সরকারি কেনাকাটায় বিশ্বের সব দেশে কমবেশি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ হলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে ৫ শতাংশ ঠিকাদার। আর তাদের এভাবে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিকে। সরকারের শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে ৬১ শতাংশ কাজ নিয়ে যাচ্ছে ৫ শতাংশ ঠিকাদার। ফলে সরকারি প্রকল্পের ক্রয়ে ২৭ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে।
এমন বিশ্লেষণ দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থাটির নিজস্ব কার্যালয়ে বাংলাদেশে সরকারি ই-কেনাকাটায় বাজার দখল, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালে ই-জিপি চালুর পর থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ অনুমোদিত চুক্তির মূল্য ছিল ৮৮১ কোটি টাকা। তবে এর চেয়ে বড় চুক্তিগুলো এখনো এ প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারি টেন্ডারে প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে ওঠার কথা থাকলেও তা গড়ে ওঠেনি। উল্টো মন্ত্রণালয়গুলোতে ঠিকাদারদের অসম প্রতিযোগিতার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। এতে সরকারি প্রকল্পগুলোর ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ কাজের চলে গেছে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের হাতে। এর মধ্যে ১ শতাংশের কম বাজার দখলে আছে ১০ শতাংশ ঠিকাদারদের দখলে।
টিআইবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১০ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মোট প্রকল্পের ৭৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ৫ শতাংশ ঠিকাদার। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়টির ৬৮ শতাংশ কাজ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের দখলে। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মোট প্রকল্পমূল্যের সাড়ে ৯১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ৯ শতাংশ ঠিকাদার এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি) ৬২ শতাংশ কাজের নিয়ন্ত্রণ ১০ শতাংশ ঠিকাদারের।
সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি ক্রয় খাত সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। তবে বেশিরভাগ দেশেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণ না হয়ে বরং এটি আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায় সেটির একটি চিত্র উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয় প্রায় ৯২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে। এই ১০টি মন্ত্রণালয়ের গড়ে ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী প্রকল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে যাচ্ছে, যা সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা হ্রাস করছে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার বা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে ঠিকাদারদের হাত বদল হয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ একই থেকে যায়। সার্বিকভাবে সরকারি ক্রয় খাত একটি জিম্মি অবস্থায় রয়েছে।
অন্যদিকে ঠিকাদারদের আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে সিটি করপোরেশন ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে, যা টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, মেয়র পরিবর্তনের ফলে সিটি করপোরেশন পর্যায়ের ঠিকাদারদের তালিকায় বড় পরিবর্তন হয়েছে। কোনো কোনো সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার তালিকায় দুয়েকজনের মিল পাওয়া গেলেও অধিকাংশ করপোরেশনের তালিকাতেই পুরোপুরি পরিবর্তন দেখা গেছে।
টিআইবি বলছে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং প্রকৃত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। তাদের মতে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, বাজার শেয়ার সীমিতকরণ এবং প্রকৃত মালিকানার তথ্য উন্মুক্ত করা হলে ঠিকাদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দুর্বল ও সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রকল্পের কেনাকাটায় দুর্নীতি প্রতিরোধে গবেষণা প্রতিবেদনে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারি ই-কেনাকাটা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) জন্য এসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে যুগ্ম উদ্যোগ (জেভি) ফার্মগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যালোচনা করা এবং স্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও বাজার দখলের প্রবণতা রোধ করা; একক ঠিকাদার সক্ষম হলে জেভি সীমিত করা। এ ক্ষেত্রে যে ঠিকাদার এককভাবে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, তাকে জেভি গঠনের অনুমতি না দেওয়া; বাজার দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ বিষয়ে ঠিকাদারদের জন্য বাজার শেয়ারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মানের নিয়মনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; প্রকৃত মালিকানার তথ্য প্রকাশ করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সংশোধন করে সব কোম্পানি ও জেভির প্রকৃত মালিকানা তথ্য উন্মুক্ত করা এবং উচ্চমূল্যের চুক্তি ই-প্রকিউরমেন্টের আওতায় আনা।