রোববার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বিদেশের মাটিতে দ্যুতি ছড়ানো বাংলাদেশি আলেম

আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:২৯ এএম

দেশের আলেমদের মধ্যে দ্বীনি খেদমতে যাদের বিশেষ অবদান ও অবস্থান রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম শায়খুল হাদিস আল্লামা রফিক আহমদ। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও জ্ঞানমহিমা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ইলেম, আমল, তাকওয়া, ইখলাস, কর্মনিষ্ঠা, আলেমসুলভ ভাবগাম্ভীর্য, দায়িত্ববোধ, মহত্ত্ববোধসহ নানা চরিত্র-মাধুর্য সমৃদ্ধ করেছে এই গুণী মনীষীর জীবনধারাকে।মহান এই মনীষীকে নিয়ে লিখেছেন আবদুল আউওয়াল

একজন আলেম সাধারণত যে গুণাবলিতে অলংকৃত হন সে সবের সবগুলোই যেন একাকার হয়ে আছে আল্লামা রফিক আহমদের মধ্যে। এক জীবনে কয়েক জীবনের কাজ করা মনীষীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। আকাবিরতুল্য এই আলেমে দ্বীন একাধারে স্বনামধন্য শিক্ষক, ইমাম, খতিব, মোহতামিমসহ জীবনে নানা পদবিতে ভূষিত হয়েছেন।

এই গুণী আলেম ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার তিতাস উপজেলার (পূর্বনাম দাউদকান্দি) করিকান্দি বাজারের রহমতনগর (বন্ধরামপুর) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলভি মুহাম্মাদ আলী (রহ.) ও মাতা জুলেখা খাতুনের ৩ ছেলে এবং ২ মেয়ের মধ্যে বয়সে দ্বিতীয় তিনি। দাদা হাজি আবুল হুসাইন (রহ.) ছিলেন একজন ধর্মীয় বিদ্বান ও বুজুর্গ ব্যক্তি। এলাকায় প্রসিদ্ধ ছিলেন ‘বড় হুজুর’ নামে।

পড়ালেখার হাতেখড়ি গৃহশিক্ষক কারি সাইদুর রহমান (রহ.)-এর কাছে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন নিজ গ্রামের বোর্ডস্কুল থেকে। অতঃপর আট বছর বয়সে মামা হাফেজ মাওলানা নায়েব আলী (হামিদুল হক)-এর সঙ্গে ঢাকায় এসে জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগের মক্তব বিভাগে ভর্তি হন। এক বছরে নাজেরা (দেখে দেখে কোরআন পড়া) শেষ করে আমপারা মুখস্থ করে ভর্তি হন মাদ্রাসার হিফজ বিভাগে। হিফজ সম্পন্ন করেন ৪ বছরে। পরের বছর ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন মাদ্রাসার কিতাব বিভাগে। ১৯৬৯ সালে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে সর্বোচ্চ নম্বর (মুমতাজ) পেয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে ফারেগ হন। লালবাগের মেধাবী ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন তিনি। নাহবেমির (৭ম শ্রেণি) থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের প্রত্যেকটি পরীক্ষায় মুমতাজ পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাত্র একবার দাওরায়ে হাদিসের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় সহপাঠী মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.) তাকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

অতঃপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে পাড়ি জমান পাকিস্তানে। ভর্তি হন পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতান শহরের বিখ্যাত মাদ্রাসা খাইরুল মাদারিসে। এক বছরের মধ্যেই ‘ফুনুনাত’ (শাস্ত্রীয় সম্পূরক বিষয়াদি) সম্পন্ন করেন। সেখানে তার বিশেষ ওস্তাদ হিসেবে ছিলেন ব্রিটিশ আমলে দারুল উলুম দেওবন্দে ‘মাকুলাত’ ও ‘মানতেক’ পড়ানো শিক্ষক হজরত শরিফ বাকি কাশ্মিরি (রহ.)। সেখানে তিনি মুফতি আবদুস সাত্তার (রহ.)-এর কাছে ‘তাখাসসুস ফিল ইফতা’ সম্পন্ন করেন। এরপর দেশে ফিরে ১৯৭০ সালে মক্কায় গিয়ে পবিত্র হজব্রত পালন করেন। ১৯৯৩ সালে (বায়তুল মোকাররমের ইমাম হওয়ার সুবাদে) সম্পূর্ণ সরকারি খরচে মিসর গিয়ে ‘তাদরিবুল আইম্মাহ ওয়াল বুয়াস’-এর তিন মাসের একটি কোর্সও সম্পন্ন করে আসেন।

তিনি জীবনে সোহবত পেয়েছেন অনেক বড় বড় মনীষীর। তার ওস্তাদদের তালিকায় আছেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ মুহাদ্দিস সাহেব (রহ.), শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক (রহ.), মুফতি আবদুল মুয়িস (রহ.), মাওলানা সালাহ উদ্দিন (রহ.) ও মাওলানা আব্দুল মজিদ ঢাকুবী (রহ.)-সহ যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ওলামায়ে কেরাম।

তার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল প্রথমে ফরিদপুরী (রহ.)-এর সঙ্গে। এরপর বায়াত হন শায়খুল ইসলাম মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.)-এর হাতে। তিনি তাকে সোপর্দ করেন হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.)-এর কাছে। মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বার বায়াত হন তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা ইনআমুল হাসান (রহ.)-এর কাছে। তার ইন্তেকালের পর শেষবারের মতো বায়াত হন মহিউস সুন্নাহ মাওলানা শাহ আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে। তিনি তাকে খেলাফতও (অধ্যাত্মবাদ প্রচারের বিশেষ অনুমতি) প্রদান করেন।

