোকই বিদেশি। তারা বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য সেখানে বসবাস করেন।
কাতারে বেকারত্বের হার অনেক কম। দেশটির কর্পোরেট আইন অনুযায়ী, যেকোনও উদ্যোগে কাতারি নাগরিকদের ৫১% থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুসারে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কাতারের মাথাপিছু চতুর্থ সর্বোচ্চ জিডিপিতে রয়েছে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি করতে বিদেশি শ্রমের উপর প্রচুর নির্ভর করতে হয় কাতারকে। দেশটিতে একটি বড় অংশই হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসী শ্রমিক।
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, শাসকদের সুপরিকপ্পিত পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক প্রভাব সব মিলিয়ে কাতার আজকের এই ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।