সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

নির্বাচনী প্রস্তুতির নির্দেশনা যাবে তৃণমূলে

  • তিন দশক পর বিএনপির বর্ধিত সভা ২৭ ফেব্রুয়ারি
  • উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা
  • তৃণমূলের মতামত শুনবেন কেন্দ্রীয় নেতারা
  • তৃণমূলের প্রত্যাশা পূরণের সভা: রিজভী
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩২ এএম

প্রায় তিন দশক পর বর্ধিত সভা ডেকেছে বিএনপি। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এই সভা হবে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে সাংগঠনিক মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই সভাকে। সভা ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যেও কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।

চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র অথবা সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এই বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে। সভায় ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রার্থীরা এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও থাকবেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূলের মতামত শুনবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দেবেন বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা। ওই নির্দেশনায় আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দলকে সংগঠিত করাসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। যাতে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে দলের বার্তা পৌঁছানো যায়। দলের ৭ম কাউন্সিল অনুষ্ঠানে সম্ভাব্যতা যাচাইও উঠে আসতে পারে সভায়।

দলের নেতারা জানান, এর আগে বিএনপি কাউন্সিল বা নির্বাহী কমিটির সভা করলেও ১৯৯০ সালের পর প্রথমবার এই সভা হচ্ছে। এটাকে এক ধরনের মূল্যায়ন সভাও বলা যেতে পারে।

দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তাদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এই বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে। কাউন্সিলের মতো বড় ধরনের কর্মযজ্ঞে যাওয়া যায় কি-না সভায় সে বিষয়ে মতামত চাইবে কেন্দ্র। একই সঙ্গে দলের সাংগঠনিক ও নির্বাচনী মাঠের অবস্থাও বোঝার চেষ্টা করবে বিএনপি। সেই আলোকে তৃণমূল নেতাদের দিক নির্দেশনা দেওয়া হবে।

জানা গেছে, গত বুধবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বর্ধিত সভার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এবং জেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, থানা-উপজেলা-পৌর কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা বর্ধিত সভায় থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিএনপি ছাড়া ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাও সেখানে থাকবেন। বাড়তি হিসেবে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল, তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে এক সঙ্গে এক জায়গায় বসে সভা করার। সেই প্রত্যাশা পূরণে এবং একটি মহাআন্দোলন শেষে আমরা এই বর্ধিত সভা করতে যাচ্ছি।’

দীর্ঘদিন বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না, বর্ধিত সভাটি কাউন্সিলের বিকল্প কি না জানতে চাইলে রিজভী বলেন, ‘না, বর্ধিত সভাটি কাউন্সিলের বিকল্প নয়। যে কোনো আন্দোলনের শেষে, নির্বাচনের শেষে অথবা প্রারম্ভে একটা মতামত জানার জন্য, বর্তমান তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা কী ভাবছেন, তৃণমূলের ভাবনা চিন্তাগুলো জাতীয় নেতারা শুনবেন, অবহিত হবেন, এই কারণে বরাবরই বর্ধিত সভা হয়ে থাকে। সেই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে এই বর্ধিত সভা হতে যাচ্ছে।’ তবে যারা ইতোমধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তারা এই বর্ধিত সভায় অংশ নিতে পারবেন না। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘সাধারণত দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন, গণঅভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর এই ধরনের সভা ডাকা হয়। ১৯৯০ সালের পর প্রথমবারের মতো এই বৈঠক হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই বৈঠকের তাৎপর্য রয়েছে।’

জানতে চাইলে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র অথবা সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এই বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে। ভেন্যু পাওয়া সাপেক্ষে স্থান নির্ধারণ হবে।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, ‘বর্ধিত সভাকে ঘিরে দলের মধ্যে এক ধরনের কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের ভাবনা তুলে ধরতে উন্মুখ হয়ে আছেন। অনেক দিন পর এই সভায় তৃণমূল তাদের ভাবনা তুলে ধরার পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পাবে।’