সংসার জীবনে তিনি ৪ ছেলের জনক। সবাই আলেম হয়েছেন। বড় ছেলে মাওলানা মাহফুজুর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমাম-খতিব। মেজ ছেলে হাফেজ মাওলানা মাহমুদুর রহমান আমেরিকান নাগরিক ও মাদ্রাসা পরিচালক। সেজো ছেলে হাফেজ মাওলানা মুফতি ইবাদুর রহমান জামিয়া দারুল উলুম মতিঝিল-এর ভাইস প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস। ছোট ছেলে মাওলানা মাসউদুর রহমান।

বর্তমানে তিনি জামিয়া দারুল উলুম মতিঝিলের সম্মানিত প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস। মতিঝিল ওয়াকফ এস্টেট মসজিদের খতিবও তিনি। একই সঙ্গে ২০২০ সাল থেকে তিনি আমেরিকার নিউ ইয়র্কে অবস্থিত দারুল উলুম নামে একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সেখানে বুখারি শরিফের দরস দিচ্ছেন ২০০০ সাল থেকে। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় সেখানে অবস্থান করে পাঠদান করে থাকেন। বিশেষ করে রমজান মাসে তারাবির নামাজ ও কোরআনের তাফসির পেশ করতে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতি বছর আমেরিকায় পাড়ি জমান। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে ধর্মের বাণী প্রচার করেন। মানুষকে ইসলামের পথে আনার দাওয়াত দেন। বলা যায়, আমেরিকার মাটিতে দ্যুতি ছড়ানো আলেম তিনি।

এই প্রথিতযশা আলেমে দ্বীন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমামের দায়িত্বেও ছিলেন দীর্ঘ ১৮ বছর (১৯৮৮-২০০৬ পর্যন্ত)। খতিব উবায়দুল হক (রহ.)-এর অনুপস্থিতিতে জুমার নামাজও তিনি পড়াতেন। এশার নামাজের পর নিয়মিত মুসল্লিদের সামনে তাফসির পেশ করতেন। ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (১৯৯৩-২০০২) সম্পাদনা পরিষদের অন্যতম সদস্যও। সে সময় তাফসিরে মারেফুল কোরআন, ফাতওয়া ও মাসায়েল, তাজরিদুস সিহাহ ও ইসলামি বিশ্ব কোষের মতো উল্লেখযোগ্য কিতাবাদিও সম্পাদনা করেন। পি.সি. কালচার জামে মসজিদ মোহাম্মাদপুরে (১৯৯৭-২০০২) খতিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৭০ সালে মাদরাসায়ে নুরিয়া কামরাঙ্গীচরে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। সেখানে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খেদমত করেন। এরপর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় কিছুদিন খেদমত করেন। ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে ঢাকার বিখ্যাত মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া (যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসায়) চলে আসেন। সেখানে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে ৩৭ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বুখারি শরিফসহ অন্য কিতাবাদির পাঠদান করেন। যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় অধ্যাপনার পাশাপাশি ঢাকার আরেক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগরে ১৯৯৬ সাল থেকে অদ্যাবধি বুখারি শরিফের দরস দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে জামিয়া দারুল উলুম মতিঝিলেও ১৯৯৫ সাল থেকে বুখারি শরিফ পড়াচ্ছেন। দীর্ঘ এই সময়ে হাজার হাজার আলেম তিনি তৈরি করেছেন। দেশ-বিদেশে তার হাজার হাজার ছাত্র, ভক্ত ও মুরিদান রয়েছে।

তাকে নিয়ে ছাত্রদের উক্তি হলো, তিনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। কথা বলেন কম। বাড়তি কথা একদমই বলেন না। খোশগল্প বা রসিকতা না করে ওজনি কথা বলেন সবসময়। পড়ান ধীরগতিতে। ইলমি আলোচনায় কথা বলতে বলতে চলে যান গভীর থেকে গভীরে। প্রতিদিনই তার থেকে পাওয়া যায় নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা। জটিল-কঠিন বলে তার কাছে কোনো কিতাব নেই। সব কিতাবই পড়ান সমানতালে। তাফসিরে বায়জাবির মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ কিতাবও খুব সহজে বুঝিয়ে দেন ছাত্রদের। দীর্ঘদিন ধরে বুখারি শরিফ পড়াতে পড়াতে এখন কিতাবটির সব বিষয় যেন তার নখদর্পণে। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত এই মনীষী এখনো ক্লান্ত নন। দেশ-বিদেশে পাঠদান করে যাচ্ছেন ফুরফুরে মেজাজে। আজীবন থাকতে চান ছাত্রদের ভিড়ে। দিতে চান হাদিসের পাঠ। বলতে চান ‘কালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!’

৭৮ বছরের বয়োবৃদ্ধ এই আলেম প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে খতমে তারাবিহ পড়াচ্ছেন। কোরআনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কাবার জিয়ারতে ২০০২ সাল থেকে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। হাজার হাজার ছাত্র ও ভক্তের ভালোবাসায় প্রতিনিয়ত সিক্ত হচ্ছেন। আলেমসুলভ শান-শওকত নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন। আল্লাহতায়ালা তার হায়াতে বরকত দান করুন। আরও দীর্ঘদিন তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থেকে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যান। আমিন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত