রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে সম্প্রতি লিফট দুর্ঘটনার কবলে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ও প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা। গত ৩১ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির ১০তলা থেকে চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত লিফটে নিচে নামার সময় তারা লিফটে আটকা পড়ে ভয় পেয়ে যান। ওই ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী লিফটের বেহাল দশা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই লিফট দুর্ঘটনার কবলে পড়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১২ মে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকায় এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে; যা নিয়ে দেশ জুড়ে ক্ষোভ দেখা দেয়।
তবে শুধু নিউরোসায়েন্স কিংবা তাজউদ্দীন আহমদ হাসপাতালই নয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের লিফটগুলো যেন পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে। রাজধানী ঢাকার বড় বড় সরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে স্থাপিত লিফটগুলোর চিত্র প্রায় একই। এসব হাসপাতালে স্থাপন করা লিফটগুলোর অর্ধেকের বেশি অকেজো কিংবা বছরের অর্ধেক সময় নষ্ট থাকে। নির্দিষ্ট মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া কিংবা যান্ত্রিক ত্রæটি মেরামত না করে অচল ফেলে রাখায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের।
তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিফটে দীর্ঘ সময় আটকে রোগীর মৃত্যুর পর রাজধানীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের বেশ কিছু হাসপাতালের লিফটের হালহকিকত ঘুরে দেখেন দেশ রূপান্তরের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকরা। কথা বলেন, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে। তারা জানান, বেশিরভাগ হাসপাতালের লিফটের তলা (ফ্লোর) নির্দেশক ডিসপ্লে নষ্ট, ফলে লিফট কোন তলায় অবস্থান করছে, তা বোঝা যায় না। প্রায়ই লিফটের দরজা আটকে গেলে তা টেনে খুলতে হয় এবং এভাবেই দিনের পর দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা এসব হাসপাতালে সেবা নিতে যাচ্ছেন। পুরনো এসব লিফট চালু হওয়ার পর উৎকট শব্দ শুরুর পাশাপাশি দুলতে থাকে, যা আতঙ্ক তৈরি করে।
লিফট সচল না থাকায় সিজারিয়ান, হৃদরোগ, অস্ত্রোপচারের রোগীদের স্ট্রেচারে সিঁড়ি দিয়ে টেনে তুলতে হয়, যা তাদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়। আর অন্য রোগীদের লিফট নষ্ট থাকায় সিঁড়ি বেয়ে বহুতল ভবনে উঠতে হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রসূতি, শিশু, বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে দুর্বল রোগীদের। এ ছাড়া জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের জীবন পড়ছে ঝুঁকিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরনো ভবনের সাতটি লিফটই মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব লিফট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নতুন ভবনগুলোয় যেসব লিফট লাগানো হয়েছে, তা-ও নষ্ট হওয়ার পথে। দেশের কিডনি রোগীদের জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট। এই হাসপাতালের ছয়টির মধ্যে চারটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যান্ত্রিক ত্রæটির কারণে এই চারটি লিফট প্রায়ই বন্ধ থাকে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সাত লিফটের মধ্যে একটি পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও দুটিতে মাঝেমধ্যেই সমস্যা দেখা যায়।
রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৯তলা থেকে লিফটে উঠতে গিয়ে নিচে পড়ে এক রোগীর মৃত্যু হয়। এই হাসপাতালের নতুন ভবনের লিফটগুলো ভালো থাকলেও পুরনো ভবনের সাতটির মধ্যে দুটি নষ্ট, বাকিগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের প্রথমেই নামতে হয় লিফটযুদ্ধে (অতি ভিড়ে লিফটে চড়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি)। এই হাসপাতালে পাঁচটি লিফট থাকলেও তিনটিই নষ্ট হয়ে আছে। বাকি দুটি লিফট চালু থাকে, যা রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা স্বজনদের সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। এতে ভোগান্তি বাড়ছে রোগীদের। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনটির মধ্যে একটি নষ্ট।
মহাখালীর ক্যানসার হাসপাতালে কথা হয় যশোর থেকে আসা সুহেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালে লিফট থেকে পড়ে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এরপরও লিফটের সংস্কার হয় না। পুরনো ভবনের লিফটে উঠলে ভয় লাগে, মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়ল।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু হাসপাতাল সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, তাই এসব জায়গায় উন্নতমানের লিফট নিশ্চিত করতে হবে। লিফট স্থাপন করলেই হবে না, যেসব প্রতিষ্ঠান লিফট সরবরাহ করবে তাদের সঙ্গে চুক্তি থাকতে হবে এসব লিফটের তদারকি করা, নিরাপত্তা পরীক্ষা করার। ওয়ারেন্টি যত দিন থাকবে, তারা তা তদারক করবে। স্থায়ী লিফটম্যান (অপারেটর) থাকতে হবে। কেননা হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা লিফট ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য নয়। লিফটম্যান না থাকলে লিফট নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের আট জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে লিফট রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে চারটি পুরোপুরি নষ্ট, আরও চারটি বছরের বেশিরভাগ সময় নষ্ট থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘অধিকাংশ লিফটই মেয়াদোত্তীর্ণ। এত রোগীর চাপ নিয়ে এসব লিফট চলতে গিয়ে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লিফটে উঠলে স্বাভাবিক মানুষেরই ভয় হয় কখন যে ছিঁড়ে পড়ে।’
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘৫তলায় আমার মা ভর্তি। তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ, দিনে ওষুধ আনতেই কেবল আমার ১০বার নিচে নামা ও ওঠা লাগছে। একটা হাসপাতালের লিফট কখন যে চালু থাকে আর কখন বন্ধ থাকে, তা কেউ জানে না। আবার রোগী ছাড়া আর কাউকে লিফটে উঠতে দেয় না। লিফট সামনে এলেই দেখা যায় পা রাখার জায়গা নেই। রোগীরাই জায়গা পায় না, সুস্থ মানুষ কেমনে উঠি।’
লিফট সংকটে রয়েছে লন্ডনিদের শহর খ্যাত সিলেটও। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১টি লিফট রয়েছে। এর মধ্যে নতুন ভবনের চারটি পুরোপুরি কাজ করছে। পুরনো ভবনের অর্ধেকের বেশি লিফটে সমস্যা রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভ‚ঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিফটের সমস্যার কারণে রোগীদের অনেক কষ্ট হয়। যেহেতু আমাদের বহুতল ভবন, তাই রোগীদের জন্য আরও লিফট প্রয়োজন। এখানে সেবা নিতে আসা রোগীদের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মতো অবস্থা থাকে না। আমাদের যেসব লিফটের সমস্যা তা সংস্কারের জন্য একাধিকবার চিঠি দিলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ লিফট পুরোপুরি সচল ও দুটি অচল বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তাসনীম উদ্দীন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে মাত্র দুটি লিফট; যার দুটিই ত্রæটিপূর্ণ। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা এক রোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘লিফট নষ্ট থাকায় হেঁটে চারতলায় উঠতে হয়েছে। আমি অসুস্থ মানুষ, চারতলা উঠতেই আমার সময় লেগেছে ২০ মিনিট। মনে হয়েছিল জীবন বুঝি এখানেই শেষ।’
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ১১ লিফটের ছয়টিই অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি লিফট দিয়ে রোগীসহ দর্শনার্থীরা চলাচল করছে। এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে সদরে এসেছি। এখানে এসে দেখি লিফট বন্ধ। এই রোগী নিয়ে কীভাবে ওপরে উঠব এবং কীভাবে ডাক্তার দেখাব।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাসপাতালের লিফটম্যান না থাকায় লিফট নষ্ট হয়। রোগীরা লিফট ব্যবহার করতে জানে না। লিফটম্যান থাকলে লিফট সুরক্ষিত থাকত বেশিদিন। আমরা নষ্ট লিফটের বিষয়ে পিডবিøউডিকে পত্র দিয়েছি। তারা এ বিষয়গুলো দেখে।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঁচটির মধ্যে একটি নষ্ট ও চারটি চালু রয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে দুটি অচল, চারটির মেরামতকাজ চলছে এবং নয়টি ভালো রয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাতটি লিফটের মধ্যে পাঁচটিতেই ত্রুটি রয়েছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)