নবগঠিত মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য শহীদুল ইসলাম মৃধা জানান, ‘আগামী দিনে দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দিক নির্দেশনা এই সভা থেকে পাওয়া যাবে বলে আমরা ধারণা করছি। একই সঙ্গে দল ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তৃণমূলের যে ভাবনা সেটিও কেন্দ্র জানতে পারবে। যার আলোকে তৃণমূলে দলের বার্তা যাবে।’

এর আগে বড় পরিসরে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দলের সকল স্তরের নেতাকর্মী নিয়ে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা করেছিল বিএনপি। রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে তখন গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্যেই দলটির নির্বাহী কমিটির প্রায় ৮০ ভাগ সদস্য উপস্থিত হয়েছিলেন। ওই সভায় নেতাদের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকা এবং বিএনপির পতাকাতলে থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর চার দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের একটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাবস্থায় ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরে কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে তারা।

তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো সময়মতো কাউন্সিল করতে পারেনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলীয় গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর সম্মেলন করার কথা বলা হয়েছে। সেটি করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল হওয়ার পর প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে কাউন্সিলের বিকল্প হিসেবে দলটি বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা করেছে।

বিএনপির বিগত কাউন্সিলগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক পথ-মতের অনুসারীদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা বটমূলের খোলা চত্বরে প্রথম সম্মেলনে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী হন প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব। দলটির দ্বিতীয় কাউন্সিল হয় চার বছর পর ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর)। সেই কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব হন যথাক্রমে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সাত বছর পর ১৯৮৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির তৃতীয় কাউন্সিল। ওই কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং সালাম তালুকদার মহাসচিব হন।

চার বছর বিরতি দিয়ে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে চতুর্থ কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া মহাসচিব হন। এর দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলটির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সূত্রগুলো বলছে, বর্ধিত সভায় অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে দলের সর্বশেষ সাংগঠনিক অবস্থাও মূল্যায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে যেসব জেলায় কমিটি নেই, সেখানে কেন কমিটি করা যাচ্ছে না, কমিটি হয়েছে সেখানে কেন পূর্ণাঙ্গ করা হচ্ছে না এসব বিষয়ে তৃণমূল নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরবেন।

ইতোমধ্যে মেহেরপুর, নাটোর, সাতক্ষীরা, বান্দরবান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ও মেহেরপুরে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। দলটির বেশ কয়েকটি জেলার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে, কিছু হবে। যেমন ২২ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলা বিএনপির কাউন্সিল, ২৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগর বিএনপির সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। বর্ধিত সভার আগে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে।

সংসদ ভবনের এলডি হলে বিএনপির বর্ধিত সভা হবে

জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলসহ মাঠ প্রাঙ্গণে দলের বর্ধিত সভার স্থান চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠি বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণকারী নেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপির দপ্তর।

এই চিঠিতে বলা হয়েছে যে, আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিএনপির বর্ধিত সভায় রাজধানীর পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবের আওতাধীন এলডিহল সহ মাঠে সকাল ১০টায় থেকে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয় থেকে নেতাদের কার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।

আমন্ত্রিত অতিথি যারা বর্ধিত সভায় অংশ গ্রহণ করবেন তাদের নাম ও পদবিসহ এক কপি স্ট্যাস্প সাইজ ছবি আগামী ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বিএনপি।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির বর্ধিত সভাটি হয়েছিল রাজধানীর ‘লো মেরিডিয়ান’ হোটেলের মিলনায়তনে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দলের বর্ধিত সভার স্থান চূড়ান্ত হয়েছে। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের নেতৃত্বে বাস্তবায়ন কমিটি এই সভা অনুষ্ঠানের সবকিছু করছেন।

বিএনপির বর্ধিত সভায় জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সব কর্মকর্তা ও সদস্যরা, মহানগর ও জেলার সব থানা, উপজেলা, পৌর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা থাকবেন।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য যারা দলীয় চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং মনোনয়নের জন্য প্রাথমিক চিঠি পেয়েছিলেন তারাও বর্ধিত সভায় উপস্থিত থাকবেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত