তারুণ্য শক্তির রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ ঘটে ২৮ ফেব্রুয়ারি। দুই সপ্তাহ না পেরোতেই দলটি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দলের নিবন্ধনের জন্য ঈদের পর নির্বাচন কমিশনে আবেদন করবে এনসিপি। ভোটে দলীয় প্রতীকও চূড়ান্ত করা হবে দলীয় ফোরামে ফয়সালা করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি ইতিমধ্যেই দুই দফায় ২১৬ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে। তবে এ কমিটি আরও বর্ধিত করা হবে। তাছাড়া জাতীয় নাগরিক কমিটির ৪৩০-এর অধিক জেলা-উপজেলা কমিটি বিদ্যমান রয়েছে। কমিটিগুলো এনসিপির কমিটি হিসেবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে কেউ যোগ দিতে চাইলে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। গত ৪ মার্চ সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং রায়েরবাজারে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি পালন শুরু করে এনসিপি। এরপর নিয়মিত দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
নিবন্ধনের যত শর্ত : কোনো দল দলীয় প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে প্রথমে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯০ ‘ক’ ধারা অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে চাইলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে।
১. স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসনে বিজয়।
২. সেসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন, সেসব আসনে মোট ভোটের ৫ শতাংশ অর্জন।
৩. একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস। দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় জেলা অফিস। আর অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার থানায় অফিস থাকবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ জন ভোটার থাকবে।
এসব ছাড়াও নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলটির গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য (২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ করতে হবে) সহ আরও কিছু বিধান রাখার শর্ত রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে নিবন্ধন পেতে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য কিছু শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব হলোÑ নিবন্ধন পেতে ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ উপজেলা বা থানায় দলের অফিস এবং দলটির কমপক্ষে পাঁচ হাজার সদস্য থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনীতিতে নতুন হওয়ায় এতগুলো জেলা, এতগুলো উপজেলায় অফিস করা তো একটু কষ্টকর, কঠিন ব্যাপার। আসলে রাজনৈতিক দল বেশি আসুক, নতুন নতুন কার্যক্রম করুক, এটাকেই উৎসাহিত করার জন্য মূলত শর্তটাকে শিথিল করার সুপারিশ হয়েছে। রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন পেতে হলে অবশ্যই তিন বছর দলের সদস্য হতে হবে। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু তারা নতুন।
এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা, না করা নিয়ে এনসিপিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে নতুন রাজনৈতিক দলটির নেতারা সেভাবে কিছু বলতে না চাইলেও কেউ কেউ জামায়াতের সঙ্গে জোট না করার পক্ষে। দলটি ইতিমধ্যে কাদের মনোনয়ন দেবে বা কারা নির্বাচনে অংশ নেবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো এ নিয়ে বৈঠক করেনি দলটি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আপাতত দলটি মনোযোগী হচ্ছে জনসমর্থন আদায়ে। দেশব্যাপী মানুষের দুর্ভোগ কমানো, শান্তি নিশ্চিত ও মানুষের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে ওপরমহল। দল গুছিয়ে আনতে পারলে এবং মাঠপর্যায়ে ভোটব্যাংক ‘দখল’ করতে পারলে আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে যাচ্ছে দলটি। তবে নিজেদের তৃণমূল পর্যায়কে শক্তিশালী করতে না পারলে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোটে আসবে দলটি।
এনসিপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, যেহেতু নতুন দল, কিছুটা সময় লাগবে। দল গোছানো হয়ে গেলে সব আসনেই ভোটের মাঠে নামার প্রস্তুতি নেব। আপাতত দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তার ও মনোনয়ন নিশ্চিত করাই লক্ষ্য।
এদিকে দলের আত্মপ্রকাশ হলেও এখনো দলীয় প্রতীক কী হবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি। তবে দল গঠনের আগে ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ শীর্ষক পরিচালিত জনমত জরিপে দলের জন্য বেশকিছু প্রতীকের প্রস্তাব এসেছে। সেগুলোর মধ্যে আছে বই, খাতা, কলম, মুষ্টিবদ্ধ হাত, কবুতর, শাপলা, ইলিশ, বাঘ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্য থেকে একটি প্রতীক চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি দলের নেতারা।
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা এখন দলীয় সক্রিয়তার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। দলের মনোনয়নের দিকে আমাদের নজর বেশি। আমাদের প্ল্যান আছে ঈদের পরপরই যেন আমরা দলীয় মনোনয়নের সব ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করতে পারি। সে অনুযায়ী জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি দেওয়ার কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তবে দলের মনোনয়নই মূল চিন্তা না বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। বরং আপাতত দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তার এবং দলকে আরও সুশৃঙ্খল করাটাই তাদের মূল চ্যালেঞ্জ বলেও জানান তিনি।
দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, আমরা দলের কাঠামো বিস্তারে কাজ করছি। মনোনয়ন বিষয়টি নির্বাচন এলে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। কিন্তু আপাতত আমরা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ দেখতে পারছি না। নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সুস্থিরতা প্রয়োজন। আমরা শঙ্কিত। বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন দিলে মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত করা ছাড়া সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার কিছু হবে না।
আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দল আত্মপ্রকাশের পর আমরা এখন নিবন্ধনের শর্তাবলির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছি। সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছি। রোজার পর এগুলো পুরোদমে চলবে। এরপর নির্বাচন নিয়ে আমরা ভাবব।